অসময়ের শুকতারা পর্ব-০৯

0
32

#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৯

সাদাতের গালে পড়া নিজের মায়ের চড়ের শব্দ নিঃশব্দ রুমে বেশ বিকট শোনায়। সাথে সাথেই শ্বাস ভারী হয়ে উঠে তার, তবে সেটা ক*ষ্টে নয় বরং রাগে। রক্তি*ম চোখ, ফুলে ওঠা ঘাড়ের রগ বলতে গেলে সাদাতের বর্তমান চেহারায় হিং*স্রতার অন্ত নেই। ছেলের চোখে মুখে আফসোসের চিহ্ন তো দূরের কথা, বরং গভীর রাগের বহির্প্রকাশ দেখে জয়ার আ*ত্মা কেঁপে উঠে। সে বুঝতে পারে সে তার ছেলেকে কেবল সুশিক্ষিত করেছে, কিন্তু ভালো মানুষ গড়তে পারে নি। ভালো হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না, এই বংশের ছেলে কিনা, বাড়িয়ে মেয়ে বউদের নি*র্যাতন করে তাদের দমিয়ে রেখে অহং*কারবোধ করে তারা।

– কি ভেবেছো তুমি আমাকে না বললে আমি শীতল কে খুঁজে বের করতে পারব না? অবশ্যই পারব। তবে এই বার ওকে একবার কাছে পাই, আমার থেকে পালানোর মজা ওকে বুঝিয়ে দিব। অনেক বড় বেড়েছে ও, শেষে কিনা আমারই বন্ধুর হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, দুঃ*সাহস তাই না? পিঠে যখন গরম রডের ছেঁ*কা পড়বে তখন বাপ বাপ করে এই দুঃ*সাহস বেরিয়ে যাবে ওর।

– পালাবে না তো কি করবে ও? তোদের মত অমানু*ষদের সাথে থাকবে? এই বাড়িতে জন্ম নিয়ে শীতল কে পা*প করেছে আজ হিমের সাথে পালিয়ে ও এই পা*পের প্রায়*শ্চিত্ত করেছে। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দে সাদাত, তাতে ওদের মঙ্গল আর তোর ও।

– মঙ্গলের খেলা শেষ, এখন অমঙ্গলের পালা শুরু হবে। আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর নজর দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে হিম, এই বেই*মানির শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে, আর বাকি রইলো শীতল। আর ব্যাপারটা পড়ে দেখছি।

এই বলে সাদাত হন হন করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। সাদাতের রাগ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা জয়ার, নিজের পেটের ছেলে বলে কথা। এখন সাদাতের মাথায় যে খুনে*র রক্ত চরে আছে তাও ভালো বুঝতে পারছে জয়া। ক্ষণে ক্ষণে বুকটা মুচড়ে উঠছে তার। সাদাত না রাগে*র মাথায় হিম না শীতলের কিছু করে না বসে।

– আল্লাহ, তোমার ভরসায় ছেড়েছি ছেলে মেয়ে দুইটা কে। তুমি ওদের দেখো, সব বাধা পার হয়ে যেনো ওরা এক হতে পারে।

___________________________________________

বিছানার ওপর অনেকক্ষণ ধরেই পা দুলিয়ে বসে আছে শীতল। চুলের বাঁধন খুলে অবাধ্য চুলগুলো তার ঘাড়ে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই, বলতে গেলে ভীষণ রেগে আছে শীতল। কেননা এখানে আসার পর থেকে একবারের জন্য ও তার গোসল করা হয়ে উঠেনি। দিনে অন্তত পাঁচ বার শরীর না ভিজালে মনের শান্তি পায় না সে, তবে সে ব্যাপারটা আলাদা। কারণ ও বাড়িতে থাকতে তাকে সারাদিনে যে পরিমাণে কাজ করতে হত তাতে পাঁচবার গোসল করাটা সাভাবিক। এখানে অবশ্য শুয়ে বসেই তার দিনাতিপাত হয়।

হিম সেই সকালে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চলল কিন্তু তার আর দেখা নেই। যাওয়ার সময় অবশ্য শীতল কে হু*মকি দিয়ে গিয়েছিল যাতে সে রুমের বাইরে পা না রাখে। শীতল ও হিমের কথা মত এই ঘরের বাইরে পা রাখেনি, সারারাত ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকতে সে চায়না।

দীর্ঘক্ষণ ধরে হিমের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শীতলের চোখে হালকা ঘুমের রেশ চলে আসে। উবু হয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে তার বন্ধ চোখে অতীত কালের কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে। বোঝ শক্তি হওয়ার অনেক আগেই শীতল তার মাকে হারিয়েছে, এমনকি সে এটাও জানে না ঠিক কিভাবে তার মা মা*রা গিয়েছে। মায়ের মৃ*ত্যুর কারণ আজও তার কাছে ধোঁয়াশা। জয়ার কাছে এসে যতবার মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছে, ততবারই কালো হয়ে উঠা মুখের কঠিন ধমকানি শুনেছে। তাই একসময় জিজ্ঞাসা করতেও ভুলে গিয়েছে শীতল।

বিকাল প্রায় ৪ টা। বৃষ্টির মৌসুম , টানা পাঁচ ঘণ্টা টানা বৃষ্টি শেষে আকাশ তখন ও মেঘলা, বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বাতাসে তখন বৃষ্টির ভেজা গন্ধ বিদ্যমান। ঘুমন্ত জয়ার পাশ থেকে অতি সতর্কতার সাথে বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে ছাদে আসে দশ বছর বয়সী শীতল। আজ বৃষ্টিটা খুব উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে তার। ছাদের ভিজে মেঝেতে পা রাখতেই ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় সারাদেহে এক অদ্ভুত পুলক বয়ে যায় শীতলের। বৃষ্টি পরবর্তী আবহাওয়া অনুভব করার ইচ্ছা আরও তীব্র হয় তার।

