অশ্রুবন্দি পর্ব-১৯+২০

0
23

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৯

ইজহানের হাইপারটেনশনের সমস্যা আছে। অবশ্য থাকবে না-ই বা কেন! যে লোক সারাদিন বউকে নিয়ে অতিরিক্ত ও উদ্ভট চিন্তা করে, সন্দেহ করে, ধূমপান করে, অ্যালকোহল পান করে তার রক্তচাপের সমস্যা থাকা অস্বাভাবিক না, বরং স্বাভাবিকই। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই কেমন কেমন করছিল ইজহান, সন্দেহপ্রবণ হয়ে ইস্মি স্ফিগমোম্যানোমিটারটা দিয়ে চেক করে দেখল প্রেসার ১৩০-১৩৯ এ উঠানামা করছে। দেখেই আঁৎকে উঠেছিল সে। ইজহান বোকাসোকা চেহারা বানিয়ে এমনভাবে তাকাল ইস্মির দিকে, যেন এতে তার কোনো দোষই নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইস্মি, চোখের জল অতিকষ্টে আটকায়। ধীরস্বরে বলে,

“আপনি আমাকে মে’রে ফেলেন, এরপর শান্তি হোন। আমি না মরলে আপনি শান্তি পাবেন না, সত্যি বলছি…”

ইজহান বউয়ের কথা শুনে মিইয়ে যায়। সে বলার কিছু খুঁজে পায় না। অবশ্য কী বলবে? কীভাবে বলবে, যে গতরাতে তার স্বপ্নে ইস্মি বউ সেজে একটা সুন্দর দেখতে লোককে বিয়ে করেছে আর স্বপ্নটা সারারাত তাড়িয়ে মেরেছে তাকে, ঘুমাতে দেয়নি ভালোভাবে! ওসব বলবে
সে? ইজহান আমতাআমতা করে এই প্রথম,

“বউ কাঁদো কেন?”

ইস্মির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়,

“আমি কি রোবট? আপনি মজা করছেন আমার সঙ্গে? না আপনি আমায় শাস্তি দিতে এইসব করেন? এই বয়সে কীসের এত টেনশন আপনার? কীসের এত ভাবনা? আমাকে নিয়েই তো যতসব আজেবাজে সন্দেহ! দোষ যখন আমার তো নিন, আমাকে মেরে এরপর যা খুশি করুন, মরতে চাইলে মরুন…”

ইজহান চুপ মেরে থাকে। ইস্মি কাঁদছে, তবে যথাসম্ভব নীরবে। বুঝতে দিতে চাইছে না! কাঁদতে কাঁদতেই সে ঔষধের বক্স খুঁজছে, ফোনে পরামর্শ নিচ্ছে ডাক্তারের। প্রেসার যদিও অতোটা গুরুতর পর্যায়ে যায়নি, তবুও বউয়ের আকুলতা ইজহানকে মুগ্ধ করে, প্রশান্তি দেয়। সে একদৃষ্টিতে বিছানায় শুয়ে চেয়ে থাকে ইস্মির ভেজা মুখপানে। ইচ্ছে করে ঐ চকচক করা গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সকাল-বিকাল করে দিতে। ইজহান আনমনে বলে,

“তোর চোখের তারায় আমার পুরো পৃথিবী বন্দি বউ!”

ডাক্তার একটা ঔষধ চেঞ্জ করে দিয়েছে। ইস্মি ফোনে পরামর্শ নেওয়া শেষ করে ইজহানের কাছে এসে বলল,

“শুয়ে থাকুন, আমি নিচে যাই। মকবুলকে ঔষধ আনাতে পাঠাচ্ছি। উঠবেন না।”

ইস্মি ভারমুখে কথাগুলো বলে উঠে গেল। দরজায় গিয়ে আরেকবার ফিরে এলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“আমার আয়ু সব আপনার হোক।”

