#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬৯
সাড়ে নয়মাসের প্রেগ্ন্যাসি জার্নি শেষ হওয়ার পর মেয়েকে আগলে রাখাই ইস্মির প্রধান কাজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খাওয়ানোর সময়টা বাদে মেয়েকে সে কাছেই পাচ্ছে না৷ কারণ সব কাজ শিকেয় তুলে তার গুণধর স্বামী ইজহান শেখ সারাক্ষণ মেয়ে নিয়ে পড়ে আছে, টনা-মনার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। নামেমাত্র অফিসের কাজ দেখছে। ইস্মির তেমন কোনোকিছুই করতে হচ্ছে না। তবে গত কয়েকটা দিন যাবৎ ইজহানের সঙ্গে তার ছোটখাটো মান-অভিমানের খেলাটা যেন কাটছেই না। লোকটা অহেতুক কারণে যেমন রাগ করে, তেমনি বোকাবোকা কথা বলে, জেদ করে পরিস্থিতি আরো নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। না চাইতেও ইস্মি তখন একটু আকটু তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যেটা ইজহানের একদম পছন্দ নয়। অথচ রাতেও মেয়ের নাম রাখা নিয়েও ইস্মি ধমক দিয়েছে ওকে। রাগ দেখিয়ে একা একা ঘুমিয়েও পড়েছে। কয়েকবার মেয়েকে উঠে যখন খাইয়েছে তখন খেয়াল করেছে ইজহান ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। সারারাত মেয়েকে পাহারা দিয়েছে আর নিজে জমিয়ে রাখা কাজ দেখেছে। ইস্মি অতোটা পাত্তা দেয়নি ওকে। মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ওর মনোযোগ না পেয়ে ইজহান অবশ্য কিছুই বলেনি। মেয়েকে খাইয়ে ইস্মি যখন শুয়ে পড়ল আবার, সে-ও এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। তবে ইস্মির পাশে নয়, ওর পায়ের নিচে। কিছু বলবে ভেবেও ইস্মি আর বলেনি। কী দরকার, এতো রাতে লোকটাকে ঘাঁটানোর? সুযোগ পেলেই তো এখন আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে উঠবে। সেজন্য কিছু না বলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটানা ঘুমিয়ে একেবারে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ইস্মির খেয়াল হলো রাতে অভিমান করে তার পায়ের নিচে শোয়ার পর এখনো লম্বা-চওড়া শরীরটা নিয়ে একটুখানি জায়গার মধ্যে ইজহান গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। নিষ্পাপ মুখশ্রীটা দেখেই ইস্মির মায়া হলো। মনে হলো লোকটাকে রাতে এভাবে না ধমকালেও সে পারতো। এমনিতে সারাক্ষণ খ্যাকখ্যাক করলে কী হবে কথা বলার তো এতোকিছু ভেবে বলে না; যা মনে আসে তা-ই বলে ফেলে! তবে গত রাতের ঝামেলার জন্য ইজহানকেও পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। মেয়ে রাতে খেতে গিয়ে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল, খাচ্ছিল না ঠিকঠাক। কেঁদেকুটে অবস্থা খারাপ করে ফেলছিল। সেজন্যই মূলত মন মেজাজ ভালো ছিল না ইস্মর। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাশে তাকিয়ে মেয়েকে একবার দেখে নিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু খেতেই হঠাৎ মেয়ের পায়ের দিকে নজর যেতেই চমকে উঠল সে। কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে ইজহানের আঙুলের সঙ্গে মেয়ের পায়ে আটকানো সরু বেল্টটা ছাড়িয়ে নিলো। মেয়ে উঠে কাঁদলে যাতে চট করেই উঠে যেতে পারে তারজন্য এই ব্যবস্থা, আর এই উদ্ভট ব্যবস্থাটা কে করেছে? মেয়ের পিতা মহামান্য ইজহান শেখ! রাগের সঙ্গে সঙ্গে ইস্মির পেট মুচড়ে হাসিও পেল। কিন্তু সে হাসলো না।সাবধানে, ধীরেধীরে একটুখানি সরে গিয়ে ইজহানের দুটো হাতের ভাঁজ সরিয়ে ওর বুকের মাঝখানে ঢুকে চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইল।
পরিচিত স্পর্শ, সুবাস নাকে ঠেকতেই ঘুমের মধ্যেও নড়েচড়ে উঠল ইজহান। হাত নাড়তে গিয়ে টের পেল সেটাকে আবদ্ধ করে কেউ তার বুকের উপর ঘাপ্টি মেরে শুয়ে আছে। সটান চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখল, তার নির্দয় রানি তার বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। গত রাতে তাকে আজেবাজে বকে যে কষ্ট দিয়েছে ইস্মিতা; সেই কষ্টের পাহাড় না ভেঙেই কাছাকাছি এসে শুয়েছে? বড্ড বাড় বেড়েছে এই মহিলার। বেশি আদর দিয়ে সে নিজেই মাথায় তুলেছে, এখন মাথা থেকে নামাতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ! নির্দয় মহিলার গ্রীবা দেশে কতক্ষণ নিজের সুখ রচনা করে আচমকাই তার ওষ্ঠাধর নিজের ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরল ইজহান, একটুও শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিলো না মেয়েটাকে। ঘুমের ভান ধরে স্বামীর মান ভাঙানোর পায়তারা করা ইস্মি প্রথমে ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পুরুষালি শক্তির সঙ্গে একটুও পেরে উঠল না সে। না পেরে ইস্মি যখন ইজহান শেখের চুলগুলো মুঠোবন্দী করে টেনে ধরল, নির্দয় মহিলাকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলল সে বিছানাতে। এরপর উল্টোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ক্রোধভরা কণ্ঠে বলল, “কাছে আসবি না।”
ইস্মি না শোনার ভান করে এবারে ওর পিঠের উপর আধশোয়া হয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে। অপরাধী কণ্ঠে বলল, “গতরাতে একটু বেশিই ধমকে ফেলেছি আপনাকে। এমন ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। আসলে মেয়ে খাচ্ছিল না তো, আমার খুব হতাশ লাগছিল! ভুল হয়েছে, আর হবে না।”
“দূরে সর।”
“সরব না।”
ইজহান চটে গেল, “কী বলেছি কানে যায়নি, না? দূরে সর, সরতে বলছি তো না কি!”
“বললাম তো আর হবে না। মাফ করে দিন না!”
ইজহান ক্ষ্যাপা সিংহের ন্যায় বিছানায় উঠে বসল। তার চোখ দিয়ে রাগের আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। আক্রোশ ভরা কণ্ঠে বলল, “এই মহিলা, তুই কী ভাবিস আমাকে? পথের কুকুর? তোর জন্য পথে পথে, জনে জনে ধর্ণা দিয়ে বেড়ানো ফকির? তোর প্রেমে মজনু আমি? দেবদাস? হ্যাঁ? শক্ত কথা দিয়ে আমার বুকটা চিঁড়ে ফেলবি এরপর ন্যাকামি করে মাফ চাইবি আর ভাববি আমি বারবার তোকে মাফ করব? গদগদ হয়ে তোর আঁচল ধরে ঘুরব? এতোটা ছাগল মনে হয় তোর আমাকে? এতোটা গুরুত্বহীন আমি? যা গুরুত্বহীনই। আমি অমনই। পাল্টাব না। সারাজীবন এমনি থাকব। এবার যা, ভেবেচিন্তে কথা বলা, মেয়ের খাওয়া দেখতে না চাওয়া, বউয়ের নামে মেয়ের নাম রাখতে না চাওয়া কোনো বুদ্ধিমান, ব্যক্তিত্বওয়ালা পুরুষ মানুষ খুঁজে নে গিয়ে। আমার আর মেয়ের ধারেকাছেও ঘেঁষবি না। তুই আমার মেয়ের মা না।”
ইস্মির বুক কাঁপছে! ভাবেনি ইজহান এতোটা জোরে ধমক দেবে। এভাবে কথা বলবে। প্রথমে ওর ভীষণ অভিমান হচ্ছিল, কিন্তু শেষ কথাগুলো যখন শুনল তখন ও হতভম্ব হয়ে গেল। চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া অশ্রুধারা লুকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, “আসলে লোকে ঠিকই বলে, কিছু কিছু মানুষ কখনো পাল্টায় না, তারা পাল্টানোর ভান করে। যখন বুঝে যায় কেউ তাকে ভালোবাসে, তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তখন সুযোগ বুঝে ছুঁড়ে ফেলে।”
ইজহান হতবাক চোখে চেয়ে রইল। কেমন যেন মাথাটা একটু ঘুরে উঠল তার। ঘাড়ের পেছনে একহাত দিয়ে মালিশ করতে করতে খানিকটা এগিয়ে এলো ইস্মির দিকে। ব্যগ্র কণ্ঠে বলল, “কী বুঝাতে চাইছ? আমি এমন কী বললাম?”
“পেটে ধরলেই মায়ের অধিকার পাওয়া যায় না; সব সয়ে ঘর করলেই স্ত্রীর মর্যাদা পাওয়া যায় না। চিন্তা নেই, আপনার বা আপনার মেয়ের কাছে আমি ঘেঁষব না, একটুও জ্বালাব না, ছুঁব না!”
কাঠখোট্টা কণ্ঠে কথাগুলো বলে ইস্মি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেটা দেখে ইজহান একটা কাচের গ্লাস মেঝেতে আছাড় মারতেই সেটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। সেই শব্দে ইজহান শেখের ছোট্ট মা ভয় পেয়ে অস্ফুটস্বরে শব্দ করতেই ইজহান তাকিয়ে দেখল, মেয়ে জেগে গেছে। এই মুহূর্তে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ইজহান চট করে মেয়ের কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “তুমি কি ভয় পেয়েছ মা?”
