অসময়ের শুকতারা পর্ব-০২

0
18

#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০২

– আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লেন্ড করতে চলেছি।

পাইলটের মাইক্রোফোনের আওয়াজ কানে আসলে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা যায় হিমের। নাকের ডগা থেকে সানগ্লাস টা খুলে শার্টের ওপর ঝুলিয়ে রাখে সেটা। তারপর নিজের তীক্ষ্ম দৃষ্টি আরোপ করে তার সামনে বেঁধে রাখা লোকটার দিকে। ভয়ে তার চোখ জোড়া যেনো বের হয়ে যাচ্ছে প্রায়। শক্ত কালো কষ্টেপ দিয়ে তার হাত, মুখ, পা পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

হিম সিট থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার পাশে রোবটের মত দাড়িয়ে আছে একদল কালো পোশাকের গার্ড, তাদের মধ্যে একজন দুটো চাপা*তি এগিয়ে দেয় হিমের দিকে। হিম সেদিকে না তাকিয়েই চা*পাতি দুটো হাতে নিয়ে সশব্দে একটা আরেকটার সাথে ঘষা শুরু করে, দেখে মনে হবে কোনো কিছু করার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সে চা*পাতি দুটোকে ধারালো করে নিচ্ছে। কাজটা করা শেষ হলে সে আবারও ভয়ং*কর দৃষ্টিতে তাকায় লোকটার দিকে।

– সময় দিয়েছি, কিন্তু মুখ খুলিস নি। এত প্রভুভক্তি তো কুকুরেও দেখায় না, আর তুই কিনা মানুষ হয়ে শেষে কুকুরের পথ বেছে নিলি? তাহলে আজ তোকে কুকুরের মতো মে*রে তোর দেহের অবশিষ্ট অংশ তোর প্রভুর কাছে পাঠিয়ে দিব।

হিম সাথে সাথেই দুহাতে দুটো চাপাতি ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেঝেতে বেঁধে রাখা লোকটার ওপর। প্রথমে লোকটার তার মুখ, তারপর গলা কেটে ক্ষতবি*ক্ষত করতে থাকে সে। কয়েক মুহূর্ত পরই লোকটা মা*রা গেলেও তার রেখে যাওয়া দেহ ভীষণ ভাবে হিমের নির্দয়*তার সাক্ষ্য হয়। চারদিকে লাল রক্তে*র ছড়াছড়ি, এমনকি হিমের সারা শরীর সেই র*ক্তে ভিজে গেছে। সেখানে উপস্থিত সকল গার্ড আবেগহীন চোখে দেখছিল ক্ষণে ক্ষণে তাদের বস কতটা নৃশং*স হতে পারে। দেহের ঊর্ধ্বাংশ এতটাই ক্ষতি*গ্রস্ত করেছে যে ডিএনএ টেষ্ট ছাড়া লোকটার পরিচয় আইডেন্টিফাই করার উপায় নেই।

সাদা শার্টের হাতার নিচের অংশ দিয়ে হিম নিজের র*ক্তমিশ্রীত ঘামের ফোঁটা মুছে নেয়, মুখে তার পরিতৃপ্তির হাসি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে গার্ডদের উদ্দেশে বলে,

– ব্রেইন, লিভার, কিডনি, আইস্, হার্ট, লান্স সব আলাদা করবে ব*ডি থেকে। ভালকরে প্রিজারভ করে লন্ডনের সেন্ট্রাল হাসপাতালে পাঠাবে। এই বা*স্টার্ড এর অরগান বিক্রি করে ভালো এমাউন্ট না পেলে ওকে এটুডুর ক্যারি করে আনাই বৃথা। Do fast boys, otherwise your situation will be like this.

