অশ্রুবন্দী পর্ব-৭২ (শেষ অংশ)

0
1

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭২ [ক]

ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কী বোঝাতে চান আপনি?”

“সব পুড়ব, আর তোমার আব্বা চাইয়া চাইয়া দেখব! তার কিছুই করার থাকব না চাঁদ…”

মোজতবার মনোজের বিদ্রুপাত্মক কথাটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে ইহসান বোঝার চেষ্টা করে, লোকটা কী বোঝাতে চাইল! খুব ভালো কিছু যে না, সেটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো।

সৈয়দ মোজতবার মনোজ অবশ্য আরসালান ইনজানের কেবিনে প্রবেশের সুযোগ কিংবা
অনুমতি কিছুই পেলেন না৷ তার আগেই বাঁধা পেলেন আজিজ শেখের সেক্রেটারি প্রদীপ বড়ুয়ার কাছ থেকে। প্রদীপ বড়ুয়া কিছুতেই তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিলো না, বরং আজিজ শেখের হুকুম পেয়ে ভীষণ অপমান করে লোক জড়ো করে ফেললেন মুহূর্তের মধ্যে। সাবেক এম পি এবং বর্তমান এম পির বাবা হলেন মোজতবার মনোজ। সাধারণ মানুষের কাছে তার ক্লিন একটা ইমেজ আছে। যদিও সবই উপরে উপরে, ভেতরে ভেতরে শয়তানিতে তিনিও কম যান না। কিন্তু নিজের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতেই আক্রোশ আর প্রতিশোধের আগুন মনে চাপা দিয়েই তিনি হাসপাতাল থেকে প্রস্থান করেন নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে। ইহসান দেখল, রাগে ফেটে পড়া মুখখানা নিয়ে মোজতবার মনোজ চলে যাচ্ছেন। তার কানে ফোন। ফোনেই কারো উপর উচ্চস্বরে রাগ ঝাড়ছেন। রাগের চোটে তার শরীর কাঁপছে, হাত কাঁপছে। আগ্রাসী কণ্ঠে কাউকে বলছেন, “আমার বুক খালি কইরা পুত্র সুখ করে? ওর পুত্র সুখ কয়দিন টেকে আমিও দেখব।”

সন্তানহারা হওয়ার বেদনা ভাষার বাইরে। এটি এমন এক অপরিমেয় শূন্যতা, যা সমস্ত আনন্দকে শূন্যতার গহব্বরে ঠেলে দেয়। জীবনের মূলে আঘাত হানে। সময়ের সাথে যন্ত্রণা হয়তো ম্লান হয়, কিন্তু ক্ষতি থেকে যায় অমোচনীয়। মোজতবার মনোজ অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় ভাবে ছেলেকে হারিয়েছেন।
কিন্তু নিজে ক্ষমতাবান হওয়া স্বত্তেও পাননি সঠিক বিচার। অথচ যার জন্য তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন, সে দিব্যি রক্ষা পেয়ে গেছে। আজিজ শেখ তাকে আগলে রেখেছেন। কোনো একটা আঁচও তার শরীরে লাগতে দেননি। ক্ষোভ তো মোজতবা সাহেবের থাকারই কথা। কিন্তু ইহসানের কেন এতো বিরক্তি মোজতবার মনোজের উপর? কেন একটুও ভালো লাগল না বরং রাগ হলো? তার কী এতোটাই স্বার্থপরতা জন্মেছে এ লোকটার প্রতি, যেমনটা সে তার বাবার মধ্যে ঘৃণা করতো? মাসখানিক আগে
নিজ হাতে পা ভেঙে দেয়া, গুলি বিদ্ধ করা ছোটো ভাইটাকে নিয়ে একটু বেশি অন্যরকম ভাবনা ভেবে ফেলে ইহসান। আর সেটা বুঝতে পারা মাত্রই নিজের উপর তার কেমন বিতৃষ্ণা জন্মায়, ঘৃণা লাগে।

°

আরসালান এখন অনেকটাই সুস্থ, আজিজ শেখ কক্ষে উপস্থিত নেই তবে ইহসান আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষটাতে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং আরসালানের উচ্চস্বর পরিভ্রমণ করছে। বিরক্তি লুকিয়ে ইহসান জোর করে ভাইয়ের মুখে ঔষধ গুঁজে দিয়ে নার্সকে বলে, “একে এভাবে খাওয়াতে হয়, বুঝিয়ে শুনিয়ে না। এ বুঝ নেওয়ার মানুষ না। আস্ত একটা অমানুষ।”

নার্স বেচারি কতক্ষণ ‘হা’ হয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের কাজ শেষ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। যেন এখানে থাকলেই সে দু-ভাইয়ের ঝামেলার মধ্য মণিতে পরিণত হবে। এরচেয়ে যাওয়া যাক, এই আধপাগল রোগীর ব্যপার তার ভাই বুঝে নেবে। নার্স যাওয়ামাত্রই ইহসান খ্যাঁকিয়ে উঠে আরসালানের উপর। যেন সে এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল, “বদমাইশের বাচ্চা! ঔষধ নিয়েও তামাশা শুরু করেছিস, নতুন নাটক?”

বেডের একপাশে পা ঝুলিয়ে থাকা আরসালান ঘাড়ে হাত রেখে মালিশ করতে করতে হেসে উঠে, “রেগে গেলে এটুকুতেই। অবশ্য রাগাটাই স্বাভাবিক। আমি বুঝি, অনেক দুঃখ তোমার! আচ্ছা, দু’দিন ধরে আমার পেছনে পড়ে আছ, ভালোমন্দের খেয়াল রাখছ। ওদিকে, ল্যাভেন্ডার ভালো আছে? ভেবো না আমি কিছু করেছি। শুধুমাত্র খোঁজ নিচ্ছি।”

হুট করে সৃজার কথা জিজ্ঞেস করায় ইহসান আবারও রেগে গেল, “ভাবি লাগে তোর, বড়ো ভাবি।”

“বা *ল আমার! ভাবিফাবি আমার মুখে আসে না। অবশ্য আনতে চাইও না। আমি ওকে ল্যাভেন্ডার ডাকি আর ডাকবও। তোমার ইচ্ছে করলে তুমি ওকে ভাবিফাবি ডেকো।”

“আমি ওকে ভাবি ডাকব? আমি? ও আমার কবুল পড়া বউ। আমার বাচ্চার মা।”

হটকারী ভঙ্গিতে আরসালান নাক সিঁটকালো, “ছিহ!”

“ইহসান দাঁতে দাঁত চাপলো, “ছিহ মানে?”

ভাইকে রেগে যেতে দেখে মনে পুলক জাগলো আরসালানের। আরো একটু রাগিয়ে দিতে ফিসফিস করে বলল, “কোনো পদ্ধতি-টদ্ধতি ব্যবহার করোনি? বিবাহিত জীবন এঞ্জয় করার আগেই একেবারে দুই দুইটা? আরে আমার নীতিনও তো এসব ব্যাপার ভালো বুঝে। আর তুমি আমার ভাই হয়ে চ্যা*ট বুঝো! বংশরক্ষার নামে ডাবল ডাবল এনে দেশের জনসংখ্যার বারোটা বাজানোর ধান্ধা!”

ইহসান রক্তচক্ষু মেলে তাকাল, “পদ্ধতি তোর বাপের ব্যবহার করা উচিৎ ছিল। তাহলে তোর মতো একটা বদ মাইশের হাত থেকে পৃথিবী বেঁচে যেতো, আমি বেঁচে যেতাম।”

আরসালান চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। পরক্ষণেই নড়েচড়ে উঠে বসে আগ্রহী চিত্তে বলল, “তাহলে আবার দেখা যেতো তোমাকে জ্বালানোর জন্য আমি তোমার ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছি। তখন কী করতে? আমাকে ফেলে দিতে? তোমার তো আবার বাচ্চা প্রীতি আছে।”

কী থেকে কী বলছে, কাকে কী বলছে কোনো জ্ঞান আছে এই শয়তানের। আবার দেখো, হাসছেও। হাসি দেখে কে বলবে এটা বিশ্ব বেহায়া? বরং কুপোকাত হয়ে যাবে। সে ছেলে হোক, বা মেয়ে। ইহসান বিদ্বেষ নিয়ে তাকাল, “বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে জান!”

“মারবে?”

“যদি বাড়ি যেতে চাস তাহলে মুখ বন্ধ রাখ।”

এরপর সত্যিই কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো। মিনিট পনেরো হবে। এরমধ্যেই আরসালান পা নাড়াতে লাগল একনাগাড়ে। প্রসঙ্গ বদলে বলল, “তোমার আব্বাজান কোথায় গেল?”

‘তোমার আব্বাজান’ বলাতে ইহসান বিরক্ত হলেও জবাব দিলো, “ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে।”

“আজ বাড়ি যাব না?”

ইহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “যাব, একটু সময় লাগবে।”

“কেন?”

“সে তোর ডাক্তার বলবে।”

আরসালানকে মহাবিরক্ত দেখাল, “ঐ টাকলা আবার কী বলবে?”

ইহসান চোখ গরম করে বলল, “জানতে হবে তো তুই আদৌ বাড়ি যাওয়ার জন্য ফিট কি না!”

“আমি চলে যাই, তোমরা ওসব ঝামেলা মিটিয়ে আসো? সত্যি বলছি, ল্যাভেন্ডারের কিছু করব না। আমি শুধু বাড়ি যাব।”

আরসালানকে বেশ অধৈর্য, উত্তেজিত দেখাল। ইহসান বোঝার চেষ্টা করল ওকে। গায়ে হাত দিয়ে তাপমাত্রাও দেখে নিল। আরসালান বিরক্ত ও প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, “এই তুমি বুঝতে পারছ না? আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। এখনি যাব। বাড়ি গিয়ে শাওয়ার নিয়ে, ভাত খেয়ে ঘুম দেব। একেবারে রাতে উঠব। এরপর একসঙ্গে কফি পান করব।”

বলার সময় ওর শরীরটা হালকা কাঁপছিল, ঘামছিল। মুখটাও লাল হয়ে উঠল ভীষণ। ইহসান সূক্ষ্ম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় ধীর স্বরে বলল, “সব হবে৷ তবে ডিসচার্জ হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে!”

°

কিন্তু ডিসচার্জ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর আরসালান ইনজান শেখকে শাওয়ার নিতে হলো, ভাত খেতে হলো, ঔষধ খেতে হলো ইহসানের হাতে। এসমস্ত নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে নিজের ঘরে একা হলো যখন, তখন ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন বারোটা ছয়, এ এম। নিজের ঘরের ডেস্কে রাখা সাদা পাউডারের প্যাকেট, ট্যাবলেটের পাতা, তামাকের গুঁড়ো, নীতিনের কিনে দেয়া বেনসন, ডার্বি, বিড়ির প্যাকেট, খালি সিরিঞ্জ এসবের কিছুই পেল না সে। সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাভ হলো না। শরীরটা ঘেমে, আগুন গরম হয়ে, গলা শুকিয়ে যখন একাকার? একটুখানি পানির আশায় সে হাত বাড়ালো বেডসাইড টেবিলের দিকে। কিন্তু ভূমিকম্পের ন্যায় কম্পিত হাতটি দুশমনি করল তার সাথে। কাচের জগটাকে ধরতে পারল না। বরং উলটে পড়ে তার শুকনো, খড়খড়ে মেঝেটা ভিজিয়ে দিলো। কিন্তু পানি তো চাই তার! পানি খেতে হবে। এরপর যা করার, যা খোঁজার খুঁজে নেবে। না পেলে বাবাকে বলবে। আরসালান দরজা খুলে সেই অসুস্থ, অস্থির শরীরটা নিয়ে যখন দোতলার করিডোরে এলো, সে পায়ে কোনো সাড় পেল না। টেনে টেনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্ধকার বসার ঘর পেরিয়ে ডাইনিংয়ের একটা চেয়ার টেনে কোনোমতে বসল, কিন্তু হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নেওয়ার শক্তি পেল না। থরথর করে কাঁপা হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল সে ক্ষুদ্ধ চোখে। এভাবে কতক্ষণ গত হলো সে জানে না। চৈতন্য জাগল তার মেয়েলি সুবাসে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল তৎক্ষনাৎ, পুনমের ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে, গায়ে চাদরের মতো ওড়না জড়িয়ে এসেছে মেয়েটা, পানি নিতে। আবার তার দিকেও একগ্লাস বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটার কী জানা নেই, দেখতে পাচ্ছে না তার হাতে একটুও শক্তি নেই? সে তুলতে পারবে না গ্লাসটা? আরসালান বিরক্ত হলো। লেবু রঙের ওড়না পরণে মেয়েটা শারাফকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই সে গুরুগম্ভীর স্বরে ডেকে উঠল, “এই দোয়া! আমার হাত নাড়াতে পারছি না। বোধহয় প্যারালাইজড হয়ে গেছে। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ। পানিটা প্রয়োজন। কীভাবে পান করব? কোনো সলিউশন জানা আছে তোমার? তুমি তো সলিউশন জানা মেয়ে।”

