#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৪
সন্ধ্যা নামতে না নামতেই সৃজাকে কাছে পাওয়া দায় হয়ে গেল। একবার রান্নাঘরে, একবার ছাদে, আবার কখনো শয্যাশায়ী বাবার ঘরে ছুটোছুটি চলছে মেয়েটার। ইহসান এলিজার সাথে বসে টিভি দেখার বাহানায় চুপচাপ বসে এসব দেখল। সবার খেয়াল রাখছে রাখুক না, কিন্তু তাই বলে ওকে ভুলে যাবে? একবারও এসে দেখা দেবে না? জিজ্ঞেস করবে না ওর কিছু প্রয়োজন আছে কিনা?
অন্তত আছে না গেছে সেটা তো দেখবে! সে বেশ অসন্তুষ্ট হলো, আকাঙ্খা নিয়ে কাতর চোখে মেয়েটাকে একবার কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা করল। কিন্তু এক পর্যায়ে, যখন দেখল ওর অস্তিত্বই মেয়েটা মনে রাখছে না, তখন চুপচাপ উঠে শোবার ঘরে চলে গেল। পকেটে ভ্রাইবেট হতেই ফোন বের করে দেখল, মেসেজ এসেছে কয়েকটা। আননোন নাম্বারে। ম্যাসেজগুলো পড়ার পর ইহসানের বুকে কম্পন আর ঠোঁটে বিচিত্র হাসি খেলে গেল। পরক্ষণেই কঠিন
হলো চেহারা। ফিরতি ম্যাসেজে সে লিখল,
“তোর সবই আমার জানা। কিন্তু ভুলে যাস না, তুই যা
চাস— তা আমার। আর যা আমার, তা আমারই থাকবে। আর যদি তাতে হাত বাড়াস, হাতটাই থাকবে না। সে তুই যে-ই হোস না কেন!”
সেন্ড এ ক্লিক করে ম্যাসেজটা পাঠিয়ে দেয়ালে একটা ঘুষি বসাল ইহসান। তখনি চোখ চলে গেল দরজার দিকে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, সৃজা নীলু ফুপির সাথে পরোটা বেলতে বেলতে দুষ্টুমি করছে, হাসছে। পড়াশোনায় মগ্ন থাকা এলিজাকে ময়দা মাখিয়ে জ্বালাচ্ছে ইচ্ছে করে। ইহসানের বুক পিত্তি জ্বলতে জ্বলতে কয়লা হয়ে গেল। ইচ্ছে করল হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে শাসন করে জিজ্ঞেস করে,
“আমি এখানে হাঁদার মতো বসে আছি, আর তুই ডানা মেলে সারা ঘরময় ঘুরছিস! তোর যে একটা বর আছে, তার কোনো খবর আছে? বেঁচে আছে না ভোগে গেছে তা জানিস?”
কিন্তু এই প্রশ্নটা সে করতে পারবে না৷ বউয়ের মন খারাপ হয়ে যাবে। সে তো সৃজার মন ভালো করতেই নিয়ে এসেছে, তাই এসব বলা ঠিক হবে না। একবার সুযোগ পাক, এই মেয়েকে হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দেবে বরের প্রতি কেমন আচরণ করতে হয়! মনে মনে বিড়বিড় করল ইহসান। রাতের খাবারের সময়েও সৃজার ব্যস্ততা কমল না। এলিজা, নীলু ফুপির সাথে গল্প করছিল, রান্নার প্রশংসা করছিল আর একগাদা পোলাও, মাংস ইহসানের পাতে তুলে দিয়ে ওর পেটের বারোটা বাজানোর ধান্ধা করছিল। শ্বশুরবাড়িতে প্রথম জামাই আদর খেতে আসা ইহসান বিগলিত চিত্তে
নীলু ফুপি আর এলিজার কথার জবাব দিলেও সৃজার কোনো কথার জবাব দিলো না, এড়িয়ে গেল। বিষয়টা
সৃজা কয়েকবার খেয়াল করল বটে, কিন্তু বিশেষ পাত্তা
দিল না। এলিজাই কয়েকবার আড়চোখে দেখল ইহসানকে। ইশারায় বোনকে কয়েকবার বোঝালও,
কিন্তু সৃজার বোধগম্য হলো না।
খাওয়া-দাওয়া, আড্ডার পর ঘুমোনোর সময় ইহসান নিজের মতো উঠে গিয়ে শোবার ঘরের বারান্দায় দাঁড়াল। ঠান্ডা বাতাস বইছে, শহরের কোলাহল কিছুটা কমে এসেছে। আকাশে উজ্জ্বল থালার মতো চাঁদ উঠেছে, চারপাশ মোহময় হয়ে উঠেছে। এমন সময় ঘর থেকে সৃজার
বিচলিত গলা শোনা গেল,
“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন, বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ঘরে এসো।”
ইহসান ঘরে আসা তো দূর জবাবই দিলো না। উল্টো চেয়ারে বসে বাইরে দূরদৃষ্টি দিলো। যেন চন্দ্রসুধা উপভোগ করবে। সৃজা বিছানা গোছাতে গোছাতে আরো কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু প্রতুত্তরে নীরবতা ছাড়া কিছুই উপহার পেল না। এবারে সৃজা অবাক হলো ওর আচরণ দেখে। বুঝল না কেন ইহসান ওমন আচরণ করছে! কোনো কারণে কি রাগ? সৃজা ইতস্তত করতে করতে ওড়না ঠিকঠাক করে বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়াল। এরপর ধীরপায়ে হেঁটে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে চুলে বিলি কাটলো। নরম হাতের মুঠোয় নিয়ে টেনে দিলো, কপালে আঙুল বুলাল, টিপে দিলো। এরপরেও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সৃজা অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথাটা পেছনে ঝুঁকিয়ে অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করল,
“রাগ করেছ?”
ইহসান চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল,
“না।”
“তাহলে এভাবে চুপচাপ হয়ে গেলে কেন?”
“তোর তো সময় নেই আমার জন্য, তাই চুপ থাকাই ভালো!”
সৃজা জিভ কেটে অপ্রস্তুত হাসল,
“আচ্ছা বাবা, এজন্য মহাশয়ের রাগ? আসলে আমি
ভুলেই গেছিলাম যে….”