ইস্মি পার্স থেকে টাকা বের করে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল৷ ইজহান সেদিকে তাকিয়ে রয়। মেয়েমানুষের কত রুপ! এই ভালো, এই খারাপ। এই প্রেম প্রেম করছে, এই ছ্যাঁকা দিচ্ছে। এই ভালোবাসছে তো এক্ষণি মরণ চাইছে। ইজহান ঠোঁট কামড়ে ভাবিনায় মগ্ন হয়। তার সব এখন ইস্মিতাকে ঘিরে, তার বেঁচে থাকাটুকুও! অথচ বয়ঃসন্ধিতে একজনের জন্য পাগল ছিল সে, চারটে বছর আগলে রেখেছিল, কুকুরের মতো ভালোবসেছিল। অথচ সেই নাগিনী তার বিশ্বাস ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তাকে ছ্যাঁকা দিয়ে, তার সবকিছু নিয়ে তাকে শূন্য করে, তাকে নিঃশেষ করে দিয়ে তার ভাইকে চেয়েছিল! ছ্যাহ! ঐ হাবলির জন্য সে কি-না সু’ই’সাইড করতে গিয়েছিল, ধিক্কার! ইজহান নিজেকেই গালি দেয় অতীতে কলেজ লাইফে করা নিজের কাণ্ডগুলোর কথা মনে করে! সে জানে ইস্মি তাকে কতো ভালোবাসে। তবুও তার ভয় হয়, বড্ড ভয়! ছেড়ে যাওয়ার ভয়। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইস্মি যদিও বলে গেছে শুয়ে থাকতে কিন্তু ধৈর্য পেল না। ফ্রেশ হওয়ার জন্য উঠল। চোখেমুখে পানি দিয়ে এসে ভেজা তোয়ালেটা বিছানায়
ছুঁড়ে ব্রাশ হাতে নিলো। এরপর বারান্দায় গিয়ে আয়েশ করে বসল! সকালবেলা হাওয়া গায়ে মেখে দাঁত ব্রাশ করা ইজহানের ছোটবেলার অভ্যাস। তখনি তার চোখ পড়ল নিচে, গেইটের দিকে। ব্রাশ করা থামিয়ে সে হা হয়ে তাকিয়ে রইল। চক্ষুকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে, ইহসানটা এতটাই ভেড়া হয়েছে যে এখন বাড়ির বাইরেও রঙঢঙ শুরু করেছে? বউ কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? ইজহান বিস্মিত, থমকিত নয়ন মেলে দেখল। দারুণ, প্যাশনেট ভাইব দিচ্ছে দৃশ্যটা কিন্তু সে ঈর্ষান্বিত হলো। হাহ! ভেড়াটা নিজেকে খুব রোমান্টিক ভাবছে! কিন্তু মোটে ওকে রোমান্টিক লাগছে না। এর থেকে সুন্দর, ভালোভাবে সে ইস্মিকে কোলে নেয়, তবে বাইরে সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায় না। যা করে বাড়ির ভেতরেই করে, ঘরে করে। ইজহান ষদ্দৃষ্টি ছুঁড়ে মনে মনে গালি ছুঁড়ল!

ইস্মিতা জানতো ইজহান কথা শোনার লোক নয়।
সে মকবুলকে টাকা দিয়ে ডিসপেনসারিতে পাঠিয়ে ঘরে এসে দেখল সত্যিই ইজহান ব্রাশ হাতে বারান্দায় বসা। ক্ষুদ্ধ, বিরক্ত হলো সে, কিন্তু কথা বাড়াল না। ইজহানের খারাপ অভ্যাসের অনেক গুণ অনেক আছে। তার মধ্যে একটি হলো ভেজা তোয়ালে বিছানায় ফেলে রাখা। পদশব্দ কানে আসায় টুপ করে ইজহান ঘোর থেকে বেরিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজাটা আটকে দিলো। ইস্মি ভেজা তোয়ালে শুকাতে দেওয়ার জন্য বারান্দায় যাবে, কিন্তু দরজার সামনে খাম্বার মতো ইজহানকে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে অবাক হয়ে বলল,

“কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বারান্দায় যাব, সরুন।”

ইজহান ব্রাশ হাতে নিতে দু’পাশে, দু’হাত দিয়ে পথ আটকে বলল,

“উহু, যাওয়া যাবে না।”

বিস্মিত ইস্মি জোরালো কণ্ঠে বলল,

“আশ্চর্য! আমি তোয়ালে শুকাতে দেব। আপনি গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকুন। সরুন…”

ইজহান তেঁতে উঠল,

“সরব না, বললাম তো যাওয়া যাবে না।”

ইস্মি হতাশ গলায় শুধাল,

“আচ্ছা যাব না। কিন্তু কারণ কী?”

উত্তর না দিয়ে ইজহান ব্রাশ হাতে চট করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। দু’মিনিট পর মুখ ধুয়ে বেরুল। ইস্মি হাতের তোয়ালে দিয়েই ওর মুখ মুছিয়ে দিলো। এরপর স্ট্যান্ডে তোয়ালেটা ছড়িয়ে দিতে যেই না পেছন ঘুরে দাঁড়াল তখনি ইজহান কিছু একটা ভাবল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইস্মির পিঠের দিকে খানিকটা ঝুঁকল। এরপর দুই হাত দিয়ে কোমড়ের কাছে আলতোভাবে ধরল। এরপর আচমকা হুট করেই
ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। ইজহানের গলা জড়িয়ে ভয়ে ইস্মি চেঁচিয়ে উঠল,

“আল্লাহ আপনার শরীর ভালো না, নামান আমাকে। এসব কী পাগলামি শুরু করেছেন? পড়ে যাবেন আপনি! নামান বলছি…”

ইজহান ওকে বিকট ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট কামড়ে আয়নায় ভালোভাবে দেখতে দেখতে
সে বলল,

“আমারটাই বেস্ট….”