______

[পিচ্চি পর্ব। যাতে পছন্দের চরিত্ররা কেউ নেই। রি-চেইক বিহীন, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭২ [খ]

এলিজার পা থমকে গেল। হৃদপিন্ড ধ্বক করে উঠল তার। নিঃশ্বাস আটকে গেল গলার কাছটাতে। চোখেমুখে খেলে গেল প্রবল বিস্ময়। দোয়া? তাকে কী দোয়া বলে সম্বোধন করল লোকটা? না-কি সে কী ভুল শুনল? কতদিন পর কেউ তাকে এই নামে ডাকলো? বাবা ছাড়া এই নামে কেউ তো ডাকতো না তাকে, না এই নামটা কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানে। এলিজা ধীর গতিতে পেছনে ফিরে স্থবির দৃষ্টি মেলে এলোমেলো চুলে, আলুথালু বেশে চেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে চাইল। আর সে তাকাতেই উন্মাদ, রক্তাভ পুরুষালি চোখ জোড়ায় ক্ষণিকের কৌতূহল ঝিলিক মেরে পরক্ষনেই যেন দপ করে নিভে গেল। এলিজার দ্বিধা ভরা পেলব মুখ খানার দিকে দৃষ্টি তাক করা আরসালানের ব্যগ্র কণ্ঠটা বলে উঠল, “একজন হসপিটাল ফেরত মানুষ এতো রাতে অহেতুক নিশ্চয় এখানে আসেনি।”

এ বাড়িতে আসার পর থেকে দেখেছে বেশিরভাগ সময় লোকটা নিজের ঘরেই থেকেছে। বের হলেও খুব কম, মাঝে মাঝে রাতে। সামনা-সামনি কয়েকবার পড়লেও সাক্ষাৎ হয়ে উঠেনি। নূন্যতম ফর্মালিটি মেনেও না, কুশল বিনিময়েও না। এলিজাও বলেনি, আরসালান ইনজান শেখও না। বিষয়টা অস্বস্তিদায়ক, কিন্তু কী করবে? ভাইয়াকে বলতে শুনেছে, লোকটা রগচটা, উন্মাদ প্রকৃতির। মানুষকে সহ্য করতে পারে না। সেদিনের কান্ডের পর এটাও জেনেছে লোকটা ড্রাগ এডিক্টেড। এ ধরনের মানুষদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে এলিজা। অথচ এই লোকটা প্রথম কথোপকথনেই ‘তুমি’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করছে, তাকে নির্বোধ বোঝাতে চাইছে? মনে উদ্রেক হওয়া অসংখ্য প্রশ্ন চেপে এলিজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে চট করে বলে ফেলল, “হেতু যদি থেকে থাকে বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”

এলিজার কথাটা বড্ড রুক্ষ শোনাল। শুনে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল আরসালান। অন্ধকারে ডোবা বসার ঘরের ভেন্টিলেটরের ফাঁকফোকর দিয়ে আসা হলদে আলোর সরু রেখায় আলোকিত নারীমুখটা দেখে তার গলাটা শুকিয়ে এলো। আরো বেশি তৃষ্ণা অনুভব করল, কিন্তু পানি খেল না। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাসটা মেঝেতে ফেলে, এলিজার মুখে কড়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়িতে পা রাখল ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মাঝখানে কী হলো, ধপ করে বসে পড়ল দোতলায় উঠার সিঁড়িটাতে, শার্টের দুটো বোতাম খুলে। ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে এলিজা খেয়াল করল লোকটার হাত ভীষণভাবে কাঁপছে, স্থির থাকছে না। তারপরও লোকটা তাকে কিছু বলছে না, কাউকে ডাকছেও না। পানিটাও ফেলে দিলো। কেন? তার কথায় কী ইগো হার্ট হয়েছে? অবশ্য হবেই তো। লোকটা তার আত্মীয় ঠিক, কিন্তু তার সঙ্গে তো স্বাভাবিক সম্পর্ক বা পরিচয় নেই। যদিও আত্মীয় হলেই যে পরিচিত হতে হবে এমন থিওরিতেও সে বিশ্বাসী না। তারপরেও এমন স্বরে কেন বলল সে কথাটা, যাতে একজন মানুষের পানি খেতেও বাঁধে! এলিজার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল।

সারা বাড়ি শুনশান নীরব। অন্ধকার বিরাজ করছে চর্তুদিকে। দোতলার সিঁড়ি থেকে আসা হলদে রঙের টিমটিমে বাতিটায় যা একটু আলো এসে আশপাশটা একটু আলোকিত করেছে, তাতে অবশ্য অন্ধকার কাটেনি। বরং ঘন হয়েছে। অসুস্থ লোকটাকে পানি পান করানোর জন্য এতো রাতে কাকে ডেকে আনবে এলিজা, সে ঠিক বুঝতে পারল না৷ দ্বিধায় পড়ে এক মুহূর্ত ভেবে ঠিক করল শারাফকে দিয়ে কাজটা করাবে, কিন্তু দু-চোখে ঘুম নেমে আসা বাচ্চাটার দ্বারা এমন একটা কাজ করাতে তার মন সায় দিলো না। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলো, সে নিজেই পানি পান করানোর মতো দায়িত্বটা নেবে। শুধুমাত্র অসুস্থ একজন বলে। যেই ভাবা সেই কাজ। যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে আরসালানের মুখের সামনে গ্লাসটা ধরতেই কিছুটা চৈতন্য ফিরল তার। পর মুহূর্তেই লোকটা ভ্রু কুঞ্চন করে, জ্বলজ্বলে চাহনি ছুঁড়ল ওর দিকে।

সেই চাহনির প্রখরতা পরিমাপ করে এলিজা একটু ঘাবড়েও গেল৷ তাতে পুরুষের ধারালো চাহনি যেন আরো গাঢ় হলো। বুকের ভেতরটা দম চাপা অনুভবে পালতৌলা নৌকার ন্যায় দুলতে লাগল আরসালানের। পরমুহূর্তে মাথা নিচু করে সে হেসে ফেলল নিঃশব্দে। কতো মেয়ে তার সংস্পর্শে এসেছে, তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। কিন্তু তার এভাবে কী কোনো মেয়ে কাছে এসেছে? উহু, মনে পড়ছে না তার। যারা আসতো তারা নিজেদের স্বার্থ আদায়ে, কামনা মেটাতে, তাকে প্রলুব্ধ করতে আসতো। অথচ এই মেয়েটা তার রাগ বুঝে, পানি হাতে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে এসেছে? অ্যামেইজিং ব্যাপারস্যাপার। এসেছে অবশ্য ভালোই হয়েছে। নয়তো এই মেয়েটার চোখে যে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে, একটা আকাশ দেখতে পাচ্ছে সেটা দেখা হতো না। আচ্ছা, সমুদ্র আর আকাশ যে-ই চোখ ধারণ করে, সেই চোখের মালকিন নিশ্চয় যে সে কেউ নয়? লেবু রঙের জামা পরণে মেয়েটার পানে আরসালান সরু অথচ গভীর চোখে তাকিয়ে রয়। এলিজা বুঝতে পারে না লোকটার ওমন দৃষ্টির মানে!
সে গলা খাকারি দেয়, তাতে সম্বিৎ ফিরে আরসালানের। পানি পান করাতে আসা মেয়েটার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই একটানে গ্লাসটা খালি করে ফেলে সে। এরপর খেয়ালে বা বেখেয়ালে এলিজার ওড়নার আঁচলটা টেনে কম্পিত হাতে নিজের মুখ মুছতে শুরু করে। আকস্মিক এমন কান্ডে চমকে উঠে এক ঝটকায় নিজের ওড়না ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় এলিজা। ভাষাহীন হয়ে গেল সে। বোঝার চেষ্টা করল, ইচ্ছেকৃত না-কি অনিচ্ছাকৃত ভুল এটা? না কি সে ভুল, আসলেই এতকিছু ভেবে কাজটা করেনি লোকটা? আরসালান অবশ্য এমন ভাব করল যেন সে বুঝতেই পারেনি কী করেছে। এলিজা সংযত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আর কিছু প্রয়োজন?”

শরীরে বোধহয় রক্তের ছুটোছুটি, তেজ বেড়েছে। মাথার ভেতরটাও এলোমেলো লাগছে। শরীরের আগুন নিভিয়ে দেয়া ঐ নেশাদ্রব্য যতক্ষণ না তার ভেতরে প্রবেশ করছে, ততক্ষণ এই অস্থিরতা, অশান্তিতে ভুগবে সে। রেলিংয়ে মাথাটা ঠেকিয়ে রাখা সে এলিজার প্রশ্নটা শুনে জবাবে একটা শব্দও ব্যয় করল না। বড়ো করে শ্বাস টানলো। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে বারবার ভেজানোর চেষ্টা করে প্রশ্নটা ছুঁড়ল আরসালান, ‘‘প্রয়োজন? হু? তুমি হবে না কি?”

এরপর নিভে আসা সচকিত চোখে কেমন করে যে হাসলো এলিজার দিকে তাকিয়ে, মেয়েটা শিউরে উঠে জামার একাংশ মুঠো করে ধরল। বিভ্রান্ত হয়ে দুই সিঁড়ি নিচে নেমে দাঁড়ালো। তা দেখে হো হো করে হেসে ফেলল আরসালান। এলিজা কিংকর্তব্যবিমুঢ়! ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। লোকটার কথাবার্তা, চাহনির ধরণ, হাসি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে চাইল না সে। শারাফকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েও কোনোরূপ ভনিতা না করেই বলল, ‘‘ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।”

“ইউ শ্যুড গো নাও।”

এলিজা যত দ্রুত সম্ভব সে ঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু এভাবে লোকটাকে ফেলে যাওয়াটা সম্ভব নয় তার পক্ষে, বিবেকে বাঁধছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো, ইহসানকে ডেকে দেবে। তারপর যা করার ভাইয়াই করবে। তাকে অন্তত একটা বেগানা পুরুষকে নিয়ে অস্থির হতে হবে না। এমনিতে যা হয়েছে তা যথেষ্ট! ভাবনার এ পর্যায়ে এসে মনোস্থির করতেই আকস্মিক এলিজার চোখ ইনজান শেখের এমন একটা নিষিদ্ধ জায়গায় চলে গেল যে ও আঁৎকে উঠে নিজের দু-চোখ বন্ধ করে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর তাড়া দেওয়া ভীষণ বিব্রত কণ্ঠে শারাফকে বলল, ‘চলো শারু, আমরা যাই।’

সিঁড়িটার একপাশে দাঁড়িয়ে শারাফ এতক্ষণ হা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার জান মামাকে। কিন্তু কিছু বলছিল না, মূলত ভয় পাচ্ছিল সে মামাকে। কেননা, এই মামা খুব রাগী। একদম পছন্দ করে না বাচ্চাদের। খুব জোরে ধমক দেয় নয়তো গায়ে হাত তুলে। দু’য়েক বার কেমিকে আনার অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে শারাফের সঙ্গে জান মামার আলাপ হয়নি। অবশ্য ধমক খেতে হয়েছে তখনো। কিন্তু সেই রেশ ধরে যে, মামার ইজ্জত হরণ হতে দেখবে সেরকম অভদ্র, খারাপ বাচ্চাও সে নয়। এলিজ আন্টিকে একটুখানি দাঁড়াতে বলে সে জান মামার কাছে ছুটে গিয়ে কানেকানে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘জান মামা, তোমার প্যান্টের চেইন খোলা।’

একটুও বিচলিত দেখাল না আরসালানকে। কাঠখোট্টা স্বরে বলল, “তাতে তোর কী?”

