অশ্রুবন্দি পর্ব-৩৩+৩৪

0
10

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৩

অফিস থেকে দেরি করে ফেরায় দেরিতেই ইজহান ভাত খেতে বসেছে, নিজের হাতে যদিও খাচ্ছে। সাথে ইস্মিকেও মুখে তুলে দিচ্ছে। পাতে রুই মাছের তরকারি, কিন্তু কাঁটা নিজে বাছতে পারছে না। ইস্মিকে বেছে দিতে হচ্ছে। একজন লোকমা মাখবে, একজন মাছ বাছবে। মহা যন্ত্রণা! খাবার মুখে নিতে নিতে ইস্মি ওকে বলল,

“আমাকেই দিন না, আমি কাঁটা বেছে মেখে দিই। এভাবে সব ঘেঁটেঘুঁটে যাচ্ছে।”

ইজহান প্লেট সরিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলল,

“না, তুমি শুধু মাছটাই বাছো। আমি তো খাইয়ে দিচ্ছিই, ভালো লাগছে না?”

ইস্মি শুকনো গলায় বলল,

“সেটা আমি কখন বললাম?”

ইজহান বিরক্ত হলো নিজের উপর। আশ্চর্য, সে বউকে ধমকি দিচ্ছে কেন? এখনি না আবার মন খারাপ করে ফেলে। এই মহিলা ইদানীং কথায় কথায় গাল ফুলাচ্ছে।
পাঁচ বছরে এমন রুপ সে হাতেগোনা দু-বার দেখেছিল। আর ইদানীং বেশিই দেখছে। আজকাল তাই সতর্ক থাকে সে কথা বলার সময়। গুগপ করে জেনেছে সে, অহেতুক কথা বলে কষ্ট দিয়ে কোনোভাবেই বউকে মন খারাপ করিয়ে দেওয়া চলবে না। তাতে ভালোবাসা কমে যাবে। এটা তো
সে হতে দেবে না, নো নেভার। ইজহান ঠোঁটে হাসি আনার প্রচেষ্টা করে বলল,

“বলোনি? ওহ! আচ্ছা এখন চুপ করো। খাওয়ার সময় এত কথা বলতে নেই, গলায় আটকে যাবে।”

এ কথা শুনে বিস্মিত ইস্মি আড়ালে মুখ ভেঙালো। নিজে যখন খেতে বসে হাজার কথা বলে ওর কান ঝালাপালা করে দেয়, তখন উপদেশবাণী কই থাকে? নিজের বেলায় সব ঠিক, অন্যের বেলায় বেঠিক। ইস্মি বিড়বিড় করল। ইজহান নিজের লোকমা মুখে পুরে ইস্মির মুখে যখন খাবার দিতে গেল তখন গোলাপি ঠোঁটজোড়ার নড়নচড়ন দেখে সে ভ্রু
কুঁচকে রুক্ষ গলায় বলে উঠল,

“কী বিড়বিড় করছ? আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন?”

ইস্মির হুঁশ ফেরে। থতমত খেয়ে বলে,

“কারণ আমি কিছু বলিইনি।”

“আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি বিড়বিড় করছ।”

“করিনি।”

ইজহান সূক্ষ্ম চোখে তাকায়, দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

“করেছ।”

ইস্মির রাগ লাগে খানিকটা। প্রকাশও করে ফেলে,

“আপনি সবসময় অহেতুক বিষয় নিয়ে পড়ে থাকেন কেন বলুন তো? আমি কেন বিড়বিড় করছিলাম সেটা জেনে আপনার কী কাজ? খেতে বসেছেন খাবারটার দিকেই মনোযোগ রাখুন না। এতদিকে নজর দিলে খাওয়া
ঠিকঠাক হবে? গলায় আটকে মরে যাব তো!”

বিরক্তি প্রকাশ পায় ইস্মির কণ্ঠে। কুঞ্চিত হয়ে উঠে ভ্রু জোড়া৷ ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুকজ মুছে নেয়। ইজহান লাল চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর হাতে তোলা খাবারটা প্লেটে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“আমার প্রতি খুব বিরক্তি কাজ করে তোমার?”

ইস্মি কিছু না ভেবেই জবাব দেয়,

“সারাক্ষণ এভাবে যন্ত্রণা দিলে বিরক্ত তো লাগবেই। আর ছোটখাটো বিষয়ে আপনি যেভাবে হাইপার হয়ে যান, মাঝেমাঝে দমবন্ধ লাগে আমার। জেলখানায় বন্দি মনে হয়। আচ্ছা, আপনাকে যদি কেউ এভাবে সারাক্ষণ প্রশ্ন আর সন্দেহ করে কথাবার্তা বলে আপনি বিরক্ত হবেন না? ইচ্ছে করবে না দুটো চড় বসিয়ে দিই?”

ইজহানের চোখ জ্বলে উঠে। এলোমেলো লাগে মাথার ভেতরটা। হঠাৎ প্লেট রেখে ঠাস করে উঠে দাঁড়ায় সে। কোনো বাক্য বিনিময় না করে হাত ধুতে চলে যায় বেসিনে। ইস্মি বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। মস্তিষ্ক কাজ করে ততক্ষণে। জিভ কাটে পরপর। কপাল চাপড়ায়। কাকে এতক্ষণ ভাষণ দিলো সে? ইজহান শেখকে? নিজের অবুঝ স্বামীকে? যে এসব কথার মর্ম বোঝে না? যে এখন ফিরে এসে রাগারাগি করে আরেক প্রস্ত যন্ত্রণা দিবে? ইস্মি হতাশ হয়ে ঘাড় বাঁকায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে বিছানার সাইডে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মুখ তুলে চায়। ইজহানের থমথমে মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। কৈফিয়ত দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ওকে একটি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ইজহান গিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে গা, হাত-পা ছড়িয়ে। ইস্মি ভড়কে গিয়ে থম মেরে থাকে। এত শীতল কেন মানুষটা? রাগারাগি করল না যে? ঝড়ের পূর্বাভাস নয়তো? মাথায় হয়তো ছক কষছে কীভাবে ওকে যন্ত্রণা দিবে একটু একটু করে। ইস্মি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ঢোক গিলে ভীত কণ্ঠে শুধোয়,

“খাবার পড়ে আছে যে…”

ইজহান ধমকি দেয়,

“তুই খা।”

“আপনি তো কিছুই খেলেন না…”

“খাবার হজম হবে না। বমি হয়ে যাবে।”

“কেন? শরীর খারাপ আপনার?”

উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে ইস্মি। ইজহান শক্ত মুখে বলে,

“আমি ভালো আছি।”

ইস্মি হাত পরিষ্কার করে এসে বসে শিয়রে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ভার গলায় বলে,

“তাহলে খাবার হজম হবে না কেন? রান্না ভালো হয়নি? লবণ কম হয়েছে? কী হয়েছে বলুন না…”

ইস্মি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ওকে। জানতে চায় কেন, কী কারণে এমন করছে ইজহান। কিন্তু ইজহান বলে না, সরু চোখে চেয়ে থাকে। একসময় না পেরে ঠাস করে এসে ওর কোলে মুখ গুঁজে রুক্ষ কণ্ঠে জবাব দেয়,

“ওসময় কী বিড়বিড় করছিলি বল…”

ইস্মি হাফ ছাড়ে,

“ওহ চড়ের কথা? ওটা তো কথার কথা বলেছিলাম, আপনাকে না। আমি কী আপনার গায়ে হাত দেব নাকি? এর আগে খসে যাক আমার হাত।”

ইজহান বলতে চাচ্ছিল না কথাটা। তবুও কৌতূহল খোঁচাচ্ছে ওকে। নিজের কাছেই হার মেনে নিয়ে সে জানতে চায়,

“উহু, ওসব না। বিড়বিড় করে কি বলেছিলে সেটা জানতে চাইছি।”

ইস্মি হতভম্ব। ও তো ভেবেছিল দুটো চড়ের কথা বলায় এই লোক ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, কিন্তু তা নয়। ও কি বিড়বিড় করছিল তা জানতে এমন অদ্ভুত ব্যবহার? সামান্য কারণে এমন আচরণ? ওর মাথা চক্কর দিলো।
বলল,

“তখন কি বলছিলাম? গুরুত্বপূর্ণ কিছু না তো, মাছের কাঁটার কথাই বলছিলাম।”

“কী বলছিলে?”

