অশ্রুবন্দি পর্ব-৪৮+৪৯

0
5

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৮ [ক]

প্রতিবারই মনোমালিন্যের পর এমন কখনোই হয়নি
যে ইস্মি ইজহানের কথা বলা বন্ধ ছিল! কিন্তু সেদিনের রাগারাগির পর আজ নিয়ে দুইদিন, ইজহানের খাওয়াদাওয়া, কথা বলা সব বন্ধ! প্রথমদিন ইস্মি রাগের বশে নিজেও কথা বলেনি, সামনেও আসেনি। কিন্তু এলিজার থেকে যখন শুনলো ইজহান কিছুই খাচ্ছে না, জোর করেও কেউ একদানা ভাত ওকে খাওয়াতে পারেনি তখনি ওর টনক নড়ল। তবুও দুপুর পর্যন্ত আসেনি সাধাসাধি করতে। কিন্তু যে লোক একবেলা খাবার দেরিতে পেলেই হট্টগোল শুরু করে, মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়, পেটে ব্যথা শুরু হয়ে যায় সে নাকি সত্যিই আজ নিয়ে দু’দিন একেবারে না খাওয়া? রাগ-ক্ষোভ , অভিমান সব কোথায় গায়েব হয়ে গেল! সন্ধ্যার পর আর থাকতে পারল না ইস্মি। ইহসানকে দিয়ে ইজহানের সব পছন্দের বাজারসদাই আনালো। ভাইয়ের নাটকে ইহসান নিজেও বিরক্ত ছিল; কিন্তু সৃজার চোখ রাঙানির ভয়ে ‘টু’ শব্দটি করল না। এমনকি সৃজা কথা আদায় করে নিলো ইহসানের থেকে; অকারণে, অহেতুক ইজহানের উপর হাত চালাচালি করা যাবে না, মুখও খারাপ করা যাবে না। ইজহান যেসমস্ত কাণ্ড করে বেড়ায় তাতে
ধৈর্য টিকিয়ে রাখা দায়! চাইলেও সেটা পারা যায় না।
সৃজার কন্ডিশনে ইহসান বিপাকে পড়ল। তবুও কী আর করা! মহারাণীর কথা শিরধার্য বলে সে এসব অন্যায় আদেশ মেনে নিলো।

বাজারসদাই ও প্রয়োজনীয় উপকরাণাদি আনার পর শেফালি বুয়াকে নিয়ে ইস্মি নিজেই রান্না করতে গেছিল, কিন্তু নীলু ফুপি আর সৃজার জন্য পারেনি। ওকে বসিয়ে রেখে সৃজাই রান্নাঘরে ঢুকেছে, তবে ইহসান ওকে সাহায্য করেছে। রান্না শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভাতের থালা নিয়ে ঘরে ছুটে এসেছে ইস্মি। কিন্তু ওকে দেখেই ইজহান বিছানায় পাশ ফিরে যে শুয়েছে তো শুয়েছেই, উঠার লক্ষ্মণ নেই। বহুদিন পর কঠিন একদফা রাগারাগি হয়েছে ইজহানের সাথে ইস্মির। তাই অস্বস্তিটাও নেহাতই কম নয়। কে আগে কথা বলা শুরু করবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে দু’জনেই। ইস্মির যদিও বুক পুড়ছিল তবুও প্রথমেই একেবারে গদগদ আচরণ দেখাতে পারল না। রয়েসয়ে ঢোক গিলে বলল, “খাবার এনেছি, উঠুন।”

বলল ঠিকই, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া পেল না ইজহানের। ইস্মি হতাশ ও ভঙ্গুর চোখে তাকিয়ে রইল।তার হাতে ভাতের প্লেট। তাতে দেশি মুরগীর রোস্ট আর বাসমতি চালের ঝরঝরে সাদা ভাত। খাসির মাংস, এক টুকরো কাগজি
লেবু আর টকদই দিয়ে শশার একটা সালাদ, সঙ্গে বোরহানি। তরকারিতে একদম ঝাল দেওয়া হয়নি, হলুদও একটু। অন্যান্য মশলাও কম দেওয়া হয়েছে। ইজহানের পছন্দের সব রান্না। কিন্তু লোকটা দেখো, খাচ্ছে না। কথাও বলছে না। ইস্মির এবারে কান্নার মতো পেল। উঠে গিয়ে বিছানার ওপাশে বসলো। কিন্তু ওকে দেখেই বিদ্যুতের গতিতে অন্যপাশ ফিরে গেল ইজহান। ইস্মির প্রচন্ড রাগ বাড়লো এবারে। উঠে আবারও অন্যপাশটাতে গিয়ে বসলো। ইজহান আবারও এমন করলো, ইস্মিও…করতেই থাকলো এপাশ-ওপাশ! বিরক্ত হয়ে ইজহান একসময় উঠে পড়লো, বিছানা থেকে নেমে পায়ে স্যান্ডেল চাপিয়ে চলে গেল বারান্দায়, ঠাস করে দরজা আটকে ফুঁসতে শুরু করল। এসে বলে কি-না, ‘খাবার এনেছি, উঠুন!’ হুহ! এত কীসের ঠেকা তার ঐ মহিলার জন্য? এত প্রেম সে দেখাবে না। বেশি আদর দেয়, বেশি চোখে হারায় বলে এই মহিলা তাকে পেয়ে বসেছে। দু’দিন ধরে সে না খাওয়া, ক্ষিধে নিয়ে সে ভেতরে ভেতরে সে মরে যাচ্ছে অথচ এই মহিলা আজ তার পছন্দের রান্না নিয়ে সাধাসাধি করছে? কী মনে করে , সে খাদক? সারাদিন খাইখাই করে? খাইয়ে তাকে ভুলানো যায়?
ইস্মিতা কী ভেবেছে, এসব দেখলেই সে বউয়ের কঠোর আচরণ ভুলে যাবে? ওর পিত্তি ফেটে যাচ্ছে অথচ সে চুপ!
কেন চুপ? রাগে চুপ।

এদিকে ইস্মি বুঝতে পারছে না কীভাবে এই লোকের জেদ ছাড়াবে। এই ধুরন্ধর লোক কখনোই নিজের ভুল দোষ মেনে নেয় না, স্বীকারও করে না। তাকেই সবসময় নত হতে হয়। মানছে তারও ভুল আছে, কিন্তু সে কী জানতো ঐ ফেরিওয়ালা লোকটা তার দিকে চেয়ে আছে, দেখছে ওকে আপত্তিকর চোখে? জানতো তো না। ভালোভাবে বললে ইস্মি তো আর আবদার করতো না, বারান্দায় বসতোও না, কিন্তু ইজহান কী করল? ওকে সাবধান না করে উল্টো ওকেই দোষারোপ করল। টবটা যে ফেলল, যদি ঐ লোকের কিছু হতো? বড়সড় একটা ঝামেলা বাঁধতো না? বেড়াতে এসে এমন ঝুটঝামেলা কি ভালো লাগতো? নীলু ফুপি, এলিজার সামনে কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছে ইস্মি! অথচ লোকটা ওকে বোঝে না৷ ইস্মি বারান্দার জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলো। শব্দ শুনে ইজহান একটু তাকালেও চট করেই আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ইস্মি আড়চোখে তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “রাগ করে না খেয়ে থাকুন আপনি, আমিও না খেয়ে থাকব, ঔষধও নেব না৷ তখন যেন কেউ আমাকে কিছু বলতে না আসে৷ বললেও আমার কিছু যায়-আসবে না৷ আমিও মানুষ, আমারও জেদ আছে৷”

ইস্মি ভেবেছিল এসব বললে হয়তো ইজহান নরম হবে, বেরিয়ে আসবে। কিন্তু অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তার কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। এদিকে তারকারি সব ঠান্ডা হয়ে গেছে, ভাত শুকিয়ে খড়খড়৷ এই লোক যদি খেতে রাজিও হয় তবুও এই ঠান্ডা ভাত-তরকারি খাবে না। এতগুলো খাবার নষ্ট হবে; ইস্মি আর অপেক্ষা করল না, খাবে না বললেও বাচ্চার কথা চিন্তা করে ভাত-তরকারি সে নিজেই খেয়ে নিলো। খেয়েদেয়ে সব রেখে এসে দরজা আটকে আবারও জানালার কাছে গিয়ে বসল। চেয়ারে বসে রেলিংয়ে পা তুলে বসে আছে ইজহান। মাথাটা পেছনে হেলানো। একহাত দিয়ে চোখ ঢাকা। হাওয়ায় কপালে থাকা চুলগুলো উড়ছে। পরণের ট্রাউজার একটা কোনোমতে হাঁটুর নিচে আরেকটা টাখনুর কাছে গোটানো। কালো রঙের টি-শার্টের কলার একদিকে বাঁকা হয়ে আছে৷ ফর্সা মাংসপেশির একটু নিচে থাকা লাল রঙের তিলটা জ্বলজ্বল করছে। এত সুন্দর এই লোকটা, অথচ বিয়ের প্রথমদিকে যখন জবরদস্তি করে আদর করতে আসতো ইস্মির কাছে ওকে বীভৎস মনে হতো। আদর নেবে না বলে রাগে ওর পেশিতে কামড় বসিয়ে লাল করে দিতো। মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতো। কিন্তু আদর নামক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতো না। ইজহান যেমন আদর দিতো, তেমনি নিজেও আদর আদায় করে নিতো ইস্মির কাছ থেকে জোর করেই। আদর না করলে ব্ল্যাকমেইল করে করে আদর নিতো এই বর্বর লোক৷ সেসময়টাতে অসহ্য হয়ে কত ভাবতো, এই লোককে সে ছেড়ে গিয়ে উচিৎ শিক্ষা দেবেই। কিন্তু পরে গিয়ে আর পারলো না, সুযোগ পেয়েও না। বাঁধা পড়ে গেল এই লোকের সব বর্বরতা, আদর আর কঠিন পাগলামোতে। বাবা-ভাইয়া কত বোঝালো, এই পাগল একদিন তোকেই মেরে ফেলবে, ইস্মির তখন মনে হয়েছিল মরণটা এই লোকের হাতেই হোক, তবুও তার কাছ থেকে দূরে গিয়ে নয়। ও দূরে গেলে এই লোক তো নিজেই মরে যাবে৷ স্ত্রী হয়ে
স্বামীর মৃত্যুর কারণ কীভাবে হবে সে? এরচেয়ে ভালো নয়, সে নিজেই মরে যাক এই লোকের অবাধ্য ভালোবাসায়? ইস্মি জানালার গ্রিল গলিয়ে উদাসীন চোখে আকাশপানে তাকায়, মনে মনে কামনা করে এই অবুঝ লোক যাতে একটু বুঝের হয়, সুস্থির হয়! চোখ নামানোর সময় চন্দ্রালোকের দ্যুতিতে নিজের সুর্দশন স্বামীর রুপের বহর দেখে ইস্মি একটু থমকায়, ঠোঁটে হাসি খেলে। পরক্ষনেই থেমে ইজহানকে উদ্দেশ্য করে বলে, “দেখুন আপনার ভাগের খাবার আমি খেয়ে নিয়েছি৷ পরে ভুল ধরতে আসবেন না যেন, আপনাকে রেখে কেন খেয়েছি! আপনার মায়ের কথা চিন্তা করেই খেয়েছি। আপনি রাগ করেই থাকুন। বরং আরো বেশি করে রাগ করুন। এখনি সময় রাগ দেখানোর, পরে আর পাবেন না ইস্মিতাকে। যে সবসময় আপনার রাগের কারণ হয়, আর রাগ ভাঙ্গারও কারণ হয়।”

