#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৮
বন্ধ চোখের পাতায় সূর্যের আভা পড়লে শীতলের ঘুমের রেশ হালকা হতে থাকে। তখনও হালকা তন্দ্রার কবলে পড়ে চোখ খোলা হয়নি শীতলের, ঠিক তখনই তার মনে পড়ে যায়, তার ঘরের জানালা দিয়ে তো কখনও রোদ প্রবেশ করেনা, হোক সেটা গ্রীষ্মকাল কিংবা শীতকাল। ছোট্ট কুঠুরির মত তার ঘর, কোনমতে একটা বিছানা আর আলমারি সেই ঘরে জায়গা করে নিয়েছে। আলো বাতাসের অভাবপূর্ণ ঘরটাতেই শীতল তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছে, আঁটসাঁট বলে কখনও নাক সিটকায় নি। কিন্তু আজ তার অতি পরিচিত বদ্ধ ঘরে আলোর প্রবেশ তাকে ভীষণ ভাবায়। থাকতে না পেরে ভারী চোখ জোড়া খুলে তাকাতেই শীতলের গলা শুকিয়ে ওঠে। বিশালাকায় রুমের বিলাসবহুল বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে সে, চারপাশের সব কিছু তার অপরিচিত।
শীতল প্রথমে ভাবে সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চোখ কচলে ও যখন অচেনা ঘর তার চেনা ঘরে রূপান্তরিত হয় না, তখন শীতলের বুঝতে বাকি থাকে না যে সে তার স্বপ্নের দুনিয়া ছেড়ে অনেক আগেই বাস্তব দুনিয়ায় চলে এসেছে। শীতলের শ্বাস আটকে আসে, কল রাতের কথা মনে করার জন্য নিজ মস্তিষ্কে জোর দিতে থাকে। কাল রাতে কাদতেঁ কাদতেঁ হিমকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য মনে পড়ে যায় তার, কিন্ত হাজার চেষ্টা করেও এর পরবর্তী কিছুই শীতল মনে করতে পারে না।
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পা আটকে মেঝেতে পড়ে যায়। সাথে সাথেই তার ওষ্ঠযুগল ভেদ করে এক অস্পষ্ট ব্যা*থাতুর শব্দ বের হয়ে আসে। ত্বক চামড়া ভেদ করে যেনো হাড়ে ব্যথা পেয়েছে সে, তার চাপা আর্ত*নাদ কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রায় সাথে সাথেই দরজা খোলার শব্দে শীতল যেনো নিজ অবস্থানে জমে যায়। ভয়া*র্ত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু মানুষটা হিম, হিম কে দেখে শীতল এক প্রকার দৌড়ে তার কাছে যায় আর তাকে জড়িয়ে ধরে। শীতল এতটাই ভয় পেয়েছিল যে পরিচিত মানুষটাকে দেখে খুশিতে সে কেঁদেই ফেলে।
হিম হাতে থাকা খাবারের ট্রে টা টেবিলে রেখে শীতল কে জড়িয়ে ধরে।
– বরফ কন্যা কাদঁছো কেনো? ভয় নেই, আমিই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। এখানে কেও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না, কেও তোমার গায়ে হাত তুলবে না। এখানে শুধু আমি আর তুমি, আর কেও নেই।
হিমের বলা কথা গুলো শুনে শীতল তাড়াতাড়ি করে হিম কে ছেড়ে তার থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। তারমানে এতক্ষণ সে যা ভেবেছিল সেটা ঠিক নয়, হিমই তাকে এখানে তুলে এনেছে। কিন্তু কেনো? উদ্যেশ্য কি তার? বিদেশে পা*চার করে দেওয়ার জন্য নাকি দেশি কোনো পতিতা*লয়ে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য? অবশ্য শীতল বো*বা মেয়ে, তাই হিমের যদি এই উদ্দেশ্যই থাকে, তবে তাকে তেমন ক*ষ্ট করতে হবে না।