ইস্মির গলায় কাঁদোকাঁদো ভাব এসে জমা হতে চায়, তখন ও আসলে কী বলছিল? মনে নেই। কিন্তু এখন এই লোককে কিছু না বললে এভাবেই ওকে নাজেহাল করে ছাড়বে। ইস্মি বহুকষ্টে আবেগ লুকিয়ে বলল,

“বলছিলাম আপনার গলায় মাছের কাঁটা বিঁধে গেলে কীভাবে ছুটাব! কোন সূরাটা যেন পড়তে হয়, সেটাই বিড়বিড় করছিলাম।”

ইজহান ওর স্বীকারোক্তি শুনে শান্তি পেল। তার বউ মনে মনে, উপরে উপরে কি ভাবে সব তার জানা চাই, জানতে ইচ্ছে করে। নয়তো হাসফাঁস লাগে। খালি খালি লাগে। সন্দেহ সন্দেহ লাগে। ও ইস্মির অনাবৃত উদরে ঠোঁট বসিয়ে চুমু খেয়ে এরপর স্বস্তি নিয়ে
বলল,

“এটা তখনি বলে দিলেই হতো। তুমি ইদানীং বড্ড
কথা প্যাঁচাও ইস্মিতা, আমার রাগ লাগে।”

ইস্মি হতাশ শ্বাস ফেলে ওর চুল টেনে দিতে দিতে বলে,

“রাগ কমান। এত রাগ ভালো না।”

ইজহান মৃদু কণ্ঠে বলল,

“চেষ্টা করি তো।”

ইস্মি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

“চেষ্টা করলে চলবে না। পারতে হবে।”

ইজহান ধীর গলায় বলে,

“কিন্তু আমার কী মনে হয় জানো? আমি রাগ কমাতে পারব না। রাগ আমার রক্তে মিশে গেছে। না চাইতেও তোমার সাথে দেখিয়ে ফেলি।”

ইস্মি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

“রাগ যাতে আমাদের মাঝে এসে তিক্ততা না বাড়ায় এরজন্যই তো রাগকে আয়ত্বে নিতে হবে। আচ্ছা ভেবে দেখুন, আমি যখন আপনার উপর সেদিন রাগ করেছিলাম তখন কী আপনার ভালো লাগছিল? সত্যি বলুন তো।”

“না লাগেনি। তোমাকে মেরে নিজেকেও মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।”

“তাহলে ভাবুন, আমার কী অবস্থা হয়! আমারও তো ভালো লাগে না আপনি এভাবে কথায় কথায় রাগ করলে। তাছাড়া আমিও তো আপনার মতোই মানুষ। রাগ তো আমারও আছে। তবুও তো আমি কথায় কথায় আপনার মতো রাগারাগি করি না। করি কি?”

“না।”

ইস্মি নিজের কোমল হাতে ওর কপাল টিপে দিতে দিতে সাবধানী গলায় বলল,

“রাগ ভালো কিছু বয়ে আনে না। আপনার রাগগুলো কষ্ট দেয় আমাকে। সত্যি বলতে তখন আমি অসহ্য হয়ে পড়ি আপনার উপর। আপনি কী চান সেটা? না তো! তাহলে কষ্ট করে হলেও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন।”

“তুমি আমার পাশে থেকে যেও ইস্মিতা, কখনো দূরে যেও না, যাবার চিন্তাও করো না। আমার আপন বলতে কেউ নেই। বাবা আছে অবশ্য। আর ভাইগুলো তো মীরজাফর। ওদের আমি সহ্য করতে পারি না। আমার তো এই তুমি ছাড়া এত কাছের আর কেউ নেই, তাই না? ভয় লাগে যদি তুমি চলে যাও আমায় কে এভাবে সামলাবে! থেকেও যেও এভাবেই, হু?”

ইজহান ইস্মির কোমড় জড়িয়ে বলে উঠে। ইস্মি খেয়াল করল ওর ভ্রু কুঁচকে আছে। মুখ আরক্ত। জানালা খোলা, সেখান দিয়ে ফরফর করে শীতল হাওয়া আসছে। চাঁদের একফালি আলো মেঝেতে আদর ছড়াচ্ছে, ইজহানের মুখে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। লোকটা এত আবদার করে বাচ্চাদের মতোন! কবে একটু ঠিক হবে? অবশ্য ঠিক হয়ে গেলে ইস্মি আবার এই পাগলাটে ইজহানকে মিস করবে। কী যেন চায় মনটা, ইস্মি আনমনে শ্বাস ছাড়ে। ঘাড় নেড়ে সায় জানায় ইজহানের প্রশ্নের প্রতুত্তরে। মুখ আগলে ধরে নাকের ডগায় নাক ঠেকিয়ে বলে,

“থেকে যাব, রাখতে শিখুন।”

“শিখব।”

.

বাতের ব্যথা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে সালেহা বেগম। কোমরে আঘাত লেগেছে তার। চিৎকার শুনে ছুটে আসে সৃজা-ইস্মি। এসে দেখে বাথরুমে পড়ে আছে সালেহা বেগম। ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ওরা তুলে ঘরে নিয়ে আসে তাকে। বুঝে উঠে না কী করবে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই, সবাই যে যার কাজে। বাধ্য হয়ে সৃজা ইহসানকে ফোন দিয়ে জানায় ব্যাপারটা। ও সব শুনে বাড়িতে ডাক্তার পাঠিয়ে দেয়। ডাক্তার এসে দেখে গেছে সালেহা বেগমকে। এক্স-রে আর বেডরেস্ট দিয়েছে। ঔষধপথ্য সব বুঝে নিয়েছে সৃজা আর ইস্মি। পুরোটা বিকেল, সন্ধ্যা কেটে গেছে সালেহা বেগমের যত্নেই। ইস্মিও যথেষ্ট দেখাশোনা করছে। একমাত্র মিতুই নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। বড় দু’জন ছেলে বৌয়ের যত্ন পেয়ে সালেহা বেগম ছলছলে চোখে তাকান ওদের দিকে, মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা বলেন। প্রশ্ন করেন, জবাব দেন। সৃজা খেয়াল করে সালেহা বেগম ইহসান-ইজহানদের কথাই বেশি জিজ্ঞেস করছে, ওদের সম্বন্ধে জানতে চাইছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করে কি-না, স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখে কি-না এসব!

সৃজা সব কথারই জবাব দেয়, ওর বেশ খারাপ লাগে। এ বাড়ির দৈন্যদশা সে দেখে। আজিজ শেখের জন্য সালেহা বেগম সবসময় ভীত হয়ে থাকেন। কারণ রগচটা এই লোকটা ভীষণ বদমেজাজি। সারাদিন ব্যবসাপাতি সামলে এসে যদি দেখেন বা বুঝতে পারেন যে সালেহা বেগম তার কথার অবাধ্য হয়ে সৃজার বা ইহসানের বিষয়ে নূন্যতম শ্বাস ফেলেছেন তাহলেই হলো! এই বয়সে এসেও সালেহা বেগমকে মার খেতে হয় স্বামীর হাতে। এজন্য ভয়ে তিনি
কুঁকড়ে থাকেন। আগ্রহী হন না ওদের সাথে কথা বলতে। মাঝেমধ্যে দিনের বেলা টুকটাক কথা হয়, কিন্তু তাতে কোনো ছন্দ থাকে না। আবার ইহসানও খুব একটা পছন্দ করে না সৃজাকে সালেহা বেগমের সঙ্গে মিশতে দিতে। কেমন যেন একটা সম্পর্ক, সালেহা বেগমের সাথে ছেলেদের! ইহসান-ইজহান, ইমরান কাউকেই মাকে নিয়ে এতটা কনসার্ন হতে দেখে না সৃজা। বিষয়টা বেশ কিছুদিন ধরেই ওকে ভাবাচ্ছে। পারিবারিক ঝামেলা যতই থাকুক, নিজের মায়ের সঙ্গে ছেলেরা কেন এত দূরত্বে থাকবে? সৃজা তাই ভেবেছে আজ এলে ইহসানকে বলবে মা’কে কিছুটা সময় দিতে।

ইহসান ফিরলো সাড়ে আটটায়। সৃজা তখন সালেহা বেগমের ঘর থেকে এসে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে ডোপামিন ডিটক্সে চোখ বুলাচ্ছে শুয়ে শুয়ে। তেমন সময় ইহসানকে ফিরতে দেখেই একলাফে উঠে গেল। কোণে রাখা ছোট্ট ফ্রিজ থেকে লেবুর শরবত নিয়ে দ্রুতপায়ে ছুটে এলো। ইহসান বাঁ দিকের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জানতে চাইল,

“ডাক্তার এসেছিল? কেমন আছেন এখন?”

সালেহা বেগমের কথা জানতে চাইছে ইহসান, বুঝে সৃজা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নিচে মায়ের ঘর পেরিয়ে এসেছে তো, দেখে আসেনি? আশ্চর্য! মা হয় তো! সৃজা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

“কেন তুমি দেখে আসোনি?”

ইহসান চটপট জবাব দিলো,

“ঘর বন্ধ তাই বিরক্ত করিনি। কেমন আছে সেটা বল!”

“ঔষধ খাওয়ার পর ব্যথা কমেছে। এক্স-রে করাতে হবে।”

“ওহ!

বলে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল ইহসান। সৃজাকে কাছে টেনে উরুতে বসাল। ঘাড়ের চুল সরিয়ে ফুঁ দিয়ে বলল,

“কেমন কাটালি সারাদিন?”

সৃজা শিরশিরে অনুভূতিতে কেঁপে উঠে ওর শার্ট আঁকড়ে ধরে। পরক্ষণেই বলে,

“খুব বোরিং, একা একা কি সারাক্ষণ বসে থাকা
যায় নাকি? একটু আন্টি মানে শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে গিয়ে বসলে কি এমন সমস্যা হয়? তিনিও তো একাই থাকেন সারাদিন, অনুমতি দাও না…”

সালেহা বেগমের কথা বলছে সৃজা। বুঝতে পেরে ইহসান রুক্ষ স্বরে বলল,

“দেওয়া যাবে না!”

“কেন?”

“আমি বলেছি তাই।”

সৃজার অবাকের সঙ্গে সঙ্গে এবার একটু রাগও হয়।
বিরক্ত কণ্ঠে বলে,

“এটা কোনো কথা হলো? এইযে, আজ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেল তোমার তো উচিৎ ছিল খোঁজ নেওয়া, মা হয় তো তোমার—নাকি? আন্টি সারাক্ষণ একা একা থাকে। আংকেলের জন্য ভয়ে কারো সাথে কথাও বলতে যান না। একা একা বসে মেয়ের জন্য কাঁদে, তোমাদের জন্য কাঁদে। তোমাদের ভাইদের কি মায়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই? দরদ নেই?”

