#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৬
বারান্দায় এক পা রেখে সাথে সাথেই আবার পা গুটিয়ে নেয় হিম। তার মন চাইছে শীতলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, তাকে একটু জ্বালিয়ে দুটো কথা শুনাতে, কিন্তু তার মস্তিষ্ক তাকে বাধা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ মুখ কালো করে চিন্তায় ডুবে থেকে শেষে ডান হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে মাঝ কপালের চামড়াটা একটু জোরেই চেপে ধরে।
– না না, আমি নিজে থেকে কিছুতেই ওই ছে*মরির সামনে যেতে পারি না। এটা আমার প্রেস্টিজ ইস্যু, এখন বেহা*য়ার মত ওর সাথে কথা বলতে গেলে ছে*মরির দেমাগ আরও বাড়বে। এটা তো হতে দেওয়া যায় না, একটা কারণ বের করতে হবে যাতে ছেম*রির সাথে ভাব দেখিয়ে কথা বলতে পারি।
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর হিমের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। মুখে একটা দু*ষ্টু হাসি বজায় রেখে পুনরায় পূর্বের সুরে গাইতে থাকে,
– ওরে ছে*মরি, ওরে ছে*মরি, আমার আন্টি কই রে।
গলাটা পরিষ্কার করে আবেগহীন চেহারা নিয়ে সে শীতলের সামনে দাঁড়ায়। পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে সেটা দিয়ে সানগ্লাসটা পরিষ্কার করতে শুরু করে সে, যেনো শীতল কে কোনো গুরুত্বই দেয় না। শীতল হিমের উপস্থিতি টের পেলেও তার দিকে চেয়ে তাকায় না। শুধু শুধু কেনই বা সে নিজের শাস্তির পাল্লা ভারী করবে? হিম কে নিজের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও জিজ্ঞাসা তো দূরে থাক একটা শব্দ উচ্চারণ না করায় মনে মনে কিছুটা ক্ষু*ব্ধ হয় হিম, কিন্তু টা মুখে প্রকাশ করে না।
– জয়া আন্টি কই এখন?
শীতল এবারেও তার দিকে না তাকিয়ে এক হাত উচু করে রান্নাঘরের দিকে ইশারা করে। অর্থাৎ জয়া আন্টি রান্নাঘরে নিজের কাজ সারছে। হিম এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। শীতল কি করে জানবে এই ছেলেটা তার কন্ঠস্বর শোনার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে? সুন্দর মানুষটার কন্ঠ ও কি তার মতোই মনোমুগ্ধকর? হিমের মাথায় এই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু আফসোস, হাজার চেষ্টা করেও এই বরফ কন্যার মৌনতা ভেদ করতে পারছে না সে।
– এই ছেম*রি, বো*বা সাজার এত সখ কেনো তোমার? আল্লাহ জবান দিয়েছে কথা বলার জন্য, আর তুমি তোমার জবানকে শিকায় তুলে রেখেছো কি করতে? না এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছ যে তুমি যার তার সাথে কথা বলো না? এটিটিউড দেখাও আমাকে, এই আয়ুশ খান হিমাদ্রো কে? তোমার কোনো যোগ্যতা আছে আমার সামনে এভাবে বসে থাকার? যতবার ভাবছি তোমাকে মাফ করে দিবো, ততবার তুমি আমার মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছ। প্রকৃত বো*বা হলে বুঝতে বো*বাদের জীবন কতটা দুর্বিষ*হ।
এই বলে গটগট করে বারান্দা থেকে চলে আসে হিম। পুরোটা সময় শীতল মূর্তির মত মাথা নিচু করে ছিল। তার চোখের কয়েক ফোঁটা পানি যে শুকনো চালকে সিক্ত করেছে সেটা হিমের রা*গী চোখে ধরা পড়ে নি কারণ সেই চোখ জোড়া তো শীতলের দিকে অগ্নুৎ*পাত করতে ব্যস্ত ছিল।
– আপনি ঠিক বলেছেন, আমাদের জীবন বড়ই দুর্বি*ষহ। এই যে এত কিছুর পরও আপনি বুঝতে চাইছেন না যে আমি বাকশক্তি হীন একটা মানুষ। কথা বলার ক্ষমতা অনেক আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি। আর বিষয়টা যে আপনাকে বুঝিয়ে বলব সেই ফুরসৎ ও আমার নেই।
– নাহ্, বাংলাদেশে এসে বেশ বেহা*য়া হয়ে উঠেছি, লজ্জা*হীনতা রোগটা ভয়াবহ ভাবে আমার ঘাড় এ জেঁকে বসেছে, তানাহলে বারবার কেনো ওই ছে*মরির কাছে ছুটে যাই আমি।
পকেটে হাত গুঁজে হেঁটে যাওয়ার সময় হিম আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। এতে আবারও হিমের মুখে হাসি ফুটে উঠে।
– আমার মত এত হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখে হয়তো ছে*মরিটা মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে, টা নাহলে আর কি কারণ থাকতে পারে আমার সাথে কথা না বলার। যাই হোক, দুদিনের ছেম*রি, এমন হাজারটা মেয়ে হিমের জীবনে এসেছে, গিয়েছে। আমি এসবে মাথা ঘামাই না। আমি খুব শীঘ্রই লন্ডনের মা*ফিয়া কিং হতে চলেছি, পুরো লন্ডন শহর আমার ইশারায় ওঠাবসা করবে, তাই এসব মিনিং*লেস্ কাজে আমার মূল্যবান সময় আর শ্রম না খরচ করলেই নয়।
নিজেকে খানিকক্ষণ সান্তনা দিয়ে হিম বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসে। অনেকক্ষণ ধরে সাদাত তার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে। বাইরে বের হতেই হিম দেখতে পায় সাদাত বাইকে হেলান দিয়ে একমনে ফোনে কি যেনো একটা দেখছে। হিমকে আসতে দেখে সাদাত তাড়াতাড়ি করে ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।
– কি রে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, তোর খবর নেই, ফ্লাইটে করে কি লন্ডনে চলে গিয়েছিলি নাকি?
