অশ্রুবন্দী পর্ব-৬৬+৬৭+৬৮

0
2

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ৬৬

আষাঢ়স্য দ্বিতীয় দিবসের সূচনা। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে সকালটা ভিজলেও দুপুরের পর মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছিল। খরতৌপ্ত রোদ্দুর তেজ ছড়িয়ে নিজের ক্ষীপ্রতা জানান দিচ্ছিল পৃথিবীকে। এই মেঘ, এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুর…ক্ষণে ক্ষণে রুপ পাল্টানো প্রকৃতি অবশ্য সেজেছেও বেশ! গাছের পাতা পানিতে ধুয়ে যেমন সজীব হয়ে উঠেছে, তেমনি ফুলে ফুলে ভরেও উঠেছে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে বর্ষণমুখর দিনের মিষ্টি ফুলের সুগন্ধ! ছেলে-মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সদ্য একটু অবসর পাওয়া
সৃজা বোনকে নিয়ে বসেছে প্রকৃতির রুপসুধা উপভোগ করতে। বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে, সাদা কভারে মোড়ানো বালিশে মাথা রেখে পাশাপাশি শুয়ে আছে দুই বোন। শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে তাদের বড়ো বারান্দাটা, যেটা এলিজার শখের ফুলগাছ দিয়ে ভর্তি; প্রতি বর্ষায় ওখানে শীতলপাটি বিছিয়ে দুই বোন দুপুর বিলাসে মগ্ন হতো! শুয়ে-বসে, বই পড়ে, বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মেখে তারা ডুবে যেতো ছোটোবেলায়। যে দিনগুলোতে তাদের সঙ্গে মা ছিল, সুস্থ একটা বাবা ছিল! যেখানে চারটি মানুষের ভরপুর সুখে ভরা একটা সংসার ছিল! মায়ের সঙ্গে সৃজার স্মৃতি যেহেতু বেশি সেজন্য বেশিরভাগ গল্পই সে বলতো মা’কে নিয়ে। বোনের কোলে মাথা রেখে এলিজা বুকের ভেতর ভার জমাতো। এক পৃথিবী দুঃখ আড়াল করতো। অথচ মাকে নিয়ে কারো কাছে বলার মতো অতো বেশি গল্প থাকতো না তার। এলিজার সব গল্প ছিল তার বাবা আর বোনকে নিয়ে, ফুপিকে নিয়ে। তবে আজ সেসব কিছু হচ্ছে না। দুই বোন পাশাপাশি, চুপচাপ শুয়ে আছে। সৃজার একটা হাত এলিজার চুলের ভাঁজে। বোনের এই রেশমের মতো কোমল চুলগুলো তার খুব পছন্দের। যখন চুলের ভাঁজে হাত রাখে, সৃজার মনে হয় তার মা-ই তার পাশে আছে। এলিজা সবসময় ওকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয় বলে সৃজার কাছে এলিজা সবসময়ই আলাদা একটা স্নেহ পেয়ে থাকে। শেখ বাড়িতে এলিজা প্রথমবারের মতো এসেছে। কিন্তু গতদিনটা আকিকার ব্যস্ততা এবং আচানক সব ঘটনার মধ্য দিয়ে এমন কেটেছে যে, বোনের সঙ্গে গল্প করার জন্য ফুরসত খুব একটা পায়নি সৃজা। বোনটা আবার না তার নিঃসঙ্গ অনুভব করে! এমনিতে মেয়েটা খুব কম প্রকাশ করতে চায় নিজেকে। সৃজা খেয়াল করল, এলিজা খুব মনোযোগ দিয়ে তেজ নিয়ে উঁকি দেওয়া সূর্যকে কালো মেঘগুলো কীভাবে বারবার ঢেকে ফেলার চেষ্টা করছে তা অবলোকন করছে। বোনের দিকে এককাত হয়ে শুয়ে সৃজা ধীর স্বরে বলে, “এলিজ,
কী দেখছিস? আকাশ?”

“হুঁ, দেখো কালো মেঘটা বারবার কেমন সূর্যটাকে ঢেকে দিচ্ছে! একটুও আলো ছড়াতে দিচ্ছে না। আমাদের জীবনটাও এমন অদ্ভুত, তাই না? যতবার ভাবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, সব ভালো হবে তখনি একটা না একটা কালো ছায়া এসে জীবনটাকে উলটপালট করে দিয়ে যায়! কী অদ্ভুত!”

উদাসীন কণ্ঠে উত্তর আসে এলিজার নিকট থেকে। সৃজা ওর কথার মানে ধরতে না পারলেও বোঝার চেষ্টা করে ঠিক কোন কারণে এলিজ এমনকিছু উপলব্ধি করেছে, যা করার কথা নয়! কিন্তু সে যথোপযুক্ত কারণটা ধরতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এর উল্টোটাও তো হতে পারে এলিজ! যেমন আমার দুঃখ ভরা, শূন্য, কলঙ্কিত জীবনের সব কালি মুছে চাঁদ-তারা হয়ে তোর ভাইয়া, আমার বাচ্চারা এসেছে, তেমনি ভালো কিছু এসে কালো ছায়াটাকে দূরও করে দিতে পারে, তাই না?”

মেঘ-রোদের লুকোচুরি দেখায় মগ্ন এলিজা নিজের কাজটাতে ইস্তফা দিয়ে বোনের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। আগ্রহ নিয়ে শুধোয়, “এমন করে আমাদের বাবা-মায়েরা ফিরে এলেও তো পারতো আপু! আমরা একা একা বড়ো হতাম না।”

এলিজের হতাশার মমোর্থ বুঝে সৃজা কিছু বলার চেষ্টা করে তন্মধ্যেই। অথচ এলিজা মিষ্টি করে হাসে, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে সৃজার হাত চেপে ধরে বলে, “ না না, আমি দুঃখ করছি না। তবে সত্যিই যদি তাঁরা ফিরতো, আমাদের শৈশবটা কতো রঙিন হতো বলো তো! অথচ বাস্তবতা এটাই যে, আমাদের জীবনটা আর আগের মতো হবে না। না হোক, তুমি খুব সুখী থেকো আপু! আমি সত্যিই চাই ভাইয়া আর তোমার জীবনের সব দুঃখ-যাতনা, কলঙ্ক, ভুল যা কিছু আছে তা যেন ফুল হয়ে আসে তোমাদের জীবনে।”

এলিজের বয়সটা কতো? আঠারো-উনিশের মাঝামাঝি। অথচ সৃজার চোখে এই মেয়েটা এখনো সেই আট-ন’বছরের বাচ্চা মেয়ে। মাকে ছাড়া যে রাতে ঘুমাতে পারতো না, মাকে ছাড়া অন্য কারো হাতে খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না, একা একা ইউনিফর্ম পরতে পারতো না, চুল বাঁধতে পারতো না, হোমওয়ার্ক করতেও আলসেমি করতো, সেই বাচ্চা মেয়েটা মাতৃবিয়োগের পর বহুদিনের অসুস্থতা শেষে যখন সুস্থ হলো রাগ-জেদ-বায়না করা একদম ভুলে গেল মেয়েটা। নিজে নিজে ইউনিফর্ম পরতে, জুতোর ফিতে বাঁধতে, চুল বাঁধতে, হোমওয়ার্ক করতে শিখল, নিজের হাতে খেতে পর্যন্ত শিখে গেল! তবে একটা জিনিসই শিখতে পারল না, মাকে ছাড়া ঘুমানো। সৃজাকেই তাই মায়ের জায়গাটা নিতে হয়েছিল! বাবার অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে সংসার সামলাতে যেমন পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল তেমনি ছোট্ট বোনটাকেও পাখির ছানার মতোন আগলে বড়ো করেছে। সৃজা আপ্লুত চোখে মিষ্টি করে হাসে এসব ভেবে। যে দিনগুলোতে তার দুঃখগুলো সুখ হয়ে উঠতো এলিজকে দেখে, সেই মেয়েটাই আজ তাকে সুখ-দুঃখের অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কী অদ্ভুত! বোন হয়েও সৃজা মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলে, কে বড়ো? সে, না এলিজ? আশ্চর্য!

°

আরসালান ইনজান শেখের সঙ্গে যেটুকু সাক্ষাৎ হয়েছে এবং নতুন করে তার আচরণ দেখছে তাতে আজিজ পুত্রকে বড়োই অদ্ভুত মনে হয়েছে সৃজার। এতগুলো দিন পর দেশ ও পরিবারের কাছে ফেরার পর মানুষ কতো স্বস্তি পায়! ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোতেও তাদের আগ্রহ থাকে চরমে। অথচ এই যুবকের মধ্যে তিল পরিমাণ আগ্রহ দেখেনি সৃজা। লোকটার বাড়ি ফেরার আজ দ্বিতীয় দিন। গত রাতে ঘুমানোর পর সে না কি এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি।
অথচ এখন বাজছে বিকেল সাড়ে পাঁচটা; এমনকি আজ সে ঘুম থেকে উঠবে না এটাও না কি জানিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার কুকুর কেমিকেও— ডিস্টার্ব করতে বারণ করেছে। ছোটো ছেলের অসুবিধা হতে পারে, সে রেগে যেতে পারে এই ঘোষণা দিয়ে বাড়ির সবাইকে সাফসাফ সতর্ক করে দিয়েছে আজিজ শেখ, “আমার জান’রে যে বিরক্ত করব, তারে পুকুরের পানিতে ভিজাই রাখা হইবে সারারাত! এইটাও আমার কথা না, আমার পুতের কথা!”