ইস্মি আগামাথা কিছুই বুঝল না।

______

মিতু একটা প্লেটে ড্রাগন ফ্রুট সাজিয়ে কালনা’গিনী সৃজা আর ইহসান যে বাড়ি ফিরেছে, সেই খবরটা বোনকে দিতে ঘরে এসেছিল। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে দেখল লিথু ঘরে নেই। বোনের অনুপস্থিতি দেখে কিছুটা হতাশ হলো সে। লিথু কোথায় গেল, সেটা বুঝতে না পেরে বাটিটা টেবিলের উপর রেখে বেরোতে নেবে, তখনি দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় লিথু। মুখ অন্ধকার, চুলের গোছা এলোমেলো।

“কী হয়েছে তোর? এমন মুখ বানিয়ে রেখেছিস কেন?”

লিথু কোনো উত্তর দিল না। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসল তেজ নিয়ে। মিতু কিছুই বুঝল না। সে উত্তেজিত ভঙ্গিতে দরজা চাপিয়ে এসে বোনের পাশে বসল। নিজের মতো রসিয়ে রসিয়ে বলল,

“যাকগে কোথায় গেছিলি জেনে আর কাজ নেই,
তোকে একটা খবর দিতে এসেছি। খবর শোন…”

লিথু কাঁপা কণ্ঠে বলল,

“কী খবর আনলে?”

মিতু উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল,

“খবর তো দারুণ! ইহসান শেখ আর তার ন্যাকা বউ ফিরে এসেছে। জানিস, কী নাটকীয় দৃশ্য দেখলাম? ভাইয়া বউকে কোলে নিয়ে সোজা ঘরে উঠে গেল। যেন দুনিয়ায় আমরা কেউ নেই!”

ব্যাঙ্গ করে বলল মিতু। বলামাত্রই আচমকা
লিথুর মুখ কুঁচকে গেল। গলার স্বর আগুনের মতো জ্বলে উঠল নিজের চুল শক্ত করে ধরে মিতুকে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল,

“কী জাদু করেছে ওরে ঐ সাপিনী? যে কোলে নিয়া নিয়া ঘুরঘুর করে, পা মাটিতে রাখতে দেয় না? আমার কিন্তু সহ্য হইতেছে না আর আপা! ইহসান ক্যামনে ঐ মাইয়ারে এত ভালোবাসে?”

মিতু প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই তাচ্ছিল্য করে,

“নাটক করে বুঝছিস, আমাগো জামাই যেন ভালোবাসে না আরকি… যত্তসব ঢঙ, গা জ্বলে।”

লিথু ক্ষোভে ফেটে পড়ল,

“তাইলে আমার কেমন লাগে বুঝ! এত দিন ধইরা তোমাদের আশায় চুপচাপ ছিলাম, কিছুই করি নাই।তিল তিল করে ধৈর্য জমাই যাচ্ছি, কী লাভ হচ্ছে, চোখের সামনে রঙঢঙ দেখা ছাড়া? মরিয়া হইয়া যারে চাইতেসি সে কিনা তার সব ভালোবাসা ওই সৃজার জন্য ঢেলে দিচ্ছে! আমার চেয়েও কী এমন বেশি আছে হারামজাদির মাঝে?”

লিথুর চোখের কোণে ক্রোধের জল জমে। মিতু ওকে সামলানোর জন্য এগিয়ে যায়। যদিও ছোট বোনটার মেজাজের জন্য লিথুকে সে খানিকটা ভয় পায়, তবে বেশ আদরেও রাখে। বোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে,

“আহা! এত রাগ করছিস কেন? রঙ্গলীলা করছে, করুক, পুরুষমানুষ হুঁশ হারায় মেয়ে দেখলে, সেখানে ঐ নাগিনী তো ভাইয়ার বউ হয়! তুই ওভার রিয়্যাক্ট করিস না, আব্বা তো শ্বশুরমশাইকে চাপ দিতেছেই…”

লিথু অগ্নিচোখে তাকায়,

“এক ডায়লগ আর কত? আব্বা খালি চাপই দিয়ে যাইব, ঐ বুইড়া কিছু করছে আদৌ? এক কাজ করো তোমরা আমারে কবরে পাঠাই দেও, তাইলে আর কিছু করতে হইব না… একটা মানুষের বউ হইতে চাইতেসি কবে থেইকা, অথচ এতদিনেও তোমরা দিতে পারলা না আপা…”

ক্রোধে ফুঁসে উঠে লিথু। মিতু আর কিছু বলার সাহস পায় না। তার খারাপ লাগে বোনের কান্না দেখে।
ইচ্ছে করে সৃজাকে ঘাড় ধাক্কা দিতে বের করে দিতে ইহসানের জীবন থেকে, নয়তো মেরে ফেলতে। তার বোনটাকে ওরা কতটা কষ্টে রেখেছে! আজিজ শেখ আশা দিয়েও তেমন কিছুই করছে না। বাবাকে জানাতে হবে এসব! মিতু বোনকে সান্ত্বনার বাণী দিয়ে উঠে নিজের ঘরে যায়। এদিকে লিথু ভেঙে পড়ে কান্নায়, ফিসফিস করে বলে,