ইজহান সব শোনে, কিন্তু গোঁ ধরে বসেই থাকে। ইস্মি আরো কিছুক্ষণ বকবক করে, কিন্তু বিকারহীন স্বামীর প্রতিক্রিয়া লাভে ব্যর্থ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু শান্তি মিলে না তাতে। কীভাবে মিলবে? এই লোককে তো সে মনে জায়গা দিয়েছে। এখন মনে বসে জ্বালাচ্ছে! হঠাৎ কী মনে হতেই ইস্মি শোয়া থেকে একটু পরেই আবার উঠে যায়। ঘরের বাতিটা নিভিয়ে হলদে বেডসাইডটা জ্বেলে দেয় সে। মিটিমিটি মায়াবী আলোয় ভেসে যায় ঘরটা। ট্রলি থেকে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি বের করে হাতে নিয়ে বসে ব্লাউজ খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না, আনা হয়নি। ইস্মি অবশ্য হতাশ হয় না, তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। এই লোককে বাগে আনার চেষ্টা করবে সে। তাতে অন্যকিছুতে নজর না দিলেও চলবে।

বাইরে থেকে বারান্দায় সিঁটকিনিটা আটকে হাতে করে শাড়িটা নিয়ে বারান্দার কাছের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ইস্মি। এরপর একটু কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে তার পাগল স্বামীর। আঁড়চোখে একনার দেখে নিয়ে পরণে থাকা শাড়ির আঁচলটা ফেলে সে তাকাতেই দেখে ইজহান দুই ভুরু কুঁচকে শাণিত চোখে তাকিয়ে। ইস্মি মনে মনে হেসে উঠে, এই লোককে এখন জ্বালাবে ও। কতক্ষণ রাগ দেখিয়ে বোম হয়ে থাকতে পারে সেও আজ দেখবে। মনের ভাবনা মনে রেখে আস্তেধীরে পরণের বসন সবটাই খুলে একপাশে রেখে দেয়। এরপর ব্লাউজহীন মোমের মতো নরম দেহে গোলাপি রঙের শাড়িটা গায়ে জড়ায় আনাড়িভাবে। সেইফটি-পিন বিহীন শাড়িটার কুচি খুলে পরে বার দুয়েক। ঝুঁকে গিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে কুচি ঠিক করে ইস্মি। এমনিভাবেই আলতো হাতে চুলের কাটা ছেড়ে দিতেই পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে কালো চুলের গোছা। কানের দুপাশে গুঁজে দেয় ইস্মি। অদ্ভুত সুন্দর, বুক কাঁপিয়ে দেওয়া মোহনীয় এক মেয়েলি দৃশ্য!

এদিকে শীতল হাওয়া গায়ে লাগিয়ে চোখের উপর হাত ঢাকা দিয়ে দৃষ্টি আড়াল করা অভিমানের জাহাজ ইজহান শেখ তখন হতভম্ব, হতবাক। অল্পবিস্তর হা গেছে তার মুখটা। শক্ত চোয়াল হয়ে এসেছে শিথিল। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই শিরশির করে মেরুদণ্ড বেয়ে কিছু একটা বয়ে চলে। শিহরণে কেঁপে উঠে সে।।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে তার। এই অপ্সরা কে? সত্যিই তার ইস্মিতা? তার বউ? ইজহান হতবিহ্বল হয়ে হিসাব মেলায়। অংকে সে পাকা, কিন্তু আজ এই অনুভূতির হিসাবে মেলাতে ব্যর্থ সে।
এভাবে একটুও না সেজে এ মেয়েকে এত আবেদনময়ী লাগে? এতটা আপন আপন, আমার আমার লাগে? কই! আগে তো সে এসব টের পায়নি। না ইস্মিতা এভাবে নিজ থেকে কখনো তার কাছে এসেছে? কস্মিনকালেও না। সে ঢোক গিলে, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে তার। ইস্মিতা কী শুনলে হাসবে? বড্ড অস্বস্তি হয় ইজহানের। এদিকে ইজহানকে খেলাতে চাওয়া ইস্মি স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে আড়াকলে মনে মনে হাসে। আরেকটু জ্বালাতে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে, হাত বাড়িয়ে বারান্দার টবে থাকা একটা গোলাপ ছিঁড়ে কানে গুঁজে বাইরে মন দেয়। গুনগুন করে কবিতা ধরে,

‘সে যদি তোমাকে অগ্নিতে ফেলে মারে?’
বিনা চেষ্টায় মরে যাব একেবারে।
‘সে যদি তোমাকে মেঘে দেয় উত্থান?’
বৃষ্টিতে, আমি বৃষ্টিতে খানখান।
‘সে যদি তোমাকে পিষে করে ধুলোবালি?’
পথ থেকে পথে উড়ে উড়ে যাব খালি।
‘উড়বে?– আচ্ছা, ছিঁড়ে দেয় যদি পাখা?’
পড়তে পড়তে ধরে নেব ওর শাখা।
‘যদি শাখা থেকে নীচে ফেলে দেয় তোকে?’
কী আর করব? জড়িয়ে ধরব ওকেই।
বলো কী বলব, আদালত, কিছু বলবে কি এরপরও?
‘যাও, আজীবন অশান্তি ভোগ করো!’

ইজহান চোখের কোণে একটুখানি হাসি চাপার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার এই ইস্মিতাকে সে চিনত না! এই মেয়ের উপর আজ আবার প্রেমে পড়ছে সে—পুরোনো প্রেম, নতুন রূপে! ইজহানের শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। বুক চেপে ধরে সে বিড়বিড় করে, “আমি শেষ, পুরোপুরি শেষ, একেবারে শেষ।”

ইস্মি ওর কথা শুনতে পায় না। সে নিজের মতো করে আবেদনময়ী ভাবভঙ্গিতে নিজেকে দেখাতেই ব্যস্ত।
ইজহানের ইচ্ছে করে ওকে বুকের ভেতর পিষে ফেলতে। কেননা, হলদে আলোয় গায়ে গোলাপ জড়িয়ে বসে থাকা এই নারীটি তার রাগের কারণ, দুঃখের কারণ, ভালোবাসায় মরণের কারণ। এমনি সময় কোনোদিন নিজে থেকে কাছে আসে না। অথচ এখন দেখো, পেট-পিঠ, গলা-বাহু আর হাসিতেই তার বুকে চা’কু বসাচ্ছে। তাকে মেরে দিচ্ছে। ইস্মি ওর হতভম্ব অবস্থা ঠাহর করতে পেরে ইচ্ছে করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, “আমার সুদর্শন স্বামী… তুমি শুনছো? চলো একটা সন্ধি করি, হৃদয়ে হৃদয় মিশিয়ে। কেননা, আজকাল তোমার রাগে আমার আকাশ কালো হয়ে আসে, তোমার অভিমানের আগুনে আমার হৃদয় পোড়ে, তোমার যন্ত্রণার ভারে আমার নিঃশ্বাস পর্যন্ত ভারী হয়ে ওঠে! তোমার ভালোবাসার মরীচিকায় ছুটতে ছুটতে এক তৃষ্ণার্ত যাত্রী হয়ে গেছি। শুনতে পাচ্ছো? এই বুকের গহীনে এক মরুভূমি জন্ম নিয়েছে, যেখানে কেবল তোমার ছোঁয়ার এক পশলা বৃষ্টি হলে সবুজ জন্মাবে!

ওহে আমার কঠিন হৃদয়ের পুরুষ, তোমার কঠোরতা আমার অন্তর্দ্বন্দ্বে হাহাকার হয়ে বাজে। একটিবার ফিরে তাকাবে না? এক ঝলক শীতল বাতাস হয়ে আমার দহন মেটাবে না? আমি তোমার প্রেমে হারিয়ে যাওয়া এক পথহারা রজনী। তোমার একটুখানি উষ্ণতা পেলেই ভোর হয়ে যাবো, তোমার একটুখানি ছোঁয়ায় আবার জেগে উঠবো!

ওহে আমার অবুঝ, রাগী পুরুষ! শুনছ তুমি? তোমার কঠিন দৃষ্টি আমার হৃদয়কে শিকলে বাঁধে, যন্ত্রণা দেয় যাতনা। আচ্ছা যাতনা চুকেবুকে যাক, সব চুলোয় যাক। এসো আমরা সন্ধি করি, দীর্ঘ রাতের শেষে, তোমার বাহুডোরে একটুখানি আশ্রয়ের, একটু স্বস্তির! আমার যন্ত্রণায় তুমি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে বিনিময়ে ঠোঁটের ছোঁয়ায় আমি তোমার তৃষ্ণা মেটাব! চলো একটা সন্ধি করি।”

এবারে যেন ইজহান আর পৃথিবীতেই রইল না। মরে গেল সে একেবারে! কয়েক মুহূর্ত পর যখন আবার পুনরজ্জীবিত হলো, ইস্মি শুনলো, কানে এলো বারান্দার দরজায় জোরালো হাতের থাবা পড়ার আওয়াজ। ইস্মি প্রথমে একটু ভড়কে গেল, পরক্ষণেই ওর মস্তিষ্ক কাজ শুরু করল। দ্রুত এলোমেলো শাড়িটা বদলে নিয়ে সাধারণ একটা শাড়ি গায়ে জড়ালো, চুল কাটায় আটকাতে যেই না উদ্যত হলো বারান্দার জানালা দিয়ে একপ্রকার হামলে পড়া মতোন করে ইজহান বলল, “পাষন্ড নারী, আমাকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিয়ে তুই এখন সতীসাবিত্রী সাজছিস? আই সয়্যার ইস্মিতা, একই মুহূর্তে যদি দরজা না খুলিস আমি লাফিয়ে পরে যাব বারান্দা থেকে। তোকে বিধবা বানিয়ে যাব। আই সয়্যার! ওয়ান, টু….”