নিজের চোখের সামনে জ*লজ্যান্ত মানুষটাকে এভাবে খু*ন হতে দেখে ভয়ে চমকে উঠে ইকবাল। গার্ড হিসেবে সে একেবারেই নতুন। হিমের সেক্রেটারি ফয়সালের কাজিন হওয়ায় জয়েনের এক সপ্তাহের মধ্যেই সে তার বসের পার্সোনাল গার্ড হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। এই এক সপ্তাহে সে তার স্যারকে চিনেছে ভীষণই বদ*রাগী আর জেদি মানুষ হিসেবে। যেটা সে চায়, দুনিয়া কিয়ামত হয়ে গেলেও সে সেটা আদায় করেই ছাড়ে। কিন্তু আজ যেন নতুন এক হিম কে আবিষ্কার করলো সে, ক্ষুধা*র্ত বাঘের মত হিম নিজের শিকার কি যেনো আছ*ড়ে কাম*ড়ে একেবারে ছিঁ*ড়ে ফেলেছে।

ইকবাল এই সময়টুকু ফয়সলের পিছনে দাঁড়িয়ে ভয়া*র্ত দৃষ্টিতে প্রথমে তাকিয়ে থাকলেও পরবর্তীতে স*হ্য না করতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলে সে।

হিম যখন নিজেকে ফ্রেস করার জন্য সেখান থেকে বাথরুমের উদ্দেশে যাচ্ছিল তখন তার কানে আসে এক কমবয়সী ছেলের ফিসফিসানির শব্দ। পিছন ঘুরে দেখে ইকবাল ফয়সলকে যেনো কি একটা বলছে। তাদের কথা শোনার জন্য সে কান খাড়া করে।

– ভাই, তুই আমাকে কোন রাক্ষসে*র কাছে কাজ করতে এনেছিস, উঠতে বসতে এমন জঘ*ন্য ভাবে মানুষ মা*রে, আবার মৃ*ত দেহ থেকে ওরগান আলাদা করে বিক্রি করে দেয়। স্যারের তো টাকার অভাব নেই তাহলে হিউম্যান অর্গান ট্রাফি*কিং কেনো করছেন?

– উনি যা ইচ্ছা তাই করুক তোর সমস্যা কি? মাসে মাসে তোর টাকা পেলেই তো হলো। চুপচাপ কাজে হাত লাগা যদি এই কপাল পোড়াটার মত বলি না হতে চাস।

ইকবাল একটা শুকনো ঢোক গিলে সামনের দিকে পা বাড়ানোর আগেই কারো কন্ঠ শুনে সে যেনো একেবারে জমে যায়। ডাকের সাড়া দেওয়ার যেনো কোনো শক্তিই নেই তার।

– hey you, green t- shirt, come here.

ইকবাল কাঠের পুতুলের মত হিম এর দিকে তাকিয়ে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করে বলে,

– স্যার আমাকে ডাকছেন?

– Are you fu*king f*ool? এখানে তুমি ছাড়া আর কেও কি গ্রিন শার্ট পড়েছে?

ইকবাল সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।

– তাহলে ওখানে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছ কেনো? আসতে বলেছি না।

ইকবাল দ্রুত পায়ে হিম এর ঠিক সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হিম তার বাজ পাখির মতো দৃষ্টি দিয়ে একবার ভালো করে স্কেন করে নেয় ইকবালকে। ভেতরে ভেতরে ছেলেটা ভীষণ রকম ঘাবড়ে যাচ্ছে।

– নতুন?

– জি – জি স্যার।

– ফয়সলের কাজিন?

– জি – জি স্যার।

– নাম কি ?

– ইকবাল।

– কি বললে, কার বা*ল?

– স্যার, ইকবাল।

– ওহ, full name?

– মোদাচ্ছের আলী ইকবাল।

– এত জ*ঘন্য নামটা কে রেখেছে? যত্তসব বু*লশিট, উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে গেলো। যে নামটা রেখেছে আমার হয়ে তাকে কষিয়ে দুটো চ*ড় মেরে দেবে।

– স্যার, যে আমার নামটা রেখেছিলেন তিনি তো আর বেঁচে নেই। তাহলে কি করে তাকে চ*ড় –

– Shut up stu*pid. ফয়সাল, এগুলো কাদের আমার দলে জুটিয়েছো? এত এক্কেবারে ফিডার খাওয়া বাচ্চা।

– জি স্যার , ও এখনও ফিডারই খায়।

– তোমার নাম কি?

– কেনো স্যার, ফয়সাল।

– পুরোটা বলো।

– সাভিয়ান আহমেদ আহসানউল্লাহ ফয়সাল।

ফয়সালের পুরো নাম শুনে হিম কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

– আমার ইচ্ছা করছে তোমাদের দুটো ভাইকে এক্ষুনি বিমান থেকে মাটিতে ফেলে দিতে। মানে এখনকার মা বাবাদের ট্রেন্ড চলছে, কে তার সন্তানের কত বেশি অদ্ভুত না রাখতে পারে।

– জী স্যার ঠিক বলেছেন।

হিমের প্রতিটা কথায় হে তে হে আর না তে না মিলানো যেনো ফয়সলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই জন্য মাঝে মাঝেই অনেক বিরক্ত বোধ করে হিম।

– দাঁত না কেলিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে যাও দুজন। তানাহলে আজ একজনের অর্গানের জায়গায় তিনজনের অর্গান সাপ্লাই হয়ে যেতে পারে।

_________________________________________

প্রায় দু ঘণ্টা যাবত নিজের ছোটবেলার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সাদাত। বিমানবন্দরের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। না প্ল্যান লেট হলে তো হিম আগেই জানিয়ে দিত। তাহলে এখনো সে বের হচ্ছে না কেনো সেটা বুঝে উঠতে পারছে না সাদাত।

হিম আর সাদাত দুজনেই একই স্কুলে পড়ত, সেখান থেকেই তাদের গভীর বন্ধুত্ব বেড়ে উঠে, যাকে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় লেং*টা কালের বন্ধু বলা চলে, আর ইংরেজিতে বলে, neck*ed friend 😂😂😂। স্কুলে পড়া শেষ করে হিম তার বড় ভাইয়ের সাথে বিদেশে পাড়ি জমায়। ছোটবেলা থেকে মা বাবা না থাকলেও হিম আর হাস্যোজ্বল চেহারা দেখে কখনোই বোঝা যেতো না যে এই ছেলেটা মাত্র তিন বছর বয়সে মা বাবা কে হারিয়েছে। বাড়ির কাজের লোকদের হাতে মানুষ হওয়ায় আদর ভালবাসা যত্ন কখনোই জোটেনি তার কপালে। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল তার বড় ভাই তুষার। তুষার বয়সে দশ বছরের বড় তার থেকে, সে হিম কে ভাই হিসেবে নয়, বরং সন্তানস্নেহে ই বড় করে তুলেছে।

দীর্ঘ সাত বছর পরে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল সাদাতের ভিতর, তাই হয়তো শীতের কড়া রোদেও দাঁড়িয়ে থাকতে তার মোটেও ক*ষ্ট হচ্ছিল না। একসময় দুর থেকে একটা কন্ঠ তার কানে ভেসে আসলে সাদাত সামনের দিকে তাকায়। সে দেখতে পায় হিম এক হাত উচু করে অন্য হাতে লাগেজ টানতে টানতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু হিম আর পিছনে প্রায় বিশের ও বেশি গার্ডের দেখে কিছুটা ভড়*কে যায় সাদাত। তাও হিম কে বুকে জড়িয়ে ধরতে সে কার্প*ণ্য করে না।

– কি রে দোস্ত কেমন আছিস? রোদে দাঁড়িয়ে থেকে তো একেবারে পোড়া কাঠ হয়ে গেছিস?

হিম আর কথায় সাদাত এক গাল হেসে বলে,

– আর তুই তো বেটা বরফের দেশে থেকে থেকে পাক্কা ইংরেজ হয়ে গেছিস। বাংলা বুঝিস তো নাকি ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।

– বাঙাল ভাষায় বললে আরও ভালো হয়। তুই তো জানিস শুদ্ধ বাংলা আমার পোষায় না। হয় বাঙ্গাল নাহয় ইংলিশ।

আবারও হাসিতে ফেটে পড়ে দুই বন্ধু। সাদাত নিজের হাসি থামিয়ে হিমের পিঠে একটা চা*পড় মেরে বলে,

– শা*লা, ভালো হইলি না। চল বাসায় চল। আর কতক্ষন রোদে দাঁড়িয়ে থাকবি।

– দাঁড়া আগে এদের বাড়ি পাঠিয়ে নেই। Boys তোমরা সবাই আমার বাংলো তে যাও, আমি কিছুদিন পর বাংলো তে ফিরব ওকে।

গার্ডরা হিম এর কথামত গাড়িতে উঠে বাংলো তে চলে যায়। এবার হিম সাদাতের কাঁধে হাত রেখে বলে,

– তো এখন তোর বাসায় যাওয়ার জন্য কিসের ব্যবস্থা করেছিস? লোকাল বাস নাকি রিকশা। নাকি আবার বলবি পায়ে হেঁটে যাইতে।

– না কেব বুক করিয়েছি, টেনশন করিস না। আমি তো আর আমার বিদেশী বন্ধুকে ক*ষ্ট দিতে পারি না।

___________________________________________

বাসার চৌকাঠ পেরোনোর আগেই কারো সাথে জোরে এক ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় হিম। পিঠ বরাবর পড়ায় কোমরে খানিক চোট পায়। চোখ বুঁজেই সে তার সাথে ধাক্কা লাগা ব্যক্তিটাকে ইচ্ছে মত গা*লি দিতে থাকে।

– কানা নাকি, দেখতে পাস না শা*লা। চোখ দুটো কি বগলের নিচে লুকিয়ে রেখে চলাফেরা করিস? দিলি তো কোমরটা ভেঙে, এখনও বিয়ের দাঁতই উঠেনি, তার আগেই কোমর ভাঙা দাদুর মতো করে দিলি। এখন বাস*র রাতে যদি আমার বউ পালিয়ে যায় তবে আমি তোর মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবো।

শীতল তার প্রশস্থ আঁখি জোড়া মেলে মেঝেতে পড়া থাকা ব্যক্তিটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অচেনা অজানা লোক, তার বাড়ির সামনে এসে তার সাথেই ধাক্কা খেয়েছে, এখন পড়ে গিয়ে তাকে উল্টোপাল্টা কথা শোনাচ্ছে।

অপরপক্ষ থেকে কোনো উত্তর না আসায় হিম এবার রাগান্বিত চোখে তাকায় শীতলের দিকে। আর সাথে সাথেই তার দৃষ্টি থেকে রাগ যেনো বাষ্পাকারে উড়ে যায়। শুধু রাগ নয় বরং এক আবেগহীন চোখে সে তাকিয়ে থাকে শীতলের দিকে। মেয়েটার রূপ বড়ই অদ্ভুত, বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না, এত সুন্দর লাগলো তাকে হিম এর কাছে। সারাজীবনে কম মেয়ে দেখেনি, তবে তারা কেউই এই মেয়েটার সামনে কিছুই না। কয়েক মিনিট পর মুগ্ধতা কেটে গেলে হিম খেয়াল করে মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের স্পাইক করা চুলগুলো হাতাতে হাতাতে হিম শীতলের কাছে গিয়ে বলে,

– I know I am handsome. তাই বলে এভাবে তাকিয়ে আমার রূপের ওপর কু*নজর দিবে ছে*মরি। সরীর বদলে কু*নজর দেওয়া কি উচিত হলো তোমার?

শীতল ভালই বুঝতে পারছে ছেলেটার মাথায় বড় ধরনের সমস্যা আছে। তাই সে কোনমতে তার থেকে পালিয়ে বাচে। জীবনে কখনও কোনো মেয়ে তার কাছ থেকে পালায় না। বরং হিম তাদের দূরে ঠেলে দিলেও তারা বেহা*য়ার মত তার পিছু করেছে। কিন্তু এই প্রথম কোনো মেয়ে তাকে ইগনোর করায় তার রাগ আনন্দ দুটোই হচ্ছে।

– বাঙালি মেয়েতো, ইগনোর করাটা এদের অভ্যাসগত বদ*ভ্যাস। সমস্যা নেই, নিজে থেকেই আমার কাছে ছুটে আসবে ছেম*রি। এটিটিউড দেখিয়ে পাত্তা পাওয়ার ধা*ন্দা, naughty girl.

চলবে………………