সৃজা এতকিছু কখন লক্ষ্য করল? কেন এত কথা বলছে? ওর কেন এত মাথাব্যথা সালেহা বেগমকে নিয়ে? ইহসানের মোটেও ভালো লাগল না৷ মা নিয়ে এত এত কথা কেন বলবে সৃজা? ও কী জানে—কিছুই না। না জেনে অহেতুক কথা কেন বলবে? ইহসান রক্তাভ মুখ করে চাইল,

“কতটুকু দরদ আছে, সেটা একজীবনেও পরিমাপ করতে পারবি না।”

সৃজা বিস্ময়ে ফেটে পড়ল ইহসানের কথা শুনে। দরদ আছে মায়ের প্রতি? কই, এ বাড়িতে আসার পর আজ পর্যন্ত দেখেনি তো দেখেনি তাদের কোনো ভাইকে সালেহা বেগমের সাথে বসে গল্প করতে, তার আদেশনিষেধ শুনতে! বরং, অপ্রয়োজনীয় একজন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে যেরকম আচরণ করতে হয় সালেহা বেগমের সাথেও ঠিক একই আচরণ করে তারা ভাইয়েরা। একদিকে আজিজ শেখ এক অদ্ভুত লোক, সালেহা বেগমকে মারধর করে একাকিত্ব দিয়ে রেখেছেন। ইজহান ইস্মিকে নাজেহাল করতে ব্যস্ত।
ইমরান মিতুর কথায় উঠবস করে, বউয়ের একচুল অবাধ্য হয় না সে। অন্যদিকে ইহসান, সে সবার থেকে আলাদা হয়েও কোথাও যেন এক, বুঝদার হয়ে অবুঝ! সৃজা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,

“দরদটা কী আসল?”

ইহসান তেঁতে উঠে,

“কী বলতে চাইছিস?”

সৃজা অনুযোগের স্বরে বলল,

“তোমার চোখে আমি আন্টির জন্য সহানুভূতি দেখি না, দেখতে পাচ্ছি না। কোনো সন্তান তার মায়ের শরীর খারাপ শুনে এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে না৷ তোমার উচিৎ ছিল বিকেলেই ফোন পেয়ে ছুটে আসা, নিজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। অথচ কী করলে, ডাক্তার পাঠিয়ে দিলে। এরপর একবারও ফোন করে জিজ্ঞেস করলে না কী অবস্থা, কেমন আছে মা! বলো, মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক এমন নির্লিপ্ত হয়?”

ইহসান বিরক্ত চোখে তাকায়,

“আমার সাথে তার সম্পর্ক এমনই চলে আসছে চিরকাল।”

“কিন্তু কেন?”

ঝোঁকের মাথায় বলে বসে ইহসান,

“কারণ—সে এ সংসার ছেড়ে যায়নি। আমার জালিম জন্মদাতাটার অত্যাচার সহ্য করে এখনো রয়ে গেছে। কোনো মানে হয়, বল? ঘৃণা করি আমি এই বোকা মহিলাকে।”

এটুকু বলে থেমে যায় ইহসান। সৃজা কিছুই বুঝতে পারে না। ইহসানের চোখ কথা বলছে, সেই চোখে সালেহা বেগমের জন্য একটুও ভালোবাসা দূর দরদও নেই। সৃজা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে বলে,

“তোমাকে আমি বুঝতে পারছি না।”

ব্যগ্র স্বরে বলে ইহসান,

“যতটুকু বুঝিস তাতেই চলবে, বেশি বুঝতে যাস না। বেশ আছি তো আমরা নিজেদের মতো, অহেতুক
কেন অন্যের বিষয়ে নাক গলিয়ে শান্তি নষ্ট করব?
বাদ দে এইসব। তুই…”

এটুকু বলে আচমকা আলমারির পেছনের দেওয়ালটায় চোখ পড়ে ওর। ভ্রু কুঁচকে ফেলে ও সঙ্গে সঙ্গে, জায়গাটা খালি, কী ছিল এখানে? কী নেই? উহ, কী যেন একটা নেই! ইহসান মনে করার চেষ্টা করে, সৃজা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকটাতে তাকায়। কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

“ওদিকে কী দেখছ?”

ইহসানের কপালে ভাঁজ। প্রশ্ন শুনে ভাবুক চিত্তে বলে,

“ওখানে কি একটা ছিল, এখন নেই…কী ছিল বল তো…”

সৃজা মনে করার চেষ্টা করে দেয়ালটাতে কী ছিল, মনে পড়ছে না। ও মাথা নাড়ে। ইহসান ওভাবেই তাকিয়ে থাকে দেয়ালটাতে ঠোঁট কামড়ে। আচমকা বলে উঠে,

“ওখানে পেইন্টিং ছিল একটা, কোথায় ওটা? আশ্চর্য, ওটা তো ওখানেই থাকে। নেই কেন? এই সৃজা…”

ইহসানের মুখ থেকে শুনে সৃজার মনে পড়ে যায় ভ্যান গগের চিত্রকর্মটি। আলমারির পেছনের দেয়ালে সাঁটা ছিল, যেটা সচরাচর চোখে পড়ে না। বাঁ দিকের সোফাটায় বসলেই যেটা চোখে পড়ে। আর এই পেইন্টিংটাই দু’সপ্তাহ আগে ইজহান খুলে নিয়ে গেছিল। সৃজা এবার একটু বিচলিত হয়, ইহসানকে বলবে কথাটা? ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করবে কি? সামান্য একটা পেইন্টিংই তো!

ততক্ষণে ইহসান উঠে দাঁড়িয়েছে রাগান্বিত ভঙ্গিতে। উচাটন ও উদ্ভ্রান্ত দেখায় ওকে। সৃজা শুকনো মুখে
ওর বিচলিত রুপ দেখে। একসময় না পেরে ইহসানের হাত ধরে বলে করুণ গলায় বলে,

“পেইন্টিংটা ভাইয়া নিয়ে গেছিল সেদিন। বাদ দাও না, একটা পেইন্টিংইতো! এতে কী এমন ক্ষতি হয়েছে? হয়তো পছন্দ হয়েছিল খুব, তাই নিয়েছে। ভাইয়ের জিনিস ভাই নিলে কোনো ক্ষতি তো না, তাই না?”

“ওটা আমার মায়ের সৃজা। আমার ঘরের জিনিস, অথচ তুই ওকে নিয়ে যেতে দিলি? কীভাবে? আশ্চর্য!”

ইহসান রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মুহূর্তেই। কপালের শিরা ফুলে উঠে ওর। ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে যায় রাগে। এত রাগার কী আছে বুঝে উঠে না সৃজা। অবাক হয়ে যায় ও, ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় ওর। মায়ের জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি, অথচ সেই মাকে একবার জিজ্ঞেসও করে না ভালো আছে কি-না? সৃজার খটকা লাগে।

.

______

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৪[ক]

– “মায়ের জন্য দরদ নেই, তার আঁকা ছবির জন্য এত দরদ?”

বিভ্রান্তি, আর সন্দেহজনক কণ্ঠস্বর। চোখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া। ব্যস! এতটুকুই যথেষ্ট ছিল ইহসানকে থামানোর জন্য। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়ে সে। কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে তাকায় সে সৃজার দিকে। বলে, “ ওটা এই ঘরের জিনিস। আমার খুব প্রিয়। যে কেউ এসে নিয়ে চলে গেল, আমি সেটা চাইতে পারব না? এরজন্য মানে বুঝতে হবে?”

-“ যেকেউ তো নিয়ে যায়নি; মায়ের ছবি ছেলে নিয়েছে। এতদিন তোমার কাছে ছিল, এখন ভাইয়ার কাছে কাছে। থাকুক। নষ্ট তো করে ফেলেনি। এটা নিয়ে এমন ঝামেলা করার মানে হয় না।”

একটু থেমে সূক্ষ্ম চোখে তাকায় সৃজা। কেমন অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করে বসে, “ আন্টিকে দেখে তো মনে হয় না, তিনি এমন ভালো পেইন্টিং করতে পারেন। তার নিজের ঘরেও তো কখনো দেখিনি এমন ছবি।”

ইহসান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে, তার কপাল কুঁচকে আছে। সৃজার কণ্ঠস্বরের বিভ্রান্তি সে ঠিক বুঝতে পারে। ভেতরে ভেতরে তার হাহাকার লাগে। পরক্ষণেই সচেতন হয়। নাহ, সৃজার সামনে এত উতলা হওয়াটা ভুল হয়েছে। ও কোমল মনের মেয়ে, এসব ওকে বলা যাবে না। যদি ওকে ভুল বুঝে, ঘৃণা করে দূরে সরে যায়? ইহসান নিজেকে প্রবোধ দেয়। সময় নিয়ে শান্ত করে সৃজাকে কাছে টানে। কোমড় জড়িয়ে পেটে মাথা রেখে নিচু স্বরে বলে, “অস্থির লাগছে, একটু শান্ত করে দে।”

সৃজা বুঝতে পারে ইহসান ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই আর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে না ওকে। চুপচাপ মাথায় হাত রাখে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে সব এলোমেলো লাগে। এই প্রথম মনে হয়, ইহসান তার কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছে, ইচ্ছে করে। যেগুলোর দুঃখের যাতনায় সে ভোগে, কিন্তু সৃজার কাছে প্রকাশ করতে চায় না। ওর মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন জমে, উত্তর জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠে।

