#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৭
সৃজার বেশ লজ্জা লাগছে। রাতে ঘুমিয়ে পড়ায় ফোনে লোকটার কণ্ঠস্বর শোনেনি, কিন্তু এলিজার কাছে মানুষটার উদ্বিগ্নতার খবরটুকু ওর মনটাতে আলতো করে দোলা দিয়ে গেল। অনুভবে, অনুরণে অবাধ্য মানবকে মনে করে চিত্ত শিহরিত হয়, রাগ গলে পানি হয়। গায়ে সাতশো টাকার সুতির জামা, সস্তার স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে রাখা সৃজাকে যেদিন ইহসান ওর হাত ধরে বিয়ে করতে বেরিয়ে গেছিল, সেদিন সৃজা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দ্বিধান্বিত ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে, ইহসানের পাশে যে নিরাপত্তা আর শীতল শান্তি অনুভব হয়েছিল, তা অস্বীকার করতে পারে না ও।বরং আশেপাশের মানুষজনের অপবাদকে বুড়ো আঙুল দেখানোয় ইহসানের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। বেশিকিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেনি, শুধু বিয়ে কেন করেছে, এ নিয়ে একবার প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু লোকটা কোনো সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়নি— রহস্য করে হেসে, একেকবার একেক বুঝ দিয়েছিল। কিন্তু সেদিনের স্বীকারোক্তির পর সৃজা বুঝে, ইহসান তাকে কতটা অনুভব করে, কতটা গুরুত্ব দেয়!
আর সেই অনুভূতির গভীরতায় মধুর এক আলোড়নে ভরে ওঠে ওর হৃদপিণ্ডটি। হিমেল বাতাসে রক্তের ভেতর জ্বলে ওঠে দুর্বার উত্তাপ। মৃদু শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে রক্তকণিকায়। রক্তিম মুখখানির দুর্বলতা যেন প্রকাশ না পায় সেজন্য মুখ ফিরিয়ে নেয় ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ের এক গোপন কোণে সে স্পষ্ট টের পায়, ইহসান তার ভাবনায় রঙ ছড়াচ্ছে, নিঃশব্দে, নিবিড়ভাবে।
“আই গেস, তুমি লজ্জা পাচ্ছ আপু!”
এলিজার কথায় ঘোর থেকে সৃজা অপ্রস্তুত হয়। বারান্দার ফুল গাছগুলোর মরা পাতা বেছে ফেলতে ফেলতে চকচকে মুখখানি স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা করে বলে,
“মোটেও না।”
“তুমি আসলে ভাইয়ার প্রতি উইক হয়ে পড়েছ!
যারজন্য মিথ্যে বললে সেটা তোমার চোখেমুখে ফুটে উঠে, তাই ভুল করেও মিথ্যে বলো না।”
“ইঁচড়েপাকা হচ্ছিস দিনদিন— তুই উইকের কী বুঝিস?”
এলিজা হেসে বলে,
“তুমি কি সত্যি ভাবো আমি কিছু বুঝি না? আহ, সিস্টার মাইন, ভাইয়া যদি তোমার জন্য এভাবে পাগলপারা হয়ে ঘুরে, তাহলে একটু তো বুঝবই!”
সৃজা এবার গাছের শুকনো পাতাগুলো একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“তুই যা, নিজের পড়াশোনা কর। এত জ্ঞান দিতে হবে না আমাকে।”
এলিজা ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্টু হাসে। ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করে কল লিস্টের প্রথম নাম্বারটিতে। এরপর সেটা সৃজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। সৃজা ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে ইহসানের গলা শোনা যায়, খানিক কর্কশ, খানিক উত্তেজিত। যেন অপেক্ষাতেই ছিল,
“সৃজু বলছিস?”
সৃজা চোখ বন্ধ করে হালকা শ্বাস নেয়। শব্দহীন, কিন্তু গভীর অনুভূতিতে ধীর স্বরে বলে,
“হুম।”
ইহসান একটু হাসে, সেই হাসির মধ্যে একটা
চাপা অভিমান মিশে থাকে।
“তোর একটা ‘হুম’ শুনতে সারা রাত অপেক্ষা
করেছি, জানিস?”
“উহু।”
ব্যাকুল চিত্তে বলে ইহসান,
“উফ! তোর কণ্ঠের পাণিপ্রার্থী আমি জান, কিন্তু
এখন ভীষণ ব্যস্ত। কিছু একটা বল। হাতে সময় নেই। রাতে কথা হবে। রাগ করে থাকিস না, কিছু বল…”
উচাটন কণ্ঠস্বরকে থামাল সৃজা,
“রেগে নেই আমি, কাজে মন দাও। ফোনের
অপেক্ষায় থাকব।”
.
বাড়িতে সৃজা নেই, তাই ইহসান ইদানীং রাত করেই ফেরে। আজ ফিরল সাড়ে দশটায়। শেফালি বুয়া ওর অপেক্ষায় ঝিমুচ্ছিল, ফিরতেই খাবার গরম করে ঘরে দিয়ে গেল। ইহসান বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, বলতে গিয়েও বলল না সে। একজন তারজন্য না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করেছে, তার দামটুকু সে দিলো। শেফালি বুয়া চলে গেলে ও দু-লোকমা খেয়ে নিলো। বাকিটা ঢাকা দিয়ে রাখল। একটা মেইল আসার কথা, ইহসান ল্যাপটপ খুঁজল তার। পেল টেবিলের ড্রয়ারে। চার্জ নেই, তাই চার্জে বসিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার আশায় বিছানায় পিঠ ঠেকাল সে। এরমধ্যেই ফোন বেজে উঠল৷ সৃজার ফোন। রিসিভ হতেই
দু-একটা কথার পর জিজ্ঞেস করল,
“খেয়েছ?”
“দু’বার ডিনার সারলাম!”
সৃজা বিস্মিত হবার ভান করে বলল,
“বাবাহ! আমি নেই দু’বার করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে? এমনিতে তো বলে-কয়েও এক প্লেট ভাত বেশি খাওয়াতে পারি না।”
ইহসান নাটুকে স্বরে বলল,
“কী আর বলব বল! তুই যাওয়ার পর থেকে, শরীরে জোর পাই না, উঠে দাঁড়াতে গেলে মাথাটা ঘুরে। বমি বমি পায়। চোখে অন্ধকার দেখি! আসল খাওয়াদাওয়া হচ্ছে না, পুষ্টি পাচ্ছি না তো। তাই নকলটা দিয়ে কভার করা চেষ্টা মাত্র, এই যা!”
সৃজা বেলাজ কথাগুলো শুনে রেগে যেতে গিয়েও গেল না। তীক্ষ্ণ স্বরে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“বাবু আসবে মনে হচ্ছে।”
“কার?”
“লক্ষ্মণ যেহেতু তোমার দেখা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে তোমারই।”
বাকরুদ্ধ বনে গেল ইহসান। হজম হলো না কথাটা। চেঁচিয়ে ধমকে উঠল সে,
“এসব কী কথাবার্তা রে সৃজা? কোথা থেকে শিখলি? তুই তো এমন নোস! মুখেও আনবি না ওসব অযাচার। ভুলে যাস না আমি ভদ্রলোক, ওসব কর্মকাণ্ড আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”
“কে যেন লাল পানি খেয়ে লাউঞ্জে মাতলামি করেছিল?”
“শাট আপ।”
সৃজা ধমক খেয়ে মনে মনে প্রমাদ গুণল। অভিমান টানল গলায়। অস্ফুটস্বরে বলল,
“তুমি একটা খারাপ লোক। আমাকে শুধু ধমকাও, নিজে যখন উল্টাপাল্টা বলে মজা নাও তখন আমি এভাবে তোমাকে ধমকাই? নিজের ষোলো আনা চাই, আর মানুষের বেলায় এক আনা-ও নিতে পারবে না।”
“তুই আমার কত আদরের! তুইবিহীন ওসব ষোলো আনা টোলো আনা ভিত্তিহীন…”
“হুহ! আমাকে ভুলানোর ধান্ধা! মুখে মধু অন্তরে বিষ, মাথাভর্তি স্বৈরাচারী আর শয়তানি বুদ্ধি তোমার।”
ইহসান এ কথা শুনে হেসে ফেলল। অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আচমকা গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এত তাড়াতাড়ি চিনে ফেললি আমায়?”
সৃজা কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা বুঝে উচাটন হলো। হৃদমঞ্জিলে ব্যাকুল হাওয়া টের পেল। ফিসফিস করে বলল,
“ফেললাম যে!”
“তাই?”
“হুম।”
ইহসান উৎকণ্ঠিত অস্থিরতা নিয়ে এবার শুধায়,
“প্রেমে পড়েছিস?”
“সেতো কবেই।”
“ভালোবাসিস?”
জবাবে লজ্জা কাতুরে সৃজা নিরুত্তর রইল। ইহসান মিনিটখানেক অপেক্ষা করে আশানুরূপ জবাব না পেয়ে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই সৃজা আবারো ফিসফিস করে সাড়া দিলো,
“বাসি তো, ভালোবাসি।”
ইহসান তীব্র গলায় বলল,
“তাহলে বলব ভালোবেসে অন্ধ হয়েছিস তুই,
চিনতে পারিসনি আমায়।”
“কেন?”
“চিনলে ভালো দূর, প্রেমেও পড়তি না।”
“আচ্ছা, এত খারাপ তুমি?”
