#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৫
সেই দুপুরে ঝামেলা করে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইহসান বাড়ি ফিরলো না। সৃজা ভাবল হয়তো রাগারাগি করে বেরিয়েছে তাই রাতে দেরি করছে ফিরতে। কয়েকিবার ফোন দিলো, তবে রিসিভ হলো না। এরপর সকাল অবধি অপেক্ষা করেও যখন দেখল ইহসান ফেরেনি, সৃজা পুরোপুরি আহাম্মক হয়ে গেল ওর আচরণে। অস্থির হয়ে একেরপর এক ফোন করল ওর নাম্বারে। কিন্তু সৃজার ফোন কোনোবারই রিসিভ হলো না। উল্টো একসময় বন্ধ দেখাল ফোনটা। সারাটাদিন সৃজার অস্থিরতায় কাটলো। ইহসান না সৃজাকে কোনো ফোন করল, না অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করল। বাধ্য হয়ে সৃজা ওর রেস্তোরাঁয় যোগাযোগ করল, কিন্তু ওখান থেকেও কিছু জানা গেল না। স্টাফরা জানাল ইহসান ওখানে যায়নি, রশিদের উপর সব চাপিয়ে দিয়ে নিজে হাওয়া। স্যার কোথায় সে ব্যাপারে ওরা কিছুই জানে না। ইহসান এরকম ব্যবহার করতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি সৃজা। ও ভীষণ কষ্ট পেল। চিন্তায়ও পড়ে গেল। কোথায় আছে, কী করছে, কী খাচ্ছে, কেন অহেতুক এই রাগ এসবের মানে বুঝল না। ও না-হয় না জেনে অতি কৌতূহল দেখিয়েছে, না বলে ওর জিনিসে হাত দিয়েছে; কিন্তু সৃজা তো জেনেবুঝে, ইচ্ছে করে হাত দেয়নি। বরং ছবিটা ওর হাতে এসে গেছিল! ইহসান এমন রিয়্যাক্ট করবে জানলে সৃজা তো কোনোদিনও ওর জিনিসে হাত দিতো না, না কিছু জিজ্ঞেস করতো!
পরপর দু’দিন ইহসান বাড়ি ফিরলো না। চিন্তায় সৃজার নাওয়া-খাওয়া উবে গেল। রাতে না ঘুমানোর দরুণ চোখের নিচে কালি পড়ে গেল। সামান্য একটা কারণে এত রাগ? একেবারে লাপাত্তা হয়ে গেল মানুষটা? সৃজা কী করবে,কাকে বলবে বুঝে উঠল না। ইজহান-আজিজ শেখকে বলবে বলে ঠিক করল।সেদিন রাতেই আজিজ শেখ ফিরলে সৃজা গেল তার কাছে। আজিজ শেখ তখন ইজহানের সাথে বসে ব্যবসায়িক আলাপ করছিলেন। সৃজাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। বাবাকে একনজর দেখে ইজহান বাঁকা গলায় বলল, “কিছু বলতে চাও নাকি?”
সৃজা কান্না চাপা গলায় নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “আপনার ভাই তিনদিন যাবৎ বাড়ি ফিরছে না, ফোনেও পাচ্ছি না।”
সৃজার মুখে এ কথা শুনে ইজহানের চোখ থেকে কোটর বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। ভীষণ বিস্মিত হলো সে। ভেড়াটা বাড়ি নেই তিনদিন যাবৎ, লাপাত্তা? এজন্যই দেখা পাচ্ছিল না! ও তো ভেবেছিল কোথাও বুঝি কাজে গেছে, বউটাকে হয়তো বলেটলে গেছে। কিন্তু এই মেয়ে এখন এসে বলছে তিনদিন যাবৎ ভেড়াটার কোনো খোঁজই পাচ্ছে না? অদ্ভুত! কোথায় গেল তাহলে? ইজহানের মনে মনে চিন্তা হলো ঠিকই। কিন্তু ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করল না। গলা খাকারি দিয়ে সৃজার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা গলায় বলল, “খেয়ে খেয়ে তো এতবড় হাতি হয়েছে, অতবড় হাতিকে নিশ্চয় কেউ কিডন্যাপ করেনি। চিন্তার কারণ দেখছি না বাপু। হয়তো ট্যুর দিতে গেছে! ট্যুরে তোমায় নিবে না বলে যোগাযোগ করছে না…”
ইস্মি সৃজার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। ও ইজহানের অবান্তর কথা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। চাহনিতে বোঝাল এসব কথাবার্তা না বলতে। ইজহান বউয়ের ইশারা বুঝে চুপ মেরে গেল। সে আজকাল বউয়ের কথা খুব মানে, অবাধ্য হয় না৷ এদিকে পুত্রের নিঁখোজ হওয়ার সংবাদে আজিজ শেখ ফিরে তাকালেন সঙ্গে সঙ্গেই। ভ্রু দুটো কুঁচকে তড়াক গলায় বললেন “কীহ?”
সৃজা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু কোথাও ওর হদিস পাচ্ছি না।”
“আর এই খবর তুমি এদ্দিন পর আইসা দিতেসো? অদ্ভুত, বেক্কল মেয়েমানুষ তো তুমি!”
আজিজ শেখ গলা চড়ালেন। তার ছেলে বাড়ি নেই, খোঁজ নেই এটা এই মেয়ে তিনদিন পর এসে বলছে? আক্কেল কী সব গিলে খেয়েছে নাকি? তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, “এমনি এমনি নিশ্চয় এমন করে নাই, কী হইসে সেইটা কও…”
সৃজা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অস্বস্তি নিয়ে বলল, “ঐ একটু রাগারাগি.. মানে ঝগড়া নয় ঠিক।”
আজিজ শেখ শাণিত গলায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চাইলেন, “কী নিয়া?”
“তেমন কিছু না।”
“এরপরেও জানতে চাইতেসি কী নিয়া, খোলাখুলি কও।”
সৃজা হতবিহ্বল হয়ে গেল। আজিজ শেখ সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। যেন জেনেই ছাড়বেন কী নিয়ে ঝামেলা! সৃজা এটা-সেটা বলে সুবিধা করতে পারলেন না, আজিজ শেখ বিশ্বাস করলেন না। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন ওকে। সৃজা ভড়কে গিয়ে গাইগুই করে বলল, “একটা ছবি।”
“ছবি মানে? ছবি নিয়া ঝগড়া হওনের কী আছে? আনো দেখি ছবিটা!”
“ছবি তো আমার কাছে নেই।”
আজিজ শেখ তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইলেন এবার, “ঐডা কী এমন বিশেষ ছবি যে একেবারে বাড়ি ছাড়ল পোলাডা? কী ছিল ছবিতে?”
সৃজার হাসফাঁস লাগল। কী বলবে ও? যে ওটা ওদের মায়ের ছবি? আমি না জেনে ধরে ফেলেছি, জেনে ফেলেছি কিছু অপ্রিয় সত্য? না, এমনিতেই ওটা নিয়ে ঝামেলা বেঁধে আছে৷ ইহসান যখন চায় না তখন ওটা নিয়ে জলঘোলা করতে রাজি না ও। সৃজা কোনোভাবে কথা কাটানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আজিজ শেখ জহুরি চোখে ওকে পরখ করতে লাগলেন। তিনি এত সহজে ছড়ালেন না ওকে। আবারো কথার মারপ্যাঁচে ফেলে জানতে চাইল কী এমন ছবি ওটা, যারজন্য তার ছেলে রাগারাগি করে বেরিয়ে গেছে! সৃজা কিছুতেই বলতে চাইছিল না, কিন্তু আজিজ শেখ বাধ্য করলেন ওকে ছবিটার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে। সৃজা হার মানলো তার কথার জালে। তবে সরাসরি কিছু বলল না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলল ছবিটা একটা মহিলা আর দুটো বাচ্চার! শুনেই আজিজ শেখ বিস্মিত হয়ে গেলেন। বুঝে গেলেন ওটা কী ছবি হতে পারে। তিনি ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সৃজার দিকে। গলা দিয়ে কতক্ষণ শব্দ বেরুলো না তার। নিজেকে ধাতস্থ করলেন সময় নিয়ে। এরপর কাঠিন্য নিয়ে বললেন, “তুমি যে একটা বেয়াদ্দব মেয়ে তা এইবার ওর বুঝা উচিৎ। ওর জিনিসে ধরবা ক্যান ওরে না বইলা?”
সৃজা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে, কিন্তু এদের সামনে কাঁদা যাবে না। কাঁদার সময়ও নয় এটা। একটা ছবির জন্য এতকিছু কাহিনী হবে জানলে ও ছুঁয়েও দেখতো না। তবে একটা জিনিস বুঝল যে, আজিজ শেখ ভীষণ চতুর ও ধূর্ত একটা লোক। ঠিকই এ কথা, সে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে ওর থেকে জেনে নিয়েছে ছবির বিষয়টা। ওর ভীষণ খারাপ লাগল ব্যাপারটাতে। তবুও আজিজ শেখকে বিনীত স্বরে বলল, “আংকেল আপনি একটু দেখুন না, যদি কোনো খোঁজ পান।”
আজিজ শেখ তিরিক্ষি গলায় বললেন, “পোলা আমার, আমি ওর বাপ। তুমি না বললেও আমি ওর খোঁজ করব। তবে তুমি যে ওর কেমন জীবনসঙ্গী হইয়া আসছো সেইটা ওর বুঝনের দরকার আছে! আমি যে বাপ হই, ওর ভালো চাই এইডা পোলাডা বুঝল না, চিরকাল আমারে ভুলই বুঝল। কোথা থেইকা হাভাতে ধইরা নিয়া আসছে। যার সংসারে নজর নাই! লাই দিয়া মাথায় তুলছে…”
সৃজার চোখে পানি এসে গেল কটুক্তি শুনে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো ও। ওদিকে ইজহানও থম মেরে বসে আছে৷ ওর বুঝতে বাকি নেই কোন ছবিটার কথা বলেছে সৃজা!
.
.
