অশ্রুবন্দী পর্ব-৬৩+৬৪+৬৫

0
1

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬৩

আট বছরেরও বেশি সময় পর ছেলে বাড়িতে ফিরেছে, বিষয়টা আজিজ শেখের জন্য মহানন্দের। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না। কারণ বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ সংযোগহীন আঁধারে তলিয়ে যাওয়া সারাবাড়ি খুঁজেও তিনি তার ছেলের হদিস পেলেন না। হতাশ হয়ে তিনি যখন ছাদে গেলেন ছেলের খোঁজ করতে তখন চারপাশ ঘুরে ছেলের অবয়বটুকু দেখতে পেলেন বাড়ির দখিনে শুভ্র সাদা ফুলের মোহনীয়তা ছড়ানো কামিনী ঝাড়ের নিচে। কালো স্যুটে গ্রিক দেবতার মতো দেখতে ছেলেটা উবু হয়ে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে, পাশে তার ল্যাব্রাডর জাতের কুকুরটিকে নিয়ে। আজিজ শেখ ছেলেকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। শংকর ছাতা হাতে নিয়ে আধভেজা হয়ে ছুটে গেলেন কামিনী ঝাড়ের নিচে। ঢোক গিলে ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, “আব্বাজান, বৃষ্টি পড়তাছে। তুমি এইখানে বইসা আছ কেন?”

জন্মদাতা পিতার আরসালান ইনজান শেখের! সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কের! এই ডাকে সাড়া না দিয়ে না কি থাকা যায় না? বিষয়টা মনে পড়তেই আরসালান মুচকি হাসলো। বসারত অবস্থায়ই একবার নিজের কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে পেছনে ফিরে তাকাল, বাপের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঁকা হেসে বলল, “ছেলে এতো বছর পর বাড়িতে ফিরেছে, মায়ের সঙ্গে দেখা করবে না? আত্মার টানে ছুটে এসেছি।”

আজিজ শেখ ছাতা ফেলেই এবার ছেলের কাছে ছুটে এলেন, হাত ধরে টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন, “এইটা তোমার মায়ের কবর, কবরের উপর এইভাবে বসতে হয় না আব্বাজান। পাপ হয় ভীষণ!”

চোখ বড়ো বড়ো করে অট্টহাসি চেপে বলল ইনজান, “এই এই এই, তোমার মুখে এসব কথা শুনলে আমার কিন্তু ভীষণ হাসি পাবে, এই মুহূর্তে তোমার হারানো প্রেমিকার কবরে দাঁড়িয়ে আমি হাসতে চাচ্ছি না…”

গম্ভীরমুখে কথাটা বলে আরসালান তার বাবার হাতটা ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো। আজিজ শেখ বিগড়াতে চাইলেন না ছেলেকে। তাই প্রসঙ্গ বদলে বললেন, “ভেতরে চলো আব্বাজান, তোমার কুত্তাটাও তো ভিজতাছে…”

স্যুটটা পুরোপুরি ভিজে গেছে, শু’তে—ও পানি ঢুকেছে। পুরো শরীর কর্দমাক্ত! ভীষণ বিরক্ত আরসালান ইনজান শেখ কঠিন গলায় সতর্ক করল আজিজ শেখকে, “উহু উহু উহু…. কুত্তা না। ও আমার বাপ, কেমি…”

আজিজ শেখ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। এই কুত্তাটাকে তার ছেলে বাপের জায়গা দিয়েছে, বাপ ডাকছে, এই দিনও তার দেখতে হলো? একটা কুকুর কখনো মানুষের জায়গা দখল করতে পারে? তার জায়গাটা এই বিদেশী কুকুরটা কেড়ে নিলো? একটা লাথি মেরে কেমিকে দূরে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হলো তার। তবে ছেলের মাথা ঠান্ডা রাখতেই নিজের ইচ্ছেকে সংযত করে নিয়েই তিনি বললেন,
“হ, তোমার বাপ। আমি জানি। কিন্তু ওরে নিয়া বেশিক্ষণ ভিজাটা ঠিক হইব না। সেনসেটিভ তো, অসুস্থ হইয়া যাইব। তাই বলতাছি ভেতরে চলো।”

গুরুগম্ভীর হয়ে এমিলি ইয়াসমিনের কবরের কালচে মাটির উপর ঝরে পড়া শুভ্র সাদা কামিনী ফুলে দৃষ্টি রেখে আরসালান মেনে নিলো বাবার কথা। কেমির গলার বেল্টটা ধরে টেনে ওকে নিয়ে একাই ফটকের দিকে রওয়ানা হলো। আজিজ শেখ পেছন থেকে সূক্ষ্ম চোখে তার সুর্দশন ছোটপুত্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন। এই ঝুম অন্ধকারে, ভেজা পথ ধরে ছেলেটা কীভাবে ঠিক পথ চিনে নিচ্ছে? দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা কোনোদিন কোথাও যায়ইনি, এ বাড়িতেই ছিল, প্রতিদিন আনাগোনা তার এ বাড়িতে! আজিজ শেখের বুকের ভেতরটা বিষাদগ্রস্ত আনন্দে কেমন উতলা হয়ে উঠল।

ইলেকট্রিসিটি নেই, আইপিএসটাও কাজ করছে না বলে সবকিছু অন্ধকার। ফটক পেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে সদর দরজায় পা রাখতেই ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার অনুভূতিশূন্য আরসালান ইনজান শেখ বুঝতে পারল না সে কেন এ বাড়িতে ফিরেছে, ঘুম থেকে উঠেই আজ তার কেন মনে হলো বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার! ঠোঁট বাঁকিয়ে ভাবল সে, ল্যাভেন্ডারকে কী একবার ডাকবে? ডাকলে আসবে? সে জানে আসবে না। কারণ, মেয়েটা তো জানেই না ল্যাভেন্ডার রঙের জামা পরণে তার এক গোপন প্রেমিক আছে, প্রেমিকটা তারই বিলাভড্ হাজব্যান্ডের ছোটো ভাই! চুপচুপে ভেজা চুলগুলোতে আরসালান একবার হাত চালিয়ে সেগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে ক্রুর হাসলো। ডাকলো সে তার ল্যাভেন্ডারকে অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠল তার তথাকথিত বাপ— কেমিও! ঘেউঘেউ স্বরে, শেখ বাড়ি কাঁপিয়ে! সেই ডাকে যখন মোমবাতি হাতে লাল রঙা জামা পরিহিত, মোমের মতোই ফর্সা, খোলা চুলের একটা মেয়ে ছুটে এসে সিঁড়িতে এসে যখন দাঁড়াল; ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই হলো আরসালান ইনজান শেখের! তার মতোই এ অচেনা মেয়েটার গালে-কপালে কেটে যাওয়া দাগ, একদম তার মতো! আগুনের অস্পষ্ট আলোয় দাগগুলো জ্বলজ্বল করছে, যেমন চাঁদের কলঙ্ক চাঁদকে পুরো পৃথিবীর কাছে বিমোহিত করেছে, ঠিক তেমনই!

°

বাড়িতে আরো একজন রাজকন্যা এসেছে। আরো একজন ‘মা’ এসেছে তাদের জীবনে, হাজারো শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ইহসান। কিন্তু নিজের উদ্বেলিত মনোভাবটা সে প্রকাশ করতে পারছে না কিছুতেই। ঝড়-বৃষ্টির কারণে গাছাপালা উপড়ে গিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ, সারা শহরের বিদ্যুৎহীন। তার মধ্যে বাড়িতে কোনোপ্রকার খবর দিতে পারছে না ইহসান নেটওয়ার্ক ইস্যুর কারণে। এতসব নিয়ে ইহসান এমনিতেই মহাবিরক্ত। তার মধ্যে ইজহান ক্ষণে ক্ষণে বোকার মতো কাজ করে, অর্থহীন কথা বলে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে আর সবকিছু তাকে সামলাতে হচ্ছে! তখন মেয়ে কোলে নিয়ে সেন্স হারানোর পর জ্ঞান ফেরাতে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছে ডাক্তারকে। সদ্য একটা ফুটফুটে রাজকন্যার বাবা হয়ে, মেয়ের মুখ দেখেই নার্ভের দুর্বলতা নিয়ে সেন্সলেস হয়ে যাওয়া, তা-ও ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী শক্ত-সামর্থ্য দেখতে একজন পুরুষ মানুষের? বাকরুদ্ধ ডাক্তার সত্যিই সেডেটিভের প্রভাবে রেখেছিল ওকে। কয়েক ঘন্টা ঔষধের প্রভাবে মরার মতো ঘুমানোর পর যখন চেতনা ফিরল, অবজারভেশনে রাখা ইস্মিতা যখন নার্স দিয়ে ডেকে পাঠাল সে তার স্বামীকে দেখতে চায় এই বলে, ইজহান তখন ভয়ংকর অপরাধবোধে মরে যাচ্ছে! ইস্মিতা তাকে সত্যিই একটা মা উপহার দিয়েছে। তার মা—টা এতো ছোট্ট, তার হাতের সমান। তোয়ালের ভেতরে ছোট্ট শরীরটা লুকিয়ে ড্যাবড্যাব করে দেখছিল তাকে, ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা নেড়ে কাঁদছিল খুব; অথচ সে তার মায়ের কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা তো করলই না উল্টো নিজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল; এটা কোনো বাবা পারে? তাদের সাথে হয়? এটা স্ট্রং বাবা হওয়ার কোনো লক্ষ্মণ? মোটেই না। তার তো লজ্জা হওয়া উচিৎ, লজ্জায় পুকুরে ডুবে মরা উচিৎ। ইস্মিতাকে সে মুখ দেখাবে কেমন করে? এতসব অবান্তর প্রশ্ন করে করে ইহসানের কানের মাথা খাচ্ছে ইজহান। ভাইয়ের এই রুপ দেখে এক পৃথিবী বিস্ময় কাটছে না ইহসানের। তার ধারণা, সে বেশিদিন বাঁচবে না, মরে যাবে। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে ইজহান। কীভাবে সে টলারেট করছে তার এই মহা পাগল ভাইটির এতসব যন্ত্রণা? তার দুটো বাচ্চার একটা বাচ্চাও তো এভাবে জ্বালায় না। সে চুপচাপ বসে ভাইয়ের উল্টাপাল্টা প্রশ্নগুলো শুনেই গেল, উত্তর দিলো না। আকস্মিক স্লাইডিং ডোর দিয়ে সাদা পোশাকের একজন নার্স কেবিনে প্রবেশ করতেই ইজহান নিজের বকবক থামিয়ে চুপ হয়ে প্রশ্নোক্ত দৃষ্টি মেলতেই নার্স একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধমক দিলো তাকে, “আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে আমাকে দু-দু’বার পাঠিয়েছে অথচ আপনি এখনো বসে আছেন? অসুস্থ একটা মানুষের প্রতি আপনার একটুও দায়বদ্ধতা নেই, আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!”
বলে দরজার দিকে যেতে যেতে তাচ্ছিল্যসরুপ বলল, “এসব কেয়ারলেস মানুষকে আল্লাহ এতো মিষ্টি বউ-বাচ্চা কেন যে দেয়, আফসোস এরা কদর করতে জানে না! এরা বাবা হবার যোগ্যই না!”

কথাগুলো কানে এলো ইহসানের। তার পছন্দ হলো না বিষয়টা। মানুষ সামনে থেকে ক্ষুদ্র কিছু ঘটনা দেখে কত সহজেই একজন অপরিচিতকে বিচার করে ফেলে অথচ ঘটনার পেছনেও যে কারণ থাকতে পারে তা একবারও যাচাই করে দেখে না৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুরুগম্ভীর স্বরে নার্সকে ডেকে উঠল সে।হকচকিয়ে উঠে নার্স পেছনে ফিরে বলল, “আমাকে বলছেন?”

ইহসান কঠিন গলায় বলল, “আপনাকেই বলছি!”