“লজ্জা মামা। এলিজ আন্টি তোমার ইন্টুপিন্টু দেখে ফেলবে।”

শারাফ এটুকু বলে নিজ হাত দিয়ে মুখ চাপলো। আরসালান বিরক্ত মুখে ধমকে বলল, “দেখুক!
দেখার জিনিসই এসব।”

শারাফের আবার কান্নার মতো পেয়ে গেল। কিন্তু সে কাঁদলো না। ভয়ে ভয়ে মামার প্যান্টের চেইনে হাত দিলো সে, লাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জোর দিয়ে টানতে পারল না। আরসালান ওর ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখে যেন খুব মজা পেল। একপলক এলিজাকে দেখে নিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “তোর এলিজ আন্টি ওদিকে ফিরে আছে। বোধহয় আমার ইন্টুপিন্টু দেখে ফেলেছে। এবার কী হবে রে? আমার মানসম্মান তো গেলই, তোরটাও যাবে।”

ভয়ে, লজ্জায় শারাফের মুখখানি এতটুকু হয়ে এলেও সে বুদ্ধি হারাল না। আচমকা ধপ করে আরসালানের কোলে বসে পড়ে এলিজাকে ডেকে উঠল, “এলিজ আন্টি, তুমি ঘরে যাও। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাও।”

এলিজা ভীষণ অবাক ও অপ্রস্তুত হয়ে পেছনে ফিরে তাকাল একটুখানি। সংযত দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ
রেখেই বলল, “তুমি যাবে না?”

ব্যাকুল কণ্ঠে বলল শারাফ, “তুমি যাও, তারপর।”

শারাফের কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে এলিজা বোধহয়
বুঝে গেল কেন এরকম করছে বাচ্চাটা। বিব্রত হয়ে দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। দ্বিগভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর যাওয়া দেখল আরসালান। এরপর শারাফের গালে একটা চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেয়ে শারাফ এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছুটে চলে গেল। রেলিংয়ে ভর রেখে আরসালান নিজেও উঠে দাঁড়াল, প্যান্টের চেইন টেনে লাগাল। এরপর নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। ভারসাম্যহীন তার হাঁটার গতি। হাঁটতে হাঁটতেই সে শেক্সপিয়রের পঙক্তি আওড়াল, “সে যতোটা লাজুক, ততোটা সুন্দর। সে তার লজ্জার চেয়েও বেশি সুন্দর।”

ঘরে যাওয়ার পর ইহসান হন্তদন্ত হয়ে তাকে দেখতে এসেছিল। ইনজানের বেশ ভালোই লাগছিল ভাইয়ের এই অস্থিরতা। কিন্তু নিজের শরীরের অস্থিরতায় টিকতে না পেরে যখন ভাইয়ের পাণিপ্রার্থী হলো, জানতে পারল, ঘর থেকে নে শা দ্রব্যগুলো তার ভাইই সরিয়ে দিয়েছে। যাতে সে এগুলো গ্রহণ করতে না পারে। কিন্তু এগুলো ছাড়া সে কী করে নিজের যন্ত্রণা কমাবে? প্রচন্ড রাগে চিসেল দিয়ে একটু একটু করে হাতের চামড়া কেটে র ক্তপাত ঘটিয়ে প্রশান্তি পাওয়ার চেষ্টা করল সে। আর সেই রক্ত দিয়ে আর্ট পেপারে একটা ছবি আঁকল। শেষরাতে যখন আঁকা শেষ হলো, খুব বিরক্তি নিয়ে দেখল তার অঙ্কিত নারীটার চোখ এবং ঠোঁট, হুবহু ঐ অনিতা রেহমানের ছোটো মেয়ে এলিজের মতো। অথচ সে আঁকতে চেয়েছিল বেগুনি ফুল অর্থাৎ ল্যাভন্ডারকে!

°

দু’দিন যাবৎ ছেলের শরীর গরম। থার্মোমিটার জানান দিচ্ছে তাপমাত্রা খুব একটা সুবিধার নয়। জ্বর-সর্দির মতো অবস্থা। এই নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ইহসান। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ আনা হয়েছে, কিন্তু তাতে তার উদ্বিগ্নতা কমছে না। ছেলেটা এমনিতেই বেশি কাঁদে, কিন্তু অসুখে পড়ার পড় থেকে কাঁদছেও না। অশান্ত ছেলেটা বড্ড শান্ত হয়ে গেছে। কোলে নিলে বুকে মুখ চেপে ঘুমায় সারাক্ষণ। ইহসানের ভালো লাগে না এতো শান্ত বাচ্চাকে দেখে। ছেলে কোলে নিয়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ায় সে। দু’দিন যাবৎ রেস্তোরাঁতেও যাচ্ছে না। তার উদ্বিগ্নতা বুঝতে পারে আজিজ শেখ। তিনি নিজেও ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু সুযোগ পেয়ে ছেলেকে কথা শোনাতে ছাড়েন না। এইতো আজ সকালেই খাবার টেবিলে বসে ইহসানকে বসার ঘরে দেখে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “বলছিলাম না, বাপ হইলে সব বুঝব? এখন বুঝে তো, সন্তানের কিছু হইলে বুক কেমনে ফাটে? কী আব্বাজান, বুঝো তো?”

ইহসান মুখ বাঁকায়, “আমি তো বুঝি কিন্তু আপনি বোধহয় বোঝেন না।”

আজিজ শেখ ভ্রু উঁচান, “কেন মনে হইলো আমি বুঝি না?”

“বুঝলে তো পায়ে পাড়া দিয়ে খোঁচা দিতে আসতেন না। না যেচে পড়ে কথা বলতে আসতেন।”

“তুমিও তো কম খোঁচা দাও না আমায়।”

“খোঁচা? আমি তো বাস্তব সত্যি শোনাই আপনাকে।”

“বাস্তব পকেটে রাখো আর আমারে আব্বা বইলা ডাইকো আব্বাজান। আমারও তো ইচ্ছা হয় তোমার থেইকা আব্বা ডাক শুনতে।”

খাওয়ার টেবিলে ইমরানও ছিল। সে সচরাচর এসব বিষয়ে নাক গলায় না। কিন্তু আজ বসাল। পরোটাতে ডিম পুরে কামড় বসিয়ে বলল, “হু, মাঝেমধ্যে ডাকলেও পারো। ক্ষতি কী ডাকলে? আমিও তো ডাকি। জানও ডাকে। কয়দিন পরে জানের কুকুর, কেমিও ডাকবে।”

বলে আচমকা হেসে উঠল ইমরান। মিতু কটমট করে চাইল ওর দিকে। পিঠের মধ্যে জোরে চিমটি বসিয়ে দিলো। ইমরান থেমে গিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টি ছুঁড়ল ওর দিকে। ইহসান বিরক্ত হয়ে উঠেই চলে আসে এ পর্যায়ে। সৃজা রান্নাঘরে ছিল, ওকে উঠে যেতে দেখে চলে আসে। করিডোরে পৌঁছাতেই মৃদু স্বরে বলে ইহসানকে, “সবসময় না ডাকো, মাঝেমধ্যে বাবা তো ডাকতেই পারো। আংকেল অনেক আশা করে বোধহয় তোমার থেকে।”

সবকিছু জানার পরেও সৃজা এমন কথা বলে ফেলল? এমনটা ওর থেকে এমন কথা আশা করেনি ইহসান। কাঠখোট্টা কণ্ঠস্বরে বলল, “আমার মায়ের সঙ্গে হওয়া বিভীষিকাময় অন্যায় গুলো জানার পর থেকে আমার আর ইচ্ছে হয় না এই লোকটাকে বাবা বলে ডাকতে। যখনি ভেবেছি ডাকব, তখনি চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। শব্দ আসে না, আমি পারি না আর ডাকতে। তাই এই লোকের আশাও পূরণ হবে না কখনো, সে যতকিছুই হোক না কেন! তুই পারতি?”

এই পৃথিবীর সব মানুষের মনস্তত্ত্ব বোধহয় এক। গর্ভধারিণীর সঙ্গে অন্যায় করা যে কাউকেই, কখনোই ক্ষমা করা যায় না, এমনকি যদি সে তার জন্মদাতা হয় তবুও। ইহসান যেমন পারছে না, সৃজাও বোধহয় পারবে না। সে আড়চোখে ইহসানকে দেখল ঝাপসা দৃষ্টিতে।

°

______

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭২[গ]

সেদিন রাতের ঘটনা শোনার পর থেকে এলিজার উপর নীলু বেগম রাগ। তার এক কথা, বাড়িতে এতগুলো লোক থাকতে এলিজাই কেন গেল ঐ নে শা খোর ছেলেটাকে পানি দিতে? যদি কিছু করে বসতো? কথাই বলছেন না তিনি এলিজার সাথে। ফুপিকে অনেক বুঝিয়েছে এলিজা। কিন্তু মান ভাঙাতে পারেননি। এরকম একটা বিষয়ে ফুপির এতো রাগ দেখে সৃজাও বিস্মিত। মনে পড়ল, তার সরল ফুপি প্রথম থেকেই ইনজান শেখের নামটিও শুনতে পারে না। তার সাথে পরিচিতও হতে যায়নি। কেমন এক অদৃশ্য, চাপা রাগ বহন করে মানুষটির প্রতি। অথচ আগে কখনো দেখেননি তিনি এই লোকটাকে। তাহলে এতো ক্রোধের কারণ কী? সৃজা ও এলিজা দু’জনেই চিন্তিত! তবে এলিজা ফুপির কথা মেনে আর একবারের জন্যও ইনজান শেখের সামনে পড়েনি। তার বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।

শেখ বাড়িতে এখন অস্থিরতা। ডাক্তারের পরামর্শে আরসালানকে সব ধরণের নে শা দ্রব্য থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে ইহসান। কিন্তু আরসালানের শরীর আর মন সেই অভ্যস্ত চাহিদার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছে না। যন্ত্রণায় পাগলপারা হয়ে গেছে সে। সারাবাড়ি তার চিৎকার, চেঁচামেচি আর হুমকিতে মুখর। অথচ সবাই যেন বধির হয়ে গেছে। কেউ দিচ্ছে না একটুখানি পাউডার, একটা ট্যাবলেট। মাত্র দু’দিনেই তার হাল বেহাল। শারীরিক অস্থিরতা এতটাই প্রবল যে মনে হয়, যেন বিকৃত কিছু ঘৃণ্য পোকা তার হাড়-মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে।রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিষ। সে বিষে তার সারা শরীর জ্বলছে, ছটফট করছে সে নিজের ভেতরেই। আরসালান চেষ্টা করেছে—রাগ দেখিয়েছে, ঘরের জিনিসপত্র ভেঙেছে একের পর এক। কিন্তু ইহসান নীরব, অনড়। প্রয়োজনীয় সব নে শার জিনিস সে নষ্ট করে ফেলেছে, আর চোখের দিকে তাকিয়ে সোজা বলেছে, “তুই মরেও গেলে তোকে এসব নিতে দেব না।”

আরসালান শেষমেশ আজিজ শেখকেও বলেছে, তার ওসব জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। যেকোনো মূল্যে আনতে হবে। সে আর পারছে না যন্ত্রণা সহ্য করতে। শত হলেও বাবা। ছেলের কষ্টটা সহ্য হচ্ছিল না আজিজ শেখের। তাই একফাঁকে প্রদীপ বড়ুয়াকে ডেকে বলেছিলেন, ব্যবস্থা করতে। কিন্তু যত গোপনেই হোক, কোনোভাবে খবরটা চলে যায় ইহসানের কানে। সে রাগে যেন উন্মাদ হয়ে যায়।
বিকেলে রেস্তোরাঁ থেকে ফিরেই নিজের ঘরে না গিয়ে সোজা চলে আসে আজিজ শেখের ঘরে।

সালেহা বেগম একপাশে চুপচাপ বসে টুকটাক কাজ করছেন, সম্ভবত পাঞ্জাবির বোতাম সেলাই করছেন।
আজিজ শেখ আধশোয়া হয়ে টেলিভিশনে খবর দেখছিলেন। হাতে চায়ের কাপ, কোলে পত্রিকা।
খবর দেখছেন, আবার পত্রিকার পাতাও উল্টাচ্ছেন।কে জানে কোনোটায় মন! ঘরে ঢুকেই ইহসান আজিজ শেখের এই নিশ্চিন্ত অবস্থা দেখে আরও চটে গেল। ধুপধাপ করে এগিয়ে গিয়ে টিভির সুইচ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, “আপনি কি চান ছেলে মরুক? মরুক ভালো। অন্তত মরে গেলে আর এই বি ষের জন্য কাতরাবে না।”