সিঁড়ি দিয়ে উঠারত অবস্থায় বাপের সতর্কবাণী কানে এসেছে ইহসানের। বাপ-ভাইয়ের নাটকে সে রীতিমতো বিক্ষুদ্ধ, বিরক্ত। ভেতরের দুশ্চিন্তা চেপে রাখতে না পেরে একটা সময় সে সিদ্ধান্ত নিলো সৃজাকে সাবধান করা দরকার! নয়তো হারামিটা যেকানো সময় কিছু করে ওর ক্ষতি করে দেবে। গতরাতেই তো মাতলামো করে মকবুলকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, সে বেচারা এখন কোমড় নিয়ে নড়তে পর্যন্ত পারছে না। বিষয়টা জানাজানি হতে দেয়নি ইহসান, কোনোমতে কাটিয়েছে। কারণ সৃজা যদি জেনে যায় তার ভাই একজন ড্রা গ এডিক্টেড তাহলে সে খুবই ছোটো হয়ে যাবে। ইহসান নিজের ভেতর কথাগুলো সাজাল ক্রন্দনরত মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে। আজওয়া ঘুমিয়ে পড়লে ওকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ইহসান সৃজাকে নিয়ে বসল। পরপর দুটো ঢোক গিলে মুখস্তবিদ্যার মতো গড়গড় করে বলে দিলো, “সৃজা, শোন! তোর কাছে যদিও ব্যাপারটা উদ্ভট লাগবে তবুও একটা বিষয়ে তোকে আমি সতর্ক করছি! ইনজান যদিও আমার ছোটোভাই হয়, তাও ওকে আমি ঠিকমতো বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি আজ অবধি। সেই প্রেক্ষিতেই তোকে সতর্ক করছি! ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবি সবসময়। আমার ভাই বলে সামান্য ফর্মালিটিও দেখানোর দরকার নেই ওকে, যেমনটা তুই ইজহানকে দেখাস। ওকে?”

ডায়াপারগুলো গুছিয়ে রাখা অবস্থায় স্বামীর আকস্মিক কান্ডে হতবিহ্বল সৃজা এবার নড়েচড়ে বসে, প্রশ্ন চোখে তাকায়। ইহসান দেরি করে না। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলে, “আমার ভাই হলেও সে বড্ড হিংসুক প্রজাতির ছেলে। অবশ্য হিংসুক বলা যায় না ওকে, হিংস্র বলা যায়! কারণ ওর কাজগুলোই পশুদের মতো। যে নিজের প্রবৃত্তি মেটানোর জন্য অনেককিছু কর‍তে পারে। নিজের খেয়ালখুশি মতো। ওর স্বভাবে চেঞ্জ আনতে অনেক কসরত করেছি একটা সময়, কিন্তু ফলাফল বিগ জিরো! তাছাড়া
ওর সঙ্গে আমার বহু পুরোনো দ্বন্দ্ব আছে, যে দ্বন্দ্বে আমার জিনিস কেড়ে নিয়ে আমাকে ফতুর বানিয়ে ও মজা পায় কিন্তু দিন শেষে জিতি আমি। জিতেও হেরে যাওয়ার বিরোধ থেকেই হতে পারে ইনজান আমার জন্য, তোর জন্য এবং আমার বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকারক।”

সৃজা পলকহীন চেয়ে রয়। শোনে ওর কথা। তীক্ষ্ণ চোখদুটোতে অতি সহজেই ধরা পড়ে ভাইয়ের প্রতি ইহসানের রুষ্টতা। সঙ্গে দ্বিধান্বিত স্নেহও। অদ্ভুত লাগে সৃজার। কিন্তু বরাবরের মতোই প্রশ্নহীন সে মেনে নেয় ইহসানের কথা। কারণ গতরাত থেকে আজকের এই বিকেল পর্যন্ত সময়টাতে সৃজা লক্ষ্য করেছে, আরসালান ইনজান শেখ একজন অদ্ভুত যুবক! তার মধ্যে কেমন একটা উদাসীনতা আছে! আচরণে আছে কৌতুকপূর্ণ রেশ। সব ভাইদের মতো তার মধ্যেও আলাদা একটা বৈচিত্রতা টের পেয়েছে সৃজা! কিন্তু পুরোপুরি ধরতে পারেনি ব্যাপারটা। তবে লোকটার চাহনি যে বিশেষ সুবিধার নয় তা অতি সহজেই ধরা পড়েছে ওর চোখে! সৃজা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগে তার। আজিজ শেখের চার পুত্র চার বৈশিষ্ট্যের লোক। শুধু একটা জায়গাতেই তাদের মিল! সবগুলো ভাইই তারা সুদর্শন! তারা স্বভাবে অদ্ভুত। কারোর সঙ্গে কারোর স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। তাদের মা আর শৈশব এরজন্য দায়ী সেটা জানে সৃজা। কিন্তু আরসালান শেখের সঙ্গে ইহসানের আলাদা করে কী নিয়ে দ্বন্দ্ব এটাই ভেবে পাচ্ছে না সৃজা। নয়তো কেন বলল, ইনজান শেখের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে? লোকটা কী সত্যিই ক্ষতিকারক তারজন্য? তার বাচ্চাদের জন্য?

°

বিকেলের শেষ, গোধূলির শুরু। একটা দিন হসপিটালে কাটিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরছে ইজহান শেখ। হসপিটালের গেইট থেকেই, শরীরটা বেশি ভালো নয় বলে বাবাকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে আকাশ। বলেছে, রাতে শেখ বাড়িতে যাবে সে বোন আর ভাগ্নিকে দেখার জন্য। কয়েকবার অবশ্য বলেওছিল ইস্মিকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ইজহান দেয়নি। মেজাজ দেখিয়েছে খুব। সকালের ঐ ঘটনার পর থেকেই লোকটার মেজাজ খারাপ, বেশ বুঝেছে ইস্মি। তখন থেকেই লোকটা ওর সঙ্গে কথা বলছে না, যদিও সব কাজ করে দিচ্ছে। হাত ধরে নিয়ে এসেছে, কথাটাই যা বলছে না। কিন্তু উদগ্রীব নয়নে তাকিয়েছে অনেকবার, ইস্মি খেয়াল করেছে! মুক্তোর মতো চকচকে প্রাডো গাড়িটার পেছনের সিটে ইস্মিতা, পুনম, সালেহা বেগম। ড্রাইভ করছে মিজু। তার পাশে বসা ইজহান, কোলে তোয়ালের ভেতরে তার ছোট্ট মেয়ে। সেই কখন মেয়ে ‘পি’ করে তাকে ভিজিয়ে ফেলেছে অথচ মেয়েকে পরিষ্কার করালেও ইজহান তেমনি বসে আছে। টু শব্দও করছে না। লোকটার যা খুঁতখুঁত স্বভাব! ইস্মিতা অনেকবার বলেছে ওকে চেঞ্জ করতে, কিন্তু ইজহান শেখ তাতে গা করেনি। যে মেয়েকে সন্তান দেওয়ার পরেও সবার সামনে নিজের স্বামীকে ‘দামড়া’ বলতে পারে সে কতটুকু তাকে ভালোবাসে তা জানা হয়ে গেছে ইজহান শেখের!

________

[ছোটো, রি-চেইক বিহীন পর্ব! ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬৭

সন্ধ্যের আঁধার গায়ে মেখে শেখ ভিলাতে রাজকন্যা নিয়ে হাজির হলো ইজহান শেখ। সবার আগে মেয়েকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। মিজু দরজা খুলে দেওয়ার পর পুনমের হাত ধরে ইস্মি যখন নেমে এলো, সে খেয়াল করল ইজহান চুপচাপ থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের ওড়না ঠিক করারত অবস্থায় চোখাচোখি হতেই ইস্মি প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে ইজহান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বোঝাল সে ইচ্ছুক নয় তার সঙ্গে কথা বলতে, চোখাচোখি করতে। স্বামীর অহেতুক রাগ বুঝে ইস্মি দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে ঠোঁটে আলতো হাসি বজায় রেখে যেচে পড়ে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করল, “ও কি ঘুমিয়েছে?”

ইজহান নিরুত্তর রইল। বারবার বললে খ্যাঁকিয়ে উঠবে এই শঙ্কায় ইস্মি আশা করল না আর স্বামীর উত্তরের। বরংচ বলল, “বাইরে এতোক্ষণ দাঁড়ানো ঠিক হবে না আপনার মা’কে নিয়ে। ভেতরে চলুন!’’