– আমি লন্ডনে না গেলেই আন্দাজ করতে পারছি তুই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ও কল্পনার রাজ্যে ছিলি। ফোনে কি দেখছিলি?
হিমের তীক্ষ্ম প্রশ্নে সাদাত আমতা আমতা করতে শুরু করে।
– ক – কই কিছু না তো এমনি আরকি ।
– উহু বন্ধু, মিথ্যা বলা ভালো না, আল্লাহ পা*প দেয়। তুই ফোনে ভাবি কে দেখছিলি তাই না? আমাকেও দেখা , আমিও আমার ভবিষ্যৎ ভাবীকে দেখতে চাই।
– ধূর হিম, কি শুরু করলি?
– তুই ভয় পাচ্ছিস, ভাবি যদি আমাকে দেখে তোর মত এগ্রিকালচারাল ছেলে কে ছেড়ে দেয়, তাই না?
– তুই সব কিছুই দুই লাইন বেশি বুঝিস হিম।
– টা তো অবশ্যই, by the way, nice bike.
– তোর পছন্দ হয়েছে?
– মাখনের মত দৌড়ালে আরও পছন্দ হবে।
সাদাত পকেট থেকে বাইকের চাবিটা হিমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
– এটা তোর জন্যই এনেছি, your birthday gift. Happy birthday my friend.
হিমের মনেই ছিল না যে আজকে তার জন্মদিন। বিদেশে থাকলে হয়তো তুষার তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করত, কিন্তু দেশে এসে সে নিজেকেই প্রায় ভুলতে বসেছে, সেখানে জন্মদিন তো খুবই ন*গণ্য বিষয়।
– ওহ তোর মনে আছে?
– জি সাহেব, আজকে আপনি ছাব্বিশ বছরের বুড়ো তে পরিণত হলেন।
– বুড়ো বললি কাকে? জানিস এই বয়সেই আমি ছাব্বিশ টা বাচ্চার বাপ হইয়ার যোগ্যতা রাখি, অতি ভদ্র বলে যারে তারে নিজের জিন দেই না, তাই এখনও বাপ ডাক শুনতে পারি নাই।
সাদাত হিমকে কনুই যের গুতো দিতে বলে,
– হয়েছে সাহেব, বিদেশ ফিরে বাপ হওয়ার প্রজেক্টে হাত দিস, এখন চল একটা রেস হয়ে যাক। অনেকদিন ধরে পাকাপোক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না পাওয়ায় বাইক রেস এ বিশেষ মজা পাচ্ছি না।
হিম বাইকে উঠে চাবি দিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।
– আমি তোর প্রতিদ্বন্দ্বী না সাদাত, আমি তোর গুরু। জিতবো তো আমিই, আমার র*ক্তে লিখা আছে জয়ের মাহাত্ম্য, শিরায় শিরায় বয়ে যাচ্ছে জয়ের কৌশল, সবই ব্রিটিশ কায়দা কানুন। তোর দেশি কায়দা সেগুলোর সাথে পারবে না। কারণ আমি জেতার জন্যই জন্মেছি।
সাদাত তার দিকে একটা তাচ্ছি*ল্যের হাসি দিয়ে বলে,
– আচ্ছা আজ সব প্রমাণ হবে, কে জিতে, আর কে হারে?