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ৷ গায়ে কোনো কাপড় নেই ইহসানের। কাচের জানালা ভেদ করে আসা রোদ্দুর চোখেমুখে পড়ছে ওর। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর ভোরের দিকে চোখ লেগে আসা ইহসান ঘুমের ঘোরেই বিরক্তিতে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে উঠল। গলা খাকারি দিয়ে বলল, “অ্যাই সৃজু, ঘুমাতে পারছি না তো। রোদ এসে লাগছে, পর্দাটা টেনে দে।”
কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন সৃজার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, জানালার পর্দা টেনে দেওয়া হলো না তখনি কপাল কুঁচকে গেল ইহসানের৷ বিরক্তি নিয়ে বন্ধ চোখদুটো খুলল সে। প্রথমে বুঝে উঠতে পারল না সে কোথায় আছে। কিন্তু মস্তিষ্কটা কাজ শুরু করতে ধরফড়িয়ে উঠে বসল ও। মনে পড়ল তিনদিন যাবৎ সে এখানে, এই ফ্ল্যাটে অবস্থান করছে! সৃজার উপর অভিমান না রাগ জন্মেছে ও জানে না। কিন্তু ও কিছুতেই চায়নি সৃজার হাতে পড়ুক ছবিটা। বাড়িতেও ফিরছে না সে এই ভয়ে, জবাবদিহি করতে হবে এই ছবিটা নিয়ে। ফোন ধরারও সাহস হচ্ছে না, যদি আবার জিজ্ঞেস করে ছবির মহিলা কে? সে কী জবাব দেবে? এটা আমার মা অথচ আমি তোর থেকে লুকিয়ে গেছি? বলিনি তোকে? ইহসান ভাবতে পারে না এমন কিছু! আজ পর্যন্ত মেয়েটা ওর ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি, না জানতে চেয়েছে কিছু! সৃজাকে সে সারাক্ষণ ক্ষেপালেও ভীষণ আদরে রাখে, ওর গায়ে হাত তোলার কথা ভাবতেই পারে না। অথচ সেদিন কী বিশ্রি ব্যাপার হয়ে গেল! ছবিটা নিয়ে রাগের মাথায় মেয়েটাকে সে আঘাত করে বসেছে। যেটা একদম উচিৎ হয়নি। তিনদিন ধরে অনুশোচনা হচ্ছে ওর ভীষণ। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। বুক পুড়ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে ভেতরে। সৃজাটা নিশ্চয় অভিমান করেছে ওর উপর! নাকি অস্থির হয়ে আছে, রাগ করে বসে আছে? মাফ চাইলে ওকে মাফ করবে মেয়েটা? ইহসান দ্বিধান্বিত হয়ে নিজের উপর ত্যক্ত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ঠান্ডা লাগছে ভীষণ। রিমোটটা খুঁজে নিয়ে এসিটা বন্ধ করে সে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রান্নাঘর থেকে দু’কাপ চা বানিয়ে পাশের রুমটাতে গেল সে। দরজার নব ঘুরিয়ে খুলল সে, এরপর ভিড়ানো দরজার কপাট লাথি দিয়ে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রবেশ করেই ভেতরের দৃশ্য দেখে ওর মেজাজটা বিগড়ে গেল। বিশ্রি একটা গালি দিলো হুইল চেয়ারে বসে থাকা যুবককে। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “সারারাত গিলেছিস এরপরেও কলিজা শান্ত হয়নি? সকাল সকালই শুরু করেছিস!”
যুবক তাকালো ওর দিকে। এরপর বিগলিত স্বরে বলল, “মর্নিংয়ে গলাটা না ভেজালে দিনটা ঠিকঠাক শুরু হয় না। দু’ পেগ নিতেই হয় ব্রো। তুমি কী নিয়ে এসেছ? কফি? উহু! তুমি তো আবার চা খোর…”
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল ইহসান, “খাবি চা?”
“তোমার আদা চা অবশ্যই খাব।”
ইহসান কাপদুটো বেড সাইডের উপর রেখে বিরক্তি নিয়ে বলল, “বোতল ফেল, ফ্রেশ হয়ে আয়।”
যুবক এবার বাঁকা হাসল, “ঠ্যাংদুটো ভেঙ্গে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছ, উড়ে উড়ে যাব যে আমার তো ডানা নেই ব্রো।”
“নজর ঠিক না করলে হাতদুটোও যাবে।”
লেভেল লাগানো কাচের বোতলটা মেঝেতে রেখে যুবক কপাল চেপে হেসে উঠল, “লাইফে সিরিয়াস একটা প্রেমেই পড়েছি, নজর তো ঠিক হবে না ব্রো। আমার নজর ঠিক যদি করতেই চাও, তাহলে হয়তো আমাকে তোমার মেরে ফেলতে হবে। আমি জানি সেটা তোমার পক্ষে সম্ভব না।”
ইহসান তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল এ কথা শুনে। রক্তাভ হয়ে উঠল চোখজোড়া। নিশপিশ করে উঠল হাত। গমগমে কণ্ঠস্বরে বলল, “অসম্ভবও না।”
ব্যান্ডেজে আবৃত পা নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে থাকা ইনজান শয়তানি হাসি দিয়ে একবার ওর হাতের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে সে বলল, “আমার তো প্রথম প্রেম তাই না? উহু! অত সহজে ছাড়ছি না।”
তেড়ে এসে ঘুষি বসাল ইহসান ওর চোয়ালে। কঁকিয়ে উঠে পরক্ষণেই হেসে ফেলল ইনজান। ইহসান ওর চোয়াল চেপে ধরে রাগত স্বরে বলল, “এই তুই প্রেম-ভালোবাসার কী বুঝিস? প্রথম প্রেম আবার কী? তোর কাছে মেয়েরা হলো খেলার জিনিস, টিস্যুর মতো একবার ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলার জিনিস। কিন্তু আমার সৃজা কোনো খেলার জিনিস না, না কোনো টিস্যু আর সস্তার মেয়েমানুষ! তাই ওকে ছাড়তে বাধ্য তুই। ভাই বলে, নয়তো কবেই তোকে কিছু একটা করে ফেলতাম আর তিনহাত মাটির নিচে রেখে দিতাম।”
ফিসফিসিয়ে বলল ইনজান, “তুমি হলে তোমাকেও আমি কিন্তু সেই সুযোগটাও দিতাম না। ব্যাপার কী? ল্যাভেন্ডারের চেয়ে আমাকে একটু বেশি ভালোবাসো নাকি? উফ ব্রো! বে-ইনসাফি হয়ে যাচ্ছে তো! ভেরি স্যাড!”
ইহসান রুক্ষ স্বরে বলল, “তোর মতো নষ্টকে যে এখনো সুযোগ দিয়ে যাচ্ছি এই তোর সাত কপালের ভাগ্য! নেহাৎ মায়ের পেটের সন্তান তুই, দায়িত্ব আছে আমার তোকে শুধরানোর। কিন্তু তাই বলে আমার সর্বস্ব তোকে দিয়ে দেব, অত মহান নই আমি। ইহসান শেখ জীবনে দু’জন মানুষকে প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে, এদেরকে সে ভাগ করতে শেখেনি ; এক তার মা, দুই তার স্ত্রী!”
ইনজান বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল, “স্ত্রী….উফ ব্রো! বুকে লাগে তো।”
“কু*ত্তার বাচ্চা, নাটক করবি না।’’
ইনজান মুখ গোঁজ করে ফেলল, “এই দেখো, সত্য বললেও রাগ করে ফেলো তুমি! জানোই তো, মিথ্যে বলে আমি কাউকে খুশি করতে পারি না আমি। আমার কিন্তু মনে যা মুখেও তা-ই।”
“ফটকাবাজি বন্ধ কর! মেরে মুখ ভেঙে দেব।”
“ওকেহ, বন্ধ করলাম। দয়া করে এবার আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হেল্প করো, পি পেয়েছে!”
ইহসান রাগ চেপে হুইল চেয়ারের হ্যান্ডেল মুঠো করে ধরল। এরপর সেটা ঠেলে ওয়াশরুম অবধি নিয়ে যেতেই যুবক তেড়ছা গলায় ওকে বলল, “ভেতরে আসবে একটু?”
“তুই কীভাবে পি করিস সেটা আমাকে দেখতে হবে?”
ইনজান আবারো কপালে আঙুল বুলাল, “চার মাসের আগে তো উঠে দাঁড়াতে পারব না। প্যান্ট খুলতে সাহায্য করবে তো নাকি!”
ইহসান চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোয়ালে পরে আছিস নির্লজ্জ!”
“উপস সরি।”
“ভন্ড।”
ইনজান কথাটা ফিরিয়ে দিয়ে বক্র হাসি ঠোঁটে ঝুলাল, “ভন্ড…আমার ল্যাভেন্ডারের একমাত্র বরটা।”
____________
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৩৬
ইহসানের অনুপস্থিতি সৃজাকে কষ্ট আর পীড়া তো দিচ্ছিলই, তার সাথে আজিজ শেখের চেঁচামেচি আর অকথ্য ব্যবহার নতুন করে যোগ হয়েছে। এতদিন ইহসানের কারণে কটুক্তি মাত্রা ছাড়াতে পারেনি, কিন্তু এখন ছেলের অনুপস্থিতি আজিজ শেখকে দারুণ একটা সুযোগ করে দিয়েছে। লিথুরাণীকে ইহসানের গলায় না ঝুলাতে পারার ব্যর্থতা আর সৃজার প্রতি ক্ষোভ—এসবের ঝাঁঝ মেটাচ্ছেন বাড়ি মাথায় তুলে। সৃজা এসব কটুক্তি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে! তবুও মাঝেমধ্যে তিক্ত অনুভূতিতে ওর মন ক্লিষ্ট হয়, চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নামতে চায়। কিন্তু মনকে বুঝিয়ে শান্ত করে। জানার চেষ্টা করছে ওর উপর রাগ করে লোকটা কোথায় গা-ঢাকা দিলো!
এদিকে অবশ্য আজিজ শেখ দু’দিন ধরে খোঁজখবর চালিয়ে অবশেষে জানতে পারলেন ইহসান কোথায় আছে! জেনে নিশ্চিন্ত হলেন ঠিকই, কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। যেহেতু সংবাদটা তিনি আগে জেনেছেন, তাই জানাবেন কি না, সেটা তার মর্জির ব্যাপার! এক সন্ধ্যায়, ইহসানের সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলেন তিনি। দরজা খুলে নিজের তাকে দেখে ইহসানের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। রশিদ আগেই ফোন করে জানিয়েছিল, আজিজ শেখ জেরার মুখে ফেলে জেনে নিয়েছেন ওর ঠিকানা। তিনি যে এভাবে কথা ঘুরিয়ে, খোঁচা দিয়ে, মুখ থেকে সব বের করে নিতে ওস্তাদ—এটা ইহসান ভালোই জানে। এবং সে এতে চরম বিরক্ত। সে বিরক্তি প্রকাশ করল স্পষ্টভাবে। কিন্তু আজিজ শেখ এসবের ধার ধারলেন না। ভেতরে গিয়ে নিজের মতো করে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসলেন। এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “এই ফ্ল্যাট কখন নিছো তুমি? আর হাভাইত্তা মেয়েরে বিয়া করার মজা বুঝছ?”
ইহসান কপাল কুঁচকালো, “হাভাইত্তা মানে?”
আজিজ শেখ বাঁকা হাসলেন। পানির গ্লাস টেনে নিয়ে ঘড়ঘড় করে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, “যার বাপ পঙ্গু, মা নাই। সম্পত্তি নাই, রেফারেন্স নাই, লাইফে কোনো স্ট্যান্ডার্ড নাই—তোমার মতো ছেলের বউ হইতে গেলে যে নিজেরও যুতসই যোগ্যতা লাগে তা জানা নাই, তারে হাভাইত্তা ছাড়া আর কি বলব?”