সালেহা বেগম গাড়ি থেকে নেমে ইস্মির সঙ্গেই দাঁড়িয়েছিলেন, ছেলে যে রাগ তা তিনিও বেশ বুঝলেন।
তাই ইস্মির কথায় তাল মিলিয়ে বললেন, “হ আব্বা,
বাবুনির সমস্যা হইব। জিন-পরীর আছড় লাগব। ভেতরে চলো।”

ইজহান একথা শুনে একবারে ফিরে চাইল। সে ভীষণই বিস্মিত হলো এমন একটা কথা শুনে। মাথায় খেলে গেল অন্য একটা দুশ্চিন্তা। তার মেয়েটা যেমন সুন্দর, তার ইস্মিতাও তেমন সুন্দর! অন্ধকারেও যেমন চকচক করছে তাতে এই মহিলার উপরও আকৃষ্ট হতে পারে জিন-ভূতেরা! বউ তাকে না ভালোবাসলে কী, সে তো এই পাষাণীকে ভালোবাসে। মানুষ তো দূর কোনো অদৃশ্য জীবের নজরেও বউকে পড়তে দেওয়া যাবে না। ইজহান তিরিক্ষি কণ্ঠে সালেহা বেগমকে বলল, “আপনার ছেলের বউকেও তাড়াতাড়ি ভেতরে যেতে বলুন, তার উপরেও আছড় লাগবে। আমি কিন্তু সহ্য করব না ওসব নটাঙ্কীপনা…”

বলেই সে একাই ভেতরে যাওয়ার পথে পা বাড়াল। এদিকে ওর কথা শুনে সালেহা বেগমের মুখ হা হয়ে গেল। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ইজহানের দিকে। যেন তিনি ভুল কিছু শুনেছন! এতো বছরেও যে ছেলে তাকে মা বলে ডাকেনি, মেনে নেয়নি সে আজ সত্যিই তাকে মায়ের স্থান দিলো? এভাবে বলল? এটা কি সচেতন না কি অবচেতন মনে বলেছে? অবশ্য যেভাবেই বলুক না কেন, একটু সময়ের জন্য হলেও তো তাকে মা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে! সালেহা বেগম উৎফুল্ল কণ্ঠে ইস্মিকে তাড়া দিলেন, “এই বউ, তুমিও আসো। নতুন মা হইছ, এখন একটু সাবধানে থাকবা বাচ্চা নিয়া। চলো আমি ধরি…”

কেমন নিষ্ঠুর লোক দেখেছ? মেয়েকে নিয়ে একাই চলে গেছে, অথচ বউয়ের খবর নেই! এই তার ভালোবাসা? ইস্মির রাগ লাগল। ক্ষোভ নিয়ে জবাব সালেহা বেগমকে বলল, “আমি আজ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। আমার স্বামী যখন আমাকে ছাড়াই চলতে পারে, মেয়েকে সামলাতে পারে তখন আমি আর ভেতরে গিয়ে কী করব? আমি যাব না আম্মা।”

“এইডা কোনো কথা বউ? পোলাডার মাথা গরম জানোই তো। রাগ কইরো না।”

ইস্মি জেদ ধরল, “আমি যাব না, উনি নিতে না আসলে আমি যাব না।”

ব্যাক ডালা থেকে মিজু ঔষধপথ্য, ব্যাগপত্র বের করছিল, পুনম দেখে নিচ্ছিল সব ঠিক আছে কি-না! ইস্মির একথা শুনে ও অবাক কণ্ঠে বলল, “মানে কী ভাবি? ভাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও এখন বাচ্চা হয়ে গেছ?”

“তোমার ভাইয়া বাচ্চা? ত্রিশ বছরেও বাচ্চা? তাহলে তো আমার জন্মই হয়নি এখনো!”

পুনম হেসে ফেলল, “ইনডিরেক্টলি আমার ভাইয়াকে তুমি কিন্তু বুড়ো বলছ!”

“বুড়োই তো, বুড়ো বলেই কোনো ফিলিংস নেই, ইমোশন নেই। কীভাবে আমাকে ফেলে ভেতরে চলে গেল দেখেছ? অথচ আমাকে ছাড়া এক পা-ও না-কি সে চলতে পারে না।”

পুনম ওর দুঃখ বুঝতে পারল, সালেহা বেগম আর মিজুও বুঝতে পারল। তাদের তিনজনের চেহারায়ই দুঃখের ছাপ বোঝা গেল। যেন আসলেই ইজহান আসলেই খুব নিষ্ঠুর। মহা অন্যায় করেছে ইস্মির সঙ্গে।পুনম ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, “আসলেই চলতে পারে না ভাবি। হসপিটালে কী অবস্থা হয়েছিল জানো না তো, রীতিমতো হার্ট-অ্যাটাকের অবস্থা! তোমার আব্বু তো ভয় পেয়ে তোমার বরকে যাতে এডমিট করিয়ে রাখে সেই পরামর্শও দিয়েছিল ইহসান ভাইয়াকে।”

ইস্মি জানে লোকটা কেমন, তাকে ছাড়া সম্পূর্ণ অচল একটা মানুষ। তবুও ওর খারাপ লাগা কমে না। বলে,
“এতো দরদ সব মেকি! নিষ্ঠুর কোথাকার!”

অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল ইস্মি। পরপর হাতের রুমালে মুখ মুছে নিয়ে পুনমের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরল ভেতরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে। পেছনে ব্যাগ বইতে থাকা মিজু মনে মনে বলেই ফেলল, “এতোদিন ভাবতাম স্যারের মুড সুইংয়ের যন্ত্রণা আপনার থেকেও আমি বেশি সহ্য করি। আমার মতো পোড়াকপালের মানুষ আর নাই। কিন্তু এখন দেখতেছি, আমার চেয়েও বড়ো পোড়াকপালি মানুষটা আপনিই ভাবি। আমার সাথে আপনার দুঃখের ব্যথা মিইল্লা গেল।ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ এই ব্যথা বুঝবে না।”

°

পুনমের হাত ধরে ইস্মি সদর দরজা পেরিয়ে বসার ঘরে আসতেই চমকে গেল! মুখটা অল্পবিস্তর হা হয়ে গেল তার। নজর ঠিকরে পড়ল বিস্ময়! মনের ভেতর জমা হওয়া গুমোট ভাবটা যেন দমকা হাওয়ার সঙ্গে মিনিষেই মিলিয়ে গেল। বসার ঘর থেকে সিঁড়ি পেরিয়ে উপরের করিডোর, ইজহান-ইস্মিতার ঘরের দরজা পর্যন্ত রঙ-বেরঙের বেলুন দ্বারা সজ্জিত। লিভিং স্পেসের একপাশে একটা টেবিল সাজানো। সাদা রঙের মখমল কাপড়ে তৈরি টেবিল ক্লথের উপর রেড ভেলভেট কেক রাখা। তার উপর গ্লিটার দিয়ে লিখা, ‘Papa Loves Mamma & Baby.’ কেকের পাশেই জ্বলছে কিছু মোমবাতি। যেগুলো থেকে মিষ্টি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরময়। দৃশ্যটা খুব পরিচিত ইস্মির। সপ্তাহখানিক আগে আযরান-আজওয়ার আগমন উপলক্ষে ইহসান এরকমই একটি আয়োজন করেছিল সৃজার জন্য। মেয়েটা তো পুরোপুরি চমকে গিয়েছিল! তার জন্যও আজ এমন আয়োজন? ইস্মি বুক ভরে ঘ্রাণ টেনে নিলো। হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ইমরান-মিতুর কোলে মেয়েকে দিয়ে ইজহান গম্ভীরমুখে সোফায় বসে আছে। মাঝেমাঝে ডিরেকশন দিচ্ছে শারাফ-শামির, এলিজা, শেফালি বুয়াকে কীভাবে তার মেয়েকে আলতো করে কোলে নিতে হবে, ব্যথা দেওয়া যাবে না এসব সম্বন্ধে। অথচ এমন একটা ভাব করছে যেন, এইসব আয়োজনের কিছুই জানে না, সে করেনি। স্বামীর নিষ্ঠুর আচরণে বুকের ভেতর মন খারাপের পাহাড় জমিয়ে রাখা ইস্মির রাগ-অভিমানের পাহাড়টা হুট করেই ভেঙ্গে পড়ে সেখানে বুকভরা ভালোবাসা উতলে উঠল। উৎফুল্ল মনের অবস্থা সে অবশ্য চাপিয়ে রাখল নিজের ভেতর, একটুও বুঝতে দিলো না। উদগ্রীব হয়ে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে ওর শরীরের খোঁজ নেওয়া সৃজার সঙ্গে জুড়ে গেল। আযরানকে কোলে নিয়ে আদর করে দিলো, আজওয়ার মাথায় হাত বুলাল। মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামিয়ে আবারও এলিজার কোলে দিলো। পুনম ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ করিয়ে, জামাকাপড় ছাড়িয়ে মিষ্টি রঙের একটা গাউন পরিয়ে হালজা করে সাজিয়ে আনলো। আজিজ শেখ বাইরে থেকে ফিরে এসে নাতনির মুখ দেখে দোয়া করে দিলেন, কোলে নিয়ে নিজের খুশি প্রকাশ করলেন। একপ্রকার হৈচৈ শুরু হয়ে গেল সকলের উৎসাহে। ইজহান ভেতরে ভেতরে আগ্রহী থাকলেও উপর দিয়ে কোনোকিছুতেই আগ্রহ দেখাচ্ছিল না; ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ইহসান এসে বলল, “কেক কাটতে যাচ্ছিস না কেন? সবাই ওয়েট করছে!”