এই বলে হিম আর সাদাত বাইক রেস শুরু করে। প্রতি মুহূর্তে তাদের পজিসন চেঞ্জ হয়, একবার সাদাত হিমকে পাশ কাটিয়ে আগে চলে যায় তো অন্যবার হিম । দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ফিনিশিং পয়েন্টে কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে হিম আগে পৌঁছায়।
– দেখলি, বলেছিলাম না, আমি জেতার জন্যই জন্মেছি। জিতেই দেখিয়েছি।
সাদাত হাসলেও মনে মনে একটা কথা বিড়বিড় করে,
– সব প্রতিযোগিতায় তুই বিজয়ী হো, কিন্তু শীতল কে পাওয়ার খেলায় আমি তোকে কখনোই জিততে দিবো না হিম। জীবনের কোনো কোনো মুহূর্তে বন্ধুত্বের চেয়ে ভালোবাসা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
হাইওয়ের রাস্তার পাশে হিম আর সাদাত দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে সাদাত গিয়ে দুজনের জন্য দুটো কোল্ড ড্রিঙ্কস এর কেন নিয়ে আসে। কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে দুই বন্ধু গল্পে মসগুল, ঠিক তখনই বখা*টে ছেলেরা বাইক চালিয়ে সাদাতের গা ঘেষে চলে যায়। আর কয়েক চুল এদিক সেদিক হলে আজ সাদাতের বড় ধরনের এক্সিডে*ন্ট হতে পারত, একটুর জন্য আজ সে বেঁচে গেছে। হিম রা*গান্বিত দৃষ্টিতে একবার ছেলেগুলোর দিকে তাকায়। কু*কর্ম করেও তারা ক্ষা*ন্ত হয়নি, বরং দুর থেকে সাদাত আর হিমের দিকে তাকিয়ে তারা তাচ্ছি*ল্যের হাসি দিচ্ছে, যেনো এই হাসি তাদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করছে।
হিম সাদাতের দিকে ফিরে বলে,
– ব্রো, ঠিক আছিস? লাগেনি তো কোথাও?
– হাতের দিকটায় একটু ছ*ড়ে গেছে মনেহয়, বড় জ্বা*লা করছে।
– তুই বাড়ি যা, আমি একটু পর আসছি।
– তুই যাবি না আমার সাথে?
– না, আমি সন্ধ্যার দিকে ফিরব।
সাদাত আর কথা বাড়ায় না। বাইকে উঠে সে সেখান থেকে চলে যায়। সাদাত চলে গেলে হিম ঘাড় কাৎ করে বলে,
– আজকে মনে হয় আবারও বাংলাদেশ থেকে অর্গা*ন লন্ডনে পাচা*র হবে।
___________________________________________
গোডাউন থেকে রক্তা*ক্ত হাতে বের হয় হিম। দুই হাত ভিজে গেছে র*ক্তে, তবে সেটা নিজের নয়। হাত দুটো পরিষ্কার করার জন্য ফয়সলের হাত থেকে পানির বোতল টা কেড়ে নিয়ে হিম বলে,
– আগের সাপ্লাই এর কি অবস্থা, ঠিকঠাক মতো পৌঁছায়সে নাকি?
– জি স্যার, অল পারফেক্ট।
– গুড।
এই বলে হিম তাড়াতাড়ি করে বাইকে উঠে পড়ে। কারণ সন্ধ্যা হয়ে আসছে, দেরি হলে জয়া আন্টি তাকে চার্জ করতে পারে।
ঢাকার জ্যামে বসে ট্রাফিক পুলিশদের ইচ্ছা মতো গা*লি দিতে দিতে বিরক্তি*কর সময় অতিবাহিত করছে হিম। মুখে চেয়ে গেছে এক রাশ অস্বস্তি।
– এই হা*লা গুলোকে সরকার মাসে মাসে মাইনে দিয়ে কি জন্য পালে বুঝি না, সারাদিন গরুর মতো ঘাস খায় আর সন্ধ্যা হলেই যাবর কাটে। এত চেয়ে খচ্চ*র কে দিলে এদের চেয়ে ভালো কাজ করবে।
– ভাইয়া ফুল নিবেন, এক পিস গোলাপ মাত্র দশ টাকা।
হিম মুখ ভেঙ্গিয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন কিছু পেটে পড়েনি, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রোদে পুড়ে ফুল বিক্রি করেছে।
– সার্কাস সম্পুর্ণ করার জন্য তোর ই আসার বাকি ছিল, এসেই গেলি। আমাকে কি ফুলের ব্যবসায়ী লাগে, আমি ফুল দিয়ে কি করবো?
– নিন না ভাই একটা, ভালো ফুল। বাসায় গিয়ে আপু কে দিবেন।
– লাভ নেই রে বাপ, ফুল দিয়েও তার দুই ঠোঁট খোলা আমার পক্ষে সম্ভব না, শেষে দেখব আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না, আমার আরও রাগ উঠবে। বড্ড তেজ টেনার।
– নিয়েই দেখেন, মাইয়া মানুষ ফুল পেয়ে আত্মহারা হয়ে যায়। আপু খুশি হবে।
– বলছিস, আচ্ছা দে দশটা, তোর নাম কি পিচ্ছি?
– বাবলু।
– কি বললি, বা*ল বুলু?
চলবে………………