“জি বলুন।”

“আপনার কাজ কী এইখানে? পেশেন্টদের দেখভাল করা, সেবাযত্ন করা। তাদের পার্সোনাল বিষয়ে নাক গলানো না। অথচ আপনার মধ্যে প্রফেশনালিজমের থেকে পার্সোনালিজমই বেশি দেখা যাচ্ছে। যেটা ভালো লক্ষ্মণ না৷” এতটুকু বলে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ইহসান আবারও বলল, “আল্লাহ কাকে, কেন বউ-বাচ্চা দেবে, পরিবার গঠনের সুযোগ দেবে সেটা তিনি আপনার-আমার চেয়ে ভালো বুঝেন। তাই তাঁর সৃষ্টির প্রতি কখনো, কোনো প্রশ্ন তুলবেন না। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড আমি কী বোঝাতে চেয়েছি?”

নার্স আমতাআমতা করে বলল, “জি স্যার বুঝতে পেরেছি।”

“বুঝতে যেহেতু পেরেছেনই এখন নিজের ভুলটাও শুধরে নিন, ইউ সে সরি!”

“জি?”

“সে সরি টু মাই ব্রাদার, আপনি আমার ভাইকে এক্ষুনি সরি বলবেন..”

“কিন্তু স্যার…”

“আপনার সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাচ্ছি না। সে সরি এন্ড গেট আউট অফ দিস রুম…”

কঠিন ও রুক্ষ শোনাল ইহসানের কণ্ঠস্বর। নার্স আমতা-আমতা করে ইজহানের দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলল। কিন্তু ইজহানের মধ্যে সরি গ্রহণের কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। সে এতোক্ষণে ঝড়ে-বকে নার্সের দফারফা করে দিতো যদি তার ভাই চুপ করে থাকতো, ইহসান টাইট দেওয়ায় সে এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবারে সুযোগ পেতেই রুক্ষ স্বরে ইজহান বলল, “আমি তো বউয়ের কথা মান্য করে চলছি ইদানীং, তাই আপনাকে তেমন কিছুই বলছি না। তবে ফ্রিতে একটা অ্যাডভাইস দিচ্ছি, অন্যের বউ-বাচ্চার দিকে আপনার শকুনি নজরটা কম দেবেন। কারণ আপনি একজন নার্স, শকুন না। যান এবার…”
অপ্রস্তুত নার্স বেরিয়েই যাচ্ছিল, তবে ইজহান আবারও ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “পরেরবার যাতে আপনাকে আমার বউ-বাচ্চার ডিউটি করতে না দেখি! ভালো হবে না…”

“খারাপ কী হবে?”

“খারাপ কিছুই হবে না, কিন্তু আপনার চাকরিটাও থাকবে না।”

আশ্চর্য এবং ভীতগ্রস্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল নার্স। বুঝতে পারল না, সামান্য একটা বিষয়ে এতো রিয়েক্ট করে কী বুঝাতে চাইল লোকদুটো! তারা খুব ক্ষমতাবান লোক? তাদের এতো ক্ষমতা আছে তার চাকরি কেড়ে নেওয়ার? তাহলে তো অবশ্যই ঐ পেশেন্ট ইস্মিতা আর তার দুধের শিশুটা থেকে দূরে থাকতে হবে! কারণ, এতো সুন্দর, ফুটফুটে দেখতে মেয়ে বাচ্চাটাকে আসলেই তিনি চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছে!

°

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬৪

তিন মাসের ছোট্ট একটা ভ্রূণ; ছেলে না মেয়ে ছিল জানতে ইচ্ছে হয়নি ইজহানের। একটা বোলে করে যখন ছিন্নভিন্ন অংশগুলো ওর সামনে রেখেছিল, দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে করেনি ইজহানের। তবে বুকের ভেতর কিছু একটা ফাঁকা ঠেকছিল ওর। দপদপ করছিল যন্ত্রণারা। ইজহানের সম্পূর্ণ খেয়াল ছিল তখন তার ইস্মিতাকে ঘিরে। তাই এতো বেশি ভাবেওনি সে ঐ ভ্রুণটাকে নিয়ে। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় ইজহানের বুক কেঁপে উঠছে পুরোনো পাপের কথা মনে করে। দম বন্ধ লাগছে। ঐটুকু ভ্রুণটা কী ছিল? তার বাপ না কি মা? কীভাবে পেরেছিল সে এতো নিষ্ঠুর হতে? তার প্রথম সন্তান ছিল তো, তার আর ইস্মিতার প্রথম ভালোবাসার ফসল। সে টিকতে দেয়নি ওকে। নিজের বাচ্চাকে! ঘাড়ে খুব যন্ত্রণা করছিল ইজহানের। ঝাপসা দেখছিল চারপাশ। সদ্য জন্মানো মেয়ের মুখটাও সে দেখতে পাচ্ছিল না, বারবার সেখানে একটা ছেলেশিশুর মুখ ভেসে উঠছিল! সহ্য করতে না পেরে দৃষ্টি ফেরাতেই ইজহান আরো দেখল, ছেলেশিশুটা তার কোল থেকে নেমে মেঝেতে বসে হামাগুড়ি দিচ্ছে, কোলে উঠার পায়তারা করছে, দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে…আধো আধো স্বরে ডাকছে তাকে ‘পাপা’ বলে। ইজহানের চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করল, চোখ কচলাল সে। কিন্তু তাও বাচ্চাটা দৃষ্টিসীমানা থেকে গেল না, বরং ওর পায়ের কাছে এসে বসলো। ওর জুতা টানলো, মোজা টানলো। এরপর ধীরেধীরে ওর কোল বেয়ে উপরে উঠে এলো। দাঁতহীন মাড়ি দ্বারা ওর কান কামড়ে ধরল, আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরল তার আঙুল। ইজহানের কেন যেন দম বন্ধ হয়ে এলো। ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে সে ডাকতে চাইল বাচ্চাটাকে, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চাইল না৷ বহুকষ্টে যখন পাপা বলে সম্বোধন করল, নিমিষেই বাচ্চাটাকে দেখল সে কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। অভিমান আর অভিযোগ মিশ্রিত চাহনি তার। খুব অভিমানের। এটুকু একটা বাচ্চার সেই অভিমান, অভিযোগের সেই দৃষ্টি দেখে আচানক ইজহানের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। হাঁসফাঁস করে উঠল সে, ‘আমার বাচ্চা’ বলে। ইহসান রিপোর্ট দেখছিল, দ্রুত এসে ধরল ওকে। ইজহানের প্যালপিটিশন হচ্ছে বুঝতে পেরে রুমাল ভিজিয়ে এনে চোখমুখ মুছিয়ে দিয়ে ওকে ধীরেধীরে শান্ত করানোর জন্য সময় দিলো সে। সম্বিৎ ফিরে পেল ইজহান কয়েক মুহূর্ত পর। প্রশ্নোক্ত চাহনিতে ইহসানকে সামনে দেখে মুহূর্তেই আবার ছেলেশিশুটির মায়াবী চেহারাটা মানসপটে ভেসে উঠল তার। চোখ থেকে বড়ো বড়ো কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ওর। ইহসান ভাইয়ের চোখে পানি দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল, “কী হয়েছে তোর? কষ্ট হচ্ছে? এতো দুর্বল হলে হয়? আম্মাজান তো হাসবে তোকে দেখে!”

আচমকা ত্রিশোর্ধ্ব ইজহান নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। মাথার দু’পাশে চেপে ধরে নিজের প্রতি ঘৃণা, আক্রোশ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আমি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছি, আমার বাচ্চাকে। ও আমার ছেলে ছিল, ছোট্ট একটা ছেলে। আমি যাকে আসতে দিইনি! জানিস, ও এক্ষুনি এসেছিল আমার কাছে! এতটুকু একটা বাচ্চা, দুধের শিশু! দাঁত উঠেনি ওর। অথচ আমি..আমি ওকে হারিয়ে ফেললাম। কী করে হারাতে দিলাম? আল্লাহ! ও আমার সন্তান ছিল! এতো বড়ো বড়ো চোখ ওর, ঠোঁট ভেঙে কাঁদল ও আমার দিকে তাকিয়ে, ঘৃণাভরা চোখে! আমি কীভাবে ওর চোখ থেকে নিজের জন্য ঘৃণা মুছব? ও কখনো মাফ করবে না আমার মতো কুলা ঙ্গার বাপকে। আমি..আমি কেমন ন ষ্ট বাপ, আল্লাহ!”

ইহসান হতভম্ব হয়ে বসে রইল। ভাষা খুঁজে পেল না ভাইকে বলার মতো! নির্বাক, নির্জীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অনুভব করল তার এই ভাইটা তার চেয়ে কয়েকগুণ ভালো, কয়েক হাজারগুণ ভালো। যাকে তার ভাই ভুল করে পৃথিবীতে আসতে দেয়নি; ঐ বাচ্চাটাও তার ভাইয়ের প্রতিটি অশ্রুর বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বাপের জন্য পানাহ চাইবে!

°

সারাটা দিন অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠা প্রকৃতিকে প্রশান্তির দোরগোড়ায় ভাসিয়ে দিতে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বজ্রসহ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছে। যার দরুণ শেখ বাড়িটি ঢেকে আছে আঁধারের ছায়াতলে। শেফালি বুয়া কোথা থেকে মোমবাতি জোগাড় করে এনেছে, তবে তা যথেষ্ট নয়! সৃজার নির্দেশে এলিজা আধভাঙ্গা মোম হাতে ঘর থেকে বেরিয়েছে দারোয়ানকে বলে আরো কিছু মোমবাতি কিংবা চার্জার লাইটের ব্যবস্থা করা যায় কি না জিজ্ঞেস করতে! আপাতত মোমের হলদেটে আলোয় আঁধার কেটেছে ইহসানের ঘরটিতে। অন্ধকার কাটলেও তীব্র বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে গলা ফাটিয়ে কেঁদে চলেছে আযরান, আজওয়া। বুকে চেপে তাদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছে সৃজা আর মিজুর ষোড়শী বউ সায়মা। নীলু বেগম দোয়াদুরুদ পড়ছে, চেষ্টা করছে কীভাবে ওদের ভয় কাটিয়ে শান্ত করানো যায় তা নিয়ে। কিন্তু বাচ্চাদুটোর কান্নাকাটি আর ভয় কমছে না। ক্রমেই বাড়ছে। হসপিটালে ছুটোছুটি করার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে ফোন করছে ইহসান। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে এতক্ষণ যাবৎ কল লাগছিল না। অনেকক্ষণ যাবৎ চেষ্টার পর যাও এবার কল ঢুকেছে, নতুন রাজকন্যা আগমনের খবরটুকু দিয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করতেই তার কানে এসেছে সন্তানদের কান্নাকাটির শব্দ। সৃজা তাকে জানিয়েছে, বজ্রপাতের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ছোট্ট পাখি দুটো কান্নাকাটি করছে, খাচ্ছেও না। তবে নীলু ফুফুরা সবাই আছে ওদের পাশে। ছেলে-মেয়ের অবস্থা শুনে ইহসান স্থির থাকতে পারছে না। ভেতর থেকে সে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পুরো বাড়িটাকে সাউন্ডপ্রুফ করার ব্যবস্থা করবে এবং সেটা আগামীকালই। অবস্থা এমন যে, ঝড়-বৃষ্টির তোয়াক্কা করতে রাজি নয়, দুটো নিষ্পাপ প্রাণকে সে কীভাবে অভয় দেবে সেই নিয়ে তার চিন্তা, পারলে তক্ষুনি বাড়ি চলে যায়! কিন্তু সৃজা তাকে উৎকণ্ঠিত হতে বারণ করল। কারণ বাচ্চারা ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। আলাপনের এ পর্যায়ে একটুখানি স্থবিরতা আসতেই নিচতলা থেকে সৃজার কানে এলো পুরুষালি অচেনা কণ্ঠটি, যেটি ‘ল্যাভেন্ডার’ সম্বোধনে কাউকে ডাকছে!