“আমি কেক কাটব না।”

“কেন?”

“আমার বউ আমাকে দামড়া বলেছে।”

হাসি পেল ইহসানের, তবে সাধারণ হাসি না। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসার মতো হাসি। অথচ ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখে বহুকষ্টে নিজেকে সামলাল সে। চোখেমুখে গম্ভীর ভাব বজায় রেখেই বলল, “তো কী হয়েছে? তুই কি কচি খোকা? একত্রিশের পথে আছিস…”

কটমট করে ভাইয়ের দিকে তাকাল ইজহান, “তাতে কী? আমাকে বুড়ো লাগে? তোকে লাগে, কিন্তু আমার বয়স এখনো পঁচিশই আছে। দেখতেও পঁচিশের ইজহান শেখের মতোই লাগে। এরপরেও ইস্মিতা আমাকে দামড়া বলল, আমি তো কিছুতেই এসব মেনে নেব না!”

পুরুষ যতোই একে-অপরের শত্রু হোক, তাদের দুঃখ একমাত্র তারাই বুঝতে পারে। ইহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের পাশে ধপ করে বসে পড়ল। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিজের গোপন একটা ব্যাপারও বলল, “মেনে নে। মেনে নিলেই জীবন সুন্দর! বউরা এসব বলেই, আমার বউ তো আমাকে শেয়াল থেকে শুরু করে সুগার ড্যাডি আখ্যা পর্যন্ত দিয়েছে, তাতে কী? আমি কী আর সুগার ড্যাডি?”

ইজহান যেন আকাশ থেকে পড়ল, “তোর বউও এসব বলে? এসব শিখল কোথা থেকে? অনিতা মিস তো ফিজিক্স শেখাতো; এসব না…”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইহসান, “ওসব শেখাতে হয় না, স্বামী বেশি ভালোবাসলে বউরা এসব আপনাআপনি শিখে ফেলে। তুই এতো ভিমরতি ধরে থাকিস না। তাতে লাভের লাভ কচু হবে, মাঝখানে পার্টিটা নষ্ট হবে।”

ইজহান ওর কথায় সহমত জানিয়ে নিজের মনকে প্রবোধ দিলো এই বলে যে, সে একা ভুক্তভোগী না। ভেড়াটাও ভুক্তভোগী। আর ভেড়া যাতে ভুক্তভোগী তাতে সে নিজে ভুক্তভোগী হলে মনকে কোনোভাবে মানিয়ে নেবে সে। দু’জনের গতিপথ এক হলেই মন মানানো যায়। ইজহান হঠাৎ সচকিত চোখে চারপাশ ভালোভাবে লক্ষ্য করে ইহসানকে বলল, “হোয়্যার
ইজ আরসালান?”

“ম দ গিলে ঘুমাচ্ছে!”

“উল্টাপাল্টা কিছু করেনি?”

“এখনো পর্যন্ত না।”

বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল ইজহান, “তোর বউকে নিজের বউ দাবি করে বসেনি?”

ইহসান রক্তচক্ষু মেলে চাইল, “নতুন বাপ হয়েছিস না? কথাবার্তা সংযত করতে শেখ! নয়তো থাপ্পড় মেরে দুই গালের চাপা এক করে দেব।”

ইজহানও মেজাজ খারাপ করে বলল, “আমি তো আরসালানের মনো ইচ্ছার কথা বলছিলাম, তেঁতে উঠে হুমকি দিলি কেন? বেশি বড়ো সাজতে যাস না।”

ইহসান হাই তোলার ভান করে বলল, “সাজার দরকার নেই, আমি বড়োই। তাছাড়া কিছু মুহূর্ত আগেও তুই নিজ মুখে স্বীকার করেছিস তোর বয়স পঁচিশ, তোকে না-কি পঁচিশের ইজহানই লাগে৷ এর মানে কী দাঁড়াল? তুই আমার ছোটো। ইনফেক্ট ইমরান আর জানেরও ছোটো! আচ্ছা, অতদূরে যাচ্ছি না, আমার নিচের সিরিয়ালেই তোকে রাখছি! আজ থেকে আমি বড়ো, তুই মেঝো, ইমরান সেঝো, আর জান সবার ছোটো। ঠিক আছে না? এতোদিনে আমাদের সিরিয়ালের একটা হিল্লে হলো, কাউকেই আর কনফিউজড হতে হবে না। আচ্ছা, আজকের পার্টিতে এটা ঘোষণা করে দিলে কেমন হয়? ছোটো মা আসার সঙ্গে সঙ্গে তার বাপও কচি হয়ে গেল, এটা শুনলে সবাই নিশ্চয় হতবাক হবে, কী বলিস? সবাইকে হতবাক করে দেব?”

রাগে লাল হয়ে গেছে ইজহানের মুখ। ফুঁসতে ফুঁসতে একহাত দিয়ে চুল টনে ধরল সে ইহসানের, পা দিয়ে লাথিও বসাল। ইহসানও ওর হাত মুচড়ে ধরল, টি-শার্টের গলা টেনে ধরল। উলটো দিকের সোফায় বসে দুজনে বিতন্ডতায় লিপ্ত হওয়ায় ইজহান কন্যা নিয়ে হুল্লোড়ে মেতে থাকা বাকিদের চোখে পড়ল না ব্যপারটা। তবে একজন যার চোখে পড়ল, সে হলো সৃজা। আযরানের ডায়াপার চেঞ্জ করছিল সে একটু দূরের ডিভানে শুইয়ে। ফিসফিস শব্দে কেউ ঝগড়া করছে এমন মনে হতেই এপাশ-ওপাশ ফিরে তাকালে দু-ভাইয়ের মারামারিটা চোখে পড়ল ওর। সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কুঁচকে গেল এদের কাহিনী দেখে। ধৈর্য ধরে আযরানকে চেঞ্জ করিয়ে ওকে একহাতে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের সম্মুখে। আকস্মিক সৃজাকে নিজেদের সামনে দাঁড়াতে দেখে মুহূর্তেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্রলোক সেজে গেল দুই ভাই। কারণসৃজার সঙ্গে সঙ্গে আযরানও ড্যাবড্যাব করে তাদের দেখছে! তারা তৎক্ষনাৎ আড়ষ্ট হেসে কথা গুছাতে লাগল মনে মনে। ওদের আমতা-আমতা ভাব দেখে সৃজা রুষ্ট গলায় বলল, “ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছেন তো, অথচ আপনাদের অভ্যাসে পাল্টাননি! বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে হলেও এবার একটু শুধরে যান। ওরা আপনাদের থেকে কী শিখবে? আশ্চর্য!”

ইহসান বউয়ের রাগ বুঝে বোকা বোকা হেসে হাত বাড়াল ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্য, “আযরানকে দে।”

সৃজা দিলো না, “আগে শোধরাও, পরে কোলে নিতে এসো।”

ইজহানও হাত বাড়িয়ে বসেছিল, সৃজা তাকেও দিলো না। বলল, “আপনার দুটো মেয়ে যদি এভাবে একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকে, সেটা কি ভালো দেখাবে ভাইয়া? নয় তো? তাই বাচ্চাদেরকে ভালো শিক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও আপনাদের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন, যদিও আপনাদের ঝামেলার কারণগুলো হাস্যকর!”

এই বলে যেতে যেতে ইহসানকে বলল, “ঝগড়া করবে মেয়েরা, ছেলেরা নয়! অথচ তোমরা দুই ভাইই মেয়েদের মতো ঝগড়ায় পারদর্শী! দরকার পড়লে কোনো কোর্সে ভর্তি হও, তারপরেও শেখো কীভাবে ঝগড়া না করে নিজেদের সংযত করতে হয়, অন্তত বাচ্চাদের সামনে!”

সৃজার মুখ ঝামটা খেয়ে দুই ভাই বসে রইল অনেকক্ষণ! একটা সময় পর মেজাজ খারাপ করে ইজহান বলল, “তোর বউ আমার কোলে দিলো না আযরানকে!”