পিতার কথা শুনে মেয়ে এবার ভ্রু কুঁচকে নিলো, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নিজের একটা হাত নাড়াল। ইজহানের মনে হলো মেয়ে তাকে বলছে, ‘সে ভয় পেয়েছে।’ একটা খারাপ লাগা অনুভূতি কাজ করল তার মনের মাঝে। ঢোক গিলে বলল, “ইস্মিতা দায়ী এসবের জন্য, আমার দোষ নেই। আমি তো ভালোই থাকতে চাই, তোমার মা কীসব করে যেন আমাকে রাগিয়ে দেয়। আমি পারি না নিজেকে সামলাতে আম্মাজান, কিছুতেই পারি না।”
মেয়ে আগের মতোই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে বিস্ময়। ইজহান প্রথম দিনের মতো লজ্জা পায়। ফিসফিস করে বলে, “ইস্মিতা খুব খারাপ, তোমার পাপাকে ভালোবাসে না। কথায় কথায় অপমান করে, আঘাত করে। ওর কাছে ঘেঁষো না তুমি। কোলেও উঠো না। পাপা আছি তো এসবের জন্য। তোমাকে কোলে নেব, ঘুম পাড়াব, খাওয়াব, আর খুব খুব ভালোবাসব। নিজের থেকেও বেশি।”
বলতে বলতে ঝুঁকে বসে মেয়েকে কোলে নিতে গেল সে, কিন্তু তুলতেই গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়ে দিলো মেয়ে। ইজহান চমকে উঠে মেয়েকে বুকের ভেতররই ঢুকিয়ে ফেলে পারলে! কিন্তু মেয়ের কান্না তাতে আরো বেড়ে গেল। কী করবে বুঝতে না পেরে ইজহান বাধ্য হয়ে মেয়েকে আগের জায়গায় শুইয়ে দিলো, তাতে অবশ্য লাভ হলো। মেয়ের চিৎকার থামলো। হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে কাঁদল, আগের চেয়ে কম। ইজহান স্বস্তির শ্বাস ফেললেও টের পেল তার বুক ধকধক করছে৷ গা ঘামছে। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে। হাতের পৃষ্ঠ দ্বারা সে তার কপাল মুছে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসল। মেয়ের কান্নাকাটি দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল, “কাঁদুনি পুতুল!”
°
গত তিনদিন ধরে সৃজা আরসালানকে লক্ষ্য করছে। অবশ্য ইচ্ছে করে যে করছে তা নয়। না চাইতেও তার সামনে এমনসব কান্ড ঘটছে যে আরসালানের কর্মকান্ডের প্রতি সে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। যেমন, এই নিয়ে তিনদিন সে রাত্রিবেলা বারান্দায় গেলেই দেখেছে পুকুরপাড়ে একটা না একটা অদ্ভুত কান্ড করছে শেখ বাড়ির ছোটো পুত্র। প্রথমদিন কেমিকে নিয়ে সুইমিং করলেও পরেরদিন করেছে ফিশিং আর বারবিকিউ পার্টি। যেটা সে একা একাই করেছে কেমিকে সঙ্গী করে। তৃতীয় দিন টেন্ট বসিয়েছে। দুটো নারকেল গাছকে ভিত্তি করে হেমক লাগিয়ে সেখানে শুয়ে রাত পার করেছে। চতুর্থদিন পাড়ে একশো একটা জারুল গাছের চারা এনে লাগিয়েছে। লাগিয়েছে লাগাক। কিন্তু তাই বলে এমন একটা সময়ে? যেখানে রাতের শেষ আর দিনের শুরুই হয়নি? ইহসান যত যাই বলুক, ভাইয়ের মতোই দেখেছে সৃজা ওকে। সে হিসেবে কেন যেন সৃজার মায়া জন্মেছে আরসালানের প্রতি। মনে হয়, লোকটা আসলেই খুব একা। আর একাকিত্ব থেকেই তার এই অবস্থা! বাড়ি ভর্তি এত এত মানুষ, কে নেই? মা। তাছাড়া তো ভাই-বোন, বাবা…সবাই আছে। এরপরেও লোকটা নিজের ঘরেই পড়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। খাবারটাও সময়মত খায় না, ডাইনিংয়ে বসে খায় না, কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলে না। সারাক্ষণ যেন ঢুলে, রাতেই একটু স্বাভাবিক দেখা যায়। যতবার খাবার খেতে দেখেছে ততবার ইমরানকে দেখেছে ওকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছে। মেঝো ভাইয়ের হাতে বেশ তৃপ্তি নিয়েই যেন খায় লোকটা। আরো যা চোখে পড়েছে তা হলো, প্রথম কয়েকদিন বেশিরভাগ সময় কেমিকে নিজের ঘরেই আটকে রাখতো, ততোটা বের হতে দিতো না। কিন্তু গত দু’দিন ধরে কেমিকে সে বের হতে দিচ্ছে। বলে দিয়েছে যে, তার কেমিকে যাতে কেউ টাচ না করে। এরপরও নিজেদের সামলাতে না পেরে এলিজা, শারাফ আর চাকরের ছেলেটা ধরেছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে ঐ ছেলেটাকে উত্তম-মধ্যম দিলেও শারাফ, এলিজাকে কিছুই বলেনি লোকটা। সেজন্য সৃজার ধারণা, আরসালানের মানসিক অবস্থাটা খুব গুরুতর। অতিসত্ত্বর চিকিৎকের শরণাপন্ন না হলে শোচনীয় অবস্থা হতে পারে। তবে আজিজ পুত্র যে খুব খারাপ তাও না। একই সাথে ভালো, খারাপ দুটো গুণই আছে। তবে খারাপটাই বেশি। যেটা তার দু-একটা ভালো কাজকে ঢেকে দেয়! এসবে অবশ্য সৃজা ইহসানের সতর্ক বার্তা ভুলে যায়নি। সে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলে আরসালানের কাছ থেকে।
তবে আরসালানের এই উচ্চ অহংকারী বা অদ্ভুত স্বভাব এ বাড়িতে একজনের বিরক্তির কারণ হচ্ছে। সে হলো ইমরানের স্ত্রী মিতু। সামনাসামনি কিছু বলতে না পারলেও রান্নাঘরে এসে সে তার ক্ষোভ ঝাড়ে। কেন তার স্বামীর হাতে খাবে আরসালান শেখ? তার কি হাত-পা নেই? যথেষ্ট আছে। অথচ সেসব তো কাজে লাগায়ই না, উল্টো পরে পরে ঘুমায় সারাদিন। যত্তসব বিগড়ে যাওয়া লোক। তার স্বামীকেই পেয়েছে৷ আহারে তার সরল সিধা স্বামী! মুখফুটে বাপ, ভাইদের কিছু বলে না দেখে তাকেই পেয়ে বসেছে। মিতু অবশ্য আরেকজনের উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। সে হলো এলিজা। তার বোন লিথু যখন এ বাড়িতে আসতো তখন যেন সবার মুখে ছাই পড়তো। আর বড়ো বউয়ের বোন এসেছে; সুন্দরী, মিষ্টভাষী দেখে মেয়েটাকে সবাই কত গদগদ করছে। এলিজা, এলিজা বলে চাকর-বাকররাও তাকে মান দিচ্ছে। আর বোবা বড়ো বউ ইস্মির ভাই আকাশ! সেও এ বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করেছে ভাগ্নিকে দেখবে বলে। সে এলেও সবার কঈ খুশি!পুনমের ছেলেদুটো তো হৈ হৈ করছে রীতিমতো! যা দেখে আরো গা জ্বলে মিতুর, ইচ্ছে করে দুটোর গালেই থাপ্পড় বসিয়ে দিতে।
এদিকে বিয়ের এতদিন পরেও তাদের কেন বাচ্চা নেই? সে কি বাজা নাকি? বড়ো দুই বউ বাড়িতে বাচ্চা দিয়ে তো রানি বনে গেছে, আর মিতু হয়েছে চাকরানি। এটা গতরাতে ঝগড়ার সময় ইমরান বলেছে। যে ইমরান বিয়ের এতদিনেও মুখফুটে ‘টু’ শব্দটাও করেনি তার সঙ্গে, সে আজকাল বাচ্চা চাই বলে বলে ওর মাথা খেয়ে দিচ্ছে! মিতুর মনে হচ্ছে এ বাড়িতে শুধুমাত্র সে-ই একা পড়ে গেছে। সব তার শত্রু, বিশেষ করে বড়ো বউ সৃজা। বরের ভালোবাসায় যেন মাটিতে পা-ই পড়ে না। এই মেয়ের জন্যই তার বাপের বাড়ির কেউ এ বাড়িতে আগের মতো আসতে পারে না। আর
ওদিকে তার বোনটা? তপনটাকে বিয়ে করে ডিভোর্স দিয়ে, এখন জেলের ভাত খাওয়াচ্ছে পেটে আড়াই মাসের একটা বাচ্চা নিয়ে! রাগে-হিংসায় রীতিমতো গা জ্বলে মিতুর আজিজ পুত্রদের এত্ত সুখ দেখে।
°
সেই তখন ঘর থেকে বের হওয়ার পরে ইস্মি আর ঘরেই আসেনি। মেয়েটার সঙ্গে যে খুব ভালো কিছু করেনি তা বুঝতে পেরেই ইজহানের নিজের উপর বেশ রাগ হলো। কেন বলল সে এসব অবান্তর, অযৌক্তিক কথা? কেন বলল, ইস্মিতা তার মেয়ের মা না? তাদের কাছে যেন সে না ঘেঁষে? সে কেন এত কষ্ট দেয় ইস্মিতাকে? এসব ভেবে মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় ইজহানের। নিজের উপর তিক্ততা আর অপরাধবোধ থেকেই সে মেয়ের দিকে নজর দেয়। মেয়ে তখন শুকনো মুখে, ক্ষিধে নিয়ে ছটফট করে জানান দিচ্ছে তার এখন মাকে প্রয়োজন, পাপাকে না। মেয়ের দৃষ্টির মমার্থ এমনই ভেবে নিয়েছে ইজহান। আর তাইতো সে মেয়ের কোমল, ছোট্ট পা দুটো ধরে অনেকবার ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু মেয়ে তাকে ক্ষমা করেছে কি না সে বোঝেনি। তবে মেয়েকে তার বুকের দিকে বারবার মুখ গুঁজতে দেখে লজ্জার সঙ্গে সঙ্গে এটাও টের পেল, সন্তানের থেকে মাকে কেন দূরে রাখা অনুচিৎ! অতঃপর মেয়েকে নিয়েই সে খুঁজতে বেরিয়েছে ইস্মিকে। পেয়েছে রান্নাঘরে। সালেহা বেগমের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করছে। যেদিন থেকে ইজহান জেনেছে ইস্মিতার গর্ভে তার একটা প্রতিদ্বন্দ্বী লালিত হচ্ছে, সেদিন থেকেই তার রান্না, কাজকর্ম সব বন্ধ। ইস্মির রান্না ছাড়া যে ইজহানের মুখে ভাত রুচতো না সে স্ত্রীর গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা অন্যের হাতের রান্না খেয়ে কাটিয়েছে। তবে অন্যের হাতের রান্না খেয়ে যে তার পোষাচ্ছে না, সেটা ইস্মি ঠিকই বুঝতে পারতো। তাই মাঝেমধ্যে ইজহানের অনুপস্থিতি সে নানাপদ রান্না করে রাখতো, খাওয়ার সময় চেনা স্বাদ পেয়ে সন্দেহী চোখে ইজহান তাকাতো ওর দিকে, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতো। কিন্তু ইস্মি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে বা বুঝতে দিতো না এসব সে রেঁধেছে। তাই এই গোপনীয় তথ্যটি এখনো অজানা ইজহানের। প্রেগ্ন্যাসি জার্নির শেষে এই প্রথম ইস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকেছে। তাও আবার তার অবাধ্য হয়ে। রাগ হলেও মেয়ের স্বার্থে ইজহান তা প্রকাশ করল না। বরংচ মেয়েকে নিয়ে বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল, কাশি দিয়েও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। কিন্তু ইস্মি তাকাল না। একমনে রুটি বেলতে আর সেঁকতে লাগল। যেন স্বামী-সন্তানের চেয়েও তার কাছে এই কাজটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ!