ফোনের ওপাশে থাকা ইহসানের কানে পুরুষালি উচ্চস্বরটি দামামা বাজালেও সে ঠাহর করতে পারল না কণ্ঠটি কার! তবুও সে মৌনতা অবলম্বন করে বুঝতে চাইল ঘটনা কী! শেখ বাড়ির ছোটো পুত্র বাড়ি ফিরেছে খবরটি তখনো ইহসান পত্নীর অজানা। অপরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনে ইহসানকে বলে কলটা হোল্ড করে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে এলিজা সিঁড়ি মাথায় দাঁড়িয়ে, ওড়না মাথায় টেনে ঢাকছে নিজেকে। নিচের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাটে, সুর্দশন এক আগন্তুক পুরুষ। ভিজে চুপসে আছে তার মাথার চুল, পরণের স্যুট থেকে পায়ের জুতা অবধি৷ বা-হাতে কুকুরের গলার বেল্ট ধরা, বাদামি রঙের একটা কুকুর ভিজ বের করে আছে, সেও ভেজা৷ অথচ আগন্তুকের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আধো অন্ধকারকেন অবমূল্যায়ন করে একদৃষ্টিতে এলিজার দিকেই তাকিয়ে। চাহনিতে নেই কোনো আড়ষ্টতা, নিষ্পলক তাকিয়ে পরখ করে যাচ্ছে ওড়নার আড়ালে ঢেকে যাওয়া তার বোনকে। যার আচরণেও বিস্ময়ের সহিত লেপ্টে আছে একরাশ বিরক্তি। এলিজা পর্দানশীল নয় তবে যথেষ্ট শালীন মেয়ে। সে পছন্দ করে নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখতে। পর পুরুষদের সামনে যায়, তবে যথেষ্ট পরিমাণ চেষ্টা করে নিজেকে শালীন রেখে তাদের সামনে যেতে। ভদ্রসভ্য পোশাকেই সে অভ্যস্ত। তবুও তার ঠিকরে পরা সৌন্দর্য অন্যকে খুব আকৃষ্ট করে ফেলে সহজেই, সেজন্য মেয়েটা চেষ্টা করে লোকসমাগম স্থানে কম যাওয়ার। বা, গেলেও নিজেকে ঢেকেঢুকে যায়। কেননা, কেউ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তিতে গা কাঁটা দেয় ওর। তাই মাথায় ওড়না টেনে ইয়া বড়ো একটা ঘোমটার আড়ালে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে মেয়েটা আজকাল। কিন্তু শেখ বাড়িতে এসে প্রথমদিনই যেসমস্ত ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে সেসব মোটেও পছন্দ হচ্ছে না এলিজার। মোমবাতির ব্যবস্থা করতে এসে যে আগন্তুকের দেখা পাবে আর আগন্তুক তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকবে ব্যপারটা ওর জন্য বেশ বিরক্তিকরই বটে! অপরিচিত লোকটার নজরের সামনে যে এলিজা অপ্রস্তুত এবং বিরক্ত সেটা বুঝতে পেরেই সৃজা দ্রুতপদে বোনের কাছে এসে দাঁড়াল। পরণের আকাশনীল শাড়ির ঘোমটাটা টেনে তুলে নিলো মাথায়। একটা বৌ বৌ স্নিগ্ধতা এসে ছড়িয়ে পড়ল মুখে। আগন্তুক লোকটার চক্ষুদ্বয় এলিজা থেকে সরে গিয়ে এবারে পড়ল তার উপর। কয়েক সেকেন্ড বাঁকা চোখে তাকিয়ে থেকে রাশভারি স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “হেই ল্যাভেন্ডার, কেমন আছ?”

আচাম্বিত দুই বোন একে-অপরের মুখের দিকে তাকাল। কেউই বুঝতে পারল না যুবকটি প্রশ্নটা কাকে করেছে৷ তবে ‘ল্যাভেন্ডার’ নামের কাউকে যে লোকটি চাইছে, তা বোঝা গেল। কিন্তু শেখ বাড়িতে তো এই অদ্ভুত, বিদেশী ফুলের নামের কেউ থাকে না৷ তাহলে লোকটা কাকে খুঁজছে? পরক্ষণেই সৃজার ঠাহর হল যুবক প্রশ্নটা করেছে তাদের দিকে তাকিয়ে। তার আর এলিজার! অথচ তারা দু’জনের কেউ এই লোককে চেনে না, কোনোদিন দেখেনিও। তাছাড়া সৃজা যদিও এ বাড়ির বউ, এলিজা আজই প্রথম এ বাড়িতে এসেছে! তাহলে কাহিনীটা কী? চুপ থেকে আগন্তুকের প্রশ্নের অর্থোদ্ভেদ করা যাবে না বলে বড়ো বোন হিসেবে সৃজা নিজেই জবাব দিলো, “ল্যাভেন্ডার? আপনি কী এই নামের কাউকে চাইছেন? তাহলে আপনাকে দুঃখিত বলতে হচ্ছে। কারণ এখানে ল্যাভেন্ডার নামের কেউ নেই, এ বাড়িতেও এ নামের কেউ থাকে না।”

রুক্ষ স্বরে কথাগুলো বলার সময় সৃজা লক্ষ্য করছিল আগন্তুকের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি তবে চোখে অদ্ভুত এক মাদকতা। যেটা তার সহ এলিজার দিকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার। বিষয়টা মোটেও ভালো লাগল না ওর। মোমবাতিটা নিজের হাতে নিয়ে এলিজাকে টেনে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে কঠিন স্বরে কিছু একটা বলতে যাবে সেই মুহুর্তেই সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে থাকা আজিজ শেখের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “এই সালেহা, পুনম, মিতু, ইমরান বাইর হয়ে আয়! আমার বাপধন ফিরছে! আমার জান বাড়িতে আসছে! তোরা কে, কোথায় আছিস আলোর ব্যবস্থা কর…”

অন্ধকারে এক টুকরো আগুন নিয়ে সিঁড়িমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা সৃজার উপর তখনি চোখ পড়ল আজিজ শেখের। সঙ্গে সঙ্গেই কিছুটা ধমকের স্বরে বললেন, “ঐখানে খাড়ায়া আছো কেন? নিচে আসো। আমার বাপধন ফিরছে, ইহসানের ছোটোভাই। সম্পর্কে তোমার দেবর হয়! আসো, আইসা পরিচিত হওওওও…”

মকবুলসহ আরো ক’জন চাকর-বাকর হারিকেন, লণ্ঠন নিয়ে ছুটে এলো আজিজ শেখের চিৎকারে। ঘরে দোর দিয়ে আকিকা অনুষ্ঠানের একেকটা দোষ-ত্রুটি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝামেলা বাঁধানো মিতুও ইমরানকে নিয়ে ছুটে এলো। সকলেই বিস্ময়ে হতবাক আরসালান ইনজান শেখকে দেখে! ভেজা পোশাক থেকে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির একেকটি ফোঁটার সঙ্গে যেন এই সুদর্শনের সৌন্দর্যও ঠিকরে পড়ছিল। মানে একজন যুবক এতোটাও সৌম্যদর্শন হতে পারে তা যেন আজিজ পুত্রকে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না। সকলকে নিজের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত আরসালান আলগা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ‘হাই’ জানাল সবাইকে। বিপরীতে সকলে ভীতি, কৌতূহল নিয়ে ওর সঙ্গে পরিচিত হলো নয়তো কুশল বিনিময়ে লিপ্ত হলো। আজিজ শেখের নির্দেশে মকবুল ছুটে এসে আরসালানের গা থেকে ভেজা স্যুট, পা থেকে শু’জোড়া খুলে টা তোয়ালে দিয়ে ওর মাথা মুছে দিতে উদ্যত হলে আজিজ শেখ নিজেই ছেলেকে চেয়ারে বসিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে লাগলেন যত্ন নিয়ে। এদিকে শ্বশুরের কথা শুনে সৃজা অবাক ও বেশ অপ্রস্তুত। সে জানে, ইহসানরা চার ভাই। ইহসান-ইজহান, ইমরান আর ছোটো ভাই ইনজান। যে কি না বেশ কয়েক বছর যাবৎ বিদেশে অবস্থান করছে। দেশে ফিরেনি একটি বারের জন্যও। সালেহা বেগমের এ নিয়েও আফসোসের শেষ নেই! অথচ ছোটো ছেলে আজ বাড়ি ফিরল, কাউকে কিছু না জানিয়ে, ভাইদের অনুপস্থিতিতে, এ বিরুপ আবহাওয়াকে সঙ্গী করে! সৃজা যখন এসব নিয়েই ভাবনায় মত্ত সেসময়ই মকবুলকে দেওয়া আজিজ শেখের আরো একটা ধমকের স্বর ওর ঘোর কাটাল। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন পুরুষের সঙ্গে ঠিক কীভাবে পরিচিত হতে হয় তা অজানা সৃজার। তার উপর পুরুষটার চাহনি যদি সুবিধার বলে মনে না হয় বা সম্পর্কে যদি সে আপন দেবর হয় তাহলে কোথা থেকে কী বলে পরিচিত হলে সেটা উপযুক্ত হবে বুঝতে পারল না সৃজা। তবে শ্বশুরের উচ্ছ্বসিত আচরণে ভদ্রতা রক্ষার্থে বিব্রত সৃজা নেমে এলো পরিচিত হতে। এলিজা এলো না, মোমবাতি হাতে সরে দাঁড়াল একপাশে। ল্যাভেন্ডারের পদশব্দ অনুসরণ করে আরসালান ইনজান শেখ চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে। ঠোঁটজুড়ে হাসি বিচরণ করল তার। মাথাভর্তি কিলবিল করতে থাকা একেকটা কুচিন্তা তাকে শীতল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বহুদূর। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে আগ্রহী চিত্তে নড়েচড়ে বসে কান খাড়া করল সে সৃজার রিনরিনে কণ্ঠস্বরের একেকটা শব্দ, বাক্য শোনার আশায়। এদিকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত তবে বিনীত ভঙ্গিতেই বলার চেষ্টা করল সৃজা, “দুঃখিত! আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই বা এর আগে পরিচিত হবার কোনো সুযোগ হয়নি বলে আপনি ঠিক কে সেটা আন্দাজ করতে পারিনি। তবে এখন যখন পরিচয় জানা গেল, এতোদিন পর যখন বাড়িতে ফিরেছেন তখন আপনার আগমনে খুব খুশি হয়েছি। আমি সৃজা রেহমান। আপনার বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী। শেখ বাড়ির বড়ো বউ।”

“আরসালান ইনজান, শেখ বাড়ির ছোটো পুত্র!”

রাশভারি কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সৃজা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল। কী বলবে তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারল না। ম্লান হেসে তবুও বলল, “সম্পর্কে আপনি আমার দেবর হোন। আমি কী আপনাকে ভাইয়া বলে ডাকব?”

আরসালান এবার সৃজার চোখে চোখ রেখে তাকাল। একটু ঝুঁকে ঠোঁটে হাসি নিয়ে সরু গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল, “তুই, তুমি, আপনি যা খুশি ডাকতে পারো সেসবে আমার বিধি নিষেধ নেই। আই ডোন্ট কেয়ার! বাট আমি কি তোমায় ল্যাভেন্ডার বলে ডাকতে পারি?”

আশ্চর্যান্বিত হলো সৃজা রেহমান। প্রথম পরিচয়েই ‘তুমি’ সম্বোধন; তার উপর ‘ল্যাভেন্ডার’ ডাকার অনুমতি চাইছে লোকটা! কথাবার্তাও কেমন অদ্ভুত, গা-ছাড়াহীন। প্রবল বিস্ময়ে সৃজা বলে উঠে, “ল্যাভেন্ডার? কিন্তু আমার নাম সৃজা রেহমান!”