“আমার কোলেও না, অথচ আমি বাপ হোই ওর।”

“আমার একটাই মেয়ে হয়েছে, ছেলে নেই। তারপরও পারল এমন করতে? দিলোই না ছেলেটাকে? এতো হিংসুক তোর বউ? আমি কিন্তু তোর বউকে গায়েব করে দেব!”

“আর আমি বুঝি আঙ্গুল চুষব?”

“কী করবি? আমার বউকে কিডন্যাপ করবি? তোর ব্যাংক-ব্যালেন্স কতো? ফকির…আমার বউকে একবেলা খাওয়াতেও তো পারবি না প্রোপারলি!”

“তোর বউকে কিডন্যাপ করলে তো তুই মরে যাবি, তুই মরে গেলে যন্ত্রণা দেব কাকে? তারচেয়ে ভালো হবে ছোটো মাকে কিডন্যাপ করব, তোরা বর-বউ বাচ্চা হারিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করবি…”

ইজহান তেঁতে উঠল, “বা—ল করবি তুই আমার!”

ইহসান ওর চোয়াল জোড়া চেপে ধরে বলল, “বেশি ফটরফটর করবি, মুখ খারাপ করবি তো জনসম্মুখে তোর অতীত কাহিনী ফাঁস করে দেব। দু’সেকেন্ডও নেব না।”

বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে এরপরেও ভেড়াটা ওর সংসার ভাঙার ধান্ধায় আছে? শুধু একটা দুর্বলতা আছে সেজন্য? ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে, ইহসান তা দেখে হাসলো। ওকে ছেড়ে দিয়ে আরাম করে পা তুলে বসলো। ওর হাসি আর ভাবভঙ্গি দেখে ইজহানের মনে হলো, এই হাসিটা আরসালানের সেই শয়তানি হাসির মতো। শরীরের ভাষাটাও আরসালানের মতো। সে বিক্ষুব্ধ গলায় ফিসফিস করে বলল, “আরসালান তোর জিনিসে ভাগ বসায় কারণ তোরা দুইজন একজনই। তোদের দুটোর স্বভাব এক, চাহিদা এক। একটুও পার্থক্য নেই।”

ইহসান সোফায় পিঠে ঠেকিয়ে বসে দুর্বোধ্য হাসে, “তা বটে। আমাদের ব্যাপারটা একই। পজিটিভ-নেগেটিভ ধারায় যতো গড়মিল! জান কী চায় সেটা ও নিজেই জানে না। তবে এটা চায়, আমি ওর প্রতি জেলাস হোই। অথচ আমার করুণা হয় ওর ভবিষ্যত ভেবে। বাই দ্যা ওয়ে, তুই আর আমিও কিন্তু এক…আলাদা নই। আমি জানি তুই এখন খুব করে চাইছিস ইস্মিতার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে, অথচ মুখে প্রকাশ করছিস না…হ্যাঁ না?”

উত্তরের অপেক্ষা করল না কথাটা বলে। ইহসান হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওকে কেক কাটার জন্য!
ইজহান যদিও নাটক করছিল, তবুও ইহসান জোর করে ওকে ইস্মির পাশে দাঁড় করিয়ে দিলো। কালবৈশাখীর কালো মেঘের ন্যায় চোখমুখ অন্ধকার করে ইজহান বউয়ের পানে একবার তাকাল, মিষ্টি রঙের পোশাকে তার বউটাকে মিষ্টি আলুর মতো আদুরে দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করল বউয়ের হাতে একটা
চুমু খেতে, কিন্তু বউ তো তাকে দু’টাকার মূল্যও দেয় না, কেন খাবে চুমু? সে এতো সস্তা না, হুহ!

থমথমে মুখ নিয়েই সে ইস্মির হাতের উপর নিজের হাত রেখে একসঙ্গে কেক কাটল। তবে ইস্মির হাতে সে নিজে কেক খেল, বউকে খাইয়ে দিলো না। শারাফ-শামির, পুনমকে খাইয়ে দিলো। বাকিদের সঙ্গেও স্বাভাবিক ব্যবহার করল। বাচ্চাদের হৈ হৈ রবে, চাকর-বাকরদের হুড়োহুড়িতে পরিবেশটাই আনন্দময় হয়ে উঠল। ভালো লাগছিল ইস্মির। উপভোগ করল পুরো আয়োজনটা। পরিশেষে ক্লান্ত হয়ে যখন নিজেদের ঘরে ফিরতে নেবে, কাঠ মুখ করে তাকে আদেশ-নির্দেশ দিতে থাকা ইজহানকে সে একফাঁকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “সবকিছু আপনি
অ্যারেঞ্জ করেছেন? আমার জন্য?”

“তুই আমার কে? আমি সব করেছি আমার মেয়ের জন্য!”

ইজহান কাঠখোট্টা স্বরে জবাব দিলো। ইস্মি ঠোঁট টিপে হাসি আটকাল। কারণ এলিজা তাকে জানিয়েছে ইজহান ওকে সবকিছু আয়োজন করতে বলেছে ইস্মির জন্য, ওকে কীভাবে স্পেশাল ফিল করাবে সে নিয়েই নাকি সকাল থেকে পরিকল্পনা করেছিল এলিজার সঙ্গে। অথচ এখন ভাব দেখাচ্ছে মেয়ের জন্য না-কি এসব আয়োজন! ইস্মি সবার আড়ালে ইজহানের হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, “আমি আপনার মেয়ের মা, আপনার ইস্মিতা! আর আপনি এমন
কেন করছেন? শুধু ওই কথাটা বলেছি বলে? রাগের মাথায় বলেছি তো…আর কখনো এমন ভুল হবে না!”

ইজহান বাঁকা চোখে তাকাল। বলতে যাবে ‘আমাকে চুমু খেয়ে প্রমাণ দাও’ কথাটা, কিন্তু বলা হলো না। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই ইজহান টের পেল কেউ তার আর ইস্মিতার পায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে৷ নরম, রোমশ, অদ্ভুত কোনো একটা প্রাণী…ইজহান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখল বাদামি রঙের একটা কুকুর তার প্যান্ট চাটছে…হতবাক সে এক মুহূর্তে ভড়কে গিয়ে ইস্মিতাকে একটানে নিজের পাশে এনে, দূরছাই ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠল, “এটা কে? এখানে কেন? কোথা থেকে এলো…এই কুকুরের বাচ্চা ভাগ এখান থেকে….”

কেমি—পুরোপুরি বোকা এবং ভীতিগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে রইল, একপাশে গুটিয়ে গিয়ে ডাইনিংয়ের নিচে লুকিয়ে পড়ল! ইহসান মেজাজ খারাপ করে এসে ইজহানকে ধমক দিলো, “চেঁচানোর কিছু হয়নি, ও শান্ত একটা বাচ্চা। তোর চেঁচামেচিতে ভয় পাচ্ছে।”

ইজহান ততক্ষণে একটু শান্ত হয়েছে, তবুও ওর খ্যাঁকখ্যাঁক কমে না, “কে এনেছে ওটাকে? কার বাচ্চা ও?”

“জান—আরসালানের।”

শান্ত হলো ইজহান, তবে ইস্মি না। ভয়ে ওর চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। কুকুর ভয় পায় মেয়েটা। ইজহানের পেছনে দাঁড়িয়ে একপ্রকার ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার মতো কাঁপন ধরল ওর শরীরে। ইজহান ওকে স্বাভাবিক করতে বলল, “কিছু করবে না, রিল্যাক্স হও…”

ইস্মি প্রায় কেঁদেই ফেলল, “আমার পা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল…আল্লাহ আমার ভয়ে এখনো বুক কাঁপছে…আমাকে নিয়ে চলুন এখান থেকে…”

বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা উদ্রেক হলো ইজহান শেখের। রাগ-ক্ষোভ ভুলে বউকে নিয়ে চিন্তিত হলো সে। অতঃপর ইস্মিতাকে নিয়ে চলল তার ঘরে, সঙ্গী হলো তার ছোট্ট মা-ও! যাবার আগে কেমির উদ্দেশ্যে বলেও গেল, “তুই আমার বউয়ের সামনে আসবি, ল্যাংড়া করে দেব তোর বাপের মতো!”

°

এসেছে থেকে এলিজার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে শারাফ-শামিরের। বাচ্চাদুটো ওর সঙ্গে সঙ্গেই থাকছে।
ইজু মামার বেবি হবে বলে এই প্রথম মাকে ছাড়া নানা বাড়িতে রাত কাটিয়েছে তারা, মাকে মিস করলেও এলিজার সঙ্গ পেয়ে একটুও বিরক্ত হয়নি তারা। বিশেষ করে শারাফ! এলিজ আন্টির সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে তার। কারণ শারাফের পছন্দের সঙ্গে আন্টির পছন্দ মিলে যাচ্ছে। যেমন এলিজ আন্টি তার মতোই ফুল পছন্দ করে, বিড়াল পছন্দ করে এমনকি জান মামার কুকুর—কেমিকেও পছন্দ করেছে। সকালে, দুপুরে খাইয়েছেও দু’জন মিলে। এরপর তো কেমি—জান মামার ঘরে গিয়ে ঘুমাচ্ছে; নানাভাই জান মামাকে ডিস্টার্ব করতে বারণ করেছে বলে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও কেমিকে ওই ঘর থেকে আনতে পারেনি শারাফ। অথচ এখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইজু মামার সুপার উইম্যানকে ভয় দেখিয়ে ধমক খেয়েছে কেমি; এটা দেখেই মন খারাপ হচ্ছে তার। কেমি তার সঙ্গে ভালো বল খেলে। বাচ্চাটা এখন ভয় পেয়ে আছে, তার সঙ্গে তো আর বল খেলবেই না!

