অশ্রুবন্দি পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯+৬০

0
3

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫৭

ইহসান হতাশ হয়ে এগিয়ে এসে সৃজার শুষ্ক ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে দিলো। চোখ বুজে মৃদু কণ্ঠে বলল, “তুই জানিস আমি মরে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে? তুই না ফিরলে আমার জানাযা হতো? তুই এসে আবার আমার জান বাঁচিয়ে দিয়েছিস, নয়তো আজ আমাকে আর দেখতে পারতি না।”

সৃজার ঠোঁট কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। অসহায়ের মতো অনুনয় করে সে, “আমার বাচ্চারা কোথায়? কেন বলছ না তুমি?”

“বাচ্চারা এন.আই.সি.ইউতে।”

কথাটা শোনার পর সৃজা এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাসই করতে পারল না যে তার সন্তানরা আছে, সত্যিই আছে! ওর চোখ দুটো স্রেফ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। শরীরে যতটুকু যন্ত্রণা আর কষ্ট ছিল, এক ঝটকায় সব যেন হারিয়ে গেল। খুশিতে চিকচিক করে উঠল ভেজা চোখদুটো। ইহসানের বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে গেল ওর এই আনন্দটুকু দেখে। সে সৃজার কপালে ভেজা একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যেভাবে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিস তোরা, শাস্তি হিসেবে এবার থেকে তিনজনকে সামলাতে হবে তোর। আমি কিন্তু আর কাউকে সামলাতে পারব না৷ এবার আমার ছুটি, আর নেই এসবে…”

“তোমার মতো করে আমি তো পারব না সবকিছু একা হাতে সামলাতে। উল্টো আরো ঝামেলা করব!”

“মারব একটা চড়! কী পরিমাণ চিন্তায় রেখেছিস তুই আমাকে, অন্য কেউ হলে এতক্ষণে টপকে যেত! আসলে আগের সৃজাই তুই ভালো ছিলি, নিজেকে একটু হলেও সামলাতে পারতি। অতি ভালোবেসে, তোকে যত্মে রেখে আহ্লাদী বানিয়ে সব ভুল আমি করেছি। এবার তাই ভুল শুধরাব।”

নিজের মানুষটার অভিযোগ, অনুযোগ শুনে সৃজা একটুও অভিমান করল না। উল্টো মেঘ ভেজা বাতাসের মতো শীতলতা ছড়িয়ে ওর চোখের পাতা কাঁপছিল, “ওরা কী দুটো মেয়ে? নাকি দুটো ছেলে?”

প্রশ্নের জবাবে ইহসান ফিসফিস করে নিজেই প্রশ্ন করে বসে, “তুই কী চেয়েছিলি?”

“আমি তো সুস্থতা ছাড়া অন্যকিছু চাইনি।”

“বাপ-মা দিয়েছিস তুই আমাকে।”

বলে আরো একটা গাঢ় চুমু খায় সে সৃজাকে। চোখ বন্ধ করে আদরটুকু নিতে নিতেই সৃজা অনুভব করে, তার পুরো পৃথিবীটা আচমকাই সুন্দর হয়ে গেছে! বসন্ত দিনের রঙিন পাতায় চারপাশ সবুজ হয়ে গেছ, গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে গেছে তার হৃদমাঝার! সেই সময়টাতেই ইহসান নিজের মাথা গুঁজে দিলো ওর কাঁধে। এরপর দীর্ঘশ্বাসের গরম হাওয়ায় ওর কাঁধ-গলা পুড়িয়ে অস্পষ্ট, অপরাধী স্বরে বলতে থাকে, “অথচ আরেকটুর জন্যই আমি ওদের হারিয়ে ফেলছিলাম। আসলে যতোই আমি তোর উপর রাগ দেখাই না কেন, ভুলটা তো আমারই! আমি যদি সেই রাতে আরেকটু সাবধান থাকতাম, আরেকটু খেয়াল রাখতাম। তোকে ছেড়ে কোথাও না যেতাম তাহলে এই দিন দেখতে হতো না…”

“কিন্তু তুমি গেছিলে কোথায়?”

“একজনকে মারতে।”

আঁতকে উঠে সৃজা, উচাটন গলায় বলে, “কাকে?”

“আমার জীবন ছিনিয়ে নিতে চাওয়া কুলাঙ্গারটাকে…”

হতবিহ্বল সৃজা ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না। লোকটা কী মজা করছে? এসব নিয়ে কেউ মজা করে? কে ওর জীবন ছিনিয়ে নিতে চায়? কাকে মারতে গেছিল ও সেদিন? এই মানুষটার এতবড়ো শত্রুটাই বা কে? সৃজা কণ্ঠে বিস্ময়, ভয় ঢেলে প্রশ্ন করে, “মানে? কে সে? কাকে মারতে গেছিলে তুমি? এইইই!!”

সৃজার নড়াচড়ায় ইহসান কিছুটা বিরক্ত হয়ে গলা থেকে মুখ তুলে তাকায়, প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে? বাঁধা দিচ্ছিস কেন?”

“তুমি এক্ষুনি কী বললে?”

ইহসান ভ্রুকুটি করে, “কী বললাম?”

“এক্ষুনি যে বললে আমার এক্সিডেন্টের রাতে কাকে মারতে গেছিলে, কেউ তোমার জীবন নিতে চায়। কী বলছ এসব?”

“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কে আমার জীবন নিবে? কাকে মারব আমি! আশ্চর্য!”

অবোধের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইহসান। এই মেয়েকে সে কখন বলেছে এসব? মনে পড়ছে না তো! ইহসান মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করল, মনে পড়ল, ঘোরের মাঝে থেকে একটু আগেই সে সৃজাকে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছে। আরেকটু সময় পেলে হয়তো ইনজান যে ওর ছবি বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিল সেটাও বলে দিতো! সম্বিৎ পুরোপুরি ফিরতেই রাগে মুখটা তেঁতো ঠেকল ইহসানের। মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিল। চোখেমুখে অন্যমনস্কতা আর বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে, রুক্ষ স্বরে বলল, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কে আমার জীবন নিবে? আমি কাকে মারতে যাব? আমি তো ঝামেলা মেটাতে গেছিলাম। সেই রাতে কারখানায় একটা ইমার্জেন্সি ছিল, নতুন একটা ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক লঞ্চের কাজ আটকে গিয়েছিল, সেটা সামলাতে গেছি। অনেক রাত হয়ে গেছিল বলে তোকে ঘুম ভাঙিয়ে আর বলিনি। ভেবেছিলাম, সকালে ফিরে তোকে সব বলব।”

একটু থেমে ঠাণ্ডা গলায় যোগ করল, “একবার তোর ঘুম একবার ভাঙালে তো আর ঘুমাতে পারিস না। তাই চুপচাপ চলে গেছিলাম। এর মধ্যেই যা ঘটালি, আমাকে সব ফেলে ছুটে আসতে হলো। তোর চিন্তায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল …এখনো হচ্ছে।”

শুধু মুখে না, চোখের ভাষাতেও একটা পরিশ্রান্ত ভালোবাসা মিশিয়ে দিল ইহসান। মিথ্যে হলেও খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সৃজা। এদিকে মুখ ফসকে সব সত্যি বলে দেওয়ায় ইহসান নিজের মাথাটাকে দেয়ালে ঠুকার জন্য কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল। ভিতরে ভিতরে নিজেকেই গালি দিল, ‘কথা বুঝেশুনে বল! এখনি তো একটা ভুল করে বউকে সন্দেহের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলি ডাফার!’

°

এলিজা জানে না, কতক্ষণ সে বোনের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যেন ওর বুকের ভেতর থেকে ফেটে পড়ছিল। কাঁদতে কাঁদতে যখন ওর হিঁচকি উঠে গেল, দম আটকে আসছিল, তখন সৃজা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল, “এই রকম কান্না তো আগে দেখিনি তোর! আরেকটু কাঁদ না এলিজ! নাকের জল, চোখের জল এক কর দেখি, কতখানি দুঃখ জমেছে তোর ছোট্ট বুকে… ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া আমার
এত্তো বড়ো মেয়েটাও যে এভাবে কাঁদতে পারে, জানতাম না তো!”

বোনের মৃদু ঠাট্টায় এলিজার কান্না থামেনি, বরং বেড়েছে, “তুমি হাসছ? আমি তো ভেবেছিলাম সব শেষ হয়ে যাচ্ছে… একা হয়ে যাচ্ছি… তোমাকে হারালে আমার বাঁচার আর কিছু থাকত না আপু…”

সৃজা ওর মাথাটা দু’হাতে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরল। গলার ভিতর কাঁটার মতো বিঁধে থাকা কষ্টটাকে ঠেলে বলল, “এসব কথা মুখে আনিস না এলিজ! আমি থাকি বা না থাকি, তুই থাকবি। তুই থাকলেই আমি বেঁচে থাকব কোথাও, কোনোভাবে। তুই তো আমার সবকিছু… মায়ের শূন্যতা আর বাবার অসহায়তার ভিতর দিয়ে তোর ছোট্ট হাত ধরে তোকে বড় করেছি। তুই ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার।”

এলিজা ভাঙা গলায় বলল, “তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাববে না।”

সৃজা তার মুখটা দু’হাতে তুলে চোখের জল মুছে দিল,
“ইশ! মুখটা কী লাল হয়ে গেছে…লাল আলুর মতো লাগছে তোকে! এভাবে আর কাঁদবি না, কাঁদলে তোকে আমার বোন মনে হয় না। কাঁদব শুধু আমি, আমাকে সামলাবি তুই। বুঝেছিস?”

এলিজা ভেজা চোখে মাথা নাড়ল, “তুমি খুব নিষ্ঠুর।”

ওকে একটু ধাতস্থ হতে দেখে, সৃজার প্রাণ যেন একটু হালকা হলো। আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ওদেরকে দেখেছিস? দেখতে কার মতো হয়েছে?”

এলিজা ছোট্ট করে মুখ গোমড়া করে বলল,
“আমার মতো।”

সৃজা চোখ বড় বড় করে তাকাল! মা সে, বাবা ইহসান। তাহলে এলিজের মতো দেখতে হলো কেন? ও বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই এলিজা বলল, “শুরুতে একেবারে আমার মতো ছিল। তবে এখন ভাইয়ার ছায়া ফুটে উঠছে। ডাক্তার-নার্স সবাই বলছে… ভাইয়ার মতো দেখতে হবে… শুনে ভাইয়ার মন খারাপ। ইজহান ভাইয়াও তো মেজাজ দেখাল, তাদের দু-ভাইয়ের চেহারা না কি ভালো না। ও আমার মতো দেখতে হয়েও আবার কেন চেহারা পালটে ওদের মতো দেখতে হচ্ছে…এই নিয়ে আফসোস!”

এ কথা শুনে সৃজা বিস্ময় নিয়ে বলল, “ওদের দু-ভাইয়ের চেহারা ভালো না? এটাও শুনতে হলো আমার? হায় আল্লাহ! এদের দু-ভাই এতো মিথ্যাবাদী কখন থেকে হলো? ছেঁড়া শার্ট, ছেঁড়া লুঙ্গি পরলেও তো মনে হয়, র‍্যাম্পওয়ার্ক করতে যাচ্ছে!”

এলিজা বলল, “আমিও তো সেটাই বলেছি ওদের৷ কিন্তু দু’জনেই মানতে নারাজ! তারা খুবই আপসেট, আমার চেহারা মুছে কেন তাদের চেহারা ভাসলো! আমি নাকি বেশি মিষ্টি, রুপবতী দেখতে!”

তারপর একটু হেসে ম্লান গলায় বলল, “অবশ্য আমি চাই না ওদের কেউ আমার মতো হোক, আমার মতো বেড়ে উঠুক! ভাইয়াদের মতো হলেই বেশি খুশি হব আমি…”

সৃজা খেয়াল করল এলিজার চোখ ভিজে উঠেছে আবার। অথচ মেয়েটা তা দেখাবে না বলে অন্যদিকে মুখ করে বসে রয়েছে৷ ও নিজের কাঁপা হাতটা দিয়ে এলিজাকে জোরপূর্বক নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর গালে হাত রাখল, গাল দুটো আবারও মুছে দিয়ে বলল, “তুই কী জানিস, এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটা কে?”

অকপটে বলল এলিজা, “তুমি।”

“উহু! এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে বুঝদার মেয়ে আমার এলিজ। তুই এতোটা ভালো, এতোটা অন্যরকম যে, আমার মতো হাজারো সৃজা তোর কাছে ম্লান! এলিজ, তোর মতো হৃদয় নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসে…”

“একটু বেশিই হয়ে গেল না?”