°
শেখ বাড়ির দোতলাটা বহু বছর আগে আজিজ শেখ ছেড়ে দিয়েছেন তার সন্তানদের জন্য। লম্বা করিডোরের দখিনে থাকা ঘরটা ছিল তার প্রিয়তমা স্ত্রী, তার চার সন্তানের মা এমিলি ইয়াসমিনের; যেটা এখন ইহসানের। আর তার বিপরীতে থাকা ঘরটা হলো ইজহানের শোয়ার ঘর। আরেকটা বড়ো ঘর অবশ্য আছে, একেবারে শেষ মাথায়। সেটা আরসালান ইনজান শেখের। যেটাতে কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি পুনমের নিজস্ব ঘরটাও দোতলায় অবস্থিত। বলতে গেলে ইমরান-মিতু, আজিজ শেখ, আর গেস্টরুমগুলো ছাড়া সকলের ঘরই দোতলায় অবস্থিত। বহুদিন বিদেশে অবস্থান করা আরসালানের ঘরটা এতোদিন লক করা ছিল, সেই সঙ্গে বিয়ের পর বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করা পুনমের ঘরটাও। সপ্তাহান্তে চাকর দিয়ে ঘরদুটো পরিষ্কার করে রাখতেন আজিজ শেখ। তবে এখন যেহেতু ছেলে-মেয়ে বাড়ি এসেছে তাই তাদের ঘর খোলা হয়েছে। এদিকে বাড়িতে আসার পর পুনম বাড়ির সবার সঙ্গে মিলেমিশে, আনন্দ করে কাটালেও রাতটা থাকে সালেহা বেগমের সঙ্গে। আজিজ শেখ নিজেই অবশ্য সালেহা বেগমকে অনুমতি দিয়েছেন মেয়ের সঙ্গে থাকতে। দুটো ছোট বাচ্চা সামলানো তো আর মুখের কথা না। যদিও শারাফ যথেষ্ট ভদ্র, দুষ্টু বাচ্চা না। তবে শামির একটু চঞ্চল। আর রাত হলেই বেশি জ্বালায় মাকে। তাই পুনম মাকে নিয়েই থাকে সাথে। রাতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে মা-মেয়েতে মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করে কাটায়। পুনমের পাশের ঘরটাতে থাকছে নীলু বেগম আর এলিজা। গত
রাতে তাদের সঙ্গে শুয়েছে শারাফ। কারণ এলিজা আন্টির সঙ্গ সে খুবই উপভোগ করছে। দু’জনে মিলে রাতে-‘দ্যা জঙ্গল বুক’ মুভি দেখেছে। এবং প্ল্যান করেছে আজকের দিনে তারা কী কী করে কাটাবে সেসব! ঘুম থেকে উঠতে পারেনি সে সকালে, এলিজা আন্টি ডেকে দিয়েছে ওকে, নিজ হাতে ফ্রেশও করিয়ে দিয়েছে, ফিডারও বানিয়ে খাইয়েছে। নীলু ফুপিকে বলতে শুনেছে এখন সাড়ে দশটা বাজে। এলিজা আন্টির ঘর থেকে মায়ের ঘরে যেতে গিয়ে দেখল, ইজু মামা বোনকে কোলে নিয়ে করিডোরে পায়চারি করছে। বোন কাঁদছে। অথচ মামা তাকে শান্ত করাতে পারছে না। শারাফের ভ্রু কুঁচকে এলো। ছোটো বাচ্চাদের কান্না একদম ভালো লাগে না, কেমন যেন কষ্ট হয় তার। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে সান মামার মেয়ে আজওয়া কাঁদলে। ঐ মেয়েটা বেশি কাঁদে। আযরানও বেশি কাঁদে। শামিরের থেকেও বেশি। তবে সে খেয়াল করেছে আজওয়ার সঙ্গে টয়’স নিয়ে খেলা করলে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেও হেসে ফেলে, হাসলে আবার ওর দুই গালে দুটো গর্ত হয়। দেখতে কী সুন্দর! মাম্মা বলেছে এটাকে টোল বলে, ইংরেজিতে ডিম্পল! শারাফ মিলিয়ে একটা নামও রেখেছে আজওয়ার—টোল বতী। এই নামটা রাখতে ওকে হেল্প করেছে ওর পাপা। ইজু মামার মেয়েও সুন্দর, ওর চোখের পাপড়ি ঘন। শারাফ তারও একটা নাম রেখেছে, পাপড়! পাপড়কে সে বোন হিসেবে মেনে নিয়েছে, কিন্তু টোল বতীকে না। বোন হিসেবে পছন্দ নয় তার আজওয়াকে, বরংচ খেলার সাথী হিসেবেই বেশি পছন্দ! শারাফ গুটিগুটি পায়ে ইজু মামার দিকে এগিয়ে গেল। ইজহান তখনো ওকে খেয়াল করেনি, শারাফ ওর পরণের প্যান্ট টেনে ধরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলল। দুশ্চিন্তার মাঝেও এই মিষ্টি বাচ্চাটাকে দেখে ইজহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। বলল,
“কী রে ব্যাটা, এত সকালে কোথা থেকে এলি?”
“এলিজ আন্টির ঘর থেকে।”
“ওহ! রাতে ঘুম হয়েছে ঠিকঠাক?”
“হয়েছে।”
ইজহান ওকে নিয়ে গিয়ে বসল বসার ঘরের সোফায়। শারাফ তখনি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল, “বোন কাঁদে কেন?”
“খিদে পেয়েছে তাই!”
“ওকে খাইয়ে দাও।”
শারাফের প্রশ্ন শুনে ইজহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গোমড়ামুখে বলে, “আমার কাছে ওর খাবার নেই।”
“কেন নেই?”
ইজহান বলতে পারল না কেন নেই, সে স্মিত হাসি দিলো শুধু। শারাফ নিজের ফিডারটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা খাবে?”
ইজহান মাথা নাড়াল, যার অর্থ না। শারাফ এবার বেশ ভাবুক হয়ে গেল। একটু ভেবে নিজে থেকেই বলল,
“ও তো ছোট! ছোটরা তো আযরান-আজওয়া, শামিরের মতো খাবার খায়। তাই না?”
ইজহান মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। শারাফ বলল, “ওরা তো দু দু খায়, শামিরও মাম্মার দু দু খায়। বোনকে তুমি দু দু দাও ইজু মামা, তাহলে আর কাঁদবে না।”
শারাফের মুখে একথা শুনে ইজহান হতভম্ব হয়ে গেল। বড়বড় চোখ করে তাকাল ওর দিকে। বুঝে পেল না এই বাচ্চাটাকে সে কী বলবে! তখনি পেছন থেকে হাসির শব্দ পাওয়া গেল, ইজহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল পুনম। সে রান্নাঘরে ছিল সৃজা আর ইস্মির সঙ্গে। এতক্ষণ ছেলে আর তার মামার কথোপকথন সবটাই তার কানে এসেছে। শারাফের বোকা বোকা কথাটা শুনে পুনম আর নিজে হাসি আটকাতে পারেনি। ফিক করে হেসে ফেলেছে। সৃজা আর ইস্মিও। সিঁড়ি দিয়ে নামারত অবস্থায় ইহসান আর এলিজাও শুনে ফেলেছে শারাফের কথা। ইজহানের মুখ লাল হয়ে গেল। ভেবে কূল পেল না তার মানসম্মান এখনো আছে না কি গেছে? এসবের মধ্যেই শারাফ আরেকটা কাজ করল; সোফায় উঠে ইজহানের পরণের টি-শার্টের বোতাম ধরে টানাটানি করতে করতে বলল, ‘‘ইজু মামা, জামা খোলো! বোন খাবে!”