“সমস্যা নেই, আমি আদর করে ডাকব! তোমার উচিৎ পারমিশন দিয়ে দেওয়া।”

বিশ্রি একটা অনুভূতিতে গা শিউরে উঠে সৃজার। বুঝতে পারে না সামনে দাঁড়ানো লোকটার আবদার স্বাভাবিকভাবে নেবে না কি জটিলভাবে। দোটানায় ভুগতে থাকা সৃজা অবশ্য বেশিক্ষণ সময় নিলো না। জটিলভাবেই নিলো ব্যাপারটা। অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে বলল, “আপনি বরং আমাকে ভাবি বলেই ডাকুন ভাইয়া, আমি তাতেই খুশি হবো!”

মালিকের কথার অবাধ্য হয়েছে শাড়ি পরণে মেয়েটা, ল্যাব্রাডর জাতের বাদামি কেমি ঘেউঘেউ স্বরে ডেকে উঠল। সৃজা যদিও কুকুর ভয় পায় না তবুও ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল হঠাৎ। কেমির কান্ডে ভীষণ রাগান্বিত হলো আরসালান তার তথাকথিত বাপকে— থামিয়ে দিলো প্রচন্ড এক হুঙ্কারে, রক্তবর্ণ চোখে চেয়ে। ওর ওমন আচরণে ভয় পেয়ে গুটিশুটি মেরে পায়ের নিকট কুন্ডলী পাকিয়ে বসে পড়ল কেমি।

এদিকে পায়ের রক্তগুলো তরতর করে মাথায় উঠতে লাগল আরসালানের। হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো তার। বেগুনি ফুল এটা কী শোনাল আরসালান ইনজান শেখকে? এতোবছর যাবৎ এতো সুন্দর ডাকনামে সম্বোধন করে যাকে নিয়ে ভাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে সে ভেতর থেকে, সেই মেয়ে কি না তাকে ভাবি বলে সম্বোধন করতে বলছে? সে জোর করে হাসার প্রচেষ্টা করল, “এজ ইয়র উইশ, ল্যাভেন্ডার!”

আজিজ পুত্র যতোটা সুদর্শন তার কথাবার্তাও তেমন অদ্ভুত! ‘এজ ইয়র উইশ’ বলে ‘ভাবি’ ডাকার সম্মতি প্রদান করলেও ঠিকই ‘ল্যাভেন্ডার’ ডাকছে! এসে থেকেও ল্যাভেন্ডারকে চাইছিল, ওকেই খুঁজছিল কি? ব্যাপারটাতে কেমন যেন খটকা লাগল সৃজার! তবে মানে বুঝতে ব্যর্থ হলো। এদিকে ছেলের কথোপকথনের বাহার দেখে কিছুটা অবাক হয়ে পুত্রের মুখপানে তাকানো মাত্রই কিছুটা ঝটকার মতো খেলেন আজিজ শেখ। ছেলের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসিটা দেখে এতক্ষণে তার বোধোদয় হলো ইহসানের সঙ্গে তার জানের দ্বন্দের কথা, ইহসান পত্নীকে নিয়ে তার ছোটো ছেলের কুটিল সব ভাবনা! অপ্রস্তুত হয়ে কেশে উঠলেন তিনি। গলা খাকারি দিয়ে ভ্রু কুঁচকে, সন্দেহী নজরে ইনজানের দিকে চেয়ে থাকা সৃজাকে বললেন, “সোনা মণিরা কই? আন্ধারে ওদের কোথায় রাইখা আসছ? যাও যাও ঘরে যাও, ওদের দেখভাল করো গিয়ে। আর সালেহা, পুনমরে পাঠাই দাও নিচে। বলো গিয়ে আমার বাপধন আসছে…”

যুবক বয়সে বড়ো কিন্তু সম্পর্কে ছোটো। অথচ তার আচরণ মোটেও ভালো লাগার মতো নয়। সৃজা আর চাইছিল না এখানে থাকতে, মূলত আরসালানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তাই ওখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসতে চাইল ও। আজিজ শেখকে বলল, “আন্টি আর পুনম ওরা ইস্মি ভাবির সঙ্গে হসপিটালে গেছে।” কথাটা বলে সৃজা চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিল, কিন্তু কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় থেমে গেল। আজিজ শেখকে বলল, “হসপিটাল থেকে একটু আগেই খবর এসেছে, ভাইয়া-ভাবির ঘর আলো করে আল্লাহ একটা পরী দিয়েছে, ছোট্ট একটা রাজকন্যা এসেছে!”

“আলহামদুলিল্লাহ!”

বংশধর জন্ম নিয়েছে আরো একজন! সৃষ্টিকর্তার অশেষ শুকরিয়া আদায় করলেন আজিজ শেখ। খুশির জোয়ার বইল তার চোখেমুখে। নিজে নিজেই বললেন, “সবই আমার নাতি-নাতনি ভাগ্য! ওদের আকিকার দিনই দেখলা কতকিছু হইলো? আরেকজন নাতনি পৃথিবীর মুখ দেখল, আমার ছোটোবাপ ফিরলো! বংশ, বাড়ি সবেতেই সোনা ফলল! শীতল, বৃষ্টিময় আর পুনরাবৃত্তিমূলক খুশির একটা দিন!”

তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছারত অবস্থায় ফাঁকে ফাঁকে আরসালান দেখল, আকাশনীলে মোড়ানো ল্যাভেন্ডার চলে যাচ্ছে এমিলি ইয়াসমিনের কক্ষের দিকে, সঙ্গে যাচ্ছে রক্তলাল রঙ জড়িয়ে থাকা মোমের পুতুল সরুপ মেয়েলি দেহাবয়বও। যার গালে-কপালে কাঁটা দাগ, চোখদুটোতে মহাসমুদ্রের উচ্ছ্বাস! অথচ অন্ধকারে মুখটা ভালোভাবে দেখতে পারেনি আজিজ পুত্র! সেইদিকে তীক্ষ নজর বিদ্যমান রেখে নিচু স্বরে বিড়বিড় করল ইনজান, “তোমার বংশ নির্বংশ হয় না কেন?”

°

বৃষ্টির দাপট কমেছে মাত্রই। সৃজা যখন এলিজাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল তখনি ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। ঝলমলে আলোয় ভরে উঠল পুরো বাড়ি, ইহসানের ঘরটি। ইলেকট্রিসিটি চলে আসায় সৃজা স্বস্তির শ্বাস ফেলতেই নীলু ফুপি ওকে বলল, “ফোন বাজতেছে অনেকক্ষণ ধরে, ইহসানের কল। বাবু কানতেছিল, ধরতে পারি নাই!”

প্রয়োজনীয় কল হতে পারে বলে সঙ্গে সঙ্গেই সৃজা কলব্যাক করল ইহসানের নাম্বারে। সেকেন্ডেই রিসিভ হলো কলটি। উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল ইহসান, “কোথায় ছিলি? বাচ্চারা বেশি কাঁদছে?”

“না না, একজন ঘুমিয়েছে। আরেকজন জেগে। তবে জ্বালাচ্ছে না। আমি নিচে গিয়েছিলাম। তোমার ভাই এসেছে। আংকেল ডাকছিল পরিচিত হতে…”

কানে ভুল শুনল না কি ইহসান শেখ? কপালে ভাঁজ ফেলে সরু গলায় দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল সে অর্ধাঙ্গিনীকে, “কার কথা বললি রে জান? কে এসেছে?”

“বৃষ্টিতে ভিজেটিজে তোমার ছোটো ভাই এসেছে। আরসালান ইনজান, ফ্রম প্যারিস!”

বিস্মিত, অবাক, হতভম্ব কিছুই হলো না ইহসান। পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে দপদপ করতে থাকা কপালে আঙ্গুল চালাল সে, “আমি বেশিদিন বাঁচব না জানিস বউ? আমি আর বাঁচব না।”

কণ্ঠস্বরটি শীতল আর আর্তনাদের মতো মনে হলো। নিমিষেই ভড়কে গেল সৃজা, ধমকে উঠল জোরেসোরে, “এসব কী অলক্ষুণে কথা বলছ? কী হয়েছে তোমার? এক্ষুনি চুপ করো, আদার ওয়াইজ আমি কিন্তু…”

“কিন্তু কী সৃজা?”

দৃঢ় ও ব্যথিত গলায় বলল সৃজা, “আমিও বাঁচব না। তোমার সঙ্গে যাব।”

“আমার মায়ের মতো আমার বাচ্চাদের মাতৃহীন করে কোত্থাও যেতে পারবি না রে তুই! আমি তোকে ক্ষমা করব না।”

বিচলিত, উচাটন কণ্ঠস্বর সৃজার, “আমাকে ছেড়ে উল্টাপাল্টা কোথাও যাবার আগে তুমিও মনে রেখো, আমি তোমায় মাফ করব না। কখনো না। পুরো পৃথিবী পায়ের কাছে এনে দিলেও না। তাই দ্বিতীয়বার ভুলেও এসব কথা উচ্চারণ করো না। তুমি কেন বোঝো না, আমার মাথার উপর হাত রাখার মতো একটা মানুষ বলতে তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার? কেউ নেই। আমি সৃজা অন্তঃসারশূন্য মেয়েমানুষ। যার মধ্যে গুণ তো দূরের কথা বাচ্চা সামলানোর ক্ষমতাটুকুও ক্ষীণ। বলো না, কী হয়েছে? হঠাৎ করে এমন বললে কেন তুমি? আমি তো তোমার ভাই আসার সংবাদ দিলাম। তুমি খুশি হওনি?”

সত্য প্রকাশ করার মতো সাহস নেই ইহসানের, তাই তেঁতো স্বরে বলল, “হয়েছি। তবে ব্যাপার কী জানিস? আমার এই ভাইটা ইজহানের চেয়েও অন্যরকম! ওর কথাবার্তা, আচরণ কিছুই ঠিক নেই। বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করে না। সাইকোলজিস্টের অধীনে রেখেও ওর মধ্যে পরিবর্তন আনা যায়নি। তাই আমার ভয় হচ্ছে ও না আবার কিছু উল্টাপাল্টা করে বসে! তুই প্লিজ সাবধানে থাক, আমি আসছি।”

এসব কথা শুনে সৃজা বিচলিত হয়ে পড়ল ভেতরে ভেতরে। মুখে বলল, “জানো, আমাকে বারবার ল্যাভেন্ডার ডাকছিল, আবার অনুমতিও চাইছিল! কথাবার্তা খুব অদ্ভুত! অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম আমি! তবে একটা ব্যাপার যা বুঝলাম, তোমার এই ভাইটা সবার থেকে আলাদা। কিছু একটা তারমধ্যে ঠিক নেই।”

ইহসানের প্রচন্ড মাথা ধরে গেল এসব শুনে। কু* বাচ্চাটা শুরু করে দিয়েছে তার ফাত্রামি? সে আর কী করবে? কী করলে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে? কেন বারবার তার অনুপস্থিতিতেই ইনজান চলে আসে? কেন? ইজহানও তো তাকে এতো যন্ত্রণা দেয়নি! এত্তো যন্ত্রণা, এত্তো সংশয় এই জীবনে! ইহসানের হঠাৎ খুব অসহায় লাগল! সৃজাকে এটা-সেটা বুঝিয়ে ফোনটা কেটে আজিজ শেখকে কল দিয়ে কতক্ষণ ঝাড়ল সে। এরপর দু’হাতে মুখ ঢেকে কতক্ষণ বসে রইল হসপিটালের করিডোরে ওয়েটিং চেয়ারেই। এদিকের পরিস্থিতি যদিও হাতের মুঠোয়, সব ঠিকঠাক! শুধুমাত্র ইজহানকেই ইস্মিতার কাছে পাঠাতে পারছে না সে, মেয়ে কোলে নিয়ে প্রথম বাচ্চাটার কথা মনে করে এখনো অশ্রু ফেলছে৷ গাধাটার হৃদয় যে এতোটা দুর্বল, সে যে এভাবে কাঁদতেও পারে এই বিরল দৃশ্যটি দেখে ইহসানের মোটেও ইচ্ছে করছে না ভাইকে রেখে কোথাও যাওয়ার! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ঝাপসা চোখদুটো আড়ালে ঢলে নিয়ে ভাইকে বোঝাতে বসলো সে। অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, শান্ত করে আরসালানের আগমনের খবরটুকু দিয়ে ইহসান যখন ইজহানকে ইস্মিতার কেবিনে পাঠাতে সক্ষম হলো ইহসান। একটা যুদ্ধ শেষ করে যোদ্ধারা যেমন নিস্তার নেওয়ার আশায় মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়, ইহসানেরও ইচ্ছে করল হস্পিটালের গুমোট আবহাওয়া থেকে নিজেকে একটু প্রশান্তির চাদরে ডুবিয়ে রাখতে। তৎক্ষনাৎই আকাশকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল।

এদিকে মূর্তিমান ইজহান গিয়েই ইস্মির পায়ের কাছে বসে পড়ল। শরীর অসাড় হওয়া ব্যথা নিয়েও এতক্ষণ পর ইজহানের অপেক্ষায় থাকা ইস্মি লোকটার উপর অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু স্বামীর কান্ডে ওর অভিমানের পাহাড় বরফের ন্যায় গলে গেল। চমকে উঠে বসার চেষ্টা করল ইস্মিতা, বিচলিত কণ্ঠে ডাকলো সে ইজহানকে, “ওখানে কী? এখানে আসুন! আমার বুকে আসুন!”