সৃজা ফিসফিস করে বলল, “বরং একটু কম হয়েছে।”

°

সবকিছুর মধ্যেও কোথাও একটা অস্বস্তি ছিল সৃজার মধ্যে। বারবার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঠিক নেই। ইহসানের চোখের দিকে তাকালেই সন্দেহ আরও জোরালো হচ্ছিল। কয়েকবার সরাসরি প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর পায়নি, শুধু কপালে দুটো শক্ত চুমু ছাড়া। তবে ব্যাকুল সৃজা যখন নার্সের মাধ্যমে জানতে পারল, নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ারেও নানা জটিলতার কারণে বাচ্চারা ঝুঁকির মধ্যে আছে। ওজন কম, হৃদপিণ্ডে সমস্যা, শ্বাস-প্রশ্বাস বিঘ্ন এবং পুষ্টির ঘাটতি তার বাচ্চাদের—এসব শুনে সৃজার শরীরে একধরনের অবসাদ ছড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতরটা শূন্য হয়ে গেল। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল সে।

সৃজা যখন নার্সের কাছ থেকে এসমস্ত তথ্য জেনেছিল তখন ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্টেন্ট করছিল ইহসান। যার কারণে সে উপস্থিত ছিল না সেখানে। তাই কেবিনে ফেরার পর সৃজার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে, ওকে ওমন করতে দেখে মেঝেতেই ওর পা দুটো আটকে গেল। সুদর্শন মুখটাতে ব্যাকুলতা মেশানো একধরনের অসহায়ত্ব নিয়ে যতই সে বুঝাতে চাইল, সৃজার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের মানসিক অবস্থাও ততই জটিল হয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছিল সৃজার চোখে পানি দেখে। সৃজার মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে নিয়ে যতই প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছিল ততোই মেয়েটার কান্না বাড়ছিল। এসব দেখে ইহসানের মাথা দপদপ করছিল। এই মেয়ের চোখের জল তার বুকের ভেতর দহনক্রিয়া, রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে বহু আগে থেকেই। একদম নিতে পারে মা সে সৃজার চোখের পানি। এই একটা জায়গায় সে ভীষণ দুর্বল, ভীষণ।তাই কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজেকে খানিকক্ষণ একা রাখতে সে চলে গেল হসপিটালের ছাদে। এলিজা তখন আপুকে বুঝাল, যেখানে বাচ্চাদের বাঁচারই সম্ভাবনাই ক্ষীণ ছিল সেখানে এখন অবধি যতটুকু সার্ভাইব তারা করেছে সেটা কী শুকরিয়া আদায় করার জন্য যথেষ্ট নয়? এরজন্য তো আরো খুশি হওয়ার কথা, কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাহলে আপু এত ভেঙ্গে পড়ছে কেন? সব হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে কাঁদছে কেন? সে কাঁদবে একমাত্র দুটো কারণে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় এবং বাচ্চারা এখনো
বেঁচে থাকায়!

নিজেকে দোষারোপ করতে থাকা সৃজা তার এলিজের কথায় একটু ধাতস্থ হয়েছিল। আসলেই তো! সে কাঁদছে কেন? এতো বড়ো দুর্ঘটনার পরেও ওরা যে এখনো পর্যন্ত তাকে ছেড়ে যায়নি এটাতেই তো তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এটাই তো ওর সবচেয়ে বড়ো উপহার! সে ব্যাকুল হলো বাচ্চাদের দেখতে। ইহসান এসে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করে দিলো। বাচ্চাদেরকে যখন সৃজার বুকে দেওয়া হলো এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হলো পুরো পৃথিবীটা সে নিজের কাছে ধরে রেখেছে। সবকিছু তার হাতের মুঠোয়।
উহু! এই জীবনে আরকিছু চাওয়ার নেই ওর। নিজের ছোট ছোট দুটো বাচ্চা, যাদেরকে নেই বলেই ভেবেছিল সে, অপ্রত্যাশিতভাবে তাদেরকে নিজের বুকে পেয়ে সৃজার দু’চোখের জল বাঁধ মানছিলোই না। সে সৃষ্টিকর্তার নিকট অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। গত কয়েকদিন না খেয়ে, নির্ঘুম কাটানো রাত্রিগুলো ইহসান ভুলে গেল তার সৃজার চোখের সেই আনন্দাশ্রু দেখে!

°
সৃজার শারীরিক অবস্থা ত্রুটিমুক্ত হওয়ায় ওকে রিলিজ করে দিলেও বাচ্চাদেরকে আরো কিছুদিন এডমিট রাখতে হবে। কিন্তু সৃজা জানাল, সে এখান থেকে কোত্থাও যাবে না। বাচ্চাদের হার্টবিট স্ট্যাবিলাইজেশন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও মায়ের সঙ্গে বন্ডিং তৈরি করার জন্য ওদেরকে সে কয়েক বেলা নিজের কাছে রাখতে পারে, বাড়ি চলে গেলে এসব
সে করতে পারবে না। সৃজা হাসপাতালেই রয়ে যাবে বলে ঠিক করল। ইহসান অগ্রাহ্য করল না, সে
নিজেও তো পারবে না ওদের না দেখে থাকতে!

প্রতিদিনই ইজহান হাসপাতালে ছুটে আসে তার টনা-মনাকে দেখতে। যতোবার আসে ততবারই তার সঙ্গে থাকে দুটো করে গিফট বক্স। সেগুলোতে জিরো সাইজ থেকে শুরু করে ওয়ান ইউক, টু উইক, থ্রি উইকের বেবিদের জন্য পোশাক আর খেলনা থাকে। তবে বেবিদের জন্য এই গিফট বক্স আনলেও এগুলো খোলার অনুমতি সে এখনো কাউকে দেয়নি। ইহসান ওর কান্ডে বিরক্ত হয়ে গিফট বক্সে কী আছে তা দেখতে চাইলে প্রতিবারই ইজহান তাতে বাঁধা দিয়ে শক্ত গলায় জানায়, টনা-মনা যতদিন না সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে ততদিন এগুলো খোলা নিষেধ!

ইহসান ওর নিষেধাজ্ঞা শুনে ঝাড়ি দিয়ে বলেছে,
বাড়ি ফিরেই যখন খুলতে হবে তাহলে সে এগুলো হাসপাতালে নিয়ে আসছে কেন? বাড়ি নিয়ে গেলেই হয়! প্রতুত্তরে ইজহান বলেছে, বাড়ির গিফট বাড়িতে। হসপিটালের গিফট হসপিটালে! এরমধ্যে ইস্মি ফোনে জানিয়েছে, ইজহান বাড়িতেও নাকি প্রতিদিন দুটো করে গিফট বক্স নিয়ে যাচ্ছে, আজিজ শেখও না কি বাড়িভর্তি করে ফেলেছে বাচ্চাদের জিনিস দিয়ে। কোনো মানে হয় এসবের? সৃজা আর এলিজা তাদের দু’ভাইয়ের বাকবিতন্ডা চুপচাপ বসে বসে দেখে। মাঝেমধ্যে ওরা ভুলে যায় এরা দুই ভাই আদৌ মানুষ না কি এলিয়েন? এলিয়েনই হবে হয়তো! নয়তো ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে এসেও ছোটোদের মতো একে-অপরের পেছনে লেগে থাকতো না। যেমন আজকেও, সন্ধ্যাবেলা ইজহান অফিস থেকে সরাসরি এখানে এসেছে দুটো বিশাল সাইজের গিফট বক্স নিয়ে। এতদিনে এতো এতো বক্স জমা হয়েছে যে, কেবিনে সেগুলো রাখার জায়গা নেই। ইহসান তাই যথেষ্ট ভালোভাবে ওকে সেগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে বলায়, ইজহান ক্ষেপে একশো একটা কথা শোনানো শুরু করলে ইহসান আর রাগ কমাতে পারেনি। কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজেও দ্বন্ধে লিপ্ত হয়ে গেল সে। ইজহান ক্ষোভের মাথায় ইহসানের চোয়াল বরাবর ঘুষি মারতেই সেও ভাইয়ের কলার চেপে ধরল। এভাবে ধরাধরি করতে করতে কখন যে, দু’জনেই ল্যাবের ভেতর ঢুকে পড়ল সেটা খেয়াল করল না তারা। একজনের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে আরেকজন গিয়ে যখন টেবিলে ধাক্কা খেল, কাচের বিকার মেঝেতে পড়ে শব্দ হলো তখনই টনক নড়ল দু’জনের।

“এক্সকিউজ মি! আপনারা কে? এখানে কী করছেন? এখানে ঢুকতে দিলো কে, এক্ষুণি বেরুন…রমিজ কোথায়? রমিজ এই রমিজ…”

মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকাল দুই ভাই। ডাক্তার নাবিলাতুজ জোহা দাঁড়িয়ে আছেন। তার চেহারা রাগান্বিত। তবে এ মুহূর্তে অতি বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। বিস্ময়ে হা হয়ে পরণের মাস্কটা একহাতে টেনে নিচে নামাতে নামাতে তিনি চমকানো গলায় বললেন, “আ আপনারা? মিস্টার শেখ…একি! আপনাদের দু’জনের চেহারাই তো এক! তার মানে…”

“ভাই হয়।”

ইহসান ইজহানের হাত ধরে টেনে ল্যাব থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কথাটা বলল। নাবিলাতুজ জোহাও পেছনে বেরিয়ে এলেন ওদের সাথে। করিডোরে এসে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললেন, “আপনারা টুইন?”

“দেখতেই পাচ্ছেন!”

এবারে বিস্ময় কেটে গিয়ে হাসি ফুটল নাবিলাতুজ জোহার চোখেমুখে, “টুইনের টুইন! বাহ! মজার ব্যাপার তো…”

ইজহানের মুখে নেমে এলো কালো ছায়া৷ ইহসানের হাত থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, “আমার টু-ইন না। মেয়ে হবে।”

গর্বিত শোনাল ওর গলা। নাবিলাতুজ জোহা হাসলেন,
“কংগ্রাচুলেশনস!”

“থ্যাংক্স!”

“সেদিন তাহলে আপডেট দেওয়ার সময় উনিই ছিলেন, আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল!”

ইহসানও তার কথায় সায় জানিয়ে সেদিনের ব্যাপারটা খোলাসা করল। সাথে ক্ষমাও চাইল আবার সেদিনের রুক্কজ ব্যবহারের জন্য। নাবিলাতুজ জোহা দু-ভাইয়ের সঙ্গে বেশ আলাপচারিতায় মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইর্মাজেন্সি তার ডাক পড়ায় তিনি অল্প কথায়ই সাক্ষাৎ শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। তিনি যেতেই ইহসান ইজহানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোর মেয়ে হবে?”

“ডাউট আছে তোর?”

“কে বলল তোকে?”

“কেউ বলবে কেন? ইস্মিতা, আমি—আমরা মেয়েই চাই। ছেলে চাই না।’’

ইহসানের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তেই। মেয়ে চেয়েছিস ঠিক আছে। কিন্তু ছেলে চাই না মানে কী? এসব কী কারো হাতে থাকে না কি? একে বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে এখন মেয়ে ধরে বসে আছে, পরে ছেলে হলে ইস্মির সাথে ঝামেলা শুরু করে দেবে। ও কর্কশ গলায় বলল, “ইজহান— আমি এখন নাটক, সিনেমা কোনোটার মুডেই নেই। অহেতুক আমার মাথা গরম করে রাগিয়ে দিস না। ছেলে চাই না যে বলছিস; প্রাণ দেওয়ার, লিঙ্গ নির্ধারণ করার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। মাথায় রাখ।”

সর্বশেষ কখন ইহসান ওকে ‘ইজহান’ বলে ডেকেছিল মনে পড়ে না ইজহানের। এক পৃথিবী বিস্ময় সে গলায় ঢেলে বলল, “ওসব বাদ দে। কিন্তু তুই এক্ষুনি কী বললি, আরেকবার বলতো! তুই কী আমার নাম ধরে ডাকলি?”

অতি বিস্মিত চোখজোড়ার দৃষ্টি দেখে ইহসান শক্ত গলায় বলল, “ডাকলাম।”

“ডাকলি? আসলেই?”

“ডাকলাম।”

“কেন ডাকলি?”

“কেন ডাকলাম সেটা বড়ো কথা না, বড়ো কথা তোকে সম্মান দিলাম।”

“যেমন?”

“আমার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতিটা সামলানোর জন্য। আমার সৃজার খেয়াল রাখার জন্য, আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে কনসার্ন থাকার জন্য। আমার হয়ে সো কল্ড বাপের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। আর আর, আর কী করেছিস জানি না, কিন্তু যা করেছিস তারজন্য তোকে নাম ধরে ডাকার সম্মান তো দেওয়াই যায়। তাই আমিও দিলাম।”

ইহসানের কথা শেষ হতেই ইজহান তীর্যক হাসলো, “তোর কী ধারণা, তোর এই ঠুনকো সম্মান পাওয়ার লোভে আমি এসব করেছি?”

“না।”

“তাহলে দিচ্ছিস কেন সম্মান, আমি চেয়েছি?”

রাগে লাল হয়ে গেছে ইজহানের চেহারা। গলার রগ ফুটে উঠছে। ইহসান রুদ্ধ স্বরে বলল,
“আচ্ছা দিলাম না তোকে সম্মান—কী চাই বল!”

“যা চাইব তাই দিবি? আছে তোর ক্ষমতা?”

“ক্ষমতার মালিক আল্লাহ! সাধ্যে যা আছে তা থেকে যা চাইবি তা-ই দেব!”

“ওকে, দ্যান তোর মেয়ে আজ থেকে আমার। ওকে আমি পালব, ভালো স্কুলে পড়াব, আমার কাছে কাছে রাখব! ও আমাকে বাবা ডাকবে। তুই ওকে দাবি করতে পারবি না।”

ভয়ংকর সব কথা, ভয়ংকর চাওয়া। বলা শেষ হওয়ার আগেই ইহসান গর্জে উঠল তীব্র রাগে, “ভালো কাজ করেছিস বলে যেই না এপ্রিশিয়েট করেছি ওমনি সুযোগ বুঝে আমার জানে হাত বাড়িয়ে নিজের রুপটা দেখিয়ে দিলি তো? আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে হাত বাড়ানোর স্বভাবটা তোদের কারোরই গেল না। একটা আড়ালে বসে বউ কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র করছে আর তুই আমার মেয়েকে নিয়ে নেওয়ার…আদৌ যদি বড়োআব্বা হওয়ার শখ থাকে তাহলে ওসব কুচিন্তা বাদ দে। নয়তো ওদের আশেপাশে ঘেঁষতে পারবি না তুই!”

ইজহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেল ইহসান। যেন গোণায়ই ধরে না ওকে। পেছনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ক্ষোভ ঝাড়ল ইজহান, “মেয়ে পেয়ে আকাশে উঠেছিস…আমাকে কাছে ঘেঁষতে না দেওয়ার তুই
কে রে? কচুর একটা ডাঁটি তুই!”

রাগের বশবর্তী হয়ে পাশে থাকা একটা ভারী ফুলের টবে লাথি মারলো ইজহান। টবটা শব্দ করে একপাশে কাত হয়ে পড়ে গিয়ে ফেটে গেল। করিডোর তখন খালি! হতবিহ্বল ইজহান এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ দেখেছে কি-না! কেউ দেখেনি নিশ্চিত হতেই সে পেছন ফিরল। আর ফিরতেই দেখল, হতভম্ব মুখে এলিজা দাঁড়িয়ে। ইজহান অপ্রস্তুত হয়ে গেল ওকে দেখে। বোকার মতোন মাথা চুলকে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আসলে, আমার একটা মেয়ে লাগবে তো…তাই! আমিও তো বাবা হই, তাই না বলো?
আমি আমার মেয়েকে চাইতে পারি না? এই শালা ভেড়া বুঝতেই চায় না! আমাকে শুধু শুধু রাগিয়ে দেয়।”

এলিজা ওর স্বীকারোক্তি শুনে, ওর কান্ড দেখে বহুকষ্টে নিজের হাসি আটকে চলে এলো। ওদিকে ইজহান ঘরের ল্যান্ডলাইনে ইস্মিকে ফোন দিলো,
“এই মহিলা! ভেড়াকে বল আমাকে একটু টনা-মনাকে কোলে নিতে দিতে। কু* আমাকে আশেপাশে ঘেঁষতে
দিচ্ছে না।”

“নিশ্চয় আপনি এমনকিছু করেছেন বা বলেছেন যারজন্য আপনাকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। ঠিক হয়েছে, উচিৎ হয়েছে একদম।”

ওপাশ থেকে কথাটা বলে ইস্মি ওর মুখের উপর ফোন কেটে দিলো। ইজহান বিস্মিত হলো তার বউয়ের সাহস দেখে। রাগান্বিত সে আবারো কল ব্যাক করতে যাবে তখনি পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, “কেউ কিছু না দিলে, ছিনিয়ে নিতে হয় ব্রাদার!”

আরকিছু পর্ব! ধৈর্য ধরুন, মন্তব্য করুন! শেষ করে দেব৷ আর এন্ডিং নিয়ে ভেবে লাভ নেই। প্লট অনুযায়ীই হবে।
______

[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫৮

ইজহান বিস্মিত হলো তার বউয়ের সাহস দেখে। রাগান্বিত সে আবারো কল ব্যাক করতে যাবে তখনি পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, “কেউ কিছু না দিলে, ছিনিয়ে নিতে হয় ব্রাদার!”

পেছন থেকে কারো তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে বলা কথাটা যেন বুক চিরে এলো। ইজহান ঝটকা খেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই চোখদুটো বিস্ময়ে ছলকে ওঠে, করিডোরের দেয়ালে স্যুট পরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখে। ইজহান স্তব্ধ গলায় বলে ওঠে, “তুই?”

°

এলিজা যখন কেবিনে ফিরে ইজহানের কান্ডগুলো বলে সৃজা শুনে বিস্মিত হলেও মজা পেয়ে হাসল কতক্ষণ! প্রশংসাসুলভ বলে, আসলেই ইজহানের মনটা শিশুসুলভ। উপরে উপরে যতোই হম্বিতম্বি করুক, তার মনটা কোমল। তাছাড়া প্রতিদিন যেভাবে উপহার এনে ঘর ভরিয়ে ফেলছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে বাচ্চাদের জন্য সবার থেকে বেশি সে-ই এক্সাইটেড। সৃজা ঠিক করে, বাচ্চারা এন.আই.সি.ইউ থেকে সুস্থ হয়ে বেরুলে দুটোকে একসাথে ইজহানের কোলে দিয়ে বসিয়ে রাখবে। তখন ওর রিয়েকশন ভিডিয়ো ধারণ করা হবে। একটা আধপাগল লোক, যে বাচ্চা চাইতো না সে কীভাবে তার ভাইয়ের বাচ্চাদের প্রতি পাগলামো করেছে, এই স্মৃতি রেখে দেবে।

রিপোর্টের উপর চোখ বুলানোর ভান করে ইহসান দুই বোনের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। তার মুখ শুকনো ও অন্ধকার। সৃজার এত আদিক্ষেতা তার সহ্য হচ্ছে না। বাচ্চাদের নিয়ে নিজের স্বামী কতোটা কনসার্ন তা দেখেছে তো এই মেয়ে? না দেখেনি৷ বোঝেওনি। ওরকম পাগলামো চাপা দিয়ে রাখে বলে তাকে রিজার্ভড পার্সন ভাবছে না কি? ইহসানের চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়। ঈর্ষায় গলা জ্বলছে তার। হাতে হাত ঘষছে সে। মনকে বোঝায় সে ইডিয়টটার প্রতি ঈর্ষান্বিত না। কিন্তু মন ঠিকই বলে, ইয়েস! ইউ’আর ইনসেইনলি জেলাস অফ দ্যাট ইডিয়ট। ইহসান ফুঁসে উঠে তার মনের কথায়। সে তার মেয়ের ভাগ কাউকে দেবে না, ছেলেরও না। আচমকা দু-বোনের গল্পের মধ্যিখানে অসহ্য হয়ে সে তার খাড়া নাকটা ঢুকিয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে, “যাকে নিয়ে হাউকাউ করছিস, সে যে নাম্বার ওয়ান ইডিয়ট তুই ভুলে গেছিস?”

সৃজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে, “এখানে এসব প্রসঙ্গ আসছে কেন?”

“আসবে না-ই বা কেন? সে আমাকে কী বলে গেছে জানিস? আমার মেয়েকে লিখেপড়ে দিয়ে দিতে। সে বড় করবে। তাকে মা ডাকবে। আমি কোনো দাবি করতে পারব না। হাহ!”

চোখমুখ ঈর্ষায় লাল হয়ে গেছে ইহসানের। সৃজা বুঝতে পারে সেটা। ওর কিছুটা মজাও লাগে দুই ভাইয়ের কান্ডে। তবে ইহসানকে বোঝাতে সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, “বেবিদের জন্য খুব এক্সাইটেড, তাই হয়তো বলেছে। দেখো না, প্রতিদিন কীভাবে ওদের জন্য পাগলামো করছে, এত্ত এত্ত গিফটস আনছে ধারণা করতে পারছ বাচ্চাদের কতোটা ভালোবেসে ফেলেছে? ডেলিভারির সময় আমাকে নিয়ে কী ছুটোছুটি, রক্ত পর্যন্ত দিয়েছে। ইস্মিতা ভাবী তো ফোনে এসব বলে বলে খুশিতে কাঁদে। ভুলত্রুটি অন্যায় যা করেছে আগে করেছে। এখন তো না। তাই এপ্রিশিয়েট করা উচিৎ সবারই। তাছাড়া গতকাল তো আমাকে বলেই গেল, তোমার মেয়ের নাম ভাইয়া রাখবে। আমিও তো হ্যাঁ বললাম।”

এলিজাও বোনের কথায় সমর্থন জানালো। ইহসানের চোখদুটো জ্বলে উঠল। ডেলিভারি টাইমে যা করেছে তাতে ইহসান চিরকৃতজ্ঞ ওর কাছে। সে স্বীকারও করে। কিন্তু তাই বলে তার মেয়ের নামও ঐ ইতরটা রাখবে? ইহসান সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠে। রিপোর্টটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বলে, “আমার মেয়ের নামও তিনি রাখবেন? বাব্বাহ! আমার বউ আমাকে না জানিয়ে আমার ভাইকে পারমিশন দিয়ে দিলো আমার মেয়ের নাম রাখতে? বেশ ভালো ব্যাপার তো! তো বাপের নামের জায়গায় ওর নামটাই লাগিয়ে দিস, আমি আর কে হই তোদের? খারাপ সময়ে ফুর্তি করছিলাম, রক্তের ব্যবস্থা করতে পারিনি বউয়ের জন্য ; আমার কী আর মেয়ের নাম রাখা সাজে …”

সৃজা ভেবেছিল ইহসান খুশিই হবে ভাইয়ের পরিবর্তনের কথাগুলো শুনে। কিন্তু ও যে এভাবে মাইন্ড করে ফেলবে বোঝেনি। এবারে ওর রাগ দেখে চুপসে গিয়ে বলে, “তুমি এমন করছ কেন? আমি তো এতকিছু ভেবে বলিনি…কাল টেডি নিয়ে এসে আমাকে বলল কথাটা। চাচা ভাতিজির নাম রাখবে। আমি মুখের উপর না করতাম কীভাবে?”

ক্ষেপে যায় ইহসান। ওর গা জ্বালা করছে। ঈর্ষায় ফেটে পড়ে সে, “ ওহ! তার মানে গিফটস দিয়েই তাহলে আমার মেয়ের দখল নিয়ে নিতে চাইছে? সব এই গিফটসের জন্য তো? এই এলিজ চল আমার সাথে…”

“কোথায়?”

“এখন থেকে আমিও উপহার আনব প্রতিদিন, আর আমার বউয়ের থেকে বাচ্চাদের এটা করার, ওটা করার পারমিশন চাইব। দেখি এবার, তিনি কাকে গ্র‍্যান্ট করেন।”

চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে বিস্মিত এলিজার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল ক্ষুদ্ধ ও ঈর্ষান্বিত ইহসান। সৃজা শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইল। পাগল হয়ে গেল না কি তার স্বামীটা, সে বুঝে পেল না। তবে পুরো ব্যাপারটা আবারও ভাবতেই মজা পেল ভীষণ যখন বুঝল, ইহসান শেখ ইজ জেলাস অফ হিজ ওউন ব্রাদার!

°

হসপিটালের তিনতলায় আধুনিক সাজে সজ্জিত ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসা দুই ভাই। হালকা খাবার অর্ডার করেছে তারা, তবে মূল উদ্দেশ্য আলাপ করা। ইজহানের চোখমুখ গম্ভীর। সে শাণিত চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। আর ইনজান ঠেস দিয়ে চেয়ারে বসা। তার স্যুটের বোতাম খোলা। সামনে বসা বড়ো ভাইয়ের কঠিন মুখখানা একপলক দেখে নিয়ে একটু হেসে পিৎজার উপর কাটার চালাতে চালাতে বলে, “ব্রো খুব স্বার্থপর। সে সবকিছু নিজের দখলে রাখতে ভালোবাসে। ভাগ দিতে চায় না। যেমনটা মাম্মার বেলায় করেছে, তেমনটা ঐ দুটো বাচ্চার সাথেও করছে। দেখলে না, তুমি ওর মেয়েকে চেয়েছ, মেয়েকে মা বানাবে বলে চেয়েছ। অথচ কী রকম রিয়্যাক্ট করল? সবার সাথে ও এরকম করে। সাচ আ হিপ্রোকেট। একটা স্বার্থপর। তাই বলছি তুমি ওর মেয়ের ভাগটুকু ছিনিয়ে নাও, নিজের মতো বড়ো করো… যা খুশি করো। শুধু খেয়াল রেখো যেন, ব্রো তার মেয়েকে না পায়। মেয়ের ভালোবাসা না পায়। তার যে বুকভরা স্নেহ সেসব যেন সে মেয়েকে দিতে না পারে…”

পাগলামো কথাবার্তা। এমন হয় না কি? সে এতোটাও ছাগল নয় সে এই সাইকোর কথায় কান দেবে। ইস্মিতা তার প্রতি এখন অনেকটা সদয়, অনেকটা ভালোবাসে ওকে। সে এমন কিছু করে বৌয়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে চায় না যেখানে ইস্মিতা নিজেই তাকে মেয়ে দেবে। তাছাড়া ভেড়ার সাথে তিক্ততা যেটুকু আছে থাকুক, আর বাড়ানোর ইচ্ছে নেই তার। পরে দেখা যাবে বুমেরাং করে সে তার আর ইস্মিতার মেয়েকেই ছিনিয়ে নেবে। তাছাড়াও টনাটাও তো আছে, ভাতিজাকেও সে আদর করতে চায়। উল্টাপাল্টা কথায় কান দিয়ে সে বড়োআব্বা হওয়ার সুযোগ খোয়াতে পারে না। সে এতোটাও বোকা না। এদিকে ইনজান তাকে ব্রেন ওয়াশ করার চেষ্টায় বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছে, যেগুলো শুনে ইজহান একপর্যায়ে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে, “স্টপ দিস ননসেন্স।”

পিৎজার টুকরোয় কামড় বসিয়ে একগালে রেখে ইনজান থমকে যায়, “ভালো না? অন্য বুদ্ধি দেব?”

“তোর বুদ্ধির দৌরাত্ম্য আমার জানা আছে। তাই থ্যাংক্স, আমি আগ্রহী নই তোর এসব উল্টাপাল্টা
বুদ্ধি শুনতে।”

এতো ভালো ভালো বুদ্ধি দিলো অথচ বিগ ব্রাদার টু মানলোই না? ইনজান যেন দুঃখ পেল। হতাশ গলায় মতো বলে, “এজ ইয়র উইশ।”

এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা। দুই ভাই নিশ্চুপ। কেউই কথা বলে না। ইনজানের পেটে ক্ষিধে, তাই সে খাচ্ছে। একঘন্টা সময়ে দুটো আস্ত পিৎজা, দুটো স্যান্ডউইচ, এক বাটি পাস্তা আর পাঁচ টুকরো চিকেন ফ্রাই সাবাড় করেছে সে। এই ছেলে খেতে পারে৷ সব খায়। কোনো বাছবিচার নেই। তার খাওয়ার স্টাইলও দারুণ, মুগ্ধ হওয়ার মতোন। খাওয়ার সময় মনে হয় একটা ছোটো বাচ্চা সময় নিয়ে খাচ্ছে। অথচ ছেলেটা একটা মা র্ডা রার। মুখ দেখে, হাসি দেখে বোঝারই উপায় নেই একাধিক মানুষকে সে টপকে দিয়েছে নিজের ইচ্ছেকৃত, অনিচ্ছাকৃত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইজহান বহুদিন পর ছোটো ভাইয়ের খাওয়া দেখে। তবে সে কিছু খায়নি। এসব ক্যান্টিন-ফ্যান্টিনে সে খেতে পারে না। তার ধারণা ওরা না ধুয়েমুছে, নোংরা হাতে অস্বাস্থ্যকরভাবে একেক পদ তৈরি করে, যা খেলে নির্ঘাত সে টেবিল ভাসিয়ে বমি করে দেবে। ফাইভ স্টার ছাড়া তার জমে না। জমে না ইস্মিতার হাতের সুস্বাদু রান্না ছাড়াও। ইস্মিতার কথা মনে আসতেই তার একটু অস্থির লাগে। ভাবে, সে এখানে কী করছে? তার তো এখন বৌয়ের কোলে মাথা দিয়ে আধঘন্টা শুয়ে থাকার কথা। পেটে মাথা রেখে বাচ্চার নড়নচড়ন অনুভব করার কথা। আর মাত্র কিছুদিন, এরপর বাচ্চাটা বেরিয়ে আসবে, তার মা হয়ে। কিন্তু যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়? এসব ভেবে ইদানীং আতঙ্ক জমা হচ্ছে তার বুকের ভেতর! ইজহান আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনজানের দিকে তাকায়। ভালোভাবে পরখ করতে থাকে কলিজার সিঙারা খেতে থাকা ইনজানকে। এদিকে ওকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকায় ইনজান ধীরেসুস্থে সিঙারাটা শেষ করে, ওয়েট টিস্যুতে মুখ মুছে, রগ ভেসে থাকা হাতটা কপালে ঘষে সরু চোখে তাকায়। মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আসার পর একবারও জড়িয়ে ধরোনি। এখন কী দেখছ?”

কী দেখছে প্রশ্নের জবাবে ইজহান নিরুত্তরে, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইনজানের দিকে। সম্পর্কে তার ছোটো ভাই। চার বছরের ছোটো। খুব আদরের আবার খুব অনাদরেরও। কত আবদার, কত বায়না সে মিটিয়েছে একসময়! আবার উল্টাপাল্টা কথা বা কাজ করলে মেরেছেও ভীষণ। ইহসানের নেওটা হয়ে ওর পিঠ পিছে লেগে থাকলেও এমন অনেক রাত গেছে যেখানে ইনজান ওর সঙ্গে সারারাত বসে গেইমস খেলেছে, জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। মাসের শেষরাত্রিতে টেরেসে বসে সস্তা ধরণের মাদকও সেবন করেছে দু’ভাই একত্রে। সেসব দিন পুরোনো হয়েছে বহু আগে। ইজহান টের পায় ইহসানের সাথে রেষারেষিটা বেশি থাকলেও আরসালানের সঙ্গে তার ভাব নেহাতই কম ছিল না। অথচ এই ভাইটার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ বা স্বাভাবিক যোগাযোগ হয় না বহু বছর! একটা পরিচিত মানুষ এতটা অপরিচিত হয়ে যেতে পারে? নিজের ভাইকে এমন পরপর লাগে? ভাইকে দেখে প্রতি মুহূর্তে বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁকা লাগছে ওর। বলিষ্ঠ শরীরে পরণে স্যুট। পায়ে শু। চওড়া কপাল, খাড়া নাক, গালের কাটা দাগ, ওয়েভি লং চুলের কাট, চাহনিতে তীব্রতা, হিংস্রতা সবকিছুই আগের মতো আছে। সামান্য স্বাস্থ্যবান আর গায়ের রঙের উজ্জ্বলতা আগের চেয়েও বাড়া ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি আরসালানের। ইজহান বসা থেকে উঠে ত্রস্ত পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ইনজান এক ঝটকায় ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে। আদুরে চোখে তাকায়। ইজহান ভাইয়ের চাওয়া বুঝে নিয়ে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে সেখানে দুটো চুমু বসিয়ে দেয়। ইনজান চোখ বন্ধ করে ভালোবাসার স্পর্শটা উপভোগ করে। ইজহান ওভাবেই কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কতবছর পরের দেখা?”

“অলমোস্ট আট।”

“ফোন ক’বার করেছিলি?”

“ঊনপঞ্চাশ।”

“কাকে করেছিলি?”

“তেত্রিশ বার তোমার রাইভালকে। সাতবার লাভলি ফাদারকে, আটবার আমার প্রিয় ব্রাদার মানে তোমাকে।”

“আর একবার?”

“ল্যাভেন্ডারকে।”

“সেটা কে?”

“দুটো কেউটা জন্ম দিয়ে তোমাকে চাচা বানিয়ে দেওয়া মহোদয়া, তবে ঐ একবার যে কলটা করেছি সেটা মহোদয়া ধরেননি!”

কথাগুলো কাঁটার মতো বিঁধে ইজহানের কানে।
রাগে চোখ রক্তিম হয়ে যায়। চুলের মুঠি ধরে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করে, “ঐ! তোর ভাইয়ের বউ হয়।”

ইনজানের ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। সে একটু সোজা হয়ে বসে বলে, “সো হোয়াটটট? তোমরা ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্কে বিশ্বাসী না আমি। তাছাড়া ভালোবাসি বেগুণি ফুলকে।”

ইজহান ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ে। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে, “আর সৃজা, সে তোকে ভালোবাসে?”

“উহু! সে তো আমাকে ভালো করে চেনেই না, দেখেওনি সেভাবে। তবে ওর ভালোবাসা চেয়েছেটা কে? আমার চাই না ওর ভালোবাসা। আমার একার ভালোবাসা যথেষ্ট ওর জন্য।”

একটু থেমে বিরতি নিয়ে কফি সিপ নিয়ে সে বলে, “লাইফে এই একটা মেয়েই, যাকে আমি একটুও ছুঁতে পারিনি। তার আগেই তোমার বাপ আমাকে দেশ থেকে লাথি মেরে বিদায় করে দিলো। তাই বোঝো, আগ্রহটাও বেশি!”

রাগ লাগে ইজহানের। হঠাৎই সে বলে উঠে, “এতোই যখন আগ্রহ তাহলে বিয়ে করে নিলি না কেন?”

“কাম অন ব্রাদার। বিয়ে একটা ঠুনকো কাগজের স্বাক্ষরে মোহর মারা বন্দিদশা। সমাজের নামে, আইনের নামে, নৈতিকতার নামে একটা চুক্তি, যার মধ্যে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নেই। আমি এমন কোনো চুক্তি বিশ্বাস করি না।”

ইজহানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কথাগুলো শুনে। বিয়ের এমন বিকৃত ব্যাখা? অথচ ইস্মিতা সেদিন কী সুন্দর করে বলল, বিয়ে মানে শুধু একটা চুক্তি নয়।
এটা এক আত্মিক সম্পর্ক। ভালোবাসা, মায়া, মোহ, টান, দায়বদ্ধতা—যেসব গড়ে ওঠে একটা অদৃশ্য শক্তিতে, অদৃশ্য বন্ধনে, একটা শপথে। আর শপথ দলিলবদ্ধ করার আনুষ্ঠানিকতাই বিয়ে।। যার মূলমন্ত্রই একে-অপরকে ভালোবাসা। দু’জন থেকে তিনজন বা একাধিকজন হয়ে সারাজীবন এক হয়ে থেকে যাওয়া। আরসালান বোঝে এসব? বোঝে না। না বুঝেই এসব বলছে। অবশ্য সে নিজেও বুঝতো না। সে ভাবতো, বিয়ে মানেই ইস্মিতা তার হবে। শরীর, মন, নিঃশ্বাস, ইচ্ছা সবকিছুকে ঘিরে একমাত্র সে থাকবে। তাই যখন ইস্মিতা ওকে রিজেক্ট করে দেয়, পালিয়ে যায়, ওর মধ্যে তীব্র একটা আতঙ্ক জন্ম নেয়। তার পাশে আছি বলা ইস্মিতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে সে দু’রাত ঘুমাতে পারেনি, খেতেও পারেনি। ইজহানের চোখে ভেসে ওঠে পুরোনো স্মৃতিগুলো! একটু সময় পর রুদ্ধ স্বরে সে বলে ওঠে, “বিয়ে মানে চুক্তি না… এটা শপথ। একসাথে মরার আগ পর্যন্ত একে অপরকে ভালোবাসার, ক্ষমা করার, অপেক্ষা করার শপথ। আর তুই সেটা ঘৃণায় ভরিয়ে দিয়ে নিজের লালসার নাম দিয়েছিস ভালোবাসা? তোর এই নাটকটা বন্ধ কর। এটা ভালোবাসা না… এটা নোংরামো। আমি বলছি, ভুল থেকে শিখে ওঠা পাপী হিসেবে।”

ইনজান ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। নিচু স্বরে বলে, “নীতিবিরুদ্ধ আরসালান ইনজান শেখের নীতিকথা সহ্য হয় না। তাই বোলো না। তাছাড়া আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক। যেখানে শুধু আমিই চাইব, আমিই পাব। যেখানে সামাজিক নিয়মের মোড়ক নেই তবে প্রবল আকর্ষণ আছে। সমাজ বলবে, এটা ভুল, এটা পাপ, কিন্তু আমি সমাজের নিয়ম মানতে আসিনি। আমি শিকারি, আর শিকার কখনো শিকারির অনুমতি নেয় না। তাই আমি সো কল্ড সমাজের তোয়াক্কা করি না।”

ইজহানের চোখে বিস্ময়, রাগ, ক্রোধ সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এতোটা পাপী তার ভাই? সম্পর্কের মূল্য দিচ্ছে না? তার যেন বমি পায় হঠাৎ। নিজেকে সামলে তীব্র গলায় বলে বসে, “দিস ইজ ঠু মাচ! অযথা ঝামেলা পাকাতে চাইছিস। ভালো হবে না তোর…”

“ভালো নামক বা ল—আমার সঙ্গে কখনো হয়েছে? হয়নি। তাই তোয়াক্কা করি না তোমার হুমকি।”

“ইউ’আর আ পিস অফ ফিলথ, ইওর ভাইল থটস মেইক মি ওন্ট টু কিল ইউ।”

ভাইয়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথা, গালিতে ইনজানের কিছু যায় আসে না। সে কফিতে সিপ নিতে ব্যস্ত। জীবনটা তার। আর এই জীবনে যা চেয়েও সে সবই পেয়েছে। আর যেগুলো পায়নি, দেওয়া হয়নি ওকে, যেটুকু বাকি থেকে গেছে সে নিজেই আদায় করে নেবে। নয়তো কেটেকুটে দেবে৷ ইজহানের রাগে লাল হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে সে একপেশে হেসে বলে, “তোমার সুন্দরীর দিকে তো নজর দিইনি, তুমি এতো রাগছ কেন?”

ইজহানের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়, সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেয় ইনজানের গালে, “কারণ সে আমার টনা-মনার মা।”

ক্যান্টিনের স্টাফ থেকে শুরু করে খেতে আসা সবাই এই দুই সুদর্শন যুবকের কান্ডকারখানা দেখছিল এতোক্ষণ। তবে এ পর্যায়ে চড়ের শব্দ পেয়ে থমকে যায় তারা। মুহূর্তে থেমে যায় চামচের শব্দ, ঠোঁটের হাসি। সকলের কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাক হয় ওদের দিকেই। কেউবা গসিপের খোরাক খুঁজে পেয়ে ফিসফাস শুরু করে। কেউ খাওয়ায় মন দেয়। কিন্তু ইনজানের ভেতর এতটুকুও হেলদোল হয় না। সে অপমানে স্থির, ভয়ানকভাবে স্থির। চড় খেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। তার চোখজোড়া রক্তবর্ণ, জ্বলছে প্রতিহিংসায়। হঠাৎ টাইয়ের নটটা খুলে, এক ঝটকায় পরণের স্যুটের ব্লেজারের অংশটা ছুঁড়ে ফেলে টেবিলের ওপর। এরপর ভেতরের সাদা শার্টের সবগুলো বোতাম একে একে খুলে আলগা করে বা-কাঁধের শার্টটা নামাতেই ব্যান্ডেজে আবৃত আংশটা বেরিয়ে আসে। ইজহান তখন রাগান্বিত, হতভম্ব! ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে বিচলিত ও গমগমে কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “হোয়াট ইজ দিস?”

ইনজান মাথাটা পেছনে ঠেলে দেয়, ঘাড়টা টানটান করে সোজা করে বসে। চোখ দুটো পিশাচের মতো লাল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। কণ্ঠে বিদ্বেষ নিয়ে সে ইজহানকে বলে, “তোমার সেই টনা-মনার মায়ের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ব্রো আমাকে মেরে ফেলতে গেছিল। বুঝতে পেরেছ? আমাকে মারতে গেছিল। আমি, তার ভাই। তার মায়ের অংশ। যেই মাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বলে মুখে বুলি ফোটায়। সেই মায়ের অংশের বুকে ট্রিগার চাপতে একটুও
তার হাত কাঁপেনি। একটুও না…না, না..”

শেষ “না” টা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ইনজান টেবিলের ওপর এমন এক থাবা বসায় যে পুরো ক্যান্টিন কেঁপে ওঠে। টেবিলের উপর থাকা তৈজসপত্র কয়েকটা গড়িয়ে পড়ে ভেঙে যায়। কেউ কেউ চমকে ওঠে, কেউ বা পুনরায় হতবিহ্বল হয়। কেউ শোরগোল শুরু করে। পরিস্থিতি সামলাতে ভীত, হতচকিত এক ক্যান্টিন স্টাফ দৌড়ে এসে বিনীত গলায় বলে, “দয়া করে চিৎকার করবেন না স্যার… এটা হাসপাতালের ক্যান্টিন। পেশেন্টরাও এখানে খেতে আসে। প্লিজ, আপনি যদি আর্গুমেন্ট করতে চান, বাইরে—”

ইনজান বসা থেকে উঠে ঠাস করে স্টাফের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তোর কথায়? তোর? তোর মতো নিচু আর দু-টাকার স্টাফ ঠিক করে দিবি আমি কোথায় গিয়ে আর্গুমেন্ট করব?”

চড়টা এতই জোরাল ছিল যে, টাল সামলাতে না
পেরে স্টাফটা পাশের টেবিলের উপর হুমরি খেয়ে পড়ল। টেবিলে দুটো যুবক বসে খাচ্ছিল। ভাত, তরকারি সব এবার ছিটকে তাদের গায়ে পড়ল। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকার পর, ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। যেহেতু দোষ স্টাফের নয়, তাই তারা গালি দিতে দিতে ইনজানের দিকে তেড়ে এল। কিন্তু ইনজান তাদেরকেও থাপ্পড় বসিয়ে দিল। একপ্রকার হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল সেখানে।

ইজহান এতক্ষণ রুক্ষ মূর্তিতে বসে ছিল, তার এসবে কিছু যায় আসে না। কারণ সে নিজেই এমন। তার নিজের পাগলামোতেও স্থান, কাল, সময় প্রাধান্য পায় না। এমন কাউকে কীভাবে সামলাতে হয় সে জানে না, সবসময় সবাই তাকেই সামলায়। কিন্তু এখন আরসালানের এই ক্রোধান্বিত অবস্থা তাকে সামাল দিতে হবে। বড়ো ভাইয়ের সামনে ছোটো ভাই এমন আচরণ করবে বিষয়টা অকোয়ার্ড লাগবে ভেবে উঠে এসে ভাইকে শক্ত হাতে আটকাল। ইনজান ততক্ষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছে। রাগে ফেটে পড়ছে
সে, “শুয়োরটা আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমার গায়ে? আমার! যেখানে তোমরা ছাড়া আমার বাপও আমাকে টোকা দেয়নি সেখানে এই শুয়োর দিয়েছে…ওকে তো আমি ছাড়ব না! ওর কলিজা কত্তবড়ো আমি আজ সেটা ছিঁড়ে দেখব…”

লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে ইনজান। বোঝাই যাচ্ছে সে শ্বাস নিতে পারছে না। তবুও ক্রোধ কমে না ওর। ইজহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের অবস্থা দেখে। এই ছেলের শ্বাসটানের সমস্যা আছে। রাগ উঠলে যখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, তখন আরো বাড়ে সেটা। যদিও সে বিরক্ত তবুও দায়িত্বশীল ভাই হওয়ার মতো করে দাঁতে দাঁত চেপে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে বলল, “গেট আ হোল্ড অফ ইয়রসেল্ফ, জান! এটা সিনক্রিয়েট করার জায়গা না!”

আমাকে আশেপাশে খেতে আসা সবাই তাকিয়ে ওদের দিকে। কয়েকজন তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, “খেতে আসছি তো না কি? এভাবে গ্যাঁজাচ্ছেন কেন ভাই? এটা গেঁজানোর জায়গা না। বাইরে ফুটুন…যত্তসব…”

আগুনে ঘি ঢাললে যেমন হয়, তেমনি তড়তড় করে মাথায় রক্ত উঠল ইনজানের। ঘাড় ফিরিয়ে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে সে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আধখোলা শার্টে কাঁধের ওখানে ব্যান্ডেজ নিয়ে ফুঁসতে থাকা সুদর্শন যুবকের দৃষ্টি দেখে লোকগুলো ভড়কে গেল। নিয়ন্ত্রণহারা ইনজান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আমি গ্যাজাচ্ছি? আর তোরা কী করছিস আমাকে নিয়ে গসিপ করা ছাড়া? তোদের মুরোদ কতটুকু আমার দেখা হয়ে গেছে ডাফারের দল!”

“আই সেইড স্টপ দিস ননসেন্স! চল এখান থেকে…!”

ইজহান প্রচন্ড রেগে ধমকে উঠল ভাইকে। ইনজান তাতে থামলো বটে তবে শাণিত দৃষ্টিতে সব ক’টাকে সে দেখে নিলো। তাকে নিয়ে আজেবাজে বলা? ওয়ার্ন করা? তার গায়ে হাত দেওয়া? তাকে ফুটতে বলা? দ্বিতীয়বার যদি এরা সামনে পড়ে, পিষিয়ে দেবে সে মাটিতে। এদিকে ম্যানেজার এসে হল্লা শুরু করায় ইজহান ভুড়িওয়ালা লোকটার মুখ বন্ধ করতে টাকার বান্ডিল ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছুঁড়ে মেরে ইনজানকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ওরা বেরিয়ে যেতেই বিরক্ত লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, “বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া পোলা, দাপট দেইখাই বোঝা যাইতেছে। দেখলেন কতগুলা টাকা ছুঁইড়া মারল? বলিহারি মা-বাপ, টাকার পাহাড়ে বড়ো করে অথচ পাবলিক প্লেসে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখায় না। যত্তসব…”

°
একপ্রকার টেনে-হিঁচড়েই ইনজানকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসে ইজহান। তার মেজাজ বিক্ষিপ্ত, ক্রমেই সেটা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বহু কষ্টে ধৈর্য ধরে সে, যাতে এই সাইকোটা উত্তেজিত অবস্থায় কোনো ঝামেলা সৃষ্টি না করে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ডিসপেনসারি থেকে ইনহেলার কিনে নিয়ে সে অশান্ত ইনজানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “মরার আগের নিঃশ্বাসটা নিয়ে নে।”

ব্লেজারটা ক্যান্টিনে ফেলে এসেছে, শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। একপাশের কাঁধ বেরিয়ে আছে, ব্যান্ডেজও সেখানে বাঁধানো। ইনহেলার প্রেস করে দু’বার পাফ নিয়ে ইনজান কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে, হালকা ভাবে হাত-পা ছেড়ে বসে থাকে। ওকে দেখতে এখন ঠিক আধুনিক যুগের যুবরাজের মতো লাগছে, যে ঘুম থেকে উঠেই শুনে রাজ্য হারিয়েছে। পরণের কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট (যেটা গায়ে ভালোভাবে জড়ানোরও সময় পায়নি) ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে নিতে পারেনি। ইজহান বিরক্ত হয়ে নিজের ভাবনা সরিয়ে দিল। বউয়ের মুখ না দেখা অবধি শান্তি পাচ্ছে না সে। তার আগে আরসালানের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সে এগিয়ে গিয়ে ইনজানের শার্ট ভালোভাবে গায়ে চড়িয়ে বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে হঠাৎ বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করে, “তোর মোটিভ কী? এখানে এসেছিলি কেন?”

ঝট করে চোখ খুলে তাকাল ইনজান। সে এখন একটু স্বাভাবিক। শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে না। ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “তোমাদের বাপ-চাচা বানাতে গিয়ে আমার বেগুণি ফুল মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে আর আমি ওকে দেখতে আসব না? এতোটা পাষাণ নই আমি৷”

গা জ্বলা কথাবার্তা। ইজহান রাশভারি স্বরে বলে, “এতো মহানুভাবও হতে হবে না তোকে। কোথায় উঠেছিস সেখানে ফিরে গিয়ে ঘুম দে। রাত অনেক হয়েছে। এখন ঝামেলা করবি না। চল, আমি ড্রপ করে দিচ্ছি তোকে।

ইনজান দ্বিরুক্তি করে না। বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে। পরক্ষণেই শক্ত মুখ করে বলে, “আই নিড সাম
ওয়াটার।”

গাড়িতে টেনে এনে বসিয়ে দিয়ে, দরজা লক করে ইজহান পাশের একটা স্টোরে মিনারেল ওয়াটারের বোতল আনতে যায়। ঠিক তিন মিনিটের মাথায় পানির বোতল নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এসে দেখে গাড়িতে নেই ইনজান। লক করে যাওয়া স্বত্তেও গোপন ট্রিক্স ব্যবহার করে আনলক করে বেরিয়ে গেছে। ইজহান বুঝতে পারে তার ছোটো ভাইটি তাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছে। একটা ঝামেলা না বাঁধিয়ে সে ছাড়বে না। বিষয়টা বোধগম্য হতেই শখের প্রাডোটার গায়ে পরপর কয়েকটা লাথি বসিয়ে দিয়ে ইজহান তার ক্ষোভ উগড়ে দেয়, “কু* বাচ্চা! আমার বউ ছয় ঘন্টা ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে! তোর জন্য আমি ওর কাছে যেতে পারছি না, তোর তো রক্ষে হবে না! যদি আমি তোকে ধরতে পারি, টেনে ছিঁড়ে তোর কলিজা, হাড়গোড় এক করে ফেলব, বুঝলি?”

এতটা রাগের তীব্রতায়, ইজহানের শরীর কাঁপছে। চোখে জ্বলন্ত আগুনের তেজ নিয়ে সে ক্রোধান্বিত
হয়ে ডায়াল করে ইহসানের নাম্বারে।

°

গত আড়াই ঘণ্টা ধরে এলিজাকে সঙ্গে নিয়ে বাচ্চাদের জন্য উপহার কিনে একে একে পুরো ক্যাব ভরে ফেলেছে ইহসান। কার্ডে যা ছিল, সব শেষ। অ্যাকাউন্ট এখন ঠান্ডা জমিন। এমনকি ক্যাবভাড়াও দিতে হয়েছে এলিজার থেকে চেয়ে নিয়ে। উপহারভর্তি ব্যাগগুলো নিয়ে এলিজাকে শ্যাওড়াপাড়ায় নামিয়ে দিয়ে, ওর কাছ থেকেই সামান্য ভাড়া চেয়ে রিকশা ধরেছে সে সোজা হসপিটালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যানজটে আটকে গেছে সে। একা সৃজাকে নার্সদের ভরসায় রেখে এসে সে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। মনটা কেমন করছে। দ্রুত পৌঁছানোর তাড়ায় সে যখন রিকশাওয়ালাকে তাগাদা দিতেই যাবে ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠল ওর। বিরক্ত সে স্ক্রিনে ইজহানের কল দেখে প্রথমে ধরতে চাইছিল না ওর আজেবাজে কথা শোনার জন্য। কিন্তু কী মনে হতেই না ধরেও পারল না। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল ইজহানের রুদ্ধশ্বাস, তীক্ষ্ণ গলা, “হা রা ম জাদাটা হসপিটালে এসেছে। আমার হাত থেকে পালিয়ে তোর বৌয়ের কাছে গেছে এখন, শিয়র।”

মন্তব্য জানাবেন।
__________

[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫৯

ইহসানকে খবরটা দিয়ে ইজহান তপ্ত মেজাজে আরসালানের গালে গুণে গুণে ছ’টা থাপ্পড় মারার উদ্দেশ্য নিয়ে আবারও হসপিটালে প্রবেশ করল। কিন্তু কেবিনে পৌঁছে দেখল কক্ষ খালি। সৃজা নেই। বারান্দাতেও না। বালিশের ওখানে পড়ে আছে ওর ফোনটা। ইজহান উত্তেজিত হয়ে বাইরের লবি-ট্যারেসেও খুঁজে আসে, কিন্তু কোত্থাও পায় না সৃজাকে, না আরসালানকে। সে হতবুদ্ধি হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। ভেবেছিল আরসালান কিছু ঝামেলা করবে, সৃজার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে বা সত্যিগুলো বলে দেবে, কিন্তু সৃজাকেই যে তুলে নিয়ে যাবে এটা সে ভাবেনি! কিন্তু হসপিটালে এত লোকের আনাগোনার মধ্যে এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
সে বিভ্রান্ত।

এদিকে ইজহানের ফোন পেয়ে ইহসান যে কীভাবে হসপিটালে পৌঁছাল, সেটা সে নিজেও জানে না। তার মাথায় শুধু একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খাচ্ছে, ইনজান সেখানে আছে মানে সৃজার ক্ষতি করে দেবে। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে যখন সে দেখল, আরসালান তো দূর সৃজাও কেবিনে নেই, ওদের বদলে সেখানে বসে আছে ইজহান; সে বিভ্রান্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সৃজা কোথায়?”