_____
চলবে…
#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭০
শারাফ আরেকটা কাজ করল; সোফায় উঠে ইজহানের পরণের টি-শার্টের বোতাম ধরে টানাটানি করতে করতে বলল, ‘‘ইজু মামা, জামা খোলো!
বোন খাবে!”
ইজহানের কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। থমকে গেল সে। বাচ্চা একটা ছেলে এসব কী করছে তার সঙ্গে? রীতিমতো মানসম্মান নিয়ে টানাটানি! বসার ঘরে হাসাহাসির রোল পড়ে গেল। পুনম তো হাসতে হাসতে সৃজার উপর পড়েই যাচ্ছিল, হাত ধরে আটকাল বলে রক্ষা। ইস্মির মনটা যদিও ভার ছিল, তবুও সে হেসে ফেলল। বউয়ের হাসি দেখে ভেতরে ভেতরে একটু প্রশান্তির দেখা পেলেও ইজহান বাইরে থেকে গম্ভীর থাকার ভান করল। বোতাম খোলার চেষ্টা করতে থাকা শারাফের ছোট্ট হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, “বোন খাবে না।”
“কেন খাবে না? তুমিই তো বললে ওর ক্ষিধে পেয়েছে, ও খাবে।”
“হ্যাঁ, ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু ও এসব খাবে না।”
“তাহলে কী খাবে?”
ভেতরে ভেতরে রাগ আর লজ্জায় অদ্ভুত অনুভূতিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছিল ইজহান। কিন্তু বাইরে থেকে তা প্রকাশ করল না। সে পুরুষ মানুষ, মেয়েদের মতো মিনমিন স্বভাব করাটা তাকে মানায় না। যদিও মাঝেমাঝে সে মিনমিন করে, তবে সেটা শুধু এবং শুধু তার ইস্মিতার রাগ গলানোর সময়, ওর খারাপ লাগা কমানোর সময়! হালকা কেশে শারাফের প্রশ্নের জবাব দিল, “আমি জানি না।”
“আমি জানি, ও দু দু খাবে।”
কান গরম হয়ে গেল উপস্থিত থাকা প্রত্যক সদস্যের। সেই সঙ্গে ইজহানেরও। সে এবার ঘর কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “শাট আপ, শারাফ!”
ধমক খেয়ে শারাফের ভীষণ রাগ হলো ইজু মামার উপর। পাপড় সেই কখন থেকে কাঁদছে অথচ খাবার দিচ্ছে না মামা! উল্টো তাকেই বকা দিচ্ছে? ভীষণ অভিমানে শারাফ মুখ কালো করে একবার তার মাম্মার দিকে তাকাল। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগ দিলো, “মাম্মা, ইজু মামা বোনকে খেতে না দিয়ে কষ্ট দিচ্ছে। ইজু মামা খুব পাজি, খুব খারাপ। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।”
বলতে বলতে সে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল। চিৎকার বেরুল না তবে ফুঁপাতে লাগল ঠিকই। শারাফের মতো শান্তশিষ্ট, ভদ্র বাচ্চার এই রুপ দেখে সকলেই হতভম্ব! একমাত্র পুনম ছাড়া। কেননা, সন্তানকে মা’ই ভালো বুঝতে পারে, চিনতে পারে। আর এতটুকু বয়সে পুনমও জেনে গেছে, তার বড় পুত্রের মন অত্যধিক কোমল। এই বয়সেই সে বড়দের মতো সবাইকে নিয়ে চিন্তা করে, মা-বাবার সব কথা শোনে। ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোনদেরও খুব ভালোবাসে। হোক সেটা চাচাতো, হোক সেটা মামাতো!
ইজহানের ধমক খেয়ে শারাফকে কাঁদতে দেখে ইহসান রেগে গেল। ইজহানকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করর শারাফকে এসে কোলে তুলে নিলো। আদর করে বোঝাতে লাগল ইজু মামা তাকে সেভাবে বকা দেয়নি, শুধু থামতে বলেছে। এরজন্য কাঁদার কোনো মানেই হয় না। বোকারাই এভাবে কাঁদে। শারাফ তো ভালো ছেলে, সবাইকে ভালোবাসে। সবাই কত কষ্ট পাবে শারাফ কাঁদলে? সান মামার কথায় শারাফের ফুঁপানো থামলো না, বরং কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো। বাচ্চাটা যে মনে মনে খুব ব্যথিত হয়েছে তা সকলেই বুঝতে পারল। ইস্মির বিরক্তি যেন আরো বাড়ল ইজহানের উপর৷ এতটুকু বাচ্চাকে লোকটা কাঁদায়? পাষাণ কোথাকার! পুনম, সৃজা, এসে শারাফকে কোলে নিয়ে খুব করে বোঝাল, তবুও কাজ হলো না। কথায় আছে না, নিরীহ মানুষ রেগে গেলে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে? শারাফের কান্নাটাও তেমনি হলো। সে সচরাচর কাঁদে না, তবে যখন কাঁদে তখন তাকে থামানো কষ্টসাধ্য! এলিজা এসে শারাফকে একটু বোঝাল, কিন্তু শারাফ বারবার ইজু মামা পচা বলে দোষারোপ করতেই লাগল। এসব শুনে ইজহানের খুব খারাপ লাগল। পাংশুটে মুখে মেয়ে কোলে নিয়ে বসেই রইল সে। ক্ষণে ক্ষণে তার চোখের সামনে বিভ্রম তৈরি হতে লাগল—পরিষ্কার দেখল, শারাফ আসলে কাঁদছে না।কাঁদছে তার ছেলে। সেই ছেলে, যাকে সে ঐদিন হাসপাতালের কেবিনেও দেখেছিল, তার কান কামড়ে ধরেছিল দাঁতহীন মাড়ি দ্বারা! ইজহান একটা সময় ধৈর্যহারা হয়ে মেয়েকে রেখে শারাফকে এসে কোলে তুলে নিলো, চোখেমুখে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলল, “এখনও কাঁদবি রে বাপ? কতো আদর করলাম তোকে বল তো?”
শারাফ মামার গলা জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “ক্ষিধে পেলে খুব পেটে ব্যথা করে। বোন না খেলে ওরও পেটে ব্যথা করবে। পেট ব্যথা হলে ডাক্তু সূচ ফুটিয়ে দেয়…”
শারাফের কথার প্রতুত্তরে ইজহান অনুশোচনা নিয়ে তকাল ওর দিকে। আহারে বাচ্চাটা! তার মেয়ের জন্যই তো এত চিন্তা করছিল, অথচ সে কী করল? অবুঝ শিশুটাকে ধমক দিলো। একরাশ খারাপ লাগা অনুভূতি কাজ করল তার মনের ভেতর। কিছু বলতে উদ্যত হতেই ঝড়ের বেগে আরসালান এসে ইজহানের কোল থেকে শারাফকে সরিয়ে পাশে বসিয়ে দিলো। এরপর সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ইজহানের টি-শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে শারাফকে উদ্দেশ্য করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোর মামা দু দু দিচ্ছে তোর বোনকে, তুই কেঁদে আমার মাথা খারাপ করে দিস না। হেই পুনম, তোর ছেলেকে থামা! আমার হাত কিন্তু কন্ট্রোলে থাকবে না বেশিক্ষণ। অলরেডি মাথাব্যথা হয়ে গেছে!”
ঘরভর্তি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ইজহান নিজের পাশে আরসালানকে দেখে, তার কর্মকাজ দেখে ভস্মীভূত নজরে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। খপ করে বোতামের উপর থাকা ব্যস্ত হাতটাকে চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “এটুকু বাচ্চার খাবার যোগানের সাধ্যি আমার নেই। আমি মেয়েমানুষ না, এটা তোর বোঝা উচিৎ।”
আরসালান চট করেই চুপ হয়ে ডিভাইনে হেলান দিয়ে বসে ভাবুক বনে গেল। বিড়বিড় করে বলল, “মেয়ে না, তুমি ছেলে? বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরো, মেয়ে কোলে নিয়ে ঘুরো। কেমন ছেলে তুমি?”
দিন-রাত ড্রা গের প্রভাবে থাকায় এসেছে থেকে এতগুলো দিন আরসালান নিজের ঘর থেকে খুব কমই বের হয়েছে। বের হলেও হাতেগোনা কয়েকবার, নয়তো রাত হলে বেরিয়েছে। তারা ভাইয়েরা যে চিন্তায় ছিল, তা নিয়ে তেমন কোনো বিশেষ ঝামেলাও করেনি। সৃজাকে নিয়ে যেমন কোনো ঘটনা ঘটায়নি, তেমনি পারিবারিক কোনো আনন্দানুষ্ঠান, বৈঠকের ধারেকাছেও আসেনি। কুকুরটাকেও আসতে দিতো না, আটকে রাখতো। দু’দিন যাবৎ ওটাকে একটু আধটু বের করলেও নিজে সেই আগের রুটিনেই চলছে। এমনকি তিনবেলা খাবারটাও যে কখন খায়, তারও ঠিক নেই। সেই ছেলে কি না সকাল দশটায়, ঘুমঘুম চোখে, ঢুলঢুলু অবস্থায় নিজের বাড়ির বসার ঘরে একঘর ভর্তি লোকের সামনে তার ইজ্জত মারতে এসেছে? ইজহান যেন ভীষণ বিস্মিত হলো, নিচু ও শক্ত কণ্ঠে সতর্ক করল, “ঘরে যা! তুই এখনো নেশার প্রভাবে, ঘুমের ঘোরে আছিস।”
ইজহানকে অবাক করে দিয়ে নিভু নিভু চোখে তাকাল আরসালান। জোরাল কণ্ঠে বলল, “ঘোরে না, ঘুমেই আছি। পি পেয়েছে বলে ওয়াশরুমে যেতে নিলাম, ওমনি তোমাদের হাসাহাসি, বাচ্চাদের কান্নাকাটি কানের পোকাটা মেরে দিল। রাগ হবে না ভাই, বলো? আমি কি আর সারারাত তোমাদের মতো সুখ নিদ্রায় যেতে পারি? সুখ তো ছেড়ে গেছে আমায়। পি টাও শান্তিতে করতে দিচ্ছ না এখন!”