ইহসান ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই এবার সরাসরি চোখে চোখ রেখে কঠিন স্বরে বলল,
“তুই ভুলে গেছিলি আমার উপস্থিতি, সিরিয়াসলি?তোর থেকে এমন আচরণ আশা করিনি আমি ”
সৃজা থেমে গেল, এ কথা কখন বলল সে? কোন কথাকে
কী বানিয়ে দেয় এই লোক, কথা বলাই দুষ্কর ওর পক্ষে। ইহসানের চোখে একধরনের অভিমান স্পষ্ট। ওর বুকটা ধক করে উঠল। বুঝল লোকটার রুক্ষ আচরণের মানে। আসার পর থেকে ফুপি, এলিজার পেছনে ছুটতে ছুটতে ইহসানকে সময়ই দিতে পারেনি সে, আগামীকাল চলে যাবে তার আগে বউয়ের থেকে এমন অনীহা মূলক আচরণ পাওয়ায় মানুষটা ক্ষেপে আছে, ক্ষ্যাপাটা অবশ্য স্বাভাবিক।
হুট করে কী যে হলো! ঘুরে এসে ইহসানের কোলের উপর বসে পড়ল সৃজা। এরপর গলা জড়িয়ে কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে টুপ করে চুমু বসিয়ে দিলো ওখানে। ইহসানের রাগ তখনো কমেনি। সে সরিয়ে দিতে চাইলো ওকে। সৃজা নাছোড়বান্দার মতো ওর বুকে মুখ গুঁজে
কাতর স্বরে বলল,
“হে পরম শ্রদ্ধেয় স্বামী মহাশয়! আপনার প্রতি আমার
চরম অবহেলা ও বেখেয়ালিপনায় আমি অপরাধী। স্ত্রী
হয়ে আপনার যত্ন না নেওয়া, সময় না দেওয়া—এ যে ঘোর অন্যায়! দয়া করে এই অধম হতভাগীকে ক্ষমা করুন। আপনি চাইলে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন, আমি হাসিমুখে গ্রহণ করব। তবে দূরে ঠেলে দেবেন না, নইলে আমি প্রতিবাদস্বরূপ এখানে বসে অনশন, ধর্মঘট করব!”
ইহসান সৃজার নাটক দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কিছু একটা ভাবল ভ্রু উঁচিয়ে। শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। হঠাৎ করেই সৃজাকে দস্যুর ন্যায় চেপে ধরল একহাতে, শক্ত করে। অন্য আরেকটা হাত ঢুকিয়ে দিলো কামিজ গলিয়ে উষ্ণ উদরে। ঠাণ্ডা পুরুষালি রুক্ষ হাতের ছোঁয়া পড়তেই সৃজা কেঁপে উঠল। ইহসান বাঁকা হেসে নিচু স্বরে বলে,
“তবে কঠিন শাস্তির জন্য প্রস্তত হ।”
“ক কীসের কঠিন শাস্তি…”
ভীতি নিয়ে শুধাল সৃজা। ইহসানের ওর কণ্ঠের কাঁপুনিটা টের পেল। ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল সৃজাকে,
“নিশ্চয় বুঝেছ, কিন্তু নাটক করছ, তাই না? আর যদি সত্যিই খুকি তুমি না বুঝে থাকো, তাহলে খুলেই বলি, এইযে তুমি, আমার বিবাহিত, কাগজে-কলমে লিখে নেওয়া বউ, আমার এখন তোমাকে প্রয়োজন।”
সৃজা বিষম খেক৷ মুডে থাকলে এই লোক ‘তুই’ থেকে ‘তুমিতে’ চলে আসে। উঠে দাঁড়াল বিপদ বুঝে। ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বলে,
“প্রয়োজন মানে…”
“মানে তোমার নরম-তুলতুলে শরীরটাকে পিষ্ট করতে চাচ্ছি, আদর দিতে চাচ্ছি। তোমার চোখের গভীরে ডুবে তোর নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় হারিয়ে যেতে চাচ্ছি, তোমাকে ছুঁয়ে মরে যেতে চাইছি…আরো ভালো করে বুঝতে চাইলে, বিছানায় চলো।”
চটে যাওয়া কণ্ঠে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল ইহসান।
সৃজা নার্ভাস ভঙ্গিতে বলে,
“অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাবে চলো।”
“শাস্তি বাকি আছে, সোনা৷ রাত তো সবে শুরু হলো।
ছয়দিন রেখে যাব, শোধ নেব না?”
একপাক ঘুরে এসে কোলে তুলে নিলো হতভম্ব সৃজাকে। এরপর সেভাবেই বারান্দার দরজা আটকে, আলো নিভিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো ওকে। অস্থির হয়ে পরণের টি-শার্ট আর প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতে গভীর চোখে সৃজাকে দেখল সে স্ট্রিট লাইটের হলদে আলোয়। গোলাপ জোড়া ওষ্ঠে ডুবে গিয়ে মাতাল মাতাল কণ্ঠে বলতে লাগল,
“তোকে ছুঁয়ে, আঁকড়ে ধরে, তোর শ্বাসের গরম পরশ গায়ে মেখে আমি তোর কাছে হারিয়ে যেতে চাই, তোর ভেতরে বিলীন হয়ে যেতে চাই! তুই আমার—শুধুই আমার! তোর গায়ের গন্ধ, ত্বকের নরম উষ্ণতা, তোর ভেজা ঠোঁট—সব আমার অধিকারে রাখতে চাই জান, সারাজীবন।”
সেই রাতে ইহসান চূড়ান্ত পাগলামি করল। সৃজার মনে হলো সেদিনের লাউঞ্জের মাতাল ইহসানের থেকেও বেশি অস্থির, অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল আজকের এই ইহসান। শেষরাতের দিকে ইহসানের ফোনে টুং করে নোটিফিকেশনের শব্দ হলো।
সৃজা হকচকিয়ে উঠতেই ইহসান কৌশলে ফোনটা হাতে তুলে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয়,
“আমি যা চাই, তা কেড়ে নিতে জানি। কাড়তে না পারলেও, ধ্বংস করতে জানি।”
ইহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে৷ পরক্ষণেই বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটে উঠে। সৃজা অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করতেই সে ফোন সুইচড অফ করে দেয়। ঘুমজড়ানো স্বরে বলে,
“শোধবোধ করতে চেয়েছিলাম, দুইদিনেরও হলো না, ধুর…”
লজ্জা কাতুরে সৃজা বেফাঁস লোকটার ঠোঁট চেপে ধরল দুই হাতে। গরম নিঃশ্বাসে তপ্ততা ওকে ছুঁয়ে গেল শিরশির করে। সৃজা ভেবে পেল না, এতটা সুখ পাওয়ার মতো যোগ্য কি-না সে!
.