ইজহান ঠোঁট উল্টালো, “সব জায়গায় খুঁজে এসেছি, তোর বউ কোথাও নেই, না আছে আরসালান!”

“মানে?”

ইজহান বলল, “মানে আমি খুঁজে পাইনি ওদের। আই থিংক তোর ব… বউকে কিডন্যাপ করেছে!”

অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল ইজহান। শুনে ইহসানের মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথাই বলতে পারল না। টের পেল, তার বুকটা কাঁপছে। হার্টবিট দ্রুত হচ্ছে। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে ধারালো গলায় বলল, “এতো বড়ো হসপিটাল, সিকিউরিটি এতো কড়া তারমধ্য থেকে একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে এটা অসম্ভব! তাছাড়া পরিচিত হলেও কথা ছিল যে, সৃজা তার সাথে চলে যাবে! মেয়েটা তো ওকে চেনেই না৷ তাহলে স্বাভাবিকভাবে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। তুই ভালো করে সব জায়গায় দেখেছিস তো?”

ইজহান দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বোঝাল সে ভালোভাবে দেখে এসেছে, কিন্তু আসলেই কোথাও পায়নি। চোখদুটো বুজে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে ইহসান তাকাতেই দেখল সবকিছু তার কাছে অন্ধকার ঠেকছে। তার মাথা ঘুরছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কী করবে সে, কী করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছে না তার। ঠিক করল সিসিটিভি ফুটেজ গিয়ে চেক করবে। ইজহানও সায় দিলো ওর কথায়। কারণ সেও চিন্তিত। এতো বড়ো একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে তার ছোটো ভাই, বিষয়টা তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে ইহসান যখনই আধখোলা স্লাইডিং ডোরটার দিকে পা বাড়াবে ঠিক তখনি সেটা বাইরে থেকে খুলে ভেতরে ঢুকলো সৃজা। তার মুখে হাসি, বাইরে থেকে এক বৃদ্ধার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। তাকে বিদায় জানিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে সৃজা যখন পেছনে ঘুরল, তখন দু’ভাইকে এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর হাসি উবে গেল। দু’জনের মুখই কেমন ফ্যাকাশে। একজন দাঁড়ানো অবস্থায় এবং অন্যজন বেডে বসা। ভাবভঙ্গি দেখে সৃজার সন্দেহ হলো যে, দু’জন হয়তো আবারও সংঘাতে জড়িয়েছে। সৃজা ইহসানের দিকে তাকিয়ে উদ্বেগজনিত কণ্ঠে বলল, “আবারও মারপিট করেছ? ভাইয়া আপনিও?”

ইজহান তখনো হতবিহ্বল। ভেবে পাচ্ছে না সৃজা এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে কেন! এর মানে কী আরসালান এখানে আসেনি? মেয়েটাকে কিছু বলেনি? কিছু করেনি? তাহলে ডাফারটা ওকে ফাঁকি দিয়ে পালালো কেন? সে তো ওটাকে ওর ঠিকানায় পৌঁছে দিতেই যাচ্ছিল! কিছুই বুঝতে পারল না ইজহান। শুধু অস্ফুটস্বরে বলল, “মারপিট করিনি।”

“তাহলে আপনাদের এমন লাগছে যে?”

এই প্রশ্নের জবাব নেই ইজহানের কাছে। দিলোও না সে। বুঝল এখানে থেকে আর কাজ নেই। আরসালান সাইকোটা ওকে ঘোল খাইয়েছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট। একে পেলে তো সে দেখে নেবে। সে শক্ত হয়ে বসে রইল। ইহসানই প্রশ্নটা করল, “তুই কোথায় ছিলি?”

“বাচ্চাদের ওখানে। খাইয়ে দিয়ে আসছিলাম। আসার পথে নাবিলা ম্যাম ডাকলেন। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।”

ইহসান রাগ চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। ওর চাহনি দেখেই আচমকা ইজহান উঠে ধীরপায়ে দরজায় দিকে এগিয়ে গেল। উদ্দেশ্য মানে মানে কেটে পড়া।

“এই তুই দাঁড়া!”

পেছন থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ডেকে উঠল ইহসান।
ইজহান থেমে যায়, কিন্তু ফিরে না তাকিয়ে দাঁত ঘষে জিভ কাটে। হ্যাঁ, সে সব জায়গায় খোঁজ করেছে কিন্তু বাচ্চাদের ওখানে খোঁজ নেয়নি। ওখানে না খুঁজেই সে গাধামো করেছে! এখন ভেড়ার সামনে কী বলবে?
নিশ্চয় এখন ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেওয়ার মতলব করছে! কিন্তু সে তো এখন ঝামেলাঝাটিতে জড়াতে চায় না। অতি শ্রীঘ্রই ইস্মিতার কাছে ফিরতে চায়। নাহ! এখানে থাকলে আজ আর তার বাড়ি ফেরা হবে না। ইহসানের ডাক পরোয়া না করে একপ্রকার ছুটেই বেরিয়ে গেল সে। সৃজা শুধু নির্বোধের মতো ওদের কান্ড দেখে গেল।

খোঁজ না নিয়ে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে বলে আত্মা নাই করে দিয়ে এখন পগাড় পার হচ্ছে বেকুবটা! একটা থাপ্পড় দেওয়া দরকার ছিল ওটাকে। কিন্তু ইহসানের ক্লান্ত, অবসন্ন মস্তিষ্কটা বলল, ও ছিল বলেই ইনজান আজ এতদূর এসেও কিছু করতে পারেনি। তাই ওর প্রতি একটু হলেও কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ তোমার, ভুল খবর দিলেও গাধামো সে করেনি তোমার মতো! ইহসান গভীর শ্বাস ফেলে নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সৃজাকে বুকে টেনে নিয়েই শান্তি কুড়ালো। এতক্ষণ দুনিয়ার সব ভয়ংকর ভাবনায় শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। অস্থিরতা গোপন করে সে সৃজাকে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেউ এসেছিল?”

“কে আসবে?”

“মানে তোর সঙ্গে দেখা করতে? আমি যাওয়ার পর?”

“না তো। কেউ আসার কথা ছিল? আর আসলেও আমি বলতে পারব না, তোমরা যাওয়ার একটু পর থেকেই আমি ওখানে ছিলাম।”

“উহু, কেউ আসার কথা ছিল না।”

ইহসান চোখদুটো বুজে নিলো। তার খামখেয়ালিপনার কারণে ইদানীং যেসব বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে তাতে অন্তত কোনো বিপদ যে ঘটেনি, এটাই স্বস্তির। তার স্বস্তিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতেই সৃজা বলল, “শুনো, একটা কথা বলার ছিল! নাবিলা ম্যাম বললেন, বাচ্চারা এখন স্টেবল আছে। ওদের রেসপিরেটরি সাপোর্ট আর লাগছে না, আর ফিডও সহ্য করছে ঠিকঠাক। ক্লিনিক্যালি ইমপ্রুভ করছে! দু-তিন দিনের মধ্যে ডিসচার্জ সম্ভব হতে পারে। ম্যাম চেয়েছিলেন তুমি গিয়ে একবার দেখা করতে।”

খবরটা শুনে ইহসানের মনে হলো একটা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার পর ঝুম বৃষ্টি নামার মতোন প্রশান্তি নেমেছে তার বক্ষপটে। ছোট্ট করে ‘হু’ বলে আরো কিছুক্ষণ সৃজাকে বুকে জড়িয়ে রাখল। চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “ইদানীং মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রেগে যাচ্ছি, অল্পতেই কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ছি। আর তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে তোকে।”

“কিছু হয়েছে তোমার? খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

“না, শুধু একটু ডিস্টার্ব।”

“আমাকে বলা যায়?”

“উহু! কিছু কিছু বিষয় বলা যায় না।”

“বললে হালকা লাগতে পারে।”

“তোর মুখ দেখলেই আমি হালকা হয়ে যাই। অন্য কিছুর দরকার পড়ে না।”

“তবুও বলবেই না?”

ইহসান প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “তখন ওভাবে রিঅ্যাক্ট করে বেরিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। সরি।”

সৃজা হাসি চেপে রেখে চোখদুটো হালকা রোল করে বলল, “তুমি আমাকে সরি বলছ? ভাইয়াকে বলো না যে?”

“তোর কাছে সরি বলতে আমার লজ্জা লাগে না। তোর কাছে নির্লজ্জ হয়েও আমি সরি বলতে পারি। অন্যদের কাছে পারি না।”

সৃজার বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন একটা ভার নামল। অজান্তেই চোখের পলক থেমে গেল। কেমন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, মলিন আর অভিমানী গলা ইহসানের।অথচ লোকটার প্রতিটা কাজে, প্রতিটা কথায়, প্রতিটা অনুভবে কেন্দ্রেই সে। কিন্তু নিজের কষ্টগুলো সেভাবে কখনও প্রকাশ করে না ওর কাছে। সারাক্ষণ ওর প্রতিটা বিষয় নিয়ে মেতে থাকলেও অন্যসব যন্ত্রণাগুলো ভোগ করে একা একা। চাহিদাগুলোকেও করে উপেক্ষা। সৃজা ওর বুক থেকে মাথা তুলে কোমল, স্পষ্ট, দায়বদ্ধ দৃষ্টিতে ইহসানের চোখে চোখ রেখে তাকাল। এক হাত বাড়িয়ে ওর গালে রাখল। ইহসানের দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু সেই শান্ত চোখের গভীরে অন্যরকম বিষন্নতা। কী নিয়ে এই বিষন্নতা পুষছে মনে? জিজ্ঞেস করলে তো বলবেই না বরং ঝাড়ি দিয়ে ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দেবে। সৃজা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ম্লান গলায় বলল, “আমি ভাবতে পারিনি ব্যাপারগুলো তোমার খারাপ লাগবে, কষ্ট দেবে। ভাইয়া আগ্রহ দেখাল বলে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা তোমার জন্য ভুল হয়ে গেল। তাই তোমাকে না জানিয়ে ওই ব্যাপারটার পারমিশন…সরি!”

“ইটস ওকে। বলিস, নাম রাখলে রাখুক। কিন্তু দাবি যেন না করে। আমি ওদের ব্যর্থ বাবা হলেও বাবা তো! ওরা আমার সন্তান, ওরা আমার একটা একটা তুই! আমি ভীষণ লোভী তোর জন্য, ওদের জন্য। ভালোবাসায় হ্যাংলা হয়ে গেছি। তাই ওভাবে চেয়ে বসলে আমি নিতে পারি না। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়…”

স্লাইডিং ডোরটা খোলাই ছিল, বাইরে চোখ পড়তেই ইহসানের চোয়াল শক্ত হলো। আচমকা সৃজাকে আরো জোরে নিজের বুকে টেনে নেয়। চওড়া বুকের আশ্রয়ে মাথা লুকিয়ে, সৃজা টের পায় পুরুষটার অভ্যন্তরীণ তাড়না। যে তার হৃদয়জয়ী, চোখের জল নিঃশব্দে গিলে ফেলা পুরুষ। যার জীবনে পদার্পণ করে, সংগ্রামী থেকে সে হয়ে উঠেছে স্নেহাসিক্তা, ভালোবাসায় নিঃশব্দে গলে যাওয়া এক নারী।

°

ম্লান দুটো হলদেটে বাতির আলোয় ডুবে আছে আশপাশটা। সারিবদ্ধ করে রাখা টবের পাতাগুলোর নড়াচড়াও কম। একেবারে নিঃশব্দ পরিবেশ।করিডোরটার এই পাশটা একটু বেশিই নির্জন। সেখানেই ওয়েটিং চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আরসালান ইনজান। তার বাঁ হাতটা দেয়ালের সঙ্গে ঠেকানো, আর ডান হাতে সিগারেট। ধোঁয়া উড়ছে। কড়া ঘ্রাণটা নাসারন্ধ্রে জ্বালাপোড়া ধরিয়ে দেওয়ার মতো। অথচ আরসালানের তাতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না। সে চুপচাপ বসে আয়েশী ভঙ্গিতেই একটু পরপর সিগারেটে টান দিচ্ছে। তার চোখদুটো স্থির হয়ে আছে লম্বা করিডোরের একেবারে শেষ মাথার কেবিনটাতে। যেটার আধা খোলা স্লাইডিং ডোরটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, তার বড়ো ভাই তার ল্যাভেন্ডারের কপালে অসংখ্য চুমুর বন্যা বসিয়ে দিচ্ছে।

চোয়াল শক্ত করে অনেকটা ক্ষণ দৃশ্যটা দেখার পর আচমকাই আরসালান ঠোঁট চেপে ধরে হাসে। সেই সঙ্গে হাসে তার জ্বলজ্বলে চোখদুটোও। সিগারেটের ফিল্টারটা নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে সে নিজের মনেই ফিসফিস করে বলে, “তোমার দুর্বলতা আমার আনন্দের উৎস। তোমাকে আতঙ্কিত হয়ে গলে যেতে দেখলে অদ্ভুত শান্তি
পাই সেটা তুমি জানো ব্রাদার। ওকে এভাবে ছুঁচ্ছ তাতে আমার একটুও রাগ হচ্ছে না, কিন্তু তোমার সুখ দেখে হচ্ছে….ছাইচাপা আগুনের মতো রাগ!”

বিচিত্র হাসি ও তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টিতে কেবিনের ভেতরের ভালোবাসার দৃশ্যটা চোখের পাতায় বন্দি করে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। কোনোরকম শব্দ ছাড়াই হাঁটতে হাঁটতে করিডোর পেরিয়ে এস্কেলেটরে চড়ে গ্রাউন্ডে নেমে আসে সে।

হাসপাতালের গেটের পাশে পাথরচূর্ণ ধূসর বর্ণের চকচকে রুবিকন জীপটা দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে এক লাফে উঠে বসে ইনজান। তখনি নাকে ঠেকে ফুলের মৃদু সুবাস, কোন ফুলের সুবাস এটা জানে না সে। হাওয়ায় ভাসতে থাকা ঘ্রাণটা পছন্দ হয় না তার। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে সে ড্রাইভিং সিটে বসা নীতিনের দিকে তাকায়। এখনো টের পায়নি তার উপস্থিতি। চোখ মুদে সাউন্ড সিস্টেমে বাজানো গানের সঙ্গে নিজেও গলা মেলাচ্ছে,

নারী জাতির কঠিন রীতি
বোঝেনা পুরুষের মতি
সদাই থাকে নিজেরে লইয়া।
তুমি করছো নারী রূপের বড়াই গো
রাধারমণে যায় কইয়া।
মান করে রাই, রইয়াছো ঘুমাইয়া।

প্রচন্ড এক থাবা বসিয়ে সাউন্ড সিস্টেমটা অফ করে দিতেই হকচকিয়ে উঠে নীতিন। পাশে নিজের অতিপ্রিয় ছোটো স্যার গাড়িতে এসে বসেও গেছে, অথচ সে টেরই পায়নি? অবশ্য যা জবরদস্ত গান শুনছিলো সে, উন্মত্ত না হয়ে কেউ পারে না কি? দুটো শুকনো ঢোক গিলে ছোটো স্যারের দিকে তাকিয়ে সে হাসল। বোকাবোকা হাসি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে স্টেয়ারিংয়ের উপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “স্যার, কই যাব? অ্যাপার্টমেন্টে?”

নীতিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকা আরসালান ইনজান শেখ তখন হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার একটি জানালার দিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে তো তাকিয়েই। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখে জমে থাকা অন্ধকারটাকে বিদ্রুপ করে সে অসহ্য রকমের শীতল
কণ্ঠে বলে, “চলল…যেখানে আলোওওওও আছে, মিউজিকককক…. আর উদযাপননন করার জায়গা
আছে সেখানে…”

শব্দগুলো এমনভাবে লম্বা করে বলল, যেন প্রতিটা ধ্বনি স্নায়ুতে ছুরি চালাতে ব্যস্ত। নীতিন গলার ভেতর শুকনো থুতু গিলে বলে, “এইডা কোন জায়গা স্যার?”

“তোর শ্বশুরবাড়ি।”

একটু পরই বলে, “উহু, ক্লাবে।”

নীতিন চোখ বড়ো বড়ো করে চায়, “আপনের আব্বায় কিন্তু মানা করছে স্যার… শরীরডা এহনো ঠিক হয় নাই…”

কথাটা বলে শেষ করতে পারে না নীতিন। ইনজান এবার সরাসরি ওর দিকে তাকায়। একটা বিষাক্ত গর্জনের মতো ঠাণ্ডা হাসি ফুটিয়ে বলল, “লাত্থি মেরে বের করে দেব নীতু সোনা? যেভাবে আমার ভাই আমাকে ল্যাভেন্ডারের জীবন থেকে বের করে দিয়েছে? হু?”

কথার মানে বুঝতে না পারলেও, আশ্চর্য হলেও হুমকি শুনে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রুবিকনটা স্টার্ট দেয় নীতিন। নাইট ক্লাবের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা জীপটা ছেড়ে যায় রাস্তার দু’পাশের সারি সারি গাড়ি, পিচঢালা পথ আর আধুনিক হাসপাতালের ওই কেবিন, যেখানে একজোড়া কপোত-কপোতী একে-অপরকে চুমু খাচ্ছে!

.

________

[রি-চেইক বিহীন ছোটো পর্বের জন্য দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬০

কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালের অন্তহীন উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটিয়ে আজ এক সপ্তাহ হলো বাড়িতে আনা হয়েছে বাচ্চাদের। একটা সপ্তাহ চোখের পলকেই কেটে গেল তবুও, শেখ বাড়ির পরিবেশে এখনো নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি বাচ্চারা। এন.আই.সি.ইউ-র যান্ত্রিক শব্দ আর আলো ঝলমলে কেবিনের অভ্যস্ততা থেকে হঠাৎ করে অচেনা ঘর, অজানা পরিবেশ, কিছু নতুন মুখ সবই ওদের কাছে অচেনা, অস্বস্তিকর। দু-চারটা পরিচিত মুখ ছাড়া কেউ কাছে গেলেই ওদের চোখে ভেসে ওঠে রাজ্যের বিস্ময়, যা ধীরে ধীরে রূপ নেয় কান্না ও চিৎকারে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, নিঃস্তব্ধ পরিবেশ ওরা পছন্দ করে, কিন্তু নিজেদের কণ্ঠে নয়। সামান্য কিছুতেই একজন কেঁদে উঠলে, আরেকজনও ঠিক তখনই শুরু করে দেয়। একচল্লিশ দিনের ছোট্ট পাখি দুটোর এমন অস্থিরতায় ইহসানের পিতৃ মন আইসক্রিমের মতো গলে একেবারে জল হয়ে যায়। সে দিন-রাত এক করে চেষ্টা করছে ওদের যাতে কোনো কষ্ট না হয়। খাওয়ানো, গোসল, ডায়াপার চেঞ্জ, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তার যত্নের ছাপ। তবু তার চেষ্টা বৃথা। দুই ভাইবোন নিজেদের মতো করে কান্নার দৌড়ে ব্যস্ত। একজন চমকে জেগে উঠলেই আরেকজনও তড়িঘড়ি কান্না শুরু করে দেয়। সৃজা আর ইহসানের রাতগুলো নিদ্রাহীন আতঙ্কে ঢাকা। সৃজার চোখে ঘুম নেই, অবসাদে সে নিজেও একসময় বাচ্চাদের সঙ্গে কেঁদে ফেলে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার পর থেকেই তার শরীর ভেঙে পড়েছে। আজ তো বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পরেই যাচ্ছিল। ইহসান ছিল বলে রক্ষা। কিছু হয়নি বলে বাচ্চাদের নিয়ে অস্থির হতে গেলে দুটো ধমক দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিয়েছে ইহসান। চেক করে দেখেছে, প্রেশার ফল করেছে মেয়েটার। ওজন একষট্টি থেকে নেমে এসেছে সাতচল্লিশে। চোখের নিচে গাঢ় কালি, রুক্ষ হয়ে যাওয়া চুল, আর ক্লান্তির ছাপ চোখে পড়ার মতো। শতবার বলেও এই মেয়েকে নিজের প্রতি সচেতন করাতে পারেনি ইহসান। আজ তাই বকাঝকা, রাগারাগি না করে চুপচাপ ফলের বাটি হাতে তুলে দিয়ে সন্ধ্যা থেকে একা হাতে বাচ্চাদের সামলাচ্ছে সে। সৃজাকে জোর গলায় মানা করে দিয়েছে সে যাতে নিজেত প্রতি মন দেয়, বাচ্চাদের খেয়াল সে বাপ হয়ে নিজেই রাখতে পারবে। সৃজা যদিও আপত্তি করছিল, সে শোনেনি। সময় নিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে, মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে আর আড়চোখে খুঁটে খুঁটে ফল খেতে থাকা সৃজাকে দেখছে। মেয়েটা তার সন্তানদের মা, অথচ ওদের নিয়ে চিন্তা করতে করতে কী হাল হয়েছে শরীরের! ইহসানের মোটেও মোটেও ভালো লাগছে না ওকে এভাবে দেখতে। ভেতরটা ভার হয়ে আছে তার নীরব দায়বোধে।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৃজার অবস্থা দেখে।

অতঃপর দীর্ঘক্ষণ কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, স্নেহভরা ফিসফিস কণ্ঠে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে গেয়ে মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে সবে শুইয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের নিঃস্তব্ধতা চুরমার করে দরজায় নক হলো। কড়া নাড়ার জোর শব্দে হকচকিয়ে উঠল সৃজা, ইহসান। বাচ্চাদের একপলক দেখে নিয়ে ইহসান সৃজার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই সৃজা হেসে ফেলল, “যাও, খুলে দাও। বড়োআব্বা এসে গেছে ওদের!”

ইহসান বিপরীতে কিছু বলতে যাবে কিন্তু দরজার বাইরে থাকা গমগমে স্বরে পুরুষালি কণ্ঠটা বলল, “এই!! এই!! দরজা খোল! এতক্ষণ লাগে কেন খুলতে? নিশ্চয় টনা-মনাকে ঘুম পাড়ানোর মতলব করছিস এখন, আমার কাছে দিবি না বলে? ধান্ধাবাজি বন্ধ করে ভালোয় ভালোয় খোল বলছি!”

দুটো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় আজ সারাদিন ব্যস্ততার সহিত অফিস করেছে ইজহান। যারজন্য বাচ্চাদের কোনো খোঁজ নিতে পারেনি সে। সেজন্যই মনটা বড্ড উচাটন হয়ে আছে তার। হাইজিনের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে না সে। বাড়িতে ফিরেই আগে গোসলটা সেরেছে সে, যাতে বাচ্চাদের কাছে গেলে ওদের কোনোরুপ সমস্যা না হয়। এখন থেকে ঠিক দুই ঘন্টা সে বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বসে থাকবে, হাঁটবে। নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে তার।
মানা করলেই শুরু করবে উল্টাপাল্টা কথার ঝড়। কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই ঝামেলা এড়াতে চায় ইহসান। আজকাল ওর সঙ্গে দ্বন্দ্বেও কম জড়ায়। উচাটন হয়ে দরজায় থাবা বসাতে থাকা পাগলকে শান্ত করতে সে দরজা খুলে দেয়। খুলতেই গলায় বাড়াবাড়ি উল্লাস, হাতে চকোলেট আর ঝাঁকুনি দেওয়া টয়স নিয়ে ঝড়ের গতিতে সোজা ঢুকে পড়ে ঘরে ইজহান। ততক্ষণে অবশ্য বড়ো আব্বার গমগমে কণ্ঠস্বর শুনে ঘুম থেকে উঠে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে দু-ভাইবোন। ছোটো বাচ্চাদের কীভাবে কোলে নিতে হয়, কীভাবে কোলে নিলে ওরা আরাম পায়, কীসব বললে খুশি হয়, হাসে, কোলে আসে প্যারেন্টিংয়ের বেসিক কিছু বিষয়ের উপর মিজুকে নিয়ে ট্রেনিং নিয়েছে ইজহান। প্রথম দু’দিন টনা-মনাকে কোলে নিতে না পেরে ইহসানের উপর রাগান্বিত হয়েই সে খুব ভালোভাবে এগুলো রপ্ত করে এসেছে। এখন দারুণভাবে দু’জনকে একত্রেও কোলে নিতে পারে সে। ইজহান সবগুলো গিফটস একপাশে রেখে তার টনার কপালে চুমু খেয়ে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো। ঊষ্ণ কোলে জায়গা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কান্না থামিয়ে জুলজুল চোখে ইজহানের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। মুগ্ধ হয়ে গেল সে। চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে কয়েকবার ‘মাশাল্লাহ’ আওড়ে নিলো সে। ইচ্ছে করল এই আদুরে বাচ্চাটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে, একগ্লাস পানি দিয়ে টুপ করে খেয়ে নিতে। দু’হাতে ভালো করে বাচ্চাটাকে আগলে নিয়ে আদর করল সে সময় নিয়ে। এরপর ‘মনাকে’ রেখে সে তার ছেলেবাচ্চা অর্থাৎ ‘টনাকে’ কোলে নিয়ে বলল, “নিয়ে যাচ্ছি! আজ ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।”

মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোয় ব্যস্ত ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে ওর দিকে তাকাল। সৃজাও বোকার মতোন তাকাল ইজহানের দিকে। এত ছোটো বাচ্চাকে নিয়ে যাবে মানে? ওকে ছেড়ে সে রাতে থাকবে কেমন করে? একটুও ঘুম নামবে না ওর চোখে। এসব বাদ দিলেও পটি পরিষ্কার, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারগুলোও আছে! দু’জনে ফিডারে অভ্যস্ত তাও রাতে দু’বার সে নিজে ফিড
দেয়। রাতে তো একটুও ঘুমায় না, নিজেরাও জেগে থেকে৷ বাপ-মাকেও জাগিয়ে রাখে। ইস্মিতার এখন যা অবস্থা, তাতে করে মোটেও উচিৎ হবে না একটা দুধের শিশুকে সারারাত সামলানো। এসব ভেবেই সৃজা আপত্তি করে উঠল, “কিন্তু ভাইয়া, ও খুব জ্বালাবে। ভাবীর খুব সমস্যা হবে।”

ইজহানের পছন্দ হলো না কথাটা। তার চাওয়ার বিপরীতে আওয়াজ তোলায় সে সৃজাকে ধমক দিলো, “এই মেয়ে, বেশি কথা বলো কেন? সমস্যা হলে আমাদের হবে। তোমার তো কোনো সমস্যা হবে না। একদম চুপচাপ বসে থাকো। নিজে তো নিজেকেই সামলাতে পারছে না আবার আমাকে বলে আমি না কি ওদের সামলাতে পারব না। হুহ! শুকিয়ে তো মরা মুরগী হয়েছ, এসেছে আমাকে বলতে…”

বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছেলেকে বুকে আগলে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল। এদিকে সৃজা হতভম্ব। মানে সে শুকিয়ে মরা মুরগীর মতো হয়ে গেছে? ভাইয়া এটা বলতে পারল? ও ইহসানের দিকে অপ্রস্তুত চোখে তাকাল। এই লোক তো এমনিতেই বোম হয়ে আছে, এখন ভাইয়ের কথায় না আবার তাল মিলিয়ে তাকে কথা শোনায়! এদিকে ইহসান বহুকষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছে। যদিও হাসার কথা না, তার উল্টো উচিৎ ইজহানের উপর মেজাজ খারাপ করা, কিন্তু তাও কেন যেন তার হাসি পাচ্ছে! কোনোমতে জিজ্ঞেস করল, “ছেলেকে চাই তোর?”