এক মুহূর্তের জন্য ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল।
সালেহা বেগমের সুঁই, সুতোটা আধা টানা, আঙুলে আটকে রইল। চোখ নামিয়ে ফেললেন। বাপ-ছেলের দ্বন্দে আড়ষ্টতায় আটখানা। বলার মতো মুখ খোলেন না কখনোই। তবে প্রতিবারই নিঃশ্বাসটুকু ভারী হয়ে ওঠে। আজিজ শেখ চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। তার অবাধ্য ছেলে ইহসান সাধারণত এ ঘরে আসে না, আজ এলো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। ছেলের কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। কিন্তু গলা নরম রাখার চেষ্টা করে বললেন, “ছেলে মারতে চাই মানে? কী হইছে ঠিকমতো বলো। এত রাগারাগি করে কিইবা হবে? বসো এইখানে, কথা বলি।”

বিছানাটা একটু গুছিয়ে জায়গা করে দিলেন। পত্রিকাটা গুটিয়ে পাশে রাখলেন। একফাঁকে সিগারেটের অ্যাশট্রেটাও সরিয়ে ফেললেন, যেন বোঝাতে চান, পুরো মনোযোগ এখন তার ছেলের দিকেই। কোণা চোখে সেটা দেখে ইহসান একটা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিজেকে সামলে গলা নিচু করল, কিন্তু রাগটা আর চেপে রাখতে পারল না।
“পরিষ্কার করে মানা করে দেওয়ার পরেও আপনি লুকিয়ে ছাইপাঁশ এনে দিতে চাচ্ছেন জানকে। দু’দিন আগে কী হাল হয়েছিল দেখেননি? ওর শরীরে আর কিছু আছে? সবকিছুর একটা সীমা আছে, একটা জায়গায় গিয়ে থামা দরকার। আপনি সেটা বোঝেন না। আপনি বোঝেন, ওকে খুশি রাখা মানে, যা চায় তাই দেওয়া। সব ভালোবাসা না, পাগলামো। আচ্ছা, আপনি কী আসলেই চান না, ইনজান আপনার থেকেও কয়টা দিন বেশি বাঁচুক?”

টাকা দিয়ে নেশা জাতীয় পদার্থ আনতে বলেছেন এটা ইহসান কীভাবে জানল? প্রদীপ বড়ুয়া বলে দিয়েছে নিশ্চয়। হারামিটাও আজকাল ভালোই তার পেছন মারছে! আজিজ শেখের রাগ হয় কিন্তু পরক্ষণেই ছেলের চোখের আগুনে তার দৃষ্টি হালকা হয়ে আসে।আমতা-আমতা করে বলেন, “কেমন করতেছে, দু’দিন ধরে দেখতেছই তো। কিচ্ছু খাইতেছেও না। আমি বাবা হইয়া কীভাবে ওরে এমন কষ্টে থাকতে দেখি!”

“দেখতে না পারলে চোখ বন্ধ করে রাখুন। সেটা না পারলে বৃন্দাবনে যান। তবু এসব বি ষ এনে নিজের ছেলের ক্ষতি করবেন না।”

“আমি ওর ক্ষতি চাই না, আব্বাজান। কিন্তু বিষয়টা এমন পর্যায়ে গেছে, এখন এসব ছাড়া থাকতে পারছে না।”

“পারছে না তো পারতে হবে! তার জন্য সময় দিতে হবে। ধৈর্য রাখতে হবে। আসক্তি ছাড়ানোর একটাই উপায়, ওকে এসব থেকে যেকোনোভাবে দূরে রাখা।
আর আপনি করছেন একদম উল্টোটা! শয়তান বানাতে চাইছেন।”

চোখ রাঙিয়ে আজিজ শেখ গর্জে উঠলেন, “শয়তান বলবা না আব্বাজান। ফেরেশতা বাচ্চা আমার!”

“আচ্ছা, সুফী সাধক বলব।”

ইহসানের কণ্ঠে খোঁচাধরা তাচ্ছিল্য। আজিজ শেখ মুখ কালো করে ফেলেন, “তো বাড়িতে রাইখা আসক্তি ছাড়াবা? এত সহজ?”

ইহসানের কণ্ঠ এবার কাঠখোট্টা, জ্বালা জড়ানো,
“সেসব নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি শুধু অতিরিক্ত আহ্লাদ দেখানো বন্ধ করুন।
আর একটা কথা মাথায় রাখবেন, আমি যেন না শুনি আপনি কূটনীতি করে আবার কিছু এনে ওর হাতে তুলে দিয়েছেন। তাহলে… একেবারে মেরে ফেলব!”

আজিজ শেখ আবারও রাগে ফেটে পড়েন, “রাগাইও না পুত!”

সেই মুহূর্তে সালেহা বেগম মিনমিন করে বললেন,
“আপনি একটু চুপ থাকেন। ও তো ভালোর জন্যই কইছে। পোলার কীসে ভালো হয়, বুঝেন না বাপ হইয়াও?”

আজিজ শেখ হা হয়ে গেলেন। তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। এ কী শুনছেন তিনি? সালেহা? এই বোবা সালেহা—যে জীবনে তার মুখের উপর ‘টু’ শব্দটি করার সাহস পায় না সে আজ তাকে চুপ থাকতে বলছে? একটা চড় মেরে বত্রিশটা দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করল আজিজ শেখের।
কিন্তু ইহসান সামনে থাকায় কিছু বলতে পারলেন না।
বরং ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন সালেহা বেগমের দিকে। ইহসান সেই দৃশ্য দেখে একটুও পেছনে না তাকিয়ে, দরজার দিকেই হাঁটা দিল।

আজিজ শেখ পড়েলেন মাঝনদীতে। আরসালানের যা অবস্থা, বেশিদিন এসব ছাইপাঁশ গ্রহণ করলে আসলেই কিছু একটা হয়ে যাবে। ডাক্তারও সাফ বারণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্নেহান্ধ তিনি এতকিছু কানে তুলেননি। তবে এবার ইহসানের কথা শুনে মনের মাঝে একটা চাপা ভয় দানা বাঁধছে। অকালে ছেলের প্রাণনাশ হোক এমনটা তিনি চান না। তাই কষ্ট হলেও এবারে বুকে পাথর চাপা দিয়ে ইহসানের হুমকিতেই তিনি দমে যাবেন বলে মনোস্থির করলেন।

°

বলা যায়, একপ্রকার বন্দী করেই রাখা হয়েছে আরসালানকে তার নিজের ঘরে। ইহসান কেমিকে ঘেঁষতেও দেয়নি। দোটানা ছিল, যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিছু করে বসে! ফার্স্ট এইড বক্স আর কয়েকটা দরকারি জিনিস হাতে নিয়ে ইহসান লক খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখে মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে আরসালান। ধারালো কিছু না পেয়ে বোধহয় নিব জাতীয় কিছু দিয়ে নিজের শরীরে খুঁচিয়েছে।
অনেক জায়গা থেকেই ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে।
এসব করে কি সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে?
এতেই কি স্বস্তি পায়? দেশে ফিরে আত্মগোপনে থাকার সময় দিনের পর দিন তাহলে এইসব করেই কেটেছে ওর? দরজায় দাঁড়িয়ে ইহসান স্থির চোখে দেখে ভাইকে। একটুখানি ভালোবাসার লোভে, তাকে অহেতুক হিংসা করেছে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিচ্ছে চুপচাপ। বুঝতে চায় না, ভালোবাসার জন্য কেউ না কেউ ঠিকই থাকে। সময় তাকে এনে দেয়।
ইহসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাতের জিনিসগুলো পাশে রাখে। তারপর ফোনটা বের করে ইজহানকে ডাকে। মেয়ের কাঁথা পরিষ্কার করে একটুখানি জিরিয়ে নেওয়া ইজহান প্রথমে আসতে চায় না।

কিন্তু যখন শুনে আরসালানের মাথার চুল কাটা হবে
তখনই কেমন উৎসাহী হয়ে আসে। ইহসানের সাথে মিলে আরসালানকে মেঝে থেকে তুলে বালিশে শুইয়ে দিয়ে ইজহান আরসালানের মাংসপেশি টিপেটুপে ফিসফিস করে ইহসানকে বলে, “কী বডি বানিয়েছে দেখেছিস? জিমটিমও করে না কি? এসবে আগ্রহ আছে ওর?”

“জানি না।”

“তা বটে। তুই শুধু আমার পেছনে লাগতে জানিস।”

ইহসান ওর কথায় পাত্তা দেয় না। চুপচাপ ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে বসে পড়ে। আরসালানের কাটা হাত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয় ধীরে ধীরে। তারপর ইজহানের উরুতে আরসালানের মাথাটা তুলে দিয়ে বলে, “এবার চুল কাটা হবে। ঠিক করে ধরবি। নয়তো ছিঁড়ে যাবে। আমি সুইচটা অন করছি।”

ইজহান ঠোঁট উল্টায়। খোঁচা মেরে বলে, “শুনলাম মেরে ফেলতেও গেছিলি? হঠাৎ এত্ত দরদ!
বাচ্চাদের মতো যত্নআত্তি করছিস। টনা-মনাকে এভাবে যত্ন করিস তো? দেখলাম তো, মশার কামড়ে পিঠে রক্ত জমে লাল হয়ে আছে টনার।”

ছেলেকে মশা কামড়েছে এটা জানত না ইহসান।
সকালে বের হওয়ার আগে তো সব ঠিকঠাক দেখে গেছে। কবে কীভাবে হলো বুঝতে পারল না।
কপালে ভাঁজ ফেলে বিচলিত গলায় বলে,
“আমার ঘরে মশা নেই। তাও রাতে স্প্রে করে মশারির নিচে রাখি ওদেরকে। বারান্দা আর আশপাশও পরিষ্কার করে স্প্রে করে দিয়েছিলাম। সেই দিক থেকে আসার সম্ভাবনা কম। তোর ঘরের ওদিকেই তো গাছগাছালির জংলা। নিশ্চয় ওখান থেকেই এসে আমার ছেলেটাকে কামড়েছে।”

ইজহান শেখের ঘরে মশা? এতো বড় অপবাদ দিলো ভেড়াটা? কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, আসলেই তার ঘরের পাশের দিকটা জংলা হয়ে গেছে। অনেকদিন আগাছাও কাটা হয়নি। মশা থাকাই স্বাভাবিক। মুখটা কালো হয়ে গেল ইজহানের। তাহলে কি সত্যিই ওই মশাই কামড়েছে টনাকে? মনেই মনেই একটু দুঃখ হলো, কিন্তু মুখে সে কিছু মানবে না। তর্কে হারতে রাজি না, তাই গলা চড়িয়ে বলে, “আমার ওদিকটাও পরিষ্কার। মশা নেই ওখানে। তুই আমার চেয়ে বেশি জানিস না কি!”

ইহসান ঠান্ডা স্বরে, বাঁকা হেসে বলল, “কম কম জানি। তাও জেনে গেছি। এবার সবাইকে জানাব।”

সেই সূঁচালো হাসি দেখে ইজহান খেঁকিয়ে উঠল,
“আমার দুধের শিশুটাকে মা হারা করার রাজনীতি এখনো করছিস? ভালো হবে না তোর, দেখিস!”

ইহসান ঠোঁট চেপে হেসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“না হোক। যে কাজ দিয়েছি সেটা কর।
ওকে ভালোভাবে ধরে রাখ। চেতনা ফেরার আগেই কাজটা শেষ করতে হবে।”

ইজহান সিরিয়াস হয়। সতর্ক কণ্ঠে বলে, “চুল কিন্তু ওর খুব প্রিয় জিনিস। কাটার আগে ভাবিস। পরে কিন্তু খুব ঝামেলা করবে। কী কাট দিবি?”

“ঘেঁষে ছেঁটে দেব।”

“মানে?”