ইহসান শ্লেষাত্মক হেসে বলল,
“খারাপ, উহু! অতিরিক্ত ভালো—তবে জানিসই তো অতিরিক্ত ভালোও ভালো নয়।”
সৃজা আগামাথা বুঝল না কথার। জিজ্ঞেস করতে যাবে এসব কথার মানে কী, তখনই প্রসঙ্গ বদলে ফেলল ইহসান,
“পড়াশোনার কি অবস্থা, ভার্সিটি যাচ্ছিস?
তোর না এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার ডেইট পরশু!”
সৃজা ভাবলেশহীন স্বরে বলল,
“তোমার ঘাড়ে যখন চাপিয়েছ, আমার সব দায়িত্ব তোমারই। অহেতুক পড়াশোনার এত চাপ নিয়ে মস্তিষ্কের বারোটা বাজাতে চাই না, এবার একটু
পানাহ চাই। লেখাপড়া আর করব না ঠিক করেছি।”
ইহসানের দৃঢ় ও বিস্মিত কণ্ঠস্বর,
“সিরিয়াস তুই?”
“তোমার কি মনে হচ্ছে?”
“কিছুই মনে হচ্ছে না, আবার হচ্ছেও!”
“মানে?”
“দেখ, তোর ভাবনায় একচোখামি পাওয়া গেছে। তুই শুধু মস্তিষ্কের কথা ভাবছিস, শরীরের কথা ভাবছিস না। আমি বলি কী! তোকে যদি একেবারে পঙ্গু বানিয়ে রেখে দিই তাহলে সাময়িক কষ্ট হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তোর কষ্ট কমবে। পড়াশোনার জন্য তোর মস্তিষ্ক আর শরীর কোনোটাকেই চাপ নিতে হবে না। উল্টো আমার ঘাড়ে যখন চাপিয়েছি, তখন ঘাড়ে বসে বসেই না-হয় আরাম-আয়েশ করবি, বাচ্চা-কাচ্চা পালবি, সংসার সামলাবি। আইডিয়াটা ভালো না?”
আহাম্মক বনে গেল সৃজা। সে তো এমনি এমনিই কথাটা বলেছে। এসাইনমেন্ট জমা করার লাস্ট ডেইট পরশু, অবশ্যই যেতে হবে ভার্সিটিতে। কিন্তু যাবে বললে ইহসান বাইক নিয়ে চলে আসবে ড্রপ করতে। যেটা ও চায় না। তাছাড়া সৃজা চেয়েছিল ভার্সিটি শেষে একবার রেস্তোরাঁয় ঢু মেরে ইহসানকে চমকে দিয়ে আসবে। অথচ এই লোক দেখ কেমন করে ওর সাথে কথা বলছে, ঠাণ্ডা স্বরে হুমকি দিচ্ছে! সৃজা কটমট করে বলল,
“আমাকে পঙ্গু বানিয়ে লিথুরাণীকে নিয়ে বাইকে
চড়ানোর মতলব কষছো বুঝি? শত হলেও এক্স হবু স্ত্রী তোমার…”
সৃজা ভেবেছিল ইহসান এ কথা শুনে ক্ষেপে যাবে। কিন্তু তা হলো না। ওকে অবাক করে দিয়ে ইহসান
নিচু স্বরে বলল,
“মন্দ বলিসনি।”
সৃজা বিস্মিত হলো প্রথমে এরপরে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। রাগারাগি করে একাকার হয়ে গেল। ইহসান এসব কিছু পাত্তা না দিয়ে শুধু বলল,
“রাগের বারুদ আমার উপর না ঝেড়ে বরং আমার আইডিয়াটা ভেবে দেখিস, শুভরাত্রি!”
.
লিথু নিজের উত্তেজনা সামলাতে পারছে না। সে খুশিতে ডগমগ। সবচেয়ে বড় কথা ওর এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না ইহসান তাকে সিগন্যাল এএক্সেপ্ট করেছে। এর মানেটা খুব ভালোভাবেই জানা আছে লিথুর। আবারো প্রমাণিত হলো, পুরুষমানুষ নারীসঙ্গ পাবার জন্য বহুদিন অপছন্দের তালিকায় ফেলে রাখা কারো প্রতিও দুর্বল হয়। লিথুর অবশ্য ধারণা, ইহসান তার নতুন রুপ মানে শাড়ি পরা রুপ দেখেই গলেছে। অবশ্য গলবে না-ই বা কেন? শাড়িতে
তাকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চেয়ে কম কিছু লাগে নাকি? সাথে যদি বারগেণ্ডি খোলা চুল আর ঝকঝকে, তকতকে, কোমল লতানো দেহখানা দ্যুতি ছড়ায় তাহলে তো চোখ ফেরানোই দায়! সারাটা দিন লিথুর কাটল উত্তেজনায়। বিকেলের দিকে স্যালুন থেকে একপাক ঘুরেও এসেছে। মিতু বোনকে ওমন হাসিখুশি দেখে কাহিনী কী জিজ্ঞেস করলে লিথু এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে , এড়িয়ে গেছে। বোনকে এটা-সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। ইহসানকে সে পটিয়ে ফেলেছে এটা সারপ্রাইজ হিসেবে থাকুক, আগে সব সেটিং করে নিক। এরপর বলবে। তার আগে অনেক কাছাকাছি যেতে হবে ইহসানের, যাতে চিরজীবনের জন্য বাঁধা পড়তে বাধ্য হয়।
যদিও লিথুর বাবা রমিজ আলী আজিজ শেখকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন, শেখ বাড়িতে তার ছোট মেয়ে বউ হয়ে না গেলে কোটি টাকার ব্যবসা ভাঙবেন তিনি। তবুও মেয়ের পছন্দের হেলাফেলা করবেন না। কিন্তু কাজ হচ্ছেটা কই? বুড়ো ভাম আজিজ শেখ আছে শুধু তার ব্যবসা বাড়ানোর ধান্ধা নিয়ে, এদিকের কোনো খেয়ালই নেই! তার নজর শুধু রমিজ আলীর সম্পত্তির দিকে। রমিজ আলী যুবক বয়স থেকেই ধান্ধা করে বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। মানুষকে টাকা ধার দিয়ে, অসহায়কে জিম্মি করে, সু’দের ব্যবসা করে আজ প্রচুর টাকার মালিক তিনি। গাড়ি-বাড়ি কিছুর অভাব নেই তার। অভাব শুধু একটা জিনিসেরই, পুত্রসন্তান! কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স ব্যবসা ভোগ করার মানুষ থাকলেও দেখাশোনা করার মতো উত্তরাধীকার নেই তার। দুটো মেয়ের পিতা হবার পর তৃতীয়বার স্ত্রীর গর্ভে ছেলেসন্তানই এসেছিল, কিন্তু সে সন্তান টেকেনি।ডেলিভারির সময় মারা যায়, সেইসাথে ভুল চিকিৎসার দরুণ তার স্ত্রীও মা হবার ক্ষমতা হারায়। যদিও রমিজ আলী অর্থলোভী মানুষ কিন্তু নারীবাজ নন। পুত্রসন্তান নেই বলে বহু জনই তাকে অতীতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। মেয়েদেরকেই অতিরিক্ত আদরে বাঁদড় বানিয়েছেন। কিন্তু কোনোটাই দায়িত্ব নিতে শিখেনি, শিখেছে সাজগোজ আর পয়সা উড়ানো! রমিজ আলী অবশ্য বাঁধা দেননি বরং শিখিয়েছেন ভোগ-বিলাসিতা। তবে বয়স হবার সাথে সাথে তার মাথায় সম্পত্তি কে সামলাবে, এ নিয়ে চিন্তা এসেছে৷ তার অবর্তমানে মেয়েদুটো এসব সামলাতে পারবে না। যে-কেউ ঠকিয়ে সব হাতিয়ে নেবে! এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকেই তিনি মেয়েদের পাশে চেয়েছিলেন এমন কাউকে, যে সবকিছুর দায়িত্ব নিবে কিন্তু তার মেয়েদের ঠকাবে না। দুই কন্যার মাঝে আর ছোট কন্যা লিথু তার বড়ই আদরের। সেজন্যই তার ইচ্ছে ছোটকন্যা লিথুকে সারাজীবন নিজের কাছেই রাখবেন। জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন ঘর জামাই রাখবেন। ব্যবসায় সূত্রে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজিজ শেখের সাথে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং আত্মীয়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ আজিজ শেখ নিজেই ধনী, আবার তার ছেলেগুলোকেও বেশ পছন্দ রমিজ আলীর! বিশেষ করে বড় দু’জন, টাকাপয়সার প্রতি তেমন লোভ নেই তাদের। তাছাড়া তাদেরও কম সম্পদ নেই, বরং অনেক আছে। তাই নিজের কোটি টাকার সম্পত্তির রক্ষার আশায়, ব্যবসার খাতিরে আজিজ শেখকে প্রস্তাব দিলে তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়তে সম্মত হয়েছিলেন।