ইহসানের চোখ ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠল, “আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলার অনুমতি কে দিলো?
আর স্ট্যান্ডার্ড, যোগ্যতার মানে কী? একে-ওকে বিয়ে করে ঠকানো? হোটেলে যাওয়া? শরীর প্রদর্শন? অবশ্য কাকে কী বলছি? কাকের কাছে কাকের গান!”
আজিজ শেখ সব কথা হজম করে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পানির গ্লাসে একটা চুমুক দিলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, “বাপের টাকা থাকলে এসব কিছু মাফ করাই যায়। দুনিয়ায় টাকাপয়সা, সহায়-সম্পত্তি আসল। অন্যকিছু বাদ দিলেও চলে।”
ইহসান বাঁকা হাসলো, “বিকৃত মানসিকতার মানুষের কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি আর কীই আশা করা যায়! বুঝি বুঝি, জুটেনি তো কপালে, তাই এই হাল—আফসোস!”
পুত্রের কটুক্তিতে মেজাজ চড়তে গিয়েও চড়ল না বরংচ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ফুটে উঠল আজিজ শেখের গলায়, “যারে কবুল বইলা নিয়া আসছ হেই তো আক্কল জ্ঞানহীন মাইয়া মানুষ! তুমি নিঁখোজ অথচ সে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াইতেছে। কোনো চিন্তা নাই। লিথুরে বউ করো নাই সেইটা মানছি কিন্তু তোমার বউয়ের আচরণ বুঝায় দিয়েছে আমি ওরে না মাইনা ঠিক পথেই আছি!”
“আপনার মানার ধার ধারছেটা কে? নিজেকে অতো দামী ভাবার কিছু নেই। আপনি কী ভাবছেন সৃজা আনন্দে আছে শুনে আমি দুঃখব পাব, নারাজ হব? উহু! আমি শুনে খুশি হয়েছি! আমার অনুপস্থিতিতে ও নিজেকে আনন্দে রাখছে শুনে আমি প্রাউড ফিল করছি, দ্যাটস মাই ওয়াইফ…”
ইহসান একপেশে হেসে বলল কথাগুলো। আজিজ শেখ এসব কটুক্তি গায়ে মাখলেন না। ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন, “সে তুমি যাই কও, তোমার ঐ হাভাইত্তা বউ ঘর হাতানি শুরু করছে! মিনিমাম কার্টেসীও জানা নাই ঐ মেয়ের। অনুমতিবিহীন ধরার সাহস পায় ক্যামনে তোমার মায়ের ছবি-ছিনারিতে? এইখানে আইসা বইসা আছ, ঠিক কাজ করছ!”
আজিজ শেখের বাঁকা কণ্ঠের কথাগুলো ভালো লাগল না ইহসানের। থমথমে গলায় আওড়াল, “আপনার মুখ থেকে সৃজার ব্যাপারে কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি কিন্তু কিছু ভুলে যাইনি! আপনি ওর কী কী ক্ষতি করার ধান্ধা করেছিলেন সবই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। নিজের আর সাগরেদদের অবস্থা আশা করি ভুলে যাননি!”
লিথুর হুট করে উবে যাওয়া, তারপর আবার তপন নামক একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফিরে আসা! ছেলের হুমকিতে মনে পড়ে আজিজ শেখের। লিথুর হাতের এ’সি’ডে পুড়ে যাওয়া অংশটা চোখে ভাসতেই তিনি নিজের পাঞ্জাবি চেপে ধরেন। এ’সি’ড পরিকল্পনায় তিনি জড়িত এটা জানার পর ইহসান তার শরীরের কিছু অংশেও এ’সি’ডে ঝলসে দিয়েছে! কাপড়ের উপর দিয়ে ঝলসানো জায়গাটায় কয়েক সেকেন্ড নীরব চেয়ে থাকেন। কী এক ছেলে হয়েছে তার, বাপকেও ছাড়েনি! আজিজ শেখ স্বাভাবিক গলায় বলেন, “এরজন্য তুমি আমার চালের মিল লাটে উঠাইসো, হোটেলের কাজটা হাতছাড়া করাইয়া ফতুর করার চেষ্টা করছ! তা করছো যেহেতু, করছো! তুমি আমার সন্তান হও, তোমার অতটুকু রাগ মাইনা নিসি।”
ইহসানের মাথা রাগে দপদপ করছে। বাপ নামক ট্যাগ লাগিয়ে রাখা এই ধুরন্ধর লোককে সে কী করবে, কোন শাস্তি দেবে? দু-একটা ব্যবসা লাটে তুলেছে, তাতে কী? এই লোকের তো বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই। কিছু হারানোর ভয় পায় না লোকটা। ইহসান চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। এক পৃথিবী বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে সতর্ক করে আজিজ শেখকে, “হু, ওটাই! মনে-মগজে গেঁথে রাখেন। দরকার হলে সাইনবোর্ড বানিয়ে গলায় ঝুলান! পরেরবার কোনো কলকাঠি নাড়ালে এইবার শেষবার, আমি ভুলে যাব সম্পর্ক কী, সামনে কে আছে।”
আজিজ শেখ পুত্রের হুমকি গিলে নেন, পরক্ষণেই সাবলীল কণ্ঠে বলেন, “সে তুমি কবেই ভুইলা গেসো আমি তোমার কে! ছোট থেকে বড় করলাম, ভরণপোষণ দিলাম, পরিচয় দিলাম, আগলায় রাখলাম, যা চাইছো জীবনে তা-ই দিলাম…”
কথাটুকু শেষ হয় না৷ তার আগেই ইহসান তীব্র স্বর তাকে থামিয়ে দেয়, “না দেননি। মাকে চেয়েছিলাম, দিতে পারেননি। আর যেসব দেওয়ার কথা বলছেন, সেগুলো আপনার পাপের প্রতিফল, আমরা পেতামই, ম্যান্ডেটরি ছিল! তাছাড়া আপনিই নাকি চেয়েছিলেন, যে-কোনোভাবে মা’কে বাগে আনতে! শেষ পর্যন্ত কী হলো? পেরেছিলেন আমার মা’কে বাগে আনতে? পারেননি। কেন পারেননি? কারণ আপনি একটা ব্যর্থ আর কাপুরুষ প্রজাতির অমানুষ! আপনার নষ্ট আর কলুষিত চরিত্রের জন্য আমরা মায়ের স্নেহ থেকে চিরজীবনের জন্য বিসর্জিত!”
ক্ষোভের কথাগুলো শুনে গা জ্বলে উঠলেও আগুন বাইরে বের করলেন না আজিজ শেখ। নিজের এই ব্যর্থতা বারবার মনে করতে চান না। কিন্তু এটাও তো ঠিক—ঐ নারীই একমাত্র ব্যক্তি, আজিজ শেখ যার মনে জায়গা করতে চেয়েছে! কিন্তু ঐ মেয়েমানুষ বারবার ভেঙেছে, তবুও মচকায়নি! তার হয়েও তার হয়নি! এই দুঃখ কোথায় রাখবেন তিনি? বুকটা ভারী হয়, জ্বলে! আজিজ শেখ গোপনে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে নিজে স্বাভাবিক হোন। কথা না শোনার ভান করলেন। ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে কথা কাটালেন, “যাইহোক, বাপ হয়ে তো আমি ফেলে দিই নাই তোমাদের চারজনকে—আব্বা হই! কিঞ্চিৎ সম্মান তো দিবা নাকি?”
“আমি ইজহান নই।”
আজিজ শেখ হাল ছেড়ে দিয়ে ফুঁস করে শ্বাস ছাড়েন, “ইহসান, তুমি যে আমার কলিজার টুকরা কোনোদিনই সেইটা বোঝো নাই।”
“ভাগ্যিস! নয়তো লুফারটার মতো গদগদ করতাম একটা রে’পিস্টকে!”
আজিজ শেখ ছেলের মুখে সরাসরি একথা শুনে মেজাজ হারান। তবে বরাবরের মতোই প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন, “তা যা খুশি বলো, আমি রাগ করি না।”
“লজ্জা থাকলে তো!”
“মেয়েমানুষ ভাবো কেন নিজের আব্বাকে?”
আজিজ শেখ হেসে উঠেন। ইহসানের বিরক্ত লাগে, চরম বিরক্ত। সে চোখমুখ শক্ত করে বাপের হাসিমুখের দিকে চেয়ে থাকে। আজিজ শেখ কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ান। এরপর ঘুরেফিরে ফ্ল্যাটটা দেখতে থাকেন। ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা। ইহসান ভেবেছিল এই লোক বিদায় নেবে, কিন্তু যাওয়ার কোনো লক্ষ্মণ নেই। ওর আরো বিরক্তি লাগে, রাগে হাত-পা নিশপিশ করে উঠে! ঐ ঘরে বিকেল থেকে ম-দ খেয়ে টাল হয়ে ঘুমাচ্ছে ইনজান। আজিজ শেখ ওকে দেখে এখন আবার আহ্লাদের নাটক বসাবে। পুত্রদের নিয়ে তার আহ্লাদের শেষ নেই! ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বাপ নামক লোকটার কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল!
.
আধ ভিড়ানো দরজাটা ঠেলতেই নাক ডেকে ভোঁসভোঁস করে ঘুমানো পেলব মুখটিতে নজর পড়তেই আজিজ শেখ বিস্মিত চোখদুটোকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তিনি উত্তেজিত ভঙ্গিতেই চিৎকার করে উঠেন, ছুটে যান চাদর গায়ে জড়িয়ে বেহুঁশের মতোন ঘুমিয়ে থাকা যুবকের দিকে, গিয়ে দু’হাতে আগলে নেন তাকে, কোনোদিক খেয়াল না করেই বলে উঠেন, “আমার ইনজান দেখি! কবে আসলা তুমি? ইশশিরে…পোলাডা ঘুমে! ও ইহসান! কলিজা বাপ আমার, তুমি এতক্ষণ ধরে চুপ
ক্যান? বলো নাই ক্যান আমার হীরামানিক এইখানে…দেশে…কাজটা কি ঠিক করলা?”
ইহসানের রাগে পিত্তি জ্বলে। উচ্চরবে বিরক্তি ঝাড়ে, “হীরা মানিক কোলে নিয়ে বসে থাকেন, আমি কারোর খবর এনে দেওয়ার পিওন নই।”
চেঁচামেচিতে আর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে যায় ইনজানের।
সে চোখ খুলে পিটপিট করে। মুখের উপর কাচা পাকা দাঁড়িওয়ালা মুখটিকে দেখে সে কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি প্রকাশ করে, “ ষাঁড়ের মতোন চেঁচাচ্ছ কেন? দেখোনি, আমি ঘুমে অর্ধমৃত?”
আজিজ শেখ খুশিতে, আনন্দে ডগমগ করছেন। এতদিন…এতবছর পর তার ছোটছেলে তার বুকে,
এই আনন্দেই তিনি গলে যাচ্ছেন। ছেলের চোখমুখে চুমু খেয়ে তিনি বললেন, “ঘুমাইও, আগে একটু আদর কইরা নিই!”