“নাম্বার জিরো হেয়ার কাট দিয়ে দেব।”

ইজহান চোখ কুঁচকে বলল, “এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি।”

ইহসান শান্ত গলায় বলল,
“হোক।”

অতঃপর চেতনা ফেরার আগেই দুই ভাই মিলে ট্রিমার চালিয়ে দিল ওর মাথায়। বেড়ে উঠা ওয়েভি লং হেয়ারগুলো একেবারে জিরো কাট দিলো। একটা চুলও রাখল না। একদম মুন্ডিত মস্তকের মতো করে দিলো। অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি-গোঁফেও ট্রিমার চালিয়ে দেওয়া হলো। যেন পুরনো মুখটা ভেঙে নতুন কোনো ছাঁচে গড়া হচ্ছে ধীরে ধীরে। তারপর ঘর্মাক্ত শরীরটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে, পাতলা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে দেওয়ার পর ইহসানের মনে হলো, এখন অন্তত কিছুটা মানুষ লাগছে ওকে।
এতদিন দেখে মনে হতো, যেন কোনো বনে থাকা উন্মাদ কেউ। অবশ্য আরসালান অর্ধউন্মাদই।
পোশাকও সব দুই রঙের, সাদা-কালো। দুই রঙে সীমাবদ্ধ এক জগৎ, যেখানে অন্য রঙের প্রবেশাধিকার নেই।

ইহসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর ঘরটা গুছাতে শুরু করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখে, ভাঙা কাচের টুকরোগুলো সাবধানে এক জায়গায় করে সরিয়ে নেয়। পর্দা নামিয়েবিছানার চাদর তুলে ফেলে। ইজহান একপাশে বসে এসব দেখে। কিন্তু কোনো কাজে হাত লাগায় না। উল্টো ভাগে পড়া দায়িত্বটা মকবুলের উপর চাপিয়ে
বালতি, মগ, নোংরা কাপড় সব এক জায়গায় করে এনে ঘরটা মুছিয়ে নেয়। সবশেষে মকবুল চুপচাপ বেরিয়ে যায়। তাকে অনুসরণ করে ইজহানও নিঃশব্দে পগার পার হয়। বাচ্চাদের কান্নাকাটির সুর কানে এসেছে তার।

তবে ইহসান ঘরটা পরিষ্কার করেও আরসালানের পাশে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে একধরনের অদৃশ্য ক্লান্তি। ভেতরে অস্থির এক উপলব্ধি। একবার অন্তত চেষ্টা করা দরকার এই গভীর আসক্তির গহ্বর থেকে ছোটো ভাইটাকে টেনে তোলার। একটা জীবন, কেন হেলায় নষ্ট হবে, যখন এখনো ফেরার পথ খোলা? জীবন মানেই তো উত্থান আর পতনের মিলেমিশে থাকা। কখনো আলো, কখনো অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বেরুতে ওকে একটু সাহায্য করা যায় না? যায় তো।।তাই না হয় একটু চেষ্টা করাই যাক। একটা জীবন, একটা অস্তিত্ব হয়তো শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে তোলা যাবে। সৃজার বলা কথাগুলো ভেবে ইহসান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আদৌ মেয়েটার কথাগুলো ফলবে তো? কে জানে। এসির তাপমাত্রা তেইশে নামিয়ে ইহসান বেরিয়ে আসে। কে জানে, উঠে আবার নিজের বন মানুষের বদলে ভদ্রসভ্য চেহারা সুরত দেখে কী কান্ড করে বসে ছেলেটা।

°

_____

চলবে…

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭২[ঘ]

সন্ধ্যের দিকে ইনজানের চেতনা হালকা হয় তীব্র গা ঘামা ক্লান্তি, গলার মধ্যে শুষ্কতা, মাথাব্যথা নিয়ে।
ধীরে ধীরে চোখ মেলার পর বুঝতে পারে সে বিছানায় উপুড় অবস্থায় শোয়া। যার দরুণ বালিশে তার নাক ঠেকানো, গরম নিঃশ্বাস সেখানে পড়ছে। এতক্ষণ উলটো হয়ে শুয়ে থাকায় ঘাড় টনটন করছে। একটুখানি মুক্ত বাতাসের খোঁজ করা প্রাণটা চিৎ হয়ে শুলো ধীরেধীরে। হাত বুলাতে গিয়ে টের পেল ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মাথাটা একটু নাড়াতেই ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল তার। শরীরটা অদ্ভুত হালকা, যেন সে শূন্যে ভাসছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অস্বস্তিকর কিছু একটা… মাথার উপরে কি যেন নেই! সে ধীরে ধীরে হাত তোলে মাথায়, আর মুহূর্তেই গা দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম ঝরতে শুরু করে। চুল নেই! ভয়ানক অবিশ্বাস এক ঝটকায় উঠে বসে ভাঙা আয়নার দিকে তাকাতেই ওর চোখদুটো স্থির হয়ে যায়।

এটা কে?
আরসালান ইনজান শেখ?
তার ওয়েভি লং হেয়ারগুলো আধা ইঞ্চি পরিমাণ হয়ে গেল কীভাবে?

অবিশ্বাস্য ভঙ্গিয়ে ছুটে গিয়ে ফাটলধরা আয়নাটার সামনে দাঁড়ায় সে। দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। ওয়েভি লং হেয়ারগুলোর বদলে আধা ইঞ্চির মতো চুল, পাতলা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। দাঁড়িগোঁফ ট্রিম করা, কিন্তু খোঁচা খোঁচা রয়ে গেছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে, টিনএজ ছেলেদের মতোন। আরসালানের হাত-পা কাঁপতে শুরু করে নিজের এই জেলফেরত কয়েদির মতোন রুপ দেখে। তার অচেতন অবস্থায় সুযোগ নিয়ে কে করেছে এসব কাজ? কার এতো বড়ো সাহস? জানা নেই, আরসালান ছিঁড়ে ফেলবে তাকে? সবাই তো জানে। সেজন্য কেউ তো কাছেই ঘেঁষে না ভয়ে। তবে অকুতোভয়টা কার? তার ভাইয়ের? ইহসান শেখের? অবশ্য সে ছাড়া আর কে এমন সাহস দেখাবে? কিন্তু ভাই কেন করল তার সাথে এমনটা? কীভাবে করতে পারল? এতো কষ্ট দিয়েও মন ভরছে না তার? সংযমের পরীক্ষা নিয়েও শান্তি হচ্ছে না তার? অস্তিত্বের দিকে হাত বাড়াতেই হলো? আরসালান গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। দেয়ালে থাবা মেরে বলে ওঠে, ”আমার ভালো থাকাতে তোমার সবসময় খারাপ হয়, তাই না ব্রো? এতো ঘৃণা পুষো আমার সবকিছুতে?”

লাগাতার সে ঘুষি বসায় দেয়ালে, হাত কেটেছিঁড়ে চুইয়ে রক্ত পড়ে তার। বাইরে থেকে বন্ধ দরজাটায় পরপর কয়েকটা লাথি বসায়। অনেকক্ষণ পর ইহসানের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। আরসালানকে থামতে বলছে সে। থামে আরসালান ঠিকই, কিন্তু তার ঘরের ভাঙা আয়নাটাকে আরো চূর্ণবিচূর্ণ করার পর।

দরজা খুলে চৌকাঠেই দাঁড়ায় ইহসান। শীতল চোখে দেখে তার ভাইয়ের দুরবস্থা। ভঙ্গুর দেহটা নিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। পায়ের নিচে কাচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। কেটেছেও অনেকটা। ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে গিয়ে দেখতে থাকে কোথায়, কোথায় কেটেছে ওর। কিন্তু আরসালান দেয় না। ক্ষোভে সরিয়ে নেয় বারবার।
রুক্ষ স্বরে বলে উঠে, “আমার চুল, দাঁড়ি? আমার
ছেলেধরা ভিশন কোথায় গেল?”

ইহসানের সোজাসাপটা জবাব, “কেটে ফেলেছি।”

“চুল কেটে কি ঠান্ডা করতে চাইলে? আমার তো ঠান্ডা লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে মগজের ভিতরে আগুন জ্বলছে!”

তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখ লাল, কণ্ঠ রুক্ষ। ইহসান মুখ তুলে ওর হাত আবারও টেনে নিয়ে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিতে দিতে বলে, “তুই আগে নিজেকে আয়নায় দেখেছিস কখনও? যা হাল করে রেখেছিস চেহারার, তাতে তোকে শ্মশান থেকে ফেরত আনা লাশ বলেই লাগত। এখন অন্তত একটু মানুষ দেখাচ্ছে।”

আরসালান তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তাই? আমি মানুষ? মানুষ হলে আমাকে বন্দীর মতো রাখা হচ্ছে কেন?”

ইহসান ধীরেসুস্থে ওর হাতের ক্ষত ব্যান্ডেজ করে ওর বিক্ষিপ্ত চোখে চোখ রেখে তাকায়। বলে, “বন্দী থাকতে
চাস না?”

“তুমি চাও?”

“কে চায়?”

“তাহলে আমি কেন চাইব?”

“কারণ তুই খুব বেশি উগ্র।”

“উগ্রতা আটকাতে পারবে এভাবে আমাকে আটকে রেখে?”

“আটকে রাখতে চাইছি না তো।”

ইহসান বলতেই, সটান উঠে গেল আরসালান। এরপর গায়ে থাকা ছেঁড়া গেঞ্জিটা আরো টেনে ছিঁড়ে ফেলে মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে টলতে টলতে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কয়দিন পর? তিনদিন। ইহসান কিছু বলল না, না রাগ দেখাল। বরং যেতে দিলো। কারণ আসলেই এভাবে কাউকে আটকে রাখা যায় না। আর সে যা করতে চাইছে, তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। একটু স্পেস দেওয়াই যাক। ইহসান ঘরটা পরিষ্কার করে বেরিয়ে এসে দেখল, মূর্তির মতোন শক্ত হয়ে সোফায় বসে আছে জান। চোখমুখ ভাবলেশহীন। কেমি তার পা চাটছে আর সে কেমির মাথায় হাত ঘষছে। পাশে বসে আজিজ শেখ তার মান ভাঙানোর চেষ্টা করছে। ইহসানের সেখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। সে চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু আজিজ শেখ তাকে চলে যেতে দেখেই বিক্ষিপ্ত গলা চড়িয়ে বললেন, “ওর এই অবস্থা কেন করলা আব্বাজান? কাজটা ঠিক করো নাই তুমি। যা করতে চাইছ মানা করি নাই, কিন্তু চুল ফালানোর কি প্রয়োজন ছিল? বাড়াবাড়ি হইসে এইডা।”

ইহসান সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জবাব দিলো, “যেন দুঃখে আপনার চোখে জল চলে আসে। তো, জল এসেছে? নাকি আসেনি? না আসলে আনুন। কারণ আপনার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার।”

আজিজ শেখ অগ্নিচোখে দেখলেন ওকে।

°

শেফালি বুয়াকে কাজে কুটাবাছার কাজের সাহায্য করছিল সৃজা, এলিজা। সন্ধ্যের নাস্তা এবং রাতের রান্না হচ্ছে তিন পদ। ভাত, ডাল আর গরুর মাংস। মাংসের সুঘ্রাণ রান্নাঘরের বাইরে অবধি চলে এসেছে। সোফায় একধ্যানে বসে থাকা আরসালান, এমনকি কেমির নাকেও সেই ঘ্রাণ এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমি তো ওর পায়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় বুভুক্ষের মতোন দাঁড়িয়ে থেকে এলিজার থেকে দু টুকরো মাংস নিয়ে এসেছে। দরজার বাইরে বাটিতে তুলে খাচ্ছে। আরসালান চেয়ে চেয়ে দেখে কেমিকে। এ ক’দিন যাবৎ নাওয়া খাওয়া বন্ধ তার। পানি ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। এখন মাংসের ঘ্রাণ নাকে লাগতেই সে টের পাচ্ছে ভয়ংকর ক্ষুধায় তার পেটে রীতিমতো ইঁদুর নাচছে।

চা বানিয়েছিল সৃজা ইহসানের জন্য। সেটা দিতেই ঘরে যাবে, বসার ঘরের সামনে আসতেই দেখল আরসালান নিস্তেজ ভঙ্গিতে সোফায় শুয়ে আছে। টকটকে লাল চোখ। চেহারার হাল বেহাল। তার উপর নতুন লুকে পনেরো-বিশ বছরের তরুণের মতো লাগছে৷ অথচ লোকটা কী এক জীবনের মায়াজালে আটকে আছে, বেরুনোর চেষ্টা নেই। কেন নেই? সৃজা আগ্রহবোধ করে জানার জন্য। কিন্তু অযাচিত আগ্রহ দেখানো ঠিক হবে না ভেবেই নিজেকে সংযত করে। পরক্ষণেই কী ভেবে ট্রে’টা নিয়ে সে ইল
ইনজানের কাছে গেল। হালকা কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ
করে বলল, “চা খাবেন?”