আস্তে আস্তে পা বাড়িতে ছাদের কিনারে ঘেঁষে রেলিং ধরে দাড়ায় সে। ধূসর রঙের মেঘের সারি সারা আকাশ ছেয়ে আছে। শীতল একটা মেঘের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বলে,

– ইসস, ওই মেঘের ওপর যদি আমি চড়তে পারতাম, কতই না ভালো হতো। মেঘে করে সারা শহর ঘুরে দেখতাম। আমি হতাম ওই মেঘের মেঘ কন্যা।

কথাটা বলেই নিখুঁত মিহি শব্দে হাসে শীতল। প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় শীতল এতটাই মশগুল ছিল যে পাশের বাসার মধ্যবয়স্ক কাকা যে তার সদ্য কিশোর বয়সে পা দেওয়া দেহের দিকে লো*লুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেটা দেখতে পায় না শীতল। আর দেখতে পেলেও হয়তো বুঝতে পারত না কাকার এই তী*ক্ষ্ম দৃষ্টির মানে। আরেকটু সময় অতিবাহিত হলে হয়তো কাকা তাকে কাছে ডেকে নিয়ে অন্যা*য়ভাবে তার দেহ স্প*র্শ করত। কিন্তু সেটা হতে দেয়নি সাদাত। কোত্থেকে জানি রাগে গজগজ করতে করতে ছাদে হাজির হয় সে।

ছাদে এসে এই দৃশ্য দেখে রাগটা তার মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে। কাকার দিকে একবার রা*গি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতলের কাছে চলে আসে সে। পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শীতল ভ*য়ে ভ*য়ে পিছন ফিরে তাকায়। পিছনে সাদাত কে দেখতে পেয়ে শীতল ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। শুকনো গলায় একবার ঢোক গিলে বলে,

– ভাইয়া তুমি, এখানে?

– কেনো এখানে এসে বুঝি ডিস্টার্ব করে ফেলেছি। মানুষকে শরীর দেখানোয় ব্যাঘাত ঘটেছে আমার জন্য তাই না রে?

ছোট্ট শীতল সাদাতের কথার কোনো মানেই বুঝে উঠতে পারে না। পিট পিট চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

– কি বললে বুঝিনি ভাইয়া।

– তোকে বুঝতে হবে না।

সাদাত আবারো পাশের ছাদের দিকে তাকায়, তবে এবার আর কাকা কে দেখতে পায় না সে। হয়তো সাদাত চলে আসায় কাকা ভয়ে পালিয়ে গেছে। সাদাত নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে।

মুখে হাসি নিয়ে শীতল কে বলে,

– ওই ফুলটা চিনিস শীত?

– গোলাপ ফুল ওটা, কিন্তু অন্য গোলাপের মত লাল নয়, মিষ্টি রঙের ওটা।

– কারণ তোকে লালের চেয়ে মিষ্টি রঙে বেশি মানায় শীত। জানিস দশটা নার্সারি খুঁজে তবে এই গোলাপের চারা আমি এনেছি। ফুলটা লাগবে তোর?

– দিবে আমায়?

শীতলের চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে। সাদাত কিছুটা হেসে গোলাপটা ছিঁড়ে শীতলের হাতে দেয়। শীতল সেটা কে কানে গুঁজতে চায় কিন্তু পরে না। শেষে সাদাত ফুলটা ভালো করে গুঁজে দেয় তার কানে।

– ভাইয়া কেমন লাগছে?

– বলব না।

– কেনো বলবো না?

– রা*গ করেছি তোর ওপর?

– কিন্তু কেনো?

– তুই আমার অধিকারের জিনিসটা অন্য কাউকে দিচ্ছিস তাই?

– মানে?

– মানে কিছু না। তুই আর কখনও একা একা ছাদে আসবি না।

– আচ্ছা।

– কিন্তু আমার রা*গ ভাঙে নি।

– তাহলে আমায় কি করতে হবে?

– কালকে বিকালে আমার সাথে একটা জায়গায় যাবি? খবরদার কাউকে বলবি না কিন্তু।

– আচ্ছা, যাবো।

এরপরের দিন সাদাত সাইকেলে করে শীতল কে নিয়ে এক নির্জন পার্কে ঘুরতে যায়। সারাটা বিকেল একসাথে বেশ খুনশুটি করে তারা। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে এক গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে তাদের। সাদাত দূরে ছিটকে গেলেও শীতলের গলায় একটা রড জাতীয় কিছু বিধে যায়। একটুর জন্য সে প্রাণে বেঁচে গেলেও বাক শক্তি হারিয়ে ফেলে ।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কানে এলে শীতল নিজের চিন্তা থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। হিম শীতলকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলে,

– আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি ,ছেম*রি। এখনই চোখে হারানো শুরু করেছো, সারা জীবন তো এখনো পড়ে আছে। তখন কি আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগাবে নাকি?

শীতল মোবাইল টা হাতে নিয়ে কিছু একটা লিখে হিম কে দেয়ায়।

– আমি গোসল করব।

হিম সেটা পরে একটা দু*ষ্টু হাসি দেয় শীতলের দিকে।

– যা দু*ষ্টু, বিয়ের আগে ওসব করতে নেই। আমার ল*জ্জা লাগে, কোনো মেয়ের সামনে সামনে শার্ট খুলতে, আর সেখানে তো তুমি আমাকে জন্মদিনের পোশাক পড়তে বলছ। এতটা ডিমান্ড করো না ছে*মরি, পড়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেললে সমাজে আমি মুখ দেখাতে পারবো না। 🥺🥺

চলবে……………….