বসার ঘরটা ফাঁকা হতেই শারাফ এলিজাকে বলল তার মন খারাপের ব্যাপারটা। ওটুকু বাচ্চার এতো চিন্তা দেখে এলিজার এতো আদর আদর লাগল শারাফকে, আলতো করে ওর গাল টেনে দিয়ে বলল, “কেমির ভয় কাটিয়ে দিলেই ও আবার আমাদের সঙ্গে খেলবে। তুমি একদম মন খারাপ করবে না। ওকে?”

শারাফ দ্বিগুণ মন খারাপ করে বলল, “যদি না খেলে? আমারই তো মন খারাপ হয়েছে, ওর নিশ্চয় আরো বেশি মন খারাপ?”

একটু ভেবে নিয়ে বলল এলিজা, “ঠিক আছে, আমরা তাহলে ওকে ভালো করে আদর করে দেব! একটুও মন খারাপ লাগবে না কেমির।”

“ও তো বল খেলতে ভালোবাসে, আমি বল নিয়ে আসি তাহলে ও মন খারাপ করবে না।”

এলিজা মিষ্টি করে হেসে বলল, “গুড আইডিয়া, নিয়ে এসো। কেমির মন খারাপ একদম ভ্যানিশ করে দেব…”

শারাফ একপ্রকার ছুটেই গেল তার বল খুঁজতে, এদিকে এলিজা বসল ডাইনিংয়ের নিচ থেকে কেমিকে
বের করে আনতে। সেই তখন যে ভয় পেয়ে কুকুরটা ওখানে গিয়ে শুয়েছে, এরপর আর বেরুয়নি। সকলে যার যার ঘরে চলে যাওয়ার পর ইহসান অবশ্য নিজেই চেয়েছিল কেমিকে বের করে আনতে, কিন্তু এলিজা আর শারাফ ওর কাছে বায়না ধরায় কেমিকে ওদের দায়িত্বেই ছেড়ে দিয়েছে ইহসান।

ভুলিয়েভালিয়ে, খাবারের লোভ দেখিয়ে বহু কসরত করে এলিজাকে বের করে আনতে সক্ষম হলো। কুইকুই শব্দ তুলে কেমি—একদম কোলের উপর বসে পড়ল এলিজার। মাথায় হাত বুলিয়ে, ঘাড় চুলকে দিয়ে আদর করে দিতেই কেমি শান্ত হলো। এলিজা গলা জড়িয়ে ধরতেই ওর হাত চেটে দিলো। কেমিকে মানিয়ে নিয়ে ওর গলার বেল্ট ধরে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতেই এলিজার নজরে পড়ল লম্বা-চওড়া যুবকের উদোম একটা শরীর৷ পরণে ফর্মাল একটা কালো রঙের প্যান্ট, কোমড়ে ঢিলেঢালাভাবে জড়ানো। নাভি ছাড়িয়ে অনেকটা নিচে। যুবক দাঁড়িয়ে ইস্মিতার জন্য সাজানো ছোটো টেবিলটার ওখানে, একটা হাত দিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তো অন্য হাতে কেকের উচ্ছিষ্ট অংশ। যেটা বহু আয়েশ করে সে খাচ্ছে! মুখ-নাক, ঠোঁটের পাশে লেগে আছে লাল-সাদা রঙের ক্রিম। কোনো
স্বাভাবিক মানুষ এভাবে খেতে পারে না। এলিজার ধারণা চোখের সামনে সে কোনো পাগলকে দেখছে, যার পেটে বহুদিন কিছু পড়েনি, অনেকদিনের বুভুক্ষু সে! ভাবনার মাঝেই আচমকা এলিজার হাত ছাড়িয়ে কেমি একদৌড়ে ছুটে গেল যুবকের কাছে, পায়ের কাছে শরীর ঘেঁষতে ঘেঁষতে দৃষ্টি আকর্ষণ করল যুবকের। দীর্ঘদেহী যুবক ঝুঁকে বসে বড়ো এক স্লাইস কেক ঢুকিয়ে দিলো কেমির মুখ!

_______

[রি-চেইক বিহীন। দেরিতে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। পর্ব পড়ে মন্তব্য করার অনুরোধ রইল। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬৮

শেখ বাড়ির ছেলে দ্বারা তাঁর ভাইয়ের পরিবারে ঘটে যাওয়া নির্মম সত্যিগুলো জানেন নীল বেগম। আর জানেন বলেই এ বাড়িতে তিনি খুব একটা স্বস্তি যে পাচ্ছেন তা নয়। মনকে বহু বুঝ দিয়ে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছিলেন, পারতপক্ষে আজিজ শেখ নামক স্বার্থপর লোকটার সামনেও পড়েননি! কিন্তু যখন থেকে এ বাড়িতে সেই খুনে ছেলেটার আগমন ঘটেছে তখন থেকেই তিনি উদগ্রীব! এখানে থাকলে প্রতিনিয়ত খু নীটার মুখদর্শন করতে হবে বলে তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না এখানে থাকতে। কিন্তু ইহসানের মুখের দিকে চেয়েই তিনি রয়ে গেছেন। ছেলেটা তো কম করেনি তাদের জন্য, নিজেও ভুগেছে ভাইয়ের জন্য! ছেলেটার অনুরোধ, আকুতির মাঝেও প্রবলভাবে তিনি বুঝতে পেরেছেন খু নে ভাইটার আগমনে ইহসান নিজেও কতোটা অস্থিরতা আর দোটানায় পড়েছে। তাছাড়া ইহসান আশ্বস্ত করেছে তাকে; সে থাকতে এ বাড়িতে তাদের কোনো সমস্যা হতে দেবে না ইনজানের দ্বারা!

নীলু বেগম সাদাসিধে মেয়েমানুষ। পার্থিব বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই।
দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সাধ কেন যেন তার ঠিক আসে না; এরপরেও নিজের মৃত্যু কামনা করতে পারেন না তিনি। মরে গিয়ে নিজের না হয় একটা গতি হলো, কিন্তু ভাইয়ের রেখে যাওয়া মেয়ে দুটো? তারা যে একা হয়ে যাবে। তিনি ছাড়া দুকূলে তো আর কেউ নেই ওদের৷ তাই তো ওদেরকে একা করে রেখে যেতে তার বড্ড ভয় হয়! অবশ্য ইহসান যেভাবে তাদের উপর ছায়া হয়ে আছে, তাতে ওর হাতে সব গছিয়ে দিয়ে আজকাল মরতেও আপত্তি নেই নীলু বেগমের।

