#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৪
– এই যে মিস্টার হ্যান্ডসাম, কি কখন থেকে খবরের কাগজে মুখ লুকিয়ে রেখেছেন, আমার দিকেও একটু নজর দিন, কখন থেকে আপনার দর্শন পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে এখানে বসে আছি। এতটা খারাপ দেখতে যে আমার দিকে আপনার তাকাতে ইচ্ছা করে না?
মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজ পড়ার সময় হিমের কানে এক পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসে। চেহারা না দেখলেও কণ্ঠের মালিক কে সেটা হিম ভালই আন্দাজ করতে পারে। অনেকদিন পর বাংলাদেশ পত্রিকাটা হাতে পেয়ে পড়ার ইচ্ছাটা সে দমাতে পারে না বিধায় টেবিলের উপর থেকে খবরের কাগজ টা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে থাকে সে। কিন্তু তার এই পড়ার মাঝে ছেদ ঘটে মিনার অতি বিরক্তি*কর ন্যাকা*মি কন্ঠ শুনে। চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে হিমের, মেয়েটাকে সে একেবারেই স*হ্য করতে পারে না সে। গায়ে পড়া থার্ড*ক্লাস মেয়ে যাকে বলে, ন্যাকামি তার শিরায় শিরায় আচ্ছন্ন। মিনাকে দেখলে কিংবা তার কন্ঠ শুনলে হিমের ইচ্ছা করে নিজের পার্সোনাল রাই*ফেলটা দিয়ে মেয়েটার শরীর ঝাঁঝ*রা করে দিতে, কিন্তু সাদাতের আপন বোন হওয়ায় প্রতিবার মিনা প্রাণে বেঁচে যায়।
মুখের সামনে থেকে কাগজ টা সরায় হিম, মি*থ্যে মি*থ্যে একটু হাসির চেষ্টা করে কাগজটা ভাঁজ করতে করতে মীনাকে বলে,
– আরে মিনা, কত বড় হয়ে গেছিস বোন? আমি তো প্রথমে চিনতেই পারি নি। টা এবার কোন ক্লাসে উঠেছিস?
হিমের মুখে বোন শব্দ টা শুনে মিনার কালো মুখ আরও কালো হয়ে যায়। নাটকীয় কান্নার ভান ধরে ডু চোখ ডলতে ডলতে বলে,
– চিনবেন কেনো আমাকে, আমি আপনার কে? একদিনও তো ফোন করে খবর নেন না সব সময় সাদাত ভাই আর মায়ের সাথে কথা বলেন। আমি অনেক কষ্টে ভাইয়ার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে নিলেই হাজার অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দেন, একটা বড় চেয়েও দেখেন না।
মিনার রং ভঙ্গের কথা শুনে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠে হিম, কিন্তু হাসির আবরণে সেটা ঢাকা পড়ে যায়। মনে মনে সে নিজেকে বলে,
– বুঝোস ই যখন তোকে ইগনোর করি, তাহলে বারবার ন্যাকা*মো করে কথা বলতে যাস কেনো ছে*মরি। নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছিস কখনও, কালা দাতল মাইয়া। তোর দিকে তাকানোর আগে যেনো আমার দুই চোখ খান খসে পড়ে, আমি যেনো অন্ধ হয়ে যাই।
কথাগুলো নিজের মনের মাঝেই আবদ্ধ রেখে হাসিমুখে হিম আবারো বলে উঠে,
– বললি না যে কোন ক্লাসে এবার তুই বোন?
– বলব না, কোনো কথাই বলব না আপনার সাথে, আপনি একটা বা*জে লোক। আপনিও আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না।
– তোর লগে কথা কইতে আমু, আমায় তো পাগ*লা ছাগলে কামরাইসে। তুই নির্ল*জ্জের কথা আমার সাথে কথা না বলতে আসলে আমারই শান্তি। ( মনে মনে )
– কেনো আমি কি করেছি বোন ,যে তুই আমার সাথে কথা বলবি না?
মিনা এবার আর স*হ্য করতে না পেরে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ায়। ইচ্ছে করে গাল ফুলিয়ে সে বলে,
– কখন থেকে বোন বোন করে চলেছেন কেনো? আমি আপনার কোন সম্পর্কের বোন লাগি?
– বন্ধুর বোন মানে তো আমারও বোন, সেই হিসেবে তুই আমার সখাতো বোন।
– না আমি আপনার বোন নই, বুঝেছেন? আমি আপনার অন্য কিছু।
হিমের রাগ চরম সীমা স্প*র্শ করে। ইচ্ছে করে এক চ*ড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মুখ ফাটি*য়ে ফেলতে। হাত হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হিম বলে,
– বোন মানে বোন আর তোর অন্যকিছু মানেও বোন। এখন যা জয়া আন্টি কে হেল্প কর কাজে। শরীরেই শুধু ধাম*ড়ি হয়েছিস, কাজে কর্মে বুদ্ধি কিছুই বাড়েনি দেখছি।
কথাগুলো খানিক ধমকের সুরেই বলে হিম। যা হবার হবে কিন্তু তাতে যদি মিনার ছেঁচ*রামো থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাতে কিছু যায় আসে না হিমের। হিমের ধমকা*নোতে কাজ হলো, মিনা মুখ বেঁকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
হিম আবারো হাস্যোজ্বল চোখে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে তার মাথায় একটা বিষয় খেলে যায়।
– সেই কখন সাদা ক্ষেতের কালো মুলা কে দেখেছিলাম, এরপর তো আর ওকে নিচে দেখলাম না। কাজের ছেম*রির কত তেজ রে বাবা, মালিক রান্না করে অস্থির আর তেনার কোনো খবর নেই। আর কত রঙ্গ দেখব এই চব্বিশ বছরের জীবনে।
কিছুক্ষণ পরে সাদাত সেখানে আসে। হিম কে দেখেও সে কোনো কথা বলে না, চুপচাপ হিমের পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে সেটার ওপর। হিম কাগজ পড়তে পড়তে আড়চোখে তাকায় তার দিকে। সাদাতের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এক ভ*য়াবহ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা হিম কে ভীষণই ভাবায়। কোনো বি*পদে পড়লে সাদাতের সবার আগে তাকে জানানোর কথা, কিন্তু আজ কি এমন হলো যে সাদাত হিম কে কিছুই বলছে না।
বাধ্য হয়ে হিম এই নীরবতা কাটিয়ে সাদাতের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে।
– কি রে বন্ধু, মুখটা এমন পেঁচা*র মত করে রেখেছিস কেনো? এমন পেঁচা*মার্কা মুখ দেখলে তোর কপালে তো ভয় জুটবে না। সারাজীবন অন্যের বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাপি*ত্তেস করতে করতেই জীবন চলে যাবে।
হিমের কথায় সাদাত কেবল এক মুচকি হাসি, নিজে থেকে কোনো কথা বলে না। হিম এবার নিজেকে শক্ত করে ফেলে। সাদাতের কি হয়েছে তাকে জানতেই হবে। ব্যাপারটা কড়া গলায় সে সাদাতকে জিজ্ঞাসা করতেই যাবে অমনি জয়া খাবারের পাতিল নিয়ে তাদের সামনে হাজির হয়। দুজনের প্লেটে খবর বাড়তে বাড়তে তিনি বলেন,
– বেশি অপেক্ষা করালাম নাকি হিম?
– তোমার জন্য তো আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারি আন্টি। দেখো না চব্বিশ বছরের বু*ড়ো হয়ে গেলাম , তাও কোনো মেয়েকে বিয়ে করলাম না, শুধু তোমারই জন্য।
– বড্ড পা*জি হয়ে গেছিস, তবে রে।
জয়া এবার ভালো করে কান মূলে দেয় হিমের। হিম সে তো হেসে কুটি কুটি। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই সাদাতের। সাদা ভাতের দিকে তাকিয়ে সে পলক হারিয়েছে। জয়া দুজনের প্লেট সাজিয়ে ওপরে যেতে নিলে হিম তাকে পিছন থেকে ডাকে।
– আণ্টি, ওপরে কোথায় যাচ্ছ, আমাদের সাথে দুপুরের খাবারটা সেরে নাও।
জয়া পিছন ফিরে তাকায় হিমের দিকে। একটু আগের হাসির মায়ায় ছেয়ে যাওয়া চেহারাটা কেমন গুমো*ট হয়ে গেছে। কন্ঠে সেই ঝংকার নেই।
– সন্তানের কৃতকর্মের প্রায়*শ্চিত্ত করতে যাচ্ছি, তুই খেয়ে নে, আমার জন্য অপেক্ষা করিস না। আমি পরে খেয়ে নেবো।
এই বলে জয়া আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়।
_________________________________________
সন্ধ্যায় বাড়ির কর্তারা ফিরে এলে খুশির আমেজ ফিরে পায় নিস্তব্ধ বাড়ীটা। আজকে তাদের বিশেষ অতিথিকে কেন্দ্র করেই জমে উঠেছে গল্পের আসর। সকলের মাঝে বসে বেশ ভালো অনুভব করে হিম। আজ যদি তার পরিবার বেঁচে থাকতো হয়তো তাদের প্রতিটা সন্ধাও এমন উৎসব মুখর হতো।
শীতলের দাদার চার ছেলে। দাদা গত হয়েছেন অনেক আগে, এখন শুধু আছেন তার সহধর্মিণী আর তার বংশধরেরা। চার ছেলের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, তার দুই সন্তান, সাদাত আর মিনা। তারপর হলেন মিরাজ উদ্দিন আহমেদ, রাহুল আর হিমির বাবা। সেজো ছেলে মাহমুদ আহমেদ, শীতলের বাবা। আর ছোট ছেলে তাদের সাথে থাকে না, তিনি কাজের সূত্রে শহরের বাইরে সপরিবারে থাকেন, মাঝেমধ্যে এসে মা ভাইদের সাথে দেখা করে যান।
নিজের রুম থেকে হাসি আড্ডার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে শীতল। বড্ড ইচ্ছে করে বিছানা থেকে উঠে নিচে যেতে, পরিবারের সাথে আনন্দে মেতে থাকতে। কিন্তু তার যে সেখানে যাওয়া বারণ। বারণটা অবশ্য তার জন্মদাতাই করেছেন, কারণ শীতল কে দেখলে তিনি নিজের রাগ*কে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না। তাই সন্ধ্যার আসরে শীতলের অনুপ্রবেশ যতটা না কঠোর ভাবে নি*ষিদ্ধ তার চেয়েও বেশি কড়াভাবে নি*ষিদ্ধ মাহমুদ সাহেবের সামনে যাওয়া।
কিন্তু কিশোরী মন যে তার বারবার নিষি*দ্ধ জিনিসের প্রতি তীব্র ভাবে আকৃষ্ট হয়, ছুটে যেতে ইচ্ছে করে সকল বাধা ভেঙে। শীতলের টলমল চোখের দিকে তাকিয়ে জয়া সবকিছু বুঝতে পারে। মলিন হাসি হেসে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন,
– অমানু*ষদের মাঝে গিয়ে কিছু নয় বরং নিজেকে অ*পমান আর কলুষি*ত করবি। ধৈর্য ধর মা, একদিন তোর ও হবে। ভরা সংসার হবে তোর, আমি বলছি।
– সেই আশাতেই থাকো মা, তোমার এই বো*বা মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আছে তো শুধু ওই রূপখানা, আসল জিনিসটাই তো নেই ওর। শেষে দেখো আরেক বো*বা কে ধরে বিয়ে দিতে হবে আর। দুই বোবা*য় মিলে সুখের সংসার করবে বলো।
মিনার খোঁ*চা মারা কথা শুনে তেতে উঠে জয়া। তিনিও কম জাননা, মুখ বাঁকিয়ে বলেন,
– টা তোর কি আছে শুনি? না আছে রূপ না আছে গুণ। খুন্তি টাও নাড়াতে পারিস না, আর চেহারা তো হয়েছে কি আর বলব। বলতেও ল*জ্জা লাগে বংশের সবচেয়ে কুৎসি*ত মেয়ে তুই। এই নিয়ে দশটা বিয়ের ঘর ভেঙেছে, তাও কিসের এত দম্ভ তোর? কিভাবে নিজেকে শীতলের সাথে তুলনা দিচ্ছিস তুই?
মায়ের কথা গুলো শুনে হিং*সায় জ্বলে উঠে মিনা। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে,
– হে শীতল ই তো তোমার সব। নিজের মেয়ে তো তোমার জন্মের শ*ত্রু।
– কি জন্য এখানে এসেছিস সেটা বলে বি*দায় হো।
– দশ কাপ চা লাগবে, তোমার নবাবজাদি কে বলো পাটরানীর মতো পালঙ্কে না বসে থেকে গতর টা নাড়িয়ে চা বানিয়ে দিতে।
– ও যাবে না, নিজেদের চা নিজেরা করে খা।
মিনা পাল্টা জবাব দেওয়ার আগেই শীতল জয়ার কথা অমা*ন্য করে নিচে চা বানাতে যায়। যতই হোক, নিন দায়িত্ব সে সারাজীবন পালন করেই এসেছে, তবে আজকে কেনো তার ব্যত্যয় ঘটবে?
শীতল সিঁড়ি বিয়ে নিচে নামতেই সেটা হিমের চোখে পড়ে যায়। খুশিতে জ্বলজ্বলে উঠে তার দু চোখ।
– যাক, এতক্ষণে সাদা ক্ষেতের কালো মুলা কে দেখতে পেলাম।
হিমও কিছু একটার বহানা দেখিয়ে শীতলের পিছন পিছন রান্না ঘরে ঢুকে পড়ে। শীতল চা বানানোর পানি গরম করতে দিয়ে চা পাতা আনার জন্য পিছন ঘুরতেই ফ্রিজের ডালায় হিম কে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। হিম তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,যেনো সেই দৃষ্টি দিয়ে তাকে সে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
কিন্তু এবার শীতল তাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। দ্বিতীয় বারের মতো একটা সাধারণ মেয়ের পাত্তা না পেয়ে হিম এবার রেগে যায়।
– এই ছেম*রি এই, তুই কি Somehow আমাকে ইগনোর করছিস? কি ভেবেছিস তুই ইগনোর করলেই আমি তোর পিছন পিছন ঘুরবো? তোর সাথে কথা বলতে এসেছি দেখে ভাববি না যে আমার তোর প্রতি ইন্টারেস্ট আছে। আমাকে কি তোর বাংলাদেশের ছেলেদের মত বে*হায়া লাগে? তোর মত হাজারটা মেয়ে আমার জন্য আফসোস করে, আমার একবার দেখা পাওয়ার জন্য তারা জাস্ট মা*রা যায় বুঝেছিস?
চলবে…………..