#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৩
হিম কে সদর দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদাত কপাল কুঁচকে তার কাছে যায়। সে এতক্ষণ এখানে উপস্থিত ছিল না, আজ সকালে হিম কে বাড়িতে আনার উদ্দেশে বাইরে হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে জয়া তার হাতে বাজারের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। হিম কে বাড়িতে ছেড়ে সাদাত পাড়ার মুদির দোকানে গিয়েছিল লিস্টের জিনিসগুলো কিনতে। কিন্তু যাওয়ার আগে সে হিম কে বলেছিল সে যেনো সাদাতের জন্য অপেক্ষা না করে বাড়িতে প্রবেশ করে।
সাদাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় বাড়ির সকলে হিমকে ভালো করেই চিনে। বিশেষ করে হিম যেনো জয়ার কলিজায় টুকরা। মা ম*রা ছেলেটাকে সে ছোট থেকেই বেশ ভালবাসতো। কতদিন যে সাদাতের জন্য টিফিন বানানোর পাশাপশি হিমের জন্য এক বক্স টিফিন বরাদ্দ রেখেছে তার ইয়াত্তা নেই। আজ এত বছর পর ছেলেটা দেশে আসবে শুনে জয়া সকাল থেকে হিমের পছন্দের সকল পদ নিজের হাতে রান্না করছেন।
সাদাত হিমের কাছে এলে সে দেখতে পায় একটা নির্দিষ্ট দিকে হিমের চোখ যেনো পলক হারিয়েছে, মুগ্ধতা চেয়ে গেছে তার চোখে মুখে, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি দেখে যে কেও আন্দাজ করতে পারবে সে হয়তো তার জীবনের অদেখা আকাঙ্ক্ষিত কোনো বস্তুকে স্বচক্ষে দেখেছে।
সাদাত হিমের ঘাড়ে হাত রাখলে হিম নিজের ঘোর থেকে বের হয়ে আসে। সাদাত কিছুটা হাসির চলে তাকে বলে,
– কি রে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিস কেনো? বিদেশে রেখে আসা গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়ছে বুঝি?
হিম একগাল হেসে সাদাত কে বলে,
– বিদেশের মেয়েগুলো বেশি সহজ সরল, জিলাপির পেঁচ নেই তাদের মাথায়, মনে নেই কুটিল*তা, তাই তারা বরাবরই আমার কাছে আনইন্টারেস্টিং। তাই তাদের কথা ভেবে সময় নষ্ট করার মতো আধপা*গল ছেলে এই আয়ুশ খান হিমাদ্র নয়, আমি হলাম এক্কেবারে ফুলপা*গলা ব*জ্জাত পোলা, made in Banhladesh।
– ভাই তুই এমন এমন কথা বলিস যে আমি না হেসে থাকতে পারি না।
– হেসে নে, কিন্তু প্রাণ খুলে হাসার আগে এটা বল, তোর বাসার ওই সাদা ক্ষেতের কালো মূলাটা কে রে?
হিমের কথা শুনে সাদাত যেনো আকাশ থেকে পড়ে। গলা খিঁচে বলে সে,
– সাদা ক্ষেতের কালো মুলা? এটা আবার কী?
– এটা যে কি সেটা আমি নিজেও জানি না, জাস্ট তুলনা দিলাম আরকি। তোর বাসার ওই এটিটিউড ওয়ালা মেয়েটা কেরে, যে দেখতে তেমন সুন্দর না হলেও নিজেকে বিশ্বসুন্দরী মনে করে। কালো কালো চুল, খাড়া নাক, ফর্সা গায়ের রং আর কোমল মোলায়েম ঠোট।
হিমের মুখে এই বর্ণনা শুনে সাদাতের বুঝতে বাকি থাকে না যে সে শীতলের কথাই বলছে। সাথে সাথেই সাদাতের মুখ কালো হয়ে উঠে। ভিতরে ভিতরে সে রাগে ফুঁসতে থাকে, মেয়েটাকে সে বলেছিল যেনো ঘর থেকে না বের হয়। কিন্তু ঘাড় ত্যা*ড়া মেয়ে ঠিকই বাইরে বের হয়েছে। সাদাত অতি ক্ষীণ কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– মা*গী রূপ প্রদর্শন করার জন্য ঠিকই বার হয়েছে।
– দোস্ত আর ইউ ওকে? হঠাৎ গুম মেরে গেলি? কিছু হয়েছে?