একদিন সালেহা বেগমকে জিজ্ঞেসও করে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের দৈন্যদশা, বাপ-ভাইয়ের সাথে
দ্বন্দ্ব কেন এত? তার সাথেই বা কেন এত স্থির সম্পর্ক? শুধুমাত্র অত্যাচারী স্বামীর সংসার করছে বলেই নাকি অন্যকিছু? কিন্তু সালেহা বেগম ঠিকভাবে কিছুই বলে না। এড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলে। দু-এক কথায় যা বলে তাতে সৃজার কিছুই বোধগম্য হয় না।তবে ইস্মিতার থেকে দু-ভাইয়ের শীতল সম্পর্কের কিছুটা জানতে পারে। সারমর্ম এমন যে—
দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া ইস্মিতা এক বিকেলে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরছিল। বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য একটা শর্টকাট ছোটখাটো গলি আছে, অন্ধকার গলি। গলিটা কেউ ব্যবহার করে না। বলা চলে পরিত্যক্ত, জনশূন্য। মাঝেমধ্যে ইস্মি ওখান দিয়ে যাতায়াত করে। সেই গলিতেই প্রথম ইজহানকে দেখেছিল ইস্মি। গাড়ি পার্ক করা নিয়ে সেখানকার তিন-চারজন বখাটে মতো ছেলে ইজহানকে সেই গলিতে নিয়ে এসে বাকবিতন্ডায় জড়িয়েছিল। সেই বাকবিতন্ডা একসময় রুপ নেয় হাতাহাতিতে। ইজহানের তখন একা ছিল, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে সক্ষম হলেও ছেলেগুলো একসময় ওর মাথায় বাজেভাবে আঘাত করে। গলি পেরুতে গিয়ে আচমকা চোখের সামনে এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হয়ে ইস্মি চিৎকার করে উঠে। পেছনে ফিরে ওকে দেখে ছেলেগুলো ভয় পেয়ে যায়। একজন এসে ছুরি ধরে ওর গলায়, বাকিরা আহত অবস্থায় কোঁকাতে থাকা ইজহানকে মাটিতে ফেলে ইজহানের পকেট ফাঁকা করে সাথে থাকা সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। ওরা আসলে ছিনতাইকারী ছিল! ওরা চলে যেতেই ভয়ে জমে যাওয়া ইস্মি প্রাণ ফিরে পায় যেন। সাহস করে গিয়ে ইজহানকে ধরে, ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে খাইয়ে দেয়, ওড়না দিয়ে মাথা ব্যান্ডেজের চেষ্টা করে ওকে ভরসা দিতে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার দরুন ইজহান সেখানেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে! ফাঁকা গলিতে ওরকম জ্বলজ্যান্ত লোককে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে ইস্মিতা খুব ঘাবড়ে গেছিল। বুঝতে পারছিল না কী করবে! হাত-পা অসাড় লাগছিল। তবুও মনুষ্যত্ববোধের জোরে রাস্তা থেকে লোকজন জোগাড় করে হাসপাতালে এডমিট করেছিল ইজহানকে৷ সেই বার দিন দশেকের মতো হাসপাতালে ভর্তি ছিল ইজহান। মানবতার খাতিরে ইস্মি নিজেও কয়েকবার গিয়েছিল ওকে হাসপাতালে দেখতে। তবে ওর এই মানবতা যে ওর গলায়ই ফাঁস হয়ে ঝুলবে তা ভাবেনি৷ ইজহানকে রিলিজ করে দেয়ার আগেরদিন কলেজ শেষে হাসপাতালে ওর খোঁজ নিতে গিয়েছিল, সেদিন ইজহান ওর সাথে প্রথম কথা বলেছিল। এর আগ অবধি যতবার দেখতে গিয়েছিল, কিছুই বলেনি, নূন্যতম ধন্যবাদও জানায়নি ওকে। সেই ইজহান ইস্মিকে দেখে আঁধার মুখ বানিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, “বোরকা পরে চলাফেরা করবে, নয়তো চলাফেরা করার দরকার নেই।”

ইস্মি হতবুদ্ধি হয়ে গেছিল ওর কথা শুনে। বিব্রতবোধ করছিল ভীষণ। এমনিতে বোরকা পরা হলেও কলেজ টাইমে ইস্মি ইউনিফর্ম পড়েই কলেজ যেতো। এর আগে বাবা-ভাই ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া ওর বাক্যবিনিময় হয়নি। অথচ এই লোক ওর ড্রেসআপ নিয়ে কথা বলছে? অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল ও। মাথা নেড়ে চুপচাপ সায় জানিয়েছিল বেরিয়ে এসেছিল সেদিন! এরপর… প্রায় দু’সপ্তাহ পর বাড়িতে হঠাৎই বিয়ের প্রস্তাব যায় শেখ বাড়ির থেকে। ইস্মি প্রচন্ড অবাক হয়েছিল। মা ছিল না ওর। ঘরে অসুস্থ বাবা সিরাজুল ইসলাম আর চাকুরিপ্রার্থী বড়ভাই আকাশকে নিয়ে টানাপোড়েনের সংসার। বিয়ের প্রস্তাবে ওরা কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এত বড় বাড়ির সম্বন্ধ, ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ হবে কি-না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ছিল! ইস্মিই তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটায়, একবাক্যে জানিয়ে দেয় সামনে ওর এইচএসসি পরীক্ষা। এরপর এডমিশন পিরিয়ড, ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব পড়ে আছে ওর। বাবা-ভাইয়ের ছোট্ট অভাবের সংসারে ওরও তো কন্ট্রিবিউট করা বাকি!
সুতরাং, এখনি বিয়ে নয়। ইস্মির কথায় ওর বাবা নাকচ করে দিয়েছিল এত বড় বাড়ির প্রস্তাব। রিজেক্ট হয়ে নাকি দু’দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিল ইজহান, পরে জেনেছিল ইস্মি! দু’দিন পর বের হয়ে সোজা চলে গেছিল ইস্মিদের বাড়িতে। দুপুরের সময়! বাবা ঘুমাচ্ছে, আকাশ টিউশন পড়াতে বের হয়েছে। ইস্মি তাদের ছোট্ট বসার ঘরে বসে উচ্চতর গণিত প্র‍্যাকটিস করছিল। সেই সময় পড়ল দরজায় জোরালো থাবা, বিচলিত ইস্মি ভাই এসেছে ভেবে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু খুলেই চমকে যায়, বাইরে আলুথালু বেশে ইজহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিতে যাবে ইজহান দু’হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একেবারে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসে পড়ে বলে, “কী রেঁধেছ, ভাত দাও।”

হতবিহ্বল ইস্মি ঠাঁই দাঁড়িয়েছিল দরজায়। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছিল ওর। বাবা অসুস্থ, ঘুমাচ্ছে। ডাকার সাহস পাচ্ছিল না, আকাশও নেই। এই সুযোগে যদি এই লোক কিছু করে বসে, তাহলে? ও দরজা থেকে সরছিল না দেখে এক ধমকে আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইজহান ওর। ঘাবড়ে গিয়ে ভাত দেয় ওকে কাকরোলের তরকারি আর পটল ভাজা দিয়ে। গপগপিয়ে খেয়ে আরো দু’বার চেয়ে চেয়ে ভাত নেয় ইজহান। ওর খাওয়া দেখে ইস্মির মনে হচ্ছিল বহুদিন এই লোক খায়নি কিছু। এত মায়া লাগছিল তখন! নিজে থেকেই একটা ডিমের অমলেট করে দেয়। ইজহান পুরোটা একবারে মুখে নিয়ে খেতে খেতে ইস্মিকে বলে, “ভালো রান্না! তবে রান্না খেতেই এখানে এসেছি ভেবো না, এসেছি তোমাকে আমার বিয়ের তারিখ জানাতে।”

বিস্মিত হলেও স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল ইস্মি, “আপনার বিয়ে?”

– “হ্যাঁ।”

-“ওহ!”

-“জানতে চাইবে না, কার সাথে বিয়ে?”

-“ আমি জেনে কী করব? আপনি তো পরিচিত কেউ নন আমাদের। তবে অবশ্যই আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল।”

ইজহান বাঁকা হাসে, “তুমিই তো জানবে, তোমাকেই জানতে হবে। কারণ তোমার সাথেই তো আমার বিয়েটা হবে।”

কপট, অবাক গলায় ইস্মি চিৎকার করে উঠে, “পাগল আপনি? আমি তো আপনাকে বিয়ে করব না। বলে দেওয়া হয়েছে আমাদের তরফ থেকে।”

বসা ছিল ইজহান, না শুনে তেড়েমেরে এসে গাল চেপে ধরে ওর, “বিয়ে করবি না তাহলে অত দরদ দেখিয়েছিলি কেন? মরে পড়ে থাকতে দিলি না কেন রাস্তায়? মাথায় হাত রেখে কেন বলেছিলি তুই আমার সাথে আছিস? একবার যখন বলেছিস, তখন আমার সাথেই তোকে থাকতে হবে। আমার পার্মানেন্ট রাঁধুনি হতে হবে। নয়তো, নয়তো তোর বুড়ো বাপটাকে ধাক্কা দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দেব।”

ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে জমে গেছিল ইস্মি। মুখফুটে শব্দ বেরুচ্ছিল না। ইজহানের রক্তজমা চোখ আর রুক্ষ হাতের চাপে ওর মস্তিষ্ক বোধশক্তি হারিয়েছিল। ইস্মি কাঁপছিল, খেয়াল করে ইজহান ছেড়ে দেয় ওকে। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিজেকে স্থির করে এরপর বলে, “সরি বাট আমার লাগবে তোমাকে, লাগবে মানে লাগবেই।”