সূর্যের প্রথম রশ্মি খুঁটে খুঁটে রুমের ভেতরে ঢোকে, কিন্তু ইজহান এবং ইস্মির ঘরে অন্ধকারই যেন সঙ্গী হয়ে থাকে। ইজহান মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল, পলক পর্যন্ত পড়ছে না। গলার মধ্যে যেন গুমোট একটা ভারী অনুভূতি আটকে আছে, কোনো শব্দ তার পেটে জমে থাকে, কোনো আওয়াজ বের হয় না। পাশেই পড়ে আছে দুটো খালি কাচের বোতল—তরলের কিছুই বাকি নেই। সবটাই গ্রোগাসে গিলে নিয়েছে ইজহান।
ইস্মি বিছানায় শুয়ে, ঘুমোয়নি সারারাত।একবুক যন্ত্রণা ওকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে চুপচাপ অন্ধকার জগতে বিচরণ করছে। অশ্রু শুকিয়ে গালে লেপ্টে আছে। মেঝেতে বসা ইজহান হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, ভারী পায়ে চলে আসে বিছানার কাছে। ইস্মিকে এলোমেলো, আদর স্বরে ডাকে। মেয়েটা শোনে তবুও হেলদোল করে না। ইজহানের রাগ হয়, চেষ্টা করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ব্যর্থ হয় সে। ইস্মির নতুন রুপ তাকে গর্জন করতে বাধ্য করে। হতাশ শ্বাস ফেলে ইস্মি চোখ খুলে তাকায়।
উঠে বসে শাড়ি কাপড় ঠিক করে। মৃদুস্বরে বলে,
“জি বলুন।”
“অ্যাঁইই, তুই দাসীবাঁদি? এমন আচরণ করবি না আমার সাথে।”
“দুঃখিত, করব না।”
এ কথা শোনার পর, ইজহান যেন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার হাতের মুঠি শক্ত হয়, কিন্তু ইস্মির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে ওর গাল চেপে বলে,
“অবাধ্য হোস না, মেরে ফেলব।”
“মৃত মানুষকে মরার ভয় দেখাবেন না, আমার হারানোরও তেমন কিছুই নেই।”
ইস্মি চোখের কোণ দিয়ে গাঢ় এক দৃষ্টি দেয়।
এ কথা শোনার পর ইজহানের বুকে যন্ত্রণা হয়। সে
পুরোটা জীবন নিজের কাছে, আগলে রাখতে চেয়েছে ইস্মিতাকে। এটা কী তার ভুল? ইস্মিতা কেন ওকে বুঝতে চাইছে না, বারবার বুক চিঁড়ে ফেলা কথা বলছে? ও বোঝে না ইজহানের কতটা ব্যথা লাগছে? কেন বোঝে না ওকে ইস্মিতা, কেন? ইজহান তার লম্বা-চওড়া দেহটার ভর
রাখতে না পেরে ইস্মির উপর ঢলে পড়ে। ইস্মি চিৎকার
দিতে গিয়েও পারে না, তবে জেদ দেখায়,
“লিভার-কিডনি যখন অকেঁজো হয়ে যাবে তখন যন্ত্রণা কাকে বলে টের পাবেন। মৃত্যু যখন হাতছানি দিবে,
আপনার এসব দুর্গতি সৃষ্টিকারী পানীয়
বাঁচাতে পারবে না আপনাকে।”
“আমায় তো ভালোবাসিস না, মরে গেলে তুই বাঁচবি। দোয়া কর, যাতে দ্রুত মরে যাই।”
ইস্মি বিরক্ত হয়,
“অলক্ষুণে সব কথা, নিজের ভাবনাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া বন্ধ করুন।”
ইজহান তীব্র হাসি দিয়ে বলল,
“ধোঁকাবাজ! সারারাত আমার হৃদপিণ্ডে ছুরিকাঘাত করলি, আর এখন মিথ্যে ভালোবাসার নাটক শুরু করেছিস? ঠকবাজ মহিলা! যদি সত্যিই ভালোবাসিস, তাহলে চিতায় ঝাঁপ দেওয়ার মতো আমার সঙ্গে কবরে চলে আসিস, দেখব তোর ভালোবাসার শক্তি কতটা!”
ইস্মির মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না, সব যেন গলার ভেতর আটকে গেছে। অদ্ভুত এক অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চলছে তার মনে। ইজহান ওর সাড়া না পেয়ে আবারো ব্যাকুল হয়ে বলে,
“তোর আগে অতোটা ভালো আমি কাউকে বাসিনি৷ ওহ না, বেসেছি একজনকে৷ আমার মাকে— জন্মদাত্রীকে। কিন্তু সে থাকতে আমায় কখনো ভালোবাসেনি।”
ইজহান নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। তার কণ্ঠে বিষণ্ণতা, ক্ষোভ আর কষ্ট মিশে। একটু থেমে আবারো বলে,
“এখন তোকে ভালোবাসি, কিন্তু তুই আমায় মন থেকে ভালোবাসছিস না। দেখ, আমার বুকটা ছিঁড়ে, সব কিছুই ছাই হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না, কিচ্ছু না। মা আমাকে ভালোবাসেনি, তুইও বাসছিস না৷ তোরা কেন মুখ ফিরিয়ে নিস, আমার থেকে বল তো! ইস্মিতা, স্বাভাবিক হও না…তোমার এই অচেনা রূপে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!”
________
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫
ইজহান নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
তার কণ্ঠে বিষণ্ণতা, ক্ষোভ আর কষ্ট মিশে। একটু থেমে আবারো বলে,
“এখন তোকে ভালোবাসি, কিন্তু তুই আমায় মন থেকে ভালোবাসছিস না। দেখ, আমার বুকটা ছিঁড়ে, সব কিছুই ছাই হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না, কিচ্ছু না। মা আমাকে ভালোবাসেনি, তুইও বাসছিস না। তোরা কেন
মুখ ফিরিয়ে নিস, আমার থেকে বল তো! ইস্মিতা,
স্বাভাবিক হও না…তোমার এই অচেনা রূপে আমার
দম বন্ধ হয়ে আসছে!”
ইজহানের ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শুনে ইস্মির বুক কাঁপে।ঠোঁট টেনে হাসি আনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে বলে,
“আমি স্বাভাবিকই আছি ইজহান শেখ।”
ইজহানের রগে রগে ছেয়ে গেল বিতৃষ্ণা। ইস্মিতা
কি সত্যিই এতটা কঠিন হয়ে গেছে একদিনের ব্যবধানে যে ওর সাথে এভাবে কথা বলতে একটুও বাঁধছে না? মেয়েটার চোখের ভেতর একটুও ভয় নেই, কোনো উষ্ণতাও নেই। বরং একধরনের মৃত কাঠিন্য ঝিলিক দিচ্ছে। ইজহান আঙুলের চাপ বাড়িয়ে ওর মুখটা আরো কাছে টেনে আনল, ঠোঁটের ওপর দাঁত চেপে বলল,
“তোর সাহস এত কেন বাড়ছে?”
ইস্মি নিস্তেজভাবে হাসল,
“সাহস বাড়লে কি আমি আজ এখানে থাকতাম, বলুন? আমি ভঙ্গুর মানুষ, ভঙ্গুর মানুষদের সাহস থাকতে নেই।
তবে ভেঙ্গেচুরে গেছি বলেই হয়তো কেন জানি কিছু নিয়ে ভয় হচ্ছে না।”
দীর্ঘশ্বাস বুকে চাপা দিয়েই ইস্মি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। রোদে চকচক করছে চারিদিকে। বেলা অনেক হয়েছে, খাওয়া হয়নি ইজহানের। ক্ষিধে সহ্যের ক্ষমতা শূন্য এই লোকের, জানে সে। ঝামেলা শুরু করতে দু’মিনিটও নেয় না৷ তবে আজ ভিন্ন। হয়তো ইস্মির কঠিন আচরণটাকেই হজম করতে পারছে না, তাই পেটের কথা মুখে আনছে না। ইস্মি উঠে ফ্রেশ হয়ে এলো, এরপর চেঞ্জ করে আরেকটা শাড়ি পরল। ইজহান অস্পষ্ট চোখে ওর শাড়ি পাল্টানো দেখে ঢোক গিলল দু’বার। তৃষিত হলো কিন্তু কাছে ডাকল না ইস্মিকে। অভিমানে যেন তার মন অবরুদ্ধ হয়ে আছে। চেঞ্জ করে ইস্মি দরজার দিকে যেতেই হুড়মুড় করে সে উঠে দাঁড়াল। ইস্মিকে পেছন থেকে ফিসফিস করে ডাকল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
পা উঁচু করে দরজার সিঁটকিনিতে হাত দিতে দিতে ইস্মি উত্তর দিলো,
“কোথায় আবার যাব? বেলা কত হয়েছে খেয়াল আছে? নাস্তা তো করেননি, আপনার তো এসময়ে গরম কফি চাই। সেটাই বানাতে রান্নাঘরে যাচ্ছি, পালাচ্ছি না…”
এই অবজ্ঞা, এই শীতলতা ইজহানের মস্তিষ্কে বাজের মতো আঘাত করল। রাতে দু-বোতল ড্রিংক নিয়েছে সে, তারই প্রভাবে বা ইস্মির আচরণের ধাক্কা না নিতে পেরে তার আচমকা মাথা চক্কর দিল, পা পিছলে গেল। ইস্মি প্রায় ছুটে এসে ধরতেই টলতে টলতে সে মেঝেতে বসে পড়ল। বৌয়ের প্রতি জমা অভিমানটা হুট করে পালিয়ে গেল কোথায় যেন! ইজহান হাত বাড়িয়ে ইস্মির শাড়ির আঁচল টেনে ধরল, কণ্ঠস্বর কাঁপল,
“আমাকে আদর দিয়ে যাও…”
ইস্মি থেমে গেল। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“খাবেন না? ক্ষিধেয় তো চোখমুখ শুকিয়ে আছে।”
ইজহানের হাতের মুঠো শিথিল হয়ে এলো,
“আমার সবকিছুই খরা হয়ে আছে। খরা কাটাতেই আদর ভিক্ষে চাইছি, এখন কি এটা নিতেও তোর পায়ে ধরতে হবে? ভিখিরি বানিয়ে শিক্ষা দিবি আমায়? সারারাত তো শিক্ষা দিলি, দে আরো দে…”
ইস্মি সত্যিই শিক্ষা দিলো ওকে, মেঝেতে ওভাবে বসিয়ে রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে। ফিরলো আধঘন্টা পর সকালের নাস্তা নিয়ে। ইজহান ওর সাহস দেখে হতভম্ব, ইচ্ছে করল বৌয়ের দাঁতকপাটি এক চড়ে ফেলে দিতে। সে দু’গাল চেপে ধরে চিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,
“অবাধ্য মানবী, তুই আমাকে এই প্রথম উপেক্ষা করলি। এর শাস্তি কী হতে পারে বল তো?”
ইস্মি ওভাবেই রুটি ছিঁড়ে ওর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“সারাদিন আদর চাই, আদর চাই, আর আজ আদর ভিক্ষে চাই? যান, মাসনা-সুলাসা-রুবাইয়া নিয়ে আসুন। একা কেন এত ভোগ করব? এটুকু শাস্তি আমার প্রাপ্য! তাই নয় কী?”
বিস্ময় ঝড়ে ঝড়ে পড়ল ইজহানের চোখ থেকে। অস্ফুটস্বরে বলল,
“আরো তিনটে বিয়ে করতে বলছিস? আমাকে ভাগাভাগি করবি, এতটা পাথর হয়ে গেছিস তুই ইস্মিতা?”
ইস্মি আগের মতোই কিছু যায়-আসে না ভঙ্গিতে ওর মুখে রুটি-তরকারি ঢুকিয়ে দিতে দিতে বলল,
“উহু, বাধ্য বউ হওয়ার চেষ্টা করছি!”
“আমি আরো তিনটে বিয়ে করলে তুই বাধ্য বউ হয়ে যাবি?”
ইস্মি জবাবে বলল,
“সব প্যারা যদি চারজনকে সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারেন তাহলে আমি ইস্মিতা পুরোপুরি
আপনার বাধ্য বউ হয়ে যাব।”
ইজহান কাষ্ঠ হাসলো,
“আমি তোমাকে প্যারা দিই, বলোনি তো কখনো!”
“বলার সুযোগ হয়নি, আজ হলো তা-ই বললাম।”
“কেন এত অবহেলা করছো, আমার কষ্ট হচ্ছে।”
ইস্মি খাওয়া থামিয়ে অভিযোগের দৃষ্টি ছুঁড়ে তাকায় ওর দিকে। গাঢ় স্বরে প্রশ্ন করে,
“নিজের সব স্বপ্ন কুরবানি দিয়ে, নিজেকে কাঠেরপুতুল বানিয়ে, সর্বোচ্চ আত্মসম্মানহীন হয়েও কেন পাঁচটা বছরেও বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি আমি আপনার? কেন এত অবিশ্বাস আমার প্রতি?”
ইজহান চুপ করে থাকে বরাবরের মতো। কথা এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে কারণ খুঁজতে থাকে। ইস্মিতা নাস্তার প্লেটটা সরিয়ে রেখে ইজহানের গা ঘেঁষে বসে। মুখটা দু’হাতে নিজের দিকে ফেরায় জোর করে। চোখঠোঁটে চুমু বসায় নিজে থেকে। ইজহান আঁকড়ে ধরে ইস্মির বুকে মুখ গুঁজে। রুক্ষ হাতে কোমড় চেপে ধরে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। ইস্মিতা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে থাকে। ইজহানের ভালো লাগে। মনটা হঠাৎ করেই বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ভেতর থেকে কে যেন বলে, ‘এই মেয়ে অবিশ্বাসের যোগ্য নয়। তুই ওকে বিশ্বাস করিস, সেটা কেন বলছিস না?’
ইজহান নিজের ভেতরের সত্তাটাকে উত্তর দিতে গিয়ে মুখ ফসকেই বলে ফেলে,
“কারণ আমি ভয় পাই। ভীতুর ডিম আমি। ভয় হয়, ও যদি ভেতরের আমাকে জেনে ফেলে তাহলে আর আমাকে ভয় পাবে না। ভয় না পেলে ও আমার মাথায় চড়ে বসবে। চড়তে চড়তে যদি ও আমায় ছেড়ে চলে যায়? মরে যাব আমি।”
ইস্মি চুপ করে শোনে। এরপর বলে,
“আর আপনাকে ভয় পেতে পেতে ইস্মিতাই যদি মরে যায় তাহলে?”
“এটা হবেই না।”
“কেন?”
কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হলো অবুঝ মানবের,
“কারণ— আমার ভালোবাসার জোর বেশি।”
“তাহলে কেন ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছেন? ভালোবাসাকে ভালো রাখতে পারলেই না বুঝতাম, আপনি তাকে ভালোবাসেন। ভালো যদি রাখতে না-ই পারেন, তাহলে আবার ভালোবাসা হলো কী করে?”
“আমি ওকে ভালো রাখছি না?”
“রাখছেন?”
ইজহান দ্বিধায় পড়ে যায়,
“তাহলে কীভাবে রাখলে ভালো রাখি প্রমাণ হবে?”
“বউকে বুঝলে!”
দৃঢ়স্বরে বলে ইজহান,
“আমি ওকে বুঝি।”
ইস্মির গলা ভার হয়ে আসে,
“তাহলে কেন বোঝেননি, আপনার ইস্মিতা মা হতে গিয়ে এক পৃথিবী জয় করে ফেলেছিল, রাণী হয়ে গেছিল? তাকে সেই রাণীর পদ থেকে টেনে-হিঁচড়ে
ঝি কুড়ানির পদে নামিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আপনিই?”
ইজহানের কষ্টে বুকটা ছারখার লাগে। তার কাছে ইস্মিতা সবসময় রাণী, কোনো ঝি কুড়ানি নয়। এটা কীভাবে বললে বুঝবে এই মেয়ে? সে আরো শক্ত করে ইস্মিকে আঁকড়ে ধরে। পেটে মুখ গুঁজে, গাল ঘষে। আবেগ্লাপুত হয়ে যায় হুট করে। পরক্ষণেই কঠিন গলায় বলতে থাকে,
“বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই ইস্মিতা সারাদিন ওর কথা বলতো, ওকে নিয়ে ভাবতো। রাতে আমি ওকে বুকে করে ঘুমাতে চাইলেও ও জেদ করতো। আমি কিছু করতে না চাইলেও ও আমার থেকে দূরে দূরে শুতো। আমাকে নাকি তখন ওর অসহ্য লাগতো। আমার মাথা নষ্ট হয়ে যেত ওর ব্যবহার দেখে। যেদিন হসপিটালে ওকে লাস্ট চেকাপে নিয়ে গেলাম, দেখলাম একটা মহিলা বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মরে গেল। আমার মনে ভয় ঢুকে গেল, ইস্মিতা যদি বাচ্চা আনতে গিয়ে মরে যেত, আমার কী হতো?”
ইস্মির শূন্য মনটা হাহাকার করে উঠে,
“তাই বলে কেউ নিজের বাচ্চা আসবে জেনেও বউকে ওভাবে ধাক্কা দেয়? ইস্মিতা যদি তখনি মরে যেত?”
“সেদিন আমি ইচ্ছাকৃত ধাক্কা দিইনি তো!”
ইস্মি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। আজকের আগে কখনো এই প্রসঙ্গে এই কথাটা বলেনি ইজহান। সবসময়ই এড়িয়ে গেছে নয়তো দুর্ব্যবহার করেছে। ইস্মিও সবসময় ভেবে গেছে ইজহান সেদিন ঝগড়ার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দিয়েছে। তিনটা বছর ধরে সে এটাই জানতো এবং মানতো। এটা অবশ্য ঠিক যে, বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই হরমোন চেঞ্জের কারণে ভীতু ইস্মিতার প্রচণ্ড মুড সুইং হতো। বাচ্চাটাকেই সব ভাবতো, ইজহানের পজেসিভনেসকে ওর নাটক মনে হতো, অসহ্য লাগতো ওকে৷ কখনোসখনো নিজে থেকে আবদার করে ইজহান ওর পেট ছুঁয়ে বাচ্চাটাকে অনুভব করতে চাইলে ও দিতো না। সবসময় দূরে দূরে রাখতো, ভাবতো ইজহান বোধহয় ক্ষতি করে দেবে বাচ্চাটার। তাই ওকে ছুঁতে না দিয়ে কষ্ট দিতো। ইজহান রেগে গেলেও পরোয়া করতো না তখন! স্মৃতিগুলো মানসপটে ভাসতেই ইস্মির বুকের ভেতরে কান্নার দলা ভাঙচুর হলো৷ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“বাবা হতে চেয়েছেন কখনো?”
ইজহান উত্তর দেয় অনেকক্ষণ পর,
“না।”
“কেন?”
“বৌ ভাগাভাগি আমার ধাতে নেই। ঐ একরত্তি শিশুর সাথেও না। আর বাচ্চা দুনিয়াতে আসার আগেই ইস্মিতা যেভাবে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল,
আমি নিশ্চিত বাচ্চাটা এলে এই মহিলা আমাকে ঘরেই জায়গা দিতো না৷”
ইস্মি হুট করেই আশা জাগানিয়া সুরে বলে,
“কিন্তু যদি আর দূরে না ঠেলে, যদি ইস্মিতা আপনাকে ঐ বাচ্চাটার জন্য আরো কাছে টানে, তাহলে?”
এ পর্যায়ে এসে ইজহান মুখ তুলে তাকায়। বিস্মিত নয়নে বোঝার চেষ্টা করে কথাটা। সত্যিই কী বাচ্চা এলে ইস্মি তাকে আরো কাছে টানবে? আগের মতো দূরছাই করবে না? ইজহান বিস্ময় নিয়ে বলে,
“ঐ বাচ্চাটার জন্য কেন কাছে টানবে? কেন নিজে থেকে টানবে না? বাচ্চাটাকে কেন ইউজ করবে?”
ইস্মি ওকে বোঝানোর জন্য বলে,
“এটাকে ইউজ করা বলে না।”
“তাহলে কী বলে?”
“ভালোবাসার সেতু বলে।”
“সেতু?”
“হুঁ, এই সেতুর কারণে দুটো মানুষ একে-অপরের সাথে চিরদিনের জন্য আটকা পড়ে যায়। ছেড়ে যেতে চাইলেও ছাড়তে পারে না এই সেতুর জন্য।”
ইজহান চেয়ে রয় প্রফুল্লচিত্তে কথা বলা ইস্মির দিকে। এগুলো তো সে জানে না, ভাবেইনি কখনো। ইস্মিও বলেনি, কেউ বলেনি। আচ্ছা, বাবা কী এইজন্যই মাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল? তারা দুই ভাই সেতু ছিল বাবার কাছে? তাই মা চিরজীবন মুখ ফিরিয়ে থাকলেও তাদের দু-ভাইয়ের জন্যই ফিরতে বাধ্য ছিল? সে অবাক হয়ে বলে,
“কিন্তু যদি সেতুটাকেই তুই বেশি ভালোবাসিস?”
“সেতু হয়ে একটা ছোট্ট ইজহান আসবে, ছোট্ট ইজহানকে ভালোবাসলে আপনার তো বরং আনন্দ হওয়ার কথা!”
ইজহান ভাবুক চিত্তে বলে,
“ছোট্ট ইজহান? যদি ছোট্ট ইস্মিতা আসে?”
“তাহলে আপনি তাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবেন, আর আমি আপনাকে বেশি ভালোবাসব। আপনি কী চান না, একটা ছোট্ট ইস্মি আসুক, যে পাপা বলে ডাকবে আপনাকে? ছোট্ট ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াবে ঘরময়। মায়ের আদর দেবে আপনাকে, চান না?”
মায়ের প্রসঙ্গ আসতেই ইজহান বাকরুদ্ধ বনে যায়,
“মায়ের আদর দেবে?”
“হু, মেয়ে সন্তান তো মা-ই হয়। মা হিসেবে ভালোবাসবেন ওকে। তাছাড়া পৃথিবীতে বহু ধরনের ভালোবাসা আছে। প্রেমিক-প্রেমিকার এক ধরনের, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আরেক ধরনের, আর মা-বাবার সাথে সন্তান-সন্ততিদের ভালোবাসা। সবগুলোর অনুভূতি আলাদা। কোনোটার সাথেই কোনোটা মেলে না। ভালোবাসার এই ধরণগুলোর সাথে আপনি পরিচিত হতে চান না?”