ইজহান ওর পায়ের পাতায় অগণিত চুমু খেয়ে ইস্মির কাছে আসলো অনুভব করল তার আধপাগল স্বামীটির অশ্রুভেজা চোখ! অথচ প্রাণপণে লুকানোর চেষ্টা করছে তার থেকে। বিব্রত ও বিস্মিত ইস্মি ইতোপূর্বে কখনো ওকে এতোটা দুর্বল হয়ে পড়তে দেখেনি। তাই স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দু’দন্ড সময় নিলো না সে। পড়ে পড়ে নিজেও কাঁদলো। ইজহান তার ইস্মিতার চোখে-ঠোঁটে চুমু খেয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে ব্যাকুল চিত্তে বলল, “দুটো দিতে পারলে না আমাকে? টনা-মনার মতো? কেন দিলে না আমাকে ইস্মিতা? আমার ভেতরটা মা’কে পেয়েও কেন এমন খালি খালি লাগছে?”

ইস্মি ওর কথা শুনে, অদ্ভুত চাওয়া শুনে বিস্মিত হয়ে গেল। ম্লানমুখে হাসলো, “ওসব কী আমার হাতে আছে? তবে আপনি বললে আরো কয়েকটা নিতে সমস্যা নেই আমার!”

ঐটুকুনি মেয়েই যা যন্ত্রণা দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তাতেই আরেকটু হলে হার্ট-অ্যাটাক করতো ইজহান শেখ! বাচ্চার দরকার হলেও ইস্মিতাকে আর গর্ভবতী করা যাবে না। কিন্তু বউয়ের কাছে কী আর নিজেকে কাপুরুষ প্রমাণ করা যায়? ইজহান তাই আবেগ বাদ দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “তোর শখ দেখে আমার চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে ইস্মিতা! এতো ষড়যন্ত্র জানিস তুই?”

“আপনার ইচ্ছে বুঝে আমারও মা হতে ইচ্ছে করছে!”

ইজহান কটমট করে তাকাতে চাইল ইস্মির দিকে। কিন্তু কেন যেন পারল না সে; আচমকা পুরুষদের কান্না করতে নেই থিওরিকে ভুল প্রমাণ করে কেঁদে ফেলল! হতভম্ব, হতবাক ইস্মি স্বামীর গাল ধরে উদগ্রীব হয়ে উঠল, “কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন? মেয়েকে পছন্দ হয়নি?”

“ও তো তোমাকে কপি-পেস্ট করে এসেছে, এলিজের মতো গায়ের রঙ নিয়ে! ও খুব সুন্দরী! আমার তো সামনে যেতে লজ্জা লাগছে!”

ইস্মি হতবাক, “মেয়ে সুন্দরী; এরজন্য আপনি কাঁদছেন?”

“না৷ আমি আমার ছেলের জন্য কাঁদছি।”

.

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬৫

ইজহান কটমট করে তাকাতে চাইল ইস্মির দিকে। কিন্তু কেন যেন পারল না সে; আচমকা পুরুষদের কান্না করতে নেই থিওরিকে ভুল প্রমাণ করে কেঁদে ফেলল! হতভম্ব, হতবাক ইস্মি স্বামীর গাল ধরে উদগ্রীব হয়ে উঠল, “কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন? মেয়েকে পছন্দ হয়নি?”

“ও তো তোমাকে কপি-পেস্ট করে এসেছে, এলিজের মতো গায়ের রঙ নিয়ে! ও খুব সুন্দরী! আমার তো সামনে যেতে লজ্জা লাগছে!”

ইস্মি হতবাক, “মেয়ে সুন্দরী; এরজন্য আপনি কাঁদছেন?”

“না৷ আমি আমার ছেলের জন্য কাঁদছি।”

ইস্মি চেয়েছিল একটা সন্তান। সেটা ছেলে-মেয়ে যেটাই হোক না কেন আলাদা করে তার কোনো চাহিদা ছিল না। সৃষ্টিকর্তার দানেই সে বিশ্বাস রেখেছিল। কিন্তু ইজহান মায়ের বায়না করেছিল বলে সে-ও দোয়া করেছিল যাতে তার মেয়েই হয়, একটা টুকটুকে মেয়ে এসেছেও। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখার পর ইজহান শেখ এখন ছেলের জন্য কাঁদছে? স্বামীর দ্বিমুখী আচরণে ইস্মি রীতিমতো বোবা বনে গেল। বুকের ভেতর আতঙ্ক জাগ্রত হলো এই ভেবে যে, লোকটা আবার আগের রুপ ধারণ করবে না তো? সেই স্বার্থপর ইজহান, যে নিজের ইচ্ছের বাইরে কিছু মেনে নিতে পারে না এবং আদায় না হলে সমস্ত কিছু ওলটপালট করে দেওয়ার প্রবণতা জেগে উঠে। আরেকটা ব্যাপারও ওর ভিতরে গুঞ্জন তুলল যে, ইজহান যদি মেয়েকে কোলে না নেয়? বাবার ভালোবাসা না দেয়? তাহলে তো ইস্মি সইতে পারবে না। ওর মন মরে যাবে! কিন্তু আজওয়াকে তো লোকটা খুব ভালোবাসে। তাহলে নিজের ঔরসের প্রতি কী দুমুখো আচরণ করবে মানুষটা? প্রবল বিস্ময় আর একরাশ ভীতি নিয়ে ঢোক গিলে ইজহানকে শুধাল ইস্মি, “ছেলের জন্য কাঁদছেন? কিন্তু আপনি তো মেয়েই চেয়ে এসেছেন প্রথম থেকে? খুশি হোননি মা পেয়ে?”

চাপা ভয়টা প্রকাশ হয়ে গেল ওর কণ্ঠের কাঁপুনিতে। ইজহান বিবশ চোখে ওর দিকে তাকাল। নীরবে দেখে গেল কতক্ষণ! ইহসান ওকে সাবধান করে গেছে, মেয়েটা সদ্য মা হয়েছে, হাসিকান্না মিলিয়ে অনুভূতি বা মানসিকতাটাই এখন থাকবে স্পর্শকাতর। এই সময়ে সে যাতে এমন কোনো অযাচিত আচরণ না করে যাতে ইস্মিতার মনে দাগ কাটে, কোনো বিরুপ প্রভাব পড়ে। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ইস্মিতাকে এখন মনে করানোটা উচিৎ হবে কি তার সেই পাপাচার? তাদের জীবনে না থাকা সেই প্রাণটার কথা? তিন মাস বয়সী সেই সন্তানকে অবহেলা করলেও, ভালো না বাসলেও ইজহান শেখকে এখন যেমন যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ; ইস্মিতা নিশ্চয় তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিল। এটুকু মাথায় আসতেই ইজহান প্রকাশ করল না আর নিজের অভিব্যক্তি। বলল, “খড়কুটো ধরে কোনোমতে বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি অথচ তুমি আমাকে দিয়ে দিল পুরো পৃথিবী। চাওয়ার চেয়েও বেশিকিছু দিয়েছ যা আমাকে কেউ কোনোদিন দেয়নি। আমি ইজহান শেখ, চাইলেও তোমার ভালোবাসার একরত্তি ভাগও শোধ দিতে পারব না। এতটা কৃতজ্ঞ, এতটা খুশি বহুদিন হইনি ইস্মিতা… যে খুশিটা তুমি আজ দিয়েছ আমায়।”

জোয়ার শেষে শান্ত হয়ে যাওয়া সমুদ্রের মতো, ঝড় থামার পর প্রকৃতিতে নেমে আসা নিস্তব্ধতার মতো, আর কালো মেঘ সরে গিয়ে আকাশে ঠিকরে ওঠা গোলাকার চাঁদের মোহনীয় প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনই ইস্মিতার মনে হলো, এতোদিন বুকের ভেতর বয়ে চলা ঝড়, সমস্ত অবর্ণনীয় দহন এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। সময় থেমে গেছে। আর থেমে গেছে ইস্মি নিজেও। দু’হাতে আগলে ধরল সে ইজহানের মুখটা। ভেতরের জমে থাকা অস্পষ্ট ভালোবাসাটা হঠাৎ করেই স্বীকার করার মতো সাহস পেয়ে বিগলিত চিত্তে বলল, “নিজেও তো একসময় শূন্য ছিলেন। আমি তো বহুদিন ভালোবেসে উঠতে পারিনি আপনাকে। আপনি শিশুসুলভ আবদার করতেন, জ্বালাতেন, আমি বিরক্ত হতাম। সেই বিরক্তি ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে উঠল। আর সেই অভ্যাস কখন যে ভালোবাসায় গাঁথা পড়ে গেল, তা টেরই পাইনি। একটা সময় এলো যখন আপনাকে শুধরে দিতে দিতে, সামলে নিতে নিতে, আপনাকে মানুষ করে তুলতে গিয়ে আপনি নিজেই আশ্রয় হয়ে উঠলেন আমার জন্য! অথচ আপনি বুঝতেই পারলেন না, ইজহান শেখ! আপনাকে খুশি করার আড়ালে আমি আসলে নিজেকেই একটু একটু করে পূর্ণ করছিলাম…”

ইজহান রাগ করল না, হাসলো কেমন করে যেন! বলল, “তবুও তো ইস্মিতা নিজের গর্ভে আমার ঔরস ধারণ করেছে—দু’বার। প্রথমজনকে আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজের খেয়ালে, অবহেলায়। অথচ সে আমারই অংশ ছিল। সেই ছোট্ট প্রাণটা আজ নেই শুধু আমার কারণে। সে আমাকে ক্ষমা করেনি, এখনো না। হয়তো কখনোই করবে না। কিন্তু আমি কি শান্তি পাচ্ছি? আমি কি পারছি নিঃশ্বাস নিতে স্বস্তিতে? পারছি না একটুও! ওর কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতর কিসে যেন চেপে ধরছে। জানি, এই কষ্ট আমি নিজেই ডেকে এনেছি। কিন্তু সে কি বুঝবে তার বাপের বুকেও ক্ষত আছে? বাপের জন্য একটু মায়া করবে?”