“আমি এখন ছোটবাচ্চা না।”
“তুমি আমার কাছে সেই ছোট্ট ইনজানই আছো বাপ, বড় হইবা না। তো কখন ফিরলা? আমায় জানাও নাই কেন? আর বাড়িতে ক্যান উঠো নাই? এইসব কী দেখতেছি আমি?”
ইনজান তখনো কপাল কুঁচকে চেয়ে। বাবার এত প্রশ্নের কোনটার জবাব সে আগে দেবে ভেবে নিয়ে বলল, “ফিরলাম মাসখানিক আগে, ফিরে বাড়িতেই যাব ভাবছিলাম। কিন্তু তোমার কলিজার টুকরা
পথেই আমাকে মেরে পঙ্গু করে প্রথমে হসপিটালে এরপর এই ফ্ল্যাটে এনে আটকে রেখে দিলো, ভাঙা
পা নিয়ে যেতে পারিনি কোথাও।”
আজিজ শেখ আঁৎকে উঠেন। চাদর সরান ছেলের উপর থেকে। দু’পা ব্যান্ডেজে মুড়ানো। দরজার কোণে হুইলচেয়ার দেখে হতভম্ব হন তিনি। আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করেন, “কিন্তু কেন?”
“ল্যাভেন্ডারের দিকে নজর দিয়েছি বলে।”
আজিজ শেখ মুখ বাঁকান, “ল্যাভেন্ডার আবার কে?”
ইনজান দুষ্টু হেসে বলে, “তোমার পুত্রবধূ রুপে যাকে বিয়ে করে নিয়েছে ব্রো, সে-ই।”
আজিজ শেখের মাথা ঘুরে উঠল। কোনোরকমে বললেন, “তোমার ওরে পছন্দ?”
“হু। প্রথম প্রেম৷ সিরিয়াস অনুভূতি। টিস্যু টাইপ না।”
আজিজ শেখ সমীকরণ মেলাতে না পেরে পাথর মুখে বসে রইলেন। তার কিছু বলার নেই। ছোটছেলে উন্মাদ, হেয়ালি ধরনের। এর গুরুদোষ, ইহসান যা পছন্দ করবে, তা ওর চাই। পুরোটা না পেলেও ভাগ চাই। তিনি ইনজানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যথিত নজরে ওর ভাঙা পায়ের দিকে দেখেন। বুকটা হু হু করছে তার। কখনো ফুলের টোকা পর্যন্ত দেননি ওদের। অথচ তার ছেলে ইহসান নিজের ভাইদেরই মেরেধরে শেষ করে দিচ্ছে। জানেন তিনি ইহসানের আচরণ সম্বন্ধে। তাই ঝামেলা এড়াতেই বিরক্তি লুকিয়ে ইনজানকে বলেন, “ঐটা একটা মাইয়া হইসে? বেক্কল আর বেয়াদবের চূড়ান্ত! আমি আরো সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখাব তোমায়। পছন্দ হইলে বিয়াশাদি কইরো একটারে।”
“উহু! অনেক বছরের ফিলিংস জমে শক্ত হয়ে গেছে। ভাঙা সম্ভব না।”
ভাবলেশহীন কণ্ঠে কথাটা বলে আজিজ শেখের উরুতে মাথা রেখে আবারও ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চোখ বুজে ইনজান। ছেলের ঝকঝকে গাল নরম চুলে হাত ডুবিয়ে মনে মনে প্রমাদ গুনেন আজিজ শেখ। সৃজা একটা সাধারণ মেয়ে। আহামরি কিছুই নেই এর মধ্যে। কী এমন দেখল তার ছেলে দুটো এই মেয়ের মধ্যে? কী বিশ্রি অবস্থা! লোকে শুনলে কী বলবে? আজিজ শেখের মনে একটু ধাক্কা দেয়, তরুণ বয়সে তিনি নিজেও যেমন চরিত্রের অধিকারী ছিলেন— অন্যের দোষ আর কী?
.
সৃজার বেশ সন্দেহ হচ্ছে রশিদের উপর। ও নিশ্চিত জানে ইহসানের কোনো না কোনো খোঁজ ওর কাছে আছে। কিন্তু বলছে না। সৃজা মন শক্ত করে রশিদকে আবারও ফোন দেয়, “আমি কতটা চিন্তায় আছি, বুঝতে পারছেন রশিদ ভাই? ওর খোঁজ আপনি নিশ্চয় জানেন, কিন্তু আমাকে বলছেন না। কেন এরকম করছেন বলুন তো?”
ফোনের ওপাশে রশিদের খুব খারাপ লাগে সৃজার জন্য। স্যারটা কী পাষাণ, অহেতুক কেন এই মিষ্টি মেয়েটাকে অস্থির করছে? ওর ইচ্ছে করছে জানিয়ে দিতে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। স্যারের আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। সে ম্লান স্বরে বলে, “আমি কিছু জানি না, বোন। জানলে কী আর বলতাম না?”
“ও সব কাজ আপনাকে জানিয়েই করে, কোথায় গেছে, কী করে, সব আপনার নোটবুকে সাজিয়ে লেখা থাকে। আমি জানি আপনি আপনার স্যারের কথায়ই আমাকে কিছু জানাচ্ছেন না, কিন্তু একবার ভেবে দেখুন এটা কী ঠিক করছেন?”
“না মানে…জানলে জানাতাম সত্যিই।”
রশিদ মন্থর কণ্ঠে বলে। সৃজা স্পষ্ট বুঝতে পারে, রশিদ জানে ইহসান কোথায় আছে। কিন্তু ইহসানের নিষেধ থাকায় বলছে না। এই রশিদ স্যারের ভক্ত—ভয়ও পায়। এজন্যই হয়তো কিছু বলছে না। ওকে আর জ্বালিয়ে কাজ নেই। সৃজা আর খোঁজ করবে না পাষাণটার! থাকুক যেখানে খুশি! অহেতুক কষ্ট পাবে না। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভার গলায় রশিদকে বলে, “আপনার বিবেককে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন তো, রশিদ ভাই, সে কী বলে! এরপর যদি আমাকে ওর খবরটা জানাতে ইচ্ছে হয়, তাহলে একটা ফোন দিয়েন। আর বিরক্ত করছি না আপনাকে। ওহ হ্যাঁ, যদি আপনার সাথে ওর যোগাযোগ হয়, তাহলে জানিয়ে দিয়েন—সে কাজটা ভালো করেনি, এরজন্য খুব ভুগবে, পস্তাবে। রাখছি।”
রশিদ বেশ বিপাকে পড়ে গেছে। ওর চিন্তা হচ্ছে। ভয় হচ্ছে। তখন সৃজা যেভাবে বলল ইহসান খুব ভুগবে, পস্তাবে! এসবের মানে কী? সৃজা আবার রাগ করে কিছু করে বসবে না তো? যদি ডিভোর্স দিয়ে দেয়? বা হতাশ হয়ে সু’সা’ইড করে? রশিদ বেশিকিছু ভাবতে পারল না। স্যারের সংসারটা সে ভাঙতে দিতে পারে না। সে বুদ্ধি খাটিয়ে ইহসানকে ফোন দিয়ে মলিন গলায় বলল, “স্যার…ম্যাডাম তো মনে হয় উল্টাপাল্টা কিছু করার প্ল্যান করতেছে।”
“প্ল্যান মানে?”
রশিদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “আমায় ফোন দিয়ে আপনার খোঁজ জানতে চাইল একটু আগেও। আমি বলি নাই। এতে ম্যাডাম বলল আপনি নাকি খুব পস্তাইবেন, ভুগবেন। কেন বলল আমার জানা নাই। কিন্তু আমার ভালো ঠেকতেছে না কিছু…”
রশিদের কথা শুনে ইহসানের ভ্রু কুঁচকে গেল। নড়েচড়ে বসল সে। তিরিক্ষি গলায় সন্দেহ নিয়ে শুধাল, “ঝেড়ে কাশো রশিদ! ভালো ঠেকছে না কেন?”
রশিদ ঢোক গিলে বলল, “গলা শুনে আমার মনে
হলো কান্নাকাটি করছে খুব! মানে স্যার…আমি বলতে চাইছিলাম ম্যাডাম যদি রাগ কইরা উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে!”
ইহসান বাকরুদ্ধ বনে গেল। আসলেই কী? সৃজা হন্যে হয়ে ওর খোঁজ করছে এটা সে জানে। কিন্তু মেয়েটা যা অভিমানী আর খেয়ালি…যদি সত্যিই ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু করে বসে? ইহসান তড়িঘড়ি করে নিজের জিনিসপত্র খুঁজতে লাগল!
___________
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৭
ইহসান বাকরুদ্ধ বনে গেল। সৃজা হন্যে হয়ে ওর খোঁজ করছে, এটা সে জানে। কিন্তু মেয়েটা এতই অভিমানী আর খেয়ালি… যদি সত্যিই ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু করে বসে? ইহসান তড়িঘড়ি করে নিজের জিনিসপত্র খুঁজতে লাগল। দু-একটা জামা-প্যান্ট ব্যাগে ভরে বেরিয়ে পড়তে যাবে, ঠিক তখনই ইনজান আর আজিজ শেখের উপস্থিতি মনে পড়ায় থমকে গেল। উহু! এই দুই কুটিল আর বিপদজনক লোককে একা এভাবে এখানে ছেড়ে রেখে গেলে আবারও কোনো ঘট পাকিয়ে বসবে। একটা ব্যবস্থা করে এরপর এখান থেকে বেরুতে হবে। ইহসান ব্যাগ ছুঁড়ে হতাশ হয়ে বসে পড়ল। মাথা চেপে ধরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল। ভেবেচিন্তে পেল না কী করা উচিত তার!