“তোমারে আমি এমন করে পাইতে চাই নাই, ইহসান শেখ। কিন্তু তুমি আমারে পাইতে বাধ্য করবা। হুঁ, তোমার বউকে সরাতে হলে সরাব! আমি যা চাই, তা সবসময় পাই, এবারও পাব। না পাইলে কাউরে শান্তি দিই না, তোমারেও দিব না…”

______

সৃজাকে পাঁজাকোলে নিয়ে বাড়ি ঢুকেছে ইহসান, খবরটা দ্রুতই বাড়ির চাকর-বাকর থেকে শুরু করে সালেহা বেগম, আজিজ শেখের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ঘর থেকেই তিনি জোরে ‘বদমাইশ’ গালি ছুঁড়লেন যা ইহসানের কান অব্ধি পৌঁছে গেল। সে অবশ্য এসবের তোয়াক্কা করেনি। তার বউয়ের সমস্যা, সে ছাড়া বুঝবে? কে কি বলল বা করল এসব গুণার সময় নেই ওর। তাছাড়া বাপ নামক লোকটার কথা ধরারই কী আছে? সে কী সাধু পুরুষ? নিজের যৌবনের কুকর্ম ভুলে গেছে? তার মা’র জীবনই তো জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছিল। এখন বুড়ো বয়সে নাটক! চোরের মুখে ধর্মের বাণী, হাহ! ইহসান তাচ্ছিল্যভরে হাসে। বাপের কিছু গুণ তারা সব ভাইয়েরাই পেয়েছে, ইনজানটা তো বোধহয় বাপকেও ছাড়িয়ে যাবে। ইহসান বুকে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সৃজাকে নিয়ে ঘরে এসে ওকে সোফায় বসিয়ে প্রথমে ওকে পানি খেতে দিয়ে নিজে লেগে পড়ে ঘর গোছানোর কাজে। বিছানা ঝেড়েঝুড়ে, নতুন বেডশিট ফেলে ঘর ঝাড়ু দিয়ে, শাওয়ারের জন্য পানি জমা করল। অতঃপর সৃজার জামাকাপড় বের করল। ওকে বলল,

“কষ্ট হবে জ্বর শরীরে, কিন্তু শাওয়ার নেওয়া উচিৎ। আমি কী সাহায্য করব?”

সৃজা ওর দিকে তাকাতে পারল না। দু’পাশে মাথা নেড়ে ‘না’ বোধক উত্তর দিলো সে। কিন্তু নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল ওর। ইহসান ধরে ফেলল ওকে। সৃজা থতমত খেয়ে বলল,

“ঠিক আছি আমি, পারব।”

ইহসান ধমক দিলো। এরপর হাত গলিয়ে ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। যেতে যেতে বলল,

“শুটিং স্পটে নেই তুই, আছিস স্বামীর ঘরে। সারারাত এই আমার বুকে পড়ে ছিলি। সব দেখেছি, মস্তিষ্কে সেট হয়ে আছে। কিন্তু এখন ঘোলা ঘোলা, অস্পষ্ট! একটু পর যখন মনে পড়বে কোথায় তোর কী আছে, গুণে গুণে বলব, এখন অসুস্থ শরীরে লজ্জাশরম ভুলে যা, আয় তোকে শাওয়ার নিতে হেল্প করি…”

সৃজা হতভম্ব ও লজ্জায় পাথর হয়ে গেল। ইহসান নিজের অনুভূতি, উত্তেজনা সব একপাশে সরিয়ে, চাপা দিয়ে ওকে যত্ন করে গোসল করতে, চেঞ্জ করতে সাহায্য করলো। খুনসুটি করে ওকে আরো অপ্রস্তুত করে দিলো না। সৃজা
ঐ সময়টাতে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখল। ভুল করে একবার তাকাতেই চোখ পড়ল ইহসানের বুকে, ঘাড়ে। আঘাতের চিহ্ন! সুন্দর, ফর্সা, পশমে আবৃত বুকের এই অবস্থা দেখে সৃজার কান্না পেয়ে গেল। কী করেছে সে এসব? দাগ বসে গেছে একেবারে! সৃজা অপরাধী মুখ করে আনমনে হাত বুলিয়ে দিয়ে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“তোমার কি বেশি লেগেছে?”

তখনি চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। সৃজার চোখে জমা অশ্রু দেখে ইহসানের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল,

“উহু!”

সৃজা মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে,

“মিথ্যুক!”

ইহসান হেসে ফেলল,

“তোর লেগেছিল?”