শীতলের অসহায় মনে এই বিষা*ক্ত চিন্তার উদয় হলেও তার বিবেক তাকে এসব ভাবতে বাঁধা দেয়। আর যাই করুক হিম তার কোনো ক্ষ*তি করতে পারে না, এই বদ্ধ বিশ্বাস শীতলের জন্মেছে হিমের প্রতি। হিম শীতলের ভেজা চোখে দুই ধরনের আবেগের সংমিশ্রণ দেখে হালকা শব্দে হেসে দেয়। শীতল কেবল মুগ্ধ নয়নে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই নিষ্পাপ হাসির অধিকারী ছেলেটা কে সে খারাপ মা*নতে পারছে না।
– আরে বো*কা মেয়ে, তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার কোনো ক্ষ*তি করার জন্য এখানে তুলে এনেছি? ক্ষ*তি যদি করতেই চাইতাম তবে কাল রাতেই করতে পারতাম। রাতে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে অজ্ঞা*ন হয়ে পড়েছিলে, তখন আমি চাইলেই তোমার ইজ্জ*তহানি করতে পারতাম, কেও কিছুই জানতে পারত না। কিন্তু আমি তেমন ছেলে নই শীতল। দীর্ঘ ষোলো বছরের অপ্রকাশিত নির্যা*তন থেকে উদ্ধার করতেই তোমাকে এখানে আমি নিয়ে এসেছি।
শীতল কিছু বলতে চাইলো, মুখের ভঙ্গির সাথে তার ঠোঁট যুগল নরে উঠলো, কিন্ত গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। এতে শীতল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আবারো মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। জন্মগত ত্রু*টি না হওয়ায় শীতল মাঝে মাঝেই নিজের এই সীমাবদ্ধতা ভুলে যায়।
হিম নিজের পকেট থেকে একটা ফোন বের করে শীতলের দিকে এগিয়ে দেয়। শীতল সেটা হাতে নিয়ে হিমের দিকে অবাক চোখে তাকায়।
– কাল রাতে জয়া আন্টি আমায় সব বলেছে, তুমি দুর্ঘটনাবশত কথা বলার শক্তি হারিয়েছ। আমি দুঃখি*ত প্রথমে এটা আন্দাজ করতে পারিনি। ভেবেছি তুমি আমাকে পছন্দ করো না, তাই আমাকে ইগ*নোর করছ। আজ থেকে এটা তোমার ফোন, তোমার যা বলার দরকার সব টাইপ করে আমাকে বলবে, বুঝেছো?
শীতল রোবটের মতো মাথা নাড়ায়। কিন্তু পরক্ষণেই ফোনে কিছু একটা লিখে সেটা হিম কে দেখায়।
– আমি বাড়ি কখন ফিরতে পারব?
লেখাটা পড়ে হিমের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রক্তি*ম চোখে শীতলের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ও বাড়ি যাওয়ার জন্য এত উতলা কেনো তুই ছে*মরি? ওখানে কি এমন মধু আছে যে আমার লাগজারিয়াস বাংলো তোর পছন্দ হচ্ছে না? ওখান থেকে তোকে তুলে এনেছি কি তোকে আবার ওখানে পাঠানোর জন্য নাকি, আবার ওই বালে*র ভাঙ্গা বাড়িতে ফিরে কি বলি*র পাঠা সাজবার মন চায়? চুপচাপ এখানে বসে থাক, নাহলে ঠেঙ ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেবো।
হিমের বকা শুনে শীতলের মুখ চুপসে যায়। একটু আগের ভদ্র ছেলেটার সাথে এখনের রা*গী হিম কে যেনও সে মিলাতে পারছে না। তাই নিজের মনের কথাটা ফোনে টাইপ করে হিমের হাতে ধরিয়ে শীতল এক ছুট দেয় রুমের বাইরে।