সাদাত নিজের চেহারা স্বাভাবিক করে বলে,
– কই না তো? ওহ ওটা আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বড্ড দে*মাগ তার, আজই তার দে*মাগ আমি শেষ করবো।
– এত সুন্দর মেয়েটা কাজের ছে*মরি, how can it possible?
ঠিক সে সময়ে জয়া সেখানে চলে আসেন। হিম কে দেখে সাথে সাথেই তিনি তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন। জয়ার সাথে সাথে হিমের মুখেও পরিতৃপ্তির হাসি দেখা যায়। দীর্ঘকাল সে এই মাতৃস্নেহের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত ছিল। আজ সেই স্পর্শ যেনো তার মনকে শিথিল করে দিচ্ছে।
– কেমন আছিস বাবা? বিদেশে গিয়ে তো তোর জয়া আন্টি কে ভুলেই গিয়েছিলি? নয়মাসে ছয়মাসে একবার করে ফোন দিতি, তাও এই সাদাত টা ভালো করে কথা বলতে দিত না তোর সাথে।
– আমি কি করে আমার সুন্দরী আন্টিকে ভুলে যেতে পারি? বিদেশে এত মেমসাহেব দেখেছি বাট কেও তোমার নখের ও যোগ্য না।
– হয়েছে পা*জি, আর পাম দিতে হবে না। যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, তারপর আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খাব কেমন? তোর জন্য বিশ জাতের রান্না করেছি।
– কি বলো আণ্টি বিশ জাত? বুঝেছি এই কয়দিন তোমার কাছে থাকলে আমার ওয়েট দ্বিগুণেরও বেশি বাড়বে, শেষে দেখো এমন না হয় যে অত্যধিক ওয়েট এর জন্য আমাকে বিমান থেকে মাঝ পথে না নামিয়ে দেয়।
– ভালই কথা শিখেছিস, যা যা আর দাঁড়িয়ে থাকিস না, গোসল সেরে আয়।
– আন্টি কোন রোমটা আমার?
– দুতলার একেবারে শেষের রুমটা।
জয়ার কথা শুনে সাদাতের মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। কারণ ঠিক তার পাশের রুমটাই শীতলের। সে শীতল কে যত আড়াল করতে চাচ্ছে, পরিস্থিতি যেনো আরও বেশি শীতল এর হিমের সাক্ষাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
হিম নিজের রুমের উদ্দেশে পা বাড়ালে সাদাত জয়ার কাছে এসে রাজি কন্ঠে বলে,
– মা শীতল কোথায়?
– ওর ঘরে কেনো?
– সেটা তোমার না জানলেও চলবে।
– সাদাত বাপ আমার, আজকের দিনটা মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করিস না।
– ও আমার কথা অমান্য করে রুম থেকে কেনো বেরিয়েছে? এসব করার আগে ওর শা*স্তি কী হতে পারে সেটা ভাবা উচিত ছিল।
– তাই বলে অতিথির সামনে তুই ওকে মার*বি?
– দরকার হলে তাই করবো, পরপুরু*ষের সামনে ওর ঢং করা আজ আমি বের করছি।
এই বলে সাদাত শীতলের রুমের উদ্দেশে পা বাড়ায়।
___________________________________________
তীব্র ব্য*থায় ক্ষণে ক্ষণে কুঁকড়ে উঠছে শীতল। তাই যেনো একটুও দয়ামায়া হচ্ছে না সাদাতের। বরং সে যেনো আরও শক্ত করে মুচড়ে ধরছে শীতলের হাতখানা। মুখে আওয়াজ করার শক্তি হারিয়ে কেবল নীরবে কান্না করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই শীতলের। চোখের কোনে জমা নোনা জলের স্রোতই যেনো তার একমাত্র প্রতিবাদের হাতিয়ার।
বেশ খানিকক্ষণ পর সাদাত শীতলের হাত ছেড়ে দিলে বেচারি মেঝেতে পড়ে যায়। অসম্ভব যন্ত্র*ণায় মুখ কালো হয়ে যায় তার, ব্যথা*র স্থানে হাত রেখে চোখ বুঁজে থাকে সে কিছুক্ষণ। কিন্তু সেটাও যেনো সাদাতের স*হ্য হচ্ছে না। শীতলের কাছে গিয়ে সজোরে তার মুখ চেপে ধরে সে। শীতল বাধ্য হয়েই তার আহত হাত দিয়ে নিজেকে সাদাতের কঠো*র স্পর্শ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
– তোকে আমি সকালে কি বলে গিয়েছিলাম? কথা বলার সাথে সাথে কি শোনার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিস তুই? নাকি শুধু আমার কথা গুলোই তোর কানে ঢোকে না, অন্য সবার সাথে হেসে খেলে ভালই তো সময় কাটাস।
এবার হয়তো শীতলের চোখের পানির ফোঁটা গুলো সাদাতের মনটা গলাতে সক্ষম হয়। ফলশ্রুতিতে সে শীতল কে ছেড়ে দিয়ে দূরে হতে দাঁড়ায়। কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা চালায়। এদিকে সাদাতের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে শীতল নিজেকে মেঝের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেলে।
– মা বাবা, কেনো আমায় এই নিষ্ঠু*র পৃথিবীতে একলা ফেলে গেলে? এখানে বিনা কারণে আমাকে মা*রা হয়, মাঝে মাঝে আমি নিজেও বুঝতে পারি না যে কোন অপ*রাধে আমাকে শা*স্তি দেওয়া হচ্ছে। প্লীজ আমাকে ও এবার তোমাদের সাথে নিয়ে চলো, আর পারছি না আমি, আর পারছি না।
কথাগুলো নিজের মনে বলতে গিয়ে কিছুটা শব্দ করেই শীতল কেঁদে দেয়। শীতলের কান্নার আওয়াজ পেলে সাদাতের মনের মধ্যে অনুশোচ*নার জন্ম হয়। প্রতিবার মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার এর পর এই অনুভূতিটা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়, কিন্তু কোনোবারই নিজেকে আটকাতে পারে না। মাথা গরম করে ঠিকই শীতলের সাথে এই ব্যবহারগুলো করে ফেলে সে।
হালকা ঝাপসা চোখে একবার শীতলের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে শীতলের কাছে যায় সে। আস্তে করে তাকে মেঝে থেকে তুলে সে। গায়ে সাদাতের স্পর্শ পেতেই শীতল আবারো দূরে সরে যেতে চায় এই ভেবে যে মানুষটার হয়তো তাকে মে*রে এখনও শান্ত হয়নি।
কিন্তু এবার ভীষণ আলতো করে সাদাত শীতলের মুখখানা নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নেয়।
– কেনো বুঝিস না আমি ঠিক কী কারনে তোকে অন্য কারো সামনে যেতে বারণ করি। অন্য কেউ তোকে দেখুক এটা আমি সহ্য করতে পারি না। অন্য কারো চোখে তুই প্রশংসার পাত্রী হোস্ এটা আমি নিতে পারি না। তুই যেমনি হস্ তোকে দেখার অধিকার শুধু আমার, বুঝেছিস শুধুমাত্রই আমার।
এই বলে সাদাত শীতলকে জড়িয়ে ধরতে নিলে শীতল নিজ থেকে তার কাছ থেকে সরে আসে। মুখ ফিরিয়ে নেয় সে সাদাতের থেকে। এতে সাদাত মনে মনে কষ্ট পেলেও মুখে কিছুই বলে না। চুপচাপ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে।
চলবে………………….