রাগে তিরতির করে ঠোঁট কাঁপল ইজহানের, বলার মতো শব্দ না পেয়ে। সংযম হারিয়ে না সিনক্রিয়েট করে বসে সাইকোটার সাথে, এই দ্বিধায় আরসালানকে ছাড়িয়ে এক ঝটকায় সে উঠে দাঁড়াল। অশ্রাব্য দুটো গালি ছুঁড়ে মেয়েকে নিয়ে ইস্মিতার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অভিমানী ইস্মি কাঠ মুখে তাকাল স্বামীর পানে, পরপরই উল্টো ঘুরে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। তৎক্ষনাৎ ইজহান বড় বড় পা ফেলে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, মুখে কিছু না বলে মেয়েকে ইশারা করে দেখিয়ে ‘ওর খাদ্য চাই’ এমন বোঝাল। বুঝেও ইস্মি প্রতিক্রিয়া দেখাল না, মেয়েকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখল। অনেকক্ষণ যাবৎ মেয়েটা না খাওয়া, বুকের ভেতরটা হু হু করে কাঁদছে মেয়েকে একটু ছোঁয়ার আশায় কিন্তু সে মেয়েকে ছুঁচ্ছে না। কেন ছোঁবে? লাঞ্চিত হওয়ার জন্য? অভিমান আর অপরাধবোধে ক্লিষ্ট ইস্মি সিদ্ধান্ত নিলো যতক্ষণ না ইজহান নিজের ভুল শুধরে নেবে ততক্ষণ সে মেয়েকে ছুঁবে না, যেন লোকটা বুঝতে পারে ইস্মিকে ঐভাবে কথা শুনিয়ে সে কতটা ভুল করেছে, কতটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে!
ইস্মি ইজহানকে পাশ কেটে চলে যেতেই নিবে তখনি আবার ইজহান ওর পথ আটকাল। খপ করে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনেকটা জবরদস্তি করেই নিজেদের ঘরে চলে এলো। এদিকে ইস্মি রেগে বোম! বারবার ওর হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইছিল। ইজহান দরজা আটকে দিয়ে জোর করে ওকে এনে বিছানায় বসাল, নিজে বসল মেঝেতে। এরপর অনেকটা ধমকেই বলল, “অনেক তো হাসির পাত্র বানালি, এবার চল মেয়েকে খাওয়াবি।”
প্রথমে দু’বার জবাব না দিলেও তৃতীয়বারের মাথায় ইস্মি কাঠ কাঠ গলায় বলল, “অযথা আমাকে ঘাঁটাবেন না, আমি মেয়ের কেউ না। একথা আপনিই বলেছেন।”
ইজহান কী করবে ভেবে পেল না। এই কথা তো সত্যি, সে এমন কঠিন কথা দ্বারা ইস্মিতাকে আঘাত দিয়েছে , যেটা ছিল অনুচিত, মহা অন্যায়! যে অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। তবুও সে তো এতকিছু ভেবে বলেনি। ক্ষমা করে দেওয়াটাই কি উচিত না ইস্মিতার? এরপরও পাষাণী দিচ্ছে না, তাকে অপরাধী বানিয়েই রাখছে। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবুঝ চেহারা বানিয়ে নরম স্বরে বলল, “কে বলেছে এই কথা? যে বলেছে সে একটা ছাগলপাঠা, না না বলদ! উহু, দামড়া! না, তাও নয়! সে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ স্বামী, খারাপ বাবা। সে বাবা হওয়ার যোগ্যই নয়!”
বলতে বলতে গলা ভার হয়ে, চোখদুটো ভিজে উঠল ইজহানের। সঙ্গে সঙ্গে মুখ আড়াল করল সে ইস্মির শাড়ির ভাঁজে। হতভম্ব ইস্মি নড়েচড়ে উঠতেই দু’হাতে আঁকড়ে ধরল তার কোমড়৷ ভেজা স্বরে, অনুরোধের সহিত বলল, “আমার মা অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে, তুমি তাকে খাওয়াও। বিনিময়ে তার বাবা না খেয়ে থাকবে, বাজে কথার শাস্তি পাবে। তবুও তুমি তাকে খাওয়াও, আমার চেয়ে তোমাকে ওর বেশি প্রয়োজন।”
অভিমানী ইস্মির মন টলল, বুকে ঝড় তুলল। মেয়েকে ফিডিং করাতে করাতে একটুখানি কাঁদলও সে বোধহয়! ইজহান দেখল না, চুপ করে অনুভব করল।
°
সোফায় পা তুলে বসে এক এক করে সবাইকে শাণিত চোখে পরখ করছে আরসালান। কারণ এখানের সবাইকে সে চেনে না, ঐ যে কেমন হলদেটে একটা জামা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটাকেও সে চেনে না। চেনে না বললে অবশ্য ভুল হবে, সে চেনে। যখন লিলাক শেডের জামা পরে, অথবা হালকা বেগুনি! তার মা যেদিন মরে গেছিল, সেদিন এমনই বেগুনি রঙের একটা জামা পরণে ছিল। কী সুন্দর লাগছিল! বাদামি চোখের, লালচে-কালো চুলের মাকে একদম পরীর মতো দেখাচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘এটা কোন রং মাম্মা?’
আরসালানের মাম্মা সেদিন শক্ত মুখে বলেছিলেন, “ল্যাভেন্ডার।”
সেই প্রথম তার রঙ চেনা। ল্যাভেন্ডার! মাম্মা সেদিন নিজে থেকেই ফটো অ্যালবাম বের করে ল্যাভেন্ডার বাগানের ছবি দেখিয়েছিল তাকে, তার নানা, নানী, বড়ো নানা ভাইয়ের ছবিও দেখিয়েছিল। দেখে খুব কেঁদেছিল মা। ছোট্ট আরসালান হাত দিয়ে মাম্মার চোখ মুছে দিয়েছিল। সেজন্য অবশ্য মাম্মা তাকে খুব বকেছিল। কিন্তু সে একটুও মন খারাপ করেনি। বরং কাছ থেকে মন ভরে মাম্মাকে দেখেছিল সে। কোল ঘেঁষে শুয়েওছিল, কিন্তু মা তাকে চড় দিয়েছিল গালে। রাগ হয়েছিল আরসালানের। বলেছিল, ‘মাম্মা, তুমি মরে যাও!’ কে জানতো, মাম্মা তুমি মরে যাও বললেই মাম্মা সত্যিই মরে যাবে? সে আর দেখতে পাবে না? সেদিন বিকেলেই আরসালান তার মাম্মাকে ল্যাভেন্ডার রঙের জামাটা পরেই ছাদ থেকে পড়ে যেতে দেখল! ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে যখন মরে গেল; আরসালান দেখেছিল, মায়ের সারা শরীর চুপচুপে হয়ে গেছে রঙিন তরল দ্বারা। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কী?’
বাবা বলেছিল, ‘রক্ত।’
‘এমন কেন?’
‘রক্ত এমনই হয় আব্বাজান— লাল!’
দ্বিতীয় রঙটা চিনিয়েছিল তাকে তার বাবা, আজিজ শেখ নামক মানুষটি। আর এই লাল রঙ খুব মানায় ঐ মেয়েটিকে, শারাফকে ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে!
আরসালান চোখ চেপে ধরে হাসে। বলে, ‘এই! তোরা সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার পি করা দেখবি? দেখলে দেখ! এই যে এই, ল্যাভেন্ডার আর লালপরী! তোমরাও দেখবে? আচ্ছা দেখো, আমি একটুও হ্যাজিটেট ফিল করব না।’
উঁচু কণ্ঠে অবলীলায় অবান্তর, নোংরা, বাজে বকল আরসালান। লজ্জায় পড়ি-মরি করে চাকর-বাকরদের একেকজন ছুট লাগাল। সৃজা, পুনমকে নিয়ে সরে এলো। সকলে অপ্রস্তুত! কেউ আর ভেবে দেখল না আরসালান কাকে ল্যাভেন্ডার আর লালপরী সম্বোধন করেছে,
শুধুমাত্র একজন ছাড়া!
এলিজা, শারাফের মতো বাচ্চাটা এখানে উপস্থিত। এদের তোয়াক্কা না করে লাগামহীনের মতো এতগুলো বাজে কথা বলে ফেলল আরসালান! রুক্ষ, শীতল চোখে ইহসান তখন তার ছোটো ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে। হাতদুটো ভাঁজ করা। কয়েকটা মুহূর্ত সে চোখ সরাল না আরসালানের উপর থেকে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখে গেল ওর ঢুলুঢুলু, উদ্ভ্রান্ত অবস্থা, ঠোঁটের বাঁকা হাসি, দৃষ্টির কৌতুক আর ঔদ্ধত্য! দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত থাকার চেষ্টা করে আরসালানকে বসা থেকে টেনে দাঁড় করাতে করাতে নিচু স্বরে বলল, “আমি রাগছি।”
বেহেড আরসালান তাচ্ছিল্য হাসলো, “আমার উপর রাগ করা তো তোমার ফরজ। আর ফরজ কাজের সওয়াব থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে, এতোটাও বোকা নয় আমার ভাই। আমি জানি।”
রাগমিশ্রিত চোখে তাকালেও ইহসান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজেকে সংযত রাখল৷ ধীর কণ্ঠে বলল, “চল!”
“কোথায়?”
“তোর ঘরে!”