ইস্মিকে একরাশ হতবিহ্বলতায় ডুবিয়ে দিয়ে ইজহান আবারও কাতর গলায় বলল তাকে, “ইস্মিতার ইজহান শেখ আজ একটুখানি, শুধুমাত্র একটুখানি উপলব্ধি করতে পেরেছে সে এখনো অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর হয়ে যায়নি। কিছুটা মনুষ্যত্ব এখনও তার ভেতর বেঁচে আছে! সেই মনুষ্যত্বের জোরেই বলছি, ইস্মিতা আর্শি তুমি কি এই অধম, কুলাঙ্গারকে কখনো মাফ করবে? যে তোমার প্রথম সন্তানকে তোমার কোলে আসতে দেয়নি, যে তোমাকে রানি বানিয়ে দিতে পারেনি, যে তোমাকে শূন্য করে রেখেছিল বহু দিন, মাস, বছর?”

সেই ছোট্ট প্রাণের কথা মনে করে ইস্মি কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ইজহানের রক্তিম মুখখানি ছুঁয়ে, কাতর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। পর মুহূর্তেই চেপে রাখা কান্না বিধ্বংসীর মতো বেরিয়ে এলো দ্বিতীয়বার। স্বামী নামক আত্মকেন্দ্রিক লোকটার বুকে মুখ ডুবিয়ে, সেখানটা ঝুম বর্ষণের মতো ভিজিয়ে দিয়ে ইস্মি যখন থামল, অস্ফুটস্বরে শুধু বলতেই পারল, “ইজহান শেখ অকৃতজ্ঞ, কুলাঙ্গার না। সে আমার দুটো সন্তানের বাবা! যাকে ইস্মিতা আর্শি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে, অনেকটা বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। এই লোকটার একটু ভাগও সে অন্য কাউকে দিতে রাজি নয়, তার মেয়েকেও নয়। এই লোকটার পুরোটা ভাগ ইস্মিতা আর্শির নিজেরই লাগবে।”

এমন একটা মুহূর্তে এসে, ক্রন্দনরত বউয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে, হেসে ফেলল ইজহান। নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল, “আর এই পাষণ্ডী মহিলাকেও আমার লাগবে, যে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন-রাত বলবে, ‘পাশে আছি,’ ‘ভালোবাসি।’ এই নির্দয় মহিলাকেই আমাকে আমার মেয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে হবে, দেখভাল করতে হবে, রান্না করে খাওয়াতে হবে আমাকে, আমার মা—কেও।
এই হিংসুটে ইস্মিতা আর্শিকেই আমার চাই ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘস্থায়ী দুটো জীবনেই।”

অশ্রুভেজা চোখে এবার ইস্মি নিজে হেসে ফেলল! মনোমুগ্ধকর চোখে স্বামীকে দেখতে দেখতে, নরম গলায় বলল, “আপনি বলছেন, ভালোবাসতে হবে। অথচ আমি ভালোবাসি আপনাকে। যতটুকু পেরেছি, নিজেকে হারিয়ে, আপনার অন্ধকারে আলোর মতো থেকেছি। বাকিটা জীবনও আপনার হয়ে থাকতে চাই পূর্ণ, অপূর্ণ হয়েও৷ শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতে যে আমি একা নই, অবাঞ্ছিত নই। আমাকে ভালোবাসার জন্য একটা মহাপাগল ইজহান শেখ আছে! তার জন্য আমি বারবার সব ছেড়ে আসব৷ শুধু একবার
বলুক সে, ‘থেকো, চিরকাল!’

‘থেকো, চিরকাল!’

স্বগোতক্তি করে ইজহান যত্ন নিয়ে শক্ত একটা চুমু বসাল তার ইস্মিতার কপালে। ঠোঁটের ছোঁয়ায় বিষাদ কেটে, দু’জনের মাঝেই আস্তেধীরে জন্ম নিচ্ছিল একদলা সুখানুভূতি। বিশাল একটা কালো মেঘের বাহন আকাশ পাড়ি দিয়ে, গোলাকার চাঁদের জোৎস্না ছড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত স্থায়ী রইল মুহূর্তটুকু!

°

বাংলা ক্যালেন্ডার বলছে আজ আষাঢ় মাসের এক তারিখ। মানে আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। এখন রাত। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময় ঠিক সাড়ে এগারোটা। অথচ রাত্রির অন্ধকারেও আকাশ জুড়ে এক নদী বিষণ্ণতা। বৃষ্টি নেই তবে শীতল হাওয়ায় চারিপাশ উত্তাল। কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকেই আকাশে একটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে, দ্যুতি ছড়াচ্ছে শেখ বাড়ির বিশাল ছাদটায়। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে পুকুর পাড়ের ঝোপ থেকে। নীতিনের কেনা সস্তার সিগারেটে ঠোঁটের ভাঁজে ফেলে একহাতে স্কচের গ্লাস নিয়ে ছাদের রেলিঙয়ে শুয়ে আছে আরসালান ইনজান শেখ। তার শুকনো জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি কামিনী ঝাড়ের নিচে উঁচু ঢিবির মতোন জায়গাটায়। যেখানটাতে তাকাতেও তার বিরক্তি, অথচ তার ক্ষোভ যার উপর সেই নারীটিই চিরনিদ্রায় শায়িত ওখানে। অনেক বছর আগের পুরোনো কথার ঝুলি খুলে বসেছে আরসালান অথচ সেসবের শ্রোতা এই বিশাল আকাশটা ছাড়া আর কেউ না। কথা শোনার মতো কেউ নেই, রাগ বোঝার মতো কেউ নেই এটা বুঝতেই আরসালনের আরো রাগ হয়, শরীর বয়ে চলা রক্ত জমাট হয় তবুও ভেতরের দহনটা একটুর জন্যও নিভে না। বিড়বিড় করে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে সে বলে, “তোমার জন্য এসেছি আমি, তোমার জন্য! তুমি ছাড়া আর কোনো কারণ নেই আমার এ বাড়িতে আসার…কোনো কারণ নেই। অথচ তুমিই চুপ করে আছ, আমার কথা শুনছ না? তুমি ইহসান শেখের মাম্মাম…তাহলে আমাকে জন্ম দিয়েছিলে কেন? হ্যাঁ?”

হাওয়ায় দুলতে থাকা কামিনী ঝাড় থেকে কয়েকটা সুগন্ধিশুভ্র ফুল ঝড়ে পারে ভেজা মাটিতে। অথচ
জবাব দেয় না মাটির নিচে শায়িত মানবীটি।আরসালান বিরক্তি নিয়ে তা দেখে। চোখ ফেরায়, তাকায় আকাশে। আশ্চর্য! সেখানেও মেঘ-চাঁদের সুখ দেখতে হচ্ছে! চারিদিকে সবার এতো সুখ তাকেই কেন দেখতে হচ্ছে? চাঁদ-তারার সুখ, প্রকৃতির সুখ, তার বাবার সুখ, ভাইদের সুখ অথচ তার জীবনে কোনো সুখ নেই। ইহসান শেখ বলে, তার না কি সে যোগ্যতাই নেই। কী করলে সে যোগ্যতা হবে ভেবেছে সে, ভেবে কিছু পায়নি। নিভু নিভু ধূমায়িত শলাকায় শেষ টান দিয়ে আরসালান চোখ বুঁজে। গহীন রাতের আঁধার আর নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে নীতিনের শোনা একটা গান মনে পড়ে তার,
আড়ালে আড়ালে
কোথায় হারালে?
ফিরে তুমি আর আসবে না বুঝি?
কতরাত কেটে গেছে আঁধারে
নেইতো ভোরের দেখা
বোঝাব কীভাবে?
কত ঘুম মিশে গেছে অজানায়
জানে শুধু দু চোখ,
ভুল সে স্বভাবে!

ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে ভাইকে গুণগুণ করে গান গাইতে শুনে ইহসান। গান শেষ হতেই গলা খাকারি দিয়ে আরসালানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রেলিঙয়ে শোয়ারত অবস্থায়ই ফিরে তাকায় আরসালান। ভাইকে দেখে বিস্মিত হবার ভান করে। রাত নামা বাতাসে ছুঁয়ে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো উড়ছে ইহসানের। চোখমুখ রক্তাভ, রাগের চোটে নাক কাঁপছে। দীর্ঘক্ষণের নিশ্চুপতায় ইতি টেনে ক্রোধ নিয়ে জিজ্ঞেস করে “আমার ক্ষতি কর‍তে আবার চলে এসেছিস?”

আকাঙ্খিত ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে আরসালান
উঠে বসে এবার। গম্ভীরমুখে বলে, “তুমি তো দাওনি, তবে লাভলি ফাদার তোমার বাচ্চাদের আকিকার দাওয়াত ঠিকই দিলো, যে করেই হোক আসতেই বলল। তার না কি সাধ জেগেছে সন্তানদের একসাথে দেখে চোখ জুড়ানোর। আমিও ভাবলাম, কতদিন আর এদিকওদিক ঘুরব, নিজের বাড়ি থাকতে? তোমাকে জ্বালাতেও পারছি না বহুদিন, উলটো নিজেই জ্বলছি তোমাদের সেদিনের কিসিং মোমেন্ট দেখে, তাই ভাবলাম চলেই আসি…”

তেড়ে এসে ওকে চেপে ধরে ইহসান। অতিষ্ঠ কণ্ঠে বলে, “আরেহ শশশালা, তুই চাইছিস টা কী? আমাকে মারবি?
তো মেরে ফেল। নিস্তার দে আমাকে।”
আরসালান নিশ্চুপ তাকিয়ে। ইহসান ফের বলে, “এই তোকে না আমি গু লি করেছি, এরপরও ভয়ডর করে না তোর আমাকে? জান দিবি তবুও আমাকে কেয়ার করবি না, এরকম টাইপ?”

“জিনিস দিচ্ছ না তো, দিলে…ভয় করব তোমাকে।”

ইহসান কথাটা বুঝে নেয় তবে ইঙ্গিতটা ধরে না। উল্টো ওকে ছেড়ে দিয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “আয় তোকে বিয়ে করিয়ে দিই, আমাকে ভয় না পেলেও বউকে ঠিকই ভয় পাবি। আফটার অল ম্যারেজে তোর এলার্জি!”

একটু থেমে ভাবুক হয় ইহসান৷ আরসালানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলে, “আচ্ছা তুই তো হাইপার সে* ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত তোর বাপের মতো। তো আজকাল কি সেটা কমে গেছে? মেইন সিস্টেমে সমস্যা? কাজ করে না? না কি এতটাই ওভার হয়ে গেছে যে শুধু অন্যের জিনিসপত্রের দিকে হাত বাড়াস, কেড়ে নিতে চাস! এত চুলকানি তোর? আমাকে বল! তোকে ভালো ডাক্তার দেখাব। জিজ্ঞেস করব কেন তোর চরিত্র এতোটা নিচু! তোর বাপ নষ্টামি করেও তো বিয়ে করেছে, দু-দুটো করেছে। তাহলে তুই কেন এমন! জানতে হবে আমাকে। আচ্ছা সব কথা ঠিক তো, না কি তোর সব ফাপড়? কোনো মেয়েই তোর মতো বিকৃত মানুষকে সহ্য করে না? লাত্থিঝাটা দেয়? আর অপমান লুকাতে, নিজেকে মহাপুরুষ প্রমাণ করতে তুই ভুগিচুগি বোঝাস আমাদের, কোনটা?”

পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় চোখদুটো রাগে কাঁপতে লাগল আরসালানের। ঘাড় বাঁকা করে ইহসানকে বলল সে, “আসো প্রুফ দেই।”

চোয়াল বরাবর ঘুষি বসাতে গিয়েও নিজেকে আটকে ফেলে ইহসান। এই নির্লজ্জ, নষ্টকে মেরে সে শুধু শক্তিই খরচ করছে। এই সাইকো ঠিক হয়নি। ঠোঁট ভিজিয়ে রাগ সংবরণ করে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে, “নট ইন্টারেস্টেড!”

“নট ইন্টারেস্টেড বলেই বাচ্চা এনে ফেললে দুটো? স্ট্রেঞ্জ! মনে হচ্ছে না ভুল করেছ?”