সৃজা আড়ষ্ট হয়ে গেল,

“না।”

“মিথ্যুক।”

সৃজা চোখ তুলে চাইল। ইহসানের ভেজা বুকে ওর দৃষ্টি স্থির হলো। ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে, ছোট ছাঁটা চুল গুলো এলোমেলো, ভেজা। সৃজাত দৃষ্টি অনুসরণ করে একটু এগিয়ে এলো ইহসান। ফিসফিস করে বলল,

“তোর আঘাতগুলো সুখের ব্যথা জান, আরেকবার দিবি? এবার মস্তিষ্ক সজাগ আছে।”

জরাগ্রস্ত সৃজা ঘোরে ডুবে গেল। ইহসান ওর উন্মুক্ত কোমড় ছুঁয়ে, কণ্ঠমণিতে চুমু খেল গভীরভাবে। শিঁরদাঁড়া বেয়ে প্রচন্ড শীতল স্রোত বয়ে গেল, ঝড় খেলল বুকের ভেতর। সৃজা আঁকড়ে ধরল ইহসানকে। গতরাতের আঁচড় দেওয়া পিঠে পড়ল নতুন আঁচড়। সৃকা অস্থির হয়ে উঠল। ইহসান তার হাস্কি স্বরে, অভিযোগ না করে অনুমতি চাওয়ার স্বরে বলল,

“শ্যুড উই ট্রাই আ ফ্রেঞ্চ কিস? আই’ভ অ্যালওয়েজ ওয়ানডার’ড হাউ ইট ফিলস! ওয়ান্না ট্রাই…”

সৃজা কাঁপতে কাঁপতে বলল,

“জ্বর হবে তোমার…”

ইহসান ঠোঁট দখলে নেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত। এ সময় এমন একটা কথা শুনে উত্তেজিত সে বলে উঠল,

“হোক!”

.

সৃজার গায়ের তাপমাত্রার পরিবর্তন নেই। ইহসান ওকে খাবার আর ঔষধ খাইয়ে ওকে কিছুক্ষণ রেস্ট করতে দিয়ে পাশে বসে জলপট্টি দিয়ে দিলো। সৃজা চোখ বন্ধ করে আছে। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়েছে, ঐ ঠাণ্ডা পুরুষালি হাতের রুক্ষ ছোঁয়ায় বারবার শিহরিত হচ্ছে। তবুও নড়চড় করছে না। মাথার ভেতর ঘুরছে গতরাতের আসঙ্গ ময় মুহূর্ত, একটু আগের ফ্রেঞ্চ কিস! কীভাবে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলল এই লোকটাকে? যে কিনা গতরাতে মদ্যপ অবস্থায় ছিল? একটু আগে ওয়াশরুমে শাওয়াররত অবস্থায় ছিল? সৃজা হঠাৎ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,

“তুমি আর কখনো ওসব গিলবে না…”

ইহসানের জলপট্টি দিতে থাকা হাত থমকে যায়। বাঁকা হেসে সৃজার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

“কেন?”

সৃজা লজ্জায়, আড়ষ্টতায় মুখ ঢেকে নেয় চাদরে,

“তুমি নিয়ন্ত্রণ হারালে মারাত্মকভাবে হও, সামলাতে পারি না…”

ইহসান ঠাট্টামিশ্রিত সুরে বলল,

“আচ্ছা, তাই?”

“হুঁ।”

ইহসান ফিসফিস করে বলল,

“তো কেমন লাগল স্বামীর আদর, ভালোভাবে দিয়েছিলাম? কিছু কি মিস করেছি? সকাল থেকে বেশি কিছু মনে পড়ছে না, তবে শুধু এটুকু মনে আছে—লাল ম’দ যতটা না খারাপ করেছে তারচেয়ে তুই বেশি খারাপ অবস্থা করে ছেড়েছিস আমায়। তার প্রমাণ এই যে, কামড় দিয়ে ঘাড়ের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছিস। আর একটু আগে তো ঠোঁটটাই…”

সৃজা কানে হাত চেপে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“প্লিজ, স্টপ ইট… আর না, আমি… আমি আর
কিছু শুনতে চাই না।”

___________

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০

মাঝরাতে যে মানুষটাকে সে জ্বরাগ্রস্ত ও দুর্বল অবস্থায় বমি করে বুক ভিজিয়ে দেওয়ার পরেও লোকটা টু শব্দ না করে সবার আগে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘জান, তুমি ঠিক আছ?’

প্রতুত্তর কী হতে পারে, এক পৃথিবী মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া? আকৃষ্ট হয়ে পড়ে সৃজা। ‘তুই’ থেকে ডিরেক্ট ‘তুমি’, চোখেমুখে ফুটে উঠা আর্তনাদ চোখ এড়ায় না ওর। চেপে রাখা ব্যাকুলতা বুঝে সে টের পায় তরঙ্গ বইছে হৃদয়ে, ডুবে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে! ওই কণ্ঠস্বরের ব্যাকুলতা তখন মেরে ফেলে সৃজাকে। বিস্মিত হয় সে প্রচণ্ডভাবে,
আফসোস হয় ভীষণ! সৃজা দুর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“তোমার গায়ে বমি করে দিয়েছি, ঘৃণা হচ্ছে না?”

ইহসান অবাক ও কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলে,

“আজেবাজে কথা ছাড়া আর কোনো কথা নেই তোর?
জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস, পেটের খাবার সব বের করে দিচ্ছিস টেনশনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আর তুই জিজ্ঞেস করছিস আমার ঘৃণা হচ্ছে কিনা?”

সৃজা তাকিয়ে রয় দুর্বল চোখে। ইহসানের গালে হাত রাখে। ঊষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে চামড়ায়। ইহসান ওর হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে চুমু খায়,

“এভাবে তাকালে আমি পুড়ে যাই, তাকাবি না এভাবে।”

সৃজা হেসে নাক কুঁচলায়,

“গেঞ্জিটা চেঞ্জ করে ফেলো, গন্ধ লাগছে…”

ইহসান চেঞ্জ করে কাপড়টা বিনে রেখে, ফ্রেশ হয়ে আবার ওর কাছে ফিরে আসে। হাতমুখ মুছিয়ে, ঔষধ খাইয়ে চাদর টেনে শুইয়ে দিয়ে ওর শিয়রে বসে জলপট্টি দিতে থাকে। ঔষধের প্রভাবে সৃজা চোখ খুলে রাখতে পারে না, তবুও সে টেনে চেয়ে থাকে। এই জীবনে যত্ন-আত্তি সে খুব কমই পেয়েছে। খুব ছোটবেলায় হঠাৎ একদিন এগুলো থেমে গেছে। দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যু, আই.সি.ইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা এলিজা, আর স্ত্রী-সন্তানের নির্মম দশায় ভেঙ্গে পড়া নাইমুর সাহেব সঠিক বিচার না পেয়ে যখন ব্রেন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন সেদিনই সৃজা বুঝে গেছিল, সবকিছুর মেয়াদ এবার ফুরোলো। আদর-যত্ন নামক স্নেহগুলো সেই ছোট্ট বয়সেই জীবন থেকে হারানোর পর ফিরে পাবার আশা করেনি কখনো, বরং দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে বাবাকে, সৃজাকে। নীলু ফুপি প্রচণ্ড ভালোবাসে ওদের,
কিন্তু সত্য তো এটাই যে, কোথাও না কোথাও কিছু ফাঁকা থেকেই যায়! তাই ইহসানের থেকে পাওয়া এসকল যত্নানুভূতি সৃজাকে টেনে নেয় অদ্ভুত মায়ায়!
পাঁচদিনের অসুস্থতার সময়টাতে সে অনুভব করেছে ইহসান শেখকে! চেয়ে চেয়ে দেখেছে লোকটার অস্থিরতা, পাগলামো আর দুশ্চিন্তা। আদর, যত্নের সাথে ভালোবাসা নামক দামী জিনিসটাও খুঁজে পেয়েছে স্বামীর দৃষ্টিতে। দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকলে তাদের মধ্যে মায়া, মোহ, অনুভূতি তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না। আর সেখানে যদি একবার প্রেম ছুঁয়ে যায় তাহলে ভালোবাসা এমনিতেই হৃদকুঠুরিতে কড়া নাড়ে। সৃজার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। সে বুঝে পায় না, মাস কয়েক আগেও যে লোকটাকে স্বপ্নেও জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবতে পারেনি, এখন সেই লোকটাকে ছাড়া নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য লাগে, একাকিনী মনে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠার পর এই শূন্যতাটা যেন আরো বেড়েছে। সারাক্ষণ মনে হয় ইহসান তার চোখের সামনে থাকুক, তার কোলে মাথা রাখুক, দুষ্টু মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখুক পুরোটা সময়। কিন্তু দিনদিন চাওয়া-পাওয়া বাড়লেও মুখফুটে সেগুলো বলতে এখনো বড্ড সংকোচ ওর। মনের কথা বলার চেয়ে ঝগড়া করাটা ওর কাছে বেশ সহজ মনে হয়। ইহসানের অনুপস্থিতির সময়টুকুতে তার শার্টে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে নিজেকে বোঝায় সৃজা, বদ লোকটা তার মনেই আছে! মিশে গেছে তার অস্তিত্বে, ক’দিনেই। অবশ্য মিশবে না-ই বা কেন? সৃজার ইদানীং আফসোস হয় ভীষণ! গত সাতটি বছরে সে কেন টের পায়নি এই মানুষটার মনের খবর? তাহলে হয়তো শাসন-বারণের পাশাপাশি কিছু-মিছু ভালোবাসাও আদায় করে নিতে পারতো।

.

জ্বর থেকে সেরে উঠার পর পাঁচদিন পেরিয়েছে।
কথা সরুপ ইহসানের কাছ থেকে সৃজা বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরেছে সৃজা। ইহসান অনুমতি দেবে কি সে একদম চুপ মেরে গেল! দিনদিন সৃজার প্রতি মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে সে, তাই চাইছিল না সৃজা তার কাছে থেকে দূরে থাকুক, একটা দিনের জন্যও। তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলে স্বৈরাচারী আচরণ হয়ে যাবে ভেবে মুখফুটে বারণ করল না। তবে সৃজা বুঝে গেল! ইহসানের অসন্তোষ চেহারাটার দিকে তাকিয়ে ওর বুক ভার হয়ে এসেছিল!
ইহসান কোনোকিছু না বলেই শুকনো মুখে রেস্তোরাঁয় চলে এসেছে সকালে। তার মেজাজ খারাপ, বাড়িতে থাকলে প্রকাশ করে ফেলবে তাই বেরিয়ে এসেছে।