“ভাবীর সমস্যা হবে, বুঝছ না কেন?”

“আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। খুব জ্বালালে আমি না হয় গিয়ে নিয়ে আসব। শখ করে নিয়ে গেছে যখন, একরাত রেখে বুঝুক বাচ্চা সামলানো কত সহজ কাজ!”

ইজহানের কাছে রাখতে যে এই লোক রাজি হবে এটা ভেবেই সৃজার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল সে ইহসানের দিকে। শুকনো মুখ করে থাকা মেয়েটার চমকিত রুপ দেখে সে মৃদু হেসে কাছে এসে ওর নাকের ডগায় কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তোকে দেখতে বোকা বোকা লাগছে!”

°

রাত দুইটা বাজে। চারপাশ নিস্তব্ধ, আকাশে পূর্ণিমার আলো। ঘরের লাইট অফ, হলদে আলোর একটা বেডসাইড ল্যাম্প জ্বলছে। ইজহানের চোখ লাল, চুল এলোমেলো, গায়ে স্লিভলেস টি-শার্ট ঘেমে একাকার। আর কোলে তার ‘টনা’—যার এখন চোখ-মুখ রক্তবর্ণ, গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। ইজহান তাকিয়ে আছে ছেলেটার মুখের দিকে হতবাক হয়ে। কান্না থামাতে কতকিছু করেছে সে? টয় দেখিয়েছে, পিঠ ঘষে দিয়েছে, গলা ফাটিয়ে ঘুমপাড়ানি গান গেয়েছে—কিন্তু কিছুতেই থামে না এই ত্যাদড় ছেলে! ফিডারটাও মুখে দিলেই ফেলে দিচ্ছে। ডায়াপার চেক করেছে ইহসান, এটাও পরিষ্কার। গরম লাগছে ভেবে সেটা খুলেই কাঁথা দিয়ে মুড়ে কোলে তুলে হেঁটছে এরপরেও আর কী চাই ছেলের? এই মুহূর্তে নিজেকে তার অসহায় মনে হচ্ছে। আদুরে মুখটার দিকে তাকিয়ে ধমকও দিতে পারছে না সে। নয়তো কখন যে আছাড় মেরে বসতো হু নৌজ! ইস্মিতা চুপচাপ নিজের স্বামীকে নাকানিচুবানি দেখছে আর মনে মনে দোয়া করছে যাতে এই লোকের মাথা না বিগড়ায়!

ইজহানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বহুকষ্টে সে নিজেকে সামলাচ্ছে। এক পর্যায়ে চিৎকার বন্ধ করার জন্য ডায়াপার পরিয়ে মুখে ফিডার তুলে দিলো সে। কিন্তু কিছুতেই খেল না বাচ্চাটা। ইজহান হতাশ হয়ে মিনমিন করে বলল, “এই… কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? বড়ো আব্বা কত আদর করলাম বলো তো! তোমার বাপে জীবনে ওমন আদর করেছে? জানে এইসব? বাচ্চাদের কীভাবে কোলে নিতে হয় জানে? প্যাকেট করে কোলে রাখলেই যে হয় না তা জানে? উহু, কিছুই জানে না। আমি কত সুন্দর করে কোলে নেই বলো তো! ও তুমি তো আবার কথা বলতে পারো না, বলবে কেমন করে! তুমি তো একচল্লিশ দিনের বাচ্চা! ওকে ওকে, নো প্রবলেম। আমি কথা বলতে পারি, বড়ো আব্বা পারে…তোমার কিছু বলতে হবে সোনা, তুমি শুধু কান্নাকাটি বন্ধ করো….”

কিন্তু ইজহানের আদুরে কথায় তার আদরের ‘টনা’ মোটেও থামল না। সে আগের মতো কেঁদেই গেল। ইজহানকে দেখে মনে হলো এক্ষুনি তার চোখে ফেটে রক্ত বেরুবে। খুব বড়ো মুখ নিয়ে সে ইস্মিতাকে বলেছিল, সে ‘টনাকে’ সামলাতে পারবে। এইটুকু বাচ্চাকে সামলানো তার বা হাতের খেল। ‘মনাকে’ যেমন কান্নাকাটি করা অবস্থায় কোলে নিলেই থেমে যায়, ইজহান ভেবেছিল এই ‘টনাটাও’ এমন। কিন্তু এই মাঝরাতে, তার মনে হচ্ছে এই ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। এটা একদম ভেড়ার কপি। ভেড়া যেমন তাকে জ্বালায়, এর ছেলেটাও ওকে জ্বালানোর পণ করেছে। তাইতো থামছে না। নয়তো সকলের সামনে তার উঁচু গলা নিচু করবে কীভাবে? তাকে হেরো প্রমাণ করবে কীভাবে? ইস্মিতার কাছে যেন মুখ ছোটো না হতে হয় সেজন্য ওর দিকে তাকিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি এত আদর করলাম এরপরেও কাঁদতে হয়? একদম বাপের মতো হয়েছে ছেলেটা!”

ইস্মিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাই তোলার ভান কর‍তে করতে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে ও আপনার মতোই হয়েছে। আপনি যেভাবে আমাকে জ্বালান, ও ঠিক তেমন করেই আপনাকে জ্বালাচ্ছে। মানুষকে জ্বালালে তার কেমন লাগে একটু বুঝুন!”

ইজহান থমকে গেল, “আমি তোমাকে জ্বালাই?”

“আপনি জ্বালাবেন কেন? আপনি তো আমাকে কতো আদর করেন! আমাকে তো জ্বালায় এই পুঁচকুটার বড়ো আব্বা! জ্বালিয়ে হাড়-মাংস এক করে দেয়!”

“ওর বড়ো আব্বা তো আমিই।”

“তাহলে হয়তো আপনার কথাই বলছি আমি!”

ইজহান মুখ ভার করে বলল, “এতো না প্যাঁচিয়ে সোজাসাপ্টা বললেই হয় আমাকে আর তোমার ভালো লাগে না। কাহিনী করার তো দরকার নেই।”

“আসলেই তো, কাহিনী করার দরকার কী? আপনি নিজেই তো একটা কাহিনী।”

“আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে!”

“আমার খুব মজা লাগছে।”

ইজহান বিস্মিত হলো, “মজা লাগছে? আমাকে দেখে তোমার মজা লাগছে? সিরিয়াসলি? আমি এখন তোমার কাছে মজার খোরাক হয়ে গেলাম?”

“আপনাকে দেখে না, আপনাকে নাকানিচুবানি খেতে দেখে মজা লাগছে!”

“সে তো লাগবেই। আমার দিকে কী আর কারোর নজর আছে? আমি তো এখন একটা জোকার। যাকে মানুষ যেভাবে নাচায়, ওমনি নাচে। ভেড়ার এই ছেল্টাও নাচাচ্ছে, তুমিও নাচাচ্ছ! আমাকে দেখে মজা লাগবে না তো প্রেম প্রেম পাবে? আদর করতে ইচ্ছে করবে?”

ইস্মিতা কিছু বলল না। শুধু ওর ভার মুখের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ হাসলো। ইজহান তীক্ষ্ণ চোখে বউয়ের উপহাসের হাসি দেখেই গেল। তার দাম এখন দু-টাকা। দু’টাকার আবার মূল্য আছে নাকি? তাকে দেখে তার বউ হাসবে না তো কাছে ঘেঁষবে? সে এতো বাড়াবাড়ি ভাবনা ভাবে কেন? এতো আশা রাখে কেন? আচ্ছা সে কী দেখতে বিশ্রি হয়ে গেছে? বয়সের ছাপ পড়েছে চোখেমুখে? সে কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে? এজন্যই কি ইস্মিতা মুগ্ধ চোখে তাকায় না? কালই কি নিজের একটু কেয়ার নিয়ে আসবে? মিজুকে বলে একটা অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখবে কি এখনই?

ইজহান যখন নিজেকে নিয়ে ভাবনায় মত্ত ঠিক তখনি সে তার প্যান্টে গরম, অস্বস্তিকর কিছু অনুভব করল। ঘোরের থেকেই অস্বস্তি কাটাতে সে হাত দিলো তার প্যান্টে। কেমন একটা অদ্ভুত চটচটে কিছু একটা লাগল তার হাতে। টনক নড়তেই ভ্রু কুঁচকে কাঁথার নিচ থেকে হাতটা বের করে আনতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল!

“ওহ মাই গড! এসব কী! এ-তো হেগেমুতে শেষ…”

বলে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ইজহান। একহাতে তাকে যন্ত্রণা দেওয়া ‘টনা’ আরেক হাতে ‘টানার’ পটি।
পটির গন্ধে ইজহানের মনে হচ্ছে তার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে, বমি পাচ্ছে! সম্ভব হলে সে এখনি কোথাও পালিয়ে যেতো। কিন্তু না, সে কাপুরুষ না। সে পালাবে না। বউয়ের কাছে ভাবমূর্তি রক্ষায় সে চোয়াল শক্ত করে, টিস্যু আর ওয়াইপস নিয়ে শুরু করল ভেড়ার ছেলের পটি পরিষ্কার করার প্রক্রিয়া। তখন ডায়াপারের দু’পাশের স্টিকি অংশদুটো ভালোভাবে
না আটকানোয় এই অবস্থা! বিছানা নষ্ট, নিজের প্যান্ট নষ্ট, মনের অবস্থা নষ্ট। কান্নাকাটি বন্ধ করে ততক্ষণে ভদ্র হয়ে যাওয়া টনাকে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে যাবে ইস্মি হতভম্ব হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “পাগল হয়েছেন আপনি? ও ছোটো বাচ্চা, ওকে বাথরুমে নিয়ে পরিষ্কার করানো আপনার কাজ না। আপনি বোলে করে এখানেই পানি নিয়ে আসুন আর এখানেই পরিষ্কার করান। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি…তার আগে গিজারটা অন করুন।”

মহা ফ্যাসাদে পড়া ইজহান কী আর করবে! হিরো হতে গিয়ে বলদ হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে সে ইস্মিতার কথামতোই কাজ করল। একহাতে ভেজা তুলতুলে নরম কাপড় দিয়ে টনার কোমল শরীর পরিষ্কার করতে করতে ইজহান রুদ্ধ গলায় বলল, “বড়োআব্বা হতে চেয়েছিলাম রে বাপ। কিন্তু তোমার মতো বাচ্চা সামলানো তো রীতিমতো যুদ্ধ… যুদ্ধ!”

ইস্মি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, “যুদ্ধে জিতলেই না ভালোবাসার ভাগ পাবেন। ফ্রি ফ্রি তো কেউ দেবে না।”

“আমি তো তোমাকে ফ্রি-তেই ভালোবাসা দিই।”

“জোর করে গলায় ঝুলানোর শাস্তি।”

ইজহানের মেজাজ খারাপ হলো। ইদানীং এই মহিলা কথায় কথায় তার বুকে ছুঁড়ি বসায়, খোঁচা মারে। সে ভালো স্বামী বলেই এসব সহ্য করে টিকে আছে। অন্যকেউ হলে কবেই বউ পেটানো শুরু করতো।
কিন্তু আদরের বউ তার, এসব তো দূর ফুলের টোকা দিতেও তার আত্তা কাঁপে। ইজহান কথা বাড়াল না। গম্ভীর মুখ করে কাজ করতে লাগল। পটি পরিষ্কার করে সে নিজেও পরিষ্কার হলো। নষ্ট হয়ে যাওয়া জামাকাপড়, ডায়াপার সব ঘরের বাইরে ফেলে এলো। এরপর নতুন করে ফিডার বানিয়ে, খাইয়ে, কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ভেড়ার ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই
সে ক্ষান্ত হলো। খুব সাবধানে, একটুও শব্দ না করে টনাকে শুইয়ে দিয়ে ইজহান বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। ইস্মিতা খুব হাসলো তার
স্বামীর অবস্থা দেখে! নাকের ডগায় চুমু খেয়ে চুলগুলো টেনে দিলো নরম হাতে। ঘুমের ঘোরে ইজহান ওকে অস্ফুটস্বরে বলল, “এই টনাকে ছেলে বানাব না, অন্যকিছু বানাব। আমাকে মেয়ে দিও, ছেলে না।”

ভোরবেলা মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বসার ঘরে আসতেই আজিজ শেখ একটা অদ্ভুত গন্ধের খোঁজ পেলেন। গন্ধটা শুঁকে শুঁকে সোফার কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখলেন সোফার উপর পড়ে আছে একটা গন্ধমাখা প্যান্ট, পাশে ব্লু ডায়াপার, পাশেই স্টিকি নোটে বড় বড় করে লেখা,
“এগুলো যে আগে দেখবে সে যেন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে।”

— ইজহান

_______

চলবে…