কীসের ভাবনায় যেন মগ্ন ছিল ইনজান, সৃজার কণ্ঠস্বর শুনে ধ্যানে ফিরল। আশ্চর্য! ল্যাভেন্ডার তাকে চা সাধতে এসেছে? ইম্প্রেসিং! সে ঘাড় নাড়ে, ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে, “কেন খাব?”

তৎক্ষনাৎ কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারে না সৃজা। বলে, “কেন খাবেন তা তো জানি না। আমি শুধু অফার করলাম। আপনার প্রয়োজন হলে বা খেতে ইচ্ছে করলে অফার গ্রহণ করতেই পারেন। তাতে শেফ একটু খুশি হবে।”

“শেফ?”

“এইযে, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।”

ইনজানের হঠাৎ খুব মজা লাগল। বাঁকা স্বরে শুধাল, “আচ্ছা, আমি বললেই চা হাজির করবে তুমি?”

“বললেই হাজির করব ব্যাপারটা এমন না। তবে চেষ্টা করা যায়।”

আরসালান নিষ্পলক চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। সৃজা এবারে একটু বিব্রতবোধ করে৷ চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে আবারও বলে, “আপনার চা।”

“চা ভালো বানাও বুঝি?”

“শুধু ভালো না, খুব ভালো বানাই।”

আরসালান ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়, “এতো কনফিডেন্স?”

সৃজা বলে, “সবাই যখন খেয়ে প্রশংসা করে, নিজের কাছেও যখন ভালো লাগে তখন নিজের কাজের উপর, কনফিডেন্স নিয়ে কোনো সমস্যা সন্দেহ থাকার প্রশ্নই তো উঠে না।”

আরসালান হেসে ফেলল, খুব স্বাভাবিক দেখাল ওকে। কে বলবে, লোকটা এডিক্টেড? এই ভাইটার জন্য ইহসান কতোটা দুশ্চিন্তায় আছে, সে তো কাছ থেকে দেখছে।
সৃজার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরুল।

চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে আরসালান বেশ আয়েশ করেই সেটা পান করল। তার বাহ্যিক আচরণেই সৃজা বুঝতে পারে চা-টা ভালো লেগেছে ওর। হুট করে কী হয়, সৃজা রান্নাঘরে গিয়ে থালায় ভাত, তরকারি, সালাদ সাজিয়ে এনে ওর সামনে রেখে বলে, “আপনি তো কিছুই খাননি দু’দিন যাবৎ। এই নিন আজকের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ। ডিনারটা না হয় আরেকটু রাতে নেবেন।”

বেগুনি ফুল তাহলে খেয়াল রেখেছে তার দিকে, সে খাচ্ছে কী খায়নি? আরসালান হতভম্ব হয় না। একটুও না। বরং তার মজা লাগে। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে। অনিতা রেহমানকে মনে পড়ে। ঐ মহিলার মেয়েই তো ল্যাভেন্ডার। তার দ্বারা এসব যেন খুব স্বাভাবিক। সে ভাতের থালা নিয়ে বাটিতে থাকা সবটা গরুর মাংসের কারি ঢেলে দিয়ে গপাগপ মুখে তুলতে থাকে। সৃজা হতভম্ব হয় ওর খাওয়ার ধরণ দেখে৷ চমকে উঠে বলে, “আস্তেধীরে খান ভাইয়া।”

লোকমা তুলতে তুলতে ইনজান বলে, “ভাইয়া ডেকো না ল্যাভেন্ডার। আচ্ছা, মাংসটা কে রেঁধেছে? তুমি? আসলেই বেস্ট শেফ তুমি!”

নাকেমুখে ভাত, ঝোল মেখে একাকার। প্রশংসা শুনে সৃজা স্তিমিত নেত্রে তাকিয়ে থেকে হতাশ স্বরে জবাব দেয়, “ওটা আমার বোন মানে এলিজা রেঁধেছে।”

তৎক্ষনাৎ খাওয়া থামিয়ে দেয় আরসালান। বিস্ময় নিয়ে তাকায়৷ বলে, “লালপরী রাঁধতেও শিখে গেছে?”

সৃজার তার ভুল শুধরে দিলো, “আমার বোনের কথা বলেছি। এলিজা, আমার ছোটো বোন। ও রেঁধেছে।”

সেই সময়টাতেই ডাক পড়ে সৃজার। ইহসান ডাকছে। চা নিয়ে আসতে কতক্ষণ, জিজ্ঞেস করছে। সৃজা চট করে আরসালানের পানে তাকায়। বিব্রত স্বরে বলে, “আপনার কিছু লাগলে শেফালি খালাকে ডাকবেন। খালা রান্নাঘরেই আছে। আমি একটু আসছি।”

দুটো বাক্য বলেই সৃজা চলে যেতে নেয়, কিন্তু কী মনে করে আবার ফিরে আসে৷ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “একটা প্রশ্ন করি?”

“হাজারটা করো।”

“ল্যাভেন্ডার কে?”

আরসালান রহস্যময় তাকায়। হেসে বলে, “আমার না হওয়া মায়ের মেয়ে। আমার না হওয়া বোন। জানো তো, ওর উপর আমার খুব দরদ।”

বিভ্রান্ত হয় সৃজা। মানে কী, তার ভাবনা ভুল? ঐ-যে শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে একটা পার্সেল এসেছিল ল্যাভেন্ডারের নামে, সেটার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই? কেউ ছিল না তার পেছনে? সৃজা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে আসে। ইনজান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “আমার না হওয়া বোন৷ তোমাকে আমার ভালো লাগে। এতোই ভালো যে, তোমার অজান্তে তোমার পিছু লেগেছি বহুবার। অথচ তুমি টেরই পাওনি।”

বলে হাসে সে। অনিতা রেহমানের বড়ো মেয়েটাকে কিছুটা ভিন্নভাবেই ভালো লাগে তার। এমন ভালো, যেটা সে ইহসানের সামনেই একাধিকবার স্বীকার করেছে। বিনিময়ে পেয়েছে কেবল তার ভাইয়ের অগ্নিদৃষ্টি। কিন্তু সত্যিই মেয়েটি অসাধারণ! কথাবার্তা, আচরণ, রূপ—সবদিক থেকেই তার মাঝে দশে নয় পাওয়ার মতো কিছু আছে। কিন্তু মেয়েটা উদাসীন প্রকৃতির। নয়তো এতদিনে বুঝে যেত, স্বামীর ছোটো ভাইটি তাকে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ করছে। অবশ্য পরখ করে বলতে সে যে তার রুপ-সৌন্দর্য দেখে ব্যপারটা কিন্তু এমন না। সে খোঁজে এমন কিছু, যা দেখে তার ভাই ল্যাভেন্ডারের প্রতি নিজের জীবন উজাড় করে দিয়েছে। এ বাড়িতে ফেরার সময় তার ইচ্ছা ছিল ভাইয়ের কাছ থেকে ল্যাভেন্ডারকে ছিনিয়ে নেবে, নিজের করে নেবে। কিন্তু সেদিন ছাদে ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্রোধে হাত কেটে ফেলার পর, লাল জামা পরা মেয়েটা এসে যখন দাঁড়াল, এক মুহূর্তের জন্য তার সবকিছু কেমন থমকে গিয়েছিল। মেয়েটির মুখে কী যেন এক অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল অনিতা রেহমানের সঙ্গে। বহুদিন পর তার ভেতরটা কেমন উলটপালট হয়ে পড়েছিল।

এরপর! জন্ম দায়িনী মায়ের ঘ্রাণ মিশে থাকা এ বাড়িটাতে সে নিজ ঘরে দিনের পর দিন বন্দী থেকেছে। ল্যাভেন্ডারকে নিজের করে পাবার জন্য কিছুই করেনি। কেন করেনি, তা মন জানে না। তবে সেদিন রাতে তৃষ্ণার্ত তাকে পানি খাওয়ানো কিংবা অবচেতনে ভুল ছবি এঁকে ফেলার পরে মন তাকে আবছাভাবে যা জানান দিলো, মনে পড়তেই রান্নাঘরের দিকে চোখ যায় তার৷

°

খাওয়াদাওয়া সেরে আরসালান টি-টেবিলের উপর থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে চোখ বুলায়। তাতে যুতসই কিছু খুঁজে পায় না। বিরক্ত হয়ে ম্যাগাজিনটা রেখে দেয় সে৷ রান্নাঘরে চোখ যায়, ওখানে এখন কেউ নেই৷ কেমিটা অনেকক্ষণ তার পায়ের কাছে বসে ঝিমুচ্ছে। আরসালানের ইচ্ছে করে ওর ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে, “ডু ইউ লাভ মি ড্যাডি?”

কেমি লাফিয়ে উঠে তার কোলে আসে, গা ঘেঁষে মাথা ঘষে। মুখ চেটে দেয়। আরসালান ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠে, “তুই আমার মুখ চাটিস, ঘন্টার পর ঘন্টা পাশে বসে থাকিস, এমনভাবে তাকাস যেন আমি তোর গোটা পৃথিবী কিন্তু এসবের মধ্যে ভালোবাসা কোথায় আমি বুঝতে পারি না রে।”

“বোবা প্রাণী কথা বলতে পারলে ঠিকই বলতো, সে আপনাকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু আপনি ওর আচরণ দেখেও বুঝতে পারছেন না?”

কৌতুকপূর্ণ পুরুষালি কণ্ঠ। কানে বাজতেই আরসালান চোখ তুলে তাকায়৷ পরনে প্যাস্টেল ব্লু শার্ট, অফিস ফেরত চেহারার এক যুবক দাঁড়িয়ে। যার মুখে লেগে আছে অমায়িক হাসি। আরসালান আপাদমস্তক তাকে দেখে নেয়। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল আছে, দাঁড়িগোফও আছে ভালোই। দেখেই বিতৃষ্ণা জন্মায় মনে আরসালানের। এ কে? আবার এসে তাকে জ্ঞান দিচ্ছে? তাকে কি চুলের বাহাদুরি দেখাচ্ছে? তার যে নেই এটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাচ্ছে? আরসালানের গা-পিত্তি জ্বলে উঠল।
ততক্ষণে যুবক এগিয়ে এসে পরিচিত হবার জন্য তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সামনাসামনি দেখা হয়নি তবে আপনাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। আপনি ইনজান শেখ। এ বাড়ির ছোটো ছেলে। আমি আকাশ— ইস্মিতার বড়ো ভাই, ইজহান শেখের সমন্ধি।”

আরসালান শুনলো, দেখল তবে হ্যান্ড শেইক করার জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হাতটাতে সে হাত মেলাল না। ভ্রু কুঞ্চন করে রুঢ স্বরে বলল, “তো? আমি কী করব?”

আকাশ কিছুটা অপমানিত হওয়ার কথা, কিন্তু নিজেকে সংযত করে নিলো। এই না হলে শেখ পরিবারের ছেলে? আচরণে যেন বলে দিতে হয়, তারা আজিজ শেখের ছেলে, তারা আলাদা। সে ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল, “আপনি কী করবেন না করবেন, সেটা সত্যিই আপনার ব্যাপার। তবে পরিচিত থাকা ভালো। ভবিষ্যতে, কে জানে, কোনোদিন কোথাও একে-অন্যের কাজে লেগে যেতে পারি।
বাই দ্য ওয়ে, আপনার পোষা প্রাণীটা সুন্দর! নিশ্চয়ই মনিবভক্ত?”