ইস্মি কথা হারিয়ে ফেলেছিল। চোখদুটো জলে পূর্ণ। ভেতরের ঘর থেকে বাবার দুর্বল গলার ডাক শুনতে পাচ্ছিল ও। তবে ইজহানের ভয়ে নড়তেও পারছিল না। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইজহান ওর দুই গাল টেনে দিয়ে বলেছিল, “ আমি শুনেছি তুমি মত দিলেই তোমার বাপ-ভাইও রাজি। তাই এবারের মতটা যাতে ‘হ্যাঁ’ হয়। রাতে আমার বাপ এসে কথাবার্তা বলে যাবে, না করো না কিন্তু৷ আজ থেকে ঠিক দু’দিন পর, আগামী শুক্রবার, দুপুর দুই ঘটিকার সময় ইজহান শেখের সাথে তোমার বিয়ে হতে চলেছে। প্রস্তুতি
নিয়ে রেখো। আর পড়াশোনা, যতটুকু পড়েছ ততটুকুই চলবে। আর পড়ার দরকার নেই। আমি চাই না তুমি বাইরে ঢ্যাংঢ্যাং করে পড়ো আর লোকে তাকিয়ে থাকুক।”

হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখিয়ে বেরিয়ে গেছিল ইজহান। ইস্মির মাথা কাজ করছিল না, আকাশ বাড়িতে ফিরতেই ওকে সব খুলে বলল। রেগে গেছিল ও এসব শুনে। নুন খেয়ে থাকবে তবুও এমন গুণ্ডার কাছে বোন দিবে না বলে পণ করে বসল। ইস্মির বাবাও মেয়েকে ভরসা দিলেন। কিন্তু রাতে আজিজ শেখ দুইগাড়ি বোঝাই করে বিয়ের সব তৈজসপত্র নিয়ে এসে আলাপ জুড়ালেন, বলা যায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়েই বললেন, তার ছেলে যখন ইস্মিকে চেয়েছে, তখন ইস্মিই হবে শেখ বাড়ির বউ। আর বিয়েটা হবেও তার ছেলের কথামতো ঠিক দু’দিন পর, শুক্রবার। এ কথার কোনো নড়চড় নয়!

ইস্মির বাবা আর আকাশ কিছু বলার সুযোগই পায়নি। ওরা বুঝে গেছিল এদের হাত কতটা লম্বা, কতটুকু যেতে পারে। তারা ছা-পোষা মানুষ। কিছুই করতে পারবে না। তাই ইস্মিকে এদের নজর থেকে কীভাবে বাঁচানো যায় সে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে ওরা। ঠিক করে খুলনা চলে যাবে। ওখানে ওদের খালার বাড়ি, ওখানেই পরীক্ষার আগ পর্যন্ত থাকুক ইস্মি। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিক। রুটিন দিলে তখন না হয় চলে আসবে। ততদিনে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে তাহলে অন্য এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরীক্ষাটা দিবে ইস্মি। আপাতত এদের কবল থেকে বাঁচুক! সেই মতোই সকালেই ওকে নিয়ে খুলনা রওয়ানা দেয় তারা। এরপর প্রায় আড়াই মাস কেটে যায় খুলনায়ই। কোনো সমস্যাই হয় না। ফাইনাল পরীক্ষার ডেট পড়ায় আকাশ ইস্মিকে নিয়ে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেয়। এলাকায় খবর নিয়ে জানতে পারে আজিজ শেখ ওদের উপর খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, কয়েকবার ছেলে-পুলে পাঠিয়েছিল। খোঁজখবর রাখছে এলাকায়। ওদের পেলেই নাকি এটা-সেটা করে বসবে। চিন্তিত হয়ে পড়ে আকাশ। তাই দূরের অন্য একটা এলাকায় বাসা ঠিক করে বোনকে নিয়ে উঠে পড়ে। নির্বিঘ্নে ইস্মি পরীক্ষায় বসে। পড়াশোনা, প্রস্তুতি ভালো ছিল তাই পরীক্ষাও ভালো হয় সব। এভাবেই আরো একটা মাস কেটে যায়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে শেষ পরীক্ষার দিন। বান্ধবীর সাথে মাঠে দাঁড়িয়ে কুয়েশ্চন মেলানোরত অবস্থায় হুট করেই সামনে চলে আসে ইজহান। এরপর সেখান থেকেই একপ্রকার জোরপূর্বক ওকে হুমকিধামকি দিয়ে একেবারে নিজেদের বাড়িতে তুলে নিয়ে চলে আসে। সেসময় ভাইয়ের কাণ্ড দেখে ইহসান প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বাঁধা দিয়েছিল বিয়েতে। মেরে মুখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল এভাবে মেয়ে তুলে নিয়ে আসায়। ভরসা জেগেছিল কিঞ্চিৎ ইস্মির মনে। পুরোটা সময় ইস্মি কাঁদছিল। বিস্মিত হলেও ভরসা নিয়ে ইহসানের কাছে অনুনয় করছিল ওকে সাহায্য মরার জন্য। ইহসানও ওকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু আজিজ শেখ কলকাঠি নেড়ে বুদ্ধি করে ওকে ঘরবন্দি করে কাজি ডেকে তড়িঘড়ি করে বিয়েটা দিয়ে দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইস্মিকে সাহায্য করতে পারেনি ইহসান।

বিয়ের রাতেই ইজহান ইস্মিকে কাছে টেনেছিল, আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল। এতদিন ওকে খুঁজে না পেয়ে কী অবস্থায় দিন কাটিয়েছে সেই অসহায় অবস্থার কথা জানান দিচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই ইস্মি টলছিল না। উল্টো ক্ষোভ আর ঘৃণাভরা চোখে দেখছিল! ইজহানের সহ্য হয়নি, তাই না চাইতেও আঘাত করেছিল ওকে। পরদিন সকালে খাবার টেবিলে আরো একবার ইহসানের হাতে মার খায় ইজহান, বেদম মার! ঘরে এসে ইস্মির দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যথা দেখিয়ে বলেছিল ইজহান, “সেদিনের মতো একটু হাত রাখো না মাথায় করে ইস্মিতা…”

ইস্মি সাহায্য দূর, তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল, “উচিৎ হয়েছে আপনার সাথে। একদম ঠিক হয়েছে। ভাইয়াকে আমি ধন্যবাদ দেব। আপনার মতো দেখতে হয়েও কী সুবিবেচক ওনি; আর আপনি? একটা পশু, নিকৃষ্ট পশু!”

ইজহান চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল, “ আমার ভাই ভালো?”

-“ আবার জিজ্ঞেস করছেন?”

-“করছি।”

-“ তাহলে শুনুন, ওনি এতটাই ভালো যে, বিয়ের প্রস্তাবটা যদি ওনি আমাকে দিতেন নিদ্বির্ধায় আমি ওনাকেই বিয়ে করে ফেলতাম।”

যে ভাইকে দু’চক্ষে সে সহ্য করতে পারে না, তাকে নিয়েই কিনা ইস্মি এমন একটা কথা বলল? ব্যস! থাপ্পড় মেরে নতুন বউয়ের গাল লাল করে দিয়েছিল ইজহান। শাসিয়েছিল, ইহসানের কাছ থেকে যেন শত হস্ত দূরে থাকে। ইজহান চাপে রাখতো ওকে, গায়ে হাত তুলতো সময়ে-অসময়ে। ইহসান ভাইয়ের এমন আচরণ সহ্য করতো না, সামনে পেলেই ধোলাই করতো। ইস্মিকে সবসময় বলতো এই পাগলকে ছেড়ে দিন। প্রথম প্রথম ইস্মিও নিদারুণ অবাধ্য ছিল ইজহানের। কিন্তু ওর পাগলামো, এলোমেলো কথাবার্তা, ভাবনার দৌরাত্ম্য দেখে একটা সময় বুঝতে পারে উপরে উপরেই এই লোকের ফুটানি আর বড় বড় কথা। ভেতরে ভেতরে সে ফাঁপা, একটা ভীতু লোক। যে মানুষ হারানোর ভয় পায়! নিশ্চিত হয়েছিল সে ইহসানের কাছ এটা শুনে যে, কলেজে পড়াকালীন সময়ে এক মেয়ের সঙ্গে তিন বছরের বন্ধুত্ব ও চার বছরের দীর্ঘ এক প্রেমের সম্পর্কে ছিল ইজহান। কিন্তু ইজহানের পজেসিভনেস ও রেস্ট্রিকশনের কারণে ধীরেধীরে এই সম্পর্কে হাঁপিয়ে উঠে মেয়েটা। আগ্রহ হারায় সে ইজহানের উপর থেকে, ঝুঁকে পড়ে ইহসানের দিকে। যদিও ইহসান ঐ মেয়েকে চরম অপমান করে রিজেক্ট করে দিয়েছিল, তবুও বেশ কিছুদিন ওর পিছু পড়েছিল। ইজহানের সাথে ব্রেকাপ করে ফেলে। হুট করে প্রিয়তমার এই কান্ডে ইজহান ভেঙ্গে পড়ে, ব্রেকাপের কারণ তখন অজানা ওর। নানাভাবে বোঝায় মেয়েটাকে, ফিরে আসতে বলে। কিন্তু চরম অপমান করে মেয়েটা বারবার তাড়িয়ে দেয় ওকে, ইজহান মানতে পারে না সেটা। কীভাবে মন গলবে তার প্রেমিকার, এই ভেবে সু’সাইডের পথ বেছে নেয়। ভাগ্যগুণে ইহসানই সেদিন ওকে বাঁচায়। হসপিটালে এডমিট করে। খুলে বলে তার প্রেমিকার কদার্যরুপ। শুনে ইজহান অবশ্য ওকেই দোষারোপ করেছিল। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিল, ওর প্রেমিকা ফিরে আসবে। কিন্তু ও ভুল ছিল, মেয়েটা ওকে দেখতে পর্যন্ত আসেনি। চ্যালেঞ্জে হেরে হাসপাতালের বেডে শুয়েই মন শক্ত করে ফেলে ইজহান, ঐ নাগিনীর জন্য সে আর ছোট হবে না। যে নাগিনী ওকে ছোবল না দিয়ে ওর খারাপ সময়ে মাথায় হাত রাখবে, ঐ নাগিনীকেই সে বিয়ে করে নেবে! আর সেই মাথায় হাত রেখে ‘আমি আছি’ বলা নাগিনীটাই ছিল ইস্মিতা! নিজের এত লম্বা প্রেমের কাহিনী অবশ্য ইজহান লুকিয়ে গেছে। কখনোই ইস্মিতাকে বলেনি, আজ অবধি না। ও সব জেনেছে ইহসানের থেকে। এসব শুনেই একটু টলেছিল ইস্মি ইজহানের উপর। ভালোবেসে ফেলেছিল ততদিনে মানুষটাকে। কিন্তু ইজহানের পাগলামো, পজেসিভনেস থামলে তো! অতিষ্ঠ করে দিচ্ছিল ওকে। দু’বছরের মাথায় যখন পেটে বাচ্চাটা আসে, তখন ভেবেছিল লোকটা বাবা হওয়ার খবরে এবার ঠিক হবে। কিন্তু খবরটা শুনেই প্রথম দু’দিন একেবারে তাক লেগেছিল মানুষটা। আঁধার মুখে বলেছিল, “আমাকে ভালোবাসবি না,
তাই ভাগীদার আনছিস তাই না?”