প্রথমে মিতুর সাথে ইহসানের বিয়ের আলাপ তোলা হয়েছিল, কিন্তু নিজের মন-মর্জির মালিক ইহসান তখন কঠোর ও স্পষ্ট স্বরে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেয়, এদিকে ইজহানও ততদিনে ইস্মিকে বিয়ে করে নিয়েছিল। তাই পরবর্তীতে মিতুর বিয়ে হয় ইমরানের সাথে। বড়বোন মিতুর বিয়েতে লিথু ইহসানকে দেখেনি, দেখেছিল বৌভাতে এসে। সাদা পাঞ্জাবি পরা ইহসানকে দেখেই প্রেমে পড়ে যায় লিথু। এই মানুষটার হাঁটাচলা, কথা বলা, ব্যক্তিত্ব সবকিছুই তার মন কাড়ে। কথিত আছে, নিষিদ্ধ জিনিসে মানুষের আগ্রহ বেশি। ঠিক তেমনি লিথুও আরো বেশি আগ্রহী হয়, যখন জানতে পারে ইহসানকেই তার বাবা পছন্দ করেছিল মিতুর জন্য, দিয়েছিল বিশাল সম্পত্তি সামলানোর প্রস্তাব। কিন্তু মোটেও তাতে আগ্রহ দেখায়নি বরং বিরক্ত হয়েছিল ঘর জামাই হবার প্রস্তাব পেয়ে। শুনে লিথু আগ্রহী হয় ইহসানের প্রতি। কৌতূহলী হয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে অন্য কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক নেই ইহসানের, তেমনি সে কোনো বেহুদা মেয়ের প্রতি আগ্রহও দেখায় না। সব মিলিয়ে লিথু দুর্বল হয়ে পড়েছিল আচমকাই ইহসানের উপর। তখন অবশ্য লিথুর নিজেরও রানিং চারটে বয়ফ্রেন্ড ছিল, মাস ছয়েকের মধ্যেই তাদের সাথে সম্পর্কের ইতি টানে লিথু। এরপরে যদিও কয়েকবার স্বভাবের দোষে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে, কিন্তু মনেপ্রাণে জীবনসঙ্গী হিসেবে ইহসানকেই চেয়েছে সে। সবসময় ওর সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে রেখেছে! বাবাকে বুঝিয়েছে ঘর জামাই আনতে হবে না, সে স্বামীর ঘরই করবে। তবে স্বামীটা হতে হবে ইহসানকেই। রমিজ আলী অসন্তুষ্ট হলেও মেয়ের জেদ মেনে নেন! লিথুর এ বাড়িতে আসার মূল কারণই ছিল ইহসান। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ইহসানকে গোলাপ আর ব্র্যান্ডেড ঘড়ি দিয়ে প্রপোজ করেছিল, কিন্তু সেগুলোর জায়গা হয়েছিল ডাস্টবিনে। তা দেখে ক্রন্দনরত সুরে লিথু জিজ্ঞেস করেছিল ইহসানকে, সে কেন এমন করল; জবাবই দেয়নি ইহসান।
কতবার, কত রকমভাবে ইহসানকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করেছে, হিসেব নেই। কিন্তু কাজে দেয়নি কিছুই। এক বছর আগে, ব্লু বার্ড আবাসিক হোটেল থেকে বয়ফ্রেন্ড তপনকে নিয়ে বেরিয়ে যখন গাড়ির অপেক্ষা করছিল, ইহসান তখন রিকশা করে ওদিকেই কোথাও একটা যাচ্ছিল! সে—কথা মনে পড়লে আফসোস হয় লিথুর, সেদিন নিশ্চয় ইহসান ওকে দেখে ফেলেছিল তপন উল্লুকটার সাথে; যারজন্য ওর এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। লিথু সব ভেবে হতাশ হয়ে বালিশে মুখ চেপে ধরে! পরক্ষণেই নিজের ভেতর ক্রোধের আগুনে জ্বলতে থাকা লিথুর মাথায় নানাবিধ পরিকল্পনা ঘুরপাক খেতে শুরু করল! আজ একবার যদি ইহসানকে সে বশ করতে পারে তাহলে দু’জনের মাঝে আর দূরত্ব তৈরি করার সুযোগ দেবে না। এমনভাবে আঁকড়ে ধরবে যেন সৃজাটার থেকে মনমুখ ফিরিয়ে নেয়। এতদিনে কম তো চেষ্টা করেনি সৃজাটাকে রাস্তা থেকে সরাতে, উচিৎ শিক্ষা দিতে। কিন্তু কী যেন, বারবার বিফল হয়েছে ওর সব চেষ্টা। এ নিয়ে লিথুর অবশ্য দুঃখ আছে। সৃজাটাকে মেরে ফেলতে পারলে ও বেশি শান্তি পাবে! তবে এরচেয়ে বেশি প্রশান্তি পাবে যখন ইহসান পুরোপুরি ওর হয়ে যাবে, ওকে ছাড়া কিছুই বুঝবে না৷ আর নাগিনী সৃজা সেটা দেখবে, জ্বলবে, কিন্তু ও কিছুই করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না! এই সৃজাকে সে বেশ দুর্বল প্রবৃত্তির মনে করে এ বাড়িতে ওকে জ্বালাতে এসেছিল, কিন্তু দিনশেষে নিজেই জ্বলেছে, অপমানিত হয়েছে। নিজের রুপ-গুণ কিছুই কাজে লাগাতে পারেনি। অবশেষে পেরেছে, এই সময়-সুযোগের অপেক্ষায়ই তো ছিল!
________
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে – ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৮
সোনালি রঙের কারুকাজ খচিত ব্লাউজের সঙ্গে লাল রঙের হাফ সিল্ক শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে লিথু। সঙ্গে কানে বড়ো ঝুমকো আর গলায় ডায়মন্ড পাথরের হার। বারগেন্ডি চুলগুলো সাইড সিঁথি করে খোঁপায় বাঁধা। ভারী মেকআপ আর লাল লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো শেষ করে নিজেকে আয়নায় দেখে হাসল লিথু। চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে! এমন সাজে যেকোনো পুরুষই ঘায়েল হতে বাধ্য, ইহসানও
নিশ্চয় ব্যতিক্রম হবে না। আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ মন নিয়ে লিথু টিস্যু দ্বারা চোখের কোণের হালকা বেঁকে যাওয়া কাজলটুকু মুছে নেয়। বুকের ভেতর টগবগ করা অনুভূতি আর আনন্দে তার হৃদয় আটখানা হয়ে আছে। লিথু ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটা বাজতে পনেরো মিনিটের মতো বাকি। কিন্তু লিথুর ধৈর্য হচ্ছে না এই পনেরো মিনিটের সময়টুকু। কখন সে কাঙ্খিত মানুষটাকে নিজের রুপে ঘায়েল করবে সেই চিন্তায় অস্থির সে। লিথু উচাটন হয়ে শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় সে।
আঁচলটা সরু করে কাঁধের উপর রেখে কুচি ঠিক করে
নেয়। টেনে বাঁধা খোঁপাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে মুচকি
হেসে বলে,
“দারুণ লাগতেছে!”
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ঊনপঞ্চাশে যখন টিকটিক করছে তখন লিথু দরজা খুলে ঘরের বাইরে এলো। আস্তেধীরে দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দেয় ও৷ সারাবাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে। কোনো আওয়াজ নেই কোথাও। সবাই যে যার ঘরে ঘুমুচ্ছে। শুধু জেগে আছে তারা দু’জন। ভেবেই লিথুর মন শীতল হয়ে উঠে। বসার ঘরে অল্প পাওয়ারের টিমটিমে হলদে বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে চোখ সয়ে নিয়ে লিথু দোতলার সিঁড়িতে পা রাখে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে একেকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠার চেষ্টা করতে থাকে; তবে গয়নাগাটির রিনঝিন করতে থাকা সূক্ষ্ম শব্দ সেই নিঃশব্দতা ঠিকঠাক আনতে পারে না। লিথু ইহসানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বুক টেনে শ্বাস নেয়। চওড়া হাসি আর উত্তেজনায় বুকের ভেতর জোরালো শব্দ হতে থাকে। লিথুর মনে হয় সে কল্প জগতে আছে, তবে সেই জগতের সব সত্যি। চুড়ি পরা কম্পিত হাতে সে দরজায় টোকা দেয় কয়েকবার। ভেতর থেকে পদশব্দ শোনা যায়, ভেসে আসে পছন্দের পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
“কে?”
ফিসফিসিয়ে বলে লিথু,
“আমি!”
দরজাটা খুলে সময় নিয়ে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ট্রাউজার-টিশার্টের আবরণে জড়িয়ে রাখা লম্বা পুরুষালি অবয়ব। যার কপালে ছড়িয়ে আছে চুল, যার চোখজোড়া শাণিত। চোয়াল শক্ত। চোখজোড়া কেমন উদ্ভ্রান্ত। হয়তো ঘুমাচ্ছিল! ইশ, ঘুমালে কোনো মানুষকে এত সুন্দর, এত আবেদনময় লাগে? ইহসানকে কেন লাগছে? উফ! লিথু পাগল হয়ে যাবে। ঐ শাকচুন্নি সৃজা এতদিন ওর রুপ উপভোগ করেছে, লিথুর বুক জ্বলে। ওকেহ! এতদিন দেখেছে দেখুক, আজ থেকে শুধু সে দেখবে। ভেবেই
অতি সুখে লিথুর বুকে প্রজাপতি উড়ে, ছুঁয়ে দিতে
আকুলতা ঘিরে ধরে ওকে। ব্যগ্র হয়ে বলে,
“আসতে বলছিলা তুমি।”
সৃজার সাথে কথা বলে ক্লান্ত থাকায় কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টের পায়নি ইহসান, সত্যিই সে ঘুমাচ্ছিল। নিদ্রাজড়িত চোখে সে তখনো লিথুর সাজগোজ দেখেনি, খেয়াল করেনি ওর ব্যাকুল চেহারা। বরংচ লিথুর কথা শুনে নিজের ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“কখন?”
“বারোটায়।”
“এখন ক’টা?”
“এগারোটা পঞ্চান্ন, আগেই আসলাম আরকি! তুমি
কাগজে লিখছিলা…”
এই তাহলে কাহিনী! ইহসান ভুলেই গেছিল! মনে পড়ায় ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে। লিথু ওর উপেক্ষা টের পেয়ে কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়। পরক্ষণেই মাথায় কুবুদ্ধি হানা দেয়, নড়েচড়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। বারবার কানের পাশে চুল গুঁজার ভান করে। ওর এমন অস্বাভাবিক ভনিতা দেখে ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে। এ এমন করছে কেন? আশ্চর্য! তখনি চোখ পড়ে ওর সাজসজ্জার দিকে, পোশাকের দিকে। আপাদমস্তক লিথুকে দেখে এ পর্যায়ে বিস্মিত হয়ে যায়। পা থেকে ব্রহ্মতালু সব জ্বলতে থাকে। লিথু ওর দৃষ্টি খেয়ালে নিয়ে লাজুক হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন লাগতেছে?”
ইহসান কোনো জবাব না দিয়ে ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত একটা বাঁকা হাসি ফুটাল। দরজার পাল্লায় হাত রেখে তাকিয়ে রইল লিথুর দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল জানে না লিথু, কিন্তু ওর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলো মুহূর্তে। লিথুর গালে আভা ছড়ায়। ইহসানের হাসিতে ওর তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, বেহায়ার ন্যায় তাকিয়েও থাকে। পলক ফেলে না। ইহসান ওকে এভাবে তাকাতে দেখে রাশভারি কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“তোমার চোখ কি আমার মতোই নষ্ট লিথু?”
লিথুর পাগল পাগল লাগে, ইহসান এত নম্রস্বরে ওর সাথে কথা বলছে বিশ্বাসই হতে চায় না ওর। তীব্রভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“এইখানে দাঁড়ায় কথা বলবা নাকি ভিতরে আসমু?”
“ভিতরে আসবে, কিন্তু কেন?”
লিথু অবাক হয়,
“তুমি যে বলছিলা…মানে প্রুফ নিবা…”
ইহসান মনে পড়ে যায় লেখাটা। সে হেসে বলে,
“স্পেশাল, হুম! প্রুফটা তোমার জন্য খুবই স্পেশাল হতে চলেছে, তাই সেটা তেমনি কোনো স্পেশাল জায়গায় নিতে হবে, এই ঘরটা স্পেশাল না।”
লিথু তাৎক্ষণিক জবাব দেয়,
“কে বলছে, এইডা তোমার ঘর, স্পেশালই।”
ইহসান নাকচ করে,
“উহু! এইখানে প্রুফ নেওয়া যাবে না।”
ইহসানের কথার পৃষ্ঠে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে না লিথু, জিজ্ঞেস করে,
“তাইলে?”
ইহসান নম্র কণ্ঠ টেনে বলে,
“আমার একান্ত, খুব প্রিয় একটা স্পেশাল জায়গা আছে। সেখানে শুধু আমার স্পেশাল মানুষদেরই নিয়ে যাই। ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাজিটেট, তুমি চাইলে
নিয়ে যাব…”
লিথুর বুক ডগমগ করে উঠে। সব স্বপ্ন মনে হয়। ইহসান ওকে স্পেশাল জায়গায় নিয়ে যাবে, ওকে স্পেশাল ভাবছে? আশাই তো করেনি সে এসব।
লিথু একবারো ভাবে না, না ভেবেই যেতে সম্মতি প্রকাশ করে। ইহসান ওর সম্মতি পেয়ে আগের ন্যায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে,
“ওয়েট…”
লিথুকে নিজ ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেয় না ইহসান। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে লাল শাড়ি গায়ে জড়ানো নারী এতে কিছু মনে করে না। সবকিছু পেয়ে যাওয়ার আনন্দ অনুভবে সে বিভোর। এই নিশিরাতে স্বপ্নময় দুনিয়া তাকে তার জীবনের আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দিচ্ছে, এরচেয়ে বেশি আর কী চাইবে ইহসানের কাছে?
পরণের কাপড়চোপড় বদলে ইহসান কাঠের আলমারিটা খুলে। চার তাকের সবচেয়ে নিচের অংশের ড্রয়ারটা খুলে ফাইলপত্র সরায় সে। নিচে থাকা আরেকটা গোপন ড্রয়ার খুলে। সেখানে একটা লকার। ভালো করে না দেখলে বা খুঁজলে কেউ কখনো বুঝতে পারবে না এখানে গোপন কিছু আছে! লকারের কপাটে আঙুল ছুঁইয়ে এক মুহূর্ত থামে ইহসান; তারপর চাবি ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে। অন্ধকার ফাঁকা জায়গাটায় হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা খোঁজে… নেই! মুহূর্তেই ইহসানের কপালে ভাঁজ পড়ে। হাতটা আরেকটু ভেতরে নিয়ে যায়, দ্রুত সরায় সারি সারি ফাইলগুলো, কিন্তু পায় না। ইহসান ঠোঁট চেপে শক্ত করে দাঁতে কামড় বসায়, গলার শিরা ফুলে ওঠে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণের শেষ সীমায় পৌঁছাতেই ড্রয়ারটা একটানে খুলে বের করে। ধুলো জর্জরিত ড্রয়ারে অসংখ্য কাগজপত্র, পেপার কাটিং, অ্যালবাম, ভাঙা কাচের চুড়ি, কাপড়ের ছেঁড়া অংশ, শুকনো ফুল, নীল মলাটের ডায়েরি সরানোর পর ধাতব বস্তুটার স্পর্শ টের পায় সে। খুব ধীরগতিতে আঙুল বুলিয়ে নেয় বস্তুটার ওপর। তারপর… শক্ত করে মুঠো বন্ধ করে তুলে আনে সেটা। চকচক করে ওঠে কালো রঙের ঠান্ডা, ধাতব, মসৃণ বস্তুটা। মুহূর্তেই ওর চোখজোড়া জ্বলে ওঠে, ঠোঁটের কোণে অস্বাভাবিক একটা হাসি খেলে যায়। পরক্ষণেই চট করে সেটা গুঁজে নেয়। এরপর বাকিসব জিনিসগুলো ঝেড়েমুছে, যত্ন করে আগের মতোই গুছিয়ে রেখে দেয় সে। অ্যালবামটা রাখার সময় সেটা একবার খুলে দেখে। বহুদিনের পুরোনো একটি ছবি খুঁজে মনোযোগ দিয়ে। পেয়েও যায় মধ্যিখানের পাতায়। ইহসান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে। তাকিয়ে দেখতে গিয়ে প্রতিবারের মতো রাগ- অভিমানে গিলে নেয় ওকে। ইচ্ছে করে সব শেষ করে দিতে। উত্তপ্ত মেজাজ আর বিতৃষ্ণা নিয়ে শব্দ করে অ্যালবাম বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে লকার আঁটকে দেয়। সব গুছিয়ে আলমারি বন্ধ করে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে নিজেকে স্থির করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখনই বেরিয়ে যায়, খেয়ালই করে না পেছনে কিছু আছে। মেঝেতে অজান্তে উল্টে যাওয়া একটা ডুয়ো ছবি পড়ে, যেটা হাওয়ায় উড়ে ততক্ষণে সোফার নিচে ঘাপটি মেরেছে!
.
নির্জন নিশীথ। বাড়িসুদ্ধ লোক ঘুমে। ইহসান বেরিয়ে পড়ে লিথুকে সঙ্গী করে। দারোয়ান টুলে বসে ঝিম ধরে ঘুমিয়ে উচ্চস্বরে নাক ডাকছে। ইহসান তাকে ডাকে না, লিথুকেও ইশারায় বোঝায় শব্দ না করতে। উত্তেজিত লিথু ওর কথা মেনে নেয়। ইহসান পুরোনো লেটারবক্স থেকে পকেট গেইটের চাবিটা বের করে আস্তেধীরে গেইট খুলে। যথাসম্ভব শব্দ না করে অতি সাবধানে বেরিয়ে আসে। ইহসান লিথুকে অনুসরণ করতে বলে, সে তা-ই করে। ফুটপাত ধরে হেঁটে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে আসে ওরা। কিছুটা হাঁটতেই আচমকা সামনে একটা গাড়ি এসে থামে। লিথু ভড়কে যেতেই ইহসান ওকে অবাক করে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে বলে। লিথু সারপ্রাইজ ধরে নিয়ে বরফের মতো গলে যায়, কোনো প্রশ্ন না করে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসে। ইহসান চালককে বিদায় করে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। লিথু একটু বিষন্ন হয় ইহসানের পাশে না বসতে পারায়, কিন্তু ততোটা পাত্তা দেয় না।। সবটাতে ওর অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ফিল হয়। গাড়ি স্টার্ট
হয়ে হাইওয়েতে উঠে। ইহসান একমনে ড্রাইভিং করে, লিথুর ইচ্ছে করে ওর সাথে গল্প জমাতে। কিন্তু পাছে রেগে না যায় তাই অনেকক্ষণ কোনো কথা হয় না। নেশাক্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে স্টিয়ারিং ধরে রাখা লম্বা আঙুলগুলো, রগে ভেসে থাকা ফর্সা হাতের পিঠ, পুরুষালি পশমাবৃত হাতটায়।
ভিসর মিররে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে থাকে শাণিত মুখটা৷ এক মোহচ্ছন্ন ঘোরে ডুবে যায় সে। ইহসান যখন বা-হাতে ভিসর মিররটা ঘুরিয়ে দেয় তখনো লিথুর ঘোর কাটে না।
সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আকাশ-কুসুম ভাবনায় বিভোর!
ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালানোর পর, ইহসান গন্তব্যে পৌঁছে। গাড়িটি একেবারে নির্জন ফ্যাক্টরি এলাকায় থামায়। পুরোপুরি জনশূন্য পরিবেশ, একেবারে শুনশান। কোথাও কোনো প্রাণী নেই, চারপাশ নিঃস্তব্ধ! ইহসানের চোখজোড়া শীতল—সে লিথুকে নামতে বলে। লিথু গাড়ি থেকে নামতে যায়। কিন্তু মাটিতে পা রাখতেই হিল জুতো বেঁকে গিয়ে সে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ঠিক তখনই ইহসান এসে ওকে হাত ধরে স্থির করে। লিথু গদগদ হয়ে যায়, তার বুকের ভেতর শিহরণ ছোটে। লিথুকে অনুসরণ করতে বলে ইহসান এগিয়ে যায়, আর লিথু বিনা বাক্যে ওর পিছু নেয়। ওর শরীরের প্রতিটি কোষ যেন আনন্দে জেগে ওঠে, খোলামেলা শাড়িটা ধীরে ধীরে কাঁধের আরো উপরের দিকে উঠিয়ে নেয়। পরিত্যক্ত এসিড ফ্যাক্টরিতে তালা খুলে প্রবেশ করে ইহসান৷ ভেতরে প্রবেশ করে লিথু ডগমগ হয়ে একটা চেয়ারে হাফ ছেড়ে বসে। তার ক্লান্ত লাগছে এতটুকু পথ হেঁটেই। একটু রেস্ট নিয়ে সে চারপাশটা দেখে। এখানে ওখানে যন্ত্রপাতি, মরচে ধরা ধাতু, এবং ভাঙা দেয়াল, কাচের বড় বড় বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঝে এবং দেয়ালে এসিডের দাগ আর কেমিক্যাল গ্যাসের তীব্র গন্ধ ভারী করে রেখেছে বাতাস। সব কিছু নোংরা, ক্ষয়প্রাপ্ত, এবং বিপজ্জনক—এখানে কেন নিয়ে এসেছে ইহসান? এটা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার মতো জায়গা কোনো? লিথুর বিরক্ত লাগে এ পর্যায়ে! নাকমুখ কুঁচকে বলেই ফেলে,
“এইডা কোনো জায়গা হইলো? আমারে বলতা,
ফাইভ স্টার বুক কইরা নিতাম…”
ইহসান টুলে বসে, তার শরীর একদম সোজা। হাত দুটো পকেটে, মাথা সামান্য নিচে, চোখগুলো একদম স্থির, ঠান্ডা দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। তার সারা শরীর এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে, কিন্তু বাহ্যিকভাবে সে একদম শান্ত। মুখের আদল পাথরের মতো শক্ত, চোখে কোনো অনুভূতি নেই। আচমকা এক হাত মাথার পেছনে রেখে, অস্থির দৃষ্টিতে হালকা হাসি দিয়ে, গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে কীভাবে চাও?”
ইহসান সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেছে! ভেবেই মনে
দোলা দেয় লিথুর, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জবাব দেয়,
“সবভাবেই, আমি তোমারে ভালোবাসি।”
তির্যক প্রশ্ন ছুঁড়ে ইহসান,
“কতটুকু ভালোবাসো?”
“অন্নেক!”
“সেতো মুখে বলেই চলেছ, মুখের কথার প্রমাণ দিতেই তো সঙ্গে এসেছ, অ্যাম আই রাইট?”
ইহসানের শীতল গলা। লিথু অজানা অনুভূতিতে হারাতে হারাতে বলে,
“প্রমাণ হিসেবে তুমি কী চাও? যা চাইবে তাই দেব।
ইহসান ক্রুর হাসে,
“দিতে গিয়ে আবার মন পাল্টে ফেলবে না তো? আমি কিন্তু রেগে যাব, তখন কিন্তু জোর করে হলেও প্রমাণটুকু নিয়ে নেব।”
ইহসানের কথা শুনে লিথু দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“তোমারে যখন দিব বলছি, তহন দিবই। নড়চড় হইবে না কথার।”
“ভুলে যাবে না তো?”
“সই-সাবুদ লাগব? নিবা?”
ইহসান ঘাড় বাঁকা করে শাণিত চোখে তাকায়। আচমকা হেসে উঠে উচ্চস্বরে,
“মকবুলের মাকে হাত করে সিঁড়িতে তেল ঢেলে রাখা, ছাদে গেলে দরজা আটকে দেওয়া, খাবারে এটা-ওটা মিশিয়ে সৃজাকে খেতে দেওয়া, ভার্সিটিতে ওর ক্লাসমেটকে হাত করে ওর নামে কুৎসা রটানোর ছোটখাটো, লেইম কাজগুলো তোমার সেসব আমি জানি। কিন্তু এ’সিড দিয়ে চেহারা পুড়িয়ে দেওয়ার কাজটা যে তোমার, কী ভেবেছ, ইহসান শেখ এটা ধরতে পারবে না?
লিথু হতভম্ব হয়ে যায় কারণ এসব কুকর্ম তার গোপন কাজ, যা বাবা ছাড়া আর কেউ জানে না, মিতুও না। মকবুলের মাকে টাকা খাইয়ে এটা-ওটা করায় কিন্তু এসিডের বিষয়টা! ইহসান কীভাবে এসব জানল, সে বুঝতে পারে না। ওর মস্তিষ্কে একটা আতঙ্ক উঁকি দেয়! ইহসান কীভাবে জানল? কে বলল ওকে এসব? রক্তশূন্য লিথুর মুখপানে তাকিয়ে ইহসানের চোখের কোণে অস্থির হাসি ফুটে ওঠে। ঠান্ডা কণ্ঠে, যেন রাগের কোনো আঁচও নেই, বলে,
“নিশ্চয় ভাবছ, আমি কীভাবে জানি? এইযে, তুমি প্রথম থেকেই সৃজার পেছনে পরে আছ, তোমার বুড়ো, শয়তান বাপটাকে নিয়ে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছ সমানতালে, ভেবেছ আমি কিছুই জানি না?
ভুল, বরং প্রথম থেকেই তুমি আমার নজরে ছিলে, তোমার কোনো কর্মকাণ্ডই গোপন নেই আমার কাছে!”
পরক্ষণেই আগ্রাসী কণ্ঠে বলে ইহসান,
“তোমাকে যতটা বোকা আর নষ্টা মেয়ে ভেবেছি, তুমি তা-ও নও। তারচেয়েও নিম্নস্তরের। আর নিম্নস্তরের তোমাকে ; সৃজার ভালোবাসার মানুষ অ্যাটেনশন দেবে, এই ভাবনাটা মাথায় এলো কীভাবে তোমার?”
হতভম্ব, হতবাক লিথুর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় এসব শুনে। মানে কী? ইহসান ওকে নজরে রেখেছিল? এজন্যই কোনো পরিকল্পনায় সফল হতে পারেনি কখনো? লিথুর গলা শুকিয়ে আসে। এখন কী করবে ইহসান ওকে? তবে যাই করুক, মেরে তো ফেলবে না। উত্তেজনা, ভয় আর রাগে ওর হাতের তালু ঘেমে উঠে। মিষ্টি ব্যবহার করে এখানে নিয়ে এসে এখন এসব বলছে ইহসান? দমে যায় না ও, কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“তুমি আমার, আমি তোমায় ভালোবাসি, তোমারে চাই।”
ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“কিন্তু আমি তো তোমাকে চাই না।”
“ক্যান চাও না?”
“কারণ আমি সৃজার, আর ওর জিনিস আমি অন্য কাউকে— বিশেষ করে কোনো সস্তা, দুশ্চরিত্রাকে দেব না।”
লিথু রাগে ফেটে পড়ে,
“কি বললা তুমি?”
ইহসান চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“দুশ্চরিত্রা— উহু না, প্রস্টিটিউট! না, তার থেকেও লেইম। এতটাই লেইম যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”
লিথুর চোখ থেকে আগুন বেরুতে থাকে,
“আমার আব্বা সব দিয়া দিবে তোমারে, এরপরেও ক্যান চাও না?”
ইহসান উঠে দাঁড়াল। সামনে থাকা একটা কাচের বোতলে লাথি মারে, ভেঙে টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে সেটা। ভেতরের নীল তরলটুকুর ঝাঁঝালো শব্দ তুলে ধোঁয়া ছাড়ে। ক্ষ্যাপাটে স্বরে ইহসান বলে,
“আমি পণ্য— কাপুরুষ নই।”
ভয়ে লিথু একপাশে সরে যায়, আমতাআমতা করে বলে,
“আমারে এইখানে নিয়া আসলা এইগুলা কইতে?”