সৃজাকে কী সে বলে দেবে সত্যিটা, নাকি এড়িয়ে যাবে? তাতে যদি মেয়েটা ওকে ভুল বুঝে? এমনিতেই তো ভুল বুঝে আছে! কিন্তু তাতে আর কী? সত্যিটা জানার জন্য এই মেয়ে নিশ্চয় উদগ্রীব হয়ে আছে। সে কী নিজে থেকে বলে দেবে? এটা কি উচিত হবে? কিন্তু নিজের মুখে এই অপ্রিয় সত্যিগুলো সে বলবে কী করে? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল, একটা চিঠি লিখবে সে সৃজাকে। কারণ— যে কথাগুলো মুখে বলা যায় না, সেগুলো কাগজে লিখে সহজেই প্রকাশ করা যায়! এই কাজটা তথাকথিত সহজ। কণ্ঠের আকুলতা, দুর্বলতা অন্যরা বুঝতে পারে না। ইহসানের চিঠিপত্র লেখার অভ্যাস নেই। তাই দোনামনা করে কলমে খসখস শব্দ তুলে কাগজে লিখতে বসল।
সৃজা,
তোর উপর এমনি এমনি রাগ করিনি। কারণ আছে বলেই রাগ করেছি। তবে রাগ হলেও তোকে আঘাত করতে বা তোর থেকে দূরে থাকতে চাইনি। তবুও থেকেছি, কারণ তুই এমন একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিস, যা আমি সব সময় লুকিয়ে রেখেছি। অতীতের সেই ঘটনা আমি ঘৃণা করি, কখনো কারো সামনে আনিনি, আনতেও চাই না। কিন্তু যেহেতু তুই সন্দেহ করেছিস, তাই মনে হচ্ছে তোকে সত্যিটা না বললে আমার শান্তি মিলবে না। যদিও সত্যি বলেও
যে শান্তি পাব, তেমনও নয়। কারণ এমন অনেক সত্যি আছে, যা আমি তোর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি। জানলে তুই ভয়ানক কষ্ট পাবি, আর আমি তোকে কষ্টে দেখতে চাই না। তুই আমার কাছে একটু খুশি—আর নিজের খুশিকে কেউ কষ্টে দেখতে চায় না। ঠিক এই কারণেই তোকে ভালোবাসা সত্ত্বেও কখনো তোকে বুঝতে দিইনি, মুখ ফুটে বলিনি। তোকে ভালোবাসলেও কখনো আমার জীবনে পেতে চাইনি, আশা করিনি, বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিনি। সব মিলিয়ে, আমার জীবনে তোর পদার্পণ আকাঙ্ক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অনাকাঙ্ক্ষিত।
এবার শোন, তোর সন্দেহটা সত্যি। ছবিতে আমি, আমার ভাই ইজহানের সাথে যিনি ছিলেন, তিনি আমার মা। জন্মদাত্রী মা। এমিলি ইয়াসমিন। আমার জীবনে দেখা অতীব সুন্দরী, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো এক নারী। শান্ত, ভদ্র, পড়াশোনায় ভালো। ক্যানভাস আর রং-তুলিতেই তার ভালোবাসা খুঁজে পেত। ফরাসি মা আর বাংলাদেশি বাবার সন্তান। জন্মের সময় মা মারা যায়। স্ত্রী বিয়োগের কষ্ট আর মাতৃহীন মেয়েকে বাবা একাই বড় করেন। মেয়ে কখনো বাংলাদেশ দেখেনি, তাই নিজ দেশ দেখাতে সতেরো বছরের কিশোরী মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। গ্রামে আসার পর গ্রামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমিলি রং-তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতো। নিরবে-নিভৃতে বসে ছবি আঁকতো। কিন্তু এটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। তার ঝঞ্ঝাটহীন রূপ চোখ ধাঁধিয়ে দেয় গ্রামের চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া, নষ্ট চরিত্রের ছেলেটার। সে এমিলির পিছু পড়ে যায়। প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব যায় বাড়িতে। কিন্তু মেয়েটা, তার বাবা এবং পরিবারের সবাই বারবার তা ফিরিয়ে দেয়। এদিকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে চেয়ারম্যানের ছেলের ইগোতে আঘাত লাগে। শোধ নিতে একরাতে সে এমিলিকে অপহরণ করে। টানা চার মাস তাকে পরিত্যক্ত বাংলোতে আটকে রাখে। নিজের মতো করে ভোগ করে মেয়েটাকে। চার মাস পর পুলিশের সাহায্যে এমিলিকে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু চেয়ারম্যানের ক্ষমতার জোরে তার ছেলে জেল থেকে পালিয়ে ফেরারি হয়ে যায়।
ততদিনে এমিলি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বাড়ি ফিরে এলেও তার চারপাশে ছি ছি, ধিক্কার পড়ে যায়। তাকে পাপিষ্ঠা, চরিত্রহীন নারী বলে অপমান করা হয়। তার পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়। তার বাবাকে অপমান, অপদস্ত করা হয়। তিনি মেয়েকে নিয়ে দেশ ছাড়তে চাইলে সেটাও হতে দেয়নি কিছু লোক। এর মধ্যে ঘটে যায় আরও একটি ভয়াবহ ঘটনা। এমিলি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সেই রেপি’স্টের সন্তান। একমাত্র ও আদরের মেয়ের হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি, উন্নত চিকিৎসার অভাব এবং মৃত্যুর শঙ্কা, মেয়ের দুর্বিষহ ভবিষ্যতের শঙ্কা—এসব সহ্য করতে না পেরে এমিলির বাবা শোকাগ্রস্ত হয়ে মারা যান। এতিম হয়ে যাওয়ার সেই শোক সামলানো সহজ ছিল না এমিলির পক্ষে। তবুও নয় মাস পর এক ঝড়ের রাতে এমিলি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।
এরপরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। চেয়ারম্যান বাড়ির বংশপ্রদীপ দুটি এমিলির গর্ভ থেকে এসেছে। হাতছাড়া করা যায় নাকি? চেয়ারম্যান ও তার ছেলে আনন্দে আটখানা হয়ে গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করে। এদিকে এমিলির দাদার পরিবার মানসম্মান আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে ছেড়ে দেয়। এমিলিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তার সৌন্দর্যের লোভে তাকে ধ্বংস করা হয়। চেয়ারম্যান তার ছেলেকে সংসারী করার উদ্দেশ্যে ছেলে আর নাতিদের জন্য বাড়িসহ কোটি টাকার সম্পদ লিখে দেন। বাচ্চা ছেলে দুটো অবশ্য তখন রেপি’স্টের অন্তঃপ্রাণ। সব পেয়ে সে বিশ্বজয়ী। কিন্তু কিন্তু কিন্তু… এমিলি ইয়াসমিন তো তাকে বিশ্বজয়ী হিসেবে দেখতে চায়নি! না হতে চেয়েছে তার সন্তানদের মা, না তার স্ত্রী! কোনোদিনই সে ভালোবাসেনি ঐ কুলা’ঙ্গার লোককে, না কাছে টেনেছে, ভালোবেসেছে ঐ দু’টো সন্তানকে। অথচ তার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তার নির্দোষ সন্তানেরা ভিখিরির ন্যায় হাত পেতে থাকতো, আর সে মা হয়ে দূরছাই করে তাড়িয়ে দিতো। দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যেত, উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করতো। পালাতে চাইতো, মারতে চাইতো স্বামী আর সন্তানদের। কিন্তু স্বামী নামক কুলা’ঙ্গার তাকে আটকে রাখতো, আটকে রাখতো ঘরে। গায়ের জোরে তাকে থামাতো। তেজ কমাতো। অবশ্য সে যে কম বিকারগ্রস্ত ছিল, তা নয়। আগেরবার তো অবৈ’ধ ট্যাগে বাচ্চা এনেছিল, এবার তার কাছে বৈধ ট্যাগ আছে। লালসা সামলাতে পারেনি কখনো মেয়েটার উপর থেকে। যার ফলে আরো দু, দু’বার গর্ভবতী হয়। এমিলি ইয়াসমিন বুঝে যায় তার জীবনটা এমনিতেই চলতে থাকবে, কেউ নরক থেকে তাকে রক্ষা করতে আসবে না। ছোটপুত্রের জন্মের বছর পাঁচেক পর একদিন তাদের মায়ের স্নেহ থেকে চিরজীবনের মতো বঞ্চিতের ট্যাগ দিয়ে ছাদ থেকে পড়ে নিজের কলঙ্কিত জীবনের ইতি টেনেছিল…সাতাশ বছরের এমিলি ইয়াসমিন।
যার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল আজিজ শেখ নামক কুলাঙ্গারের ছত্রছায়ায়। কিন্তু তার সন্তানরা আজও সেই ন’ষ্ট, লালসাবাজ অমানুষের রক্ত বহন করছে। তাদের জন্যই তাদের মায়ের জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল। বল, এগুলো শুনলে লোকে ঘৃণা করবে না? হাসবে না?
সৃজা, এই সত্যি আমি, আমরা কখনো কাউকে বলিনি। তোকেও বলতে পারব না। তাই এই চিঠি লিখলাম। তুই কি আমাদেরও হেলা করবি? ভালোবাসা বন্ধ করে দিবি? অবশ্য নষ্টদের কি কেউ ভালোবাসে?
এটুকু কাগজে লিখে থামল ইহসান। এরপর একবার নয়, বারবার পড়ল চিঠিটা। কিন্তু সবকিছু তার কাছে অগোছালো মনে হলো। কাটাকুটি করে আবারো সাজিয়ে লিখল। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না। ভেতরটা হাঁসফাঁস লাগল, হতাশায় নিমজ্জিত হলো। এসব জানলে সৃজা ঘৃণা করবে সত্যিই ওকে। নাহ! এসব সে সৃজাকে বলতে যেমন পারবে না, তেমনি লিখেও জানাতে পারবে না। বিশ্বাস হয় না, তবুও মনে উঁকি দেয়… সৃজা ঘৃণা করবে ওকে। ওর থেকে দূরে চলে যাবে! ইহসান ঘড়ির দিকে তাকালো। কাঁটা ঘুরছে এগারোটার আশেপাশে। সৃজার খবর নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় স্থির বসে থেকে এরপর নিজের অন্য একটা সচল নাম্বার থেকে ইজহানের বেডরুমের ল্যান্ডলাইনে ফোন দিলে ধরল ইজহান। ধরেই হেঁড়ে গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ইহসান আশা করেছিল ফোনটা ইস্মি ধরবে। কিন্তু তা হয়নি দেখে সে নিরাশ হলো। কাঠ গলায় জবাব দিলো, “আমি!”
ইহসানের গলা শুনে বেজায় চমকাল ইজহান। কিছুটা সময় পর ধাতস্থ হওয়ার পর অবাক হওয়া ভুলে সে নড়েচড়ে বসল। খোঁচা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তা হাতছাড়া করল না। গা জ্বালানো হাসি হেসে বলল, “তা রেস্টুরেন্ট ওউনারের ফোনটা কি ভুল রাস্তায় ব্রেক কষে এখানে চলে এসেছে? হুম?”
আজেবাজে কথা শুনে ইহসান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তোকে ফোন করিনি, ফোনটা… ইস্মিকে দে।”
ইজহানের মুখ শক্ত হয়ে গেল। কেন? এই ভেড়া কেন কথা বলতে চায় ইস্মিতার সাথে? ওর সন্দেহ হলো। ঘুমন্ত ইস্মির দিকে দৃষ্টি তাক করে সে কাঠখোট্টা গলায় বলল, “আমার বউকে কী বলতে চাস তুই? গোপন কথা নাকি কোনো কুবুদ্ধি? শোন, ইস্মি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমাদের বাবু আসছে। আমরা এখন ভালোয় ভালোয় সংসার করছি। ঝামেলা লাগানো অত সহজ না। তাই যা বলার আমাকেই বল, ওকে নয়! দেখি কী বলবি…”
ইজহানের উল্টোপাল্টা কথায় মহা বিরক্ত হলো ইহসান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোর পাছায় লাথি মেরে যেন চলে যায়, এটাই বলব!”