°

চাপড়া চাপড়া অন্ধকার আর উত্তুরে হাওয়ায় একটা দুটো করে গাছগাছালির পাতা নড়ার দৃশ্যে মিশে আছে রাতের সৌন্দর্য। পাতা ঝরার শনশন আওয়াজে আদুরে হয়ে উঠা শান্য, শীতল আবহাওয়ায় শেখ বাড়ির প্রতিটা সদস্যই ঘুমে। একমাত্র ইহসান শেখ ছাড়া। সারাদিন বাচ্চা দুটোকে সামলানোর ফাঁকে মিনিট পাঁচেক সময় পেলেও সৃজা রেহমান যেখানে মরার মতো ঘুমিয়ে ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টা করে, সেখানে নিজের রেস্তোরাঁ, ব্যবসা, বউয়ের নোট জোগাড় করা, বাজারসদাই করা থেকে শুরু করে বাড়িতে ফিরে ভাইয়ের সঙ্গে একদফা কথা-কাটাকাটি করা, বাচ্চাদের সামলানো এমন কোন কাজ নেই যেটা ইহসান সামলাচ্ছে না? একা হাতে সব সামলাচ্ছে, কারো সাহায্য নিচ্ছে না, চাইছেও না। নিজের কর্মযজ্ঞ সামলেই যেখানে বেশিরভাগ পুরুষ ক্লান্ত হয়ে বাকি কাজের দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়, সেখানে এই লোকটার কী একটুও ক্লান্ত লাগে না? ইচ্ছে করে না পুরুষালি দেহটিকে একটুখানি বিশ্রাম দেই, পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও? না, ইহসান শেখ বিশ্রাম নেওয়ার মানুষ নয়। সে একটা রোবট, যাকে চালনা করতে চার্জেরও প্রয়োজন পড়ে না। নয়তো রাত তিনটায় ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে অন্য কেউ যেখানে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতো, সেখানে এই লোক দিব্যি বারান্দায় বসে চায়ের কাপে ডুবে আছে, মেয়ে উঠে যদি কাঁদে এই শঙ্কা নিয়ে! ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসায় টানা একচল্লিশ মিনিট ঘুমানোর পর সৃজা রেহমানের ঘুমটা যখন চায়ের কাপের টুংটাং শব্দে হালকা হলো, সেই থেকেই মেয়েটা দেখে যাচ্ছে নিজের একান্ত পুরুষটির খামখেয়ালি কর্মকাণ্ড।
যা প্রতি মুহূর্তে তার মনে বিরক্তির উদ্রেক করছে!
বিরক্তি নিয়েই শোয়া থেকে উঠে বসল সৃজা। এলোমেলো হয়ে পিঠের নিচে পড়ে থাকা চুলগুলোকে হাতখোঁপা করে এদিকওদিক খুঁজল তার পরণের ওড়নাটা। দেখল, ওড়নার একাংশ তার ছেলে আযরানের পিঠের নিচে চাপা পড়ে আছে। যেটাতে টান দিয়ে আনতে গেলে তার পাজি ছেলের ঘুম ভাঙবে নির্ঘাত। এরপর চিৎকার করে সে তার বোনের ঘুমটাও ভাঙাবে। সৃজার আচমকা বড্ড হাসি পেল, তার এই পাজি ছেলেটার কপালে না জানি কোন মেয়ে জুট্র! কিছু হলেই কেঁদেকুটে একসার হয়ে মা-বাবাকে যেভাবে জ্বালাচ্ছে তাতে সৃজা নিশ্চিত আযরান নিজের জীবন সঙ্গীকে তার বাপের মতোই জ্বালাবে! সৃজা ঘুমন্ত ছেলের কপালে আলতো একটা চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘অনেক বড়ো হও বাবা, মা তোমাকে অনেক বড়ো হতে দেখতে চাই।’
আজওয়াও হয়েছে ঠিক তার বাবার কার্বন কপি, এলিজা ঠিকই বলেছিল। দিনদিন বাবার মুখটাই নিজের মুখে বসিয়ে নিচ্ছে মেয়েটা, যেভাবে তাকায়… মাঝেমধ্যে সৃজার মনে হয় বাপের মতো এক্ষুনি
একটা ধমক দিয়ে বসবে তাকে!

গায়ে জড়ানো আকাশি রঙের সালোয়ার-কামিজের ওড়না না পেয়ে সৃজা চেয়ারের উপর থেকে একটা চাদর জড়িয়ে নিলো তার গায়ে। এরপর ল্যাম্পের আলোটা কমিয়ে ধীরপায়ে বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বিয়ের পরবর্তী দিনগুলোতে এমন অনেক পূর্ণিমা রাতে দু’জনে বারান্দায় জোৎস্না বিলাস করেছে, গল্প করে কাটিয়েছে। রাত ভোর হওয়া দেখেছে, সকাল হতে দেখেছে…

একমনে বাইরের নিস্তব্ধ পরিবেশে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা থাকা স্বত্তেও সৃজার উপস্থিতিটা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেল ইহসান, পেছনে না ফিরেই ওকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক ঠিক একচল্লিশ মিনিট ঘুমানো দু-মাস বয়সী বাচ্চার মায়েদের হেলথের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আযরানের মায়ের এখন ঘুমানো উচিৎ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করা না। অ্যাম আই রাইট?”

ভাবনায় মত্ত সৃজা পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো। জবাবে বলল, “ঘরে-বাইরে সামলে এসেও যে পুরুষ এক মিনিটের জন্যও চোখের পাতা এক করে না, তার এতো উপদেশ দেওয়া মানায়? আমার মতে তো না।”

অভিযোগ শুনে ম্লান হাসলো ইহসান। চট করে পেছনে ফিরে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দৃষ্টি স্থির করল সৃজার ঘুম ঘুম মুখটাতে। ভ্রু উঁচিয়ে শান্ত স্বরে
জিজ্ঞেস করল, “কী? স্বামীর জন্য মন পুড়ছে নাকি সৃজা রেহমানের?”

“মন থাকলে পুড়তেই পারে। তোমার মতো স্বামী যার আছে, তার মন তো পুড়তে বাধ্য।”

ইহসান হাত বাড়িয়ে টেনে এনে ওকে কাছে বসালো। ঘাড়ের উপর চিবুক রেখে দু’হাতে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ব্যগ্র স্বরে বলল, “মন পোড়া তো ভালো ব্যাপার না, কী করা যায়?”

“কিছুই করতে হবে না মহাশয়, আপনি গিয়ে পিঠটা একটু বিছানায় লাগান, কয়েক ঘন্টা চোখ দুটোকে বিশ্রাম দিন। আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দিন, তাতেই চলবে।”

“সম্ভব না, আমি শুলেই মেয়ে উঠে যাবে।”

“মেয়ের জন্য আমি আছি, তুমি যাও…”

“বেশি পাকামি না করে চুপচাপ গিয়ে এখন বিছানায় শোবি…আমার জন্য এত চিন্তা করতে হবে না।”

“আমাদের এতো যত্ন নিচ্ছ, খেয়াল রাখছ, টাইম মেইনটেইন করে খাবার খাওয়াচ্ছ, ঔষধ দিচ্ছ। কোনোকিছুতেই কমতি রাখছ না, কার্পণ্য করছ না। অথচ নিজে অসময়ে খাবার খাচ্ছ, শরীরের যত্ন নিচ্ছ না, ঘরে-বাইরে সবদিকে নজর! অন্যের প্রতি উদার হয়ে নিজের প্রতি দিনদিন বড্ড নিষ্ঠুর আর খামখেয়ালি হচ্ছ; অথচ আমি বাচ্চাদেরই দেখভাল করতে পারছি না! তোমার প্রতিও বড্ড বেখেয়ালি! আমার কি কষ্ট লাগে না তোমাকে এভাবে দেখলে? আমার বড্ড কষ্ট হয়। রাগও হয়। মনে হয়, আমি তোমার জীবনে একটা উটকো ঝামেলা বৈকি কিছুই নয়।”

সৃজার কণ্ঠস্বর অভিমানী হয়ে উঠল। নিজের অপারগতার জন্য যে রাগ সেটাও প্রকাশ পেয়ে গেল ওর কথায়। ইহসান ওকে আরেকটু আগলে নিয়ে একদম কোলেই তুলে ফেলল, গালের পাশে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “আমার বাচ্চা পেটে ধরে, রাতদিন এক করে ওদের লালনপালন করে, সামলাতে গিয়ে তোর সুন্দর চোখদুটোর নিচে কালির ছাপ পড়েছে, গাল ভেঙেছে, শরীর ভেঙেছে। তোকে দেখে কেন যেন আমার অস্বস্তি বাড়ে, অপরাধবোধ বাড়ে। আমাকে বাবা বানাতে গিয়েই তো ঘুমহীন রাত কাটাচ্ছিস একের পর এক! এসবের পরেও তুই আমার বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপ। যাকে এভাবে দেখে আমার হৃদয় জুড়ায়, চক্ষু শীতল হয়, সব না পাওয়া পাওয়া হতে দেখি। বিশ্বাস কর সৃজা, তুই আমার জীবনে আঁধার কেটে আসা একঝাঁক জোনাকির জ্বলজ্বলে আলো, যে আলোতে আমি আমার পৃথিবীকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি!”

নিজে থেকেই সৃজা ওর বুকের সাথে মিশে রইল অনেকটা ক্ষণ। বলল না আর কিছু। কআন পেতে চুপচাপ শুনতে লাগল মানুষটার হৃদস্পন্দন।
যা তার হৃদস্পন্দনকেও হার মানাচ্ছিল! ইহসান সৃজার পেলব গালদুটোতে আলতো করে চুমু বসাল। পরপর নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল, “এই, আমাকে দেখ! আগের চেয়ে কেমন সুদর্শন হয়ে গেছি, ভুড়িও বোধহয় ইঞ্চি দুয়েক বেড়েছে। ভুড়ি কামানোর জন্য হলেও নিজের প্রতি একটু বেখেয়ালি হতেই হবে। হোই না একটু বেখেয়ালি, তাতে দোষের তো কিছু নেই…”

সৃজা ওর বুকে ঘুষি বসিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে না। অনেক বেশি চালাক তুমি!”

ইহসান ওর হাতদুটো মুঠোবন্দী করে বলে উঠল, “আমি চাই তুই আগের সৃজা হো, যাকে দেখে আমার মন মানতে বাধ্য হবে, এই মেয়েটাকে আমি সত্যিই ভালো রাখতে পারছি!”