ঘটনাটা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটে যে হিম বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ফোনের দিকে তাকায় শীতলের ” আপনি অনেক পঁ*চা” লেখা দেখতে পায় সে, সাথে সাথেই দ্বিগুণ রাগে তেঁতে উঠে হিম। বড় বড় পায়ে সেও রুম থেকে বের হয় শীতল কে ধরতে।
শীতল দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একবার পিছন ফিরে চায় কিন্তু নিজের পিছনে হিম কে দেখতে না পেয়ে সে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে। সামনের দিকে তাকালে সে সদর দরজা দেখতে পায়, এখান থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ। কিন্তু সদর দরজার বাইরে পা রাখার পূর্ব মুহূর্তেই সে ধরা পরে হিমের বলিষ্ঠ দেহের কাছে।
শীর্ণ শরীরের শীতল যেনো আকারের দিক থেকে হিমের অর্ধেক, আর শক্তির দিক থেকে হয়তো হিমের দশ ভাগের এক ভাগও না। হিম শক্ত করে পিছন থেকে শীতল কে জাপটে ধরে। তারপর শূন্যে তুলে তাকে কাধে ফেলে হিম তার রুমের উদ্দেশে হাঁটা দেয়।
– পালানোর খুব শখ, আমার থেকে পালানোর শখ আজ আমি বের করব। তুই এই হিমাদ্র নামের ফুল পাগ*লা ছেম*রার মনকে বিগলিত করে তাকে নিজের মায়ায় আটকে ফেলেছিস ছে*মরি, এখন আর তোর মুক্তি নেই। অজান্তেই হোক অপরাধ করেছিস, সেই অপরাধের শা*স্তি পেতে হবে। আর তোর শা*স্তি হচ্ছে সারাজীবন এই পাগলা*র পা*গলা মলম হয়ে তোকে থাকতে হবে।
________________________________________
সকাল থেকে শীতল কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা নিয়ে বাড়ির সবার যেনো কোনো মাথা ব্যা*থাই নেই। কারণ তাদের চিন্তার মূল বিষয় হলো সাদাত। মাথায় টিউমা*র ধরা পড়লে যেমন মানুষ মাথা ব্যথা ভুলে যায়, তেমনি শীতল কে খুঁজে বের করার চেয়ে সাদাত কে সামলানো সকলের জন্য কষ্ট*সাধ্য হয়ে পড়ছে। সারা বাড়ি জুড়ে রয়েছে শীতলের অস্তি*ত্ব, কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষটা উধাও হয়ে গেছে। শীতলের দেখা না পেয়ে সাদাত যেনো উম্মা*দে পরিণত হয়েছে। নিজের চুল আঁ*কড়ে ধরে চিৎকার করছে সে। জয়া নিজের ছেলের এই বেহাল দশা দেখে একটুও বিচলিত হচ্ছে না, বরং খুশি মনে সব দেখছেন। আজ সাদাত নিজের কৃতকর্মের শা*স্তি পাচ্ছে। কি এমন ক্ষ*তি হতো যদি সে শীতল কে ভালবেসে, সম্মান করে তাকে আপন করে নিত। তার ভালোবাসার কমতি ছিল না, কিন্তু ভালোবাসার বহিপ্রকাশ ভুল ছিল। জোর জু*লুম নির্যাত*ন করে কখনও ভালবাসাকে আটকে রাখা যায় না, সেটাকে মনের আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়তে দিতে হয়। সাদাত বাড়ির বাকিদের মত শীতলের সাথে পশু*র মত আচরণ করেছে, এতে শীতলের ভালবাসা তো দূরের কথা ঘৃ*ণ্য মানুষে পরিনত হয়েছে।
– এখন কাদঁছো কেনো সাদাত? আজকে তো তোমার খুশির দিন। তোমার চোখের কাটা শীতল চলে গেছে, আনন্দ করো।
– আমি জানি তুমি আগে থেকেই জানতে যে হিম শীতল কে নিয়ে গেছে, তুমি সবটা জানো শীতল কোথায় আছে? মা আমাকে বলো , শীতল কোথায়? আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, তুমি কেনো বুঝতে পারছ না। আমি ওকে ভালবাসি।
চলবে………………….