ইস্মির বলা কথা শুনে, ওর ব্যাকুলতা দেখে ইজহান জুলজুল চোখ করে চেয়ে থাকে। লোভী হয়ে উঠে মনটা। দ্বিধাবোধ নিয়েই মাথা নাড়ে আলতো করে।
সে চায়, চায় ভালোবাসার সব অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে। ইস্মি হঠাৎ ওর মাথা নাড়ানো দেখে প্রচন্ড এক ধাক্কা খায়। মুখ হা হয়ে যায়। এত সহজ? এত সহজে ইজহান রাজি হয়ে গেল? এটুকু সম্মতি দিয়ে দিলো? সে তো স্বপ্নেও আশা করেনি। ইস্মির চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠল। ঠোঁটজোড়া আপনাআপনি হাসিতে চওড়া হয়ে গেল। চোখভর্তি পানি আর ঠোঁটের হাসি নিয়ে সে আছড়ে পড়ল ইজহানের বুকে। বহুদিন পর মন খুলে কাঁদলো সে। নাকের পানি, চোখের পানিতে বুক ভিজিয়ে দিলো ইজহানের। অপ্রস্তুত হয়ে ওকে বুকে চেপে ধরে ইজহান মৃদুস্বরে বলল,
“বাবু নিতে চেয়েছি তো…”
“আপনি কী সবসময় এমন অবুঝই হয়ে থাকবেন? কেন বুঝেন না এটা খুশির কান্না?”
ইজহান আরো শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে ইস্মিকে। তার একটু একটু নয়, অনেকখানিই ভালো বোধ হচ্ছে। বলে,
“বাবুকে আমি ভালোবাসব না, শুধু মায়ের আদর নেব। এরজন্য তুই আমাকে আরো বেশি ভালোবাসবি এই মর্মে স্বাক্ষর দিবি…”
ইস্মি এসব শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। অবাক ভঙ্গিতে শুধাল,
“কোথায়?”
“ষ্ট্যাম্পে, দলিল করে রাখব।”
___________
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৬
তিনদিন যাবৎ সৃজা শ্যাওড়াপাড়ায় বাবার বাড়ি এসেছে। তিনটা দিন ওর কাছে তিনযুগের ন্যায় লম্বা লাগছে। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে সে একটা পুরুষকে দেখেনি, তার কণ্ঠস্বর শোনেনি, তার বুকে ঘুমোয়নি, তাকে আলিঙ্গন করেনি, তার চুমু কপালে পায়নি। যদিও প্রতিদিনই ইহসানের সাথে ওর ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে, রাতে ঘুমানোর সময় আধঘন্টা প্রেমালাপ, দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া হচ্ছে তবুও সৃজার কেমন নিঃসঙ্গ লাগে। এ ব্যপারটা কারো কাছে স্বীকার করেনি সৃজা, কিন্তু এলিজার জহুরি চোখ বোনের অস্থিরতা দেখেছে, তার মনের অবস্থা টের পেয়েছে। যেহেতু আপু ওকে কিছু বলেনি, তাই এলিজাও এ বিষয়ে প্রশ্ন করে বোনকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়নি। এসব প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি খুব
একটা সে বোঝে না। কিন্তু বোঝে এই অনুভূতিটা
খুব দামী। এটা খুব গোপন আর একদম নিজস্ব হয়। কখনোসখনো এই অনুভবের যাতনায় নিজেকেই জ্বলতে হয়, পুড়তে হয়। মোটকথা, ভালোবাসা মানে নিজের সীমাহীন যন্ত্রণা মেনে নেওয়া, অন্যের জন্য। এলিজা বারান্দায় তিতকুটে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বাবার সেবাযত্নে ব্যস্ত সৃজাকে দেখছিল। আচমকা সৃজার চোখ পড়তেই সে জিজ্ঞেস করল,
“দেয়নি ফোন?”
এলিজা হাতে থাকা সৃজার ফোনটাতে আরো একবার ঘাড় নাড়িয়ে ‘না বোধক’ উত্তর দিতেই সৃজা অন্ধকার মুখ করে বাবার ঔষধপত্র গুছিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তবে যেতে গিয়েও ফিরে এসে বসল ওর পাশে। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে এলিজাকে কড়া কণ্ঠে আদেশসূচক বলল,
“ফোনটা তোর কাছে রাখবি, যদি রাতে কলটল দেয় ধরবি না। ধরলেও বলে দিবি আমি ঘুমিয়ে গেছি।”
এলিজা সৃজার বাধ্য বোন। কখনোই বোনের কথা অমান্য করে না সে। কিন্তু অবোধ বালিকার মতো বোনের অভিমান দেখে ওর হাসি পেল। সেটা অনেক কষ্টে চেপে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া হয়তো কাজে, কোথাও হয়তো আটকে গেছে। বাড়ি ফিরে হয়তো ফোন দেবে। তুমি বাচ্চাদের মতো রাগ করো না।”
সৃজা ওর কথা শুনে বিব্রত হলো। ইহসান সন্ধ্যা থেকে ওর ফোন ধরছে না। সাতটার দিকে শুধু একটা ম্যাসেজ লিখেছে ‘সুন্দরী বউ দূরে থাকলে আসলেই জ্বালা, দূর থেকে স্বামীর অ্যাটেনশন চাই সারাক্ষণ। কাছে চলে আয়, এত ভুগতে হবে না আমার মতো।’ সেই থেকে সৃজার মন-মেজাজ খারাপ। কল দিলেই বুঝি অ্যাটেনশন সিকার হয়ে যায়? ও তো খোঁজখবর জানতে চাইছিল, লোকটার হ্যাড়ে গলাটা শুনতে চাইছিল। এটা কী দোষের কিছু? না তো। পরক্ষণেই সৃজার বোধোদয় হলো৷ এতটা উতলা হওয়া আসলেই ঠিক হয়নি! সম্প্রতি, ইহসান নিজের আইডিয়া ব্যবহার করে একটি টেক স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি তার আইডিয়া হাতিয়ে নিয়ে বাজার থেকে তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এ নিয়ে আইনি জটিলতায় জড়িয়েছে ইহসান, দিনরাত দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে তাকে। ব্যস্ততার এই চক্রে সৃজার জন্য সময় বের করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। গতরাতেই বলে দিয়েছিল ইহসান।
কিন্তু এরপরেও চিন্তা হচ্ছিল বলে ওকে কল দিয়ে জ্বালিয়েছে সৃজা। কাজে মনোনিবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ইহসান কড়া গলায় ওকে ধমকের পাশাপাশি ওর ফোনে কারফিউ জারি করে দিয়েছে সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত। এ সময় নো ফোন, নো কথোপকথন। কিন্তু বউ তো, সৃজা এই কারফিউ থোরাই কেয়ার করে একেরপর এক কল দিয়েই গেল৷ ইহসান যখন একটা কলও রিসিভ করল না তখন থেকেই ওর মনে অভিমানের মেঘ জমতে জমতে আশি কেজি ওজন ধারণ করে ফেলেছে। এলিজার কথাটা শুনে তাই সৃজার মনে হলো আসলেই সে বাচ্চাদের মতো রাগ করছে, যার কোনো মানেই হয় না। উল্টো মানুষটার উপর যা চাপ যাচ্ছে, তাতে নিজে থেকেই ওকে বোঝা উচিৎ ছিল সৃজার। ও নিজের উপর বড্ড বিরক্ত হলো। অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে প্রসঙ্গ বদলে এলিজাকে বলল,
“রুমে চল, ঘুমাবি তো!”