কথাটাতে কী ছিল জানা নেই সৃজার, থেমে গিয়েও আচমকা গভীর স্বরে বলে উঠল, “আমাকে একটু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরো তো, ইদানীং বাচ্চাদেরই আমার আদরের ভাগ দিয়ে দিচ্ছ! আমার কিন্তু বড্ড হিংসে হয় ইহসান শেখ!”

বলতে দেরি কিন্তু আদরে লিপ্ত হতে দেরি হয়নি ইহসান শেখের। উদাস বাতাসের আদরের চাদরে দু’জনে যখন গভীর প্রণয়ে উন্মত্ত; সেই সময়টাতেই হঠাৎ সৃজার চোখ পড়ল পুকুরঘাটে। একটা লম্বাটে লোক, মাথায় বোধহয় হ্যাট! ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামছে, হাতে সরু লাঠির মতো কিছু একটা নিয়ে।
সৃজার ভ্রু কুঁচকে গেল আচমকা। পরিচিত মনে হলো লোকটাকে। আলতো স্পর্শে, ফিসফিস কণ্ঠে ইহসানকে বলল, “ওটা আরসালান ভাইয়া না? অসময়ে ঘাটে কী করছে!”

নারিকেল পাতার শনশন আওয়াজে চারিদিকে তখন ভোর হবার ঘ্রাণ। চুলের ভাঁজে নাক ডুবিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলা ইহসান কথাটা শুনেই মাথা উঁচু করে তাকাল ঘাটের দিকে। দেখল তার অবাধ্য ও বেপরোয়া ছোটোভাইটি পুকুর ঘাটে নামছে। সঙ্গী করেছে তার কেমিকেও! একরাশ বিরক্তি
আর রাগ নিয়ে ইহসান তাকিয়ে রইল জানের দিকে। কেমিকে নিয়ে আরসালান পানিতে নেমেছে সাঁতার কাটতে! অথচ সাঁতার কাটছে কম, কেমিকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে বেশি। আবার মাঝেমধ্যে ঘাটে বসে বিরতিও নিচ্ছে। পরক্ষণেই নিজে লাফিয়ে পানিতে পরছে,
দেখাদেখি কেমিও। সরল মনের পোষ্য কুকুরটার প্রতি এই অমানবিকতা দেখে রাগ উঠে গেল ইহসানের। ইচ্ছে করল সামনে গিয়ে কষে চড় বসাতে ইতরটার দুই গালে। তাকিয়ে দেখল সৃজা অবাক হয়ে দেখছে ওর এই কান্ড। সে তৎক্ষনাৎ সৃজাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো। সৃজা তখনো ঘোরে, বিহ্বল কণ্ঠে বলল,
“এটা কী ছিল?”

ইহসান পানি খেতে খেতে রাগমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলো, ”এটা ওর পাগলামো ছিল।”

“তাই বলে কেমিকেও? বাইরে কতো ঠান্ডা…”

“ও এসব বোঝে না, বুঝলেও গা করে না। আর এজন্যই ওর থেকে দূরে থাকতে বলি তোকে।”

সৃজা চিন্তিত স্বরে বলল, “ভাইয়ার তো ইমিডিয়েট কাউন্সেলিং প্রয়োজন!”

ইহসান স্পষ্ট জবাব দিলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, “যে পাগল হয়েই জন্মেছে, তাকে কোনো কাউন্সেলিংই কাজে দেবে না।”

অতঃপর সৃজাকে ঘুমন্ত বাচ্চাদের কাছে রেখে ইহসান ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল কেমিকে উদ্ধার করে আনতে! মিনিট দশেক পর নিয়েও এলো কেমিকে, বারান্দায় নিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে পরিষ্কার স্থানে রাখল। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে লোমগুলো শুকিয়ে দিলো। বাটিতে করে বিস্কুট আর কেকও খেতে দিলো। কেমি একটুও জ্বালাল না। সারা বারান্দা ঘুরে ঘুরে বিস্কুট আর কেক খেল। মাঝেমাঝে ঘেউ ঘেউ স্বরে ডেকে উঠে নিজের মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করল। সৃজা এসব দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে ইহসানকে বলল, “ভাইয়া ওকে আনতে দিলো?”

“না।”

“তাহলে? জোর করে আনলে?”

“অপশন ছিল না।”

আরসালান পুকুরঘাটের বসার জায়গাটায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি ভোরের ম্লান আকাশে নিবদ্ধ। কী দেখছে লোকটা জানা নেই সৃজার, কিন্তু তার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সৃজার বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

°

কামিনী গাছের ঝাড়! যেটার নিচে চার পুত্রের জন্মদাত্রী শায়িত! সেই স্থানে মেয়েটি দাঁড়িয়ে। ঠিক দাঁড়িয়ে নয়, মাঝেমধ্যে ছুটোছুটিও করছে পুনমের বাচ্চাদের সঙ্গে, কেমিকে নিয়ে। তারা হাসছে, খেলছে। ভেজা ঘাসের উপর থেকে ফুল কুড়াচ্ছে। অনেক ফুল, রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই তাই মেয়েটি নিজের ওড়নায় কুর্চি ভরে নিচ্ছে। আরসালান ইনজান শেখ আলস্য ভরা দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি পানরত অবস্থায় সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সেই লাল রঙা জামায় পা থেকে মাথা অবধি
জড়ানো মেয়েটিকে। কোমড় ছাড়ানো লম্বা খোলা চুল,
হাওয়ায় একটু একটু উড়ছে। বড্ড বিরক্ত করছিল বোধহয়! মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা দুটো হাত তাদের শাসন করে বারবার গোলাপি আভা ছড়ানো কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দিচ্ছিল। হাতের পৃষ্ঠ আর লম্বা আঙুলগুলো লাল রঙ দ্বারা রঞ্জিত। হাতদুটোও কী সুন্দর! ওমন সুন্দর হাত এর আগে কখনো দেখেছে কি না—আরসালান জানে না। তবে এর আগে সে এর আগে যা দেখেনি, আজ তা-ই দেখল! বাতাসের ঝাপটায় একটা মেয়ের মাথা থেকে ওড়না সরে গেলে, তার উপর গাছ থেকে শুভ্র রঙের ফুল ঝরে পড়লে, চোখ বন্ধ করে আলতো হেসে একটা মেয়ে ঠিক কীভাবে মস্তিষ্কের নিউরন অবধি কাঁপিয়ে দিতে পারে তা দেখল! বারান্দার রেলিংয়ে দু’হাত ভাঁজ করে সেখানে চিবুক রেখে বিবশ দৃষ্টিতে আরসালান ইনজান শেখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে গেল মেয়েটাকে। বহু বছর আগে এমন দেখতে একজনকে সে
মা বানাতে চেয়েছিল, মায়ের স্থান দিতে চেয়েছিল!
অথচ সেই নারীটি তার গালে থাপ্পড় মেরে তার ক্ষোভের শিকার হয়েছিল!

°

চারদিন হয়েছে ছোট্ট মা’কে তোয়ালেতে মুড়িয়ে বাড়ি ফিরেছে ইজহান। এ চারদিনে সে একবারের জন্যও বাড়ির বাইরে বেরুয়নি। সব কাজ সে বাড়িতে বসেই করেছে, বাকিসব মিজুর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আপাতত তার দিন কাটছে বাচ্চাদের নিয়েই। তবে ইস্মিতার সঙ্গে এখনো একটা নীরব যুদ্ধ চলছে তার, ঠিকঠাক কথা বলছে না এখনো। ইস্মি যদিও চেষ্টা করছে, তবুও ইজহান এমন করছে। এমনটা করছে সে তার মনের কথায়। মন তাকে বলেছে এমন করলে বউয়ের অ্যাটেনশন পাওয়া যাবে। ছোট্ট মেয়ে পেয়ে বউয়ের মনে এমনিতেই একজন ভাগ বসিয়েছে, ভারসাম্য বজায় রাখতে একটু নাটক করলে ক্ষতির তো কিছু নেই। এমনিতেও মেয়েকে সে অনেক ভালোবাসা দিচ্ছে! এতেও আবার মন খচখচ করে তার। বউয়ের ভালোবাসা পাওয়ার আশায় তার ছোট্ট মা টাকে আবার কম ভালোবাসছে না তো? ইজহান শেখের তাই মনে শান্তি নেই। মনের শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে আজওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম খুঁজছে সে, কিন্তু একটা নামও তার পছন্দ হচ্ছে না। তার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা শুনে মকবুল বলেছে, “স্যার আফনে আফনের মাইয়ার নামও যাতে ভাবিজানের নামে রাইখা দিন। এতো কনপিউশনের কিছু নাই। ভাবিজানের নামটা সুন্দর!

মকবুলের প্রস্তাবটা মনে ধরেছিল ইজহানের, কিন্তু ইস্মিতাকে এই কথাটা বলার পর সে ভয়ংকর একটা ধমক খেয়েছে। তাকে আর মকবুলকে বোকার হদ্দ, গাধার গাধা বলেছে ইস্মিতা!

_______

চলবে…