ঘাড়ের উপর দিয়ে এক হাত নিয়ে ইহসানকে আঁকড়ে ধরে একপা ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল আরসালান, “এ বাড়িতে আমার ঘরও আছে? অথচ এ বাড়িটা তোমাদের লিখেপড়ে দিয়ে দিয়েছে আজিজ শেখ। আর আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে মূলা।”
“যখন আমাদের লিখে দিয়েছে তখন তো জানতো না তুই আসবি।”
“ঠিক, তার মানে আমি অনাকাঙ্ক্ষিত!”
‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শব্দটি মাথায় গেঁথে গেল ইহসানের। হ্যাঁ, আরসালান ইনজান শেখ অনাকাঙ্ক্ষিত,
অনাকাঙ্ক্ষিত সে নিজে আর ইজহানও, এমনকি ইমরানও। তাহলে জান কেন নিজেকে একলা অনাকাঙ্ক্ষিত দাবি করে? কেন এই ছেলেটাকে এতগুলো বছরেও সে বোঝাতে পারল না, যে আগুনে সে জ্বলে, তার বাকি ভাইরাও সেই একই আগুনে জ্বলে? ইহসান চুপ করে রইল। জবাব না পেয়ে আরসালান এতক্ষণ ঘোলাটে দৃষ্টি ভাইকেই দেখছিল, ভাইয়ের নীরবতায় একটু ক্ষেপে গেল সে। হাজার বার করতে থাকা একটা প্রশ্ন সে আবারও করল ইহসানকে, “এজন্যই তোমার মা আমায় ভালোবাসেনি?”
ইহসান শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, “আমি তো জানতাম না সে তোকে ভালোবেসেছে কি না!”
“কিন্তু আমি জানি!”
এই বলে সে ইহসানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’হাতে প্রথমে নিজের চুল টেনে ধরল, এরপর টি-টেবিলটাতে লাথি বসাল। যখন দেখল ওটার কিছুই হলো না, বরং পায়ে লেগেছে। তখন রাগ সীমা অতিক্রম করল তার, একপাশে সাজিয়ে রাখা আজিজ শেখের বড্ড শখের বেলজিয়াম কাচের ফুলদানিটা ভেঙ্গে ফেলল। পরপর সোফার কুশন সব ছিঁড়েছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ভাঙল কর্ণার, দেয়ালের ফটোফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের কাচ এবং সবশেষে টেলিভিশন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভাঙা কাচের টুকরোয় বসার ঘরের মেঝেটা ঢেকে গেল।
ভাঙচুরের শব্দে সারা বাড়ি তখন কাঁপছে। আজিজ শেখ বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঘরে, ইমরানও। তারা যে যেমন অবস্থায় ছিল, ছুটে এলো। এমনকি ইজহান-ইস্মিতা, সৃজা, পুনমও। এসে দেখল ভাঙা কাচের উপর মুমূর্ষু রোগীর ন্যায় বসে হাঁপাচ্ছে আরসালান। চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত। তার পরণের কালো টি-শার্টটা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। অথচ সে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে আর বুক চেপে ধরছে। প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়েই তবে সে থামল। এদিকে আজিজ শেখের চোখদুটো জ্বলে উঠল ছেলের অবস্থা দেখে। অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। বিচলিত ইমরান এসে তাকে ধরতেই তিনি ব্যগ্র স্বরে বললেন, “আমার জানের কী হইল? ও পইড়া আছে কেন? ওরে ধরো বাপজান।”
কাচের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেহাল অবস্থা। এক ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক ছেলেকে ক্ষত-বিক্ষত হতে তো তিনি দেখতে পারেন না। তাই আজিজ শেখ উচাটন ভঙ্গিতে ইমরানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না, না। তোমার ধরতে হইব না। আমিই যাই জানের কাছে। সরো, ছাড়ো আমারে।”
আজিজ শেখ ভাঙা কাচে পা রেখেই ছুটে ধরতে গেলেন পুত্রকে, কিন্তু তার আগেই ইহসান নিজে গিয়ে ধরল জ্ঞানশূন্য ভাইকে। উত্তেজিত না হয়ে একজনকে ডেকে পানি আনতে বলে ইমরানকে পাঠাল আরসালানের ইনহেলার খুঁজে আনতে। এরপর চুপচাপ বসে রইল ভাইয়ের পাশেই, তার হাত ধরে।
এদিকে আকস্মিক এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কোন্দলের মুখোমুখি হয়ে সকলেই যখন অপ্রসন্ন, অপ্রস্তুত! এলিজা তখন সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে গেল ভাংচুরের খেলায় মেতে উঠা, নিজেকে একঘরে বন্দী করে রাখা আজিজ পুত্র আর কেমির মালিককে! ভয় পাবে বলে শারাফকে নিয়ে এলিজা সেখান থেকে সরে গেল ইহসানের ইশারায়। যাওয়ার আগে আরো একবার নিষ্পলক চোখে দেখে নিলো আরসালান ইনজান শেখকে৷ যার বিড়বিড় করে বলা একটা
কথাই বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘সে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছে। মাম্মা আমায় ভালোবাসেনি, বাসেনি, বাসেনি!’
_____
চলবে….
#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭১
ছেলেটা অতি মানবীয় সৌন্দর্যের অধিকারী। তার মুখাবয়বে একবার চোখ পড়লে সেখান থেকে সহজে নজর সরানো কঠিন। কাটা দাগের ফর্সা মুখ, ধারালো চোয়াল, সুগঠিত নাক, ঘন ভ্রু, অন্ধকার রাতের তারার মতো তীক্ষ্ণ জ্বলজ্বলে দুটি চোখ; প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এমনভাবে তার মুখাবয়বে সাজানো যেন কোনো শিল্পী তার মুখটা যত্ন নিয়ে এঁকেছে। আরসালান ইনজান শেখ পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই তার মা’কে উল্টেপাল্টে এসেছে। নজর লাগার ভয়ে আজিজ শেখ ছেলেটার দিকে তাকান না সচরাচর। তাকালে অবশ্য তার প্রিয়তমা, তার সন্তানদের মা এমির কথা মনে পড়ে। এমি, তার এমি! একটা শান্ত প্রজাপতি! ডানা মেলে যে উড়ে বেড়াতো গ্রামের বনে-বাদাড়ে। একা বসে ছবি আঁকতো। বাংলা বলতে পারতো না, তবে বুঝতে পারতো। টুকটাক যা বলতো তা ভাঙা ভাঙা। গ্রামের লোকে ওর বাংলা শুনে হাসলেও মুগ্ধ হতো আজিজ শেখ! সেই মুগ্ধতা থেকেই তো তার পিছু নেওয়া, সমাজ, সংস্কারের বাঁধা ডিঙিয়ে তাকে নিজের করে নেওয়া। লোকে বলে পদ্ধতিটা ভুল, অন্যায়। অথচ ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব দেওয়ার পরেও আজিজ শেখের ভালোবাসার কদর করতে চায়নি এমি, এমির বাবা। তার বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল জীবনের দোহাই দিয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভালোবাসা কী প্রত্যাখ্যান মানে? আজিজ শেখের ভাষ্যমতে তো না। আর সেজন্যই তো জবরদস্তি করা। এসবে তো নিজের কোনো ভুল খুঁজে পান না তিনি!
শান্তশিষ্ট, বাদামি চোখের সুন্দরী রমণী। যার পেলব দেহ আর লালচে কালো চুলের ভাঁজে তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন এক পৃথিবী সুখ! এমি চলে গেছে বহুদিন আগে, তাকে ছেড়ে, তার ছেলেদের ছেড়ে। যাওয়ার আগে শাপ দিয়েছিল, যে তার বাবাকে মৃত্যু নামক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়ে, তাকে পরিবার, সমাজের কাছে কলঙ্কিত করে তার জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছিল, সেই লোকটার আলোভরা জীবনটা যাতে তলিয়ে যায় গহীন অন্ধকারে। একাকিত্ব, শূন্যতা যাতে গ্রাস করে নেয় তার থেকে সব ছিনিয়ে নিয়ে।মূলত এমি চেয়েছিল তাকে শাস্তি দিতে। যে শাস্তিতে আজিজ শেখ নামক অমানুষটা সব হারিয়ে পদে পদে ভুগবে, একা হয়ে যাবে সেই শাস্তি!
এমির ভাবনার পরিধি ছোট ছিল, অনেকটা অবোধ শিশুর মতো। কিন্তু আজিজ শেখ তো অবোধ নয়। জেদি, আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজ স্বার্থে অটল থাকা, একজন মানুষ। আর সেজন্যই তো তিনি একা হয়ে যাননি। একাকিত্ব তাকে গ্রাস করতে পারেনি। কারণ তার কাছে ছিল অমূল্য রত্ন! এমিরই গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া তার নিজের রক্ত, তার সন্তান— চার চারটা পুত্র। যাদেরকে তিনি অন্ধের মতো ভালোবাসেন। যে ভালোবাসার পরিমাপ করা অসম্ভব! এমির দেওয়া এতো দামী উপহারগুলো থাকতে এমি ভাবলো কী করে তার মৃত্যুতে আজিজ শেখ একা হয়ে পড়বে? বোকা নারী! আফসোস!
নিঃস্তব্ধ কেবিনটার সাদা চাদরে আবৃত সিঙ্গেল বেডটায় শোয়ারত অক্সিজেন মাস্ক পরিহিত ধীরেধীরে উঠানামা করা পুরুষালি পশমাবৃত বুকটার দিকে তাকিয়ে পঞ্চাশোর্ধ আজিজ শেখ চক্ষু জুড়ান হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ছোঁন। ঘামে লেপ্টে যাওয়া চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে আরসালানের মুখপানে তাকিয়ে থাকেন। বুকে জাপ্টে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে ছেলেকে। অথচ তিনি তা করেন না। বরং ছেলের শিয়রে এসে বসা এমিকে দেখেন। কমবয়েসী সুন্দর একটা মুখ। গালে লালচে আভা। এলোমেলো, জট পাকানো রুক্ষ চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। মুখটা মলিন অথচ ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। আজিজ শেখ চমকালেন না। কেননা, তিনি জানেন এটা বিভ্রম। মাঝেমাঝেই বিভ্রম হয়ে তার কাছে আসে এমি। কত শাপ-শাপান্ত যে করে, ভালোই লাগে তার।তবে এবার এমি এসেছে অনেকদিন পর। আজিজ শেখ হেসে উঠেন, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন, “এই এমি! অনেকদিন পর আসছ যে, এখনো দেখি খোঁজ রাখো?”