মনিব ভক্ত না কি চোখে দেখতে পাচ্ছে না? রাহে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো ওর হাত। নিশপিশ করতে লাগল একনাগাড়ে৷ কে না কে, তার সাথে যেচে পড়ে এসে কথা বলছে। জ্ঞান দিচ্ছে। তাকে অর্থব বোঝাতে চাইছে। তার বাহ্যিক অবয়ব নিয়ে নিশ্চয় মনে মনে ঠাট্টা করছে? সে পাত্তা দিলো না। ম্যাগাজিনে চোখ বুলাল। আকাশ আর ঘাঁটাল না। তবে অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। এরপর যখন সম্বিৎ ফিরল, সে খেয়াল করল শারাফ তার গালে হাত দিয়ে ডাকছে।
আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল।
শারাফকে কাছে টেনে হাঁটুর উপর বসিয়ে হেসে
বলল, “এ দেখি চাঁদ!”

শারাফ গালে মুখে হাত বুলিয়ে দিলো ওর। আকাশ চমৎকার হেসে সেই আদর ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“তো, কেমন আছ শারু?”

“ফাইন। তুমি?”

“আমিও ভালো আছি।”

“আসবে বলেও আর এলে না কেন তুমি?”

“ব্যস্ত ছিলাম সোনা। এজন্য তো তোমার পাপড় বোনকেও দেখতে আসতে পারিনি।”

শারাফ অভিমানী গলায় বলল, “আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল। আজ এসেও ডাকলে না তুমি আমাকে।”

বাচ্চাটা এত ভদ্র আর মনখোলা, এমনভাবে কথা বলে যে আদর না করে থাকা যায় না। আকাশ ওর কথা শুনে নিজেও মন খারাপের ভান করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে সোনা। আমি ভেবেছিলাম তুমি বাড়ি চলে গেছ।”

“মাম্মা বলেছে আমরা আরো থাকব।”

আকাশ ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “তাহলে তো ভালো হলো। পাপড়কে দেখতে আসলে তোমার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে।”

“তুমি আমাদের বাড়িও যেও। আমি আমার সব টয়সগুলো তোমাকে দেখাব। আর এখানে তো কেমিও আছে, আসো তোমাকে দেখাই। এই কেমি এখানে আসো।”

বলে শারাফ কেমিকে ডাকল। ভীষণ উৎসাহিত দেখাল ওকে। ততক্ষণে অবশ্য পরিচিত মুখ দেখে কেমি নিজেই এগিয়ে গেছে শারাফের কাছে।
শারাফ আকাশের সঙ্গে কেমিকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আদুরে চেহারার প্রাণীটাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না তার মালিকের রুক্ষ আচরণের জন্য। আকাশ কেমির গায়ে হাত বুলিয়ে আদর দিতেই কেমিও মিশে যায় তার সঙ্গে। তার চকচকে রিস্টওয়াচটা শুঁকতে থাকে। হাত চেটে দেয়। আকাশ হেসে ওর মাথায় হাত রাখে।

কাউকে নিয়ে মাথাব্যথা যেহেতু নেই, এতদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না আরসালানের। ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা বদলের সময় হুট করে কেমিকে আকাশের নিকটে দেখে তার শিরায় শিরায় রাগ ছড়িয়ে পড়ল। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল, “কেমি, কাম হেয়ার।”

কেমি ওর ডাক শুনে তাকায়, কিন্তু কাছে যায় না। ফিরে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। যেন এই খেলাটা সে বেশ উপভোগ করছে। এটা…এটা বোধহয় প্রথম! কেমির অবাধ্যতা করল জানের সঙ্গে। আরসালানের মেজাজ বিগড়ে গেল। রাগ চরমে উঠল তার। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, “কাম হেয়ার, আদারওয়াইজ তোকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসব।”

মনিবের চিৎকার শুনে কেমি চমকে উঠল। পরক্ষনেই ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে, কুঁইকুঁই করে ক্ষমা চায়। তবুও আরসালানের রাগ কমে না৷ সে চিৎকার করে চাকরকে ডেকে আদেশের সুরে বলল, “এইটাকে এক্ষুনি ভালো করে পরিষ্কার করে আনবি, নয়তো ওকেসহ তোকেও রাস্তায় ফেলে আসব।”

জান মামার রাগ দেখে শারাফ ভয়ে আকাশের হাত আঁকড়ে ধরে বসে। সত্যিই কী, জান মামা কেমিকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবে? ওর মন খারাপ হয়ে যায়, চোখে জলে টলমল করতে শুরু করে। এদিকে আকাশ হতচকিত। ব্যবহারেই বুঝেছিল লোকটা শর্ট টেম্পার্ড। কিন্তু এমন অভাবনীয় আচরণ করতে পারে সে কল্পনা করেনি। এই লোক কী ইজহান শেখের চেয়েও এককাঠি উপরে?

_______

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারি
#পর্ব-৭২[শেষ]

ভেজা শরীরটা ড্রায়ারের সাহায্যে শুকানো হচ্ছে। শরীর জুড়ে থাকা বড়ো বড়ো লোমগুলো বাতাসের তাড়নায় ফরফর করে উড়ছে। অন্যসময় হেলেদুলে মুহূর্তটা উপভোগ করলেও আজ কেমির মুখভার৷ ঘেউঘেউ শব্দে বাড়ি কাঁপিয়ে মনিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তার মনিব ফিরেও তাকাচ্ছে না তার দিকে। না কিছু বলছে। বরংচ অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সে তার উপর কতোটা রেগে আছে। কেমির কিছু করার নেই, অসহায় চোখদুটি দিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।

রাগে শরীরটা এখনো জ্বলছে আরসালানের। হাউ ইজ ইট পসিবল? কেমি কীভাবে তার ডাক উপেক্ষা করতে পারল? তাও আবার যারতার জন্য? পথ থেকে তুলে এনে পেলেপুষে কুত্তাটাকে বড়ো করেছে, এ দেশে নিয়ে এসেছে তাকে এই দিন দেখানোর জন্য? আরসালানের ইচ্ছে করছে ঘাড় ধরে এটাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য। সে অবশ্য দিলোও। মিনিট দশেক পর নিজের মানসিক অস্থিরতা আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাড়ির বাইরে বের করে দিলো। বাগানের কোণে বেশ পুরোনো একটা খোয়াড় ছিল, সেটাতে থাকতে দিলো ওকে৷ নির্বাসিত হয়ে কেমির মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। প্লেটভর্তি খাবার পেয়েও হামলে পড়ে সেসব খেলো না। মাংসের লোভেও না৷ কেমি মাটিতে শরীর বিছিয়ে শুয়েই রইল, মাঝেমাঝে লেজ নেড়ে জানান দিলো তার অভিমান। মকবুল অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন ওকে খাওয়াতে ব্যর্থ হলো এবং হতাশ হয়ে এসে আরসালানকে খবরটা দিলো। শুনে ক্ষিপ্ত আরসালান ঘর কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কুত্তার বাচ্চাটাকে ধরে আন৷ কষে কয়েকটা ঘা না লাগালে এটার ভিমরতি ছুটবে না।”

হুংকারে মকবুলের মনে হলো তার কানে তালা লেগে গেছে। কানে হাত চাপা দিয়ে বিচলিত সে ভয়ে ভিয়ে বলল, “মটকা মাইরা পইড়া আছে, উঠে না। খালি লেজ নাড়ে। জোরাজোরি করতে গেলে কামড়াইতে আসে।”

“ছুরি নিয়ে আয় তো।”

মকবুল আঁৎকে উঠল, “ছুরি কেন? কেমিরে মাইরা ফেলবেন নাকি স্যার?”

আরসালান উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না, বিরক্ত চোখে দেখল ওকে।

এই স্যারটা এতো নির্দয়? মনে মনে শয়তানের বাচ্চা গালি দিয়ে মকবুল আচমকা বলে ফেলল, “দরকার লাগে ওরে সারাজীবন খোঁয়াড়ে বন্দী কইরা রাখেন, নয়তো রাস্তায় ফেলায়ে দেন। এরপরেও এই অমানবিক কাজটা কইরেন না স্যার।”

“তুই আমাকে মানবিক জ্ঞান দিচ্ছিস? তোর মুন্ডু ঘেঁটে দেখব আমি ওখানে কতো মানবিকতা আছে, হারামির বাচ্চা।”

চোটপাট নিজের উপর এসে পড়তে পারে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে মকবুল পগাড় পার হলো। ছুটতে গিয়ে অবশ্য দু’বার টাল হারিয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। তবে টাল হারালেও বোধবুদ্ধি পুরোপুরি হারাল না। খবরটা গিয়ে ইহসানের কানে পৌঁছে দিলো। কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে বসে রইল ইহসান এসব শুনে। কেমির উপর কেন ক্ষিপ্ত হয়েছে বদমাইশটা? এর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে? লনেশা-ভাং না পেয়ে মাথা কি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে? মহা যন্ত্রণায় পড়া ইহসান তড়িঘড়ি করে ছুটে গেল নিচে৷

মকবুলের কল্যাণে ততক্ষণে খবরটা সাড়া বাড়িতে এই খবর প্রচার হয়ে পড়েছে। খবর শুনে শারাফ তার বিচলিত এলিজা আন্টিকে নিয়ে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ছুটে এলো। ওদের পেছনে পেছনে নামলো ইজহানও। অফিস থেকে ফিরেছে সে একটু আগে। এসে দেখে বাড়িতে তার সমন্ধি আকাশ সাহেব এসেছে। তার মেয়েকে নিয়ে বাঁদড়টা খেলায় মগ্ন। আধঘন্টা যাবৎ নিয়ে কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে, তার কাছাকাছি ঘেঁষছে না।
যদি ভাগ্নিকে আর কোলে না দেয়, এই শঙ্কায়। চুপিসারে বাঁদড়টার জুতা ইজহান বারান্দা দিয়ে ঝোপে ফেলে দিতেই যাচ্ছিল, কিন্তু আরসালান কেমির লেজ কেটে দিচ্ছে এই খবর শুনে সব ফেলে টেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। প্রথমদিকে কেমিকে অপছন্দ করলেও এখন মোটামুটি পছন্দই করে সে। কারণ অন্য কুকুরদের মতো এতো যন্ত্রণা দেয় না। কথাও শুনে খুব। হুটহাট ঘরেও ঢুকে পড়ে না। ভীষণ প্রভুভক্ত। সে তাই আদর না করলেও অনাদর করে না। রুটি, কেকও খেতে দিয়েছে দু’দিন। ইজহানের সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন কেমি কুইকুই শব্দ তুলে মাথা নিচু করে নিজের ভুল স্বীকার করে, মাফ চায় তখন।

সকলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দেখল খোয়াড়ের ভেতর কেমি বসে লেজ নাড়ছে। তার চোখে একরাশ ভয়, শঙ্কা। ফল কাটার ছুরি নিয়ে উবু হয়ে বসে আরসালান বেরিয়ে আসতে বলছে, গালি ঝাড়ছে কেমিকে। কিন্তু ফরাসি ভাষায় কী গালি দিচ্ছে সেটা ইহসান ছাড়া আর কেউ বুঝল না। সে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ছুরি নিয়ে তুই কী করছিস এখানে?”

“লেজ কাটব৷ লেজ কেটে এর লেজ নাড়ানোর নাটক আমি বের করব।”

“মানে তুই কী পাগল? যা তা করছিস একেবারে।”

ইজহান এসে গলা খাকারি দিয়ে নিজের বিরক্তি ঝাড়ল, “তোর না বাপ হয়? তো দোষটা কী তোর বাপের?”

“দোষ মানে? মহা দোষ বলো। আমার খেয়ে, আমার পরে এই কুত্তা আজকে আমার কথা অমান্য করেছে। তাও আবার কার জন্য জানো? ঝাঁকড়া চুলের আকাইশ্যার জন্য। ভাবতে পারো কেমি কুত্তাটার
স্পর্ধা কতটুকু বেড়েছে?”

যা নয় তা-ই বলছে। কাকে নিয়ে বলছে? আকাশকে? তীব্র রাগে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলো ইহসান ওর গালে। পাশ থেকে ইজহানও তার গালে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘আকাইশ্যা কেন বললি এটা তার গিফট!’

আরসালান গালে হাত দিয়ে চোয়াল শক্ত করে দু-ভাইয়ের দিকে তাকাল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “আমার থেকে এই হারামি কুত্তা আর ঐ আকাইশ্যার জন্য তোমাদের এতো দরদ?”