“আমি ওদের বাপ। ঠিক করেছি না ভুল করেছি আমি বুঝব। তুই চাচা হোস ওদের, যদিও নষ্ট মনের। তবুও আমি আমার বাপ-মা দুটোকে বলে দেব চাচা ডেকে তোর কষ্ট যেন একটু হলেও কমিয়ে দেয়…আফটার অল নিজের বলতে কেউ নেই তোর। না একটা বউ, না বাচ্চাকাচ্চা…”

“উপহাস করছ?”

“ফ্যাক্ট বলছি।”

“অহংকার করছ, তোমার সব আছে বলে?”

কঠিন গলায় বলে ইহসান, “আমার কাছে সব নেই, বউ-বাচ্চা ছাড়া।”

অ্যালকোহল পান করার কারণে বেশ চড়ে গিয়েছে ততক্ষণে নেশাটা। কথাবার্তা এলোমেলো হচ্ছে টের পেলেও ইহসানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছিল আরসালান। বুকে কাঁটার মতো বিঁধে তাকে নিয়ন্ত্রণহারা করে তুলছিল ক্রমশই। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাতের গ্লাসটা মুঠোয় চেপে ধরতেই ভাঙল সেটা, কাচ ঢুকে কাটল হাতটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। ফ্যাসফেসে, ধারাল কণ্ঠে বলল সে, “আমারও তো কেউ নেই। আমার বুঝি নিজের কেউ লাগে না? তোমরা সবাই এতো স্বার্থপর কেন? নিজেদের কথাই ভাবো শুধু! তোমার ঐ পাগল মায়ের মতো! তোমাদের মতো সেও স্বার্থপর! না, সে আরো বেশি স্বার্থপর! তার গর্ভে জন্ম নিয়ে একটা জীবন আমার ভালোবাসাহীন কাটছে, লোকের বাঁকাত্যাড়া কথা হজম করে কাটছে। আর এখন তোমরা একেক ভাই নিজেদের আলাদা পরিবার গঠন করে আমাকে লাত্থি মেরে জীবন থেকে বের করে দিচ্ছ, যেন আমি কেউ না তোমাদের! আর তুমি? তুমি তো বারবার আমাকে কাঙাল প্রমাণ করছ! তোমার ঐ মা—টা? যাকে ভিক্টিম মনে করো তুমি, স্বার্থপর মহিলাকে মাফ করব না আমি। নিজে বেঁচে গেছে, তার ছোটো ছেলের জীবন ধ্বংস করে, একদিন সব ক’টাকে আমি কাঙাল করে দেব আমার জীবন হেলাফেলা করে নষ্ট করে দেওয়ার কারণে…”

হাতে কাচ বিঁধেছে, কেটে রক্ত অঝোরে রক্ত ঝরছে! অথচ আরসালানের সেদিকে বিকার নেই। ক্ষোভ আর ক্রোধে সে ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে নিজের মেজাজের উপর। ইহসানের মাথার ভেতরটা এলোমেলো লাগে ভাইয়ের কথাগুলো শুনে। শার্টের কলার ধরে সে দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় চিৎকার করে, “এতো পাগলামো কেন করছিস জান? কীসের এতো ক্ষোভ তোর আমার উপর? তুই তো ভালোবাসা বুঝিস না, সৃজাকে ভালোবাসিস না। তাহলে কেন এই হঠকারীতা করছিস আমার সঙ্গে? তোর জন্য প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকতে হয়! কখন, কী করে বসিস এই টেনশনে আমি আজকাল নিজের উপর এতটাই উদাসীন আর ডিজাপয়েন্টেড যে ঠিক যে কারো সঙ্গে দুটো কথা বলব, ভেবে সিদ্ধান্ত নেব সেইটাই পারছি না। আমি আমার নিজেকেই হারিয়ে ফেলছি তোর পিছনে কুত্তার মতো ছুটতে ছুটতে। ছোটোবেলা থেকে তুই আমার পেছনে লেগে আছিস, আর কত সইব আমি? একটু বলবি আমায়, কবে নিস্তার দিবি? কতোবার মারতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম, মারতে পারলাম না৷ তোর শাস্তিই নয় ওটা। আমি কী করি বলতো? একদিকে ভ্রাতৃত্বের টানে তোকে মারতে গেলে হাত কাঁপে, বুক কাঁপে অন্যদিকে তোর কার্যকলাপ মনে এলে ইচ্ছে করে কু পি য়ে ফালাফালা করি তোকে। আমি কী করি তুই বলে দে আমায়…নয়তো আমাকে মেরে এরপর তুই তোর জীবন সাজা, তোর মনমতো। যে জীবনে আমি নেই, যে জীবনে আমার সৃজাকে তুই নিস্তার দিবি…”

আরসালান ইনজান শেখ তাকিয়ে থাকে তার ভাইয়ের দিকে জ্বলজ্বলে নেত্রে। বুকের ভেতর দহন শুরু হয়, মস্তিষ্ক ঘট পাকায় তার মাথার ভেতর। নিতে পারে না সে ভাইয়ের কথাগুলো। রাগে-জেদে মিলেমিশে এক সমুদ্রে পতিত হয় তার। অথচ চোখদুটো বুজে ভাইকে সে আচমকা জড়িয়ে ধরে। ইহসান অবাকও হয় না, আঁকড়েও ধরে না ওকে। বরংচ মেঘ স্বরে বলে, “ছাড় আমাকে! তোর মতো খু নী আমাকে ছুঁলে আমার গা ঘিনঘিন করে, বমি পায়। মনে হয় মরে যাই…”

“কিন্তু আমি তোমাকে মরতে দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি আমাকে সুখী দেখো আর আফসোস করো।”

“কাউকে সুখী দেখলে আমার আফসোস হয় না, আমি খুশি হোই। দোয়া দেই আরো সুখী থাকার জন্য।”

ক্ষোভ আর অট্টহাস্যে ভরা কণ্ঠে বলল আরসালান, “তুমি সবসময় চেষ্টা করো আমাকে কষ্ট দেওয়ার, কষ্টে দেখার, অথচ আমি তেমন থাকি না। খুব আমুদে থাকি, ফূর্তি করি, নিজেকে নিজে ভালো রাখি। তোমার একটুও লোভ হয় না আমার লাইফ স্টাইলের প্রতি?”

ইহসান এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। পরক্ষণেই শক্ত গলায় জবাব দিলো, “তোর কোনোকিছুর প্রতিই আমার লোভ লাগে না। ভালো, খারাপ কোনোটাতেই না। ইনফ্যাক্ট, আমি কিছু অনুভবই করি না তোর প্রতি। আর তুই যে বলছিস তুই এসব করে নিজেকে নিজে ভালো রাখিস, আসলেই কি তুই ভালো থাকিস?”

আরসালান ভালো থাকে না, আসলেই সে ভালো থাকে না। অথচ সে ভালো থাকার ভান করে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের সামনে। এই অকাট্য সত্যি কথাটা শুনলে তার বড়ো ভাই তাকে নিয়ে অট্টহাসি হাসবে, তাচ্ছিল্যভরে তাকাবে৷ যেটা সে আসলেই সহ্য করতে পারবে না। সে আচমকাই শান্ত হয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘আমি ভালো থাকি, এসব করেই আমি ভালো থাকি।’
অথচ সে বলতে পারল না। তার আগেই ছাদের দরজায় একটা মেয়েলি অবয়বে চোখ আটকে গেল তার। একদম চুপ করে গেল সে।

“ভাইয়া আছ এখানে? আপু ডাকছে তোমায়!”

অন্ধকার সিঁড়িঘর থেকে রিনরিনে অথচ শক্ত একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বরে কিছুটা চমকে উঠল ইহসান। ঘাড় ফিরিয়ে ছাদের দরজার দিকে তাকাল সে। দরজাটা খোলাই ছিল, শীতল বাতাসে বারি খাচ্ছিল বারবার। এলিজা সেটা দু’হাতে ঠেলে রেখেছে, চোখমুখে তার অপ্রস্তুত ভাব। ইহসান ছেড়ে দিলো আরসালানকে। কলার থেকে সন্তপর্ণে নামিয়ে আনলো নিজের হাতটা। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখের ভাষায় ভাইকে শাসিয়ে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল এলিজার দিকে। টুকটাক দু-একটা কথা বলল, এরপর এলিজাকে নিয়েই নেমে গেল। অথচ আরসালান ইনজান শেখ সচকিত চোখে লক্ষ্য করল, লাল জামা পরণে মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তখনকার সেই মেয়েটাই এটা। সিঁড়ির একেকটা ধাপ পেরুতে পেরুতে মোট তিনবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে এবার মেয়েটা। একবার তার মুখের দিকে, আর দু’বার তার কাটা হাতের দিকে। যেখান থেকে অঝোরে র ক্ত ঝরছে!

°

আষাঢ়স্য দ্বিতীয় দিবস। গাঢ় কালো মেঘমল্লারে ডুবে আছে আকাশ। বৃষ্টিময় দিন। ভোর থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। চারপাশের রুক্ষ গাছপালা সজীব হয়ে প্রশান্তি ছড়াচ্ছে প্রকৃতিতে। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তবে বাজ পড়ছে না। ঝাপসা কাচের জানালা গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা। উদাসীন নয়নে ভিজতে থাকা প্রকৃতি দেখায় মগ্ন ইস্মিতা আর্শিকে চেক আপ শেষে ডাক্তার জানাল, সবকিছু ঠিক আছে। কোনো অতিরঞ্জিত সমস্যা নেই। মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরা যাবে আজই। বাড়ি যাবার খবরটা শুনে ইস্মির সঙ্গে সঙ্গে ইজহানও সুস্থির হলো। হাসপাতাল তার বড্ড অপছন্দের জায়গা, কেমন রুগ্ন রুগ্ন লাগে সুস্থ মানুষকেও। বাড়ি ফিরতে পারলেই সে সবচেয়ে খুশি। আযরান-আজওয়াকে কখন তার মা’কে দেখাবে এই নিয়েও ভীষণ উত্তেজিত সে। আকাশ আর মিজুর সঙ্গে হস্পিটালের বিল বিষয়ক যাবতীয় ফর্মালিটির বিষয়ে কথা বলতে সে বাইরে গেল। আলাপচারিতা শেষে কেবিনে ফিরে বসামাত্রই দরজা ঠেলে একজন নার্স ঢুকল। জানাল, ঘুম ভাঙার পর থেকে ইস্মিতা আর্শির মেয়েশিশুটি খুব জোর কাঁদছে; তাকে এখন খাওয়ানোর সময়! মা যেন প্রস্তুতি নিয়ে রাখে! নার্সের কথা কর্ণগোচর হতেই ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। গর্জে উঠে বলল, “এতটকু বাচ্চাকে এখনো কিছু খাওয়ানো হয়নি মানে? না খাইয়ে রেখেছেন ওকে? আশ্চর্য! আপনাদের খাম-খেয়ালিপনার জন্য আমার মেয়ের কিছু হলে আমি থানায় কমপ্লেইন জানাব আপনাদের নামে।”

নার্সকে যথেষ্ট বিরক্ত দেখাল, “আপনার বেবি তো রাত ধরে ফর্মুলা খাচ্ছে, কিন্তু ম্যাম বলে দিয়েছেন ওকে যাতে মায়ের দুধ দেওয়া হয়! আপনি থানায় কমপ্লেইন দিলে তার কোনো ভিত্তিই থাকবে না স্যার!”