“মুখ সামলে কথা বল!”
গর্জে উঠল ইহসান, “ইস্মিকে ফোনটা দে!”
“ও ঘুমাচ্ছে, আমি ওকে ডেকে ঘুম নষ্ট করতে পারব না। তোর কি দরকার বললে বল, নয়তো ভাগ!”
ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সৃজার খোঁজ এনে দে, কী করছে ও?”
ইজহান বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল,
“আমি কোথা থেকে খোঁজ এনে দেব? অবশ্য খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই। তোর বউ বাড়িতেই আছে, ঘরে আছে! তোর জন্য অযথা দুশ্চিন্তা করে ভেবে মরছে—এমন ভাবার দরকার নেই, এখনো এতটা হনুও হয়ে যাসনি। আমি তো এতদিন মেয়েটাকে উল্লুক ভেবে এসেছিলাম, এখন দেখছি অতো খারাপও নয়।
ঠিকই আছে। কিন্তু তোর মতো শয়তানের গলায় ঝুলে বেচারির এই দশা হয়েছে।”
“বেচারি কাকে বলছিস? আমি এখনো বেঁচে আছি।”
ইহসানের কর্কশ কণ্ঠ শুনে ইজহান ফোনের ওপাশে মুখ বাঁকালো। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই গলার স্বর নামিয়ে বলল, “এই! তোর বউ মায়ের ছবিতে হাত দিয়েছে বলে তুই নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিস? কেন বল তো? বউয়ের ভয়ে, নাকি তার চোপা নিতে না পেরে? ভালোই নাটক জানিস তো!”
ইহসানের মেজাজ মুহূর্তেই চড়ে গেল। “মজা নিচ্ছিস? নিজের দশা কী হবে, সেটা ভুলে গেছিস? মায়ের ব্যাপারটা জানাজানি হলে ইস্মি তখনো তোর পাশে থাকবে তো? ওকে বলে দিয়েছিস নাকি, তোর বাপ একজন রে’পি’স্ট, তোর মা ভিকটিম, আর আমরা সেই রে’পি’স্টের অবৈধ ডিএনএ! আর যাকে সবাই আমাদের মা ভাবে, সে আসলে আমাদের মা-ই নয়, আজিজ শেখের দ্বিতীয় স্ত্রী! বলেছিস এসব? নাকি এখনো মুখ বন্ধ রেখেছিস? অ্যাসহোল!”
একগাদা কথা শুনিয়ে ইহসান ফোন রেখে রাগে, বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বসে রইল। এই ইজহানটাকে চড়িয়ে গাল লাল করতে পারলে তার শান্তি লাগত! ওকে এসেছে ভড়কাতে, নিজেও যে একই পথের সঙ্গী ভুলে গেছে! ইহসান বিরক্তির শ্বাস ফেলে মাথা চেপে ধরল। লুজারটা দিলো না তো ফোনটা ইস্মিকে, এখন কোথায়, কার কাছ থেকে সে সৃজার খোঁজ জানবে? বাড়ি ফিরতে তো আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন! ইহসান যখন এসব ভাবনার দোলাচালে জর্জরিত, তখনই আবার ফোনটা বেজে উঠল। ভ্রু কুঁচকে ইহসান ফোনটা কানে তুলল। রাগ মিশ্রিত স্বরে বলল, “বিরক্ত করছিস কেন? তোর…”
ওপাশ থেকে নম্র ও উত্তেজিত নারী কণ্ঠ ভেসে এল, “ভাইয়া, আমি ইস্মিতা। আপনি কোথায়? জানি ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো উচিত না, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি… এভাবে হুট করে কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়ে বসে আছেন? সৃজা কতটা চিন্তায় আছে, কত জায়গায় খোঁজ করছে জানেন আপনি? ফোনটাও বন্ধ রেখে কষ্ট দিচ্ছেন মেয়েটাকে, এসব কী মানায় আপনাকে? আপনি তো দেখছি আপনার ভাইয়ের মতোই যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করেছেন!”
ইহসান ইস্মির সব কথা শুনল চুপ করে। জবাব কী দেবে এত প্রশ্নের তা ভেবে পেল না। আসলেই সে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করছে। কেন করছে, সে জানে না! রাগ জড়িয়ে রেখেছে ওটাই শুধু জানে। সৃজা না বলে কেন ধরল সেদিন ছবিটায়? এরপরে এত এত প্রশ্ন জুড়ল! এতেই তো সবকিছু হয়েছে, নয়তো কী ইহসান এমন করত? গায়ে হাত তুলত? যন্ত্রণা সৃজা একা পাচ্ছে? নিজেও সে যন্ত্রণা ভোগ করছে। কীভাবে সৃজার মুখোমুখি হবে তা নিয়েও দোটানায় ভুগছে! নিজের বাচ্চামি আচরণে সে নিজেই বিরক্ত, অথচ ইহসান এসব কিছু ইস্মিকে বলল না। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “সৃজাকে একটু দেখে আসুন তো, ঠিক আছে কি না!”
ইস্মি এ কথায় বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “ওর কী হবে?”
“রাগ করে নাকি রশিদকে কীসব উল্টাপাল্টা বলেছে। তাই…”
ইস্মি চিন্তিত হয়ে গেল, “ফোনটা আপনি সৃজাকে করলেই পারতেন। রাগ-অভিমান মিটে যেত! যাইহোক, আমি দেখে আসছি!’’
“ওকে।”
এদিকে বারান্দায় গিয়ে ইজহান বিড়বিড় করে গালাগাল করছিল ইহসানকে, যা কানে আসছিল ইস্মির। ইস্মি কিছুই বুঝতে না পেরে ফোন রাখার আগে ইহসানকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনার ভাইকে কী বলেছেন যে সে এত গজগজ করছে অহেতুক?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “অনেক কিছুই বলেছি, আপনার সেসব জানা উচিত হবে না। অবশ্য না জানলেও চলবে। আপাতত সৃজার খোঁজটা এনে দিন আমাকে।”
ইস্মি কথার আগা-গোড়া কিছুই বুঝতে পারল না। তবে সৃজার ঘরে যেতে যেতে আন্দাজ করল কিছুটা! দু’ভাইয়ের কেউই এ ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না। অথচ সৃজার সাথে সাথে ইস্মিও জেনে গেছে ওদের মায়ের ব্যাপারটা! ইস্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সৃজার ঘরে গিয়ে ওকে ইহসানের ফোন করার ব্যাপারটা জানাতেই সৃজা কষ্ট নিয়েই হেসে ফেলল। ইস্মি ওকে হাসতে দেখে ভড়কে গেল, “হাসছ যে?”
“তোমার ভাইয়ার নাটক দেখে।”
“নাটক?”
ইস্মির ভড়কানো কণ্ঠস্বর শুনে সৃজা গম্ভীর গলায় বলল, “নাটক নয়তো কী? ফোনটা আমাকে না করে তোমাকে করেছে! কত বড় খারাপ লোক দেখেছ? এতদিন ধরে তার খোঁজ পেতে মরিয়া আমি, অথচ ফোন করল কাকে? তোমাকে! শোনো ভাবি, তোমাকে যদি এই লোক আবার ফোন করে, তাহলে তুমি ফোন ধরবে না। আর যদিও ধরো, তাহলে বলে দিও তুমি কোনো খবর দিতে পারবে না।”
ঘরে ফিরে ইস্মি ঠিক সৃজার কথামতোই কাজ করল। ওদিকে ইহসান ইস্মির এমন কড়া কথা শুনে কিছুক্ষণ থমকে গেল। হজম করতে কষ্ট হলো ওর ব্যপারটা!
.
_____
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে.….
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩৮
মায়ের মৃত্যুর সময় ইনজানের বয়স ছিল পাঁচ। ছোট, অবোধ শিশু। মায়ের মৃত্যুতে তারই বেশি কাঁদার কথা থাকলেও সে কাঁদেনি। বরংচ খুশি হয়েছিল। সবাইকে বলছিলও তা, তাকে না ভালোবাসা, আদর না করা, তাকে চড় মারা মহিলাটা মরে গেছে এতে সে খুশি। এই খুশিতেই সে দিন সাতেক নাচানাচি, দাপাদাপি থামাতে পারেনি। ছোট ভাইয়ের ঔদ্ধত্যপনা নয় বছরের ইহসানের সেবার পছন্দ হয়নি, ইজহানেরও নয়। কারণ মা তাদের ভালো না বাসলেও তারা মাকে ভীষণ ভালোবাসতো। তাই মায়ের মৃত্যুতে ইনজানের উৎফুল্লতা প্রকাশ করাটা ওরা ভালোভাবে নেয়নি। দু’জনেই ইনজানের উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে বেশ মেরেছিল সেদিন ওকে। মেরে ঠোঁট কেটে দিয়েছিল। আজিজ শেখ আটকেছিল ওদের। ইহসান তাকেও ধাক্কা দিয়েছিল! তবে এরপর হঠাৎই একদিন বিকেলে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ইনজানকে খুঁজে পায় ছাদের চিলেকোঠায়, যেখানে মায়ের ছবি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছিল। ডাকতেই ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “মরে যাওয়া মানে কী লুকিয়ে থাকা? মা এতদিন ধরে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছে? মায়ের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।”
ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে তার প্রতি একটু রাগ কমিয়েছিল ইহসান। তবে আজিজ শেখ ছেলেকে বুঝিয়েছিল, মায়েরা মরে যায় না, দূর আকাশের তারা হয়ে যায়। তার মাও তারা হয়ে গেছে। আকাশ থেকে তাদের দেখছে। এখন থেকে সেখানেই থাকবে। ইনজান খুশি হয়েছিল। সত্যিই বিশ্বাস করেছিল মা তারা হয়ে ওদের দেখছে! সে এরপর থেকে তারাদের সাথেই কথা বলতো, জিজ্ঞেস করতো মায়ের কথা। কিন্তু কোনো উত্তর পেতো না। তখন তার আবার রাগ হতো। চিৎকার, কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় করতো, জিনিসপত্র ভাঙচুর করতো। আজিজ শেখ কিছুই বলতেন না। ছেলেকে ছেলের কাজ করতে দিতেন, এভাবেই যদি শান্তি পায় তো পাক! তার কী টাকার অভাব? ছেলেরা নিজের দুঃখ পূরণে যদি সবকিছু ভেঙে ফেলে তাহলে তিনি আবার নতুন করে সব কিনবেন। এভাবে শাসন, বারণহীন বড় হতে গিয়ে দেখা গেল তার ছেলেগুলো বড়োই বেপরোয়া হয়ে গেছে। যাক তবে, বেপরোয়াই ভালো। হাঁদারাম তিনি নিজেও নন, ছেলেগুলোকেও বানাতে চান না। সেই…পনেরো পেরোতেই ইনজান যতটুকু বিপথে পা বাড়ানো যায়, বাড়িয়েছিল! ম-দ, গাঁ-জা, সিগারেট….এমন করতে করতে ড্রা’গে আসক্ত! অপরিণত বয়সেই রাস্তায় বাপের গাড়ি নিয়ে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে বেপরোয়া গতিতে রাস্তায় ছুটানো, ইভটিজিং থেকে শুরু করে এহেন কোনো অপকর্ম নেই যাতে সে নিজেকে জড়ায়নি। দু’দিন পরপর নতুন নতুন গার্লফ্রেন্ড বানানো, এরপর তাদের ব্যবহার করে, মেরেধরে একাকার করে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলা! সব ঝামেলা সামলাতেন আজিজ শেখই, তবে পুত্রকে মানা করতেন না। বয়সটাই তো এমন, এ বয়সে একটু-আধটু এরকম হয়ই! তবে সেইবার একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট আর এক নেতার ছেলেকে মেরে, ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়ার পর যখন বড়সড় ঝামেলায় পড়েছিল…তখন একটু টনক নড়েছিল আজিজ শেখের। বড় পদের লোকজন ধরে, টাকাপয়সা দিয়ে ঝামেলা
মিটিয়ে ছেলের নামটা সবার সামনে প্রকাশ্যে আনা থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। এরপরই পড়াশোনার অজুহাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেশের বাইরে, লণ্ডনে! তবে সেখান থেকে ইনজান আবার শিফট করেছিল প্যারিস শহরে। এতটা বছর সে ওখানেই ছিল। বাড়ির সাথে যোগাযোগ বন্ধ ছিল, শুধু ইহসানকেই ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতো মাঝেমধ্যে। আর আজিজ শেখকে তার কোনো বিশেষ
দিনে ফোন দিয়ে কংগ্রেচুয়েট করতো!
ইজহান এসবে গা করতো না, মাথাব্যথাও বেশি ছিল না ছোট ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে। তবে ইহসান খানিক মাথা ঘামাতো, ঘামাতেই হতো! কারণ মায়ের প্রতি মাঝেমাঝে অভিযোগের পসরা সাজিয়ে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতো ইনজান। আর মাকে নিয়ে একটা বাজে অক্ষরও ইহসান নিতে পারতো না। তাই ইনজানের প্রতি বিক্ষিপ্ত আচরণ করতো। মারও দিতো। এটাকে মজা ভেবে নিয়ে ভাইয়ের পেছনে লাগতো ইনজান সবসময়। সেই থেকে ইনজান ইহসানের বই, খাতা, কলম থেকে শুরু করে পছন্দের খাবার এমনকি জামাকাপড়ে পর্যন্ত ভাগ বসাতো। বিরক্ত হলেও স্বাভাবিকভাবে নিতো ইহসান। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল সবকিছুতেই ইনজান বেশি বেশি! তার যে জিনিস পছন্দ, সেটাতে ইনজানেরও একটা সূক্ষ্ম নজর সবসময় বিদ্যমান। ছোটভাইয়ের স্বভাব-চরিত্র জানা আছে বলেই সে কিছুতেই চায় না সৃজার আশেপাশে থাকুক ইনজান। একেই তো চরিত্রহীন, তার উপর ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলছে। সৃজাকে ওমন নজরে দেখবে ভাবলেই ওর রাগে ভাইয়ের চোখ গেলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভ্রাতৃত্বের টানেই ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও সে গুরুতর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ইহসান চোখমুখ শক্ত করে গিয়ে আজিজ শেখকে বলল, “ওকে যদি বাড়িতে দেখি তাহলে হাতদুটোও ভেঙ্গে দেব।”
নিজের এতবড় বাড়ি থাকতেও ছোট ছেলে
এই ফ্ল্যাটে থাকবে এই বিষয়টা একদমই মানতে পারলেন না আজিজ শেখ। তিনি ঠিক করলেন ইনজানকে এখান থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। সেখানে সালেহা বেগম ওর সেবাযত্ন করবে, মকবুল করবে। দরকার হলে আরো কাজের লোক রাখবে ছেলের দেখাশোনা করার জন্য। ইহসানের আপত্তিতে তাই খ্যাঁকিয়ে উঠেন আজিজ শেখ, “বাড়াবাড়ি কইরো না ইহসান, ও তোমার ভাই লাগে।”
“তাই তো কিছু করছি না। কিন্তু সৃজা…”
আজিজ শেখ বাঁকা গলায় চেঁচিয়ে উঠেন, “ওইডা তোমার দেখার বিষয়। ও ঐ মেয়েরে পছন্দ করে এইডা নিশ্চয় তুমি জানতা, তো ভাইয়ের জন্য স্যাক্রিফাইস করতা, জানোই তো ও একটু অবুঝ, পাগলপনা বেশি…”
“কোথায় ওকে বোঝাবেন, তা না করে আরো আস্কারা দিচ্ছেন? ছেলেদের এমন কুশাসনে বড় করে অবুঝের ট্যাগ দিতে লজ্জা করে না?”
“বাপ হইলে বুঝবা।”
“ওমন কু-বাপ হতেও চাই না।”
“ইহসান, মুখ সামলাও।”
আজিজ শেখের রাগান্বিত কণ্ঠে কপালের শিরা ফুলে উঠে ইহসানের। গলার স্বরে নেমে আসে নিদারুণ ক্রোধ, “স্যাক্রিফাইসের কথাটা কেন এলো তাহলে? হুম? আমি আপনার মতো একজন কুলাঙ্গারের অবাধ্য তাই? আপনার মতো তথাকথিত কলুষিত এখনো হতে পারিনি সেজন্য আমাকে খুব সাধু ভাবছেন? ভাবছেন আপনি বললেই আপনার কথামতো চলব? লিথুকে লোভে পড়ে বিয়ে করে ফেলব? সৃজাকে ছেড়ে দেব? আবার আপনার ছোট ছেলের জন্য ওকে স্যাক্রিফাইসও করব? জি না, এত সাধু হতে পারিনি।”
আজিজ শেখ কিছু না বলে বিক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকান। আসলেও তাই! ইহসান তার কথা অনুসারে জীবনে কোনোদিন চলেনি। চলেছে নিজের মর্জি মতো। চলাফেরা করেছে ভালো-খারাপ সব ধরনের মানুষের সাথেও। তাতে যদিও বিপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু যায়নি। সেজন্যই আজিজ শেখ কিঞ্চিৎ ভেবে এসেছেন, তার অন্য ছেলেদের চেয়ে ইহসান একটু বুঝদার, অন্য সময় অবাধ্য হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে সে নিশ্চয় বাপের কথা শুনবে। কিন্তু না, বরাবরের মতোই তিনি ভুল ছিলেন!
নিজের ভাবনা পরাজয়ের পর থেকেই তিনি তাই বিপর্যস্ত! এ পর্যায়ে এসে শক্ত গলায় বলেন, “কাজ, কথা কোনোটাই ভালো না তোমার।”
“আমি এমনই।”
“ইনজান ছোট, বোঝা উচিৎ তোমার।”
“আমি বড়, আমার স্ত্রী ওর বড় ভাবি, মায়ের চোখে দেখা উচিত। এটা ওরও বোঝা উচিৎ। অবশ্য জীবনে শিক্ষা দিলে তো বুঝবে, যার বাপ একজন রে’পিস্ট তার ছেলের থেকে এরচেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়?”
আজিজ শেখ ক্রোধ সামলাতে না পেরে উঠে এসে চড় বসিয়ে দেন ওর গালে। ইহসানও কম যায় না। সে হাত মুচড়ে ফেলল আজিজ শেখের। রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলল, “এই থাপ্পড়টা নিজের গালে বসান। আমি দেখি, তিরিশ বছরে একটুখানি অনুতাপ ছুঁতে পেরেছে কি-না আপনাকে!”
“অনুতাপ, অনুশোচনা তোমার আব্বার আসে না।”
“আমারও দয়া আসে না আপনার প্রতি!”
কথাটা হসান ঘৃণা ভরে তাচ্ছিল্যপূর্ণ গলায় বলল।এরপর ইনজানকে যেন বাড়িতে না দেখে এটা নিয়ে আবারও সাবধান করল আজিজ শেখকে। ফলে দু’জনের মধ্যে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। ইহসান শেষ পর্যন্ত রেগে বের করে দিলো ফ্ল্যাট থেকে আজিজ শেখকে। এরপর তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে গেল ইনজানের রুমে। দেখল বিছানার হেডবোর্ডে হেলে বসে ল্যাপটপে গেইম খেলছে সে। তবে ইহসান নিশ্চিত এতক্ষণ ধরে তার আর আজিজ শেখের চলা বাকবিতন্ডতা সবই এই শয়’তানের কানে এসেছে। কিন্তু এখন ভাব ধরেছে সে দুনিয়ায় নেই! ইহসান বাঁকা হেসে, চোয়াল শক্ত করে গিয়ে ওর ভাঙ্গা পা চেপে ধরতেই ইনজান ল্যাপটপে নজর রেখেই ভারী স্বরে বলল, “পায়ের থেকে বুকে বেশি ব্যথা দিচ্ছ!”
“কেটে দেখব?”
“খু-নের পরিকল্পনা করছ নাকি?”
“চুনোপুঁটি মেরে হাত নষ্ট করি না।”
ইনজান বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলে উঠে, “হেই ব্রো! তুমি ভুলে গেছ, আমি রাঘববোয়াল, চুনোপুঁটি না! আমার চুনোপুঁটিদের আমারই মতো পঙ্গু করে দিয়েছ তুমি! তবে আমি কিন্তু বেশ কষ্ট পেয়েছি তুমি আমার বিশ্বস্ত গুপ্তচরটাকে লুলা করে দিয়েছ, তাই। ”
ইহসান ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, “পাঠা দিয়ে চরগিরি করবি, ঝোপে লুকিয়ে আমার বউয়ের উপর নজর রাখবি, ভয় দেখাবি, গিফট পাঠাবি, ফুল, চিঠি পাঠাবি আর আমি টের পাব না? তোকে আর তোর ডাকু চরকে যদি কেটে পিসপিস করতাম তাহলে শান্তি পেতাম।”
ইনজান হেসে উঠল উচ্চস্বরে, “শান্তির জন্য সব জায়েজ, করে ফেলো।”
ইহসান ওর কপাল থেকে গাল অবধি আঙুল টেনে ভারী স্বরে বলল, “যদি তোর মুখটা মায়ের মতো না হতো…”
ইনজান কুটিল হেসে বলল, “ধুর, ঐ মহিলার মতো হয়ে দেখি বিরাট সমস্যায় পড়ে গেলাম! ভালোবাসার জন্য খু-ন হতে গিয়েও হচ্ছি না। আমার কী নিজেই আত্ম’হুতি দেওয়া উচিৎ?”
ইহসান চোখেমুখে কঠোরতার বীজ বপন একহাতে ওর চুল টেনে মুখটা নিচু করে চেপে ধরল। অন্যহাতে পেটে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বলল, “ভালোবাসা মানে তোর কাছে কী, বল তো হা’রা’মজাদা।”
ইনজান ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠল ঠিকই, তবে আর্তনাদের স্বর লুকিয়ে বলল, “যাকে একবার চোখে লাগে, তাকে পাওয়া।”
“ধর, সৃজা বাদে অন্য কেউ তোর চোখে লেগে গেল, তাহলে?”
“তাহলে তাকেও চাইব।”
“মর তুই!”
.
ম্যাট্রেসে শুয়ে গা ব্যথা হয়ে গেছে ইহসানের। মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে তার মেজাজও খারাপ। একেই তো একশো বিপদ, তার উপর ইনজানের যন্ত্রণা, ইস্মির কড়া কথা বলে ফোন রাখা, রশিদের কাছেও নিশ্চয় সৃজা আর ফোন দেবে না। তাহলে মেয়েটার খবর পাবে সে কোথায়? আচ্ছা, আর কতদিন সে এমন অবুঝপনা করবে? একটা সময় তো ফিরতেই হবে। তাহলে অহেতুক কেন কষ্ট বাড়াচ্ছে? ধুর! চুলোয় যাক এসব রাগাভিমানের খেলা। সে বাড়ি ফিরবে এক্ষণি! এমন অস্বস্তি আর শূন্যতায় আর একটা দিন কাটলে সে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে! চারটা বাজার একটু আগেই ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে রশিদের উপর ইনজানের দায়িত্ব দিয়ে ইহসান বেরিয়ে পড়ল অশান্ত মনে শান্তির ছিঁটেফোঁটা পাওয়ার জন্য!
কুয়াশাজড়ানো নরম হাওয়ায় দুলছে প্রকৃতি। নিঃস্তব্ধতার ভিড় ঠেলে আঁধার সরেনি চারপাশ থেকে এখনো। মন কেমন করা বিবর্ণ ভোর। ঠকঠক শব্দ তুলে দরজায় টোকা পড়ল ঠিক এ অসময়টাতেই। চোখ লেগে আসা কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেল নিমিষেই সৃজার। হকচকিয়ে উঠল ও। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল আসলেই দরজায় শব্দ হচ্ছে না-কি ভুল শুনছে! সে একা—এইঘরে! ইহসান নেই। বাড়িতে তো সবাই ঘুমাচ্ছে। এই অসময়ে কে আসবে? কিছুটা ভয় হলো সৃজার। দরজা না খুলেই বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে উঠে বসল। ফোনটা হাতের কাছে রাখতেই তখনি আবার টোকা পড়ল। সৃজা ঢোক গিলল দু’বার। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না৷ এদিকে দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ ব্যক্তি ধৈর্যহারা হয়ে আস্তে কিন্তু একনাগাড়ে শব্দ করেই যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলানোর নিমিত্তে সাহস সঞ্চয় করে সৃজা বলে উঠল কাঁপা গলায়, “কে?”
“খুল।”
অস্বস্তি আর ভীতি নিয়ে বসে থাকা সৃজা চমকে গেল। এটা তো ইহসানের গলা। এই লোক এখানে কী করছে? কখন ফিরেছে? আদৌ ফিরেছে? কেন যেন ওর বিশ্বাস হলো না৷ তাই আবারও সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আমি।”
কয়েক সেকেন্ড থমকে রইল সৃজা। বিশ্বাস হচ্ছে না ইহসান ফিরেছে! তৃতীয়বারের মতোন আকাঙ্খিত পুরুষটির কণ্ঠস্বর শুনে সৃজার মনে হলো বুক থেকে পাথর নেমে গেছে। আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ও ফুঁস করে ছাড়ল। গাল মুছে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দরজার সিঁটকিনিতে হাত রাখতে গিয়ে ঠিক করল ফিরেছে তো ফিরুক! এই পাষন্ড লোকের কাছে সে কিছুতেই নিজের গদগদ ভাব আর প্রকাশ করবে না। কী ভেবেছে সে? সৃজা মূল্যহীন? যা খুশি তাই করা যায় ওর সঙ্গে? সময়ে আদর করবে আবার সময়ে ছুঁড়েও ফেলবে? অনাকাঙ্খিত কান্ডের জন্য গায়ে হাত তুলবে এরপর নিজেই রাগ করবে? কিছু না বলে লাপাত্তা হয়ে যাবে? কোনো খোঁজ না রেখে, না দিয়ে দিব্যি যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে? অন্যদের কাছে ওকে দোষী সাব্যস্ত করবে? উহু! সৃজা অতোটাও সস্তা হবে না। নিজেকে সামলে চোখেমুখে কাঠিন্যতা নামিয়ে সৃজা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দিয়ে অবশ্য দাঁড়াল না ওখানে। ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও তাকালও না এক সেকেন্ডের জন্য, সরে এলো! ঘরে প্রবেশ করেই তৃষ্ণার্ত চোখে একপলক ইহসান দেখল সৃজাকে। দেখেই সে শান্ত হলো। যাক বাবা! রশিদের কথামতো উল্টাপাল্টা কিছু দেখতে হয়নি তাকে। কিন্তু মেয়েটা এমন মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওর কি মন ভালো নেই? অবশ্য থাকবেই বা কী করে? একে তো থাপ্পড় দিয়েছিল সেদিন, তার উপর কয়েকটা দিন বড্ড চিন্তায় রেখেছে মেয়েটাকে সে এতদিন! সে কথা মনে পড়তেই ইহসানের অস্বস্তি লাগল বেশ। বাইরের নিভে আসা অন্ধকার, নিঃস্তব্ধতা সব মিলিয়ে অস্বস্তিতে সে গাঁট হয়ে যাচ্ছিল। ইহসান সোফায় বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা খাকারি দিয়ে সৃজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ঘুমাচ্ছিলি?”
“শুয়েছিলাম।”
“ডিস্টার্ব করে ফেললাম মনে হচ্ছে?”
কথাটা শুনে সৃজা চোখ তুলে তাকাল ইহসানের দিকে। সেই চোখের ভাষায় তীব্র ব্যাকুলতা আছে ঠিকই কিন্তু বিরক্তিও আছে। সৃজার বলতে ইচ্ছে করল, ‘ডিস্টার্ব তো অবশ্যই করেছ তুমি, কিন্তু তারচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছ। মন বিষিয়ে দিয়েছ। আমি তোমাকে এরজন্য একটা শিক্ষা দেবই।’ কথাগুলো মনে আওড়ে নিয়ে সৃজা বিড়বিড় করল। ইহসান আবারও একই প্রশ্ন করলে সৃজা অন্যমনস্ক গলায় বলল, “না।”
ইহসানের মনে পুলক জাগলো। সৃজা কি তাহলে ওর অপেক্ষা করছিল? তার মতোই রাত জেগেছিল? মিস করছিল ওকে ওর মতোই? ও উৎফুল্ল মনে ইতস্তত স্বরে বলল, “সত্যিই জেগে ছিলি?”
“জাগা বারণ নাকি?”
সৃজার কাঠ স্বর, শুনে হকচকাল ইহসান। হাসার প্রচেষ্টা করে বলল, “তা নয়, কিন্তু কেন?”
সৃজা ভাবলেশহীন কণ্ঠে বিছানায় চাদর সরাতে সরাতে জবাব দিলো, “মুভি দেখছিলাম।”
ইহসান অপ্রত্যাশিত জবাব পেয়ে বড়বড় চোখ করে চাইল ওর দিকে। এই মেয়ে বলছে কী? এতক্ষণ মুভি দেখছিল? এই, এত রাত অবধি! তাও আবার ওর অনুপস্থিতিতে! সে কপাল কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। চারটা বেজে ঊনপঞ্চাশ মিনিট। ভোর হতে শুরু করেছে। একটা রাত মেয়েটা মুভি দেখে কাটিয়ে দিলো অথচ সে আশা করল সৃজা এতক্ষণ ওর জন্য না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছে! মনে মনে বেজায় রাগ হলো ওর। তবে তা বাইরে প্রকাশ করল না। মোজা গুলো ছুঁড়ে ফেলে পায়ে স্যাণ্ডেল চাপিয়ে সে ফ্রেশ হতে গেল। ও যেতেই সৃজা এতক্ষণের আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে, টুকটাক কাজ গুছিয়ে সুন্দর করে গায়ে চাদর টেনে একপাশে শুয়ে পড়ল! ফ্রেশ হয়ে এসে ইহসান আবার ধাক্কা খেল যখন দেখল সৃজা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করেনি! ভেবেছিল মেয়েটার সাথে দু’টো কথা বলবে, অথচ, অথচ!! ইহসান মুখ কালো করে ফেলল সৃজার আচরণ দেখে। বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে টেবিলের কাছে গেলেই চোখে পড়ল শুকনো খাবার আর পানির উপর। দেখেই এতক্ষণে গরম হয়ে যাওয়া মেজাজটা ঠান্ডা হলো ওর। মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। যাক! এই অভদ্র মেয়েটাকে এরজন্য ক্ষমা করে দেওয়াই যায়! সে তড়িঘড়ি করে দু’টো ড্রাই কেক আর পানি পেটে চালান করে সৃজার পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ওকে বুকে টেনে নিলো। বুকে চেপেই শান্তি হলো। এই ক’দিনে সে ঘুমাতে পারেনি এই মেয়েটার জন্য! একটা সৃজার নিদারুণ শূন্যতায় ভুগেছে সে। এখন বুকটা ভরা ভরা লাগছে। ইহসান সৃজাকে দু’হাতে আলতো করে জড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। চুলে নাক ঘঁষলো। মিষ্টি ঘ্রাণে চোখদুটো বুজে এলো। তবে মিনিটখানেক পরই সৃজা নড়চড় শুরু করল, এপাশ-ওপাশ করার বাহানায় সন্তপর্ণে ওর হাতের বাঁধন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুলো। ইহসান অবাক হয়ে মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “হলোটা কী?”
সৃজা ঠিকঠাক করে শুতে শুতে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “ঘুমাতে পারছি না।”
“কিন্তু তুই তো এভাবেই ঘুমাস। এখন…”
“এখন আর ঘুমাই না।”
সৃজা মন্থর কণ্ঠে ছোট্ট করে উত্তর দিলো। ইহসান বিস্মিত হয়ে গেল৷ আগের মতো ঘুমায় না? ঘুমায় না মানে? অভ্যাস পালটে ফেলছে এই মেয়ে? ইহসান রাগ চাপা গলায় শান্ত স্বরে বলল, “কেন?”
প্রশ্ন করে ইহসান কান খাড়া করে রইল কিছু শোনার জন্য, কিন্তু উত্তর শোনার বদলে সে সৃজার গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পেল। ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা! ইহসান বালিশে ধপ করে মাথা রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কী হলো ব্যাপারটা, সৃজা কি ওকে এড়িয়ে গেল?
.
________
[রি-চেইক বিহীন পর্ব। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…