আত্মা কেঁপে উঠল ইস্মির। ইজহান ‘থ্রি’ বলার আগেই দ্রুত গিয়ে দরজার সিঁটকিনি খুলে দিলো। এরপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল রাগীমানবের বুকে। টি-শার্টের খোলা বোতামের ওখানে নগ্ন বুকে পরপর কয়েকটা চুমু বসিয়ে দিয়ে আগ্রাসী স্বরে বলে, “ইজহান বিহীন পৃথিবীতে ইস্মিতা বেঁচে থাকতে চায় না। ইস্মিতা তার পাগলকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটাতে পারবে না!” ইস্মিতার গলা কাঁপছিল জ্বলন্ত রাগে। ইজহানের চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলল, “নিষ্ঠুর, বিবেক বর্জিত পুরুষ! দ্বিতীয়বার কখনো এটা বলার আগে, দেখবে তোমার ইস্মিতা হারিয়ে গেছে ইজহান শেখ!”

এর আগে কখনো এত আপন করে ইস্মি কখনো
ওকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেনি। নিজ থেকে এতো আদর কখনো করেনি। ইজহান ওর মুখ তুলে পাগলের মতো চুমু খেতে খেতে ওকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নেয়। ইস্মিও ওকে সমানতালে চুমু বসায়, ইজহানের পাগল পাগল লাগে। দু’দিনের ক্ষিধেটিধে সব গায়েব হয়ে ভয়ংকর তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, “এই মহিলা, আমার পুদিনার শরবত কোথায়?”

“খেয়ে ফেলেছি।”

“এবার তোকে খেয়ে ফেলব আমি, আই সয়্যার!”

কন্ট্রোল হারা হলেও ইজহান নিজের সীমা জানে। সীমা অতিক্রম না করেই সে নিজের আদর-যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ করে তুলল ইস্মিকে। আর এই পুরুষের রাগ-জেদ একেবারে নিঃশেষ করে দিতে হলে এই মুহূর্তে তার অবাধ্য হওয়া যাবে না। ইস্মি অবাধ্য হলোও না। চুপচাপ আদরটুকু মাথা পেতে গ্রহণ করে নিলো। ফিসফিস করে প্রশ্ন করল, “এভাবে
কেন আটকে ফেললেন আমাকে?”

“কারণ—তুমি আটকে ফেলেছ আমাকে।”

[ঐ, মন্তব্য করো না কেন?]

——–

[রি-চেইক বিহীন। ৪৮[খ] তে টুইস্টওয়ালা বাকি অংশ পাবেন। আজ ওদের রাগ অভিমান লিখতে লিখতে বোর হয়ে গেছি। যাইহোক, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে..

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৮ [খ]

মানুষের মৃত্যু আর সময়ের বয়ে চলার দিকে দৃষ্টি না রেখে চললে হারানোর সম্ভাবনা প্রকট হয়। মৃত্যুর পরের শূন্যতা, আর সময়ের প্রলম্বিত যাত্রা দুটো একে অপরের সাথে মিশে যায়, একে অপরকে ছাপিয়ে যায়। ক্ষণগুলো গড়িয়ে চলে, অনন্ত এক স্রোতের মতো। নাইমুর সাহেব গত হয়েছেন, অনেকগুলো সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। তবে তার স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় সকলের মস্তিষ্কে। উত্তরের খোলা ঘরের বিছানাটায় তার শুয়ে থাকা, চওড়া বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে সূর্যাস্ত দেখা, সৃজা-এলিজাকে ডেকে রাতের চাঁদ দেখা! ওদের নিজের কাছে বসিয়ে শৈশবের গল্প বলা, বোনের হাতের রান্না খেতে চাওয়া…. কতশত স্মৃতি! কোনোভাবেই মুছে ফেলতে পারে না সৃজা। প্রতি মুহূর্তেই বাবার সাথে কাটানো সময়গুলো ওর মনে পড়ে। আর মনে পড়লেই ভার লাগে সবকিছু! তবুও ভারত্বটা কমাতে সে চেষ্টা করে। শ্যাওড়াপাড়ায় থাকার সময় প্রতিটা মুহূর্ত বাবার স্মৃতি তাড়া করে বেড়াতো বলে সেখান থেকেও শেখ বাড়িতে চলে এসেছে সেই কবেই! এরপর যদিও কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, রাতে থাকা হয়নি।
সেটাও হাসপাতালে চেকআপ করে ফিরে আসার সময় এক, দু-বেলা কাটিয়ে এসেছে। তবে বাবার স্মৃতি থেকে নিষ্কৃতি মিলেনি ওর। না মিলুক, মানুষটা স্মৃতিতেই হবে বেঁচে থাক!

নীলু বেগম যদিও চেয়েছিলেন এ সময়টা সৃজা ও বাড়িতেই থাকুক, কিন্তু ইহসান রাজি হয়নি। তার বউয়ের দেখাশোনা সে নিজেই করবে। আর এটা তার দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এমনিতেই অনেক কাহিনী হয়ে গেছে, ভুলচুক হয়ে গেছে। সে আর সৃজাকে দূরে রাখতে চায় না, আর এমন একটা সেনসেটিভ সময়ে তো নয়ই। তাছাড়া সৃজা মা হলে
সে নিজেও বাবা হচ্ছে, বাবা হওয়ার অনুভূতি সে অনুভব করতে চায় পুরোদমে। নীলু বেগম অসুস্থ মানুষ, এলিজারও ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার চাপ আছে। ওখানে থাকলে কে আর দেখাশোনা করতে পারবে ওকে? বাসায় কোনো শক্তসামর্থ্য পুরুষ নেই যে প্রয়োজনের সময় এগিয়ে আসবে। শেখ বাড়িতে আরকিছু না হোক, সে ছাড়াও চাকরবাকর আছে অনেক। ওর অনুপস্থিতিতেও তারা সৃজাকে দেখে রাখতে পারবে। স্বামী এবং বাবা হিসেবে এসব তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া শারীরিক-মানসিক দু’দিকেই স্টেবল থাকা দরকার সৃজার, কিন্তু এ বাড়িতে সেটা হবে না। সারাক্ষণ বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে মেয়েটা। এ মুহূর্তে যেটা উচিৎ নয়। সম্প্রতি হাইপ্রেশার আর ডায়াবেটিক নীলু বেগমের শরীরে বাসা বেঁধেছে। দুর্বল করে দিয়েছে তাকে আগের থেকে। এখন তার নিজেরই সময় অন্যের উপর ভরসা করে টিকে থাকার। সৃজাকে এখানে রাখতে গিয়ে হুট করে কিছু হয়ে যায়, তার তো সামর্থ্য হবে না মেয়েটাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করার! সবদিক ভেবেই তাই নীলু বেগম আর দ্বিমত করেননি।

শেখ বাড়িতে অবশ্য সৃজার যত্নের অভাব হচ্ছে না।দোতলা থেকে নামা ওর কঠোরভাবে নিষেধ। শেফালি বুয়া সর্বক্ষণ ওর পাশে থাকে। মালি কাকার বড় মেয়ে তুলিও ওকে আর ইস্মিকে সঙ্গ দেয়। রান্নাবান্না, কাপড় কাচা সহ যাবতীয় দায়িত্বের ভার ইহসান তুলে দিয়েছে আরেকজনের হাতে। সৃজার কাজ শুধু রুটিন মেনে চলা আর নিজের দিকে
খেয়াল রাখা। অবশ্য এটা শুধু মুখের বুলিতেই।
বাস্তবে সৃজা কী খাচ্ছে, কী পরছে, কখন খাবে, কখন ঘুমাবে সবেতে ইহসানই ওর সব খেয়াল রাখছে।

এমনকি কাজকর্ম কমিয়ে, রেস্তোরাঁ স্টাফদের উপর ছেড়ে দিয়ে দিব্যি সে বাড়িতেই থাকছে। এরমধ্যে কোনোদিন যদি ব্যবসার কাজে বাইরে যেতে হয়, তাহলে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসে। বাকি সময়টা ইচ্ছে হলে নতুন রেসিপি রান্না করছে (যদিও সে খাবার মুখে তোলার মতোন না, রান্নার হাত খারাপ ওর, তবুও চেষ্টা করছে।) কাঁথা সেলাই করছে, ঘরদোর নিজহাতে ধোঁয়ামোছা করছে। জোর করে সৃজাকে খাওয়াচ্ছে, বমি করলে পরিষ্কার করছে। চুল বেঁধে দিচ্ছে, হাত-পা ব্যথা করলে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। বাচ্চার মায়ের বাচ্চামো থেকে শুরু করে তাঁর অসুস্থতা, ভয়, মুড সুইং, উদ্ভট সব খাবারের আবদার, মান্থলি চেকআপ থেকে— পেট ছুঁয়ে বাচ্চাদের অস্তিত্ব অনুভব করা; সবকিছুতেই বাবা হওয়ার অনুভূতি মিশে আছে। এসব অনুভূতি নেহাৎই সাধারণ নয়, অসাধারণ। পুরোদমে বউয়ের দেখভালের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে সে বাবা হওয়ার অভূতপূর্ব সময়টা উপভোগ করছে।

এদিকে যেদিন থেকে আজিজ শেখ জানতে পেরেছে, তার দুই ছেলের ঘর আলো করে সন্তান আসতে চলেছে, সেদিন থেকেই তিনি ভীষণ উচ্ছ্বসিত। ইহসান-ইজহানের সন্তান মানে আদতে, তারই বংশধর। আর নিজের বংশধরদের প্রতি তার এক আকাশসম মায়া, আবদার, অধিকার কাজ করে।
তাই তিনি নিজেও অপেক্ষমাণ কখন তার বংশধররা পৃথিবীর মুখ দেখবে, যেমন করে তিনি অপেক্ষমাণ ছিলেন এমিলির গর্ভধারণের পর—তার প্রথম সন্তানদের জন্য! সৃজাকে যদিও তিনি পছন্দ করেন না, তবুও নিজস্বার্থ আর বংশপ্রদীপ আসার আনন্দে সালেহা বেগমকে দিয়ে দুই পুত্রবধূকে উপহার
দিয়েছেন। ইস্মির গর্ভে এক সন্তান বলে তাকে একবিঘা জমি আর সৃজার গর্ভে দু’জন বলে তাকে দুই বিঘার জমির উইল উপহার দিয়েছেন। বাড়িতে তখন ইহসান-ইজহান অনুপস্থিত ছিল। রাতে বাড়ি ফিরে যখন ইহসান জানল, অবৈধ টাকায় গড়া জমিসম্পদ থেকে আজিজ শেখ কিছু, ইহসানের হালাল জীবনেও প্রবেশ করাতে চাইছে; মাথা ঠিক রাখতে পারেনি সে, সৃজা শুয়ে পড়ার পর সে এলো আজিজ শেখের কাছে। ঝামেলা বিহীন উইলগুলো ফেরত দিয়ে চলে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আজিজ শেখ তালবাহানা শুরু করলেন এগুলো তিনি ফেরত নেবেন না বলে। একপর্যায়ে তো কঠোর গলায় বলেই দেন, তিনি এসব ফেরত নেবেন না এবং প্রয়োজনে কম মনে হলে তিনি আরো দেবেন। তার কথায় ঠাঁটবাট আর সূক্ষ্ম অহংকার বিরাজমান ছিল বলে ইহসান শান্ত থাকতে পারেনি, উইলগুলো ছিঁড়ে নিজের পদপৃষ্ঠে পিষে ফেলেছে সে বাবার সামনেই। পুত্রের এ কাজে হতভম্ব আজিজ শেখ শুধু চোখ গরম করে তাকিয়েই থাকেননি, রেগে গেছিলেন, “এইটা তুমি কী করলা আব্বাজান?”

“আমার যথেষ্ট অর্থসম্পদ আছে, আশা করি কারো অবৈধ টাকায় গড়া জায়গাজমি আমার সন্তানদের প্রয়োজন পড়বে না।”

“প্রয়োজন না পড়ুক, আমার এসবকিছু তো তোমাদের জন্যই। খুশি হইয়া আমি কী আমার বংশধরদের দিতে পারি না?”

“বংশধরদের অবশ্যই দিতে পারেন, কিন্তু আমার সন্তানদেরকে না।”

আজিজ শেখ রাগে কাঁপতে কাঁপতে আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, “আমি তোমার আব্বা না? তুমি আমার সন্তান না? তোমার সন্তানরা কী আমার কেউ না?
আমি ওদের দাদা না?”

রাতের তখন সাড়ে এগারোটা। শুয়ে পড়েছে সবাই। নিঃস্তব্ধ পরিবেশের নিঃস্তব্ধতা খানখান করে আজিজ শেখের হুঙ্কার। ইজহান ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসেবে দাঁতব্রাশ করছিল, কিন্তু অসময়ে চেঁচামেচি শুনে সে বেরিয়ে আসে। বিচলিত ভঙ্গিতে বাপ-ছেলের যুদ্ধ দেখে সে করিডোরের বারান্দাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে কখনো এদের যুদ্ধে নাক গলায় না,
চুপ করে সব শোনে। আজও তাই করে।

ইহসান যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলেছিল। যাতে করে সৃজা এই ঝামেলার কিছু টের না পায়, কথাগুলো না শোনে। কিন্তু আজিজ শেখ চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় উঠাতে লাগলেন রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে, যাতে করে দ্বিগবিদিক ভুলে ইহসানও বাপের সাথে তর্কে জুড়ে গেল, “কোনো রে পি স্ট অন্ততপক্ষে আমার সন্তানদের দাদা না।”

“কী রে পি স্ট, রে পি স্ট করো তুমি সবসময়? লজ্জা করে না নিজের জন্মদাতাকে রে পি স্ট বলো? কী দেই নাই তোমাদের? কি বাকি রাখছি? খাইতে, পড়তে, বিলাসিতা করতে দেই নাই? নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চলছো, আমি কোনোদিন বাঁধা দিছি? তুমি একলা আমার হাতে বাইরে গিয়া ছোটলোকের মতো বসবাস করো, আমি বাঁধা দিসি? লিথুরে বৌমা করতে চাইছি, তুমি শেষ পর্যন্ত রাজি হওনাই। এখন তোমার হাভাতে বৌ আমার বংশধর ধরছে, আমি মাইনা নিসি। খুশি হয়ে একটুখানি জমি দিসি দাদা হইয়া। আর তুমি আসছ সবসময়ের মতো তেড়েক দেখাইতে বাপের সাথে। কই! ইজহান, ইমরান তো আমার সাথে এমন ব্যবহার করে না। তোমার মা তো তাদেরও মা, মারে কি তুমি একলাই ভালোবাসো? যে কোন কাহিনীর রেশ ধইরা তুমি সবসময় আমারে অসম্মান করো? বেয়াদব!”

হুঙ্কারে কেঁপে উঠে বসার ঘর। ইহসানের একটুও রুচিতে বাঁধে না আজিজ শেখের সাথে কথা বলতে। ঘৃণায় বিষিয়ে উঠে একদলা থু থু ফেলে মেঝেতে সে। আজিজ শেখ তাতে আরো ক্ষেপে যান, “আব্বাজান, সীমা লঙ্ঘন কইরো না। আমি কিন্তু সবসময় তোমার অপদস্ততা মেনে নিব না।”

“চুপ, কে আপনার আব্বাজান? আমি নই। আমাকে এসব বলে, আহ্লাদ দেখিয়ে বাগে আনতে পারবেন না। আর অপদস্ত করেছি কী বলেন, আপনি তো এসবেরই যোগ্য। সম্মানবোধের আপনি কী বোঝেন? আগাগোড়া তো শুরু থেকেই অসম্মানিত ব্যক্তি। আপনার থেকে রাস্তার কুকুরকে সম্মান করা ভালো এরচেয়ে।”

আজিজ শেখ রাগে কাঁপতে থাকেন, “আব্বাজান, ভদ্রভাবে কথা বলো।”

“আমি ভদ্রভাবেই কথা বলতে চাচ্ছি, কিন্তু পাগলা কুকুর আমাকে সেটা করতে দিচ্ছে না।”

“কী বললা তুমি?”

“কুকুর — ঘেউঘেউ করা পাগলা কুকুর। তাড়িয়ে
দিলেও বারবার যে বিরক্ত করতে চলে আসে। আপনি ঠিক তেমনই।”

বাকরুদ্ধ আজিজ শেখ আগুন চোখে ছেলের দিকে চেয়ে থাকেন। ইহসান আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। সিঁড়িতে পা রাখতেই আজিজ শেখ ক্ষোভে ফেটে পড়েন, “তোর মায়ের পিছনেও আমি ঠিক কুত্তার মতোই ঘুরতাম, ওর মন পাবার জন্য। অহংকারী নারী দেয় নাই। তারজন্য কত কী করলাম, অবৈধ তোদের পয়দা করলাম, বাধ্য হইলো আমার জীবনে আসতে তোর মা। কিন্তু এরপরেও তেজ কমে নাই তার, মরার আগ অবধি আমায় জ্বালায়া গেছে। তুই ঠিক তোর মায়ের মতোই হইছোস। কোনো পার্থক্য নাই। ঐ
মহিলা অকালে গিয়া তো নিজেরে শেষ করলোই,। তোর মনেও বি ষ ঢুকায় দিয়া গেল। যে বি ষ আমি এত বছরেও বের করতে পারি নাই। তুই নিজে এবার বল, কী করলে আব্বা বইলা একটু সম্মান দিবি ইহসান।”

“আপনি মরে যান তাহলেই। তবে হুট করে মরে গেলে হবে না, আসতে-ধীরে মরতে হবে। কষ্টে ভুগে ভুগে মরতে হবে। বন্দিদশায় থেকে মরতে হবে। যেমন আমার মা মরেছিল, ঠিক তেমন। তাহলে আমি ভেবেচিন্তে দেখব, বাপ নামক রে পি স্টকে সম্মান দেওয়া যায় কি না!”

“তোমার সম্মান পাওয়ার জন্য আমার এখন নিজের জীবন দিতে হইব?”

“আপনি ছেলের কাছে আশা করেছেন, আমি জন্মদাতার কাছে আশা করতে পারব না? হিপোক্রেসি হয়ে গেল না? পারবেন না যখন, তখন এত আশা করেন কেন, না করলেই হয়!”

আজিজ শেখ ছেলের দিকে তাকিয়ে রাগে কাঁপতে থাকেন। বলার মতো শব্দ খুঁজে পান না। চেঁচামেচি শুনে সালেহা বেগম ভীতি নিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, রাগ সামলাতে না পেরে আজিজ শেখ তাকেই গিয়ে আক্রমণ করে বসেন। ইহসান ফিরে এসে আজিজ শেখকেই ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে সালেহা বেগমকে বাঁচিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে হুঙ্কার ছাড়ে, “কোনদিন না আপনার মরণটা আমার হাতেই হয়ে যায়, খু ন হয়ে যান আমার হাতে! সরলের উপর আর কত জুলুম করবেন? একটু নিজের উপর করেন এবার, একটু আফসোস অন্তত করুন! এ বয়সে এসেও ভীমরতি বাদ দিতে না পারলে মরণের সময় মুখে পানি দেওয়ার কেউ থাকবে না।”

ইহসান ঘৃণিত দৃষ্টি ছুঁড়ে, রাগে শরীর কাঁপছে ওর।
এই একটা লোক, যাকে এত ঘৃণা করার পরেও প্রতিনিয়ত চোখের সামনে দেখতে হয়! সে এক সেকেন্ডের জন্যও লোকটাকে আর সহ্য করতে পারছে না, একদম না। এই মুহূর্তে ওর এখান থেকে যাওয়া উচিৎ, নয়তো আরো তুলকালাম কান্ড হয়ে যাবে। তৎক্ষনাৎ স্থান ত্যাগ করে সে।

এদিকে ইজহান হতভম্ব! এসবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে ভেবেছিল অন্যান্য দিনের মতোই তাদের মধ্যে কোনো ছোট্ট বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, কিন্তু এসব শোনার পর, বিশেষ করে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে আজিজ শেখের বলা কথাগুলোর জন্য সে হতবাক। এতদিন ধরে চাপিয়ে রাখা এ বিষয় এভাবে সামনে চলে এলো? ইজহান ঢোক গিলে, তার থেকে কিছুটা দূরে এক নারী ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে৷ বিভ্রান্ত হয়ে একপলক তাকাতেই চোখাচোখি হয় তার, সৃজার সঙ্গে! তবে ওকে দেখেই সৃজা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় ন, ঘরে ফিরে যায়। ইজহান টের পায় তার পা চলতে চাইছে না৷ এক জায়গায় আটকে গেছে। এই মেয়ে
কী সব শুনে নিয়েছে? ইস্মিতাকে কী গিয়ে সব বলে দেবে? অবশ্যই বলবে। এসব ব্যাপারে না বলে থাকবে না। এরপর…এরপর ইস্মিতা তাকে ছেড়ে যাবে, ঘৃণার নজরে দেখবে! তার সব গুলিয়ে আসে।
ঘরে যাওয়ার সাহস পায় না। দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে সে নিচে নেমে আসে। বিতৃষ্ণা নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা আজিজ শেখকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে, কিন্তু কোমড়ে বেশ চোট পেয়ে ব্যথায় মূর্ছা যাবার উপক্রম হয় আজিজ শেখের। ইজহান ধীরেধীরে তাকে বসিয়ে মকবুলকে ডেকে এনে আজিজ শেখের সেবায় লাগিয়ে দেয়। ইজহানকে দেখে আজিজ শেখ একটু স্বস্তি পান, কাছে ডাকেন। কিন্তু ইজহান শক্ত মুখ করে কিছু না বলেই বেরিয়ে আসে। তার মাথা ঘুরছে সবকিছু ফাঁস হয়ে যাওয়াতে। এর ফলাফল ভয়ানক বৈকি আরকিছু হবে না। দুরুদুরু মন নিয়ে ঘরে এসে আরো একদফা তার বুকের রক্ত ছলকে উঠে। তার ভাবনাই সত্যি। ইস্মিতা বিছানার এককোণে বসে আছে, ওর চোখে বিস্ময়! ইজহানের পা কাঁপে। সে দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। মূর্তির মতোন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকে, চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয় না। লজ্জা এবং ভয় ঝেঁকে ধরেছে ওকে। ইস্মিতা উঠে বসে আছে মানে তাহলে সব শুনেছে! বাবার চিৎকার, মায়ের কথা সব! ইজহানের বুক ভেঙ্গে আসে অজানা ভয়ে। দরজা ছেড়ে সে হাঁটু ঠেকিয়ে এসে বসে ইস্মির পায়ের কাছে। এরপর চুপ করে বসেই থাকে…অনেকক্ষণ পর ওর হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে কম্পিত স্বরে বলে, “আ আমি তোমাকে তো ভালোবাসি, আমার বাচ্চার মা তুমি…ইস্মিতা, আমি কখনো তোমাকে আরকিছু বলব না, ভালোবাসতেও না। শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ পর ওর মুখটা ইস্মি দু-হাতে আগলে নেয়, ইজহান টলমল চোখে ভীতি নিয়ে তাকায়, পরক্ষণেই নামিয়ে নেয়। ওর সাহস হয় না ইস্মির চোখে নিজের জন্য করুণা দেখার…মেয়েটা কী জা র জ বলে ওকে ছেড়ে দেবার কথা বলবে? ঘৃণা করবে? ইজহানের হাতের মুষ্ঠি শক্ত হয়ে আসে। সে মরে যাবে ইস্মিতা ঘৃণা চোখে তাকালে, উল্টাপাল্টা কিছু করলে… তবে ভাবনাটা শেষ হবার আগেই হঠাৎ কপালে কোমল ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই ইজহান চমকে উঠে। নিজেকে আবিষ্কার করে ইস্মির বুকের মাঝে। সঙ্গে সঙ্গেই সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে একপ্রকার অনুনয় প্রার্থনা করে, “ঘৃণা নিয়ে তাকাবি না ইস্মিতা, আমি সহ্য করতে পারব না। মারব প্রচন্ড। আমার বাচ্চার আবার ক্ষতি হবে, হলে হোক। কিন্তু তুই…তুই কখনো ঘৃণা নিয়ে তাকাবি না আমার দিকে৷ ছেড়ে যেতে হলে আমার মৃত্যুর পর যাবি, এর আগে না। আমি অপবিত্র বলে এই শাস্তি আমার মেনে নিতে হবে, পারব না। আমি অতো নরম হতে পারব না …”

আগে থেকে এ ব্যাপারে কিছুটা জ্ঞাত থাকায়, হাজারো প্রশ্ন মনে উদ্রেক হলেও ইস্মি কোনো প্রশ্ন করে না।
একান্ত পাগল মানবের মনোভাব বুঝে চুপচাপ ওকে আগলে বসে থাকে। মুখে না বললেও চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, সে কখনো অতো কঠোর হবে না।

.

এতরাতে বাড়িতে ছোটখাটো নয় বড় একটা ঝড়ই বয়ে গেছে। যেভাবে গলা চড়িয়েছিল আজিজ শেখ, তাতে ইহসানের এতদিনের চেষ্টা পুরোটাই বিফলে গেছে। ব্যাপারটা তখনই সে বুঝতে পারে যখন ঘরে পা রাখে আর সৃজা শীতল, শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। কোনো প্রশ্ন করে না মেয়েটা। স্বাভাবিক ভাবে একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয় ভারী শরীরে। ইহসান পানিটা খায় না, রেখে দেয়। তার এখন একগ্লাস পানিতে বুক ভিজবে না। এক সমুদ্র পানি লাগবে। সৃজার কাছে জবাবদিহি করার মতো কোনো শক্তি একফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। ইহসান অপরাধী আর অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সৃজার দিকে। মেয়েটা এত স্বাভাবিক! অথচ ইহসানের কাছে অস্বাভাবিক লাগে ওকে। কোনো একটা কথাও না বলে একটু মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। পেছন পেছন সৃজা আসে। রেলিঙয়ে হাত রেখে ওর দিকে দৃষ্টি তাক করে। ইহসান না তাকিয়েও বুঝতে পারে সেটা। আচমকাই ঘুরে সৃজার কাঁধ চেপে ধরে দেয়ালে ঠেসে কঠোর স্বরে সে জিজ্ঞেস করে, “তুই ভালোবাসবি না আমায় আর?”

সৃজা এ কান্ডে প্রথমে হতবিহ্বল হলেও ধাতস্থ হয়েই হেসে ফেলে প্রশ্ন শুনে, “এত কাঙাল তুমি? কেউ ভালোবাসে না?”

“আর কেউ লাগবে না আমার, তোর ভালোবাসা লাগবে।”

“আমি বাসি না?”

“বাসতিস!”

“বলছো এখন আর বাসি না?”

এ পর্যায়ে আর্ত স্বরে বলে ইহসান, “তুই যেটা শুনেছিস, তারপর কেউ আর ভালোবাসে না। যেকেউ শুনলে তার মন ঘৃণায় বিষিয়ে যাবে। তুইও ব্যতিক্রম হবি না, এটা বিশ্বাস করতে চাইছি না। তবুও মানুষের মন, ব্যতিক্রম হতেই পারে।”

“হতে পারে কেন? আমি তো ব্যতিক্রমই। নয়তো এমিলি আন্টির অস্থির ছেলেকে মন দিয়ে বসি? তার বাচ্চা ধারণ করি?”

ইহসান বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ওর দিকে। তোতলে উঠে সে, “মা আমা মায়ের ন নাম কীভাবে জান…লি? কে বলল তোকে?”

অস্থিরতায় ছেয়ে যায় সে৷ যেন প্লাবন বইছে বুকে। হাত-পা কাঁপে ওর৷ সৃজা কীভাবে ওর মায়ের নাম জানলো, ভেবেই বিস্ময় কাটছে না ওর। মেয়েটা তো শুধু ছবি দেখেছিল, সে কিছু বলেনি। তাহলে? ইহসান অবশ্য জোর করে জানতে চাইতে পারে না। ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকে চাঁদ গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজার পানে। সৃজা ওকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। ভাবলেশহীন স্বরে পুকুরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলতে থাকে, “দুমড়ানো-মুচড়ানো একটা নোট পেয়েছিলাম অনেকদিন আগে। কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিল, পরে হয়তো দ্বিধাবোধ থেকে আর দিতে সাহস করেনি নোটটা। হয়তো ভেবেছিল, আমি এসব জেনে তাকে ঘৃণা করব, দূরে সরে যাব। আমি অতি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম তার ভাবনার দৌরাত্ম্য দেখে, তাই আর ঘাটাতে আসিনি। পরে না আবার জবরদস্তি ভেবে বসে। আসলে, এখনো আমার প্রতি বিশ্বাস জন্মাতে পারেনি সেই অধম। অথচ এই পৃথিবীতে গুটি যে ক’জন মানুষ আমার নিজের, তাদের মধ্যে সে আমার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে ভরসার। নোট লেখা সেই অধম হয়তো জানে না, ভালোবাসার মূলমন্ত্র বিশ্বাস আর ভরসা। জানলে কি আর এমন করতো? ইহসান শেখ, বলো তো সেই অধমটা কে? তুমি কি তাকে চেনো?”

ইহসান দমকা হাওয়ার মতো উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সৃজার বুকে। অসহায়, অনুযোগের ভারে তার গলা কাঁপে, “সৃজা, ধর্ষিতা আমার নিজের জন্মদাত্রী। এই কথা আমি কীভাবে বলি তোকে যে আমি অপবিত্র, অবৈধ, জা র জ, পাপী?”

“ধ র্ষি তার সন্তানকে অপবিত্র বলছ? তবে তো ধ র্ষ ক তোমার চেয়ে পবিত্র! সে শুধু পাপ করেছে, আর তুমি করছো পাপীকে সাধু আর পীড়িতকে পাপী সাজানোর চেষ্টা।”

সৃজার কথায় কিছুটা চমকে ওঠে ইহসান। কেউ কি কখনও এভাবে বলেছে ওকে? বা ও নিজেই কি কখনও এভাবে ভেবেছে? চিরকাল নিজেদের একপ্রকার পাপী বলেই মেনে নিয়েছে, আর পাপ তো সত্য! কিন্তু সৃজার কথাগুলো যেন ওর এতদিনের বিশ্বাসকেই দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। তাহলে কি ওরা আসলেই দোষী নয়? অন্তত সৃজার কাছে? চোখের সামনে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ ধসে পড়ার অনুভূতি হয় ওর। দুটো ঢোক গিলে সে, “কে পাপী, সৃজা?”

ওর কণ্ঠ অস্বাভাবিক, ভেতরে তোলপাড় চলছে। আদৌ কি এই প্রশ্ন আসলেই জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল? নাকি নিজের কাছেই উত্তর খুঁজছে সে? প্রশ্ন শুনে সৃজা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর শান্ত গলায় বলে, “যে অন্যায়ের জন্ম দিয়েছে সে পাপী, আর যে অন্যায়ের ভার নিয়ে নিজেকে অপরাধী ভাবছে, সে শুধু শিকার। আমার ক্ষেত্রে, এই শিকারকে আমি ভালোবাসি। ইহসান শেখ, তোমায় আমি ভালোবাসব আজীবন।”

ইহসানের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এতদিন ধরে পাপের জালে বন্দি হয়ে থেকে মস্তিষ্কে সায়ই দেয়নি এ কথায় যে, ওদের কোনো দোষই ছিল না। অথচ আজ সৃজা এটা বলল, শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ইহসানের। বুকের ভেতর জমে থাকা পাহাড়টা ধসে পড়ে এক নিমিষেই। চোখদুটো বুজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “আমার মা যখন আমাদের দুনিয়ায় আনে, তখন তাঁর বয়স সতেরো-আঠারোর বেশি না। এখনকার তোর বয়সের চেয়েও কম। আমাদের ভাষাটাও ঠিকঠাক বলতে পারত না। খুব চুপচাপ, মিষ্টি দেখতে এক মেয়ে, ছবি আঁকতে ভালোবাসত। না ছিল কারও সঙ্গে শত্রুতা, না ছিল মিত্রতা। কিন্তু শুধুমাত্র রূপের কারণে এক নরপিশাচ তাকে ধ র্ষ ণ করল, নাজেহাল করে দিল—একেবারে ধ্বংস করে দিল তার জীবন। অথচ সমাজ? সমাজ তাকেই ভ্র ষ্টা চারী উপাধি দিয়ে নরকের জীবন উপহার দিল। ধ র্ষ কের নামের সঙ্গেই জুড়ে দিল তার নাম। আর লোকটা? যে এই অপরাধের মূল কারণ, মায়ে’র জীবনটা সে জা হা ন্নামে পরিণত করে এখনো
দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা ডায়েরি লিখত। আমি চুরি করে সেই ডায়েরি পড়তাম, জানতাম তাঁর বিভীষিকাময় জীবনকাহিনী। ছোট ছিলাম, সব বুঝতাম না। কিন্তু এটুকু বুঝতাম—আজিজ শেখ ভালো কিছু করেনি মায়ের সঙ্গে। আজ দেখ, মায়ের অস্তিত্বই কোথাও নেই! অথচ যে নরপিশাচের কারণে মা’কে এত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অবমাননা সহ্য করতে হয়েছিল, সে দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। তার কাছে সব আছে, যা সে চেয়েছিল। অথচ আমরা? এই পাপীর জন্য মায়ের ভালোবাসা পাইনি, পাইনি স্নেহের ছোঁয়া। তিনি জন্মদাত্রী হয়েও আমাদের ঘৃণা করেছেন—শুধু এই কু-লা ঙ্গা রের জন্য! ভাব, আমাদের জন্মটাই কত অপরাধের!”

গলাটা ভারী হয়ে আসে ইহসানের। সেখানে আবার তাচ্ছিল্যের হাসিও জুড়ে থাকে৷ এই স্মৃতিচারণগুলো করতে গিয়েও তার মানসপটে ভেসে বেড়াচ্ছে তার মায়ের সুন্দর মুখটা৷ এত রূপবতী এই নারী, ঠিক যেন কোনো চাঁদের মতো মাধুর্য, যেন কোনো অজানা রহস্য উপন্যাসের নায়িকা, অকালে ঝরে পড়া ফুল। মা মরে গিয়েছে দুই দশকেরও বেশি সময়। আজ সে ত্রিশ বছরের পূর্ণাঙ্গ এক যুবক, অথচ তার মায়ের বয়সটা আটকে আছে সেই সাতাশেই। এসব ভাবলে মস্তিষ্ক যে ওকে কীভাবে যন্ত্রণা দেয়, কাউকে বোঝাতে পারবে না ইহসান কখনো। চেপে রাখা এসমস্ত কথা কারো সামনে এভাবে প্রকাশ করবে, কাউকে বলবে, ইহজন্মেও ভাবেনি। বুকের ভেতর মরুঝড় বয়ে চলে, পথহারার ন্যায় হাঁপিয়ে উঠে সে। সৃজার ছোঁয়ায় তার ঘোর কাটে। মেয়েটা বেতের সোফায় একটু চেপে বসে তাকেও টেনে বসিয়েছে। ধপ করে পাশে বসে ইহসান একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সৃজা কিছু বোঝে, আবার বোঝেও না; মেয়েটা ওর গালদুটোতে অনেকক্ষণ ঠোঁট বসিয়ে রেখে একসময় ছেড়ে বসে। নাকে নাক ঠেকিয়ে বলে, “যদি জন্মই অপরাধ হতো, তাহলে সৃষ্টিকর্তার প্রতিটি সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন উঠত। অথচ তিনি যা সৃষ্টি করেন, তা নিখুঁত ও পূতপবিত্র। জন্ম যার যেভাবেই হোক, অপবিত্র কোনো জন্ম নেই, অপবিত্র শুধু দৃষ্টিভঙ্গি। ধ র্ষ ণের সন্তানও সৃষ্টিকর্তার দান। সৃষ্টিকর্তা কখনো কোনো সৃষ্টি অশুদ্ধ করে না, তাঁর দানে কোনো দোষ নেই। তাঁর পরিকল্পনা আমরা কখনো বুঝি না, কখনো উপলব্ধি করতে পারি না। মানুষের দৃষ্টি সীমিত, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টি অসীম। সবকিছু সৃষ্টিকর্তার এক মহৎ পরিকল্পনার অংশ, যেখানে অন্ধকার থেকেও আলো উঠে আসতে পারে। তাই পাপ তার নয়, যে ভুগেছে। পাপী সে, পাপ অপরাধীর, তার দ্বারা জন্ম নেওয়া শিশুর নয়। আর সমাজের বিচারব্যবস্থার কথা বলছ? যেখানে পাপীর স্থান দেয় তারা ক্ষমতার আসনে, আর নির্দোষের স্থান পায়ের নিচে। সমাজের বিচারব্যবস্থার মূলমন্ত্রই তো এটা, অন্যায়ের দাঁড়িপাল্লা কেবল দুর্বলের দিকে ঝুঁকবে! আমাদের বিয়ের ঘটনাটা মনে আছে তোমার?ভাইবোনের মতোন সম্পর্ক ছিল তখন আমাদের! অথচ সমাজ নোংরা করেছিল সম্পর্কটাকে, ভ্র ষ্টা চা রী বানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আর তুমি এই ভ্র ষ্টা চারীকে সম্মান দিয়ে জীবনে জায়গা দিয়েছ!
ভাগ্যিস দিয়েছ, নয়তো আমার পরিণতি খুব একটা ভালো হতো না…”

বিভোর হয়ে শুনতে থাকা ইহসান এ পর্যায়ে থমকায়, “কী হতো?”

“সেই সৃজা রেহমান ম’রে যেতো।”

“এতক্ষণ এত বড় বড় কথা বললি, আর নিজের বেলায় মরে যেতি?”

“নিজেদের দুঃখকে আমরা এতবেশি গুরুত্ব দিই যে, প্রেরণার চেয়ে আবেগই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে তখন।”

বলে সৃজা হেসে ফেলে। ইহসান ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ওর নাকে কামড় বসায় জোরেসোরে, “লোকের সন্দেহ কিছুটা হলেও সত্যি ছিল, তোকে তখনো আমি ভালোবাসতাম সৃজা—বোনের নজরে আমি শুধু আমার এলিজকে দেখেছি। তুই হয়তো ভ্র ষ্টা চারী না, কিন্তু মনে মনে আমি ভ্র ষ্টা চার ছিলাম!”

__________

[রি-চেইক বিহীন। দেরিতে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪৯

ইজহান ইস্মিকে নিয়ে হাঁটছে। চারপাশ শূন্য, কোথাও কেউ নেই। আকাশে তপ্ত রোদ্দুর। চোখে বড্ড লাগে। তাকানো যায় না। ইজহান শক্ত করে ইস্মির হাত ধরে রাখল ওকে, যাতে না ছুটে যায়। কিন্তু হঠাৎই আকাশ হয়ে গেল কালো। চারদিক সন্ধ্যের অন্ধকারে ডুবে গেল। বালিঝড় শুরু হলো। ঝড় শেষ হলে দেখা গেল, ইস্মি ওর পাশে নেই। কোথাও নেই। ইজহান হারিয়ে ফেলেছে ইস্মিকে। সে পাগলের মতো খুঁজল ইস্মিকে, চিৎকার করল শূন্য মরুভূমিতে, কিন্তু ইস্মি ফিরে এলো না। ইজহান ঘুম থেকে উঠল চিৎকার করে।

গত দু’দিন বৃষ্টি ছিল, সাথে ঠান্ডা বাতাস। আকাশে রোদের দেখা মিলেনি মেঘ ছিল বলে। আজও মুষলধারে বৃষ্টি , স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তবে আরামদায়ক আবহাওয়া। হাফ ডে অফিস সেরে ইজহান বাড়ি চলে এসেছে। খেয়েদেয়ে ভাতঘুম দিয়েছিল সে ইস্মিকে নিয়ে। আধঘন্টা ঘুমিয়ে উঠার
পর সৃজার সাথে বিকেল পর্যন্ত বসে গল্প করেছে ইস্মি। মাগরিবের আযান হওয়ায় মাত্র ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই ইজহানের অপ্রত্যাশিত কান্ডে ভড়কে গেল ইস্মি। বিচলিত ভঙ্গিতে পেটে হাত চাপা দিয়ে আস্তে করে এগিয়ে এসে ধরল ওকে। কাঁপতে থাকা ইজহানের হাত মুঠোয় নিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, “কী হয়েছে? এমন করছেন কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন? এভাবে কাঁপছেন কেন?”

ইজহান তখনো স্বপ্নের ঘোরেই আছে, “ইস্মিতা কোথায় তুমি, আমার দমবন্ধ লাগছে…”

ইস্মি জাপ্টে জড়িয়ে ধরল ওকে, “এইতো আমি। আপনার কাছে। কোথাও যাইনি তো।”

রিনরিনে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ধাক্কা খেল এবার ওর মস্তিষ্কে। ইজহান চোখ খুলে তাকাল। এরপরই নিজেকে আবিষ্কার করল ইস্মির বুকে, ও তৎক্ষনাৎ গায়ের ভর ছেড়ে দিলো, “কোথায় হারিয়ে গেছিলে আমাকে রেখে, জানো আমি কত ভয় পেয়েছি?”

“মানে? হারিয়ে গেছি আপনাকে রেখে? কী বলছেন এসব?”

ইস্মি হতবুদ্ধি। কী বলছে ইজহান সে বুঝতে পারছে না। তবে লোকটা যে স্বপ্নের ঘোরে আছে এটা বুঝল। ইস্মি ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “আপনি ঘুমের ঘোরে আছেন! হুঁশে আসুন। আপনার পাশে বসে আছি, এইতো আমি। তাকান না!”

ইজহান এবার টকটকে লাল চোখে তাকাল, পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল। এরপর আবার আচমকা জাপ্টে ধরে চেঁচাল, “আমি খুব ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখলাম। কেন দেখলাম? কেন এমন হলো? আমি তো এখন ভালো হয়ে গেছি তাই না?”

“হ্যাঁ মহাশয় আপনি ভালো হয়ে গেছেন। কিন্তু আমাকে খারাপ বানানোর ধান্ধায় আছেন যারজন্য উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছেন। আচ্ছা, মেয়ের বাপ হবেন আপনি, এত ভয় পেলে মেয়ে কী বলবে বলুন তো।”

ইজহানের তখনো বুক কাঁপছে, “আমার সব ভয় তো তোমাকে নিয়েই। মেয়েটেয়ে লাগবে না আমার। ডেলিভারিতে যদি তুমি মারা যাও, আমি মরে যাব! বাচ্চা এতিম হয়ে যাবে, কী দরকার এতিম বাচ্চা দুনিয়ায় আনার? পরে আমার মতোই কষ্ট পাবে।!”

অসহায় শোনাল ওর গলা। ইস্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এভাবে চললে কেমন করে কী হবে? ও নিজেকেই তো ঠিক রাখতে পারবে না। ভয় কি ওর কম হচ্ছে? ইজহানের পাগলামো দেখলে সারাক্ষণ অশুভ চিন্তা মাথায় আসে, যদিও ইস্মি পাত্তা দেওয়ার চেষ্টা করে না সেসব বিষয়ে তবুও একটা পোড়া অনুভূতি, বিষন্ন ভয় ওকে ঘিরে রাখে আজকাল। একটু করে বদলে যাওয়ার চেষ্টা করা ইজহান, তার অহেতুক অস্থিরতা, ইস্মির কাছে নত হওয়া সবই ওর চোখে জল এনে দেয়। এত এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য মনে করে না নিজেকে ইস্মি, হুট করে এতসব পেয়ে গিয়েই যেন ওর মনটাও এসব মানতে পারে না। তবুও ইস্মি মনে মনে প্রার্থনা করে তাদের যাতে সত্যিই একটা মেয়ে হয়। ইজহানের যাতে নিজের একটা মা হয়, কাঙাল ভেবে আসা জীবনে অন্তত মেয়ের ভালোবাসা পাক, একটু হলেও! ইস্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবনা থেকে বের হয়ে ইজহানের কপালে হাত বুলিয়ে চুল সরাতেই বুঝে ওই লোক ঘেমে একাকার। ইজহানকে বুক থেকে সরিয়ে পরণের গেঞ্জিটা খুলে দেয় সে, তোয়ালে ভিজিয়ে এনে ওর ঘামে ভেজা বুক, পিঠ, কপাল, মুখ, সমস্ত শরীরটা মুছে দিয়ে একগ্লাস পানি খাইয়ে ওকে শান্ত করতে চাইল, “দুঃস্বপ্ন সত্যি হয় না। আপনি এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না।”

কিন্তু অস্থির ইজহান বলল, “আমার নিঃশ্বাস তুই, ভুলভাল বকে বুঝ দিবি না। আমি কিন্তু নিজেকে
শেষ করে ফেলব তোর কিছু হলে। আমার দরকার নেই কোনো বাচ্চার। তুই হলেই চলবে।”

ইস্মিও এবার কঠিন গলায় বলল, “না চলবে না। আমি নারী, মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার, মা হবার অধিকারও আমার আছে। ক্ষমতা থাকতে আমি কেন এই সুখ পাব না? একবার পেয়েও হারিয়েছি, এবার আর হারাতে পারব না। পাগলের প্রলাপ বাদ দিন।”

“তোর সুখ আমি!”

“সাথে মাতৃত্বও।”

“সোজাসাপ্টা বল!”

“বললাম তো! ”

“ধৈর্যহীন করে ফেলছিস। আমি বাপ হতে চাই না, মা লাগবে না আমার। আমি শুধু তোকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমাদের ভালো থাকার মাঝে কোনো তৃতীয়পক্ষ চাই না। তাই মরুক ঐ বাচ্চা, আমার কিছু যায় আসবে না যতটা না তোর কিছু হলে যায় আসবে…”

এত পাগলামো করার মাঝে কেউ যদি এমন একটা কথা বলে নিজের অনাগত সন্তান সম্বন্ধে, তাহলে কি কোনো মায়ের মাথা ঠিক থাকে? ইস্মির হঠাৎ কি হলো জানে না, সে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ইজহানের গালে। ফর্সা গালে সঙ্গে সঙ্গেই রক্তিম ছাপ বসে গেল। ইজহান ঝড় শেষ হয়ে যাওয়া প্রকৃতির মতো থমকে গেল। ইস্মি ভেজা তোয়ালে ওর মুখে ছুঁড়ে মেরে ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “আপনি একজন মায়ের সামনে কীভাবে তার অনাগত বাচ্চার মৃত্যুর কথা তুলতে পারেন? একজন মায়ের কেমন লাগে আপনি বুঝেন? অবশ্য বুঝবেন কেমন করে, আপনি তো আর পেটে ধরেননি। শুনুন, দু-ফোঁটা রক্ত-বীর্য দিলেই কেউ বাবা হয়ে যায় না। বাবা হতে গেলেঅনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়, নমনীয় হতে হয়, একবুক ভালোবাসা থাকতে হয় বুকে, প্রাণটা দেওয়ার জন্যও তৈরি থাকতে হয়। অথচ আ আপনি বলছেন ও মরুক? আপনার কিছু যায় আসে না? ছিহ…বাবা নামের কলঙ্ক আপনি। আপনার জন্য, আপনার জন্য আমি প্রতিবার এত চাপের মধ্য দিয়ে যাই তবুও দয়া হয় না আপনার, এখনো যেহেতু হয় না আর হবেও না। আপনি বড্ড স্বার্থপর, নিজেরটা ছাড়া আর কারোরটা বোঝেন না, আমারটাও না। এত স্বার্থপর বলেই আপনার কাছে কিছু থাকে না, আর থাকবেও না।”

রক্তিম হয়ে গেছে ইস্মির চোখ, দৃঢ় কণ্ঠস্বর। শরীর কাঁপছে ভয়ানক রাগে। ইজহান স্তব্ধ মুখে বসে রইল, রাগে তারও গা কাঁপছে। ইস্মি দেখল সেটা, তবে আর একটা বাক্যও ব্যয় করল না। নিজের ঔষধের বক্সটা খুঁজে নিয়ে বের করে একটা ঔষধ গিলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ না, আর সে নমনীয় ব্যবহার করবে না এই লোকের প্রতি, যে তার বাচ্চার ভালো চায় না। এদিকে ইজহান উত্তপ্ত চোখে বউয়ের অবাধ্য কান্ড দেখে রাগে লাথি বসালো টি-টেবিলে, “গায়ে হাত তুলিস তুই আমার? এতবড় স্পর্ধা? কিছু করি না বলে দিন দিন সাহস বাড়ছে? হাত ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দেব তোর আমি। অসভ্য নারী।”

ইস্মি না ফিরেই দৃঢ় স্বরে বলল, “সাহসের কী দেখেছেন আপনি? কিছুই দেখেননি। কষিয়ে আরো দুটো চড় দেওয়া উচিৎ ছিল আপনাকে।”

ক্ষোভে ইজহানের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো এবার, কী! তার বউ তাকে কষিয়ে থাপ্পড় মারতে চায়?এতবড় কলিজা হয়ে গেছে এই নারীর পেটে বাচ্চা ধরে? তাহলে এই বাচ্চা এলে তো আরো মাথায় চড়ে বসবে, নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। সে তীব্র গলায় বলল, “তেজ দেখানো শিখে গেছিস? স্বামীকে সম্মান করিস না! বেশি তেড়িবেড়ি করলে বাচ্চাকে আমি এতিমখানায় দিয়ে আসব দেখিস।”

“আর সেদিনই আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটবে।”

তেড়েফুঁড়ে গিয়ে চেপে ধরলো সে ইস্মির চোয়াল, “তার আগেই মেরে দেব তোকে!”

“দয়া করে এই পুণ্য কাজটা করুন, আমিও অশান্তি থেকে মুক্তি পাই।”

ইজহানের হুঁশ হলো, যে সে কি বলেছে এতক্ষণ! ইস্মিকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কী? আমি তো রাগের কারণে এটা বলেছি। সত্যি তো আমি মারব না।”

ইস্মি ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আপনি আর আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। কথা বলার চেষ্টা করলে বুঝব, আপনি একটা বুদ্ধিহীন মানুষ। যে আস্ত একটা অফিস চালায়, কিন্ত কোথায় কি বলতে হবে, কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় সেটুকু কমনসেন্স নেই। আর কমনসেন্স বিহীন লোকের সাথে আমি কথা বলতে চাই না।”

রাগে খেই হারাল ইজহান, “আরে যা যা, বয়েই গেছে তোর সাথে আমার কথা বলতে। স্বামীর মন বুঝিস না, ভয় বুঝিস না দরকার নেই এমন বউয়ের।”

“কে যেন একটু আগেই আমি হারিয়ে গেছি বলে মেয়েদের মতো কান্নাকাটি করল!”

তাচ্ছিল্য ঝড়েঝড়ে পরল ওর কণ্ঠস্বরে। ইজহানের গা দিয়ে আগুন বেরুলো। কতবড় বুকের পাটা তাকে ব্যঙ্গ করে এই মহিলা, একটু দুর্বলতা দেখিয়েছে বলে! সে ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে রইল। ইস্মি ভয় পেল না, সে জানে একটু পরেই এই লোক সোজা হয়ে যাবে। তবে এবার সে অত সহজে গলবে না, কোনোমতেই না।

.

শেষ বিকেল। বৃষ্টির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। সবুজ ঘাসে একজোড়া পা ধীরগতিতে হাঁটছে। তুলতুলে, নরম ও রক্তিম কাদামাখা পা দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে ইহসান একদৃষ্টিতে। হতাশ সে বসে বসে কদম গুণছে বউয়ের। এতক্ষণে তেত্রিশ কদম হাঁটা হলো সৃজার। পঞ্চাশ কদম হলে এসে একবোতল পানি খাওয়ার শর্ত দিয়েছে ইহসান। এই মেয়ে আজকাল পানি খায় না। খেলেও খুব কম খায়। না খাওয়ার পেছনে অবশ্য কারণ আছে৷ ইদানীং পানি শরীর ফুলে গেছে ওর। ওজন বেড়ে গেছে। গায়ে রঙ খুলে মাতৃত্বের অপার সৌন্দর্য ভর করেছে দেহে। যতবার ওর দিকে তাকায় ততবার ওকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে ইহসানের৷ বহুকষ্টে সে নিজেকে সামলায়। অথচ সৃজা এতসব বুঝতেই চায় না। ওজন বেড়ে যাচ্ছে বলে নিজেকে কুৎসিত মনে করে হায়-হুতাশ করে। সৌন্দর্য চলে যাওয়ার জন্য ইহসান ওকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করবে বলে সারাক্ষণ সন্দেহ করে। শরীরের ফোলা ভাব আর ওজন কমাতে তাই আজকাল খাবার খুব কম খায়৷ মেপেঝুঁকে খায়। তাতে শরীরের যে বারোটা বাজছে সেদিকে খেয়াল নেই। এই নিয়ে ঝগড়া করে গত দু’দিন যাবৎ কথা বলেনি ইহসান ওর সাথে। সৃজা যদিও ওর রাগ ভাঙানোর জন্য পেছন পেছন ঘুরেছে, তবে এত সহজে রাগ ভাঙেনি ইহসানের। সে শর্ত দিয়েছে এসব উল্টাপাল্টা চিন্তাধারা বাদ দিয়ে যদি ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করে, নিজের যত্ন নেয় তাহলেই যেন ওর কাছে আসে। নয়তো এত আদিক্ষেতার দরকার নেই ওর। বাচ্চাকাচ্চা যদি সুস্থভাবে না আসে, তাহলে তাদের নিয়ে সে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসের পথ ধরবে। এর কোনো নড়চড় হবে না।

মাতৃত্ব শরীরে জেঁকে বসার পর দিনদিন সদ্য কৈশোরে পদার্পণ করা আবেগী কিশোরীর ন্যায় অদ্ভুত আচরণ করে সৃজা। সারাক্ষণ স্বামীকে আঁচলে বেঁধে রাখার চিন্তাভাবনা ঘুরে ওর মনে। এই মনে হয় ইহসান ওকে দেখছে না, ওর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না, টান কমে যাচ্ছে প্রতি তো এই মনে হচ্ছে ইহসান দ্বিতীয় বিয়ে করবে ওকে রেখে, এই ঘর থেকে বের করে দেবে ওকে। এসব অবশ্য ওর মাথায় এমনি এমনি ঢুকেনি। ঢুকিয়েছে শেফালি বুয়া আর মিতু। শেফালি বুয়া যদিও এমনি এমনি বলে, ‘ভাবিজান, পুরুষ মানুষ হইসে ছোঁকছোঁক করা জাতি। বৌয়ের প্রতি টানের থেইক্কা বাইরের মা* গো লাগি ওদের বেশি টান কাম করে। পোয়াতি বউয়ের কাছে শান্তি না পাইলে অদের ত্থুইয়া বাইরের বাসি বিরিয়ানিতেই মুখ দেওয়া ওগো স্বভাব। ভাবিজান আফনে ভাইজানের উপরে দখল রাইখেন। যদিও আমাগো ভাইজান এমুন না, তাও আপনে তারে বাঁইধা রাইখেন৷’

আর নিজের বোনকে ইহসানের গলায় ঝুলাতে না পেরে হিংসার জ্বলতে থাকা লিথুর বড়বোন মিতু সৃজাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, কার বর কাকে ছেড়ে গেছে প্রেগ্ন্যাসিতে সৌন্দর্য হারানোর ফলে, কে দ্বিতীয় বিয়ে করে বউকে তাড়িয়ে দিয়েছে, একসময় বউয়ের কথায় উঠবস করা বউপাগল লোকও কিভাবে বউকে দিনের পর দিন কাছে না পেয়ে পরকীয়ায় মেতেছে এসব নিয়েই ওর যত কথাবার্তা। একদিন তো খোঁচা মেরে সৃজাকে বলেই বসল, ‘ভাইয়া এহনো তোমারে আদর করে? সন্তুষ্ট হয়? আজকাল যে তার মুখটা শুকনো দেহি! দেইখো, আবার যেন অন্য কারোতে
না মজে।’

সৃজা অযাচিত কথা নিতে না পেরে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল ওর গালে। সম্পর্কে ইস্মি-সৃজা বড় হলেও বয়সে মিতু ওদের বড়। তাই অপমানটাও বেশ লেগেছিল মিতুর। এসব নিয়ে মিতু কম নাটক করেনি। কেঁদেকুটে একাকার করেছিল। অভিশাপ দিয়েছিল ওকে। সৃজা যদিও ম্যাচিউর আচরণ করার চেষ্টা করে তবুও কীভাবে কীভাবে যেন মাথায় ঢুকে গিয়েছিল মিতুর কথাগুলো। এরপর থেকে এই সন্দেহ করা রোগটা পেয়ে বসেছে ওকে। ইহসান কোনোভাবেই বোঝাতে পারে না নতুন করে রুপ খোলা এই মেয়ের প্রতি সে কতটা দুর্বল হচ্ছে দিনদিন, কতটা আকৃষ্ট হয় প্রতিবার। ছোট করে বুকে ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়, কামড়ে খেতে ইচ্ছে হয়। এসব বোঝাতেই পারে না সে।

“কার কথা ভাবছ?”

গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাটা শুনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ইহসান। সামনে ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সৃজাকে দেখে নড়েচড়ে উঠে বোতলের ক্যাপ খুলে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “পানিটা শেষ কর!”

সৃজা হাত বাড়িয়ে না নিয়ে শক্ত গলায় বলল, “আগে প্রশ্নের উত্তর দাও।”

ইহসান ধৈর্যহারা হয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। একহাতে টান মেরে কাছে এনে ঠেসে ধরলো বোতলটা ওর মুখে, “একটা কথা বলবি তো এখানেই পুঁতে দেব। চুপচাপ খা।”

সৃজা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পানিটা শেষ করল। না করে উপায় ছিল না। যেভাবে চেপে ধরেছিল তাতে রেহাই ছিলো না ওর। পানি খাওয়া শেষ হলে ইহসান ওকে ছাড়ল। দেখল অনেকটা পানি পড়ে ভিযে গেছে সৃজার গলা, বুকের ওড়না। সে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে কপাল চেপে ধরে বিড়বিড় করল, “শালা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করলে এমনেই মরবি।”

“এবার বলো কী ভাবছ।”

পানির বোতলটা রাগে ছুঁড়ে মারলো দূরে ইহসান। এরপর হুট করেই কোলে তুলে নিলো সৃজাকে। আতঙ্কিত হলেও সৃজা আঁকড়ে ধরলো ওর কলার। ইহসান রাগী গলায় সামনে এগুতে এগুতে বলল, “জীবনটা তেজপাতা করে দিচ্ছিস আমাকে। তোর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমি। বয়স হচ্ছে কুড়ির বেশি, ভাব ধরিস সদ্য পয়দা হওয়া মেয়ে মানুষের!”

সৃজা থমথমে চোখমুখ করে তাকিয়ে রইল। অভিমানে ওর কান্না পাচ্ছে। জানে, ইহসান কিছু করবে না তবুও মনে শ য় তা নে নাড়া দেয় ওকে। ও কী করবে? ঘরে এনে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলো ইহসান। সেদ্ধ ডিম দিয়ে তৈরি করা সালাদের বাটিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ শেষ করতে বলে চিরুনি নিয়ে বসলো ওর চুল আঁচড়ানোর জন্য। ঘন চুলগুলো খোঁপা মুক্ত করে সে কতক্ষণ মুখ গুঁজে রইল চুলের ভেতর। মিষ্টি সুঘ্রাণে বিমোহিত হয়ে গেল মুহূর্তেই। নাক ডুবিয়ে সে মাতোয়ারা কণ্ঠেই বলল, “তোর চুলগুলোতে নাক ডুবিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মরে গেলেও আফসোস থাকবে না আমার জান।”

“চুলগুলো কেটে ফেললে বেশি ভালো হতো। ভালো লাগছে না। গরম লাগে বেশি।”

“আগে তো আফসোস করতি টাক হয়ে যাচ্ছিস বলে, এখন কী? বাচ্চারা চুল এনে দিলো এখন রাখতে চাইছিস না। আশ্চর্য! শত্রুতা শুরু করেছিস দেখছি।”

সৃজা শুনে মুখ গোঁজ করে ফেলল এবারে। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই থেমে গেক পেটে হাত দিয়ে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, “বাচ্চারা নড়ে।”

“নড়ুক। তোকে আগে সামলাই পরে ওদের সামলাব।’’

“আমি কী বেশি জ্বালাই?”

“নিজেকে কর প্রশ্নটা।”

“আমার ওজন আরো এক কেজি বেড়েছে।”

“বাড়ুক, একশো ক্রস করুক। আমি তোকে কোলে নিয়ে হাঁটব, কোনো সমস্যা নেই।”

“তখন ঠিকই পরকীয়া করবে।”

আকাশ কাঁপিয়ে ধমকে উঠল ইহসান, “হুঁ, করব তো। অবশ্যই করব। তোকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিয়ে সুন্দরী, মোটাতাজা গাভী নিয়ে আসব। যার শরীরে ভরপুর মাংস থাকবে, জড়িয়ে ধরলে ফাঁকা জায়গা থাকবে না। যাকে পিষে মারতে বেশি মজা। ঘাসপাতা, পানি, যা দেব তাই খাবে বেশিবেশি। বুঝেছিস আহাম্মক! উফ আল্লাহ! আমি এই মেয়েকে কেন গলায় ঝুলালাম, এত প্যারা কেন দিচ্ছে আমাকে! হএ পরওয়ারদিগার, তুমি আমার অবুঝ বউকে বেশি
বেশি বুদ্ধি দান করে ম্যাচিওর করো, আমার আগের বউকে ফিরিয়ে দাও। আমার বাচ্চারা যেন একেকজন চারকেজি ওজনের হয়ে পৃথিবীতে আসে। এক হাজার
মিসকিন খাওয়াব আমি৷ আমার জীবন রক্ষা করো৷ আমিন!”

সৃজা বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে শুনে গেল কথাগুলো। হা হয়ে রইল। ঠোঁট নাড়িয়ে প্রতুত্তর করতে যাবে ইহসান ফট করে ওর মুখ বন্ধ করে দিলো ঘাড় টেনে। মিনিটখানিক পর ছেড়ে দিয়ে এরপর অসহায় গলায় বলল, “চুলটা বাঁধি? বকবকানিটা কম করে রেহাই দে অন্তত।”

অতঃপর সৃজা দ্বিরুক্তি করল না। ইহসান স্বস্তির শ্বাস ফেলে ওর চুল নিয়ে বসলো। কাঠের চিরুনিতে চুলের সব জট ছাড়িয়ে আস্তেধীরে তেল ম্যাসাজ করল, বেণী করে দিলো সময় নিয়ে। ততক্ষণে সৃজার অর্ধেক খাওয়া শেষ, অবশিষ্ট খাবারটা খেতে চাইলো না আর। জোর করেও পারা গেল না। ইহসান ওকে পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে এঁটো খাবারটা নিজেই নিয়ে খেল। খেতে খেতেই ওর ফোনে টুং শব্দে বেজে উঠল৷ ইহসানত তাতে অতো একটা গা করল না। দেখলও না কীসের ম্যাসেজ এটা। উদাসীন ভঙ্গিতে ধীরেসুস্থে খাবার
শেষ করে এরপর ঘুম দিলো সৃজাকে নিয়ে। অনেকটা সময় ঘুমিয়ে যখন সৃজার নড়াচড়ায় ঘুম ভাঙলো, ওয়াশরুমের কাজ সেরে এসে বেখেয়ালি হয়েই ফোনটা সে হাতে নিলো। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে এগারোটা। স্ক্রিনে ভেসে আছে একটা ভয়েজ ম্যাসেজ আর একটা ফোনকল। দুটোই রশিদের। ইহসান উদাসীন ভঙ্গিতে কল ব্যাক করল রশিদের, রেসপন্স পেল না। বন্ধ দেখালো। ইহসান খানিকটা চিন্তিত হয়ে এবার ম্যাসেজ চেক দিলো। ভয়েজ ম্যাসেজ, অন করতেই রশিদের উত্তেজিত ও দুর্বল গলা ভেসে এলো। যা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে বসলো, নিজের প্রতি রাগে কিলবিল করে উঠল সে। ভয়েজ ম্যাসেজের টাইমিং দেখাচ্ছে এখন থেকে আরো কয়েক ঘন্টা আগে। আর সে এটা দেখছে এই রাত সাড়ে এগারোটায়? ইহসান নিজের প্রতি রাগে, দুঃখে ফোনটা আছাড় মারলো মেঝেতে। ভয়েজটা তখনো বেজেই চলেছে, ‘ছোট স্যার ফ্ল্যাটে নাই স্যার, আমাকে মেরে চলে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।’

______

[রি-চেইক বিহীন এলোমেলো একটা পর্ব। দেরিতে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে….