#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব–৫৩
সৃজাকে রেখে এক মুহূর্ত দূরে যেতে চায় না ইহসান।ওর দায়িত্বও কারো উপর চাপাতে চায় না, অন্যের উপর একফোঁটা বিশ্বাস নেই ওর। নিজে যেভাবে নিঁখুতভাবে সৃজার কাজগুলো করে, অন্যকেউ সেভাবে করবে না। তাছাড়া এই মেয়ে নিজের প্রতি বড্ড উদাসীন। খেতে চায় না, জেদ করে। বাচ্চাদের মতো জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়। এসব নিয়ে সারাদিন চিন্তায় কাটানো ইহসান বুঝতে পারছে না ওকে একা রেখে ইনজানের খোঁজ করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না! মনটা যদিও একদম সায় দিচ্ছে না, তবুও সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। ইনজান যা শুরু করেছে তাতে কোনদিন কী ঘটনা ঘটায় কে জানে! এই বিকৃত মস্তিষ্কের ভাইটাকে নিয়ে সে আছে মহা যন্ত্রণায়। তখনকার ফোন কেটে যাওয়ার পর ইনজান আবারো ম্যাসেজ পাঠিয়েছে তাকে। সৃজার ক্ষতি করার হুমকি দিয়েছে। এসব নিয়েই ইহসান দুশ্চিন্তায় আছে। যতক্ষণ না ওকে একটা শিক্ষা দিতে পারছে ততক্ষণে অবধি ওর শান্তি নেই। লোকেশন যখন একবার ট্রেস করা গেছে, অতি শ্রীঘ্রই ওকে ধরা দরকার। নয়তো আবার কোথাও ঘাপ্টি মারবে কে জানে! এখন বাজছে রাত একটা। একটু পরই ইহসান বের হয়ে যাবে৷ সৃজা ঘুমিয়ে। নাইমুর সাহেব মারা যাওয়ার পর থেকে রাতে সৃজার গাঢ় ঘুম হয় না। বহুকষ্টে ঘুমালেও পুরোপুরি হয় না, ছাড়াছাড়া ঘুম হয়। একবার ডাকলে আর ঘুম হবে না সারারাত। ঘুমন্ত সৃজাকে এভাবে রেখে যেতে ওর মন সায় দিচ্ছে না। মনটা ‘কু’ ডাকছে। যদিও এসবে সে বিশ্বাস করে না তবুও কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। তবে কিছু করার নেই, যেতেই হবে। আর সৃজাকে না বলেই যেতে হবে। বলে গেলে মিথ্যে বলতে হতো, যা সে চায় না। শেফালি খালাকে অবশ্য বলা আছে, সে খেয়াল রাখবে সৃজার। ইহসান ছোট্ট একটা কাগজে নিয়ে তাতে নোট লিখল, ‘আমি খুবই দুঃখিত একটা দিন তোর খেয়াল রাখতে পারছি না তাই। এই একটা দিন আমার হয়ে আমার সৃজার খেয়াল রাখিস সোনা।একটা কাজে বেরুলাম, খুব দ্রুত ফিরে আসব।’
— তোর ইহসান।
★ তুই ঘুমিয়েছিলি, বলে যেতে পারলাম না তাই ফিরে এলে কান মলে দিস। ‘টু’ শব্দও করব না।
নোটটা বেড সাইডে গ্লাসের নিচে চাপা দিয়ে রাখলো ইহসান। ঘুম থেকে উঠে সৃজা পানি খায়, ওর খোঁজ করলে তখন নোটটা পাবে। ইহসান ওটা রেখে সৃজার কপালে চুমু খেয়ে শেফালি বুয়াকে ডেকে এনে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
বাইরে ঝড়ো আবহাওয়া। ঠান্ডা বাতাসে সবকিছু শীতল হয়ে আছে। একটু ঠান্ডা লাগতেই ঘুম হালকা হয়ে গেল সৃজার। তবে চোখ খুলল না। ঘুমের ঘোরেই ধীরেধীরে পাশ ফিরে শুতে শুতে ইহসানকে ডাকলো, “ইহসান ভাই, শুনছ? পানি খাব!”
ইদানীং ঘুমের মধ্যে গলা শুকিয়ে যায় সৃজার। কয়েকবার উঠে পানি খাওয়ায় ইহসান। সাথে দু-একটা ফলও জোর করে খাওয়ায়। নিত্যদিনের কাজ এটা। অথচ আজ ইহসান ডাকেনি ওকে। সৃজা গুঙিয়ে উঠে আবার ডাকল ইহসানকে, তবে এবারেও সাড়াশব্দ পেল না। সৃজা পাশে হাত বাড়াল। হাতড়ে হাতড়ে ইহসানকে খুঁজল, ছোঁয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হাতে কিছুই ঠেকল না, পাশটা ফাঁকা অনুভব হলো। এবারে সৃজা চোখ খুলে চাইল। বেডসাইডে জ্বলা আধো-আলোতে দেখল পাশটা শূন্য, ইহসান বিছানায় নেই। সৃজার ভাবল হয়তো বাথরুমে গেছে। তাই এতো বেশি মাথা ঘামাল না, অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু এক মিনিট, দু-মিনিট, তিন মিনিট…একে একে মিনিট বিশেক কেটে যাওয়ার পর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সৃজার ভ্রু কুঁচকে গেল। এতো সময় তো লাগার কথা নয়! কোথায় গেল মানুষটা? কিছু কী হয়েছে? সৃজা দু’বার ডাকল ওর নাম ধরে। কিন্তু সাড়াশব্দ, প্রতুত্তর নেই। এবারে চিন্তিত হয়ে সাবধানে পেটে হাত চাপা দিয়ে উঠে বসলো সে। ওকে রেখে রাতে কোথায় এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায় না ইহসান। কখন, কী লাগে এই ভেবে বেশিরভাগ নির্ঘুম রাত কাটায়, সারাক্ষণ অস্থির থাকে। চাওয়ার আগেই সব হাজির করে। কিছু করতে দূর একা একা বিছানা থেকে নামতেও দেয় না। যা করে সব নিজে করে। চোখের আড়ালে যায় না। আজ তাহলে কী হলো? এতোটা সময় অবধি সাড়া নেই। সৃজা এদিকওদিক তাকিয়ে ঘড়ি দেখল। এরপর ঠিক করল ঘরের বাইরে দেখে আসবে, এতোরাতে ওকে না বলে কোথায় গেল মানুষটা! সৃজা বিছানা থেকে নামতে যাবে তার আগেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল খানিকটা, নিচে মাদুর পেতে শেফালি খালাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। এতরাতে খালা এইখানে? মানে কী? সৃজা হতভম্ব হয়ে খালাকে ডাকল কয়েকবার। কিন্তু সারাদিন ফায়-ফরমাশ খেটে ক্লান্ত শরীরটা গাঢ় ঘুমে ডুবে থাকায় ওর ডাক শুনতে পেল না। সৃজা হতাশ হলো। হয়তো ক্লান্ত তাই গভীর ঘুমে আছে। ডাকবে না আর ভাবলো। গলা শুকিয়ে আছে, পানি খেয়ে নিজেই একবার দেখে আসবে ইহসান কোথায়। বেডসাইড থেকে গ্লাসটা নিতে গিয়েই চাপা দিয়ে নোটটা পেল সে। ভ্রু কুঁচকে তুলে এনে সেটা পড়লো এরপর বিচলিত হলো। এভাবে না বলে, ঘুমে রেখে কোন কাজে
গেল ইহসান? এজন্যই খালাকে দিয়ে গেছে? অভিমান হলো সৃজার! আনমনে পানির গ্লাসটা নিতে যাবে হাত ফসকে পড়ে ভেঙে গেল সেটা। শব্দ হলেও শেফালি বুয়ার ঘুম ভাঙল না। বাধ্য হয়ে সৃজা নামলো। মেঝেতে পা স্পর্শ করল বটে তবে পরক্ষণেই ঘটনাটা ঘটল! বেড সাইডের হলদে আলো-আঁধারিতে চোখ না সওয়ায় স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে কদম ফেলতেই পানিতে পিছলে মাদুরের ভাঁজে পা বাঁধল ওর। পা দু’টো পিছলে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আতঙ্কে চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেল সৃজার। তৎক্ষনাৎ বেডসাইড ড্রয়ারের হাতল ধরার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারল না নিজেকে। বরংচ বেডসাইড টেবিলটার টান খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। উপরে থাকা ল্যাম্পটা সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ঘরটাও আঁধারে ডুবে গেল। সেইসাথে সৃজার শরীরটা আছড়ে পড়ল মেঝেতে। কোমড়সহ পেটে আঘাত লাগল, ডান পা মচকে গেল। চোখদুটো বুজে পেটে হাত দিয়ে তীব্র ব্যথায় সৃজা চিৎকার করে উঠল।
শব্দ আর চিৎকার শুনে শেফালি বুয়া ধরফড়িয়ে উঠলেন। চোখ কচলে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অন্ধকারে কিছুই গোচর হলো না। তার কানে শুধু সৃজার আর্তনাদের শব্দ ঠেকল। শেফালি বুয়া কিছুই বুঝে উঠলেন না, ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। হাতড়ে হাতড়ে কিছু একটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে
করতে বললেন, “কী হইসে ভাবিজান? সব এমুন আন্ধার হইয়া আছে ক্যান? আমি বাত্তি জ্বালাইতাছি।”
বলতে বলতে আন্দাজে সে উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালাল; এরপরই হতবাক হয়ে গেল। বিছানার পাশেই মেঝেতে পড়ে আছে টেবিল, ভাঙা কাচের ল্যাম্প, পানির গ্লাস, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঔষধের বক্স, চামচ ইত্যাদি। আর সৃজার অবস্থা তো ভয়াবহ। ব্যথায় চোখমুখ নীল হয়ে এসেছে মেয়েটার। সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে পেট চেপে, পা গড়িয়ে তরল গড়াচ্ছে। শেফালি বুয়ার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। একছুটে গিয়ে ধরল সৃজাকে। কেঁদে ফেলল নিমিষেই। ধীরেধীরে সৃজাকে তোলার চেষ্টা করতে করতে বিলাপের সুর তুলল, “আল্লাহ গো! এইডা কী হইসে? বেশি কষ্ট হইতাছে গো ভাবিজান?”
সৃজা চোখে সব অন্ধকার দেখছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর। পেটে তীব্র চাপ, মোচড়ানি আর কাঁপুনি। ব্যথায় আর্তনাদ করছে, অথচ কথা বলার শক্তি নেই ওর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চটচটে রক্তে ওর পা ভিজে গেছে। আচ্ছা, বাচ্চারা কী ঠিল আছে? সৃজার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, সে দুনিয়ায় নেই।
এদিকে এতোরাতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ইস্মির বদৌলতে বাড়ির সকলে জেগে গেছে। জড়ো হয়েছে বাইরের দরজায়। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। শেফালি বুয়া এতক্ষণ এতোটাই হতভম্ব হয়েছিলেন যে, বাড়ির কাউকে যে ডাকবে এ ব্যাপারটাও তার মাথায় আসেনি। জোরালো শব্দ শুনেই তা-ই সে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। বাইরে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইজহান-ইস্মি, ইমরান-মিতু, আজিজ শেখ-সালেহা বেগম, রান্নার বুয়া, মকবুলের মা। শেফালি বুয়া তাদের দেখে বিলাপ শুরু করল, “ও চাচাজান, ও ভাইজান গো, ভাবিজানের দ্যাহেন কী হইসে? কেমন করতাছে! আল্লাহ গো! কী সর্বনাশ হইছে!”
তার কান্নাকাটি দেখে বকতে গিয়েও থেমে গেল ইজহান, ইমরান আর আজিজ শেখ। বিচলিত হয়ে থাকা ইস্মি আর সালেহা বেগম হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন। মিতুও ঢুকল। সালেহা বেগম সৃজার অবস্থা দেখে মুহূর্তেই ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। ইস্মি ছুটে গিয়ে সৃজাকে ধরল, ততক্ষণে ভারসাম্য হারিয়েছে সৃজা। ইজহান ভেতরে ঢুকে এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল, আজিজ শেখ রাগে কাঁপতে কাঁপতে শেফালি বুয়াকে ধমকে উঠলেন, “এই হারামির বাচ্চা, এই অবস্থা কী করে হইলো ওর?”
“আমি নিচে ঘুমাই আছিলাম, হঠাৎ শব্দ শুইন্না উইঠা দ্যাহি ভাবিজানের এই অবস্থা…”
“ইহসান কই? তুই এতরাতে এইখানে কী করছিলি?”
“ভাইজান কই জানি গেসে, আমারে কইয়া গেসিল ভাবিরে একটু দেইখা রাখতে… আমি পারি নাই গো চাচাজান। কী জবাব দিমু, আমারে মাইরা ফালাইব ভাইজানে…”
“ওয় কী করব? আমার নাতি-পুতির কিছু হইলে তোরে আমি নিজেই মারমু ফকিন্নির ঝি…”
কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ শেফালি বুয়ার। আজিজ শেখ পারেন না তাকে চিবিয়ে খেতে। তিনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন। এদিকে ইজহান সৃজার অবস্থা দেখে ঢোক গিলছে বারবার! তার মাথা ঘুরাচ্ছে। সবার আর্তনাদে সেও চোখে সব অন্ধকার দেখছে। যেমন দেখছিল, তাদের প্রথম বাচ্চাটার বেলায়! এরকমই হয়েছিল ইস্মির সাথে…সে প্রচন্ড ধাক্কায় ইস্মিকে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল! ইজহান দরজা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল, চোখ খুলে আচমকা ভঙ্গুর গলায় চিৎকার করে উঠল, “আমি গাড়ি বের করছি, ওকে হসপিটালে নিতে হবে ইমিডিয়েটলি…”
.
সাড়ে সাত মাসের টু-ইন প্রেগ্ন্যাসি। ব্লাড প্রেশারের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পেশেন্ট। পেট বড়ো হয়নি পর্যাপ্ত। পায়ে পানি এসেছে, ওজন বেড়েছে। বাচ্চারা এখনো পরিপুষ্ট হয়নি, সঠিক সময় আসেনি দুনিয়ায় আসার। অথচ আজ এতবড়ো দুর্ঘটনা! বিচলিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে সবাই। সৃজার ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন, টেস্ট রিপোর্ট এখনো আসেনি। তবে আপাতদৃষ্টিতে যা দেখেছেন তাতেই অবস্থা ভয়াবহ! ডাক্তাররা ধারণা করছেন সবকিছু ঠিক নেই। এক্ষুনি ও.টি রেডি করতে হবে। প্রি-ম্যাচিউর বেবি। এন.আই.সি.ইউ’তে রাখতে হবে। তবে অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, মা-বাচ্চাদের মধ্যে যে কাউকে বেছে নিতে হতে পারে! এবং এটা নিয়েই আজিজ শেখের সাথে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে ডাক্তার এবং ইজহানের! তিনি চাইছেন যে-কোনো অবস্থাতে তার নাতি-নাতনি যেন ঠিক থাকে, সৃজার কী হলো না হলো, মরলো না বাঁচলো তাতে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ইজহান আর ডাক্তাররা এর ঘোর বিরোধিতা করছে। তাদের এক কথা, এমন সিচুয়েশনে মা-বাচ্চার মধ্যে মা’কেই প্রায়োরিটি দেবেন তারা। ইজহান বাবার একচোখামো আর স্বার্থপরতা দেখে তার উপর চরম ক্ষিপ্ত! রাগে লাল হয়ে গেছে সে। এ কেমন মানুষ? কোন বোধে এই লোক ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে এমন কথা বলতে পারে? সৃজার জায়গায় ইস্মিতা হলেও কী বাবা এমন করতো? ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতো? ইজহান ভাবতে পারছে না কিছু। তার এক কথা, যদি তার বাবা নিজের বংশধর রক্ষার জন্য স্বার্থপর হোন, তাহলে তারচেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।
.
শূন্য বাড়িতে কাজের লোক আর মিতুর ভরসায় ইস্মিকে রেখে আসতে পারেনি ইজহান। সালেহা বেগমের সাথে সেও এসেছে। একটা কেবিন বুক করে দিয়েছে ইজহান। সেখানেই অস্থিরতা নিয়ে বসে আছে তারা। বাবার উপর চোটপাট করে ইজহান কেবিনে এসে দেখল ইস্মি ফোনে ব্যস্ত। দেড় ঘন্টা যাবৎ সে চেষ্টা করছে, ইহসানের নাম্বারে। কিন্তু ফোন ঢুকছে না। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তিত ইস্মি ইজহনের দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বোঝাল, ইহসানকে এখনো রিচ করতে পারেনি সে৷ অস্থির হলো ইজহান, মেজাজটাও খারাপ হলো ভীষণ। চেয়ারে একটা লাত্থি বসিয়ে সে মাথা চেপে ধরল। কু* বাচ্চাটা এতরাতে, কাউকে কিছু না বলে কোন ক্ষেতে মূলা খেতে গেল যে নেটওয়ার্ক লাগছে না? আরে বাবা, তুই বাপ হতে যাচ্ছিস, তোর বউ-বাচ্চা মরতে বসেছে…এতদিন তো যাসনি বউ ছেড়ে, আজই গেলি আর এমন বিপদে পড়তে হলো! দুনিয়ার যত নোংরা গালিগালাজ জানা ছিল সব ছুঁড়তে লাগল সে ইহসানকে উদ্দেশ্য করে। ইস্মি হতভম্ব হয়ে গেল। ইতোপূর্বে সে যত খারাপ অবস্থায়ই পড়ুক, এ ধরণের অশ্লীল, নোংরা গালাগালি কখনো শোনেনি ইজহানের মুখে। সে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে।
.
ইনজানের বাংলোতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেল ইহসানের। পৌঁছে সে কতক্ষণ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। মোজাইকের দেয়ালে বহুদিনের পুরোনো নেমপ্লেটের দিকে চোখ পড়তেই সে থমকে গেল ‘অরণ্যবীথি’ নামটা দেখে। থমকানো ভাবটা কাটতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। তবে শান্ত থাকার চেষ্টা করল। লোহার গেইটটা ভেতর থেকে বন্ধ। ইহসান কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করবে বুঝতে পারল না। সঙ্গী করে যাদের এনেছে তাদের মধ্যে একজন বলল সে প্রাচীর বেয়ে ভেতরে গিয়ে গেইট খুলে দেবে। সবাই তাতেই রাজি হলো। ইহসান মাথা নাড়তেই লোকটা রাস্তার পাশের একটা আমগাছ বেয়ে উঠে গেল। বেশিক্ষণ সময় নিলো না, দ্রুতই গেইটটা খুলে দিলো। ইহসান তাদের সবাইকে একসাথে ভেতরে যেতে বারণ করল, প্রথমে সে যাবে। পরিস্থিতি বুঝে উল্টাপাল্টা কিছু হলে বাকিরা যাবে। সবাইকে সব বুঝিয়ে ধীরেধীরে ‘অরণ্যবীথির’ ভেতরে প্রবেশ করলো সে। ঘাস মাড়ানো বিশাল লন পাড়ি দিতে দিতে ওর মানসপটে ভেসে উঠল মায়ের মুখটা! এই বাংলোতেই বন্দি ছিল চারমাস তার বাবার কাছে! অকথ্য যন্ত্রণার শিকার হয়েছিল এই বাংলোতেই।
আর ইনজানটাও ঘাপ্টি মেরে আছে এখানে, সে কী জানে এ ব্যাপারটা? ইহসান রাগ চাপা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে চমকে গেল তখনই যখন নীতিনকে দেখল ক্রাচে ভর দিয়ে তড়িঘড়ি করে ভেতরে যাচ্ছে, মুহূর্তেই ছুটে গিয়ে ওকে এক লাত্থিতে নিচে ফেলে দিলো। ক্রাচের সাহায্য নিয়ে হাঁটাচলা করা নীতিন চোখের সামনে ইহসানকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ইহসান ওর কোমড়ে লাথি বসিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুই এখনো ওর সাথে আছিস? পায়ের জোর নেই, লুলা হয়ে আছিস এরপরেও ওর সঙ্গ দিচ্ছিস বাস্টা*? তোকে জানে বাঁচিয়ে একটুও লাভ হয়নি দেখছি!”
নীতিন ব্যথায় চিৎকার করে উঠল৷ ভয়ে চুপসে গিয়ে বলল, “মাইরেন না ভাইজান…মইরা যাব আমি!”
“তোর মরাই উচিৎ।”
“বিয়া করি নাই এহনো ভাইজান, একটা বউ নাই আমার৷ লুলা কইরা দিসেন কেডায় আমারে বিয়া করব?”
নীতিন চিৎকার শুরু করল। ইহসান রাগান্বিত স্বরে বলল, “ডাকাতের মতো চেহারা তোর, এমনিতেও মেয়ে দিবে না কেউ। ভয়েই মরে যাবে৷ লুলা করে আমি বরং পূণ্যের কাজ করছি। এখন বল হারামিটার সঙ্গ ছাড়িস নাই কেন? আমি ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম না?”
সবাই চেহারা ছবি দেখে নীতিকে কালো বলে, হুদকা বিলাই বলে, ডাকাত বলে। ছোটোবেলার কালো হওয়ায় কালু ডাকলেও কেউ ডাকাত বলতো না৷ বড় হয়ে যখন টুকটাক অপরাধে জড়িয়ে গেল, গা জা খাওয়ার বদৌলতে যখন টকটকে লাল হয়ে গেল চোখ, তখন থেকেই সকলে ওকে ডাকু নীতিন বলে ডাকে৷ তবে ইনজান স্যার বেশ ওর ডাকাত মার্কা চেহারার বেশ প্রশংসা করে তার সেনাপতি হওয়ার অফার করেছিল। অফারে রাজি হওয়ায় দুটো লুঙ্গি কিনে দিয়ে ফাইভ স্টারে নিয়ে খাইয়েছিল ইনজান, সোনারগাঁও হোটেলে স্যুট-টাই পরে সাহেব সেজে নরম বিছানায় এক রাত কাটিয়েছে সে। ছোটো স্যারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুইমিংপুলে ছবি তুলেছে। ফর্সা, সুদর্শন ছোটো স্যারের এই ব্যবহারে কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল নীতিনের মনটা। আর কেউ যেই দাম তাকে দেয় না, ছোটো স্যার দিচ্ছে। প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কখনো অবাধ্য হবে না ছোটো স্যারের। ওসব টুক টাক মার খেয়ে বড়ো ভাইজান কীভাবে ভাবলো, সে ইনজান স্যারের সঙ্গ ছেড়ে দেবে? পা গেছে যাক, হাত গেলেও যাক, প্রাণ গেলেও যাক! ছোটো স্যারের সঙ্গ সে আজীবন দেবে। মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নীতিন চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে ইহসানকে বলল, “কাজকাম পাই না, পেট চালাইতে ছোটো স্যারের সঙ্গ দিতাছি বাধ্য হইয়া ভাইজান…”
নীতিনের কাহিনী সবটা জানে ইহসান। তাই ওর কথা বিশ্বাস করল না। চুলগুলো মুঠোবন্দি করে টেনে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “তোকে আমার চেনা আছে।
তুই হচ্ছিস নেড়ী কুত্তা। ছোটো স্যারের ডানহাত তুই। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে ওর সঙ্গ ছাড়াতে পারিস না সেসব কাহিনী বেশ জানা আছে আমার৷ এখন বল, ইনজান কই?’’
চুলে টান খেয়ে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে নীতিন বাধ্য হয়ে বলে দিলো, “উপরের ঘরে…”
ইহসান ওকে ছেড়ে দিয়ে পা বাড়ালো ভেতরে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে নীতিন ডেকে অসহায় গলায় বলল, “সারা শইল্যে ছোটো স্যারের বেদনা…রাইতে ঘুমাইতে পারে নাই। আপনে কী করবেন…”
ইহসান জ্বলন্ত চোখে নীতিনকে একবার দেখল এরপর এসে চোয়াল বরাবর ঘুষি বসালো, “এত দরদ দেখাবি না, চুপচাপ থাক হারামি।”
বলে উপরে চলে গেল। মাথা গরম অবস্থায় সবগুলো ঘর খুঁজল একে একে। ইনজানকে পেল একেবারে শেষ মাথার ঘরটায়। দরজা চাপানো ছিল। ইহসান ঠেলে ঢুকলো। ঢুকেই নাক চেপে ধরল সে। ম দের বিশ্রি গন্ধ ভাসছে। এসি অন করা। ইনজান এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে উদোম গায়ে। বুকের নিচে বাঁধাই করা বড় একটা ছবি, ইহসান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে ছবিটা টেনে বের করে হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে গেল। সৃজার একটা ছবি, তাও অনেক বছর আগের। ওর ছবি বুকে করে ঘুমাচ্ছে ইনজান? ইহসানের মাথায় তড়তড় করে রক্ত উঠে গেল। তার বউয়ের ছবি নিয়ে, তার ঘুম হারাম করে ইনজান এখানে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে? পকেট থেকে হ্যান্ডগা-নটা বের করে উদোম, ফর্সা পিঠে হ্যান্ড-গানের নলটা ঠেকালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“দিব? দেই? চিরশান্তির ঘুমে পাঠিয়ে দেই?”
______
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব–৫৪
ইহসান মাথা গরম অবস্থায় সবগুলো ঘর খুঁজল একে একে। ইনজানকে পেল একেবারে শেষ মাথার ঘরটায়। দরজা চাপানো ছিল। ইহসান ঠেলে ঢুকলো। ঢুকেই নাক চেপে ধরল সে। ম দের বিশ্রি গন্ধ ভাসছে। এসি অন করা। ইনজান এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে উদোম গায়ে। বুকের নিচে বাঁধাই করা বড় একটা ছবি, ইহসান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে ছবিটা টেনে বের করে হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে গেল। সৃজার একটা ছবি, তাও অনেক বছর আগের। ওর ছবি বুকে করে ঘুমাচ্ছে ইনজান? ইহসানের মাথায় তড়তড় করে রক্ত উঠে গেল। তার বউয়ের ছবি নিয়ে, তার ঘুম হারাম করে ইনজান এখানে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে? পকেট থেকে হ্যান্ডগা-নটা বের করে উদোম, ফর্সা পিঠে গানের নলটা ঠেকালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “দিব? দেই? চিরশান্তির ঘুমে পাঠিয়ে দেই?”
কর্কশ কণ্ঠ আর সূক্ষ্ম কিছুর খোঁচা পিঠে লাগতেই একটু নড়ল ইনজান। তবে উঠে গেল না। কপালে লেপ্টানো চুলের ভাঁজ থাকা ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল তার। বিরক্ত দেখাল তাকে। বন্ধ চোখের পাতা না খুলেই সে অস্পষ্ট শব্দ করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “নীত! সিরিঞ্জ আর ডিংক্স রেডি রাখ, উঠেই এক সিপ নেব। গা ব্যথায় জন্য রাতে জমেনি। রাগ হচ্ছে আমার… ”
ইনজানের কথাগুলো শুনে ইহসান মোটেও অবাক হলো না। এসবের সঙ্গে সে পরিচিত। ভাইয়ের ব্যবহার তার জানা। তবে অবাক না হলেও সে বিরক্ত হলো প্রচন্ড। হ্যান্ডগানটা আরো জোরে চেপে ধরল ওর মেরুদন্ড বরাবর, এরপর সেটা ধীরেধীরে ওর সম্পূর্ণ পিঠ, ঘাড় বেয়ে মাথার পেছনে ঠেকাল। এরপর ওর কানের কাছে গিয়ে নিম্ন স্বরে বলল, “অনেকক্ষণ হয়েছে আমি তোর ডেরায় এসেছি, ওয়েলকাম না করে পরেপরে ঘুমাচ্ছিস! রাগ তো আমারও হচ্ছে জান! আমার বউয়ের ছবি তুই বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিস…ইচ্ছে তো করছে তোর শরীরের প্রতিটা হাড়-মাংস জ্বালিয়ে নিজেকে শান্ত করি। তুই কী উঠবি, না কি এভাবে ঘুমিয়ে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবি?”
কানের কাছে নিঃশ্বাসের গরম ছোঁয়া আর অতি পরিচিত, আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বরের হুমকি শুনতেই ইনজান চোখ খুলে তাকাল। তাকাতেই শক্ত, গম্ভীর ও রাগান্বিত চেহারাটি ওর চোখে অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো। ঘুমের রেশ না কাটায় কয়েকবার চোখ কচলে নিয়ে এরপর শীতল কণ্ঠে বলল, “এভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব? সিল্লি না?” ইনজান ঠোঁটের কোণে একটুকরো ব্যঙ্গ হাসি টেনে নিয়ে চোখে চোখ রাখল ইহসানের। “ব্রো, তুমি চাইলে গুলি করতে পারো… বাট ফ্রম হোয়ার আই স্ট্যান্ড, মরে গিয়ে তোমার হিরো বানানোর শখটা পূরণ করতে পারব না। আর ল্যাভেন্ডারের ছবিটা বুকের নিচে ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা শুয়ে ঘুমোনোর জন্য না, ভেতরের আগুনটাকে জিইয়ে রাখার জন্য।”
ইহসান গর্জে উঠল, “তুই কী বলছিস ঠিক করে বল!”
এবার আস্তে করে উঠে বসল ইনজান। চাদর না গায়ে দিয়ে এলোমেলো চুলে, উদোম গায়ে হালকা এক নেশাগ্রস্ত অথচ হিমশীতল চাহনি নিয়ে ওর দিকে তাকাল, “তুমি জানো না, আমার ভেতরের একেকটা হাড়, একেকটা শিরা, ল্যাভেন্ডারের নাম ধরে হাঁকে রাত-বিরেতে। আমি একজন এডিক্টেড। ড্রা গ স
এবং ল্যাভেন্ডারে! দুটোতেই আসক্ত…”
ইহসান সটান ওর কপালে গানটা এবারে চেপে ধরে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখল। রাশভারি স্বরে সে স্বগোতক্তি করল, “আর আমি শুধুই ওর প্রতি আসক্ত!”
“গ্রেট জব!”
“আমার আসক্তিকে দুর্বলতা ভেবে বারবার ভুল করেছিস তুই।”
“ভুলের শাস্তি দিতে চলে এসেছ?”
বিকৃত চাহনিতে ইনজান তাচ্ছিল্যভরে তাকাল। যেন মজার কথা শুনেছে, এমন করে দুলে দুলে হাসলো সে। ইহসান পুরো সময়টা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওকে এমন প্রতিক্রিয়াহীন দেখে থেমে গেল ইনজান। চোখের দৃষ্টি প্রথমে তাক হলো ব্যারেলে, এরপরই ভাইয়ের মুখের দিকে। ইহসানের চোখদুটো তখ উদ্বেলিত। ছলছল করছে যেন এক সমুদ্র জলে। ইনজান বুঝতে পারল না সেটা রাগের কারণ, না কি স্নেহের পরশ! বিভ্রান্তি নিয়ে পাশে থাকা একটা কাচের গ্লাস চেপে ধরল হাতের মুঠোয়। গমগমে কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “তুমি কী পেয়েছ ওর মধ্যে? কেন ছাড়তে পারছ না ওকে আমার জন্য?”
“জীবন খুঁজে পেয়েছি। পরিপূর্ণ জীবন। যে জীবনে ও একমাত্র আমার নিজের কেউ, যাকে আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে দাবি করতে পারি, অধিকার দেখাতে পারি। অথচ একটু অভিযোগ না করেও ও আমার সব দাবিদাওয়া মেনে নিতে পারে সেই জীবন। সৃজা একদম আমার নিজের। লিখিত, অলিখিত সবভাবেই। ও আমাকে ভালোবাসা-সম্মান দিচ্ছে, নিঃস্বার্থভাবে। আমাকে আমার পরিচয় দিচ্ছে, আমার বাচ্চাদের নিজের গর্ভে ধারণ করেছে, জানিস তুই? এটা কতবড় উপহার আমার জন্য? আমার অশুদ্ধ রক্তকে ও শুদ্ধ করে দিচ্ছে, সব কলঙ্ক মুছে দিচ্ছে—ওদের দ্বারা। ও যখন জেনে গেল, আমি একটা অশুদ্ধ মানুষ। ওর চোখে আমার জন্য করুণা, ঘৃণা ভাসেনি। বরং আমার প্রতি ওর ভালোবাসা আর দৃষ্টি গাঢ় হতে দেখেছি। আমাকে হারানোর ভয় পেতে দেখেছি।
আর এজন্যই ও আমার আসক্তি, ভালোবাসা সব।
ওকে ছাড়া সব কেমন দুঃস্বপ্ন লাগে, এই দেখ,
তোকেও লাগছে!”
কঠোর এবং পরিপক্ক স্বরে কথাগুলো বলে একটু থেমে ইহসান এবারে নিচু গলায় বলল, “এভাবে আগলে রাখার, সম্মান দেওয়ার, ভালোবাসার এমন কেউ তোর নেই, আমার আছে। আর ওটাই তুই নিতে পারিস না ইনজান! সেই ছোটো থেকে তোর লোভ আর আকৃষ্টতা আমার সব জিনিসের প্রতি। অথচ তুই কখনো অর্জনই করার চেষ্টা করিসনি, চেয়েছিস আদায় করে নিতে। যার জন্য তোর অবস্থান আজকে এখানে, একজন নিঃস্ব’র মতোন। ইজহানের তো তাও ইস্মিতা আছে, যতোই পাগলামি-ছাগলামো করুক নিজের আপন কাউকে লোফারটা খুঁজে নিয়েছে। অথচ তুই আমার জিনিস কেড়ে নেওয়ার ধান্ধায় থাকতে থাকতে এমন পর্যায়ে গেছিস যে বাপ নামক নোংরা লোকটা ছাড়া আপন কাউকে খুঁজেই নিতে পারিসনি। আর এখানেই তুই জীবনে গো হারা হারলি এবং এভাবেই হারবি…শুধুমাত্র তোর এই নোংরামোর জন্য!”
ইনজানের আচরণ অস্বাভাবিক। দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ। কাঠিন্যতা ভর করেছে সুদর্শন মুখটাতে। চোয়াল জোড়া শক্ত। রক্তাভ হয়ে গেছে চোখ। এ কথাগুলোকে সে ঘৃণা করে, যতোটা ঘৃণা করলে একজন মৃত নারীকে জীবিত করে তাকে আবারো
ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে, ঠিক ততোটাই। নেই,
নেই এবং নেই— শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত, ত্যক্ত বিরক্ত। ইনজানের হাতের চাপ শক্ত হলো৷ গ্লাসটাকে সে ততক্ষণ চেপে ধরে রাখল যতক্ষণ না সেটা বিদীর্ণ হলো। এরপর প্রচন্ড জোরে আচমকা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারল, নিস্তব্ধ ঘরটাতে বজ্রপাতের মতো বাজল শব্দটা। গ্লাসটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে এসে পড়ল ওর চোখেমুখে। ইহসান তীক্ষ্ণ চোখে চুরমার হওয়া গ্লাসটা দেখে নিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ইনজানের দিকে তাকাল। ঠোঁটে রক্ত আর চোখে আগ্রাসী রাগ নিয়ে ইনজান তখন কাঁপছে। কণ্ঠস্বরে উন্মত্ততা,
“আর আমার তোমার সেসব কিছুই চাই যেগুলো তুমি আমার হতে দাওনি। যেগুলো আমারও পাওয়ার কথা ছিল, অথচ তুমি একা পেয়েছ।”
ইহসান বাঁকা হেসে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলো, গানটা এবারে ঠিক বুকের বাঁপাশে ঠেকিয়ে বলল, “সারাজীবন তোরা আমাকে এরজন্যই হিংসা করে গেছিস অথচ চেষ্টাও করিসনি সেগুলো অর্জন করার। আজ যেসব আমি পেয়েছি আর পাইনি, নিয়তিতে লিখা ছিল বলেই। যেমন ধর, সৃজা! নিয়তি ওকে আমার জন্য বরাদ্দ করে রেখেছিল বলেই ওকে আমি পেয়ে গেছি! আর নিয়তি যখন নিজের কাজ শুরু করে, তার পথকে কেউ থামাতে পারে না। সৃজা আমার৷ আমারই থাকবে।”
ইনজান হালকা হেসে বলল, “খুব নিয়তির গল্প করছ না? তাহলে শোনো… নিয়তির একটা জঘন্য দিক আছে, সে কাউকে চিরকাল একজায়গায় রাখে না। যেমন তুমি ভাবছো, তোমার বউ তোমারই থাকবে, এমনও হতে পারে নিয়তি একদিন তাকে তোমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কারো বুকে তুলে দেবে। তখন আমার আজকের অবস্থান, এই শূন্যতা তুমি খুঁজে পাবে নিজের মধ্যে।”
“একটা প্রবাদ আছে, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। অনেকবার প্রমাণ পেয়েছি। তাই আমি একটুও ভয় পাচ্ছি না ইনজান।”
“তোমার সৃজা তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে, তোমার
ভাই তার সুযোগ নেবে, এই ভয় তো ঠিকই পাচ্ছ!”
ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই নিজের কল্পনায় বাস করিস, ইনজান! আমি কখনোই ও হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে তোকে ভয় পাই না। তুই ওর ক্ষতি করে দিবি বলে ভয় পাই। রিয়েলিটিতে যদি সৃজা জানে
যে, আমার ছোটোভাই তোর মতো কোনো কুলাঙ্গার! তাহলে ওর গা গুলিয়ে উঠতো। তাই বিকৃত চিন্তাভাবনা আর হিংসায় জ্বলা জিভ দিয়ে আমার বউয়ের নাম উচ্চারণ করবি না!”
“তাই?” ইনজান আবার ব্যঙ্গ করল, “খুব জ্বলে? অধার্মিক মনে হয় আমাকে? খুব নিকৃষ্ট লাগে? আচ্ছা, তুমি কী ইনসিকিউরড ফিল করছ যে, তোমার বাচ্চাদের মা আমার হ্যান্ডসামনেসের প্রেমে পড়ে যায় তাহলে..”
ওর নোংরা কথাটা শেষ হতে দিলো না ইহসান। ঘৃণাভরে বলল, “ও যদি কোনোদিন তোর দিকে তাকায়ও, সেটা ঘৃণা এবং ঘৃণাই হবে… ভালোবাসা
তো দূর কি বাত।”
ইনজান কপালে হাত দিল, ওর চোয়াল কাঁপছে ভয়ানক রাগে। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে বলল, “ভালোবাসা আর ঘৃণার মাঝখানে একটা রেখা আছে ব্রো, সেখানেই আমি দাঁড়িয়ে থাকব না হয়! দেখব কী আছে ওর মধ্যে, কেন ঘায়েল তুমি ওর প্রতি…ওর মা’কে কিন্তু আমার ভারী পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু বেচারি আমার এতো ভালো প্রস্তাব না মেনে অকালে প্রাণটা খোয়ালো। অথচ প্রস্তাবটা মানলে চারটা ছেলের মা হতো, আমরা একটা মা পেতাম। ল্যাভেন্ডার আমাদের বোন হতো, তখন ওকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো না আমাদের, দু-ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো থাকতো…”
নোংরা ইঙ্গিত, বেপরোয়া কথাবার্তা এবং পুরোনো ক্ষতে আঁচড় পড়তেই ইহসানের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল এবার। চোখ আরও কঠিন হলো। গভীর ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়ল সে। গলার শিরাগুলো ফুলে উঠল, ট্রিগারের উপর রাখা আঙুলটা দৃঢ় হয়ে উঠল। চোখের পলকে ট্রিগার টিপে দিলো ইহসান। ঠাস করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে খানখান হলো। ইনজানের শরীরটা ছিটকে গেল একটু পিছনে, কিন্তু পড়ে গেল না। শেষ মুহূর্তে ইহসানের মতিগতি বুঝে একটুখানি সরে যাওয়ায় গুলিটা লেগেছে ঠিক ওর বাঁ কাঁধের কাছে। কাঁধটা একটু দুলে উঠল, চাদরের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল গাঢ় রঙের লাল রক্ত। তবে ঘাবড়ে গেল না। ওর চোখে অন্যরকম উত্তাপ। অথচ মুখে বিকৃত হাসি, রক্তমাখা ঠোঁটের কোণ উঁচু করে বলল, “একটুর জন্য মিস করে গেলে। নেক্সট টাইম হার্টে মেরো, না হলে মরব না!”
ইহসানের চোখে আগুন। এমন প্রতিক্রিয়ায় সে অভ্যস্ত না। তার চোখের দৃষ্টি কাঁপছে, হাত জোরে কাঁপছে, কিন্তু সে নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বকে সংবরণ করছে। একটা লাথি বসিয়ে দিলো সে ইনজানের কোমড়ে। চুলের মুঠি একত্র করে জোরালো আঘাত করল মেঝেতে। ইনজান তাতেও দুর্বল হলো না। কাঁধের একপাশ চেপে ধরে আজেবাজে বকতেই ব্যস্ত,
“তুমি জিতেছ ভালোবাসা পেয়ে, আমি জিতব সব ছিনিয়ে নিয়ে। তোমার যতটা না ভালোবাসা, আমার ততটাই ক্ষত।”
রাগান্বিত, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ইহসান ওকে আচ্ছামত মেরে আবারও ওকে শুট করে ওর চ্যাপ্টার ক্লোজ করতে উদ্যত হলো ঠিক তখনি পেছন থেকে নীতিন চিৎকার করে উঠল, “মাইরেন না, মাইরেন না ভাইজান। ছোটো স্যার মইরা যাইব। আপনের ভাই লাগে হ্যায়, এমনে মারবেন? ভাইজান একটু শুনেন আমার কথা, আপনের আব্বা ফোন দিসে, আপনের লগে কথা কইতে চায়, ছোটো স্যাররে ছাইড়া দেন…”
ক্র্যাচে ভর দিয়ে একহাতে ফোন নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে তখন নীতিন। তার করুণ দৃষ্টি মেঝেতে পড়া ইনজানের দিকে। অনুনয় করতে লাগল সে বারবার ইহসানকে ওকে না মারার জন্য। কাজের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটানোয় ইহসান প্রচন্ড বিরক্তি আর রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকাল। ওর ভয়ঙ্কর চাহনি দেখে নীতিন ঢোক গিলে ফোনটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “জরুরি কথা ভাইজান, এক্ষুণি কইতে হইব..”
ইহসান এক মুহূর্ত থেমে গাঢ় শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করল। চুলগুলো ঠেলে পেছনে সরিয়ে
কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়াল। হাতে থাকা গানটা আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরে ইনজানকে আরো একটা লাথিতে ছিটকে সরিয়ে দিলো, নীতিন আবারও হায় হায় করে উঠল। কাঠের ক্র্যাচদুটো চালিয়ে দ্রুত ছুটে এসে ইহসানের কাছে দাঁড়াল সে ভয় নিয়ে। ফোনটা লাউড স্পিকারে দেওয়া, ওপাশ থেকে আজিজ শেখের চিন্তিত, ভয়ার্ত গলা শোনা গেল। নীতিনের কাছ থেকে সব শুনেছে বোঝাই যাচ্ছে। তিনি ইহসানকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাচ্ছেন, “আব্বাজান
তুমি যদি ওরে কিছু করো, তোমার বউরে কিন্তু আমি বাঁচাই রাখমু না। এমনিতেও বাঁচার অবস্থায় নাই, আমার কিন্তু বেশি কষ্ট করতে হইব না ওরে পিষে দেওয়ার জন্য। তুমি যদি ওর জানটুকু চাও, তাইলে আমার জানরে নিস্তার দিয়া দ্রুত চইলা আসো। তোমার বউয়ের অবস্থা ভালো না, হসপিটালে আছে…”
এক মুহূর্তের জন্য ইহসান স্থবির হয়ে গেল। পা দুটো থেমে গেল, বুকের রক্ত ছলকে উঠল ওর। বিভ্রান্তি আর সন্দেহ নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “হসপিটালে মানে? সৃজার কী হয়েছে?”
“তোমার পাকনা বউ পাকনামি করতে গিয়া আছাড় খাইয়া পইড়া গেসে। যে বান্দির বাচ্চারে দেখাশোনার জন্য দিয়া গেসিলা, সে মরার মতো এমন ঘুম দিসে যে কিছুই কইতে পারে নাই। এখন তোমার বউ আর আমার নাতিপুতির জীবনমরণ নিয়া টানাটানি।”
ইহসানের মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল সে, “কখন ঘটল এসব? কেউ আমাকে কিছু জানায়নি কেন? সৃজার কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ব না।”
“তোমারে তো বড়বৌ ফোন দিতাছে সেই রাত থেইকা, নেটওয়ার্ক নাই। আমি আন্দাজ করছিলাম তুমি আমার ছোটোবাপের কাছে যাইবা, আন্দাজটাই ঠিক হইসে। নীতিন না জানাইলে তো… যাইহোক, এখন ভাবো, ঠিক করো কী করবা…”
ভাবার মতো এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করল না ইহসান। যে কাজে এখানে এসেছিল, সেটা
অসমাপ্ত রেখেই একছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ইহসান যেতেই নীতিন ছুটে এসে ধরল গুলিবিদ্ধ, জ্ঞানশূন্য ও রক্তাক্ত ইনজানকে।
.
দশ ব্যাগ রক্ত লাগবে সৃজার। ডোনার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজিজ শেখ কিছু ডোনার জোগাড়
করে এনেছেন, কিন্তু তাতেও দুই ব্যাগ কম পড়ল। ইমার্জেন্সি ডোনার খুঁজে না পাওয়ায় তখন ইজহান রক্ত দিলো সৃজাকে। ইতোপূর্বে কখনো কাউকে রক্ত না দেওয়া ইজহানকে আজ নিজে থেকেই এত উচাটন হতে দেখে ইস্মির চোখে জল চলে এলো। মানুষটা বারবার বাবার সাথে ঝগড়া করছে সৃজার সুস্থতার জন্য, বাচ্চাগুলোর জন্য। এমনকি রক্ত দেওয়ার পর বিশ্রাম না দিয়ে, কিছু না খেয়ে সে ও.টির সামনে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে শুধুমাত্র মা, বাচ্চা তিনজন সুস্থ আছে কি না সেই খবর জানতে।
ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, ওদেরকে নাজেহাল করে তুলছে একটুকুতেই। সারাজীবন স্বার্থপর ভেবে আসা মানুষটার এমন রুপ দেখবে, ইস্মি কখনো ভাবেইনি। এমনকি ও.টি শেষ হওয়ায় পর ছুটোছুটি করে ফ্রেটারনাল টুইনসদের এন.আই.সি.ইউতে শিফট করার সময়, ইজহান
এতোটা ব্যস্ত হয়নি ওদের জন্য, যতোটা না সৃজা
সুস্থ আছে কি না জানতে হয়েছে। সৃজার অবস্থা ক্রিটিকাল। বর্তমানে পোস্টপার্টাম হেমোরেজ-এর কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার প্রেসার ড্রপ করেছে। রক্তের গ্রোথ স্বাভাবিক করার জন্য কয়েক ব্যাগ রক্ত ট্রান্সফিউশনের পরও ওর হিমোগ্লোবিন স্থিতিশীল হয়নি। ডাক্তাররা বলছেন, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি শরীর রক্ত ধরে রাখতে পারে এবং ইনফেকশন না হয়, তাহলে সম্ভাবনা আছে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু এখনো সে অচেতন, সাড়া দিচ্ছে না। যারজন্য ওকে আই.সি.ইউতে রাখা হয়েছে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে। আজিজ শেখ ওর বিষয়ে মোটেও ভাবছেন না, তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে নাতি-নাতনিদের নিয়েই ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। ইজহান যখন আরো একবার কথা-কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে গেল তার সাথে, তখনি ওর ফোন বেজে উঠল। তিক্ততা নিয়ে ইজহান ফোন নিয়েই দেখল ইহসান কল করেছে। সে রিসিভ করেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কু* বাচ্চা, কোন গর্তে লুকাইছিস যে কোটি কোটি ফোনও যায় না? যায় না যখন ফোন করিস না আর, একেবারে বউয়ের খতম পড়াতে আসিস।”
ফোনের ওপাশ থেকে অস্থির ইহসানের কর্কশ ও রাগান্বিত স্বরে চিৎকার করল, “অশুভ! তোর মুখের চোপা ভেঙে ফেলব উল্টাপাল্টা কথা বললে। তুই কোথায় আর আমার বউ কেমন আছে সেই খবর দে। তোর আব্বাজান কিন্তু ওকে মারার তালে আছে। আমি কিন্তু সৃজার কিছু হলে তোর বউকেও মেরে দেব। তাই বলছি, ওকে কয়েকঘন্টার জন্য দেখে রাখ, তোর বউও বেঁচে থাকবে।”
ইজহান এবারে রাগলো না ওর উপর, গালাগালিও ছুঁড়ল না। বলল, “তোর বউবাচ্চা সবাই ইন্টেনসিভ কেয়ারে আছে।”
ফোনের ওপাশে থাকা ইহসান থমকে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। স্টেয়ারিংয়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে সে বলল, “ওহ গড!”
_____
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫৫
কয়েক ঘন্টা জার্নি করে হাসপাতালে পৌঁছে বাড়ির কারো সাথে দেখা না করে, কোনোদিকে না তাকিয়ে কাউন্টার থেকে ইহসান সোজা এলিভেটরের দিকে গেল। কিন্তু এলিভেটর খালি না পেয়ে ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে।
একসাথে দুই-তিন ধাপ লাফিয়ে উঠতে লাগল। হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে হঠাৎ এমন ছুটে চলা দেখে কয়েকজন থমকে তাকালেও সে কারো দিকে ফিরেও তাকাল না। ষষ্ঠ তলার ইন্টেসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে গিয়ে থামার পরই ওর পা দুটো থামল। জনসাধারণ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় চারপাশ জনশূন্য, নীরব। আলো-অন্ধকারের খেলায় করিডোরটা দীর্ঘ আর ভুতুড়ে লাগছে। বুকের ভেতরে জমে থাকা ভয়, অজানা এক আশঙ্কা ওকে অস্থির করে তুলছে। গলার ভেতর আটকে আছে শব্দগুলো। পা জমে যাচ্ছে। ভর দিয়ে হাঁটলেও মনে হচ্ছে মেঝে নিচে দেবে যাচ্ছে। দেয়ালে টাঙানো ওয়ার্নিং সাইনগুলো চোখে লাগছে বেশি। বারবার মাথায় ঘুরছে একটা কথা, ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ঢোকা মানে চুক্তি করা। জীবনের সাথে অথবা মৃত্যুর সাথে।
ঘর্মাক্ত দেহ, আর আতঙ্কে বুক ধরফড় করতে থাকা ইহসান দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই চেষ্টাটুকুও বিফলে গেল সম্পূর্ণই। টেনশনে ওর গলা শুকিয়ে গেছে৷ পানি পান করা দরকার। কিন্তু সৃজাকে এক পলক না দেখলে এক সমুদ্র পানি পান করলেও ইহসানের এই অস্থিরতা কমবে না। পাগল পাগল হয়ে সে বাইরে থেকে এন্ট্রান্স ডোরে নক করল কয়েকবার। কিন্তু তৎক্ষনাৎ সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতর থেকে কেউ না আসায় আতঙ্ক আর রাগ ওকে গ্রাস করে ফেলল ভেতরে ভেতরে। রাগান্বিত হয়ে কয়েকটা লাথি বসিয়ে দিলো দরজায়, “হে! কেউ আছেন? ওপেন দ্য ডোর!”
ওর চিৎকারে পুরো করিডোর কেঁপে উঠল এবং অল্প সময়ের মধ্যে কিছু স্টাফ দৌড়ে এলো। তাদের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কড়া গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইহসান চেঁচিয়ে উঠল, “কতক্ষণ যাবৎ ওয়েট করছি আমি? কোথায় ছিলেন আপনারা? দরজা খুলছিলেন না কেন? আমি দেখা করব পেশেন্টের সাথে। দেখি সরুন।”
বলে সটান হাঁটা ধরল ভেতরে প্রবেশের জন্য। ওর চিৎকারে মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যাওয়া স্টাফদের এবারে টনক নড়ল। দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর আগেই ওরা ইহসানকে থামিয়ে দিলো। একজন বিরক্ত গলায় জানাল, আইসিইউ-তে কারো প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু ইহসান সেটা মানতে চাইল না, সে যেকোনো প্রকারে ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু স্টাফরা চায় ওকে এখান থেকে বের করে দিতে। ওকে সরাতে পারছে না দেখে একজন বেশ দম্ভ নিয়ে ওর কলারে হাত রাখতেই ইহসানের মাথা ঘুরে গেল রাগে। ঘুষি বসাল ছেলেটার নাকে। বেচারার নাক দিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগল। কলিগের এ অবস্থা মেনে নিতে পারল না বাকি দু’জন। শুরু হয়ে ঝামেলা। এক, দুই করতে করতে লোকজন জড়ো হয়ে গেল। এই সময়েই ইন্টেনসিভ কেয়ারের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সদ্য জয়েন করা ডাক্তার নাবিলাতুজ জোহা। বাইরে এমন অস্থির অবস্থা দেখে তিনি ধমকি দিয়ে লোকজনদের সরতে বললেন। আর ঝামেলার মধ্যমণি উদ্ভ্রান্ত যুবককে দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “আপনি এখানে ঝামেলা করছেন কেন? একটু আগেই তো পেশেন্টের কন্ডিশন তার বাড়ির লোকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
রাগে ফুঁসতে থাকা ইহসানের মস্তিষ্ক তখন এতকিছু ভাবছে না। সে তেঁতো স্বরে জবাব দিলো, “আমাকে কিছুই জানানো হয়নি।”
নাবিলাতুজ জোহা কপাল কুঁচকালেন, “আশ্চর্য! আমি যখন বলছিলাম আপনি সেখানেই ছিলেন। অথচ বলছেন আপনি জানেন না!”
“না, জানি না। কানে যায়নি আপনার?”
ওর গলার রুক্ষতা, চোখের অস্থিরতা, বেয়াদবি আচরণ দেখে নাবিলা তুজ জোহা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এইতো আধঘন্টা আগে মা আর বাচ্চাদের কন্ডিশন, লাস্ট আপডেট এই পেশেন্টের বাড়ির লোকদের জানিয়ে এসেছেন, তখন এ লোকটাও ছিল। অথচ এখন অস্বীকার করছে? মাথায় সমস্যা আছে না কি স্ত্রী-সন্তানের দুর্দশা দেখে এ অবস্থা লোকটার? হয়তো তাই। তিনি আর কথা বাড়ালেন না এ ব্যাপারে। পরিস্থিতি সামলানোর নিমিত্তে পরখ করতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার নাম?”
“ইহসান শেখ।”
“পেশেন্টের কে হোন?”
উত্তরটা দিতে গিয়ে গলার স্বর ভেঙে গেল ইহসানের, “হাজব্যান্ড।”
নাবিলাতুজ জোহা আবারও অবাক হলেন, তখন যা বুঝলেন, এ লোকটা পেশেন্টের বড়ো ভাইয়ের মতো হয়, অথচ এখন বলছে স্বামী? মানে কী? সব এতো উলটপালট লাগছে কেন? তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না তবে এটা বেশ বুঝতে পারলেন এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়ানো লোকটা কতটুকু অস্থিরতা পুষছে বুকের ভেতরে। অবশ্য এখানে আসা প্রত্যেকটা পেশেন্টের কাছের মানুষদের রিয়েকশন আতঙ্কগ্রস্তই থাকে। তবে এই লোকের চোখেমুখে অন্যরকম উন্মত্ততা, এক ধরনের অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছে,
যা তিনি এর আগে খুব কমই দেখেছেন। কিন্তু এটা তার কাজের জায়গা৷ রুলসের বাইরে তিনি যেতে পারেন না। তাছাড়া কাজে যোগ দিয়েছেন সপ্তাহও পেরুয়নি, এরমধ্যে আবেগে পড়ে রুলস ভঙ্গ করাটা অনুচিত। তাই গলার স্বর যথাসম্ভব নম্র করে বললেন, “আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি মিস্টার শেখ…কিন্তু আমাদের হসপিটালের কিছু রুলস, রেগুলেশন আছে যেগুলো পেশেন্টের ভালোর জন্যই আমরা সেটা ভঙ্গ করতে পারি না। তাই সরি, আমরা এখন আপনাকে এলাউ করতে পারছি না। যখন সময় হবে তখন দেখা করবেন। পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করুন।”
“আমার আচরণের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আর এক মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না। না মানে না। এক্ষুনি, এ মুহূর্তে ওকে দেখতে চাই ডক্টর, ব্যবস্থা করুন। প্লিজ, এই দেখুন আমার শ্বাস আটকে আসছে! আমি আমার বাচ্চাদেরও দেখিনি, ওকে না দেখে ওদের কাছে যেতে পারব না আমি…”
ভীষণ অসহায় কণ্ঠে কথাগুলো বলল ইহসান। বলতে বলতে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল ও। নাবিলাতুজ জোহা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন। আবেগের তাড়নায় বাস্তবতা ঢাকা পড়ে গেল তার। নিজের পেশাগত দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে, তিনি বললেন, “মিস্টার শেখ, আমরা বুঝি আপনার অনুভূতি। কিন্তু রুলস রুলসই। পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আপনি চাইলে এখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক ঝলক দেখতে পারেন। তবে এক মিনিটের বেশি নয়। সিনিয়ররা ব্যাপারটা খুব ভালো চোখে দেখবে না, ঝাড়ি খেতে হবে আমার।”
রিকগনিশন পেয়ে একটু শান্ত হলো ইহসান।
পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুপমেন্ট পরে, এন্ট্রান্স ডোর পেরুল। কাচের দরজার সামনে দাঁড়াল অস্থির হয়ে। কেবিনের ভিতরে অগণিত তারের জটলা, ভেন্টিলেটরের শব্দ। বেডে শোয়া সৃজা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। পুরোপুরি চেহারা দেখা যাচ্ছে না ওর। অজস্র ইন্ট্রাভেনাস লাইন দ্বারা বেষ্টিত দেহটা পুরোপুরি নিস্তেজ এবং নির্জীব, একটুও নড়চড় নেই। এক রাতের ব্যবধানে অভিমানী, জেদী মেয়েটাকে এমন অবস্থায় দেখে ইহসানের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। হাতের নখ মুঠোয় চেপে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে, “বেশি আদরে বাঁদড় বানিয়ে ফেলেছি যে এতো বড়ো কান্ড ঘটানোর আগে একবারও তোর বুক কাঁপেল না? একটা রাতই তো একা রেখে গেছিলাম, এরজন্য এতবড়ো শাস্তি দিলি? নিজের একটুও খেয়াল রাখলি না? একবার সুস্থ হো; ঘর মোছা, কাপড় কাচা, রান্নাবান্না সব আমি তোকে দিয়ে করাব, করাবইই।”
মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। শ্বাস ভারী ঠেকে ওর। গলা কাঁপতে থাকে। একটু থেমে বড়সড় একটা ঢোক গিলে চাপা স্বরে আটকে আটকে বলে, “আমার ছোট্ট বুকটা খা খা করছে, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, তুই কেন ওভাবে শুয়ে থাকছিস? উঠে পড় না সৃজা, বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড় না আমার এই হতভাগা বুকটাতে। শুনছিস তুই? আমি কিন্তু তোর বাচ্চাদের দেখিনি, তোর কোল ছাড়া দেখবও না। ভালো হয়ে এ নিয়ে দোষ দিতে আসলে তোর চেহারার মানচিত্র বদলে ফেলব আমি।”
.
ইজহান শক্ত মুখ করে ইহসানকে দেখছে। এই মুহূর্তে রাগে ওর সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একটা ঘুষি মেরে ভেড়টার চোয়াল ভেঙে দিতে। মানে একটা মানুষ এতোটা ইররেসপন্সিবল কীভাবে হয় যে, তার প্রেগন্যান্ট বৌকে রাত-বিরেতে একা, ঘুমে রেখে, কাউকে কিছু না জানিয়ে আরসালানের মতো পাগলকে বধ করতে যায়? কোনো মানে হয় এসবের? সে তো ইস্মিতাকে এ অবস্থায় রাতে একা রেখে কোথাও যায় না। গেলেও সবাইকে একশোবার করে জানিয়ে দিয়ে যায় তার বউয়ের দিকে যেন নজর রাখে, নয়তো সবাইকে শেষ করে দিবে। আর মহামান্য ভেড়া মহাশয় শেফালি খালাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে, যার কি না ঘুমই ভাঙে না। ইজহান সেসব ভেবেই ককটেল হয়ে আছে। তবুও দুইবার নিজে গিয়ে সেঁধেছে, বাচ্চাদের দেখে আসতে। হারামি, মীরজাফর আবার ডায়লগ দিচ্ছে, সে না কি বৌয়ের কোল ছাড়া বাচ্চাদের দেখবে না। কোনো মানে হয় এসবের?।এরপর আবার ভং ধরে কিছু না খেয়ে করিডোরে বসেই আছে ঘাড় সোজা করে। ইজহান মনে মনে ভাবছে, ঘাড়টা ধরে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের দেখিয়ে আনতে! কিন্তু সে পারছে না, ভেড়ার শুকনো মুখ দেখে। আরসালানের ব্যাপারটা আপাতত সে তুলছে না সেজন্যই। কয়েক পাক ঘুরে এসে ইজহান অস্থিরতা নিয়ে গিয়ে আবারও সাঁধল, “অনেক হয়েছে, এইবার চল। বাচ্চাদের বয়স কিন্তু একদিন হয়ে যাচ্ছে…”
“যাব না একবার বললাম তো। কানে শুনতে পাসনি?”
“তুই এখন দুঃখের মুডে আছিস, তাই তোর কথা গোণায় ধরা প্রয়োজন বলে মনে করছি না। ঠেকায় পরে বারবার সাধছি। পরে তো খোঁটা দিয়ে বলবি, তোকে তোর বাচ্চাদের প্রথম প্রথম মুখদুটো
দেখতে দিইনি।”
ইহসান ওর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। শক্ত গলায় বলল, “আমাকে একা থাকতে দে।”
বলে চলে এতে উদ্যত হতেই আচমকা ইজহান চট করে ওর ঘাড় চেপে ধরল, ইহসান প্রতিরোধের চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। ইজহানের নির্দেশে মিজুও এসে একপাশ থেকে ওকে ধরল। দু’জনে মিলে জোর করে নিয়ে যেতে লাগল এন.আই.সি.ইউ ইউনিটে, বাচ্চাদের কাছে। ইহসান পা দিয়ে কয়েকটা লাথিও বসাল, রাগের আগুন ঝরাল দু-চোখ দিয়ে, গালাগাল ছুঁড়ল। কিন্তু যখন বাচ্চাদের কেবিনের সামনে এলো সঙ্গে সঙ্গেই চুপ
হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সে। একজন ডাক্তার
এসে ওদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে এরপর
ইজহানকে বলল, “পাঁচমিনিটের বেশি এলাউ করা যাবে না। দূর থেকেই দেখবেন।”
ইজহান প্রচন্ড বিরক্ত মুখে বলল, “ওকে ফাইন। আপনি বিদায় হোন।”
অতঃপর দুই ভাই প্রথমবারের মতো বাচ্চাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ইনকিউবেটরের স্বচ্ছ কাচের ভেতরে শুয়ে থাকা ছোট্ট দুটি মানবশিশু, অকালপ্রসূ জন্মের পরও জীবনতাড়নায় স্পন্দিত। ক্ষীণদেহ, মাথাভর্তি ঘন কালো চুল, টকটকে লাল ঠোঁট, ক্ষীণ হাতে-পায়ে টুকটাক নড়চড় সব মিলিয়ে এক অপার্থিব আবেগে থমকে গেল দু’জনের হৃদয়। অভিজ্ঞতা নেই, প্রস্তুতিও নেই—তবু এটাই তাদের প্রথম পরিচয়, প্রথম মুখদর্শন। ইজহানের হঠাৎ বুকের ভেতর হাহাকার উঠল কী উষ্ণ এক ভালোবাসা, সে বোঝে না। আচমকা ইহসানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “ওরা তোর রক্ত, তোর প্রতচ্ছবি, তোদের অঙ্গজ। ইস্মিতা ওদের বড়োআম্মা, আমি ওদের বড়োআব্বা। কংগ্রাচুলেশনস ব্রাদার! টনা-মনার মধ্যে তোর আর আমাকে দেখতে পাচ্ছি। এরা এরা যেমন , তেমনি থাকতে দে৷ আমাদের মতো যেন অভাগা, হতভাগা না হয়। শুনছিস তুই? যদি শত্রুতার জন্য ওদেরকে আমাকে ধরতে না দিস তাহলে খবর করে ফেলব…’’
বঅলতে বলতে আরো শক্ত করে ইহসানকে জাপ্টে ধরল ইজহান। ওর এমন কান্ডে কোনোরুপ বাক্য বিনিময় করল না, বিস্মিতও হলো না ইহসান। চোখের কোণে জমা এক ফোঁটা পানি অতি গোপনে মুছে নিয়ে সে শুধু অপলক তাকিয়ে রইল তার রক্ত, উত্তরসূরি, অস্তিত্ব, ভবিতব্যদের সবচেয়ে বড় কথা তার সৃজার দিকে। ক্ষীণ হাতে ছোট্ট আঙুলগুলো যেভাবে নড়ছে, ছোট পা দুটি যে কাঁচ ছুঁয়ে তার কাছে আসতে চাইছে; ইহসান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে শুধু সেসবই দেখে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই ওর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল বাবা হওয়ার মতো দামি অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ায়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আব্বাজানেরা, বলতে পারেন আমি লোভী। আপনাদের আম্মার বুকে দেখব বলেও শেষ পর্যন্ত লোভী মনটাকে থিতু করতে পারিনি, দশঘণ্টা পরে এসে আপনাদের দেখতে এলাম। এরজন্য আমাকে মাফ করবেন না জানি, কিন্তু আমার অভিযোগ যে আপনাদের প্রতি অনেকগুলো—সেগুলো বলতে এসেছি। কেন এত দ্রুত, এত ছোট্ট অবয়ব নিয়ে এলেন? আমি তো চেয়েছিলাম, আপনাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁধটা আপনাদের ওজনে ভেঙে পড়ুক, আমার সত্তাও যেন কাঁপে। আপনারা আপনার আম্মার মতো বুকের মাঝে জলোচ্ছ্বাসের মতো ঢুকে পড়বেন, আমি ঝড় হয়ে আগলে রাখব আপনাদের। কিন্তু… কি থেকে কী হয়ে গেল, সব এলোমেলো। আমি আপনাদের জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি, তবে ভয় হচ্ছে, আমি সামলাতে পারব তো আপনাদের? আপনাদের মাকে? ঐ নিষ্ঠুর নারী দেখুন আমাকে কীভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, আপনাদের পেটে আনার পরেও, পেট থেকে বের করার পরেও…”
“আস্তাগফিরুল্লাহ!”
______
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫৬
ইহসান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তার বাচ্চাদের দেখে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই ওর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল বাবা হওয়ার মতো দামি অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ায়।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আব্বাজানেরা, বলতে পারেন আমি লোভী। আপনাদের আম্মার বুকে দেখব বলেও শেষ পর্যন্ত লোভী মনটাকে থিতু করতে পারিনি, দশঘণ্টা পরে এসে আপনাদের দেখতে এলাম। এরজন্য আমাকে মাফ করবেন না জানি, কিন্তু আমার অভিযোগ যে আপনাদের প্রতি অনেকগুলো—সেগুলো বলতে এসেছি। কেন এত দ্রুত, এত ছোট্ট অবয়ব নিয়ে এলেন? আমি তো চেয়েছিলাম, আপনাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁধটা আপনাদের ওজনে ভেঙে পড়ুক, আমার সত্তাও যেন কাঁপে। আপনারা আপনার আম্মার মতো বুকের মাঝে জলোচ্ছ্বাসের মতো ঢুকে পড়বেন, আমি ঝড় হয়ে আগলে রাখব আপনাদের। কিন্তু… কি থেকে কী হয়ে গেল, সব এলোমেলো। আমি আপনাদের জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি, তবে ভয় হচ্ছে, আমি সামলাতে পারব তো আপনাদের? আপনাদের মাকে? ঐ নিষ্ঠুর নারী দেখুন আমাকে কীভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, আপনাদের পেটে আনার পরেও, পেট থেকে বের করার পরেও…”
“আস্তাগফিরুল্লাহ!”
আবেগ বহিঃপ্রকাশের মুহূর্তে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথার পর ইজহান ধরেই নিয়েছিল ইহসান এবার ক্ষেপে যাবে। কিন্তু ওর ভুল ভাঙল পরক্ষণেই; যখন নিজের পিঠে দুটো শক্ত হাতের চাপ বিচরণ করল। কাঁধে একটা অসহায় দীর্ঘদশ্বাস পড়ল, একফোঁটা অশ্রু গড়িতে পড়ল। মাথাটা ধীরে গুঁজে গেল আরো। সৃজা বাদে এভাবে কাউকে জড়িয়ে ধরেছে এর আগে মনে নেই ইহসানের। দুর্বলতা প্রকাশ ওর স্বভাবে নেই। কাউকে ছুঁয়ে ভরসা নেওয়ার অভ্যাস ওর নেই। আগে তো বহু দিন গেছে, গলা আটকে এলে, বুক চাপা কষ্টে ভেঙে গেলেও পাশে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ইজহানের সঙ্গে তো তার আজন্ম শত্রুতার সম্পর্ক—অহেতুক অথচ অনিবার্য! দু’জনের মিলমিশ হয়ে উঠেনি কখনো। বিবাদ লেগেই থাকতো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে, একটা সময়ের নির্লিপ্ত, আত্মকেন্দ্রিক ইজহান ওর অনুপস্থিতিতে যেভাবে বাচ্চাদের ব্যাপারটা সামলেছে, সৃজাকে প্রটেক্ট করেছে, আজিজ শেখের চক্ষুশূল
দৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছে তা ইহসানকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অথচ ইজহান এমন নয়। সে কেবল নিজের স্বার্থ দেখে৷ নিজের আরাম-আয়েশ ছাড়া কিছু ভাবতে চায় না, নিজের বউ ছাড়া কিছু বোঝে না। আজ ওর মধ্যে এই পরিবর্তন এতটাই অপ্রত্যাশিত যে কৃতজ্ঞতা শব্দে ধরা যাচ্ছে না। ইহসান কিছু বলতে পারছে না। আড়ষ্টতায় চেপে আছে ইহসানের গলার স্বর, চোখের ভাষা।
এদিকে ইজহান ছিল আগের মতোই স্থির। কিছু না বলে, শব্দ না করে বিস্মিত সে নিঃশব্দে ভাইয়ের বুকের সাথে মিশে রইল। এই সেই ভাই, যাকে ভেড়া বলে খোঁচানোয় অদ্ভুত আনন্দ পায় সে। যার চোখে শত্রুতা খুঁজে নিতে নিতে বড় হয়েছে। সেই ভাইটির হৃদযন্ত্র আজ যেন বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলেছে। মুখে কোনো কথা না, নত হওয়া না, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না, না কোনো ব্যাখা! তবুও ইজহান বুঝতে পারল,
এই জড়িয়ে ধরার ভেতর এক পৃথিবী কৃতজ্ঞতা মিশে আছে। ঠোঁটের কোণে এক বিচিত্র হাসির রেখা ফুটে উঠার সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটোতেও টলটলে একটা ঝিলিক খেলে গেল সেই মুহূর্তেই। এই তো, এই ইহসান শেখ—যার সঙ্গে তার নাম, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রঙ, এমনকি ডিএনএ-ও মিলে যায়! অথচ জন্ম থেকে ওর সাথেই লেগে আছে এক নীরব প্রতিযোগিতা, এক অব্যাখ্যাযোগ্য দ্বন্দ্ব। কেন? প্রশ্নটা বহুবার করেছে নিজেকে, উত্তর পায়নি কখনো। কখনো
মনে হয়েছে বাবা-মায়ের পক্ষপাতিত্ব দায়ী, কখনো আবার শুধুই নিজের অভিমান, ঈর্ষা।
কিন্তু এসব ভাবনার বাইরেও, আজ বুকের গভীরে একটা শীতল প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটা ইস্মিতাকে বুকের কাছে পেলে হয়। এমনটা কেন হচ্ছে? সে তো ভাইকে ভালোবাসে না! অন্তত এতদিন সেটাই ভেবেছে। তাহলে এই প্রশান্তি, এই অদ্ভুত আবেগ; এসবের মানে কী? বিভ্রান্ত ইজহানের মাথায় হঠাৎ সময়ের কথা আসতেই সে ফিসফিসিয়ে বলল, “টাইম ওভার! এলাউ করবে না আর, বাইরে যাই? বাইরে গিয়ে জড়াজড়ি করি? টনা-মনা দেখছে!”
পাঁচ মিনিটের সময়টুকু ইহসানের কাছে যেন এক মিনিটও মনে হয়নি। আশ্চর্য! এত দ্রুত সময় কেটে গেল? যদি আরও কিছু সময় পেত, বাচ্চাদের আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারত, প্রাণভরে দেখতে পারত। ইহসানের ভেতর চাপা এক রাগ দানা বাঁধল৷ এত ছোট্ট বাচ্চা তারা, অথচ জন্মের পরপরই সে তাদের কোলে নিতে পারেনি। যখন কোলে নেবে, তখন আর সেই প্রথম অনুভূতিটা ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। সে ইজহানকে ছেড়ে সরে গেল। ইনকিউবেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “আপনাদের স্থান এখানে—আমার বুকে। খুব তাড়াতাড়ি কঠিন সময়টা কাটিয়ে উঠুন, মা’কে নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। আপনারা চলে গেলে, আব্বা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।”
একটু থমকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে পুনরায় বিড়বিড় করে বলল, “বাইরে এলিজ কাঁদছে। যদি আপনাদের কিছু হয়, ওর কাছে আব্বার মুখ থাকবে না…”
.
ইহসান না আসা পর্যন্ত কেউ শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে খবর পাঠায়নি। ও ফেরার পরই খবর পাঠানো হয়েছিল। এলিজা তখন ভার্সিটিতে। গুরুত্বপূর্ণ টপিকের উপর ক্লাস নিচ্ছিল রজব স্যার, যিনি খুব কড়া মানুষ। তার ক্লাসে এটাই নিয়ম যে, কেউ ক্লাসের সময় কথা বললে বা এটেন্ড না করলে শাস্তি পেতে হয়। এমনকি সঠিক সময়েই ক্লাসে না উপস্থিত হলে ডাস্টারও ছোঁড়া হতে পারে। তার ক্লাসের মধ্যে সবসময় পিনপতন নীরবতা থাকে, সবাই ভয়ে থাকে যেন কিছু না ভুল হয়ে যায়। তবে আজ সেই নীরব মুহূর্ত টুকু ভেঙে দিয়ে সশব্দে বাজতে শুরু করে এলিজার ফোন। সাইলেন্ট মোডে না রাখার কারণে ফোনের রিংটোন কানে যেতেই এলিজা চমকে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত হলেও, ক্লাসের সকলের নজর তার দিকে পড়তেই বুঝতে পারে যে, তার ব্যাগে ফোন বাজছে। রজব স্যার ততক্ষণে রেগে আগুন।
এলিজা নাম্বার চিনতে না পেরে কল কেটে দ্রুত ফোন সাইলেন্ট করে দেয়। অপরাধী চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলতেই, তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন এবং বেরিয়ে যেতে বলেন। গুরুত্বপূর্ণ টপিকের ক্লাস মিস হওয়ার ভয়ে, এলিজা স্যারের কাছে অনেক অনুরোধ করে তাকে কনসিডার করার জন্য। কিন্তু বদমেজাজি রজব স্যার ওর কোনো কথাই শোনেননি, ডিরেক্ট বের করে দিয়েছেন। হতাশ হয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে একনাগাড়ে বাজতে থাকা ফোনটা রিসিভ করে, ধমক দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে ইহসানের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ফোনেই ইহসান জানায় সৃজার সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার খবর। তবে সৃজার ইনটেনসিভ কেয়ারে (আই.সি.ইউ) ভর্তি হওয়ার কথা এলিজাকে বলার সাহস পায় না। কিন্তু ওটুকু শুনেই এলিজা অস্থির হয়ে পড়ে। এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না। হাসপাতালে ছুটে আসার পথে তার ভেতর একরাশ দুশ্চিন্তা, ভয়ের অনুভূতি ছিল। কিন্তু এখানে এসে যখন জানতে পারল সৃজা এবং তার বাচ্চা সকলেই বিশেষ পর্যবেক্ষণ, তাও প্রায় দশ-বারো ঘণ্টা ধরে, এলিজার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। কোনোমতে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলালেও, বুকের ভেতরটা আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল ওর। হাত-পা কাঁপছিল থরথর করে। মা মারা যাওয়ার পর, তেরো বছরের সেই বাচ্চা মেয়েটি যেভাবে এলিজাকে সামলেছিল, সেই তেরো বছরের মেয়েটির মুখটা বারবার এলিজার চোখে ভাসছিল; আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। মা নেই, বাবা নেই, নীলু ফুপি অসুস্থ। আজকাল তিনি আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে, কেউ তাকে ডাকছে, মরহুম স্বামী তাকে নিতে আসছে, কিছু খারাপ হতে চলেছে। ফুপির এসব কথা শুনে এলিজা ভয়ে, দুশ্চিন্তায় রাতে চোখের পাতা এক করতে পারে না। তাই বোনকে হারানোর আতঙ্ক ঘিরে ধরায় শক্ত মনের এলিজা নিজেকে আর আটকাতে পারেনি। বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, কতো আর পারা যায়? এলিজাও পারেনি। নিজের আবেগ, অনুভূতি, দুর্বলতা সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে। ইস্মি আর সালেহা বেগম তাকে সামলানোর চেষ্টা করলেও, ওর কান্না নিঃশব্দ এক আকুতি হয়ে সবার বুকে বিঁধছিল, আর ইহসানের বুকের ভেতর হাহাকার জমা হচ্ছিল। এলিজাকে সচরাচর ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায় না। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত রাখে বলে মেয়েলি নমনীয়তাটা একেবারেই চোখে পড়ে না। আর ওর এই গুণটার জন্য ইহসান ওকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, ভালোবাসে। কিন্তু আজ যেভাবে ও কেঁদেছে, তাতে স্পষ্ট যে, এই মেয়েটা বোনের জন্য কতটা নমনীয়তা পুষে রেখেছে।
ইহসান এখনো এলিজার সামনে যায়নি। তার সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ নেই। যতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে সৃজাকে দেখে রাখার কথা বলেছিল, আজকের বাস্তবতা সেই আত্মপ্রবঞ্চনাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভাঙা কিছু নিয়ে সে এলিজার সামনে দাঁড়াতে চায় না। দাঁড়িয়ে কী বলবে সে? “তোর বোনকে আমি দেখে রাখিনি, এই অবস্থায় একা ফেলে ভাইকে খু ন করতে গেছিলাম, আমাকে সাধুবাদ জানা!” এসব বলবে? ছিহ! তবুও শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধাতস্থ করে, নিঃশব্দে এগিয়ে এলিজার পাশে বসে মাথা নিচু করে খুব আস্তে বলল, “কাঁদিস না প্লিজ, এলিজ!”
এলিজা মাথা তুলে তাকায় না, বরং চোখের পানি
গাল বেয়ে পড়তেই থাকে, “আপু যদি না ফিরে আসে ভাইয়া… আম্মু-আব্বুর মতো যদি চলে যায়…”
কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে ওর, আর কিছু বলতে পারে না। সেইখানেই থেমে গিয়েও আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।
ইহসানের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলেও কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে ওর মাথায় রাখে, “উহু! কেউ যাবে না। না তোর আপু, না আমার সৃজা আর আমার ছেলে-মেয়ে। কেউ না। তুই ওদের জন্য দোয়া করবি… আমার বিশ্বাস আছে, আল্লাহ আমাদের এই পরীক্ষা থেকে পার করে নেবেন।
তবে তোকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তুই ভাঙলে আমি আর কাকে ভরসা করব বলতো?”
এলিজা চোখ তুলে তাকায় ইহসানের দিকে। অসহায়, বিধ্বস্ত, কিন্তু তবুও আশায় টিকে থাকা দুই জোড়া চোখ একে অপরকে দেখতে থাকে।
“তুই আমার ছোটো, কিন্তু আমার চেয়ে সাহসী। এখন তুই এভাবে কাঁদলে আমি আর ধৈর্য রাখতে পারবো
না এলিজ।”
ইলেকট্রিক বাতির নিচে, কান্নায় ভেজা চোখ মুছে এবার আস্তে করে মাথা হেঁট করে ফেলে এলিজা। ইহসান ওর গাল থেকে অশ্রুবিন্দু মুছে দেয়, “ভিজিটিং আওয়ারে আমি যাব না। তুই ওকে দেখে আসবি। তোর আপু তোর কণ্ঠ চেনে। তুই ডাক দিলে ও শুনবে…বলবি আমি প্রচন্ড রেগে আছি ওর উপর। গুণে গুণে চারটা থাপ্পড় খাবে সুস্থ হওয়ার পরে…”
এলিজা চোখ মুছে নিয়ে মাথা নেড়ে ইহসানকে
আশ্বস্ত করে, সে আর কাঁদবে না। ওর প্রতিশ্রুতি ইহসানকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইজহান দীর্ঘ সময় ধরে ওদের ভাই-বোনকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার চোখে কোনো বিরক্তি নেই, বরং এক অজানা টান অনুভব করছে সে, ইহসান, সৃজা, এলিজা… এদের প্রতি, বাচ্চাদের প্রতিও। এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। নিজেকে ইজহান জানে, সে স্বার্থপর। তার দুনিয়াতে মনোযোগের
কেন্দ্রে শুধু একজনই আছে, সেটা তার ইস্মিতা।
তবু ওদের জন্য আজ মন কেমন কেমন করে বলে
সে ওখানে আর দাঁড়ায় না। চুপচাপ কেবিনে চলে আসে। এসে দেখে কেউ নেই আশেপাশে। ইস্মি মুগ্ধ চোখে চুপচাপ বসে বাচ্চাদের ছবি দেখছে। ইজহানের কী হলো কে জানে, হঠাৎ করেই দস্যুর মতো ইস্মিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর গাল, গলা ভিজিয়ে ফেলে চুমুতে চুমুতে। প্রথমে চমকে গিয়ে ইস্মি ওকে ঠেললেও ওর শক্তির সাথে পেরে
উঠে না। বরং ইজহান জবরদস্তি করে ওর ঠোঁটে
ঠোঁট রেখে দেয়।ওর স্পর্শে ইস্মির শরীর অবশ হয়ে আসে। ওকে আর আটকায় না।
ঠিক এর কয়েক মুহূর্ত পরই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসেন সালেহা বেগম। বের হয়েই ওদের এমন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। এরপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বিব্রত হয়ে বাইরে চলে যান। কাঠ হয়ে থাকা হতভম্ব ইস্মি কেঁদে ফেলে। ইজহান ভেবে পায় না সে তার বউকে আদর করেছে, চুমু খেয়েছে এতে লজ্জার কি আছে? বিরক্ত সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “কান্নাকাটি করে নাটক শুরু করবি না। আমি তোর বর—ভুলে যাস না যেন।”
ইজহানকে ভাবলেশহীন ও বিরক্ত হতে দেখে ইস্মি রেগে উঠে, “স্থান-কাল বিবেচনা করেন না আবার মেজাজ দেখাচ্ছেন? আম্মা কি ভাবল? অবিবেচক, নির্লজ্জ!”
ইজহান উত্তেজিত হয়ে গেল, “জোর করি না বলে মাথায় উঠে গেছিস? কতদিন আদর দিস না তুই? আমি কি নপুংসক? ফিলিংস নেই? রাতে ঘুমাতে পারি না, খবর আছে? আজ যেচে পড়ে হ্যাংলা হয়েছি তাই চোখ রাঙাচ্ছিস? শেইম অন ইউ, ইস্মিতা…”
আসলেই ইজহান সেই রাগারাগির ঘটনার পর থেকে ইস্মিকে যন্ত্রণা দেয় না। বরং যথেষ্ট স্পেস দেয়।
তবে এতে যে মহাশয় নিজেকে কীভাবে সামলায় তা মনে করেই ইস্মির হাসি পেয়ে যায়। ও ঠোঁট টিপে হাসি চেপে বলল, “আমাকে শেইম দিলে কী হবে? সংসার তো আমার সাথেই করতে হবে, আমার বাচ্চার বাবাও হতে হবে।”
এই কথাটা ভারী পছন্দ হয় ইজহানের। তাই মেজাজটাও হালকা হয়ে যায় তার। প্রসঙ্গ বদলে সে বলল, “বউকে শেইম অন দিলে কী পাপ হয়?”
ইস্মি হাই তুলতে তুলতে বলল, “প্রায়শ্চিত্ত না করা অবধি পাপ হয়।”
ইজহান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওর গা ঘেঁষে বসে দুটো ভয়ের ঢোক গিলে নমনীয় কণ্ঠে বলল, “মায়ের মা, আমাকে মাফ করে দিন।”
“হবে না।”
“কেন?”
“পাপ করতেই থাকবেন।”
“করব না।”
“ভুলে যান আপনি বারংবার।”
“ভালোবাসা কমিয়ে দিলেই তো আমি পাপ করে ফেলি! আমার কী দোষ? আমি নির্দোষ।”
মুখ কালো করে কথাগুলো বলল ইজহান। ইস্মি আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ওকে। অভিযোগের শেষ নেই এ লোকের। ভালো হয়ে যাব বললেও এ লোক ভালো হবার নয়। অন্তত আদরের ক্ষেত্রে তো নয়ই। হতাশ ইস্মি ওর শার্টের কলার ধরে টেনে এনে টপাটপ ওর ঠোঁটে পরপর কয়েকটা চুমু বসিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আপনার অভিযোগ, আদরের খোঁটা শেষ হবে না এ জীবনে। তাই আদর দিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম। আমি বাচ্চাদের ছবি দেখছি। দয়া করে আর জ্বালাবেন না।”
কথাগুলো দারুণ পছন্দ হলো ইজহানের। ইস্মি নিজে
থেকে আদর দেওয়ায় সে সব ভুলে নিদারুণ আগ্রহ নিয়ে বাচ্চাদের ছবি দেখতে লাগল!
.
তিনটা নিষ্পাপ প্রাণের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় একে একে কেটে গেছে দুটো দিন। সবকিছু ফেলে অস্থিরতার সহিত ইহসান ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে যাচ্ছে তার প্রিয় প্রাণগুলোকে সুস্থভাবে দেখার আশায়। ইস্মির এমন অবস্থায় বাকিদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও নিজে হাসপাতাল থেকে একচুলও নড়েনি ইহসান। তবে ওর সাথে জেদ ধরে এলিজাও কোথাও যায়নি। নীলু ফুপিকে ভাড়াটিয়া আন্টির আয়ত্তে রেখে নিজে এখানে পড়ে আছে। দিনের অন্তিম প্রহর চলমান। সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারিপাশ। ব্যস্ত শহরের কৃত্রিম আলোর সাথে তাল মিলিয়ে অন্ধকার খেলছে আলো-আঁধারির খেলা। তারমধ্যে একটু আগেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। হসপিটালের ওয়েটিং লাউঞ্জের জানালার পাশে বসে চুপচাপ বৃষ্টি দেখারত অবস্থায় একজন স্টাফ ইহসানকে খুঁজতে খুঁজতে এসে জানাল, সৃজা রেহমানের জ্ঞান ফিরেছে। বৃষ্টির ঝিম ধরা শব্দে গুমোট মন নিয়ে বসে থাকা এলিজা টের পেল গত দুটো দিন সে এ খবরটা শোনায় প্রতীক্ষায়ই ছিল। কান্নায় ওর চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে ডিসপেনসারিতে স্যাম্পল আনতে যাওয়া ইহসানকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে চঞ্চলা পাখির মতো ছুট লাগাল ইন্টেসিভ কেয়ারের দিকে। তবে আপুর সঙ্গে দেখা করার পারমিশন পেল না। ইহসান এসে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার পর জানা গেল, আজ দেখা করার অনুমতি পাওয়া যাবে না। যদিও পেশেন্টকে নিয়ে এখন চিন্তার কিছু নেই। তবে কিছু কমপ্লিকেশনস আছে যেগুলোর জন্য অবজারভেশনে রাখতে হবে ওকে। তাছাড়া নরমাল বেডে শিফট করার পরে আরো কয়েকদিন হসপিটালে থাকতে হবে।
শারীরিক যন্ত্রণা আর নানা কম্পলিকেশন্সের কারণে বেশিরভাগ সময় সেডেটিভের প্রভাবেই ছিল সৃজা। সাধারণ বেডে ওকে শিফট করা হলো চব্বিশ ঘন্টা পরে। বেডে দেওয়ার আরো কয়েকঘন্টা পর ওকে দেখার পারমিশন পাওয়া গেল। ইহসানের জোরাজোরি না মেনে এলিজা আগে ওকেই পাঠাল পরিস্থিতি বিবেচনা করে। যেন দু’জনে একান্তে কিছুটা সময় কথা বলতে পারে। ইহসান চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্লাইডিং ডোরটা সরিয়ে ধীরপায়ে কেবিনে প্রবেশ করে দেখল মলিন, ফ্যাকাশে মুখে এদিকওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে সৃজা। ওর চোখদুটো রক্তিম। শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখেই সৃজা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল। ওকে কাঁদতে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইহসানও। হুঁশ ফিরে আসামাত্রই মারকুটে ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সে সৃজার দিকে। চাপা কিন্তু রাগান্বিত স্বরে বলল,
“এই তোর দায়িত্বজ্ঞান আর নিজের প্রতি খেয়াল রাখা? তিনদিন অজ্ঞান থেকে, আমাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে? শান্তি পেলি তো? আমাকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পেলি?”
সৃজা কিছু না বলে শুধু অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তাতে ওর চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ওকে নীরবে কান্না করতে দেখে ইহসান আরো ক্ষেপে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমড়ে একহাত রেখে অন্যহাতে চুলে ব্যাকব্রাশ করার মতো করে ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে দাঁড়াল। একপাশের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ‘‘যাহ! আমি কেন তোর কাছে এক্সপ্লেনেশন চাইছি? আমি কে? আমি তো খারাপ, দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী। তোকে না বলে ঘুরতে চলে গেছি। নিজের বউ-বাচ্চাকে দেখে রাখতে পারিনি যখন, তখন কিছু বলারও অধিকার নেই আমার।
আই এম সরি।”
সৃজা ওকে দেখে, ওর কথা শুনে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় একাকার হয়ে গেল। শব্দ করে কেঁদে উঠে অস্ফুটস্বরে বলল, “বাচ্চারা আমার পেটে নেই কেন? ওরা কোথায়? আমার বাচ্চা কোথায়?”
“আমার কাছে জানতে চাইছিস কেন? তুই নিজেই তো ভালো জানিস ওরা কোথায়!”
সৃজার সাহস হয়নি কাউকে বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করার, যেচে পড়ে কেউ কিছু বলেওনি তাকে। ওর তাই দৃঢ় বিশ্বাস তার বাচ্চারা আর নেই। অবশ্য থাকবেই বা কীভাবে? যেভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে তাতে সাড়ে সাত মাসের টুইন প্রেগ্ন্যাসি টেকার কথা না। তাহলে কি ও কষ্ট পাবে বলেই কেউ ওকে কিছু বলছে না? সৃজার সুন্দর চোখদুটো পানিভর্তি হলেও তাতে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ আর অনুশোচনা। যেন খুব বড়ো একটা ভুল করেছে সে, যার কোনো ক্ষমা নেই। ওকে দেখতে এখন ঠিক, আদালতের কাঠগড়ায় তোলা আসামির মতো লাগছে। ইহসান ওর কান্নাকাটি দেখে মৃদুস্বরে ধমকে উঠে, “কান্নাকাটি বন্ধ।”
“ও…ওরা দেখতে কার মতো হয়েছিল?”
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠে ইহসান, “হয়েছিল মানে? ভাববাচ্যে কথা বলে কী বুঝাতে চাইছিস?”
কী বোঝাবে সৃজা? আসলেই কী বোঝানোর মতো ওর কাছে কোনো শব্দ আছে? নেই তো। এতো বড়ো কান্ড ঘটানোর পর কোনমুখে ওদের নাম নেবে সে? সৃজা অপরাধে জর্জরিত মুখটা ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। ওর মাতৃসত্তা যন্ত্রণা, হাহাকারে ওকে অতিষ্ঠ করে তুলছে ওকে। সৃজার মনে হচ্ছে ও মরে যাবে। নিজের প্রতি একটু যদি খেয়াল রাখতো, একটু সাবধান থাকতো তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। দু’জনকে পাশে নিয়ে চোখ জুড়াতো। নিজের খামখেয়ালিপনায় বাচ্চাদুটোকে হারিয়ে সৃজার ভেতরটা মরে গেছে। পেটে হাত রেখে ও ব্যাকুল হয়ে কাঁদতেই থাকে।
ওর অবস্থা দেখে মায়া হয় ইহসানের। হতাশ হয়ে এগিয়ে এসে ওর শুষ্ক ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে দিলো। চোখ বুজে মৃদু কণ্ঠে বলে, “তুই জানিস আমি মরে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে? তুই না ফিরলে আমার জানাযা হতো?”
সৃজার ঠোঁট কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। অসহায়ের মতো অনুনয় করে সে, “আমার বাচ্চারা কোথায়? কেন বলছ না তুমি?”
“বাচ্চারা এন.আই.সি ইউতে।”
___________
চলবে…