অশ্রুবন্দি পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
6

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব – ৩০

লিথু যে বাড়িতে নেই সেটা টের পেল প্রথমে মিতু। সচরাচর এগারোটার আগে ঘুম থেকে উঠে না লিথু। যদি কোনোদিন এর আগে উঠে তাহলে সেটা নিজের মন-মর্জিতে ধরলে। তাই প্রথমে এতকিছু ভাবেনি মিতু। কিন্তু সাড়ে এগারোটার পরেও যখন লিথুর কোনো সাড়াশব্দ, আনাগোনা পেল না, তখন ডাকতে এলো ওর ঘরে। কড়া নাড়তেই দরজাটা একটু দুলে উঠায় মিতু ঠেলল সেটা, দেখল দরজা খোলা। কিন্তু ঘরে কোথাও লিথু নেই৷ মিতু অবশ্য এতকিছু ভাবল না, হয়তো ছাদে বা নিচে গেছে। নয়তো পুকুর পাড়ে হাঁটতে বেরিয়েছে ভেবে চলে গেল। আধঘন্টা পরেও যখন লিথুর দেখা নেই তখন একটু খটকা লাগ ছাদে, ঘরে-বাইরে সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করল। পেল না। সালেহা বেগম রান্নাঘরে ভাতের পাত্রে খুন্তি নাড়ছিলেন। তার শরীর আজকাল বিশেষ ভালো যায় না। অবশ্য এ বাড়িতে তাকে কারোরই বিশেষ প্রয়োজন হয় না৷ দেখভালের দরকার হয় না। বেশিরভাগ সময় ঘরেই ইবাদত-বন্দেগি করে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। মিতুকে হন্তদন্ত হয়ে সারাবাড়ি
খোঁজ করতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন কিছু হয়েছে কি-না! মিতু আর্ত আর বিরক্ত গলায় জানাল সে লিথুকে খুঁজছে। কোথাও দেখেছে কি-না! সালেহা বেগম মাথা নাড়লেন, লিথুকে তিনি দেখেননি, সকাল থেকেই। মিতু চিন্তায় পড়ে গেল, কোথায় গেল লিথু? সে আবারো লিথুর ঘরে এলো। ফোন বের করে কল করল কয়েকবার, কিন্তু ফোন বন্ধ! মিতু কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। হঠাৎ তার চোখে পড়ল বালিশের তলায়, একটা কাগজ, ভাঁজ করে রাখা। মিতু হন্তদন্ত হয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিল। খুলে লেখাটা পড়ল,

“ইহসান শেখকে চাইছিলাম। কিন্তু তোমরা আমারে দিতে পারতেছ না, চোখের সামনে তার সংসার দেখা আমার
পক্ষে অসম্ভব। তাই চইলা যাইতে। সময় হলে ফিরে আসমু। আমার কিছুদিন একলা থাকনের দরকার। খবরদার
আমায় খুঁজবা না। আব্বারে বইলা দিও।”

লেখা পড়ে মিতু হতভম্ব! গতদিনও যে মেয়েকে উৎফুল্ল, হাসিখুশি দেখাচ্ছিল একরাতেই তার মনে কি এমন পরিবর্তন হলো যে বোনটা তাকে কিছু না জানিয়েই কাগজে চিঠি লিখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল? মিতু রমিজ আলীকে ফোন করে সব খুলে বলল। ছোট মেয়ের লাপাত্তা হবার খবরে তিনিও বেজায় চমকে গেলেন। যে মেয়ে ইহসান, ইহসান করে মাথা পাগল করে দেয়, গোপনে ইহসান শেখের বউকে তাড়ানোর জন্য ফন্দিফিকির আঁটে এমনকি পরশুদিনও যে মেয়ে বাবার কাছে ইহসানকে আবদার করল, সে হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে কোথায় গেল? অবশ্য লিথুর এমন লাপাত্তা হওয়া নতুন ঘটনা নয়। এর আগে বহুবার এমন করেছে। বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে পালিয়েছে, কখনোবা ট্যুর দিয়েছে। আবার নিজে থেকেই পাঁচ-সাতদিন পরে ফিরে এসেছে। এবারো হয়তো তেমন কিছুই। আদরের মেয়ে বলে কথা! কিছু বলতেও পারেন না রমিজ শেখ!

আজিজ শেখ এসব শুনলে কী ভাববেন কে জানে! কথার খোঁচা দিতে ছাড়বেন না। রমিজ আলী মিতুকে বলে দিলেন লিথুর লাপাত্তা হবার খবর যেন কাউকে না বলে। তাহলে আজিজ শেখ কথা শুনাতে ছাড়বেন না তাকে। মিতুও বাবার কথায় সম্মত হলো। এসব জানাজানি হলে সবাই গসিপ করার মালমশলা পেয়ে যাবে, ইহসানও হয়তো
আরো কঠোর হয়ে যাবে। শেষে দেখা গেল, সৃজাকে তাড়িয়েও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। তাই, লিথুর
লাপাত্তা হবার খবরটা ওরা বাবা-মেয়ে চেপে গেল।
মিতু ব্যপারটা সামলালো এটা বলে যে, বাবার জন্য মন পুড়ছিল বলে লিথু সকাল সকালই বাড়িতে চলে গেছে। যদিও কেউ জানার আগ্রহবোধ দেখায়নি, তবুও মিতু
বলে রাখল যাতে কারোর সন্দেহ না হয়!

°

অফিসে আজ কাজের বেশ চাপ গেছে ইজহানের। সব গুছিয়ে, এর-ওর উপর চাপিয়ে দিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। সবই ঝুলে আছে। মাথা হ্যাং হয়ে যাওয়ায় সব ছেড়েছুঁড়ে বাড়ির পথ ধরল আটটায়। পথে সিগন্যালে গাড়ি থামলে ভীষণ ত্যক্ত হয়ে গেল সে।ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজে শরীরটা সিটে হেলিয়ে দিলো সে। বেলিফুলের গাজরা নিয়ে দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে তার গাড়ির জানালায় মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,

“ফুল লইবেন স্যার?”

ইজহান পেছনের সিটে তখন শরীর তুলে দিয়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টায় রত। সে জবাব দিলো না। মিজু একবার নিজের স্যারকে দেখে নিয়ে ফুলওয়ালিকে ইশারায় ডাকল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,

“কত করে?”

“বিশ ট্যাকা কইরা, লইবেন?”

“দশ কইরা রাখ।”

“হইব না, বানাইতে পরিশ্রম হয়।”

“পনেরো করে দিই, দুইটা দাও।”

মেয়েটা হেড়ে গলায় বলল,

“একদাম বিশ ট্যাকা, দামাদামি নাই।”

মিজু বুঝল দামাদামি করলে তেমন একটা লাভ হবে না।
এই মেয়ে বেশ চতুর। ব্যবসা করতে করতে পাকাপোক্ত। কথা শুনলেই বোঝা যায়। সে বার্গেনিং করতে ব্যর্থ হয়ে পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করল। দুটো বেলিফুলের গাজরা নিলো। ফুলওয়ালি দাঁত বের করে হেসে জোরালো গলায় বলল,

“বউয়ের লাগি লইছেন?”

“হুম!”

“নেন নেন, ভাবি খুশি হইয়া যাইব।”

মিজু আলতো হেসে টাকা পরিশোধ করে দিলো। ফুল নেওয়ার কারণ তার বউ। দু’দিন ধরে ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরেছে। কিন্তু ইজহান স্যারের কাছে ছুটি চেয়েও লাভ হয়নি। দেয়নি ব্যাটা নিরামিষ। উল্টো কটমট করে তাকিয়েছে, কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে। ছুটি না পাওয়ায় বউকে কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি। সে বেচারি তাই রাগ। জানে না তো, কোন খচ্চরের পাল্লায় পড়েছে তার স্বামী। জানলে নিজেই কপাল চাপড়াত। তাই বউকে খুশি করার জন্য গাজরা দুটো নিলো, তার বউয়ের পছন্দের ফুল বেলি। ফেরার পথে কিছু চিপস, চকলেটও নেবে। মল খোলা
পেলে একটা শাড়ি নেবারও ইচ্ছে আছে তার। লাল শাড়িতে তার বউটাকে টকটকে লাল গোলাপ লাগে! বউয়ের মুখটা মনে করে তার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। তখনি পেছন থেকে বাঁকা গলার স্বর ভেসে এলো,

“কী নিলে?”