“এখন ঘুমাব? মাথা খারাপ আপু! টেস্ট পেপার অর্ধেকটাও কমপ্লিট হয়নি। অনেক পড়া বাকি, তুমি শুয়ে পড়ো…”
এলিজা পড়াশোনার বিষয়ে কতটা সিরিয়াস তা জানে সৃজা। তার বোনের স্বপ্ন, আইন নিয়ে পড়বে, ব্যারিস্টার হবে। এরজন্য ছোট থেকেই পড়াশোনায় ডুবে থাকা মেয়ে সে। সৃজা ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“খুব চাপ যাচ্ছে, না?”
এলিজা তিতকুটে কফিতে শেষ চুমুকটা বসিয়ে বলে,
“মার্ক আনতে চাপ গিলে খেতেই হবে। টেস্ট পরীক্ষায় টুয়েন্টি মার্কের জন্য ফার্স্ট প্লেইজ হাতছাড়া হয়েছে। ফাইনালে আমি তা চাই না।”
সৃজার খুব মায়া হলো বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছুদিন পর এইচএসসি ফাইনাল। মুখটা শুকিয়ে আছে পড়াশোনার চাপে। সারাদিন তো পড়ছেই, রাতেও পড়ছে। ঘুমায় ফজরের সময়, উঠে পড়ে আটটায়। এরপর এগারোটায় টিউশন পড়তে বেরিয়ে বাসায় ফিরে বিকেলে। ফিরেই আবার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সৃজা হাত বুলিয়ে দিলো এলিজার মাথায়। এলিজা কিছু বলল না, চুপ করে বোনের আদরটুকু উপভোগ করল। তাদের সম্পর্ক একদিকে যেমন ভালোবাসার, তেমনি তীব্র দুঃখ ও বোঝাপড়ার। একে অপরকে ঘিরে হাজারো আশা, দুঃখ, সুখ এবং কষ্টের জগত তাদেরকে একভাবে বেঁধে রাখে। সৃজা এলিজার কাছে মায়ের মতো, আর এলিজা সৃজার কাছে তার ছোট্ট স্নেহময়ী বোন, যাকে সে মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছে। দু’জনের জীবনে অনেক কঠিন সময় গেছে, কিন্তু সেই ছোট বয়স থেকেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। সৃজা শক্ত হলেও মাঝে মাঝে নিজের দুঃখবোধ চেপে রাখতে না পেরে প্রকাশ করে ফেলে, কিন্তু এলিজা তেমন নয়। তার চিন্তাধারা অন্যরকম—বিচক্ষণ এবং পরিপক্ব। সে কখনো নিজের ক্ষত অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চায় না, পারেও না। নিজের অনুভূতিগুলোকে কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে আত্মমর্যাদা বজায় রাখতেই স্বস্তি পায়। সৃজা ছোট বোনটাকে চেয়ে দেখল, একদৃষ্টিতে! কী সুন্দর প্রিন্সেসের মতো চেহারা! রুপে-গুণে একটুও কমতি নেই। কথাবার্তা, পড়াশোনা, চলাফেরা সবকিছুতে মার্জিত ভাব। কিন্তু একটাই মুদ্রাদোষ তার ছোট বোনটির, কখনোই কোনো অন্যায় দেখলে মুখবুজে থাকতে পারে না। নিজের যেটা ঠিক মনে হবে, সেটাই করবে। এরজন্য এলিজাকে নিয়ে গর্ব হলেও মাঝেমধ্যে ওর খুব ভয়ও করে।
.
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। নামাজ শেষ করে এলিজা কুয়েশ্চন পেপার সলভ করছে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু ওর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাল ফোনের ভ্রাইবেশন। এলিজা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল সৃজার ফোনটা টেবিলের একপাশে জ্বলজ্বল করছে। ও বইটা বন্ধ করে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করতেই ইহসানের অস্থির, হেড়ে গলার ধমক শুনতে পেল,
“সৃজা কা বাচ্চি, আমার ফোন ইগনোর করিস তুই? সামনে পেলে মেরে মুখ ভেঙ্গে দেব…”
“ভাইয়া আমি এলিজা, আপু তো ঘুমিয়ে পড়েছে।”
এলিজার কণ্ঠ শুনে ওপাশ থেকে ইহসান চুপ করে গেল। ফোন ওর কাছে কেন? ওহ! প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে, তখন ফোন ধরেনি বলে? ইহসানের রাগ হতে লাগল। পরক্ষণেই অস্থির হলো। ভার গলায় বলল,
“শোন এলিজ, এক্ষুনি যা বললাম ওসব ফাঁকা বুলি। আমি তোর বোনকে স্বপ্নেও মারতে পারি না। মুখ ভেঙে দেওয়া তো দূর! উল্টো তোর বোন আমায় খুব চাপে রাখে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন যে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যায় করে ফেলি! দোয়া করিস আমার জন্য৷ আমি কিন্তু তোর আপুকে আদরে রাখি, এবিউজার না।”
এলিজা সিরিয়াস গলায় বলল,
“জানি, আপু ন্যাগিং ওয়াইফ।”
“এইতো ঠিক ধরেছিস।”
এলিজা হাসি চেপে বলল,
“কথা বলবে আপুর সাথে?”
ইহসান স্বস্তির শ্বাসটুকু ছেড়ে মাথা নাড়লো, যা ওপাশের এলিজা জানল না। এক্ষুনি সৃজার গলা শুনতে হবে তার, নয়তো রাতে ঘুমাতে পারবে না।
তার তৃষ্ণা পাচ্ছে, বউয়ের কণ্ঠস্বর শোনার। পাছে এলিজার কাছে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হয়, তাই
সে দোষটা সৃজার উপর চাপিয়ে দিয়ে বলল,
“না বললে যদি কথা শোনায়? অত্যাচার করে? চিনিস না তুই ওকে, আস্ত প্যাঁচের বস্তা নিয়ে ঘুরে। তুই ডেকে দে নয়তো?”
এলিজা ওর মনোভাব বুঝে গেল৷ একটুক্ষণ চুপ করে বলল,
“কাঁচা ঘুম ভাঙালে যদি মাথাব্যথা করে? ডাকা কি উচিৎ হবে?”