ইস্মির ভালো লাগেনি কথাটা। মনে গেঁথে গেছিল।
তাই প্রেগ্ন্যাসির সময়টাতে ও বেশ রুঢ় আচরণ করতে শুরু করেছিল ইজহানের সাথে। দূরে দূরে থাকতো যা সহ্য হয়নি ওর। এক রাতে ঝগড়ার মাথায় তাই বাচ্চা মিসক্যারেজের মতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে৷ বাচ্চা হারিয়ে ইস্মি পুরোপুরি শকে চলে গেছিল। ঘৃণায় বিষিয়ে উঠেছিল মন। তাই সব ছেঁড়ে ছুড়ে চলে গেছিল বাবা-ভাইয়ের কাছে। ইজহান সেবার ওকে আর আটকায়নি। যেতে দিয়েছিল৷

প্রায় দু’ সপ্তাহ পর আকাশ খবর নিয়ে আসে,
ট্র্যানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাকের শিকার হয়ে
হাসপাতালে ভর্তি ইজহান। জ্ঞান ফেরার পর থেকে কারো সাথেই নাকি কথা বলেনি। কী করতো ইস্মি, জানা ছিল না। বাবা আর ভাই বলেছিল ওকে, এই পাগলের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে, ইহসানও বলেছিল দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথা কাজ করছিল না ওর।
ঘৃণার তলায় চাপা পড়া ভালোবাসাটা চিড়বিড়িয়ে উঠে তাকে এই ডমিন্যান্স লোকের কাছে নিজে থেকেই ফিরতে বাধ্য করেছিল! হাসপাতালেই রাতে জিজ্ঞেস করেছিল ইজহান, “এখনো সুযোগ আছে, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
রাত পোহালে যেটা আর থাকবে না।”

ইস্মি ভাবলেশহীন ভাবে ওর দিকে তাকিয়েছিল, “কীসের সিদ্ধান্ত?”

– “আমার অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচানোর। ফিরতে
কিন্তু আমি বলিনি।”

– “কিন্তু এমন কাজ করেছেন, যাতে আমি ফিরতে
বাধ্য হই।”

কঠোর শোনাচ্ছিল অসুস্থ লোকটার কণ্ঠস্বর, “এরপরেও বলছি, সুযোগ কাজে লাগাও। আমি যেমন আছি, তেমনি থাকব। বদলাব না। পরে কোনো দোষারোপ, অভিযোগ মেনে নেব না। ভাবো, ভাবতে থাকো।”

ইস্মি ভাবেইনি কিছু। শুধু হাত মুঠোয় নিয়ে বসেছিল। ঔষধের প্রভাবে ঘুমে মগ্ন ইজহানের মুখের দিকে
চেয়ে নিজেকে দুর্বল, ব্যর্থ নারী মনে হচ্ছিল!

______

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৪[খ]

ইস্মির মুখে ইজহানের তুলে এনে বিয়ে করার
ঘটনা শোনার পর সৃজা আরো একবার ইজহানের পাগলামোর সাক্ষী হলো এর ঠিক দু-মাস পর। যেদিন
ইস্মি ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ঠিক সেদিন! ইজহান অফিসে ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ওকে খবর দেওয়া হয়নি। দু-ঘন্টা পর খবর যায়। খবর শুনে ও আর দেরি করেনি। মিজুকে ছাড়া একাই ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরেছিল বিশ মিনিটের মধ্যে। এরপর বিধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে যখন দেখল ইস্মি চোখ বন্ধ করে নিথর হয়ে বিছানায় শোয়া, আর ডাক্তার ওকে চেকআপ করছে ; বেচারা সেখানেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল! দারোয়ান আর মকবুল মিলে ধরাধরি করে পানিটানি ঢেলে ওর হুঁশ আনতেই ভয়ে চুপসে গিয়ে ইস্মির পাশে গিয়ে বসলো সে। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল না কী হয়েছে, কেন হয়েছে—জিজ্ঞেস
করল, “আমার বউটা বেঁচে আছে তো?”

ইহসানের ইচ্ছে করল ওর মুখে একটা ঘুষি মারতে। বদমাইশটার আক্কেল দেখ! ও নিজেকে বহুকষ্টে সামলালো। আর এমন কথা শুনে ঘরভর্তি মানুষ সঙ্গে সঙ্গে চমকে ইজহানের দিকে তাকালেও ডাক্তার সাহেব ইজহানের স্বভাব জানা স্বত্তেও সেদিন ওর দিকে বিরক্ত চোখে চাইলেন, “এসব কী কথা? বৌমা মরে যাবে কেন?”

“ও তাহলে এমন করে পড়ে আছে কেন?”

ডাক্তার যেন মজা পেলেন, “তুমি যদি অহেতুক বেহুঁশ হতে পারো তাহলে এসময় বৌমার হুঁশ হারানো তো একদম ফরজ!”

“এসময় মানে? এটা আবার কেমন সময় আংকেল?”

ডাক্তার সাহেব ভনিতা করছিলেন, “কঠিন সময়! উল্টাপাল্টা কিছু হলে বা মানসিক চাপ দিলে এ সময়ে মানুষ মরেও যেতে পারে।”

ইজহানের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। সৃজা তা দেখে মকবুলকে ইশারা করতেই ও পানি নিয়ে আসে। বলে, “স্যার মাথাডাত পানি ঢালুম? আপনে তো আবার অজ্ঞ্যান হইয়া যাইতেছেন।”

বউ মরে যাচ্ছে আর এই হারামি আছে পানি নিয়ে? ইজহান মুখ খারাপ করে ফেলে, “কু’ত্তার বাচ্চা সর তুই!”

ডাক্তার ওর স্বভাব জানেন। তাই আটকান না, বরং বলেন, “উহু! এ সময়ে বৌমার সামনে এমন আচরণ করা যাবে না। তোমার উগ্র আচরণের এফেক্ট ওর মানসিক অস্থিরতার কারণ হবে। সেই থেকে ভেতরের কলকব্জায় পচন ধরবে। ভেতরের পচন বাইরের থেকেও দ্রুত হয়, তাই… সাবধান!”

এসব কী বলছে এই ডাক্তার? পচন৷ ভেতরে-বাইরে? কী এসব? ইস্মিতার কী বড়সর রোগ হয়েছে? ও যেভাবে চড়-থাপ্পড় দিতো, ধাক্কাও দিয়েছে অনেকবার! এসবের কারণে কিছু হয়নি তো? উফ আল্লাহ! কী করবে ও? ইস্মিতাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না ও? ইস্মিতার কিছু হলে ও তো মরে যাবে! ইজহানের কপাল বেয়ে চিকন ঘাম গড়য়ে পড়ে। সে ঢোক গিলে কয়েকবার ধরা গলায় বলে, “কী হয়েছে ওর? ক্যান্সার?”

“তার থেকেও মারাত্মক কিছু!”

“কী?”

ডাক্তার একটি রিপোর্ট এগিয়ে দেয়, যেটা হাতে নিয়ে ইজহান পড়ে এরপর বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
১২ সপ্তাহের গর্ভাবস্থা! ইস্মির চাওয়া, তারও কী? ইজহান বুঝে উঠতে পারে না। ডাক্তার ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “টেস্ট করানো হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সব স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু আগের ঐ ইন্সিডেন্টটা কিন্তু মারাত্মক ছিল, তাই এবারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এবারের প্রেগ্ন্যাসিটা ওর জন্য হাই রিস্ক হতে পারে। যদিও আমরা মনিটরিং করব তবুও সর্বক্ষণ মনিটরিং করার দায়িত্বটা এবার তোমাকে দিলাম। আর কোনো ভুল নয়, আগের বারের মতো পাগলামি নয়।”

ইজহান বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনে। কিন্তু বোধগম্য হয় না কিছুই। শুধু মাথায় ঘুরে এটা ‘হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি।’

সে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। চোখে আঁধার দেখে। ঝাপসা ঝাপসা ঠেকে ইস্মিকেও। মকবুল ওর পিছেই ছিল, ও এসে ধরে। ইজহান ঢলে পড়ে ওর উপর। ডাক্তার সাহেব হতাশ শ্বাস ফেলে বলে, “এ তো নিজেই দুর্বল হার্টের রোগী। বৌমাকে সামলাবে কি! ওকেই তো সামলাতে হবে মনে হচ্ছে!”

ইহসান সৃজার ফোন পাওয়ামাত্রই বাড়িতে এসেছিল। এতক্ষণ চুপ করে ভাইয়ের বেঁহুশ হওয়ার নাটক দেখছিল। ডাক্তারের কথা শুনে ল এবার তাচ্ছিল্য করে বলল, “কাপুরুষ কী আর এমনি এমনি বলি? তুই বাপ হবি, কোথায় বুক ফুলিয়ে বউয়ের সেবাশুশ্রূষা করবি না উল্টো তারই চারটা নার্স লাগবে। আংকেল একে এক বছরের জন্য রিহ্যাবে রাখার ব্যবস্থা করুন তো! নয়তো হাড়-মাংস জ্বালিয়ে খাবে।”

সবাই হেসে উঠলেও সৃজা একমাত্র, যে ইহসানকে চোখ গরম করে থামতে বলল! সৃজার ইশারা পেয়ে ইহসান একটু থতমত খেল, ভাবলো—সৃজার এরকম অবস্থা হলে সে কী করতো! এইরকম করতো কী? উহু…হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি হলে সে নিজেও চায় না সৃজাকে সেদিকে ঠেলে দিতে! এদিকটাতে ভাইয়ের সঙ্গে নিজের চিন্তাধারার মিল পেয়ে, ইহসান শুকনো মুখ করে তাকিয়ে রইল ইস্মির পাশে বসে থাকা সৃজার দিকে। ঢোক গিলে বলল, “বাপ হওয়া লাগবে না আমার।”

এরপর ইস্মি যখন স্বাভাবিক হয়—ইজহান পুরো রাত ওকে আর ঘুমাতে দেয় না! পুরুষ কাঁদে না, কাঁদতে নেই এই থিওরি ভুল প্রমাণ করে হু হু করে কাঁদে সে। তবে শব্দ করে না। ইস্মি শুধু হতবিহ্বল হয়ে দেখে আর অনুভব করে, এই পাগল লোক তাকে কতটা ভালোবাসে, কতটা হারানোর ভয় পায়। ও শুধু কাঁপা গলায় ইজহানকে বলে, “আপনার মা আসছে তো, আপনার মায়ের আদরে ভাগ না বসিয়ে আমি কোথাও যাব না।”

.

.

গোসল সেরে বেরুতেই ইহসান দেখল খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে সৃজা৷ মেয়েটাকে এত মনোযোগী হতে দেখে ইহসান যখন ও কথা বলে, তখন! এখন তো ও কথা বলছে না, তাহলে কীসের প্রতি এত মনোযোগ সৃজারন? ইহসান পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে ঘায়ারে নাক ঘঁষে জিজ্ঞেস করে, “আমার মনোযোগ কাকে বিলি করছিস?”

শীতল স্পর্শে চমকে উঠে সৃজা। ঢোক গিলে কয়েকটা পরপর। মৃদু কণ্ঠে বলে, “উমম..একটা ছবি।”

“কী এমন ছাতার ছবি দেখা তো…”

“এইযে….”

ছবি দেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না ইহসানের। কিন্তু চোখের সামনে অতি পরিচিত কোলাজটা দেখে নিজেও চোখ সরাতে পারল না বেশ কিছুক্ষণ। এরপর যখন সম্বিৎ ফিরল তখন আপনাআপনি সৃজার কোমড় ছেড়ে গেল তার হাতদুটো। কপালে ভাঁজ ফেলে একপ্রকার ছোঁ মেরেই ছবিটা নিয়ে নিলো সে। পকেটে পুরলো দুমড়েমুচড়ে। গম্ভীর হয়ে এলো কণ্ঠ, “ধরেছিস কেন না বলে…”

“আমি তোমার বউ তো! ধরে ফেলেছিই না হয়! এবার বলো তো, কে ইনি?”

ঘর পরিষ্কার করতে গিয়েই যে সৃজা ছবিটা পেয়েছে সেটা ওকে বলল না। ইহসানও অবশ্য জিজ্ঞেস করল না ওকে ছবিটা কোথায় পেয়েছে। উল্টো চোয়াল শক্ত করে বলল, “জানি আমার সবকিছুতে তোর অধিকার আছে, কিন্তু তারপরেও আমি চাই না তুই আমার অজান্তে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে ঘাঁটাঘাঁটি করবি। এটা ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে না৷”

সৃজা হতবিহ্বল মুখে চেয়ে রয়, “আমি তো শুধু জানতে চেয়েছি ইনি কে?”

ইহসানের গলা গমগমে হয়ে এলো, “তোকে আমি এসব জানার জন্য বিয়ে করিনি।”

“মানুষের কৌতূহল থাকতে পারে না?”

ইহসান ত্যক্ত কণ্ঠে বলল, “অনর্থক কৌতূহল থাকতে পারে না। ছবিতে কে আছে, কী আছে, কে এরা জেনে তুই কী করবি? তোর কী কাজ? আমি তোর বর, তোর ধ্যানজ্ঞান থাকবে আমাকে নিয়ে। এর বাইরে অন্যকিছুতে না। কিন্তু ইদানীং তুই বড্ড বেশি অনর্থক কৌতূহল দেখাচ্ছিস যেটা আমার ভালো লাগছে না।”

“আসলে বাচ্চাদুটো তো… ”

“তর্ক করিস না সৃজা।”

সৃজা অতি আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়ে। সেই গলায়ই বলে, “এভাবে বলছ কেন? আমি শুধু জানতে চেয়েছি৷ এটাতে এতো রিয়েক্ট করার কী আছে? বললে কী পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব…”

ইহসানের মাথায় দপ করেই আগুন জ্বলে উঠে। মেজাজ হারিয়ে ফেলে সে। আচমকা সৃজার গাল চেপে ধরে বলে উঠে, “ছেড়ে যাবি এ কথা মুখে আসে কেন? ভাবিস নিশ্চয়? উহু! না ভাবলে তো মুখে আসতো না! মাথার ভাবনা মাথায়ই রাখ, পুঁতে ফেলব। সব রেখে কার জন্য এত করি আমি? তোর জন্য। আর সেই তুই আমাকে বলিস ছেড়ে চলে যাবি? ডাফার!”

কথাটা তো শেষও করতে পারেনি! সৃজা বিস্ময়াভিভূত নয়নে তাকিয়ে থাকে ইহসানের রক্তজমা চোখে। কাঁপছে কেন লোকটা? ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ডানহাত বাড়িয়ে ইহসানের কপালে পড়ে থাকা ঘর্মাক্ত চুল সরিয়ে গালে হাত দিয়ে কম্পিত স্বরে বলে, “অ্যাই!! কী হয়েছে তোমার?”

উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “আমি তোকে যেমন রেখেছি, তেমনি থাক। যতটুকু জানাই, ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাক। কেন খামোখা এটা-ওটা বলে আমার মাথা খারাপ করিস? জানিস না অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়? জানিস তো!”

সৃজা হঠাৎ বলে উঠে, “কোনো সত্যি জেনে যাব কী?”

ইহসানের হাতের চাপ বাড়ে সৃজার নরম, মসৃণ গালে। দাগ বসে যায়। সৃজা তবুও চুপ থাকে না। ব্যথায় অস্ফুটস্বরে শব্দ করে উঠে। বিভ্রান্তি নিয়েই বলে, “ছবিটা তোমার—তোমাদের মায়ের, তাই না?”

ইহসান রুক্ষ চোখে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই প্রশ্ন করে, “তোকে কে বলল?”

“কেউ বলেনি, তুমি এবার বলো।”

ইহসানের বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে। কপালের শিরা ভেসে উঠে। গলা হয়ে উঠে তীক্ষ্ণ, রুক্ষ। হিসহিসিয়ে বলে সে, “ওটা একটা ছবি। বুঝেছিস? স্রেফ একটা ছবি। তুই..তুই আর কখনো না বলে আমার গুছিয়ে রাখা জিনিসে হাত দিবি না। প্রথমবার বলে বেশিকিছু বললাম না।”

ইহসান ওর গাল ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। দু’হাতে চুল খামচে ধরে হাসফাঁস করে এযা সৃজার নজর এড়ায় না। ও তবুও বলে, “আমি জানি এটা তোমার মা।”

ইহসান চিৎকার করে উঠে, “বল…কোন হারামি এটা তোকে বলেছে? কে? কেন একটা ছবির জন্য আমার মাথা খাচ্ছিস সৃজা? আমার হাত উঠে যাবে।”

“তোমার চোখ বলেছে!”

দৃঢ় স্বরে বলে সৃজা। না পেরে সত্যি সত্যিই হাত উঠিয়ে ফেলে ইহসান। দ্বিতীয়বারের মতো গালে হাত রেখে অবিশ্বাস্য নজরে তাকায় সৃজা। গাল ভেসে যায় নোনাজলে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তবে ও শব্দ করে না। উল্টো শক্ত গলায় ইহসানের চোখে চোখে রেখে বলে, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না।”

অস্থির ও থমকানো ইহসান ছবিটা পকেটে পুরে চেয়ারে লাথি মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সৃজা
শূন্য চোখে ওর প্রস্থান দেখে।

দরজা খোলাই ছিল, ইস্মি পানির জগ হাতে নিয়ে করিডোর পেরুতে গিয়ে না চাইতেও দেখে ফেলে দৃশ্যটা। ইহসান সৃজার গায়ে হাত তুলেছে, এ জিনিসটাই ওকে বাকরুদ্ধ করে দেয়!

.

পুকুরে কয়েকটা হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। সাদাকালো, সবুজ-বাদামির মিশেলে রাঙানো হাঁসগুলো একটু পরপরই ঠোঁট ডুবিয়ে পানি থেকে শ্যাওলা খাচ্ছে। তাদের বয়ে চলাতে, ডানা ঝাপটানোতে মৃদু তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে পানিতে টইটম্বুর পুকুরটাতে। সৃজা ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে, একমনে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে, গায়ের ওড়না উড়ছে। সৃজার সেদিকে খেয়াল নেই। গাল ভেজানো নোনাজলে ওর চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আছে। রুদ্ধ হয়ে থাকা মনটা বারবার শুধু বলছে, দ্বিধান্বিত মনের মেয়ে হওয়াটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ওর উচিৎ ছিল যা হচ্ছে তা হতে দেওয়ার আগে প্রশ্ন তোলা, জিজ্ঞেস করা যে, এ কাজটা কেন হচ্ছে, কেন করছে! কিন্তু না, সবকিছুই ও এতদিন বিশ্বাস আর ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিয়ে অদৃষ্টের দেখানো পথ ধরে হেঁটে গেছে! তাই আজ ওর এ দশা। দূরের রেললাইনে সশব্দে ট্রেন ছুটছে। সৃজা সেদিক পানে তাকায় না, তাকাতে ইচ্ছেও হয় না। অথচ যতবার এপথে ট্রেন ছুটে যায়, ততবার বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে ও দীর্ঘ যানটাকে মুগ্ধ চোখে দেখে। অথচ আজ ওর কিছুতেই মনোযোগ নেই, কিছু দেখার ইচ্ছেও নেই। আচমকা কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ অনুভব করে সৃজা। শুনতে পায় ইস্মির গলা, “কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো! রোদ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে, ঘরে চলো।”

সৃজার চোখদুটো বুজে আসে। নড়ে না জায়গা থেকে। বলে, “শরীর তো সেরে যাবে, মনের কী হবে?”

“সেটাও সেরে যাবে। ভাইয়া সারিয়ে দেবে। সে তো ভালোবাসে তোমাকে।”

“ভালোবাসলে গায়ে হাত তুলতো না।”

“রাগের মাথায় তুলেছে।”

সৃজা অভিমান ভরা গলায় বলে, “সেই রাগ আমারও আছে।”

“তাহলে ছেড়ে দাও, চলে যাও ভাইয়ার জীবন থেকে।”

সৃজা এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকাল, “অসম্ভব!”

“অসম্ভব কেন?”

সৃজা মুখ গোঁজ করে ফেলে, “কারণ ভালোবাসি তাকে।”

ইস্মি হাসে, “এতদিন বলতে না কেন আমি তোমার ভাইয়াকে ছেড়ে যাই না? কেন তার সব অপমান, গালিগালাজ, অবুঝপনা মেনে নিয়ে পড়ে আছি!
এই ভালোবাসাটা হয়ে গেছিল বলে!”

ইস্মির কথার পিঠে সৃজা নিজেও কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর নিজেও হেসে ফেলে। ঝাপসা হয়ে আসা চোখজোড়া মুছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়ায়। পুকুরপাড়ে সারিবদ্ধ গাছগাছালির উপর দৃষ্টি রেখে বলে, “তারা ভাইয়েরা যতই নিজেকে আলাদা বলে দাবি করুক, দু’জনেই এক তাই না? হোক ভালো, হোক খারাপ! যেকোনো একটা রুপ দেখিয়ে বিপরীত মানুষটাকে দুর্বল করে দিয়ে এ দুর্বলতার নাম দেয় ভালোবাসা। আটকে ফেলে এই জালে। এরপর তাদের কদর্যরুপ দেখিয়ে ফেললেও আর এই জাল থেকে বেরুনো সম্ভব হয় না। ইচ্ছেই জাগে না। কী অদ্ভুত!”

ইস্মি খানিকটা কেঁপে উঠে৷ তার প্রেগ্ন্যাসির চার মাসে পড়তে চলল! অথচ এ উপলব্ধিটা সে করতে পারেনি আজও। অথচ সৃজা করেছে এবং খুব দ্রুতই। ও ছোট শ্বাস ফেলে, “ভাইয়া তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন করেছে আমাকে কী বলা যায়? বড়বোন হিসেবে!”

সৃজা চুপ করে থাকে। এরপর মাথা নাড়ে। হাতের ফোনটা নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকে একটা ছবি বের করে ইস্মির দিকে এগিয়ে দেয়৷ ইস্মি কিছুই বুঝে উঠে না। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয়। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে একটা ছবি, যার মধ্যে কোলাজ করা অনেকগুলো ছবি একসাথে। অনেক পুরোনো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে—বিশ-বাইশ বছরের ম্লানমুখের এক তরুণীকে। যার বাদামি চোখ। সরু নাক। পাতলা ঠোঁট। চুলগুলো কালচে-লাল। অথচ খুব সুন্দরী। চোখ ধাঁধানো। পরণে ঢোলাঢালা শার্ট আর স্কার্ট৷ বিরক্তি আর রাগের চিহ্ন ফুটে আছে তার চোখেমুখে। দেখতে বিদেশি মনে হলেও বাঙালি এটা অবশ্য বোঝা যায়। এমন সুন্দরী তরুণী ইস্মি এর আগে খুব কমই দেখেছে। তবে চমকের বিষয়টা হলো তরুণীর দু’পাশে বসে থাকা দু’টো বাচ্চা। একজন কাঁদছে, অন্যজন ভীতু মুখে তরুণীটির দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ তরুণীর তাতে কিছু যায় আসছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এরা যে এই তরুণীটির সন্তান তা বোঝাই যাচ্ছে। নিবিড় চোখে ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে ইস্মি তেমন কিছুই খুঁজে পায় না। তবে একটা সময় বাচ্চাদুটোর ঠোঁট আর ভ্রু দেখে একটু ধাক্কা খায়। চমকিত ও কাঁপা ঠোঁটে বলে সৃজাকে, “এটা তো ও-নি; ম মানে তোমার ভাইয়া। আর..কাঁদছে যে এটা ইহসান ভাই…”

সৃজা ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে। বলে, “স্ক্রল করো, পরের ছবিটা দেখো…”

ইস্মি পরের ছবিটা দেখে। আগের ছবিটারই উল্টোপিঠ! সাদাটে ফাঁকা জায়গা। সেখানে কালো কলমে ইংরেজি অক্ষরে কিছু লিখা। প্রথমে নীল কালিতে লিখা, Vous êtes innocents, mais je vous déteste. Tant que je vivrai, je détesterai. এরপরেই তার নিচে কালো কালিতে লিখা,
Même si tu nous détestes, tu es notre seul amour. Parce que tu es notre mère.

ইংরেজি হলেও ভাষাটা অন্য। পড়ে মোটেও কিছু বোধগম্য হয় না ইস্মিতার। অবুঝ চোখে তাকায় ও সৃজার পানে। জিজ্ঞেস করে, “কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“প্রথমে লিখা, ‘তোমরা নিষ্পাপ, কিন্তু আমি তোমাদের ঘৃণা করি। যতদিন বাঁচব, ততদিন করব।’
পরেরটাতে লিখা, তুমি ঘৃণা করলেও তুমিই আমাদের একমাত্র ভালোবাসা। কারণ তুমি আমাদের মা।”

সৃজা নিঃশব্দে হাসে। ইস্মি প্রচন্ড অবাক গলায় বলে, “কীভাবে বুঝলে?”

”ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখা, স্ক্যান করে অর্থ বুঝেছি।”

বিস্ময় কাটে না ইস্মির, উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কই পেলে ছবিটা?”

“সোফার নিচে পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছি। ধুলো জমে গেছিল৷ বাতিল কাগজ ভেবে ফেলে দিতেই যাচ্ছিলাম, পরে দেখি এটা ছবি।”

ইস্মি আগের মতোই বিস্ময় নিয়ে বলে, “মূল ছবিটা কোথায়?”

“কী ভেবেছ, তোমার ভাই ওটা দিয়ে যাবে? ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি অবশ্য ওকে দেখানোর আগেই ফোনে ছবি তুলে রেখে দিয়েছিলাম।”

ইস্মি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “আম্মা তাহলে ওদের মা নয়!”

সৃজা মলিন অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “যদিও আমি এই ছবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারিনি তবে এটা নিরানব্বই শতাংশ শিওর যে ছবির এই মেয়েটিই ওদের মা। আন্টি না। আর নিজের মা নয় বলেই আন্টির প্রতি ওদের এমন ব্যবহার! নিজের মাকে বোধহয় খুব ভালোবাসে, অন্য কাউকে সেই জায়গাটা দিতে পারেনি।”

ইস্মি বলার মতো অবশিষ্ট কিছু খুঁজে পায় না। ও বাকরুদ্ধ বনে গেছে।শব্দ ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে৷ মাঝেমধ্যে ভাইদের আচরণ দেখে যে ওর সন্দেহ হতো না, তেমনটা নয়৷ কিন্তু আসলেই ও ভাবতে পারেনি সালেহা বেগম ওদের মা নয়!

______
চলবে…