ইজহান কিছু বলার আগেই ইহসান গর্জে উঠল, “একদম বাজে বকবি না। আকাশকে নিয়ে তো একদমই না। ওকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলার রাইট তোর নেই। ও তোর মতো মাথাখারাপ, উন্মাদ বাপের টাকায় ফুটানি করা রাজপুত্র না। উচ্চশিক্ষিত, খেটে খাওয়া বিনয়ী মানুষ। তুই ওর নখের যোগ্যতার ধারেকাছেও নেই। তাই উল্টাপাল্টা বলে নিজের ঠুনকো সম্মানটা হাওয়া করে দিস না।”

গমগমে কণ্ঠে কথাগুলো বলে ওর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলো ইহসান৷ আরসালানের ভেতরটা আরো টগবগ করে ফুটতে লাগল। ঐ আকাইশ্যার নখের যোগ্যতাও তার নেই? এমনটাই বলল বিগ ব্রো? এদিকওদিক মাথা নাড়িয়ে ব্যাক ব্রাশ করল সে তার মাথার অর্ধ ইঞ্চির চুলগুলোতে। মাথা নুইয়ে গাঢ় করে নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর গলা চুলকাতে চুলকাতে মুখ
তুলল উপরের দিকে। তখনি আরসালানের নজরে পড়ল সদর দরজার বাইরে শারাফকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এলিজার উপর। মেয়েটার চোখমুখে রাগ আর তীব্র বিরক্তি। রাগে যেন কাঁপছে। এত্তো রাগ? আরসালান ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল ওর দিকে। যেন বুঝতে চেষ্টা করল অনিতা রেহমানের ছোটো মেয়েটা তাকে অসন্তোষ নিয়ে কেন দেখছে?

এলিজা এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়াল না। শারাফের হাতটা মুঠো বদ্ধ করে ওকে নিয়ে ভেতরে চলে এলো। কিছুতেই বুঝতে পারছে না লোকটা কীভাবে এতো পাষাণ হতে পারে? অহেতুক, অযৌক্তিক কারণে নিজের পোষা প্রাণীকে এমন গুরুতর শাস্তি দেওয়ার কথা যে চিন্তা করতে পারে সে কী, আস্ত অমানুষ।
নীলু ফুপির বলা কথাটা মনে পড়ল ওর, ‘এই ছেলে উন্মাদ, পাগল। এর থেকে দূরে দূরে থাকিস।’

মানুষ উন্মাদ, পাগল হয়৷ কিন্তু তাই বলে এতোটা নির্দয়? এলিজার মন বিষিয়ে গেল কেন জানি!

°

ইজহান শেখের অহংকারী ছোটো ভাইয়ের অমানবিক চিন্তাধারার কথা আকাশের কানে এসেছে এইমাত্র। শুনেই সে হতভম্ব এবং বিচলিত। এতো আদুরে প্রাণীটাকে এভাবে টর্চার করার কথা চিন্তায় এনেছে কীভাবে আরসালান শেখ? এ তো আস্ত অমানুষ? ঘটনা যদি সত্যিই এমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে সে এই অমানুষটাকে আজ উচিৎ শিক্ষা দেবে। কোনোভাবেই পিছু হটবে না, না কুকুরটার কিছু হতে দেবে। এই ভেবে ভাগ্নিকে রেখে সে ছুটে আসে নিচে। কিন্তু নিচে নামতেই সামনে তার সামনে পড়ে গেল এলিজা। আকাশ ওকে দেখে হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ শারাফ এলিজার হাত ছাড়িয়ে ছুটে এসে ওর কোলে উঠে পড়ল। আকাশ ওকে তুলে নিয়ে এলিজাত দিকে তাকাল। হাসার প্রচেষ্টা করে বলল, “ইস্মি বলল তোমরা এখনো রয়ে গেছ, আমি দেখাই করতাম।
কিন্তু এখন শুনলাম, কুকুরের উপর টর্চার করা হচ্ছে। বিষয়টা জেনেই ছুটে এলাম। মকবুলের থেকে শুনলাম ওর লেজ কেটে দেবে। এসব তো হতে দেয়া যায় না।”

ওর উদ্বিগ্নতার কথা জানতে পেরে এলিজা বলল, “ভাইয়ারা নিয়ে আসছে ওকে। কোনো ক্ষতি হয়নি। কেমি একদম ঠিক আছে।”

একটু স্বস্তিই পেল বোধ হলো আকাশ। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল, “যাক তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম ঘটনা সত্যি হলে ত্রিপল নাইনে ফোন দিয়ে ইনজান শেখের একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব। এসব শুনলে মাথা ঠিক থাকে?”

“আমারও মাথা ঠিক নেই।”

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ওরা৷ আকাশ বলল, “চলো বসি, বসে কথা বলি।”

দু’জনে গিয়ে বসল সোফায়। কথাবার্তা হতে লাগল টুকটাক। আকাশ জিজ্ঞেস করল, “তুমি তো টিউশন করো শুনেছিলাম। তো এখন ম্যানেজ করছ কীভাবে?”

এলিজা আন্তরিক কণ্ঠে বলল, “সপ্তাহে তিনদিন করে পড়াই। এরমধ্যে ওদের পরীক্ষা শেষে কয়েকটা দিন ছুটিও ছিল। আমার ভার্সিটিও কয়েকদিন বন্ধ গেছে। তাই এতো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। তাছাড়া আগে কখনো কোথাও যাওয়া হয়নি, ছুটিও চাইনি। এবারই প্রথম। তাই আন্টিরা একটু ছাড় দিচ্ছে। তবে এই ছাড়ের বেশি সুযোগ নেব না, চলে যাব শুক্রবার। এরপর আবার ব্যস্ততার দিন শুরু হবে।”

“তুমি খুব পরিশ্রমী মেয়ে। ভালো কিছু করতে পারবে।”

“দোয়া করবেন।”

“বেস্ট অব লাক।”

“থ্যাংক ইউ।”

“এতো ফর্মাল হতে হবে না।”

“তা বললে চলে? আপনি আমার সিনিয়র। সিনিয়রদের আবার এলিজা রেহমান খুব সম্মান করে।”

ওর রসিকতায় আকাশ হেসে ফেলল, এলিজাও।

°

হিড়হিড় করে টেনে আরসালানকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে ইহসানের নজরে পড়ল আকাশ এবং এলিজার উপর। তারা বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। ওদের সামনে দিয়ে অমানুষটাকে নিয়ে ভেতরে যেতে বিব্রতবোধ করল সে। তাই একপাশে সরে এসে নিজের ক্রোধটাকে চাপা দিয়ে আরসালানের হাতটা ছেড়ে নিচু স্বরে বলল, “ওদের সামনে দিয়ে তোকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাই না। তাই এখান থেকে সোজা ঘরে যাবি।”

ইজহান আর মকবুল মিলে কেমিকে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। আরসালান তাকালও না এই বেঈমান কুকুরটার দিকে। তার কথা অমান্য করেছে, কীভাবে পারল কেমি? শীতল কণ্ঠে বলল সে, “যাব না।”

“এখানে কোনো সিন ক্রিয়েট করবি না।”

“ঐ সোফায় আমি শুয়ে ভাত খেয়েছি। আকাইশ্যা আমার সোফায় বসেছে কেন?”

ইহসান কটমট করে বলল, “মার খেয়েও তোর জেদ যায়নি? আকাশ তোকে কি করেছে?”

আরসালান বলল না আকাশ তাকে কি করেছে। অবশ্য করলে তো বলবে। কিন্তু আকাশকে তার অসহ্য লাগছে। ইচ্ছে করছে কয়েক ঘা বসিয়ে মুখের মানচিত্র পাল্টে দিতে। যেচে পড়ে জ্ঞান দিতে আসে!
ইহসান ওকে চুপ দেখে আবারও শক্ত গলায় বলল, “তুই যাবি না আমার হাতে ধোলাই খাবি? নাকি ঘরবন্দী করে রাখব?”

আরসালান শীতল চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো, “আমার ড্রা গ দাও।”

“ওসব পাবি না।”

আরসালান ভ্রু উঁচিয়ে ঠাট্টার সহিত বলল, “কেন? ভালো বানাতে চাইছ আমাকে? কিন্তু আমি তো ভালো হব না।”

“তোর লাইফের গোল নেই?”

“তোমার শান্তি বিনষ্ট করা।”

ইহসান তাচ্ছিল্যভরে হাসলো, “এত অশান্তিতে রেখেও তোর শান্তি হলো না? তাহলে জেনে রাখ, তোর শান্তি হবেও না যতোদিন আমি বেঁচে আছি। আমি মরেটরে গেলে শান্তির মাকে পাস কিনা তখন বুঝে, দেখে-শুনে নিস।”

এটুকু বলে বসার ঘরে চলে গেল ইহসান আরসালানকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়েই। সে শাণ মুখ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। ক্রোধ নিয়ে চলে এলো ভেতরে। কয়েকটা মুহূর্ত, এই হবে ত্রিশ-চল্লিশ সেকেন্ডের মতো সে দাঁড়াল বসার ঘরের ওখানে। ঘাড়টা বাঁকিয়ে দেখল আবার মেয়েটাকে। কথায় মগ্ন এলিজার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় কিছু একটা ইঙ্গিত দিতেই তার চোখ পড়ল শকুনের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে তাকানো লোকটার দিকে। ও ভীষণ বিব্রত হয়ে চুপ করে গেল। নিজেকে আড়াল করল ইহসানের পাশটাতে। শারাফকে টেনে এনে কোলে বসাল। আরসালান তা দেখে বাঁকা হাসলো। এরপর সিঁড়ির ধাপ পেরুল। যা দেখে এলিজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারো সহজ হয়ে এলো ওদের সাথে।

সিঁড়ি মাথায় উঠে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের গল্পের আড্ডা দেখল আরসালান। তার চোয়াল শক্ত। তার ভাই এতো কেন প্রায়োরিটি দিচ্ছে, হেসে কথা বলছে আকাশটার সাথে? তার সাথে তো এভাবে বলে না। আবার অনিতা রেহমানের ছোটো মেয়েটাও কী নিয়ে বিশ্লেষণও করছে এটার সাথে? তখন তাকে অসন্তোষ নিয়ে দেখেছে, একটু আগে নিজেকে লুকিয়েও ফেলেছে। কেন? আরসালান তীক্ষ্ণ চোখে দেখল ওকে।

°

ইহসান আসার পর অনেকটা সময় পড়াশোনা, রাজনীতি, চাকরি-বাকরি নিয়ে আলাপ হয়েছে। এলিজার কোমড় ধরে এসেছে বসে থাকতে থাকতে। তাই বিদায় নিয়ে উঠে এলো সেখান থেকে। শারাফ অবশ্য এলো না। সে কেমিকে দেখতে গেছে ইজু মামার সাথে। দোতলার করিডোরটা তখন খালি, আবছা অন্ধকার। এলিজা ধীরপায়ে হেঁটে শোয়ার ঘরটার দিকে যাচ্ছিল। তার আগেই দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষমাণ লম্বা একটা ছায়ামূর্তি হঠাৎ ওর গা ঘেঁষে পাশ কাটিয়ে গেল। ফিসফিসানো কণ্ঠে বলল, “নাইস স্মেল।”

এলিজা শিউরে উঠে তৎক্ষনাৎ দূরে সরে গেল। হতভম্ব হিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কী হলো এটা তার সাথে!

______

[৭২ শেষ, এরপর ৭৩ থেকে শুরু হবে। গল্পটা এখন অন্য ধারাতে চলছে, যেটা অনেকেই রিলেট কর‍তে পারছেন না, কিন্তু আমি ভেবেই রেখেছিলাম এরকম। বলেও দিয়েছি সেটা। প্লিজ যাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগছে তারা ইতি টানতে পারেন, কেন না আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হোক তা চাই না। আমি আমার মতো ভেবে লিখব, আপনারা নিজেদের মতো ভেবে আশাহত হবেন এটা আমার কাছে ভালো লাগবে না। আপনাদের মনমতো লিখতে না পারা আমার ব্যর্থতা, তাই আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আবার বলছি, গল্প যেমন ভেবে লিখছি তেমন করে লিখতে পারলে শেষ পর্যন্ত মনে হয় না এই গল্প আপনাদের প্রিয়র তালিকায় থাকবে বা যুক্ত হবে। তবুও আমি সেভাবেই লিখে যাচ্ছি, কেন না ভেবে রেখেছিই তেমনটা। আমার অপারগতা, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…