মিজুর মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। স্যার উঠে গেছে ঘুম থেকে? উফ! এখন না জানি কি বলে! সে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলল,

“বেলিফুল।”

“বেলিফুল? কার জন্য?”

ততক্ষণে সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। ড্রাইভিং করতে করতে মিজু ধমক খাবার ভয় নিয়ে ধীর স্বরে বলল,

“ইয়ে…সায়মা মানে আমার বউয়ের জন্য নিলাম স্যার।”

ইজহান অবাক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল তৎক্ষনাৎ,

“বউয়ের জন্য ফুল? এসব পথের ফুল দিয়ে তোর
বউ কী করবে?”

মিজু কিছুটা লাজুক গলায় বলল,

“ওর খুব পছন্দ, খোঁপায় দিবে।”

ইজহানের চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। প্রায়ই সে দেখে মানুষ রাস্তা থেকে এসব ফুলটুল নিয়ে যায়। বউকে দেয়, প্রেমিকাকে দেয়। ওসব সস্তার ন্যাকামি দেখলে তার রাগ লাগে। বউকে ফুলের মতো সস্তার জিনিস কেউ দেয়? তোর টাকা নেই তো দিবি না, দিলেও অন্যকিছু দে। কিন্তু ওসব পচা-বাসি ফুল দিবি কেন? যত্তসব টোকাইয়ের দল। এসব ভেবে গালি দিতো মনে মনে। ইহসানকেও একদিন ফুল নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখেছিল, আজ মিজুটাও নিচ্ছে। ব্যাপারটা কী? আসলেই কি বউরা ফুল পেলে খুশি হয়ে যায়? ইজহান নিজের বিস্মিত গলা নিয়ে প্রশ্নে জর্জরিত করে মিজুকে,

“আসলেই?”

“জী স্যার?”

“আসলেই তোর বউ খোঁপায় এই ফুল দিবে?”

“অবশ্যই স্যার। মেয়েমানুষরে ফুলটুল দিয়া আপনি
যে খুশি করতে পারবেন, হীরা দিয়েও পারবেন না।”

এ কথা শুনে ইজহান আরো বিস্মিত হলো। হীরার চেয়েও ফুল দামী? এটা নেহাৎই ঢপ! তার মনে আরো অনেক প্রশ্ন জাগলো। মিজুকে জেঁকে ধরল। বেচারা মিজু পড়ল বিপাকে। বিরস মুখে উত্তর দিতে লাগল। ইজহান ওর থেকে জানতে পারল এসব সস্তার জিনিসই বরং মেয়েদের কাছে বেশি প্রিয়। ফুল, চকলেট, ফুচকা এসব ছোটখাটো জিনিসে মেয়েরা অতি আনন্দিত হয়। আর যদি সেটা স্বামীর হাত থেকে পায় তাহলে তো কথাই নেই৷ ইজহান এসব গালগল্প কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি। সে কখনো ইস্মিতাকে ফুল দেয়নি। আজ তাই ও ভাবল একটু ট্রাই করে দেখার। এমনিতে ইস্মি আগের চেয়ে একটুখানি স্বাভাবিক হয়েছে, তবে পুরোপুরি হয়নি। বউটাকে একটু খুশি করার চেষ্টা করার ইচ্ছে জাগলো তার। বাড়ির সামনে গাড়ি থামার পর নামার সময় ইজহান একটু থেমে ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে মিজুকে দিয়ে গমগমে গলায় বলল,

“ফুলগুলো আমি নেব, তোর বউকে অন্যদিন
খুশি করিস।”

বেচারা মিজু আপত্তি জানাল,

“কিন্তু স্যার…”

ইজহান চোখ গরম করে তাকাল,

“মেরে পুতে ফেলব, বুঝলি! দু-টাকার ফুল চাওয়ায় আপত্তি জানাস?”

মিজু ওর চোখে দেখেই আর কিছু বলার সাহস পেল না। গোমড়া মুখে গাজরার প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। তার এই বজ্জাত স্যার যে কখন মানুষ হবে বা আদৌ হবে কি-না, কে জানে!

.

সময় নিয়ে গোসল নিয়ে বেরুনোর পর মেজাজটা ঠিকঠাক লাগল ইজহানের। ইস্মিতাকে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখে অবশ্য আরো ভালো লাগল ইজহানের। ভেতরটা গদগদ ঠেকলেও সে চোখেমুখে নিজস্ব গম্ভীরতা ধরে রাখল৷ তোয়ালে কাঁধে ঝুলিয়ে গিয়ে বসল ইস্মির সামনে। মুখ হা করল। ইস্মি ভাত মেখে রেখেছিলল, ইজহান হা করতেই সে মুখে পুরে দিলো একটা লোকমা। খাবার মুখে নিয়ে ইজহান আপাদমস্তক ইস্মিতে চোখ বুলিয়ে নিলো। এরপর
জিজ্ঞেস করল,

“খেয়েছ?”

“খাব, আপনি আগে খেয়ে নিন।”

বলে পরবর্তী লোকমাটা এগিয়ে দিলো ওর দিকে। কিন্তু ইজহান সেটা ঘুরিয়ে ইস্মির মুখেই ঢুকিয়ে দিলো জোর করে, হতবাক ইস্মি বলল,

“এটা কী?”

“ভাগাভাগি।”

এর আগে এমন কখনো করেনি ইজহান। তাই ইস্মি অবাকই হয়েছে বটে। ভাগাভাগি কথাটা শুনে বিস্ময় নিয়ে এবার শুধাল,

“কী?”

“ভালোবাসা।”

.

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করার পর ইজহান ইস্মিকে সাজাতে বসাল। আলমারি থেকে পছন্দমতো শাড়ি, চুড়ি বের করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখল। আর ইজহানের এমন অদ্ভুত আচরণে ইস্মি পুরোই হতভম্ব!
কৌতূহল মন নিয়ে তাই জিজ্ঞেস করল,

“এসব কী করছেন?”

ইজহান ফুরফুরে গলায় বলল,

“তোমাকে সাজাব।”

ইস্মি হতভম্ব গলায় প্রশ্ন করল,

“হঠাৎ, কেন?”

পছন্দ হলো না প্রশ্নটা। গমগমে কণ্ঠে জবাবটা দিল ইজহান,

“ইচ্ছে, তাই।”

ইস্মি ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ল, এই লোকের হলোটা কী আজ? এত আদর, এত ইচ্ছে! বিয়ে পরবর্তী কোনোদিন তো এমন আচরণ করেনি। ইস্মির হজম হচ্ছে না এসব! তাই জোরালো গলায় বলল,

“এসব রাখুন। আপনার না হাঁটু ব্যথা করছে, আসুন মালিশ করে দিই।”

ইজহান উত্তেজিত ভঙ্গিতে সবকিছু একসাথে গোছাচ্ছিল; গয়নাগাটি, এটাসেটা! কিন্তু ইস্মির মুখে এ কথা শুনে ও রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। গয়নার বাক্সটা হাতে ছিল, ওটা চেপে ধরল দু’হাতে। ছুঁড়ে মারবে এমন একটা ভাব। বুঝে ইস্মি আতঙ্কিত চেহারায় তড়িঘড়ি করে বলল,

“আচ্ছা আচ্ছা, যা খুশি করুন। আমি কিছু বলব না। এই চুপ, চুপ আছি!”

.

সাদা রঙের শাড়ি, যার কুচি গুলো গোছানো নয়। কোনোমতে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। হাতে সোনার চিকন দুটো চুড়ি, কানে সোনার দুল আর আদুরে গলাটা চেইনের কারণে জ্বলজ্বল করছিল। ইজহান চুল আঁচড়াতে পারে না তেমন, দশ-বারোবার চেষ্টা করার পর মাঝখানে আঁকাবাঁকা সিঁথি করে কোনোমতে একটা খোঁপা বেঁধে নিলো। ইস্মি বারবার ওকে সাহায্য করতে চাইছিল, কিন্তু ইজহান তার গরম চোখ দিয়েই ওকে ঠান্ডা করে দিয়েছে। নিজের মতো করে সাজিয়ে সে দেখল কোনোকিছুই ঠিকঠাক হয়নি, ভেতরে ভেতরে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। ইস্মি বোধহয় সেটা বুঝল। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখে নিয়ে বলল,

“দারুণ তো!”

“তোর কচু।”

ইস্মি অবশ্য মানল না,

“উহু, প্রথমবারের হিসেবে দারুণ হয়েছে। অনেকে তো এতটুকুও পারে না। সেই হিসেব করলে আপনারটা অন্য সবার চেয়ে ভালো হয়েছে। পরেরবার আরো ভালো হবে।”

ইজহানের মন ভালো হয়ে গেল প্রশংসা শুনে। শাড়ি, চুল ঠিকঠাকভাবে করতে না পারলেও ইজহানের চোখে তার ইস্মিতাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে। এভাবে এলোমেলো অবস্থায়ও মেয়েটা কত মোহনীয়! ইজহান ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ খোঁপাটায় চোখ পড়তেই বেলির গাজরার কথা মনে পড়ল। দ্রুত সে ওগুলো নিয়ে এসে প্যাকেট থেকে বের করে ইস্মির খোঁপায় আটকে দিলো দুটো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে। এরপর সে নিজেই চমকে গেল। এত সুন্দর লাগছে তার ইস্মিতার খোঁপাটাকে! ইজহান হা হয়ে দেখল। মন ভরে দেখল। তার বুক রকেটের গতিতে ছুটল। আয়নায় তাকিয়ে ইজহানের এই অভাবনীয় কান্ডটা দেখে ইস্মির চোখজোড়া টলমল করে উঠল৷ এই লোককে কে বলল এসব? কে শেখালো? ইস্মি প্রশ্নচোখে তাকাল ইজহানের দিকে। ইজহান আমতা-আমতা করল। মানে কী? মিজু বদমাইশটা তো বলেছিল, বউ খুশি হবে। কিন্তু তার বউ কাঁদে কেন? ইজহান অসন্তোষ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ইস্মি নিজেই বলল,

“আমার জন্য ফুল?”

“হু, আসলে মিজু হাঁদাটা বলল যে…”

ইস্মি পা উঁচু করে ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরল,

“আজকের মতো খুশি আমার কখনো লাগেনি।”

বউ খুশি হবে কী, ইজহান নিজেরই তো পাগল পাগল লাগছে।

ইজহান মন ভরে দেখল তার ইস্মিতার হাসিমাখা মুখ। কপালে চুমু আঁকল। ইস্মির অশ্রুসিক্ত গালে ঠোঁট বসাল। কোলে তুলে বারান্দায় গিয়ে বসল। বেলির সুগন্ধে বারান্দা মাতোয়ারা হয়ে গেল। ইস্মি তখনো গুণগুণ করে ওর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদছে। ইজহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“কাঁদে না বউ।”

হিঁচকি তুলে ফিসফিস করে ইস্মি বলে,

“এমন ইজহান শেখকে চেয়েছি আমি প্রার্থনায়, যে
সবসময় আমায় আজকের মতো, এভাবে ভালোবাসবে।”

ইজহানের বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে যায়। ইস্মি মন খুলে কিছু বললেই তার এমন লাগে। ইজহান ওর চুলে ঠোঁট বসিয়ে রাখে। এমন জানলে সে বহু আগেই ফুলের বাগান করে ফেলতো। আঁধার রাতকে সৌন্দর্যের পাতায় মুড়িয়ে দেওয়ার জন্য হুট করেই মেঘ সরে গিয়ে থালার মতো গোলাকার চাঁদটা দ্যুতি ছড়ানোর উদ্যোগ নিলো।

____

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩১

সেদিন শ্বশুরবাড়িতেস আদর আদর সকাল
কাটানোর পর দুপুরের দিকে বিদায় নিয়েছিল ইহসান। এরমধ্যেই দুটো দিন পেরিয়ে গেছে। লাস্ট ডেইটে সৃজা ইহসানকে না জানিয়েই ভার্সিটিতে এলো এসাইনমেন্ট জমা দিতে। কাজ শেষ করে রিকশা নিয়ে ভার্সিটি থেকে সোজা অরবিট টাওয়ারে চলে গেল। ‘Le Cœur de Maman’ এ তখন একটা ফ্যামিলি গেট ট্যুগেদারের পার্টি চলছে। ভেতরে ছোটখাটো স্টেজের মতো বানানো হয়েছে, সেখানে বাচ্চাদের নাচ-গানের ফাংশন চলছে। হৈ-হুল্লোড় আর গানে মাতোয়ারা পরিবেশটা সৃজা বাইরে থেকে ঠাহর করতে পারেনি। সাজানো-গোছানো, রঙিন আলোয় ঝলমল করা রেস্তোরাঁর প্রবেশমুখে ইংরেজি অক্ষরে ‘বুকড’ লেখা। কিন্তু সেটা দৃষ্টিগোচর হলো না সৃজার। সে হুট করেই কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে সৃজা ঢুকে পড়ল। আর তাতে করে দরজার পাশে সেট করে রাখা মিউজিক বক্সের তার ছুটে লাইন অফ হয়ে চারপাশ শুনশান হয়ে গেল। হঠাৎ করে অনুষ্ঠানের মাঝখানে মিউজিক বন্ধ হয়ে যেতেই গেস্টরা কী হয়েছে না হয়েছে দেখতে সকলেই একযোগে ফিরে চাইল। কিন্তু দরজায় অনাকাঙ্খিত এক মেয়েকে দেখে কেউ কেউ কৌতূহল নিয়ে তো কেউ কেউ বিরক্ত চোখে তাকাল। সৃজা আড়ষ্টবোধ করল তাদের চাহনি দেখে। বোকা বোকা হাসলো। সামনে এগুবে নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝে উঠল না। মস্তিষ্ক কাজ করা শুরু করতেই নিজেকে নিজেই বলল, স্টাফদের দরজা দিয়ে ঢুকলেই তো হতো। তাহলে আর এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। সৃজা গেস্টদের দিকে তাকিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলল, “আসলে…”

কথাটা শেষ হলো না, তার আগেই ক্ষ্যাপামতো একজন লোক চেঁচিয়ে উঠল, “আসলে নকলে রাখেন তো ম্যাডাম। কী এক রেস্তোরাঁয় আসলাম, কোনো প্রাইভেসি নেই। যখনতখন মানুষ ঢুকে যাচ্ছে। পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে এসেও শান্তি নেই।”

পাশ থেকে একটা ব্লন্ড চুলের মেয়ে গলায় লোকটাকে বলল, “ইনিই প্রথম ঢুকেছে আব্বু, আর কেউ নয়। এরকম মিস্টেক হতেই পারে। তুমি শান্ত হয়ে বসো।”

সৃজা তড়িঘড়ি করে বলল, “আসলে আমার জানা ছিল না রেস্তোরাঁ বুকড, ভুল করে ঢুকে পড়েছি।”

ব্লন্ড চুলের মেয়েটা দেখতে দারুণ সুন্দরী, কথাবার্তা বলে দারুণ। পরণে ওয়েস্টার্ন, অনাবৃত পেট বেরিয়ে আছে। সে সৃজাকে মিষ্টি হেসে বলল, “ইট’স ওকে আপু। আমরা কিছু মনে করিনি।”

সৃজা কোনোমতে বলল, “আপনাদের অনুষ্ঠানে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য আমি দুঃখিত। প্লিজ বি কন্টিনিউ।”

কেউ কেউ ইট’স ওকে বলল তো কেউ বিরক্তি প্রকাশ করল। সৃজা দুঃখ প্রকাশ করে দ্রুত ওখান থেকে সরে পড়ল। উত্তেজনায় কী বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই পড়তে হলো। ধীরে সৃজা, ধীরে। নিজেকে ধাতস্থ করে বেরিয়ে এসে স্টাফদের দরজায় বেল বাজিয়ে ওখান দিয়ে ঢুকল। সৃজাকে স্টাফরা চেনে-জানে স্যারের বউ হিসেবে, তাই সবাই হাসিমুখেই কথাটথা বলল। কিন্তু ইহসানের খোঁজ করতেই তারা জানাল, ইহসান মাত্রই বেরিয়ে গেছে। সৃজা হতভম্ব মুখে একজন স্টাফকে বলল, “কোথায়?”

“জানা নেই। তবে একটা কথা বলি ভাবি মানে ম্যাম…”

“দয়া করে ভাবিই ডাকুন, ম্যামট্যাম পোষায় না আমার ভাই। তাছাড়া আমি আপনার অনেক ছোট।”

স্টাফটা খুশিই হলো সৃজার সহজ ব্যবহারে। বলল, “আমার মনে হলো, স্যার আসলে আপনাকে দেখেই বেরিয়ে গেছে।”

“মানে?”

“আপনি যখন সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন, স্যার তখন ওখানেই ছিলেন।”

অবাক হলো সৃজা, “আমি তো দেখিনি।”

“কিন্তু স্যার দেখেছে৷ এরপরই তো বেরিয়ে গেল।”

চমকে দিতে এসে নিজেই চমকে গেল সৃজা। ইহসান ওকে দেখল, অথচ ডাকলো না? আবার কিছু না বলে বেরিয়েও গেল? ওর অনেক রাগ হলো ইহসানের উপর। স্টাফদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এলিভেটরে উঠতেই ফোনে ম্যাসেজ এল, “পাখিটার বেশ ডানা গজিয়েছে— কেটে দেব কী?”

না জানিয়ে এসেছে বলে ইচ্ছে করে এরকম করল
ইহসান! রাগে-দুঃখে সৃজা উত্তর না দিয়ে ফোনটাই বন্ধ
করে দিলো। কথাই বলবে না এই নির্দয় লোকের সাথে।
নিচে নামতেই সাঁ করে কালো রঙের বাইকটা নিয়ে সৃজার সামনে এসে দাঁড়ালো ইহসান। প্রথমে চমক উঠলেও পরে নিজেকে সামলে নিলো সৃজা। ভারমুখে, অভিমানী কণ্ঠে বলল, “সরো।”

“উঠ।”

“পারব না।”

“পারতে হবে। উঠে বস।”

সৃজা শক্ত গলায় বলল, “বললাম তো পারব না, উঠব না আমি। একা এসেছি, একাই যেতে পারব। হাত-পা এখনো অক্ষত আছে আমার।”

“তোমার ওসব ছোট পরিসরের অভিমানের চেয়ে আমার রাগের মাত্রা সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ছে। শেষবার বলছি, আদর করে বলছি, উঠে বসো সোনা। নয়তো হাত-পায়ে গজানো সুন্দর, নরম ডানাগুলো বেশিক্ষণ অক্ষত থাকবে না।”

ঠান্ডা হুমকি শুনে সৃজা বাধ্য হয়ে উঠে বসল। বাইকে বসতে এখনো দ্বিধা, ভয় চোখেমুখে স্পষ্ট। ইহসান মিররে ওর মুখ দেখে বাঁকা হাসল। সৃজা ভয় নিয়ে বাইকের পেছনে বসেই একহাতে পিঠ খামচে ধরে অন্যহাতে ইহসানের কাঁধ আঁকড়ে অভিমান নিয়ে বলল, “তুমি খুব খারাপ।”

বাইক স্টার্ট দিতে দিতে ইহসান বলল, “হু জানি, কোথায় যাবি?”

“কোথাও যাব না।”

“তাহলে এসেছিস কেন?”

বাইক সাঁই করে রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল। সৃজা ভয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ গুঁজল ওর পিঠে, “অ্যাসাইমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট আজ। তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম, তাই বলিনি।”

ইহসান শীতল ও রাগান্বিত স্বরে বলল, “বাহ! আমার বউ তো ভালোই সারপ্রাইজ দিতে শিখেছে! তবে সত্যি বলতে আমি যতটা না চমকেছি ততটাই রাগ হচ্ছে তোমার উপর বউ! ইচ্ছে করছে প্রথমদিনের মতো গালে দুটো বসিয়ে দিই মিথ্যে বলার জন্য।”

সৃজা ওর ঘাড়ে নখ বসিয়ে দিয়ে বলল, “আমারও!”

“কী?”

“তোমাকে পুলিশে দিতে ইচ্ছে করছে।”

“তাই, কেন?”

“আমার সারপ্রাইজে বাজে ফিডব্যাক দেওয়ায়,
অবশ্য ওয়েস্টার্ন পরা মেয়েলোক দেখলে বেহেনজি বউকে চড়-থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করে সব পুরুষেরই।”

ভীষণ অবাক হয়ে ইহসান বলল, “ওয়েস্টার্ন পরা মেয়েলোক মানে?”

সৃজা হিংসুক কণ্ঠে বলল, “ব্লন্ড চুলের সুন্দরীকে,
ভুলে গেছ এত তাড়াতাড়ি? সব নাটক। বুঝি না ভেবেছ?”

ক্রুদ্ধ আর অভিমানী গলা সৃজার। ইহসানের কপালে ভাঁজ পড়ল। তার বউ আবার উল্টাপাল্টা ভেবে বসছে নাকি? উহু! তা হতে দেওয়া যায় না। ইহসান হালকা নিভলো, “সে আমার গেস্ট সৃজা।”

সৃজার রাগ এবার বিস্ময় হয়ে ফুটে উঠল, “সে?”

“শাকচুন্নি, শান্তি?”

অতিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতুত্তর এলো। সৃজা হাসি লুকালো বহু কষ্টে, “কিঞ্চিৎ।”

তবে তখনি বাইকের গতি কমিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে ইহসান বলল, “ব্লন্ড চুলের অথবা বারগেন্ডি চুলের শাকচুন্নি হোক। আমার মরণ বহু আগেই হয়ে গেছে কালো চুলের, ক্রন্দসী সৃজা রেহমানেই।”

.

বাইক হঠাৎ থামতেই ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে গেল সৃজাকে। শিরশিরে, ঠান্ডা অনুভূতি গ্রাস করতেই ইহসানের পিঠ থেকে মাথা তুলল সৃজা। চারিদিকে তাকাতেই চমকে গেল। আরে এটা তো সেই নদীর পাড়টা, যেখানে এর আগেও একবার নিয়ে এসেছিল ইহসান ওকে। সেদিন ভিড়ভাট্টা বেশি থাকায় অবশ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। তবে আজ একদম জনশূন্য জায়গাটা, কেউ নেই। শতবর্ষী বটগাছ,
মাটির রাস্তা, ঝোপঝাড়ে অজানা ফুলের সমারোহ, বহমান শান্ত নদী, তীরে বাঁধা ছোট ছোট ডিঙি নৌকো দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল ওর। চোখমুখে খুশিটা ফুটে উঠল, “কী দারুণ! আগের থেকে চমৎকার হয়েছে জায়গাটা, তাই না?”

ওর মুখে হাসি দেখে চিত্ত শিহরিত হলো ইহসানের। বাইক থেকে নামতে নামতে বলল, “হু।”

এরপর নেমে ওর গাল টেনে দিলো, “সব চমৎকার হচ্ছে কিন্তু তুই দিনদিন অবুঝ-অবাধ্য হচ্ছিস।”

“আমি, কীভাবে?”

“এইযে, আমাকে সারপ্রাইজ দিবি বলে একা একা চলে এলি, না করিনি আমি এভাবে না বলে কোথাও না যেতে? রাস্তাঘাটে কোনো বিপদ হলে তখন কী করতাম আমি? তোর এলাকাটা তো ভালো নয়। সেখানে কত শত্রু আছে তোর ভুলে গেছিস? যদি তারা এই সুযোগে তোর আবারো কোনো ক্ষতি করে দেয়? আমি এমনিতেই ওখানে পাঠিয়ে তোকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তায় আছি, জানিস না! অথচ তুই গুরুত্বই দিস না সৃজা।”

ইহসানের চিন্তার কারণ শুনে সৃজার মন খারাপ হয়ে গেল। আসলেই ওর মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল এলাকার ষন্ডা-পাণ্ডাগুলোর কথা! যারা কুৎসা রটিয়েছিল, শ্লীলতাহানি করে ভিডিয়ো পর্যন্ত করেছিল ওর। মাত্র দু-মাস আগের কাহিনী। অথচ সৃজা ইহসানের বারবার মানা স্বত্তেও কে না বলে হুজুগের বশে বেরিয়ে পড়েছে। যেটা একদম ঠিক হয়নি। সারপ্রাইজ অন্যভাবেও দেওয়া যেত। না হোক কোনো বিপদ, মানুষটার কথার দাম দেওয়া উচিৎ ছিল, মান্য করা উচিৎ ছিল। মানুষটা মনে মনে হয়তো নারাজ হয়েছে। সৃজার সবকিছু শূন্য শূন্য ঠেকল ওর চোখের দিকে চেয়ে। বুক ভারী হলো। অপরাধবোধ জাগ্রত হলো। ধুর, এই মানুষটার কথা কীভাবে অমান্য করে ও? কেন গুরুত্ব দেয়নি? সৃজা চোখে চোখ মিলাতে পারল না ওর। ইহসান চুপ করে ওকে দেখছে,
হিজাব ভেদ করে বেরিয়ে আসা চুলগুলো হাওয়ায় এদিক-ওদিক উড়ছে। সে চুলগুলো দেখছে একদৃষ্টে। সৃজা আড়ষ্টতা কমাতে আশপাশটা একপলক দেখে নিয়ে ম্লানস্বরে বলল, “আর কখনো তোমাকে না
বলে কোথাও যাব না, প্রমিজ।”

“মনে থাকবে?”

“হু।”

.

ডিঙি নৌকোর কিনারে বালিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে সৃজা। আর ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ইহসান। তার চোখ বোজা। সৃজা ওর লম্বা চুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে বিলি কাটছে চুপচাপ। ওর ভালো লাগছে। তবে তার চেয়ে বড় ব্যাপার এই বিশাল আকাশের ছাউনির নিচে, মিষ্টি রোদ পড়া সুদর্শনের ঠোঁটে উত্তপ্ত একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। ব্যাপারটা একান্তই ওর ইচ্ছে, কিছুটা লজ্জাবোধও হচ্ছে। তাই মুখে প্রকাশ করল না সেটা। অপারগ নীরব পরিবেশের নিঃস্তবদ্ধতা বাড়িয়ে দিতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরক্ষণেই মনে হলো, কী এমন হবে একটা চুমু খেলে, বরটা তো ওরই! আশেপাশে মানুষ দূর কাকপক্ষীও নেই। আর এই অভদ্র লোকটাও ঘুমিয়ে আছে। এই সুযোগে একটা চুমু খেয়ে নিলে বুঝতেই পারবে না। যেই ভাবা সেই কাজ! সৃজা চট করে একটা চুমু খেল ইহসানের কপালে, এরপর নাকে। নড়চড় করল না ইহসান। সাহস বাড়ল মেয়েটার। নিজের ওষ্ঠাধর ছুঁইয়ে দিলো পুরুষালি শুকনো ঠোঁটে। ওমনি খপ করে ওর মাথা ধরে ফেলল ইহসান। ছটফট করেও শেষরক্ষা করতে পারল না সৃজা। সময় নিয়ে পরবর্তী কাজটা শেষ করল ইহসান। সৃজা ধরা পড়ে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলল। সুবোধ বালিকার ন্যায় অন্যপাশে আকাশ দেখার ভান করল। ইহসান কিছুই বলল না। আবারো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। সৃজা এবার আর পারল না। ওর খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “এখানে ঘুমাতে এসেছ, এটা ঘুমানোর জায়গা? চুল দাঁড়ি কাটো না কেন?”

ইহসান হাই তোলার ভান করে উঠে বসল এবার। গলায় নাটকীয়তা এনে জবাব দিলো, “দু-রাত ঘুম হয়নি, তাই ঘুমাতে এসেছি। আর চুলদাঁড়ির কথা, সে তো বউ এতদিন খেয়াল করে বলে দেয়নি, তাই কাটিনি। তবে আজ যখন করেছে কালই কেটে ফেলব। পরশু বাড়ি ফিরছিস তো তুই, দেখবি তোর বর সেজেগুজে খাটে বসে আছে।”

সৃজা প্রথমে চোখ পাকিয়ে তাকাল, এরপর হেসে ফেলল। ইহসান ওর হাসির দিকে তাকিয়ে নিজেও আনমনে হেসে ফেলল। এরপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে প্যান্ট গুঁজতে শুরু করল। সৃজা জিজ্ঞেস করল কী কারণ— বলল না সে। তীরের হাঁটু সমান পানিতে নেমে পড়ল। খানিক দূরে পাড়ের মধ্যে কলমি ডগা, সেখানে ফুটে আছে হালকা বেগুনি রঙে আবৃত
মিষ্টি কলমি ফুল। ইহসান পকেট ভর্তি করে ফুল নিলো, অধিকাংশই চ্যাপ্টা হয়ে গেল। তবুও নিলো। ফুলে তেমন গন্ধ নেই৷ ইহসান ফিরে এসে ফুলের গন্ধ শুঁকে মুখ কুঁচকে ফেলল। সৃজা ওর মুখ দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “কী?”

ইহসান ঠোঁট উল্টে ফেলল, “সুগন্ধহীন।”

“এমনি হয়।”

“আগে দেখেছিস?”

“খুব ছোটবেলায়, মা ছিল তখন।”

হঠাৎ মায়ের কথা বলে হাসি ম্লান হলো সৃজার
ঠোঁটের। ইহসান অবশ্য বেশিক্ষণ ওকে সেভাবে বসে থাকতে দিলো না। ওর হিজাব সরিয়ে চুলগুলো নিয়ে বেণীগাঁথতে বসল। বেণী গেঁথে সেগুলোর ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিলো কলমি ফুল। কালো চুলের ভাঁজে ফুলগুলো আকর্ষণ বাড়াচ্ছিল এই শান্ত নদীর দেশে। ইহসান ঘনঘন নাক ডুবাল সৃজার চুলে। ওর কান্ড দেখে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল সৃজা, ইহসান ধমকে ওকে চুপ করাল। ফিসফিস করে বলল,
“তোর হাসিটা পুরো ফাঁসির মতোন।”

পকেটে ভ্রাইবেশন মুডে রাখা ফোনটা তখনি কম্পিত হলো। ইহসান বিরক্ত ভঙ্গিতে সেটা বের করে ম্যাসেজ সিন করল, “ল্যাভেন্ডারের সিমিলার, তাই না?”

চোখমুখ শক্ত করে রিপ্লাই করল ইহসান—
বড়ভাবী মায়ের মতো হয়। তাই কিছু মনে করিনি।

ফোনটা বন্ধ করে ইহসান সৃজার চুলের বেণী খুলে
ফেলল, সব ফুল এক এক করে ছাড়িয়ে ফেলে দিলো।
সৃজা এই আচরণের মানে বুঝল না। ফিরে দেখল চোখমুখ লাল হয়ে আছে ইহসানের। সৃজা বিচলিত হয়ে ত্বরিত বলল, “চোখমুখ এমন লাগছে কেন তোমার?”

“আর কখনো এই রঙের বা এর সিমিলার কোনোকিছু
পরবি না। না জামাকাপড়, না ফুল। সব নিষিদ্ধ তোর জন্য।”

“কিন্তু কেন?”

সৃজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। ইহসান চোখমুখে বিরক্তি এনে বলল, “আমি বলেছি তাই। এই রঙ বিচ্ছিরি দেখায় তোকে, একদম যায় না।”

বলে পরক্ষণেই বিড়বিড় করল, “তোর ল্যাভেন্ডারের আগুনে আমি না, আমার ভাইও ছাই হয়ে যাচ্ছে।”

সৃজা শুনে ফেলল কথাটা, ”তোমার ভাই?”

_______

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩২

প্রকৃতিতে শীতের ডাক এখনো পড়েনি। তবে ইদানীং বিকেল নামতেই ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে রোদকুচি। চারিদিকে মন খারাপ ভাব। নীলু বেগমের শরীর ভালো না, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি ঘুমিয়ে আছেন নিজের ঘরে। এদিকে আগামীকাল চলে যেতে হবে, সব মিলিয়ে সৃজার মন খারাপ, সাথে এলিজারও। একজন বিকলাঙ্গ, বাকশক্তিহীন পুরুষ আর তিনজন অসমবয়সী মেয়েলোকই এতদিন অর্ধমৃত ফ্ল্যাটটির কিঞ্চিৎ প্রাণ ছিল। কিন্তু সৃজার অনুপস্থিতিতে আগের সেটুকু প্রাণোচ্ছলতাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এলিজা সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নাইমুর সাহেব তো বিছানায় পড়া, যার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, বোধগম্যতা নেই। একেবারে শক্তি-সামর্থ্যহীন। নীলু বেগমের দিনকাল পঙ্গু ও বোধশক্তিহীন ভাইয়ের সেবাযত্ন করেই কাটান। নয়তো নামাজকালাম পড়ে, কখনোসখনো ওল বুনে অবসর সময় কাটাতেন। অথচ সেই মানুষটাও আজ বিছানায় পড়া। একাকিত্বের ভারে আজকাল তিনিও কেমন নরম হয়ে পড়ছেন। বহুবছর আগে মা চলে যাওয়ার পর থেকে একদম একা হয়ে পড়েছিল এই পরিবারটা। তখন এই ফুফুই তো আগলে রেখেছিল ওদেরকে, জীবনে কোনোদিন কিছু না পাওয়া স্বত্তেও কখনো কিছু চাননি, আফসোস করেননি। সৃজার তাই আজকাল মাতৃতুল্য ফুফুটার জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়, ভেতরটা বিষন্ন লাগে। আগামীকাল চলে গেলে আবারো এলিজা, ফুপি একা হয়ে যাবে। অর্ধমৃত ফ্ল্যাটটা আরো শুনশান হয়ে যাবে। ভেবেই সৃজার চোখদুটো ভিজে আসে। কী আশ্চর্য! আগে কখনো কথায় কথায় ওর চোখ ভিজতো না, কিন্তু এখন কিছু হলেই চোখদুটো নোনাজলে ভিজে উঠতে চায়। দুর্বল ঠেকে নিজেকে। নিজের এই দুর্বলতা নিয়ে সৃজার ভয় হয়, বড় বিষন্ন লাগে। এই বিষন্নতায় ঘেরা রাত দশটার দিকে হঠাৎই কুরিয়ার থেকে সৃজা রেহমানের নামে একটা পার্সেল আসে। কোনোকিছু অর্ডার না করা স্বত্তেও এত রাতে পার্সেল পেয়ে সৃজা যখন বিচলিত তখন এলিজা বলল, পার্সেল খুলে দেখলেই হয়। বোনের কথামতো পার্সেল খোলার পর একটা ল্যাভেন্ডার ফুলের বুকে আর একটা চিরকুট পাওয়া গেল৷ চিরকুটে
শুধু দুটো শব্দ লিখা,

‘ল্যাভেন্ডারের জন্য।’

চিরকুট পড়ে সৃজার ভ্রু কুঁচকে আসে। দ্বিধায় পড়ে যায়।
কে পাঠিয়েছে পার্সেলটা? তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনও তো নেই সৃজার যে এসব পাঠাবে! তাহলে কে পাঠাল? ইহসান? ও কেন এসব পাঠাবে? তাও এ ধরনের লেখা? কাল তো সৃজা বাড়িতে যাচ্ছেই। কিন্তু ইহসান যদি না পাঠিয়ে থাকে তাহলে? এলাকার কোনো বখাটে আবার এমন মজা করেনি তো? সৃজা চিন্তায় পড়ে গেল। এলিজা বোনের চিন্তা দেখে ফোন করে ইহসানকে একবার জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করল। কিন্তু সৃজা মানা করল।
যদিও সে নিজেও দ্বিধাদ্বন্দে ছিল, তবুও বোনকে বোঝাল, ইহসান হয়তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। তাই পাঠিয়েছে। এখন যদি সারপ্রাইজড না হয়ে উল্টো ওকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তাহলে ব্যাপারটা বিশ্রি দেখাবে। তাছাড়া ইহসান যদি না পাঠিয়ে থাকে তাহলে ওকে এসব বললে এত রাতে লোকটা চিন্তায় তো পড়বেই, ঝামেলাও করতে পারে। তাই পরে জানাবে বলে মনোস্থির করল। বোনের অমত দেখে এলিজা আর ইহসানকে ফোন করল না। চেপে গেল। তবে নীলু বেগমের সেদিন রাতে আগের চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তার সেবা করতে গিয়ে দু’বোনের মাথা থেকে এ বিষয়টা উবে গেল। যদিও পরদিনই নীলু বেগম অনেকটা সুস্থ হয়ে যান, কিন্তু তাও সৃজা আরো ক’দিন থেকে যাওয়ার বায়না ধরল ইহসানের কাছে। ইহসান অবস্থা বিবেচনা করে তিনদিন থাকার অনুমতি দিলেও আরো চারদিন বাড়িয়ে দু-সপ্তাহ পর শেখ বাড়িতে ফিরে এলো সৃজা। এদিকে কথা অমান্য করায় ইহসান রাগ করে ওকে আনতেও যায়নি, বিকেলের দিকে রশিদকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রাতে রেস্তোরাঁ থেকে বাড়িতে ফিরেও সৃজার সাথে কোনো বাক্যবিনিময় করল না। হ্যাঁ, না কোনোকিছু না। সারাক্ষণ এ কাজ, সেকাজের বাহানা দেখিয়ে ফোন আর ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে রইল। রাগ বুঝে সৃজা ওর আশেপাশে ভীতি নিয়ে ঘুরঘুর করল। নিজে থেকে প্রশ্ন করল। ইহসান হু, হা উত্তরে সীমাবদ্ধ থাকল। এমনকি ঘুমানোর সময়ও ইহসান ওর বুকে মাথা রাখতে দিলো না। কাঁদোকাঁদো মুখ করেও লাভ হয়নি সৃজার, ইহসান শক্তপোক্ত গলায় অন্যদিকে ফিরে শুয়ে কাছে না ঘেঁষার রেস্ট্রিকশন দিয়ে দিলো। সৃজা এসব মানলে তো! জোরাজুরি করে নিজে থেকে কাছাকাছি গেল, গিয়ে অবশ্য ফেঁসে গেল। ইহসানও সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিলো। রাতভরে রাগ মিশিয়ে আদর করল তো ঠিকই, তবে একশর্তে ওকে মাফ করবে বলে জানাল। সৃজা শর্ত জানতে চাইলে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, অতি শ্রীঘ্রই বাবা হতে চায়, প্রিন্সেস লাগবে ওর। সৃজার প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতোন, স্তব্ধতায় মুড়ানো চমকিত মুখখানা,
পরবর্তীতে যা ইহসানের নগ্ন বুকের নিচে চাপা পড়েছিল!

.