উত্তেজনায় ভাটা পড়ল ইহসানের৷ হতাশ হয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“তাহলে ঘুমাক।”
…
সৃজার অনুপস্থিতি স্বস্তি আর সুখ দিচ্ছে লিথুকে।
দুটো দিন ধরে তার মনে যারপরনাই আনন্দ। লাল, হলুদ, কমলা রঙের কিছু শিফন শাড়ি অনলাইন থেকে অর্ডার করে আনিয়েছে। ওগুলো পরে সারা বাড়িময় ঘুরঘুর করছে। উদ্দেশ্য— ইহসানকে আর্কষিত করা। শাড়িতে বাকি সুন্দরীদের আরো সুন্দর লাগে। পুরুষেরা প্রেমে পড়ে, তাদের দুর্বলতা নাকি শাড়ি। ইস্মিকে দেখেছে লিথু, বিয়ের পর থেকে শাড়িই পরে, কখনো সালোয়ার-কামিজ পরেনি। বাড়িতে থাকলে সবসময় ইজহান ওকে চোখে হারায়। যেহেতু, ইহসান- ইজহানের পছন্দে মিল আছে, তাই ইহসানেরও শাড়িতে নিশ্চয় দুর্বলতা আছে। লিথু আজ অবধি সৃজাকে শাড়ি পরিধান করতে দেখেনি। তাই ওর অনুপস্থিতিতে ট্রাই করে ইহসানকে নিজের প্রতি
দুর্বল করতে চাইছে! সকালে ইজহান ব্রেকফাস্ট করতে বসে বিরক্ত হলো লিথুকে দেখে। পাতলা, স্বচ্ছ শাড়ির বেশিরভাগটাই খোলামেলা। আঁচল তুলে রাখা কাঁধের উপর। অঙ্গভঙ্গিও সুবিধার নয়। ইস্মিও লিথুর শাড়ি পরার ধরণ দেখে খুব বিব্রত হলো শ্বশুর আর ইজহানের সামনে। ও তাকাল না, চুপচাপ নাস্তা তুলে দিলো পাতে। ইজহান কাটাকাটা স্বরে লিথুকে ‘গভীর রাতের পরী’ বলল। লিথু কম্পলিমেন্ট পেয়ে খুশিতে ইজহানকে ধন্যবাদ জানাতেই ইজহান রগচটা স্বরে বলল,
“ঐ পরীগুলা রাস্তায় পুরুষ দেখলেই ঢলে পড়ে,
বুঝলা লিথুরাণী? তোমার শাড়ি পরার ঢং ভালো, চালিয়ে যাও। তবে আমার বাড়ির বাইরে…”
লিথু প্রথমে বোঝেনি, কিন্তু যখন বুঝল কথাটা ভিন্ন অর্থে বলেছে ইজহান ওর রাগ হলো। ইস্মিকে আড়চোখে দেখে তর্কে গেল,
“আপনার বউও তো শাড়ি পরে, তারেও কি ওমন লাগে?”
মাথায় রক্ত চড়ে গেল ইজহানের, গ্লাসে থাকা জুসটা ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে উঠল,
“ইস্মিতার সাথে নিজের তুলনা? ওর পায়ের নখের যোগ্যতা আছে তোর? আছে? গলাটা চিপে শ্বাসটা নিয়ে নেব একদম…”
তেড়েফুড়ে গেল ইজহান। ইস্মি ব্যস্ত হয়ে ওকে সামলাতে গেল, আজিজ শেখ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে লিথুকে ইশারা করলেন, ভয়ে একছুটে মিতুর ঘরে গিয়ে দোর আটকে দিলো লিথু। ইজহান গর্জন করে আজিজ শেখকে বলল,
“প্রস্টিটিউটদের মতো ব্যবহার, অঙ্গভঙ্গি! আমার ইস্মিতার সাথে তুলনা করে নিজেকে? এত্ত সাহস
পেল কই রমিজ আলীর মেয়ে? ভেড়ার গলায়
ঝুলাতে চাইছ, ঝুলাও নয়তো বাড়ি থেকে বের কর, আমি কিন্তু ছাড়ব না একে!”
আজিজ শেখ ইজহানকে উত্তেজিত হতে দেখে
ভড়কে গিয়ে বললেন,
“এমন করব না ও আর, ভুল করছে। আমি ওরে মাফ চাইতে বলব বড় বউয়ের কাছে।”
“কীসের মাফ? ইস্মিতার আশেপাশে ঘেঁষলে ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলব। কোনো মাফ নাই।”
আজিজ শেখ ইশারা করলেন ইস্মিকে। উত্তেজিত আর রাগান্বিত ইহসানকে ইস্মি জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করল। ইজহান ওর পেট জড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ডুবিয়ে রইল। ইস্মি শুধু বলল,
“রাগ কমানোর চেষ্টা করুন।”
“হয় না।”
“আপনি একটা পাগল।”
“শুধু বউপাগল।”
.
মিতু ইজহানের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ব্যস্ত। এদিকে লিথুর রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। নিজের বউ পুতপবিত্র আর অন্যরা গভীর রাতের পরী? রাগ-জেদ ওর মন এমনভাবে গ্রাস করে নিলো যে লিথু সিদ্ধান্ত নিলো ও এভাবেই শাড়ি পরবে, ইহসানের সামনে যাবে। কে কি বলল সেসব গুণবে না। তবে ইহসানের সামনে যাবে বললেই চলে না, এই লোক কখন বাড়ি থেকে বেরুয়, রাতে কখন ফেরে লিথু বুঝে উঠে না। তাই দু’টো দিন তক্কেতক্কে রইল। তাতে কাজ হলো। সামনে পড়ল কয়েকবার। বউ ছাড়া বিবাহিত পুরুষ আর আগুনের গোলা; দুটোর মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই। এরা সবসময় হল্কা ছড়ায়। এসময়টাকে কাজে লাগানো সোজা। লিথুও সুযোগ নিলো। ভদ্রসভ্য হয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল। লিথু হাসতো চোখাচোখি হলে, কিন্তু ইহসান এমন একটা ভাব করতো যেন ওর সামনে কেউই নেই। তবুও লিথু হাল ছাড়ল না। কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। এটা-ওটা করে। রাতে যখন ইহসান বাড়ি ফেরে সেসময়টাতে ইচ্ছে করে সিঁড়ির ওখানে ঘুরঘুর করে। ইহসান কিছু বলে না। লিথুর সাহস বাড়তে লাগল। একদিন তো ছোট্ট করে কাগজে চিরকুটও লিখল,
“তৃষ্ণার্ত হৃদয়টাকে একটু স্বস্তি দিতে পারো কি, শেখসাহেব?”
এরপর সেটা ইহসানের ঘরে গিয়ে বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখে এলো। পরদিন সকালে সামনে পড়তেই লিথু মনে মনে ভয় পেল, কিন্তু ইহসান কিছুই বলল না। বক্র হাসি উপহার দিয়ে চলে গেল। লিথু চমকাল, থমকাল। প্রত্যাশার চেয়েও বেশিকিছু পেয়ে সন্দেহ হলো, লেখাটা কী পড়েছে ইহসান? নাকি না? পড়লে তো কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া করতো। পজেটিভ নয়তো নেগেটিভ! কিন্তু কিছুই বলেনি, এর মানে কী? উত্তেজিত লিথু ইহসানের ঘরে গিয়ে বালিশের তলায় কাগজটা পেল। হাতে তুলে নিয়ে ওর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ইহসান শুধু পড়েইনি, লিথুর লেখার নিচে নিজেও লিখে গেছে,
‘স্বস্তিটুকুই চাই?’
অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আনন্দে লিথুর চোখে পানি চলে এলো। পাল্টা উত্তরে লিখল,
‘চাই—পুরোপুরি তোমাকে, তোমার মনোযোগকে। এরজন্য সবকিছু করতে রাজি আমি। একবার ঠাঁই দিয়ে দেখোই না শেখসাহেব!’
পরদিন এর পাল্টা উত্তর এলো,
‘প্রুফ নেব,
—রাত বারোটা।’
____
[রি-চেইক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি৷]
চলবে…