রোদ্দুরে ছেয়ে আছে চারিপাশ। বাতাস খেলা করছে গাছগাছালিতে। পুকুরে ডোবা মাছেরা খেলা করছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। স্নিগ্ধময় এক সময়। আদর আদর দুপুর! রোদে বসে ভেজা চুল শুকাতে থাকা সৃজার মন ভালো নেই। ওর বাড়ি যাওয়া নিয়ে ঘট পেকে আছে, ইহসান চাইছে আবার চাইছেও না ওকে ঐ বাড়ি যেতে দিতে। অনুমতি দিচ্ছে আবার দিচ্ছেও না। সৃজা ওর মনের ভেতর কি চলছে বুঝতে পারছে না। সকালে বাড়ি যাওয়ার কথাটা জিজ্ঞেস করতেই কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করল, সেই থেকে সৃজা অস্থির হয়ে আছে। ও কল করল ইহসানকে,

“আমি বাড়ি যাব না।”

ওপাশ থেকে ইহসানের কর্কশ সুর ভেসে আসে,

“তোর বাড়ি, তোর পরিবার। যাবি না কেন ওদের কাছে? অবশ্যই যাবি। আমি তো না করিনি, অবশ্য না করারই বা কে? তুই যাবি, আগামীকালই। দ্যাটস ফাইনাল।”

সৃজার অভিমানী কণ্ঠস্বর,

“কথার মাঝে এরকম খোঁচা মিশিয়ে অনুমতি দিচ্ছ, লাগবে না অনুমতি। আমি যাব না তোমাকে ছাড়া।”

“ঐ? আমি তোকে বেশি বেশি আদর দেই বলে আমাকে কুকুর ভাবিস? আমায় ছাড়া কেন যাবি না? শোন, আমি ইহসান শেখ ভালো মানুষ নই। তুই চিনিস না আমায়, ভালো রুপে আছি তাই থাকতে দে। খারাপটা সামনে আনলে ঘৃণা করতে বাধ্য হবি, যেটা আমি মরণেও চাই না।”

ইহসান ফোন কেটে ছুঁড়ে মারলো সোফায়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? ওহ গড! সে কেন এত উদ্ভট আচরণ করছে?ইহসান পরণের শার্টের বোতাম খুলে এসির টেম্পারেচারটা নামিয়ে দিলো আরো। মাথা এলিয়ে বসল সোফায়। ইন্টারকমে রশিদকে ডেকে পাঠাল। তক্ষনি হাজির হলো সে। ইহসান তাকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করল,

“ড্রিংক্স আছে স্টকে? বিয়ার, শ্যাম্পেইন এনিথিং..”

রশিদ মাথা নেড়ে বলল,

“বিয়ার!”

ইহসান তুড়ি বাজানোর মতো করে বলল,

“সব নিয়ে আসো, ট্রাই করব…”

“আপনি তো খান না এসব..”

ইহসান চোখ লাল করে তাকাল,

“এখন থেকে খাব, রোজ! ব্যবস্থা করবে তুমি। গট ইট?”

রশিদ হা হয়ে গেল। ইহসানকে কখনোই সে এসব খেতে দেখেনি। আজ কেন? সে ভয় মনে নিয়েই কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নটা করে ফেলল,

“কিছু নিয়ে চিন্তিত স্যার?”

“হু চিন্তিত, এখন কি করবে তুমি? আমার চিন্তা দূর করে দেবে? তাহলে আসো, এসে আমার কোলে বসো। মাথায় উঠে নৃত্য করো…”

রশিদ তড়িঘড়ি করে বলল,

“আমি যাই স্যার।”

একপ্রকার পগার পার হলো রশিদ। কিছুক্ষণ পর এলো বিয়ারের দুটো ক্যান নিয়ে। পিন্ট গ্লাস সাজিয়ে দিয়ে ইহসানের সামনে রাখল। এরপর একপাশে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইহসান পানি খেতে খেতে ওকে এভাবে ওয়েটারের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

“কী ব্যাপার? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বিয়ার ট্রাই করবে? ট্রাই করে লাভ নেই, যখন বউয়ের বিরহে ভুগবে তখন ট্রাই করো। এখন যাও…”

রশিদ আমতাআমতা করে বলল,

“একটা খবর দেওয়ার ছিল!”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল ইহসান,

“কী?”

“অনিকের অবস্থা ভালো না।”

ইহসানের সাথে সাথে মনে পড়ল না,

“অনিক কে?”

“আপনার ফুপুর ছেলে, যাকে মেরে তক্তা বানিয়েছিলেন। পাজরের হাড়ে ক্ষয় ধরেছে।”

মনে পড়ল এবার। ইহসান বিস্মিত স্বরে বলল,

“ওই বাস্টার্ড, ভোগে যায়নি এখনো? আমি তো ভেবেছি তিন হাত মাটির নিচে কবেই পৌঁছে গেছে!”