এমি চোখ তুলে চায় তার দিকে, তীব্র একটা ঘৃণার চাহনি ছুঁড়ে পরক্ষনেই মুখটা নামিয়ে আরসালানের পানে তাকায়। আজিজ শেখ সেই চাহনি দু-চোখ ভরে দেখে, বিতৃষ্ণ মনটাকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। আরসালানের নিথর হাতটা মুঠোয় নিয়ে এমির দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলেন, “তুমি নাই, তুমি থাকবা না, তোমারে পাব না বললে কী হবে, এইতো তুমি আছ, আমিতো একা হয়ে যাই নাই। হবও না। যতদিন এরা আছে, আমার সন্তানরা আছে! বরংচ তুমিই ভুল ছিলা বোকা মহিলা, আস্ত বোকা। তাই প্রেম বুঝো নাই, ভালোবাসা বুঝো নাই। বুঝছ নিজের জেদ! এই জেদই তোমারে খাইছে। আচ্ছা, এখন যেইখানে আছ, সেইখানে ভালো আছ তো? ভালোই থাকবা। সেইখানে তো আর আমি নাই। তাছাড়া আমার ছেলেগুলোরে কষ্ট পাইতে দেখলে, ক্ষতি দেখলে নিশ্চয় তুমি ভালোই থাকো, তাই না এমি? কিন্তু আমি তো আমার ছেলেদের ক্ষতি সহ্য করতে পারি না। ওদের একটা আঁচ লাগলেও আমার কলিজা ছিঁড়ে যায়। আমার উত্তরাধিকাররা দুর্বল হোক এটা আমি চাই না। তবে হাজার হোক, ভালো না বাসলেও ওদের শরীরে তো তোমার রক্তও বইছে। এমন পাষাণ হও কীভাবে এমি?”
আজিজ শেখ অপেক্ষা করতে থাকেন এমির জবাবের, অথচ তা আসে না। এমি পাথরের মতো মুখ করে আগের মতোই বসে থাকে। আজিজ শেখ হঠাৎ করে রেগে যান এমির উপর। বলেন, “মনে আছে, জানের জন্মের পর কী করছিলা? এক বোতল সিরাপ খাওয়াই দিসিলা ওরে! পাষাণী… এতটুকু বাচ্চারে তুই মারতে চাইছস! আমার বাচ্চারে! কত্ত বড়ো কলিজা তোর এমি…”
কথা জড়িয়ে আসতে চায় ক্ষিপ্ত আজিজ শেখের। তাই তিনি শক্ত করে ছেলের হাতটা চেপে ধরলেন, মুখ থেকে বের হলো ভাঙা স্বর, “আমি না থাকলে সেইদিন..আমার বাচ্চাটা মইরা পইড়া থাকতো। বাচ্চা তো তোমারও!”
আজিজ শেখ ব্যাকুল হয়ে উঠেন। অথচ এমি তাকায় না, কোনো কথা বলে না, উঠে চুপচাপ চলে যায়। আজিজ শেখ অপলক নয়, হিসেবি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। সাতাশের এমিলি ইয়াসমিনের বিভ্রমটা আস্তে-ধীরে অনেক দূরে চলে যায়। আজিজ শেখ নিরাবেগ, যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে চোখ বুজে ফেলেন।
_______
দরজাটা কাঠের। তার মাঝখানটায় জানালার মতো একটা ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে, যেটা কাচ দিয়ে আবদ্ধ। বাইরে থেকে ঐ একটুখানি অংশ দিয়েই ভেতরের পুরো ঘরটা দেখা যায়। একটা সাদা চাদরে মোড়ানো সিঙ্গেল বেড, তাতে আটকানো সরু লম্বা একটা লোহার স্টিক, তাতে স্যালাইন ঝোলানো। একপাশে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার, বেডসাইড টেবিল সাজানো। অন্যপাশে হৃদপিণ্ডের গতি পরিমাপক মেশিনটা বিপ বিপ শব্দ তুলছে…
ছোট্ট কাচটা ভেদ করে বেডে শোয়ারত নির্জীব ভাইটাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখছে ইহসান। একশো চার ডিগ্রি জ্বর, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা আর সেইসঙ্গে অতিরিক্ত নে শাদ্রব্য গ্রহণের ফলে নানাবিধ জটিলতা নিয়ে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে আছে ইনজান শেখ। ইহসান হাতে থাকা রিপোর্টটার দিকে তাকায়, যেটা একটু আগেই সে ল্যাব থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। জ্বর নিয়ে অতিরিক্ত
কো কেইন গ্রহণের ফলে শরীরে অক্সিজেনের সঠিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে হাইপোক্সিয়া দেখা দিয়েছে আরসালানের। চিকিৎসক জানিয়েছে, রাতটা হাসপাতালে কাটাতে হবে।
ভারি পাল্লার দরজাটা ঠেলে হাতে থাকা রিপোর্টগুলো নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলে শব্দ শুনে আজিজ শেখ চোখ তুলে তাকায়। দেখেন, তার অবাধ্য বড়ো ছেলে ইহসান এসেছে। তার মুখ গম্ভীর, মলিন। চোখদুটো টকটকে লাল, কেমন যেন প্রাণহীন! অথচ কাজে-কর্মে, দায়িত্ববোধে কমতি নেই। ছোটো ভাইকে সহ্য করতে পারে না এমনটা শুধু মুখেই বলে। সারাদিন যেভাবে ওকে নিয়ে অস্থির হয়েছে, ছোটাছুটি করেছে তাতে আজিজ শেখ বড়ো ছেলের উপর মাত্রাতিরিক্ত সন্তুষ্ট। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন
তবে ইহসানের মলিন মুখটা দেখতে ভালো লাগে না তার। উঠে ছেলের কাছে যান। টিস্যু দিয়ে ঘর্মাক্ত কপাল, মুখখানি মুছে দেন। ইহসান বাঁধা দেয় না। এক বোতল পানিও ধরিয়ে দেন ওর হাতে, বিনিময়ে ওর হাতে থাকা আরসালানের টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকেন। এ সময়টাতে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাল তাকে। অস্থির কণ্ঠে প্রশ্ন করেন ইহসানকে, “ডাক্তার কী বলল? জটিল কিছু?”
“কেন? হলে ভালো হতো?”
আজিজ শেখ তাজ্জব বনে গেলেন, “মানে কী বোঝাতে চাইতেছ তুমি? আমি খুশি হব জানের কিছু হইলে?”
“বোঝাতে চাইছি না, এটাই বুঝাচ্ছি।”
“ও আমার জান—আর ওর অসুস্থতায় আমি খুশি হব? পাগল হইছ তুমি? দেখ আব্বাজান, মন ভালো না। আলতু-ফালতু কথা বইলা মেজাজটার দফারফা কইরো না।”
ইহসান ঠান্ডা চোখে জন্মদাতার দিকে তাকাল, তার চেয়েও শীতল কণ্ঠে বলল, “আপনি যদি আমাদের বাপ না হতেন, আফসোস! আমার ভাইটার জীবন এভাবে হেলায় যেতো না। মাঝেমাঝে মনে হয় জন্মের আগে কোনো পাপ করেছিলাম যার দরুণ আপনি আমাদের বাপ। নয়তো আমরা কেন আপনার ঘরে জন্ম নিলাম বলুন তো?”
আজিজ শেখ স্তব্ধ হয়ে গেলেন ইহসানের মুখে এমন তিক্ত সত্য শুনে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। ঠোঁটদুটো শক্ত করে চেপে রাখলেন, যেন নিজের রাগকে আটকে রাখছেন। কয়েক সেকেন্ড পর ফস করে বলে উঠলেন, “আমি এতো খারাপ বাপ?”
ইহসান চোখ সরাল না, বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল,
“ভালোবাসার স্বার্থে একজনের জীবন নষ্ট করেছেন, তার সন্তানদের এক অসম্পূর্ণ পৃথিবীতে ফেলে রেখেছেন। আপনি শুধু আপনার উগ্র ভালোবাসা দেখিয়েছেন, দায়িত্ববোধ না। তাহলে আজ ওকে এমন অবস্থায় দেখতে হতো না। আমার মা…”
কথাটুকু সমাপ্ত করার আগেই আজিজ শেখ এবার গর্জে উঠলেন, “তোমার মা থাকলে কী করত বল? জানের এমন অবস্থা হইতো না? জানো, তোমার মায়ের কেমন চিন্তাধারা ছিল? ও কী চাইত? নিজের মতো করে বাঁচতে, আঁকতে, উড়তে, আমারে ছাড়তে… আমি শুধু ওরে বেঁধে রাখতে চাইছিলাম আমার সংসারে, আমার সন্তানদের মা করে। এইটা কি দোষ?”
ইহসান রোষপূর্ণ চোখে তাকাল, “হ্যাঁ, দোষ! কারো স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া দোষ। তাকে ভালোবাসার নামে বেঁধে রাখা, জোর করা, বদনাম করা; সবই দোষ। মূল কথা, আপনি ভালোবাসেননি, দখল করেছেন।”
আজিজ শেখ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন এরপর বললেন, “তুমি আমারে ঘৃণা কোরো, আমি জানি। কিন্তু তুমি জানো না, তোমাদের জন্য আমি কতো কিছু হজম করছি, কতো কিছু ছাড় দিছি।”
“আপনি যা দিয়েছেন—আদর্শহীন ভালোবাসা, প্রশ্রয়, দম্ভ! সবকিছু ইনজানের জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে।”
আজিজ শেখ সংকট পূর্ণ চোখে তাকাল, “তছনছ?”