দু’সপ্তাহ পর শেখ বাড়িতে ফিরে লিথুকে না দেখে
বেশ অবাক হলো সৃজা। যে মেয়ে সারাদিন রঙঢঙ করে ইহসানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে এবং বিয়ের এ দু-আড়াই মাসে একদিনের জন্যও বাপের বাড়ি যাওয়ার নামগন্ধ নেয়নি, সে শেখ বাড়িতে নেই? ইস্মির কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে সৃজা মনে মনে স্বস্তি পেল বেশ। যাক, এতদিন তাহলে ডাইনিটা ছিল না। ভালোই হয়েছে। যখন তখন ইহসানের গায়ে ঢলে পড়া এ মেয়েকে একদম সহ্য হতো না ওর, পছন্দ করতে পারে না সৃজা। গিয়ে ভালোই হয়েছে ওর কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে গেছে ইহসানটা। তবে একটা জিনিস সৃজা খেয়াল করল, যে ইস্মির ঠোঁটে হাসি খুঁজে পাওয়া দুর্বোধ্য ছিল, তার ঠোঁটের কোণে এখন এক-আধটু হাসিত হাসির ছিঁটেফোঁটা পাওয়া যায়; যেটা আগের মতো নকল নয়। সৃজার বেশ ভালো লাগল এবারের ইস্মিকে দেখে।

.

নতুন ডিলের চুক্তি সেরে ইজহান ফুরফুরে মেজাজে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল। হাতে তার শপিং ব্যাগ আর পিজ্জার পার্সেল। ডিলের চুক্তি হয়ে যাওয়ার খুশিতে ইস্মির জন্য সে গোলাপি রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি এনেছে, নিজে পছন্দ করে। এই রঙে তার বউকে রাণীর মতো লাগে। প্রতিবারের মতো বাড়ি ফিরে হাঁকডাক না ছুঁড়ে সে নিঃশব্দে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখল ইস্মি নেই, ঘর খালি। ইজহানের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। এই বিকেলে তার বউ আবার কোথায় গেল? এ সময় তো এই মেয়ের ঘরে থাকার কথা! আবার ভেড়ার বউটার সাথে গল্পে মজেছে না তো? দেখল তো সে, গতদিন বাড়ি ফিরেছে৷ ইজহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। নিশ্চয় তার ইস্মিতার মাথায় উল্টাপাল্টা কুবুদ্ধি ঢোকাচ্ছে ভেড়ার বউটা, হয়তো বলছে তারা কী রোমান্টিক সময় কাটায়, রিকশা করে ঘুরে, বাইকে করে নদীর পাড় যায়, ফুচকা খায় ইত্যাদি! ইজহান তিরিক্ষি মেজাজে শপিং ব্যাগ আর পিজ্জার প্যাকেট রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এ ঘর, ও ঘর খুঁজতে লাগল। পেল না কোথাও। শেফালি বুয়াকে জিজ্ঞেস করল৷ সেও নাকি দেখেনি। বসার ঘরে, রান্নাঘরেও নেই৷ চিন্তিত হলো ইজহান। কোথাও না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ইহসানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এখন তার বদ্ধ বিশ্বাস ইস্মিতা এ ঘরেই সৃজার সাথে আড্ডা জমিয়েছে। বউটা তার এই মেয়ের কাছ থেকে কুবুদ্ধি নিয়ে গাল ফুলিয়ে থাকবে তার সাথে—নাহ! এ হতে দেওয়া যায় না। একবুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইজহান বহুদিন… উহু! বহুবছর পর ইহসানের ঘরের দরজায় টোকা দিলো, আস্তে করে দুটো টোকা দিয়েই সে অবশ্য থেমে গেল। বুকটা আচমকা ভার লাগল! এ ঘরটা…এ ঘরটা তার মায়ের! তার কত প্রিয়, অথচ দেয়নি! ভেড়াটা দেয়নি এ ঘরটা, নিজে দখলে নিয়ে বউটাকে নিয়ে সংসার পেতে বসেছে। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুলতে এত সময় লাগে নাকি? অসহ্য হয়ে সে থাবা বসায় আবারো, ভেতর থেকে মেয়েলি গলা ভেসে আসে,

“আসছি…”

দরজা খুলে ইজহানকে দেখে সৃজা অবাকই হয়। তবে সেটা বুঝতে দেয় না৷ মাথায় ওড়নাটা টেনে বিহ্বল কণ্ঠে বলে,

“ভাইয়া আপনি, কিছু দরকার?”

আদিক্ষেতা! ভাই ডাকা হচ্ছে! সে আবার কখন থেকে এই মেয়ের ভাই বনে গেল? হুহ! ইজহান শক্ত মুখ বানিয়ে গমগমে স্বরে বলে,

“ইস্মিতাকে আসতে বলো।”

সৃজা অবাক হয়ে বলল,

“ইস্মিতা… মানে ভাবি, ভাবি তো এখানে নেই।”

ইজহান ভ্রু কুঁচকে ফেলে,

“নেই মানে?”

“নেই মানে এখানে আসেনি।”

“মিথ্যা বলছ, ডাকো ওকে।”

সৃজা বোকা হয়ে যায়, সরু গলায় বলে,

“আশ্চর্য! মিথ্যে বলব কেন আমি আপনাকে?”

ইজহান কটমট করে বলে,

“আমার বউকে কানপড়া দিতে, আর কেন! শুনে রাখো মেয়ে, আমি কিন্তু একদম এলাউ করব না আমার বউকে কু-বুদ্ধি দিয়ে নষ্ট করলে।”

সৃজা হতভম্ব হয়ে ইজহানের দিকে তাকিয়ে রইল। এ লোকটা কীভাবে এমন সন্দেহপ্রবণ হতে পারে? এতদিন হলো বিয়ে হয়েছে, তবুও নিজের বউকে সামান্য বিশ্বাস করতে পারে না? আর তার কী দোষ? সে কখন ইস্মিতাকে কুবুদ্ধি দিল? এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগে রাগের চেয়ে বিস্ময়ই বেশি লাগছে ওর!

“ভাইয়া, আপনি যা বলছেন, সেটা ঠিক না। ভাবি এখানে আসেননি। আমি জানিও না উনি কোথায় আছে। আর আমি কেন ওনাকে কুবুদ্ধি দিতে যাব?”

“কৈফিয়ত চাও? বেয়াদব! ডাকো ইস্মিতাকে, আমি জানি ও এখানেই আছে। ইচ্ছে করে মজা করছ, আমায় বোকা ভেবো না।”

গমগমে স্বরে চেঁচিয়ে উঠে ইহসান। সৃজা প্রথমে হকচকিয়ে উঠে। ভীত গলায় বিস্ময় নিয়ে বলে,

“ভাবি নেই, আসেনি এখানে। বিশ্বাস করছেন না তো, এসে চেক করে যান।”

ইজহান ভ্রু কুঁচকে থাকে। এ মেয়েকে বিশ্বাস করতে তার বয়েই গেছে। আস্ত নাটকবাজ এরা ভেড়া-ভেড়ী! নিশ্চয় ইস্মিকে এটাসেটা বুঝিয়ে এখানে চুপ করে বসিয়ে রেখেছে। তার বউটা তো সরল, নিশ্চয় এদের কথা মেনে বসে আছে। কিন্তু আছে কী? নাকি নেই? ঘর ঢুকে একবার চেক দেবে কী? নাকি না? দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই একসময় সে ঘরের ভেতর পা বাড়ায়, বহুবছর পর! সৃজা একপাশে সরে দাঁড়ায়। ইজহান ঘরে ঢুকে এদিকওদিক দেখে, ইস্মিতা নেই কোথাও। বারান্দায় খুঁজে, সেখানেও পায় না। না পেয়ে সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। নিচে বা ছাদেও তো নেই ইস্মি, এখানেও আসেনি। তাহলে গেল কোথায়? ওকে এভাবে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সৃজার হাসি পায়, ঠিক ইহসানের চেহারা বেরিয়ে এসেছে। এই দু-ভাইয়ের এত মিল কেন, কীভাবে হয়! এইযে, ইজহান ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে আছে, কাছের মানুষ না হলে কেউই
ধরতে পারবে না যে, তারা দু’জন ভিন্ন পুরুষ! সৃজা ধরতে পারে, বেশ ভালোভাবেই। ইহসানের গায়ের ঘ্রাণ শুনলেই বুঝে, দূর থেকে একবার দেখলেও বুঝে। এটা কী—ভালোবাসা, টান? হয়তো তা-ই! সে ডাকলো ইজহানকে।
নম্র স্বরে বলল,

“পেলেন ভাবিকে?”