ইহসান নিজেকে ধীরস্থির শান্ত করে সময় নিয়ে।
ভ্রু উঁচিয়ে শাণিত সুরে বলে,
“উহু! আমি নিয়ে আসিনি, তুমি স্বেচ্ছায় এসেছ, ভুলে গেলে?”
লিথু ভীতি নিয়ে জবাব দেয়,
“না না, ভুলি নাই। কিন্তু আমি তোমারে ভালোবাসি দেইখাই তো আসছি।”
ইহসান দু’হাত পেতে দেওয়ার ভঙ্গি করে বিস্মিত
স্বরে জানতে চায়,
“সেই ভালোবাসাটাই দেখতে চাচ্ছি, কোথায় তোমার ভালোবাসা? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? অনুভবও করতে পারছি না। এটা কেমন ভালোবাসা?”
ইহসানের কথা লিথুর কিছুই বোধগম্য হয় না।
তারপরও বলে,
“তুমি অন্ধ তাই আমার ভালোবাসা দেখো না…”
ইহসানের ঠোঁটে অস্বাভাবিক হাসি খেলে যায়,
“না, সেটা ভুল। আমি দেখি, তুমি কতটা ডেস্পারেট হয়ে আমাকে চাও, আমার কাছে আসতে চাও,
ঘেঁষতে চাও! ভালোবাসার চেয়ে আমার প্রতি শারীরিক আকর্ষণটা বেশি কাজ করে তোমার—তাই না?”
লিথু জবাব খুঁজে পায় না। মাথা নেড়ে ভীতু স্বরে বলে,
“তুমি যদি চাও আমি তাতেও রাজি…”
ইহসান ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করে।
চোখ কুঁচকে, এক পৃথিবী ত্যাক্ততা নিয়ে সে ক্রুর হাসে। কঠিন ও গমগমে গলায় বলে,
“ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে আমি এসব সস্তা জিনিস নেব না, অন্য কোনো দামী বস্তু চাই।”
লিথুর মনে আশার সঞ্চার হয়, একছুটে গিয়ে হাত
ধরে ব্যাকুল চিত্তে জানতে চায়,
“এতদিন যা যা করছি তার জন্য মাফ চাইছি, আর করব না সৃজার সাথে এইসব। তুমি শুধু আমার হইয়া যাও। এরজন্য কী চাও বল, যা চাও তাই দিব।”
ইহসান ভ্রু কুঁচকায়। খুব এগিয়ে আসে, লিথুর মুখ বরাবর মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। হঠাৎ ভীষণ অস্বাভাবিক দেখায় ওকে। লিথু ঘাবড়ে যায়, ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার। ঠাণ্ডা ও শীতল কন্ঠস্বরে ইহসান ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“তোমার প্রাণ।”
_______
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৯
ইহসান ভ্রু কুঁচকায়। খুব এগিয়ে আসে, লিথুর মুখ বরাবর মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। হঠাৎ ভীষণ অস্বাভাবিক দেখায় ওকে। লিথু ঘাবড়ে যায়, ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার। শীতল কন্ঠস্বরে ইহসান ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“তোমার প্রাণ।”
ইহসানের ঠান্ডা, শীতল স্বরে বলা কথাটা শুনে আতঙ্কিত আর অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল লিথু। বুক কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো, ঢোক গিলে কয়েকবার। ভীতি স্বরে হাসার প্রচেষ্টা করে,
“এইসব কী বলো তুমি?”
ইহসান ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“চাইতে বলেছ, চেয়েছি!”
“আমায় বোকা বানাইতে মিথ্যা বলতেছ!”
ইহসান সরে এলো লিথুর কাছ থেকে। আরাম করে হেলে বসে চেয়ারে। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে এরপর ছোটছোট চোখ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তুমি আমাকে ভালোবাসো, অথচ ভালোবাসার মানুষটাকেই বিশ্বাস করছ না? এমনটা আশা করিনি একদম।”
পরক্ষণেই সূক্ষ্ম কণ্ঠে বলে,
“দেখো, আমি সত্যিই চাই তোমার প্রাণ, ওটুকু দিলেই আমি প্রমাণ পেয়ে যাব তোমার ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু!”
লিথু ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
“এরজন্য আমায় মরতে হইব? মরে গেলে পাবটা কী?”
ইহসান হাসলো সুন্দর করে,
“আরকিছু পাও আর না পাও, মানুষের ঘৃণা থেকে বেঁচে যাবে। জানোই তো, কত মানুষের ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছ তুমি! ঘৃণা নিয়ে বাঁচা যায় না, এরচেয়ে মরে যাও, ভালো হবে। তোমার জন্যও, বাকিদের জন্যও।”
“কে আমারে ঘৃণা করে? তুমি?”
মাথা নাড়ল ইহসান দু’পাশে। তাচ্ছিল্য সূচক কণ্ঠে বলল,
“উহু! তোমার দুই ডজন প্রাক্তনও তোমাকে ঘৃণা করে। তোমার করা প্রতারণা ঘৃণা করে। তবে আমি যেটা করি সেটা ঠিক ঘৃণা নয়, ঘৃণার চেয়েও বেশিকিছু।”
“সেইটা কী?”
একরাশ গম্ভীরতা ছেয়ে গেল ইহসানের চোখমুখে। বিদ্রুপাত্মক ও তেজদীপ্ত কণ্ঠস্বরে বলল,
“সেটা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তবে জেনে রাখো,
তোমার উপস্থিতি আমার জন্য অস্বস্তিদায়ক,
তোমার ছোঁয়া কোনোকিছু আমার রাগের কারণ,
তুমি মানেই আস্ত এক নিম্নমানের ডাস্টবিন, যা দেখলেই আমার গা গুলায়। তোমার মেকআপ করা ভারী চেহারাটা দেখলেই আমার সারাদিন খারাপ যায়। তুমি যখন মাঝেমধ্যে হুটহাট এসে আমার উপর ঢলে পড়, আমাকে ছুঁয়ে দাও, সৃজার সামনে আমাকে নিয়ে আহ্লাদ করো; ট্রাস্ট মি, তখন আমার নিজেকে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে, জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কতবার জীবাণুনাশক ব্যবহার করি জানো না তুমি। মনে হয়, মনে হয় তোমাকে মেরেই ফেলি!”
শেষ কথাটা বলতে বলতে ক্ষিপ্রতা এসে ভর করে ইহসানের চোখেমুখে। রাশভারী হয় গলার স্বর। লিথুর হিংসায় শরীর জ্বলছিল। বাঁকা স্বরে বলে,
“বউয়ের ছোঁয়া পাইয়া আমারটা ঘেন্না লাগে? ক্যান, তোমার বউ কি আমার থেইক্কা বেশি সুন্দর? ঐ তো ওইটুক চেহারা। নাই কোনো ফ্যাশন সেন্স, নাই স্মার্টনেস, নাই আমার মতো কোটিপতি বাপ। এরপরেও হ্যায় তোমার কাছে সব? কেউ যদি কাউরে বশ না করে তাইলে সেইটা অসম্ভব ব্যাপার। তোমারে ঐ নাগিনী…”
এ পর্যায়ে এসেও সৃজাকে কটুক্তি করায় রাগে শরীর কেঁপে উঠল ইহসানের। কোনোকিছু না ভেবেই সে হিপ হোলস্টারে হাত দিলো। ওখানে থাকা ধাতব বস্তুটাতে আঙুলগুলো ঠেকতেই ঠান্ডা স্টিলের স্পর্শ পেল। গ্লকের গ্রিপটা দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে বের করে আনতেই লিথুর চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেল। পলক ফেলতে ভুলে গেল সে। চারপাশের শব্দ মিইয়ে গেল, যেন এই অভাবনীয় মুহূর্তের ভারে পুরো দুনিয়া থমকে গেছে। ইহসান এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে হ্যাণ্ডগানের
স্লাইড টেনে নিশ্চিত হয়ে নিল চেম্বারে গুলি আছে কি-না! নিশ্চিত হয়ে সে লিথুর মাথায় গানটা চেপে ধরে ট্রিগারে আঙুল রাখল সে,
“বহুবার তোমার জন্য আমি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি বউটার সামনে। কিন্তু বারবার সুযোগ দিয়ে গিয়েছি, যাতে না শুধরে তুমি নিজের অপরাধের পাল্লা বাড়িয়েছ। সীমা ছাড়িয়েছ ওকে বাজে কথা বলে। আমার জান ও, ওকে তুমি বারবার বাজেভাবে টিজ করবে আর ভাববে আমি চুপই করে থাকব? নট ফেয়্যার, নট ফা*কিং ফেয়ার…”
লিথু ভেবেছিল ইহসান ওকে এতক্ষণ পরীক্ষা
করছিল। প্রাণ চাওয়ার কথা বলে ওকে ভয় দেখাচ্ছিল। ভাবতেই পারেনি ইহসানের কাছে হ্যাণ্ডগান আছে, আর সেটা ওর মাথায়ই ঠেকিয়েছে! কতক্ষণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও এ পর্যায়ে আতংকে কেঁদে ফেলল,
“আ আ আর কমু না, ভভু ভুল হইয়া গেসে। এইডা সরাও, প প্লিজ ইহসান, সরাও এইটা…”
ইহসান সরায় না তার হ্যান্ডগান। সরানোর লক্ষ্মণও নেই। লিথু জোরে কাঁদতেও ভয় পায়, শুধু অনুনয় করতে থাকে। ইহসান বিরক্ত ও শীতল গলায় বলে,
“কুমিরের কান্না কেঁদে লাভ নেই। আজ আমি শোধবোধ করতে এসেছি। এত আদরের বউ আমার, আর ওকেই তুমি আমার থেকে দূরে সরাতে সস্তা পরিকল্পনা করো? শায়েস্তা করতে চাও,বিপদে ফেলতে চাও, জ্বালিয়ে দিতে চাও ওর পবিত্র মুখখানা…কী ভেবেছ? আমি শুধু ওর রুপে মুগ্ধ?