ইহসানের একমাত্র, কুটনী ফুপু অনিতা বেগমের মাতাল, নেশাখোর, ইভটিজার, চাঁদাবাজ, গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে অনিক। তার ফুপাতো ভাই। খুব কম বয়সেই নষ্টামির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও কেউ তাকে আটকায়নি, বারণ করেনি কখনো কোনো অপরাধ করতে৷ আজিজ শেখ তো আরো খুশিই ছিল, এরকম সন্ত্রাসী ভাগ্নে থাকলে লোকে তাকে ভয় পাবে, সমীহ করে চলবে ভেবে। ডানহাত বানাতে চেয়েছিলেন। রাস্তাঘাটে নোংরামো করতে করতে এই শেখ বাড়িতেও আধিপত্য করার সুযোগ পেয়েছিল অনিক এই আজিজ শেখের কারণেই। আর এরই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে ক্লাস টেনে পড়া পুনমের দিকে কুনজর দিয়েছিল। পুনমের ওয়াশরুমে গোপন ক্যামেরা ফিট করে ওর গোসলের ভিডিয়ো ধারণ করেছিল। ইহসান জানতে পেরে বেধড়ক মেরেছিল সেদিন অনিককে, কিন্তু আজিজ শেখ এসবে গা করেননি। ভাগ্নেকে অবিশ্বাস না করে পুনমকেই অবিশ্বাস করেছিলেন এবং ঝামেলা এড়াতে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে শেখ বাড়িতে অনিকের আনাগোনা ছিলোই। শুধু তাই নয়, সবসময় সব ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করতো। ইহসান তাকে কস্মিনকালেও পছন্দ করতো না, সহ্য করতো না। যেমন তাদের বিয়ের দিন সন্ধ্যায় আজিজ শেখের সাথে কথা কাটাকাটির সময় বাপ-ছেলের মধ্যে নাক গলাতে এসেছিল অনিক, সৃজাকে ‘ফকিন্নির ঝি’, ‘বাজারি লোভী মেয়েছেলে’ বলেছিল। গায়ে পড়ে ওর সাথে লাগতে এসেছিল, সহ্য করতে পারেনি ইহসান। পুরোনো ক্ষোভ, ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল! অনিককে মেরে আধমরা করে হাসপাতালে পাঠিয়ে, সৃজাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে সে শপিং করতে বেরিয়েছিল। আজ প্রায় দেড় মাস অনিক হাসপাতালে ভর্তি। সেই থেকে ভয়ে ফুফু এ বাড়ি আর আসে না। কথাগুলো মনে পড়ায় ইহসান একদলা থুতু ফেলে ক্ষোভিত গলায় বলে,

“জা’নোয়ারগুলো সহজে মরে না, এটাই চিরন্তন সত্য রশিদ।”

“ঠিক বলছেন স্যার।”

“এখন যাও।”

রশিদ চলে যাওয়ার পর ইহসান বাঁকা হাসলো অনিকের নিয়তির কথা ভেবে। পরক্ষণেই চিন্তা ঢুকল মনে। অনিককে সৃজা চেনে না, নামও জানে না। এই ঘটনাও জানে না। বাড়ির প্রত্যেককে হুমকি দিয়ে রেখেছে সে, কেউ যদি এসব সৃজার কানে তুলে তাহলে তার জিভ ছিঁড়ে নেবে। সেটা তার বাবা হলেও!ভয়ে তাই কেউ সৃজাকে বলেনি এই ঘটনা। এমনকি মিতু-লিথু বা ইজহানও সাহস করেনি, ব্যাড রেকর্ড ইহসানের বেশ ভালোই আছে। তাই সে কোনোক্রমেই চায় না সৃজা এসব জানুক। মেয়েটা ওকে নিয়ে অন্যরকম ধারণা পুষে রাখে মনে। এসব শুনলে যদি ওকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায়? উহু! ঠিক হবে না। উত্তপ্ত মেজাজের ইহসানের নজর পড়ল বিয়ারের ক্যান গুলোর উপর। মাথায় ঘুরপাক খেল সৃজার বিনীত কণ্ঠস্বর,

“তুমি আর কখনো ওসব গিলবে না।”

মনে পড়তেই উঠে গিয়ে ক্যান দুটো বিনে ফেলে দিলো ইহসান। একবোতল ঠাণ্ডা পানি শেষ করল। যদিও সে ভীষণ ঈর্ষান্বিত হচ্ছে, তবুও মন ঠিক করল সে। বিরহ, কষ্ট অনুভব হলেও সৃজাকে ঐ বাড়িতে যেতে নিষেধ করবে না, এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ! এরকম করলে ইজহানের সাথে তার পার্থক্য কই? সে তো আলাদাই হতে চায় শেখদের থেকে! পারলে সবার থেকে, শুধুমাত্র সৃজার থেকে না।

.

_______

চলবে….