ইজহান বিরক্ত চোখে তাকাল,

“কোথায় ও?”

সৃজা হতাশ গলায় বলল,

“এখানে আসেনি। দুপুরে রান্নাঘরে দেখেছিলাম,
কিন্তু এরপর আর দেখিনি।”

ইজহান ঠিক বিশ্বাস করতে চাইল না, কিন্তু সৃজার ভদ্রসভ্য মুখ দেখে মনেও হলো না এই মেয়ে মিথ্যে বলছে। তার চিন্তা শুরু হলো ইস্মির জন্য, বুক ব্যথা অনুভূত হলো, হাত দিয়ে চেপে ধরল। সৃজা সেটা বুঝে সাবধানী কণ্ঠে ওকে বলল,

“ফোন দিয়ে দেখুন নয়তো….”

“ওর ফোন নেই।”

শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো ইজহান। সৃজার বুক কেঁপে উঠল ওর ধমক শুনে। আমতাআমতা করে বলল,

“তাহলে ছাদে গিয়ে খুঁজে দেখি, দাঁড়ান আমি দেখে আসছি….”

“নেই কোথাও, খুঁজে এসেছি।”

অসহায় শোনাল যেন গলাটা। ইজহান কী প্যানিক করছে নাকি? সৃজারও এবার চিন্তা লাগল। গেল কোথায় ইস্মি?
ও ঘর থেকে বেরিয়ে আবারো খুঁজল ছাদে, সব ঘরে। পেল গিয়ে সালেহা বেগমের ঘরে। সালেহা বেগমের পায়ে সরষের তেল মালিশ করে দিচ্ছে ইস্মি। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকায় ইজহ৷ হয়তো ভেবেছে এ ঘরে নেই ইস্মি। সৃজা
দেরি করল না ইজহানের ফেরার খবরটা ইস্মিকে দিতে।
শুনে ইস্মি হন্তদন্ত হয়ে কাজ সেরে ছুটে গেল উপরে, সৃজাদের ঘরে। গিয়ে দেখল ইজহান ঐ ঘরের মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বুকে হাত চেপে বসে আছে। ইস্মি চিৎকার দিতে গিয়েও দিলো না৷ ছুটে গিয়ে ধরল ওকে। বুকে হাত বুলাতে বুলাতে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

“কী হলো আপনার?”

ইজহানের জানে যেন পানি ফিরে এলো বউয়ের গলা শুনে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। এরপর হুট করে একহাতে গাল চেপে ধরে বলল,

“কই ছিলি তুই? কোন প্রেমিকের সাথে বিকেলের
প্রেম জমাতে গেছিস? এদিকে সারা বাড়ি খুঁজে আমি হয়রান!”

ইস্মি জানতো না ইজহান আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরবে, কখনো ফেরেও না এমন সময়ে। আজ এমনিতেই ক্ষেপে আছে, এখন যদি শুনে ইস্মি
সালেহা বেগমের পা মালিশ করে দিচ্ছিল, অন্যের কাজ করছিল তাহলে এই লোক আরো হাজারটা প্রশ্ন করে ওকে আধমরা করে ফেলবে। ইস্মি তাই আমতাআমতা করে বলল,

“মাথাব্যথা করছিল, আম্মার ঘরে ঔষধ খেয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

বউকে খুঁজে না পেয়ে কী অবস্থাই না হয়েছে লোকটার! এত এত টক্সিসিটির মাঝেও ইজহানের এই বউ পাগলামো মনোভাব দেখে সৃজার একসাথে মিশ্র অনুভূতি হলো। এদিকে ইজহান বউয়ের অসুস্থতার খবর শুনে শান্ত হলো। রাগ-ক্ষোভ উবে গেল। উল্টো ওকে কাছে টেনে নিয়ে বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করল,

“মাথাব্যথা কমেছে?”

“কমে গেছে।”

“সত্যি?”

“মিথ্যা বলি আমি?”

অভিমানী গলা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ইজহান মাথা নাড়ল দু’পাশে। ইস্মিতা মিথ্যা বলে না, সে জানে। ইজহান
স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে, তখনি ওর চোখ যায় দরজায়। বাইরে দাঁড়ানো সৃজা। যদিও এদিকে তাকাচ্ছে না, তবুও ওকে দেখে মুখটা কালো করে ফেলে ইজহান।
ইস্মিকে বলে,

“এই বউটা কুনজর দিবে, চল ঘরে যাই!”

ইস্মি ধমক দিতে গিয়েও দেয় না, হতাশ গলায় বলে,

“চলুন।”

দু’জনেই উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যাবে বলে ইজহান একবার ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়, বারান্দায় উঁকিঝুঁকি মেরে আসে। ইস্মি বোকার মতো ওর কান্ড দেখে। ডাক দেয় ওকে। ইজহান অপ্রস্তুত হয়ে যায়, ইস্মির হাত ধরে বেরিয়ে আসে৷ বেরিয়ে এসে সৃজাকে ইজহান রাগী গলায় বলে,

“তুমি আমার বউ থেকে দূরে থাকবে। আমার সংসারে অশান্তি চাই না আমি।”

ইস্মি হতবিহ্বল। পাগল নাকি এই লোক? কাকে কী বলছে? ইস্মি কিছু বলতে যাবে তার আগেই সৃজা ওকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে ইজহানকে বলল,

“আপনার সংসার! আপনার সংসারে অশান্তি থাকুক বা না থাকুক, এতে আমার কিছু যায় আসবে না। কিন্তু আপনার বউয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিল, সেটা একবার ভেবে দেখবেন ভাইয়া। আর আমি সত্যিই চাই, আপনারা সুখী থাকুন, সুখী হোন। আপনি একটু পাগল আছেন বটে, কিন্তু নাইস গাই। আপনি নিজের মনটাকে কন্ট্রোল করলে সত্যিই আপনারা পারফেক্ট কাপল হবেন।”

কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল ইজহান, কোনো উত্তর দিলো না। এই নারীবাদি মেয়ে কী ওর প্রশংসা করল নাকি নিন্দা? কনফিউশনে পড়ে গেল সে। ইস্মি বহুকষ্টে হাসি আটকাল। ইজহান বোকা বোকা হয়ে গেল। সৃজাকে ধমক দিলো,

“বেশি কথা বলো তুমি।”

“কম বলার চেষ্টা করব।”

“তাহলেই ভালো।”

এটুকু বলে হঠাৎ করেই আবার ইহসানের ঘরটাতে প্রবেশ করে ইজহান। ইস্মি হতভম্ব, সাথে সৃজাও। এমন করছে কেন এই লোক? দু’জনেই কিছু বোঝে উঠল না। ইজহান গিয়ে দেয়ালে টাঙানো একটা ভ্যান গগের একটা পেইন্টিং খুলে নিয়ে সঙ্গে নিয়ে নেয়। সৃজাকে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করে না, তবে ঘর থেকে বেরিয়ে ফিসফিস করে ইস্মিকে বলে,

“এটা আমাদের ঘরে টাঙাব।”

ইস্মি বুঝতে পারে না ভাইয়ের ঘরের পেইন্টিং এই লোক না বলে নিয়ে এলো কেন! ও বিস্মিত হয়ে বলে,

“কিন্তু এটা তো ওদের।”

“চুপ, এটা ওদের না।”

ইস্মি শুধোয়,

“কার তাহলে? আপনার?”

ইজহান নম্র স্বরে বলে,

“উহু! আমার মায়ের।”

________

চলবে…