ওর চেহারা ঝলসে দিলে আমি ওকে অবহেলা করে তোমার মতো ভ্রষ্টাচারিণীর প্রতি ঝুঁকে যাব? ঊহু! ওর রুপ থাকুক আর ঝলসে যাক, ওর প্রতিটা কোষে কোষে আমি ইহসান শেখ, মুগ্ধ! যা একবিন্দু পরিমাণেও কমবে না! আজীবন একই থাকবে।”
আগ্রাসী স্বরে হুঁশ জ্ঞান কাজ করে না লিথুর। লাল রঙের পরণের শাড়ি এদিকসেদিক খুলে পড়ে। ইহসান রক্তচক্ষু করে ঘর কাঁপিয়ে ধমকে উঠে ওকে। ট্রিগারে আঙুল বাজায়। ভয়ে, আতঙ্কে লিথু শাড়ি ঠিকঠাক করে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“তু তুমি আমারে ছাইড়া দাও ইহসান…”
ওর অসহায়ত্ব একটুও টানে না ইহসানকে। বরং বিরক্তিবোধ করে। ফিচেল হেসে বলে,
“ছেড়ে দেব? অনেকবার তো ছেড়ে দিয়েছি, সাবধান করেছি। শুধরাও নি তো! উল্টো আমাকে সিডিউস করতে উন্মাদ হয়ে গেছ! এইযে তুমি রাস্তার মেয়েদের মতো রঙচঙে শাড়ি পরে, সেজেগুজে থাকছ সৃজার যাওয়ার পর থেকে, ভেবেছ আমি তোমার মতলব বুঝি না? আজ আমার সাথে কোন কুমতলব নিয়ে, আমাকে ভুলাতে এসেছ, ভেবেছ আমি জানি না? সব জানি আমি। যাকগে, বাদ দাও। সৃজার উপর এসিড ছুঁড়ার কুবুদ্ধি, পরিকল্পনায় তুমি আর তোমার শয়তান বাপ জড়িত জানি। কিন্তু আরো একজন আছে, যেটা নিয়ে আমি ধোঁয়াশায়। এখন তুমি স্বীকার করো, সেই লোকটা কে, কোনোভাবে আমার বাপ, আজিজ শেখ নয়তো?”
লিথুর ভয়ে অন্তরাত্মা কাঁপছে। বলতে চাইছিল না কিন্তু আপনি বাঁচলে বাপের নাম মনে করে ও মাথা নাড়ল একনাগাড়ে। ইহসান বাঁকা হাসল এবারে।
তার সন্দেহ ঠিক ছিল! এই বুড়ো কিছু করতে না
পেরে এখন মান্ধাতার আমলের ট্রিক্স প্রয়োগ করছে?
কী ভেবেছে? ইহসান জানতে পারবে না? রাগ
শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ল ওর।
“আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? তোমাকে পিস পিস কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াই৷ তবে এসব আমি ভালো পারি না। তাই ভাবছি আজ তোমাকে দিয়েই শুরু করি।”
“কী শুরু করবা?”
“খু-ন। যারা আমার সৃজার ক্ষতি চাইবে তাদেরই খু-ন করব। দরকার হলে আমার বাপকেও। আর বাপকে খু-ন করতে যে ছেলের হাত কাঁপবে না তার নিশ্চয় তোমাকে আর তোমার শয়তান বাপকে মারতেও কোনো অসুবিধা হবে না৷ কী বলো?”
লিথু বাকরুদ্ধ বনে যায়। এই ইহসানকে সে চেনে না, চিনতে পারছে না। তাএ স্বপ্নপুরুষ, তার ভালোবাসা তাকে মারতে নিয়ে এসেছে এখানে? লিথু আতংকিত বোধ করে। ইহসান ওর চোখের ভয় দেখে হাসে। বলে,
“হ্যান্ডগানটাতে পাঁচ রাউন্ড গুলি আছে, সবগুলো তোমার মাথায় ঢুকাব এক এক করে। এরপর তোমাকে পিস পিস করে কাটব, অবশ্য আমি কাটব না। লোক ভাড়া করেছি, তাদের দিয়ে কাটাব। বুঝলে তো, তোমাকে ছুঁলে আমার নিজের হাতটাকেই কেটে ফেলতে ইচ্ছে করবে। তাই সে রিস্ক নিচ্ছি না। তো যা ব বলছিলাম, পিস পিস করার পর কী করব জানো? এইযে কেমিক্যালগুলো দেখেছ, একেকটা এ’সি’ডের বোতল! তোমার হাড্ডি থেকে মাংস সব জ্বালিয়ে দেব। ওয়েট, মরে গেলে তো এ’সি-ডের যন্ত্রণা কেমন হয় তা বুঝবে না তুমি। বেকার কাজ! তারচেয়ে প্রাণ থাকতে থাকতে একটু চেখে নাও….”
বলে ইহসান কোথা থেকে গিয়ে একটা ছোটখাটো বোতল নিয়ে এলো। ভিতরে পানির মতো একটা তরল। লিথু ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করল,
“ওটা কী?”
“যেটা তুমি সৃজার মুখে ছুঁড়তে লোক ভাড়া করেছিলে…”
বলে সময় নেয় না। লিথুর হাতে-পায়ে এবং অনাবৃত থাকা পেটের উপর কিছুটা তরল ছুঁড়ে মারে। তেজালো তরল মাংস গলিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। মরণ যন্ত্রণায় চিৎকার করে ছটফট করে উঠে লিথু। ইহসান শুনে তা, ওর তৃপ্তিবোধ হয়। কোনো মায়ার উদ্রেক হয় না মনের ভেতর। উল্টো রাগ বাড়ে৷ সৃজাকে এই তরলে যন্ত্রণা দিতে চেয়েছিল, এখন দেখ কেমন লাগে। ওর ক্ষতি করতে চাইলে এমনই হবে। লিথুর চিৎকার বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে বিরক্ত হয় ইহসান, পানি এনে ঢালে। ঠাণ্ডা স্বরে বলে,
“যথেষ্ট চিৎকার করে আমার কানের পোকা মেরেছ। এবার চুপ করো, নয়তো মুখটাই বন্ধ করে দেব।”
লিথু সাথে সাথে থেমে যায়। দয়া-মায়াহীন সাইকো মনে হয় ইহসানকে। কান্না পুরোপুরি বন্ধ হয় না ওর, ফুঁপাতে থাকে শুধু। ইহসান ক্রুর হেসে বলে,
“ভালোবাসো আমায়? আমাকে ভালোবাসলে জ্বলতে হবে, ঠিক এভাবেই! যাইহোক, একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় বলি? তোমাকে শায়েস্তা করার এই ছোট্ট পরিকল্পনাটা
কে সাজিয়েছে জানো?”
যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা লিথু মাথা নাড়ায়, সে জানে না। ইহসান উচ্চস্বরে হেসে উঠে,
“যার সাথে ব্লু-বার্ড হোটেলে যেতে মাঝেমাঝে! যাকে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফতুর করে ছেড়ে দিয়েছিলে? তোমার সেই হাজব্যান্ড, তপন।”
লিথু বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। তপন! ঐ হাঁদার বাচ্চা? যাকে কোর্ট ম্যারেজ করে, টাকাপয়সা খেয়ে শেষ করে, বুদ্ধু বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল গোপনে ঐ হাঁদা তপন? ওর এত সাহস, প্রতিশোধ নিচ্ছে ওর উপর? তাও ইহসানের সাথে মিলে? লিথু কী করবে? কে বাঁচাবে ওকে এখন? মৃত্যুভয়ে জেঁকে ধরে ওকে। কেঁদে উঠে জোরেশোরে,
“আমি আর এইসব করব না ইহসান। মেরো না আমায়, এবারের মতো ছাইড়া দাও। আর কখনো তোমার জীবনে আসতে চাইব না৷ কাউরে ঠকাব না। ইহসান, আমায় ছাইড়া দাও…”
লিথু কান্নায় ভেঙে পড়ে। তবে চিৎকার করতে পারে
না ইহসানের ভয়ে। মনে মনে একশো একবার তওবা কাটে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চায়, আজ যদি একবার বাঁচার সুযোগ পায় তাহলে সে আর কখনো কাউকে ঠকাবে না। ভুলভাল কাজ করবে না। কারো ক্ষতি করবে না৷ সৃজার পা ধরে মাফ চাইবে। আর ইহসান, এই সাইকোর থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকবে। দরকার হলে সারাজীবন একলা কাটাবে, তবুও এই ইহসান শেখের সুদর্শন চেহারায় ডুববে না। প্রার্থনা করতে করতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে লিথু,
চোখে সব ঝাপসা দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ইহসান ওর নির্জীব হয়ে পড়ে থাকতে দেখেও বিরক্ত হয়, ভেবেছিল পিস্তলের সব বুলেটের ব্যবহার করে আজই এই চরিত্রহীনার ইতি ঘটাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে এই ভ্রষ্টাচারিণীর শিক্ষা!
—–
ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটা। গাড়িতে শুয়ে অন্ধকার কেটে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল ইহসান। একসময় আঁধার কেটে আলোর দেখা মিলতে লাগল। লিথুর হাজব্যান্ড তপন, ওকে ফোন দিলো ইহসান। লিথুর বাকিসব ব্যবস্থা করতে বলল। লিথুকে শায়েস্তা করায় তপন কৃতজ্ঞ গলায় ওকে ধন্যবাদ দিয়ে জানাল লিথুকে সে নিজের কাছে রাখবে৷ প্রতিশোধ নিলেও এখনো সে লিথুকে খুব ভালোবাসে। ইহসান বিরক্ত হলো কাপুরুষটার এসব কথা শুনে। লিথুকে নিয়ে এসব আহ্লাদি কথা শুনতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। প্রয়োজনীয় কথা সেরে তাই ফোন রাখল। রশিদ ব্যবস্থা করেছিল রাতে গাড়িটার। ইহসান এরপর ওকে ফোন দিয়ে বলল গাড়ি এসে নিয়ে যেতে। রশিদ জানাল সে আসছে। ফোনে গাড়িটার লোকেশন সেন্ড করল ইহসান ওকে। রশিদ কাছাকাছিই কোথাও ছিল হয়তো, চলে এলো ঘন্টা খানিকের মধ্যে। ইহসান গাড়িতে চড়ল না, হ্যান্ডগা’নটা রশিদকে দিয়ে বিদায় করল ওকে ওই এলাকা থেকে। এরপর নিজেও বিদায় নিলো। অনেকদূর হেঁটে এসে প্রথমে রিকশা নিলো এরপর সিএনজি। সকাল সাতটা। উজ্জ্বল রোদ্দুরে ঝলমল করছে চারপাশ। আকাশ নীল। গাছ-পালা বাতাসে লুকোচুরি খেলছে। ইহসানের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভীষণ অবসন্নবোধ করছে। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। এই অবসাদটুকু কারো উপর চাপিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। হুট করে কি মনে হলো, ইহসান শ্যাওড়াপাড়ায় সৃজাদের বাড়িতে চলে এলো। সাত-সকালে এলিজা দরজা খুলে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল। ইহসান ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“ক্লান্ত, একটু ঘুমাতে এসেছি। তোর বোন কই?”
“ঘরে, ঘুমাচ্ছে।”
“ওকে, ডাকার দরকার নেই। আমি যাচ্ছি।”
এলিজা মাথা নাড়ল। কাউকেই ডাকল না। সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে। নীলু বেগম অবশ্য একবার উঠেছিলেন। ফজরের নামায সেরে, রুটি বেলে রেখে এরপর ঘুমিয়েছেন। এলিজা নামাজ সেরে সাড়ে ছয়টায় এলার্ম দিয়ে রেখেছিল। পড়াশোনার চাপ বাড়ছে, তাই ভোর ভোরই উঠে পড়তে বসে এতক্ষণ পড়ছিল। এত সকালে ইহসানকে আশা করেনি। কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। মেইন ডোর বন্ধ করে আবারো পড়তে বসল। জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় এলিজা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকাল। সোনাবরণ রোদের নৃত্য আর সকালের ঘ্রাণে চারপাশ ডুবুডুবু। দূরের বিশাল আকাশে উড়ছে অজানা পাখিরা, পাড়ি দিচ্ছে পথ। আজকের সকালটা অদ্ভুত সুন্দর! মন ভালো করার মতো।
ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ। পর্দা টানা। বাইরে সকাল হলেও ভেতরটা দেখলে যে কেউ ভাববে এখন মাঝরাত। ইহসান অন্ধকারে সৃজাকে মন ভরে দেখল। অনেকক্ষণ দেখার পর তার মন কিছুটা শান্ত হলো। চাদরের তলায় নিজেকে আড়াল করল। ঘুমন্ত সৃজার উদরে আঁকিবুঁকি করতে করতে গলায় মুখ গুঁজল। ছোট ছোট অসংখ্য চুমুতে গাল-গলা ভিজিয়ে দিয়ে ওষ্ঠপুট দখলে নিয়ে নিলো সে। দমবন্ধ ও শিরশির অনুভূতিতে কেঁপে উঠল সৃজা। ঘুম ছুটে গেল সৃজার। শরীরের উপর একটা পুরুষালি অবয়ব দেখে অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে নিলো ওকে। অসাড় হয়ে এলো হাত-পা। তবুও সাহস যুগিয়ে ঠেলে সরাতে চাইল লোকটাকে। তবে সফল হলো না। ব্যর্থ হয়ে চুল খামচে ধরল। আদরের মাঝে ওরকম বাঁধা পেয়ে বিরক্ত হলো ইহসান। পছন্দ হলো না ব্যাপারটা। চুলে টান খেয়ে তাই ক্ষেপে গেল। ওষ্ঠ ছেড়ে সরে গিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
“একদম শান্তি দিচ্ছিস না…”
হতভম্ব সৃজা লাফিয়ে উঠে বসল সৃজা। ইহসানকে দেখে কতক্ষণ থমকে রইল। এই লোক এখানে? কখন এলো? সৃজার বিশ্বাস হতে চাইল না৷ অবিশ্বাস্য চোখে একবার ঘড়ি একবার ইহসানকে দেখল। এরপর চিমটি কেটে যখন বুঝল লোকটা স্বপ্ন নয়, আসলেই বাস্তব! ঝাঁপিয়ে পড়ল একদম ওর বুকে,
“কখন এসেছ তুমি?”
ইহসানের বুকে প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল,
“একটু আগে।”
সৃজা গদগদ কণ্ঠে বলল,
“ডাকোনি কেন?”
“মরার মতো ঘুমাচ্ছিলি, তাই ডাকিনি।”
সৃজার অভিমানী টানলো গলায়,
“তুমি বানিয়ে বানিয়ে এসব বলো, জানি আমি।”
“উহু! কিছুই জানিস না তুই।”
“কী জানি না?”
“আমি কেন এসেছি সেটা।”
সৃজা শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কেন এসেছ?”
“আদর আদর পাচ্ছে তাই। আদর দে!”
সৃজা ওর বুকে নাক ঘঁষে সরে এলো ওর থেকে। বালিশে মাথা রেখে চাদর গায়ে টেনে নিয়ে প্যাকেট হয়ে শুয়ে পড়ল। ইহসান ওর কাণ্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠে বসল। ধমক দিয়ে বলল,
“পাপ হবে সৃজা, স্বামীর কথা মানতে হয়।”
সৃজা শক্ত গলায় বলল,
“হোক পাপ। যে লোক শুধু আদর পেলেই আমার কাছে আসে, তাকে আমি চাই না। কই! এতদিন তো আসোনি। যে, দেখে যাই সৃজাটাকে। কেমন আছে,
কী হালত! আর ফোন! সেটাও দু-একবার দিয়েছ! আমাকেই দিতে হয়েছে বেশিরভাগ সময়।
এখন আদর চাইতে এসেছে।”
ইহসান ওর অভিযোগ শুনে মাথা দু’হাতে চেপে ধরল
ব্যথায় ওর কপালের রগ টনটন করছে। ক্লান্ত লাগছে। কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে সৃজাকে বলল,
“এত রাগছিস কেন? দেখতে আসলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করতো, বেশি বেশি ফোন দিলে তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে করতো। তুই বেড়াতে এসেছিস, আমি যদি ঘন ঘন চলে যাবার কথা বলতাম তখন ভাবতি আমি বেশি বেশি করছি! তোকে শান্তি দিচ্ছি না। বিরক্তি হতি। এখন আসিনি, এটাতেও প্যাঁচ ধরছিস। বোঝ একটু। কাছে আয় না সোনা…”
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ইহসানের শিয়রে পেয়ে সৃজা যে কতটা আনন্দিত হয়েছে সেটা কে বোঝাবে এই লোককে? সৃজা তো রেগে নেই ওর প্রতি। ওকে ঘাঁটাতে এগুলো বলছে। খেলাচ্ছে লোকটাকে।
এদিকে সৃজার নিজেরও প্রেম প্রেম পাচ্ছে। তবে
সেটা প্রকাশ না করে বিরক্ত হবার ভান করে বলল,
“লজ্জা করো একটু!”
“লজ্জা করে কী হবে বল তো? তুই এমনিতেই কাছে চলে আসবি? ওকেহ! লজ্জা করলাম তবে…”
ইহসানের গলা অসহায় শোনাল। সৃজা আড়ালে হাসল। কিন্তু সেটা দেখাল না ওকে। গম্ভীর মুখে তাকাল ওর দিকে। এরপর দু-হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। ইহসান এগিয়ে গেল, সৃজা ওকে চমকে দিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“আমার সকালটা খুশি খুশি রোদে রাঙিয়ে দেওয়ায়
তোমাকে এবারের মতো মাফ করে দিলাম।”
ইহসান ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে ওকে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
“দেখি একটা চুমু খা!”
——-
[রি-চেইক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…