“হয়নি বলছেন?”
প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা না করে ইহসান বেরিয়ে আসে। তার ভেতরটা কেমন অদ্ভুত যন্ত্রণায় পুড়ছে। কেমন নিঃস্ব নিঃস্ব মনে হচ্ছে। এমনটা হচ্ছে জানের কথাগুলো শোনার পর থেকে। ছেলেটার একটাই অভিযোগ, তাকে কেউ ভালোবাসেনি।
ভালোবাসেনি, অদ্ভুত! এ জগতে কে আর কাকে
বিনা স্বার্থে ভালোবাসে? আপন মানুষ ছাড়া? বাপ আছে—নামে মাত্র! ভালোওবাসে লোকটা ছেলেদের, অথচ ছেলেরা সেসব অনুভব করতে, স্বীকার করতে চায় না। জানকে কে বোঝাবে এসব? ইহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। করিডোরের ওয়েটিং চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। পকেটে থাকা ফোনটা ভ্রাইবেশন হচ্ছে অনুভব করে চেক করে কল ব্যাক করে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটা সুন্দর নারীমুখ, যা দেখে বুকের ভেতরটা শীতল ঠেকে তার। ইহসান শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “ওড়না গলায় প্যাঁচিয়ে বসে আছিস কেন? টান খেলে তো মরে যাবি।”
“উফ, খেয়াল নেই। তোমার ছেলের যন্ত্রণায় কিচ্ছু খেয়াল নেই৷” বলতে বলতে সৃজা ওড়নাটা ঠিকঠাক করে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে “ওদিকের কী অবস্থা? ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে?”
“ফিরেছে, তবে এখন ঘুমাচ্ছে।”
সৃজা স্বস্তি পায়, “যাক, দুশ্চিন্তামুক্ত করলে। জানো তো, আন্টি যা কান্নাকাটি করছিল…”
কথার মাঝখানেই ওকে থামিয়ে দিয়ে ইহসান গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে, “সৃজা?”
অপলক চেয়ে জবাব দেয়, “হু?”
“জান এডিক্টেড! বিষয়টা জানাইনি তোকে।”
সৃজা স্মিত হেসে জবাব দেয়, “এসব নিয়ে কথা না বলি? মানুষটা অসুস্থ!”
“কিন্তু… ”
“সবচেয়ে অন্ধকার রাতও এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শেষ হয়, তাই আশা রাখি সব ঠিক হয়ে যাবে। আশা রাখতে তো কোনো দোষ নেই।”
এই মেয়েটা কখনোই, কোনোকিছুতে কঠিন হয় না। এতকিছু জানার পরেও না। ইহসান ভেবে পায় না, তার সৃজাটা এমন কেন? সে আবেশিত কণ্ঠে বলে, “সৃজা,
আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ আ লট!”
মেয়েটা হাসে, “জবাব এখন দিতেই হবে?”
“উহু, তোলা রাখ!“
“এখন রাখি? মেয়ে জ্বালাচ্ছে।”
ইহসান নিজেও হাসে, প্রশান্তিতে চোখ বুজে নেয়ম ছোটো করে বলে, “রাখ।”
তবে ফোন রাখতেই কললিস্টে গিয়ে ইহসানের চোখ কপালে উঠে। ৬১+ মিসড কল ফ্রম ইজহান। কখন দিলো এত কল? টের পেল না তো ইহসান। সে কল ব্যাক করে না, ম্যাসেজ লিখে, ‘রাতটা হাসপাতালে কাটাতে হবে। সুস্থ হলেই নিয়ে চলে আসব। বারবার ফোন করার দরকার নেই, আমি আপডেট জানাব। বাচ্চাদের খেয়াল রাখিস। উহ হ্যাঁ, আযরানের ফর্মুলাটা শেষের পথে। কাউকে একটা পাঠিয়ে আনিয়ে দিস। আমি টাকা সেন্ড করে দিচ্ছি।’
পাঁচ মিনিট পর দুটো রাগের ইমোজির সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা লেখা চ্যাট বক্সে ভেসে উঠল, ‘টাকা তোর পেছনে ভরে রাখ। তোর টাকায় আমি হিসু করি, পটি করি…’
ইহসানের ভারাক্রান্ত মনটা হাসলো একা একাই।
_______
‘তুমি আজিজের ছেলে না? কী যেন নাম? ইহসান? না আরসালান?’
দুপুর তিনটা। রৌদ্রস্নাত দিন। একরাত হসপিটালে কাটানোর পর বিল পে করা নিয়ে কাউন্টারে কথা বলতে যাচ্ছিল ইহসান। কিন্তু পেছন থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে ডাকা কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়াল। পেছনে ঘুরতেই দেখল কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে একটা লোককে দাঁড়িয়ে। পরিপাটি চেহারার সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো রঙের কোট পরিহিত লোকটাকে দেখে বিস্মিতও হলো সে। লোকটাকে সে চেনে, একসময়ের তুখোড় রাজনীতিবিদ, সাবেক এমপি সৈয়দ মোজতবার মনোজ। বংশ পরম্পরায় যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত। যার পাঁচ পুত্রের ছোটো ছেলেটাকেই আরসালান পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল…অথচ তৎকালীন এমপি হওয়া স্বত্তেও আজিজ শেখের টাকা আর ক্ষমতার কাছে তিনি হেরে পরাভূত হয়েছিলেন। অনেক বছর আগের ধামাচাপা দেওয়া ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে উঠল ইহসানের। রাশভারি স্বরে জবাব দিলো, “ইহসান, ইহসান শেখ।”
সাবেক এমপি একটু হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে, সেইসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “বড়ো না তুমি?”
“জি।”
“বাহ, বাহ! আজিজ শেখের বড় চাঁদ, ভাবসাবই আলাদা তোমার। তো আমারে চিনছ তো নাকি?”
ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তর দিলো, “জি, চিনেছি।”
“কে আমি, কও তো?”
লোকটা ভণিতা করছে বুঝতে পেরে ইহসান বিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সৈয়দ মোজতবার মনোজ। সাবেক এমপি আর বর্তমান এমপির বাবা।”
গর্বে যেন বুক ফুলে উঠল সৈয়দ মোজতবার মনোজের। তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। কাঁধ চাপড়ে দিলেন ইহসানের। চুপচাপ সেটা সহ্য করল ইহসান। ঝামেলা করার মতো মন-মানসিকতা ওর নেই। এমনিতেই আরসালানের যন্ত্রণায় মন বিক্ষিপ্ত ওর। হতচ্ছাড়াটা জ্ঞান ফেরার পর থেকেই বাড়ি যাব, বাড়ি যাব করছে। ওকে স্বাভাবিক দেখে সৈয়দ মোজতবার ভ্রু কুঁচকে ফেললেও কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়ে বললেন, “তাইলে তো এইটা ভালোই জানো যে, আমার ছোটো ছেলের সঙ্গে তোমার ছোটো ভাই পড়তো। নাম শুনছ তো ওর, সামির। সামিরের বন্ধুই তো তোমার ছোটো ভাই। তা খবর পাইলাম সে নাকি দেশে ফিরছে অনেক বছর পর! ছেলের মতো হয়, তাই ভাবলাম দেইখা আসি। কতদিন দেখি না ওরে….আগে কতো যাইতো সামিরের সঙ্গে আমাদের বাড়ি! তো হাসপাতালে কেন? বেশিই অসুস্থ নাকি ওয়?”
“তেমন কিছু না, জ্বর। দু-একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি জানেন কীভাবে?”
গলা খাকারি দিলো লোকটা, পাশের দু’জন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে হাসলেন। এরপর বললেন, “আমাদের অনেক পোষা কবুতর আছে। তারাই সব খবরাখবর নিয়া আসে। একটা উদাহরণ দেই? তোমার বাপের সঙ্গে তোমার শ্বাশুড়ির বিয়ের প্রস্তাব দিসিলো তোমার ছোটো ভাই, এমন আইকনিক ব্যাপার-স্যাপারও জানি। বুঝোই তো, রাজনীতির মানুষ আমরা। লিংক ভালো থাকতে হয় খুঁটিনাটি সব বিষয়ে!”
একচোখ টিপে গোয়ারের মতোন হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। হাসির দমকে শরীরটাও দুলে উঠল তার। কেমন চতুর একটা ভাব ফুটে উঠল চোখে। ইহসানের ভালো লাগল না, সে শক্ত মুখে তাকিয়ে রইল। ওকে ওমন মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি থামালেন মোজতবার মনোজ। খানিকটা ঝুঁকে এসে তিক্ত স্বরে বললেন, “তো তোমার ভাই কত নম্বর কেবিনে আছে? আসছি যখন দেইখাই যাই। মনটা একটু শান্ত করি। বুঝলা তো, অনেক বছরের আগুন জইমা আছে ভেতরে৷ বাইর হওয়ার জন্য টগবগ করতেসে, বড্ড যন্ত্রণা দিতেসে। ভেতরের আগুন বের করার এখনই যে সময়! তবে তাতে একটা দুঃখিত ঘটনা যে ঘটব, তা ভাইবাই মনটা খারাপ হয়ে আসছে আমার।”
ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কী বোঝাতে চান আপনি?”
“তোমার আব্বা চাইয়া চাইয়া দেখব! তার কিছুই করার থাকব না এইটাই বোঝাতে চাই আমি চাঁদ…”
মোজতবার মনোজের বিদ্রুপাত্মক কথাটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে ইহসান বোঝার চেষ্টা করে, লোকটা কী বোঝাতে চাইল!
_______
[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে….