#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৫
রান্নাঘর থেকে হিমের চিৎকারের আওয়াজ শুনে সাদাত সেদিকে পা বাড়ায়। রান্নাঘরে ঢুকে হিম ও শীতল কে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদাতের যেনো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। শ্বাস ভারী হয়ে আসে তার। এত গুলো কটু কথা বলার পরও শীতলের মৌনতা হিমের রাগকে ক্ষণে ক্ষণে বাড়িয়ে তুলছে। এতক্ষণ তার চোখে মুখে কৌতুক থাকলেও এবার সেটা সরে গিয়ে কালো হয়ে আসতে থাকে তার শুভ্র মুখ। দু হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও সে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মেয়েটার এত গুমোট যেনো হিমের স*হ্য হচ্ছে না, এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে সে উল্টা পাল্টা কিছু একটা করে ফেলতে পারে বিধায় তার চলে যাওয়াটাই শ্রেয়।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছন ঘুরে চলে যেতে নিলেই হিমের সাথে সাদাতের চোখাচোখি হয়। তারও মুখ আষাঢ়ের ঘন মেঘের মতো কালো হয়ে আছে। হীমকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সাদাত ঠান্ডা গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করে,
– কোনো সমস্যা হয়েছে কি? বাইরে থেকে তোর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
হিম রাগে কটমট করতে করতে বলে,
– কি হয়েছে সেটা এই অত্যধিক এটিটিউড ওয়ালা মেয়েমানুষ কে জিজ্ঞাসা কর। অতিথির প্রতি এত অব*জ্ঞা দেখানো কি তোদের বাড়ির রীতি? দুঃখি*ত আমার জানা ছিল না। এই ছে*মরি কে বলে দিস আমার সামনে যেনো সে আর না পড়ে, কার সাথে কি ব্যবহার করতে হয় সেটার শিক্ষাও মনে হয় পেটে নেই।
এই বলে হিম আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। লম্বা লম্বা পা ফেলে ওপরে নিজের রুমে চলে যায়। এদিকে শীতল বো*কার মতো হিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, কি ঘটছে, কেনো ঘটছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। হিম নামের এই অচেনা ছেলেটির প্রথম দিন থেকেই তার প্রতি রহস্য*ময় আচরণ বারবার শীতল কে অপ্রস্তুত করে ফেলছে। সাদা চামড়ার, উচুঁ ঘাড় বিশিষ্ট, দীর্ঘকায় ছেলেটাকে তার অত্যধিক মাত্রার সুদর্শন মনে হয় না, তবুও ছেলেটা সবার থেকে আলাদা সেটা এক বাক্যে স্বীকার করবে শীতল।
দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই শীতলের চোখ যায় তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদাতের দিকে। বড় বড় চোখ জোড়া তার রক্তিম হয়ে উঠেছে। অমায়িক চেহারাও যে কিছু সময়ের জন্য ভয়া*নক হয়ে উঠতে পারে সেটা সেই মুহূর্তে সাদাত কে দেখলে প্রমাণ মিলবে।
শীতল শুকনো গলায় কয়েকটা ঢোক গিলে চা এর ট্রে টা হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। কিন্তু সাদাত কে অতিক্রম করার আগ মুহূর্তে একটা ঠান্ডা কন্ঠ যেনো তার পা দুটোকে স্থবির করে দেয়।
– কণ্ঠশক্তির সাথে সাথে কি দৃষ্টি শক্তি হারানোর ইচ্ছা তোর মাথায় জেঁকে বসেছে শীতল?
শীতল এবার ভয়ে ভয়ে সাদাতের দিকে তাকায়। সাদাত মেঝের দিকে তাকিয়ে তাকে উদ্যেশ্য করে কথাগুলি বলেছে। ভয়ে ঠোঁট পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে শীতলের। আবারও এক পৈশা*চিক নির্যাতনের শিকার হতে চলেছে সে, অথচ সেটা স*হ্য করার মতো কোনো শক্তিই তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।
নিচের দিকে তাকিয়ে সে মাথা দুলিয়ে বোঝায় যে সে টা চায় না।
– তাহলে তোর সাহস কি করে হলো হিমের দিকে তাকানোর? তোর ওই চোখ জোড়া শুধু আমাকে দেখবে আর কাউকে না।
শীতল ভীষণ ভড়কে যায়। সে তো কিছুই করেনি, হিম যেচে তার সাথে কথা বলতে এসেছিল। নিজেকে নি*র্দোষ দিবো করার জন্য ট্রে টা কেবিনেটের ওপর রেখে শীতল হাত দিয়ে ইশারা করে সাদাত কে কিছু বোঝাতে চায়। কিন্তু সাদাত সেগুলো বুঝতে নারাজ, শীতলের এক হাত খানা খপ করে ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। এবার শীতলের দুই পায়ের সাথে সাথে শীতলের পুরো দেহ জমে যায়। কেনো জানি এই লোকটার স্পর্শ তার কাছে বি*ষের মত লাগে।
– কেনো তাকিয়েছিস, কি জন্য তোকে তাকাতে হয়েছে, আমি এগুলো শুনতে চাইনা। আমি শুধু জানি তুই শুধু আমার দিকে তাকাবি, আর অন্য কোনো পুরুষের দিকে না। এখনের মত ছেড়ে দিচ্ছি দেখে ভাবিস না যে তুই বেঁচে গেলি। রাত টা পার হোক তারপর তোর ব্যবস্থা আমি করছি। এখন চা দিয়ে যা বসার রুমে।
এই বলে সাদাত শীতল কে সেখানে রেখে চলে যায়। শীতল যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে। গলা ভীষণ রকমে শুকিয়ে গেছে তার। তাই সে তাড়াতাড়ি করে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি সে গলায় ঢেলে দেয়। খাওয়া শেষে বোতলের ছিপি লাগাতে লাগাতে শীতল নিজ মনে আওড়ায়,
– দেশি পাগ*লের জ্বালায় বাঁচি না, এখন বিদেশি উ*ম্মাদ এসে জুটেছে।
__________________________________________
অনেকটা পথ জার্নি করায় কাল রাতে আর সুটকেস আনবক্স করা হয়ে উঠেনি হিমের। রাতের খাওয়া শেষে নিজের রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। রাতে লুঙ্গি আর ঢোলা টি শার্ট পরে ঘুমানোর অভ্যাস হিমের বহুদিনের। কিন্তু তার নিদারুণ ঘুমের কারণে ট্রাউজার পরেই ঘুমিয়ে গেছে কাল রাতে।
সকাল সকাল সাদাত হিমের রুমে ঢুকে তাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য। কিন্তু বিছানার ওপর হিমকে চারদিকে চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সাদাতের ভীষণ হাসি পায়। বাচ্চাদের মত লুল গড়িয়ে পড়ছে হিমের মুখ থেকে। কে বলবে এই মাসুম চেহারার অধিকারী ছেলেটা রেগে গেলে কতটা উ*ন্মাদ হয়ে উঠতে পারে।
সাদাত হিমের গা স্পর্শ করে তাকে ডাকতে থাকে।
– হিম, ওঠ ভাই, আর কত ঘুমাবি? সকাল ১০ টা বাজে।
হিমের ঘুম পাতলা হয়ে আসে। গায়ের ব্লেঙ্কেট টা দিয়ে মুখ ঢেকে চাপা কন্ঠে বলে,
– দাঁতের বা*চ্চা, ঘুমাতে দে। আমার ঘুমের সাথে তোর কিসের এত শত্রুতা? আমার ঘুম কি তোর বউ কে বিয়ের পিঁড়ি থেকে তুলে এনেছে?
– আরে ভাই ওঠ না, খিদার জ্বা*লায় পেট ব্যথা করছে, তোকে ছাড়া তো খেতেও পারছি না।
এবার হিম মুখের থেকে চাদর সরিয়ে মুখ বাঁকিয়ে সাদাতের দিকে তাকায়।
– কেনো? তুই কি পণ করেছিস আমার হাত ছাড়া আর কারো হাতে খাবি না? নাকি তোর হাতকে আমি হ্যান্ড*কাফ পরিয়ে রেখেছি যে তুই খেতে পারছিস না?
সাদাত মুখ শুকিয়ে বলে,
– মা বলেছে তোকে ছাড়া আমি খেতে পারব না।
সাদাতের কথা শুনে হিম এক তাচ্ছি*ল্যের হাসি হাসে।
– এখন তো মানবি যে আন্টি তোর থেকে আমাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। দিবেই তো after all আমি হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, ডেসিং, ইন্টিলিজেন্ট এন্ড চার্মিং বয়। তোদের মত তো আর agricultural people না।
– agricultural people মনে?
– ক্ষে*ত, তোরা ভীষণই ক্ষে*ত।
– অপমান করছিস আমায়, দেখে আমি কিন্তু কোনো দিক থেকেই কম যাই না। দেখতে মোটেও আমি ক্ষে*ত না।
হিম কাঁধে তোয়ালে রেখে বাথ রুমের উদ্দেশে পা বাড়ায়। কিন্তু দরজা লক করার আগে মুখ বাড়িয়ে সে সাদাত কে বলে,
– আজকে শপিং মলে যাব, সেখানেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে বেশি হ্যান্ডসাম। এখন আমার গোসল সারতে সারতে আমার ব্যাগটা খুলে রাখ। কালকে খোলার সময় পায়নি।
এই বলে হিম সাদাতের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দেয়। সাদাত আর উপায় না পেয়ে বিছানার পাশ থেকে ব্যাগটা উপরে রেখে এর চেইন খুলে। চেইন খুলতেই এক গাদা স্কিন কেয়ার এর প্রোডাক্ট দেখে সাদাত অবাক হয়। একটা ছেলে মানুষের এত বিউটি প্রোডাক্ট যে একটা শুটকেস লেগে যায়।
গোসল সেরে হিম বাইরে এলে সাদাত কে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে বলে,
– মাথায় ঠা*ডাঃ কখন পড়ল তোর?
– what ননসেন্স, আমার মাথায় ঠা*ডাঃ কেনো পড়তে যাবে?
– তাহলে মাথায় হাত দিয়েছিস কেনো?
– এগুলো তোর?
সাদাত হিমের সুটকেসের দিকে ইশারা করে।
– ইয়েস বন্ধু, এগুলো সব আমার।
– এত কিছু কেনো?
– সৌন্দর্য বন্ধু, সৌন্দর্য। রূপ ই জ্ঞান, রূপই ধ্যান, রুপই চিন্তা মণি, রূপ ছাড়া আমি যেনো মনি হারা ফ*নি।
– ফা*লতু কাজে এত টাকা খরচ করছিস? তোর কলিজা আছে বলতে হবে।
হিম ভিজা চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সাদাতের দিকে আড়চোখে তাকায়।
– আমার অনেক টাকা বন্ধু, জানিস না আমি কে? আমি হলাম বড় বড় বাঁশ বাগানের মালিক, মানুষ ভালবেসে আমাকে বাঁশ দেয়, আমিও সেগুলো যত্ন সহকারে গুছিয়ে রাখি। এভাবেই আমি অনেকগুলো বাঁশ বাগান বানাতে পেরেছি, তুইও কাজে লেগে পর।
– থাক, আমার দরকার নেই, তাড়াতাড়ি বাইরে আয়। কাজ আছে।
– তুই যা, আমার একটা পার্সোনাল কাজ আছে, সেটা সেরেই আসছি।
সাদাত আর কথা বাড়ায় না। সাদাত চলে গেলে হিম গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রেডি হতে শুরু করে।
__________________________________________
হিমের রাগ উঠতে যেমন দেরি হয়না, তেমন রাগ ঠান্ডা হতেও দেরি হয়না। নিছক কারণে রাগ নেমে গিয়ে সে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়, সেটা হোক রাতের ঘুমের মাধ্যমে কিংবা বাইরের খোলা বাতাসের কারণে। তাই রাতে রাগারাগি করা সত্ত্বেও হিম নিচে নেমেই শীতল কে খুজতে থাকে। শীতলের দর্শন না পেলে যেনো হিমের সারাদিন টাই মাতি হয়ে যাবে।
– ওরে সাদাত ওরে সাদাত আমার ছেম*রি কোথায় রে? ওরে সাদাত ওরে সাদাত আমার ছে*মরি কোথায় রে?
হালকা কন্ঠে গুনগুন করতে করতে হিম নীচ তলায় সবটা খুজে দেখে কিন্তু শীতল কে পায়না। শেষে ড্রয়িং রুমের লাগোয়া বারান্দায় শীতল কে সে খুঁজে পায়। শীতল এক মনে চাল ঝারছিল।
– ওরে সাদাত ওরে সাদাত আমার ছে*মরি এখানে রে।
চলবে……………….