ঝাঁঝিয়ে উঠা ইজহানের মাথায় প্রথমে খেলল না কথাটা! ইস্মির দিকে তাকাতেই মেয়েটা যখন অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো, সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল বউয়ের দিকে। ইস্মির মনে হলো কোনো গর্তে লুকিয়ে পড়তে! রাতে কয়েকবার ফিডিং করানোর চেষ্টা করেছিল সে মেয়েকে, কিন্তু কাজে দেয়নি। বাধ্য হয়ে ফর্মুলা খাইয়েছে ডাক্তারের পরামর্শে। সারারাত নার্সদের কাছে ছিল বলে তারাই সব করেছে। কিন্তু মায়ের দুধের গুরুত্ব বেশি বলে, বারবার চেষ্টা করতে বলেছে ডাক্তার। ঔষধও দিয়েছে তেমন। সবটাই সে করেছে ইজহানের আড়ালে বা অনুপস্থিতিতে। লোকটার বেফাঁস মন্তব্য বা কান্ডে লজ্জা পাবে বলে বিষয়টা জানতেই দেয়নি ওকে ইস্মি। সে সময়টুকুতে নানান বাহানায় ওকে কক্ষের বাইরে এই-সেই কাজে পাঠিয়ে দিতো বলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন? কী বলে লোকটার থেকে নিজের লজ্জা লুকোবে সে?

ইজহান অবশ্য কিছুই বলল না। বুকের ভেতর হার্টবিট জোরাল হলেও আগ্রহ নিয়ে বসে রইল। তোয়ালেতে মুড়িয়ে পুনম যখন ইজহানের বহু আকাঙ্খিত মাকে নিয়ে কক্ষে এলো, ইজহান এক সমুদ্র আবেগ আর নরম দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখল। লাল দুটো ঠোঁটে ক্ষিধের যন্ত্রণা নিয়ে অসহায়ের মতোন কান্না করা শিশুটির একেকটা চিৎকার সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারল না। ইজহান শেখের মেয়ে সে; ও কেন এতো কান্নাকাটি করবে? বাবা-মায়ের প্রাণভোমরা সে; এতো কেন অসহায় দেখাবে তাকে? বাবা হয়ে মেয়ের আর্ত সুর সহ্য করতে পারল না ইজহান মোটেও। চট করে পুনমের কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে অসংখ্য চুমুর সাগরে ভাসিয়ে দিতেই সে টের পেল, ষোলো ঘন্টা আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া তার শত্রু ওরফে মা—তার দিকে এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে! কী যে হলো! লজ্জায় চোখমুখ আবারও লাল হয়ে গেল ইজহানের; ইস্মির দিকে মেয়েকে বাড়িয়ে দিয়ে কাঠ কাঠ স্বরে বলল, “ও এভাবে তাকায় কেন? ওকে এভাবে তাকাতে মানা করো!”

পৃথিবীর সব সুখ নিয়ে এতোক্ষণ বাবা-মেয়েকে দেখছিল ইস্মিতা। স্বামীর কথায় এবারে তার ঘোর ভাঙল, হাসিও পেল খুব। কিন্তু স্বামীর আদেশ মেনে নিয়ে আদর আদর স্বরে মেয়েকে বলল সে, “মা, এভাবে তাকায় না। বাবা হয় তোমার। বাবার দিকে এভাবে তাকালে তোমার বাবা লজ্জা পাচ্ছে!”

একবার, দুবার, তিনবার… বলা হলো। কিন্তু ঘন্টাখানিক বয়সের মেয়েশিশুটি, যার চোখদুটোতে বাবাকে দেখার বিস্ময়; সে মোটেও ইজহান পত্নীর কথা শুনল না, মাকে বিরক্তি দেখিয়ে বাবার দিকে তাকিয়েই রইল। পুনম তা দেখে হাসতে হাসতে বলল, “এই আদরটা বাবা পাগল হবে দেখো ভাবি, বাবার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। তোমাকে যেমন ভাইয়া ঘুরাতো, ঠিক তেমনি…”

বোনের কথা শুনে ইজহান একটা ধমক দিতেই যাচ্ছিল কিন্তু মেয়ে ভয় পেতে পারে সালেহা বেগমের থেকে এমন সতর্কবাতা পেয়ে সে নিভে গেল। ছোট করে পুনমকে বলল, “তুই কি ভবিষ্যত বিশারদ? কীভাবে জানিস এতো কিছু?”

“এরজন্য ভবিষ্যত বিশারদ হবার কী আছে? সিক্স সেন্থ বলে একটা ব্যপার আছে! তুমি কোলে নিতেই মেয়ে কেমন চুপ মেরে গেল দেখেছ?”

মনের বাগানে হাজারো প্রজাপতি ডানা মেলল ইজহানের। পেটের ভেতর গুঁড়গুঁড় করল, তার শব্দও হলো। সবকিছু কেমন হালকা লাগল। তোয়ালের ভেতরে হাত-পা নেড়ে অদৃশ্যভাবে তার সব আকর্ষণ কেড়ে নেওয়া মেয়েকে তার কাছে সদ্য ফোটা ফুল মনে হলো। মনে হলো মেয়ের চোখ
তার ভেতরের আগুনকে ঝুম বর্ষার পানি দ্বারা নিভিয়ে দিচ্ছে! ইজহান ইস্মিতাকে কেমন উদাসীন গলায় বলল, “ওকে এভাবে তাকাতে বারণ করো, বারণ করো!”

ইস্মি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো হেসে বলল, “কিন্তু ও আমার কথা শুনবে না।”

বিস্ময় নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল ইজহান, “কেন?”

স্বামীর গালে হাত রেখে ভীষণ মায়া মায়া কণ্ঠে ইস্মি বলল ওকে, “ও আপনার মা। আর মা কখনো তার ছেলের থেকে দৃষ্টি ফেরায় না। আপনার মেয়েও ফেরাবে না। সে আমি যতোই বলি!”

বুকের ভেতর লক্ষ তারাবাজির বিস্ফোরণ, আর মহাকাশের সব নক্ষত্রের আলো ইজহান শেখের পৃথিবীটাকে অন্য এক রঙিন দুনিয়ায় স্বাগত জানাল। জন্মদাতা মাও কখনো তার দিকে ভালো করে তাকায়নি, ভালোবাসা নিয়ে এক পলক দেখেনি—সীমাহীন আফসোসে আর দংশনে এতোকাল যে বুকটা চৈত্রের রোদে পুড়ে খাঁক হতো, সেই বুকটা সাইবেরিয়ার সবচেয়ে শীতলতম স্থানের চেয়েও শীতল ঠেকল ইজহানের। মেয়েকে সে বুকে চেপে ধরল, আলতো অথচ শক্তভাবে। মেয়েও বাবার
সাদা টি-শার্টের বুকের অংশটুকু এমনভাবে চেপে ধরল, তফাতে বসে থাকা সালেহা বেগম চোখভরা জল শাড়ির কোণে মুছে নিয়ে বলে ফেললেন, “মা পাইছ তো বাপজান? একদম মনমতো?”

ইজহান অস্ফুটস্বরে জবাবে বলল, “পেয়েছি!”

সালেহা বেগম পুত্রের পানে চেয়েছিলেন আকুতিভরা চোখে। পেটে না ধরেও এদের চার ভাইকে সে ছেলে মানে, পুনমের চেয়ে কোনো অংশে কম ভাবেন না তাদের নিয়ে। অথচ কোনো কালেই তাদের মা হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। অপরিচিত, অনাকাঙ্খিত একজনের সঙ্গে মানুষ যেমন আচরণ করে ঠিক তেমনই আচরণ পেতেন ওদের থেকে। ছোটো পুত্রকে তো নিজের হাতে তুলে ভাত পর্যন্ত খাইয়ে দিয়েছেন কতকাল; সেও দেয়নি মায়ের জায়গা। সালেহা বেগমের বুকের ভেতরটা হু হু করে, তবুও পুত্রদের সুখ দেখে তিনি খুশি হোন। তার স্বস্তির জায়গা এটাই যে, ছেলেগুলো একটা জালিম বাপের রক্ত নিয়ে পৃথিবীতে এসেও জালিম বাপের মতো পুরোপুরি হয়ে যায়নি, একটু-আধটু মানুষও হয়েছে! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিঁড়ে, ম্লান হাসি দেখা যায় ঠোঁটের কোণে। ইস্মি টের পায় তা, পুনমও। তাদের চোখের সান্ত্বনার চাহনি সালেহা বেগমকে বুঝ দেয়, যতোই ভাইয়েরা স্বীকৃতি না দেক, তিনি মা-ই হোন আজিজ পুত্রদের!

কক্ষটাতে নির্জনতা জেঁকে ধরেছিল কয়েকটা মুহূর্ত, কেটে গেল সেটা ইজহান কন্যার ক্ষুর্ধাত কান্নার জোরে। উচাটন হয়ে ইজহান মেয়েকে তুলে দেয় ইস্মির কোলে। আগ্রহভরা স্বরে বলে, “ওর ক্ষিধে পেয়েছে, খাওয়াও ওকে।”

বলে বেশ আগ্রহ চিত্তে বসল ইজহান। যার মানে সে এখানেই আছে এবং বসে বসে মেয়ের খাওয়া দেখবে। স্বামী হলেও তার দিকে বিস্ফোরিত আর অসহায় নেত্রে তাকাল ইস্মি। সালেহা বেগমও লজ্জায় পড়ে মুখে আঁচল টানেন। পুনম অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতে বলল, “বাইরে যাও ভাইয়া, বেবি খাবে। তোমার এখানে কোনো কাজ নেই।”

ভ্রু কুঁচকে ফেলল ইজহান, “তার মানে আমার চেয়েও বেশি কাজ তোদের? বাপের চেয়েও ফুফু বেশি দরকারি?”

“এক্ষেত্রে অবশ্যই।”

“কেন?”

“ভাবিকে হেল্প করতে হবে, যেটা তুমি পারবে না। তাছাড়া ভাবিও লজ্জা পাবে। তুমি প্লিজ যাও…”

ইজহান সন্দেহ নিয়ে তাকাল, “আমাকে বের করে আমার মেয়ের খাবারে নজর দেওয়ার ধান্ধা! তোরা বেরু…”

কান গরম হয়ে উঠে ইস্মির। পুনম মেজাজ খারাপ করে ফেলে, “ভাইয়া তুমি খুব নির্লজ্জ!”

ক্ষ্যাপাটে কণ্ঠে বোনকে ধমক দিলো ইজহান, “মেয়ের খাওয়া দেখলে কেউ নির্লজ্জ হয়ে যায় না। এটুকুও জানিস না অথচ শারাফের মা হয়ে গেলি তুই? আশ্চর্য! না, আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব আর মেয়ের খাওয়াও দেখব…”

“কী দিনকাল আইলো গো আল্লাহ! ছি ছি…”

বিড়বিড় করে বলল সালেহা বেগম। মুখে তার আঁচল চাপা। অথচ ইজহান স্পষ্ট শুনে ফেলল তা। কপালে ভাঁজ ফেলে একটু শক্ত গলায়ই বলল সে, “আপনি এরকম করছেন কেন? মেয়েকে সামলাতে পারেন না আবার ছি ছি হচ্ছে?”

বলে বিরক্ত চোখে ইস্মিতার দিকে তাকাল সে, স্বামীর বেলাজ আচরণে ইস্মিও হতাশ। লজ্জা বিসর্জন দিয়ে না হয় আধপাগল লোকটাকে ম্যানেজ করে মেয়েকে ফিডিং করাতো সে, কিন্তু নার্স, শ্বাশুড়ি, ননদ তো আছে! এরা তো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে। ইস্মি তাই শক্ত করেই বলল, “বাইরে যান।”

ইজহান শক্ত হয়ে বসে রইল, দৃঢ় স্বরে বলল,
“যাব না, এখানেই থাকব।”

ক্ষিধের জ্বালায় মেয়ে কাঁদছে এদিকে লোকটা মেয়েদের মতো ঝগড়া আর জেদ করছে! ইস্মি না পেরে রুষ্ট গলায় ধমকে উঠল ইজহানকে, “আশ্চর্য! আপনি অবুঝ শিশু? দামড়া একটা লোক অথচ বাচ্চাদের মতো বিহেভ! যান বাইরে… ”

দামড়া, ইজহান শেখ দামড়া?

°

________

চলবে…