অসময়ের শুকতারা পর্ব-১১

0
50

#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:১১

মেসেজটা পড়ে তুষার না হেসে পারে না। ঋতি মেয়েটা তাকে অনেক ভালবাসে, আর সেই বা কম যায় কিসে? গুনে গুণে দশ বছরের ছোট মেয়েটা তার থেকে, কিন্তু তবুও মেয়েটার শাসন সে মুখ বুজে মেনে নেয়। প্রিয় মানুষটার চিন্তার জগৎ যে সে ষোলো আনা দখল করে নিয়েছে সেটাই তুষারের শান্তির জায়গা।

ঋতি হিমের ক্লাসমেট, ভাইয়ের বান্ধবী হিসেবেই ঋতির সাথে তুষারের পরিচয়। তুষার কখনও ভাবতে পারে নি যে ত্রিশের কোটা পার করার পরেও সে এক বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়বে তাও এত ভয়াবহ ভাবে। এই ভয়াবহতা কেবল তুষারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, ছোঁয়াচে রোগের মতো ঋতির মনকেও ছুঁয়েছে সেটা। আজ পাঁচ বছর হলো তাদের ভালোবাসার সম্পর্কের। গত কয়েকমাস ধরে তুষার একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ঋতি কে ঠিকমতো সময় দিতে পারছে না। কিন্তু আজকের দিনটা অনেক স্পেশাল, তাই আজকে প্রেয়সীর মুখোদর্শন না করলেই নয়।

তুষার সাথে সাথেই ঋতিকে মেসেজের রিপ্লাই দিলো,

– গ্রিন পার্কে বিকাল ৪ টায় এসো, ওখানেই দেখা করবো। আর হ্যাঁ নীল শাড়ি তো পড়বে, সাথে ম্যাচিং জুয়েলারী। মোদ্দা কথা আমি আজ আমার জান কে নীল পরির রূপে দেখতে চাই। আর হ্যাঁ গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেটা করেই আসবে। কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ চড়া যাবে না। আমি চাই না আমার জানকে অন্য কেউ দেখুক।

___________________________________________

ভোর রাত ৫ টা, ফজরের আজান পড়ে গেছে বোধহয়। সাদাত অতি সতর্কতার সাথে হিমের বাংলো বাড়ির উচুঁ প্রাচীর পেরিয়ে বাড়ির পিছনের ঝাপরা গাছগুলোর পিছনে লুকিয়ে পড়ে। পিছনের দিকটা থেকে গার্ড রা চলে গেলে সে আসতে করে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। আশপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে সাদাত ওপরের দিকে তাকায়। দুতলায় দুটো রুমের জানালা ভেদ করে আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। এতে সে নিশ্চিত হয়ে যায় একরুমে হিম আছে, আর আরেক রুমে শীতল। এই বাংলোয় এর আগে কয়েকবার এসেছে সাদাত, তাই হিমের রুম কোনটা সেটা সে ভালো করেই আন্দাজ করতে পারে।

মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে সাদাতের, কিছুটা কষ্ট ও লুকিয়ে আছে সেই হাসিতে।

– তুই আমার অত্যা*চার গুলোই দেখলি শীত, এই অত্যা*চারগুলোর আড়ালে আমার অপ্রকাশিত ভালবাসাটা দেখলি না।

কথাগুলো নিজ মনে বলার সময় সাদাতের চোখ জোড়া কিছুটা ঘোলাটে হয়ে আসে। কিন্তু এখন প্রিয়তমার শোকে অশ্রুবিসজন দেওয়ার চেয়ে তাকে মুক্ত করে নিজ খাঁচা*য় বন্দী করা বেশি জরুরি সাদাতের কাছে। জানালার কর্নিস বেয়ে শীতলের রুমের বারান্দায় পৌঁছায় সে। আস্তে করে থাই গ্লাসটা খুলে সাদাত রুমে ঢুকে পড়ে। স্মিত আলোয় তেমন কিছুই নজরে পড়ছে না সাদাতের, কেবল আন্দাজের ওপর পা ফেলে সে আগাচ্ছে বিছানার দিকে।

সাদাতের মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছে। এবার হয়তো সে হিম কে হারাতে সক্ষম হয়েছে, বস্তুত সাদাত জীবনে অনেকবারই হিম কে পরাজয়ের স্বাদ দিতে চেয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে হেরে গিয়ে সেটাকে বন্ধুত্ব বলে চালিয়ে দিয়েছে। সাদাত বিছানার চাদর স্পর্শ করতেই যাবে ঠিক তখনই ঘরের আলো জ্বলে উঠে। সাদাত ভয়ে ভয়ে পিছনের দিকে তাকাতেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে।

হিম শুভ্র রঙা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সাদাতের দিকে তাচ্ছি*ল্যের দৃষ্টি আরোপ করছে। হিমের মুখে ভঙ্গিমা এমনই যে সে আগে থেকেই জানতো যে সাদাত এখানে আসবে। সাদাত নির্ভয়ে হিমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

– তুই এখানে কি করছিস?

– What a silly question? আমার বাড়ি আর আমি থাকব না, এই প্রশ্নটা তো আমি তোকে করবো সাদাত। তুই এত রাতে আমার বাসায় চোরে*র মত ঢুকেছিস কেনো?

– আমি নই, তুই চো*র। আমার ভালবাসা কে আমার থেকে চু*রি করে এখানে বন্দী করে রেখেছিস।

– তাহলে মানছিস এবারেও হেরে গেলো আমার কাছে। আর আমি চু*রি করিনি কাওকে, শীতল নিজ ইচ্ছায় এখানে আমার সাথে আছে। তুই চাইলে ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারিস।

– তুই যে ওকে হুম*কি ধাম*কি দিয়ে শীতল কে সত্য বলতে বাধা দেসনি তার কোনো প্রমাণ আছে হিম?

– হুম*কি দেওয়া তোর স্বভাব সাদাত, নারী জাতিকে সম্মান করতে আমি জানি। না তুই তোর মা কে সম্মান করিস , না তোর বোনকে, আর না শীতল কে। আর ভালোবাসার কথা বলছিস? তুই ভালবাসিস শীতল কে? মনে পড়ে, যেদিন আমি তোর কাছে শীতলের পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম, সেদিন তুই বলেছিলি শীতল তোদের কাজের লোক। ভালোবাসার মানুষের সম্মান আসলেই তোর কাছে বাসার কাজের লোকের মতো।

– হিম মুখ সামলে কথা বল। আমাকে ভালোবাসো শিখাবি না, খবরদার। তোর চেয়ে আমি শীতল কে হাজার গুণে বেশি ভালোবাসি।

– এত ভালবেসে কি হলো, সম্মান টাই তো করতে পারলি না ওকে, আর না পারলি ওর মনে জায়গা করতে।

– সেটা তোর ভাবার জিনিস না, সামনে থেকে সর, আমি শীতলের সাথে দেখা করবো।

– এত কিছুর পরও তুই আশা করছিস আমি তোকে শীতলের কাছে ঘেঁষতে দিবো? ভালয় ভালয় চলে যা এখন থেকে, আমি তোর সামনে খারাপ হিমাদ্র হতে চাই না।

– আজ তোর পাওয়ার আছে বলে আমাকে চলে যেতে বাধ্য করছিস হিম। আমি কথা দিচ্ছি একদিন আমিও তোর পজিশন এ গিয়ে শীতল কে তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবো, তুই দাঁড়িয়ে দেখবি কিন্তু কিছুই করতে পারবি না।

__________________________________________

সকালটা বেশ গুমোট, ঘুম থেকে উঠে শরীর টা বেশ খারাপ লাগছে শীতলের। মনটাও খারাপ তার, এর আগে কখনও জয়া কে ছেড়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি তার। তাই একটু আদর পাওয়ায় আশা তার মন কে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েই শীতল রাতের কাপড় গুলো ছেড়ে নেয়। লুঙ্গি পরে আর যাই হোক মানুষের সামনে যাওয়া যায় না।

গায়ে ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে শীতল নিচে চলে যায়। রান্নাঘরে মেইড রা ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত, অর্থাৎ হিম এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। ভালই হয়েছে এই সুযোগে বাড়িটা ভালো করে দেখে নিতে পারবে সে। শীতল পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে চলে আসে। সুবিশাল প্লটের ওপর হিমের বাংলো বাড়ি। চারদিকে গাছের অন্ত নেই। বেশ রুচিশীলতার সাথে তৈরি করা হয়েছে, সাথে সাথেও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বেশ যত্ন সহকারে।

শীতল হাঁটতে হাটতে বাড়ির দক্ষিণ দিকে পৌঁছায়। সেখানে এক বাধানো পুকুর, পুকুরের পাড় টা বেশ পরিষ্কার, তবে সুইমিং পুল নয়। শীতল বেশ খুশি বলে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ে, আর পা দুটো পুকুরের ঠান্ডা পানিতে ডুবায়। বেশ ঠাণ্ডা পানি, কিন্তু তবুও শীতলের বেশ ভালো লাগছে। অনেক জীবন পর সে পুকুরের পাশে বসার সুযোগ পেয়েছে। তাই কোনো কিছু না ভেবেই শীতল সুযোগ টা লুফে নেই।

কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর শীতলের মনে হয় পানি টা কেমন নড়ে উঠছে, আর কিছু একটা যেনো তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথমে পাত্তা না দিলেও কয়েক মুহূর্ত পর পানির নিচ থেকে কিছু একটা ভেসে উঠতেই শীতল লাফ দিয়ে সেখান থেকে উঠে পড়ে।

জলজ্যা*ন্ত কুমির, তাও দুটো। পুকুরের পানিতে কুমির কিভাবে এলো ভাবতেই শীতলের মাথা ঘুরতে থাকে। ঠিক সেই সময় পিছন থেকে হিমের জোরালো কন্ঠ শুনতে পাওয়া যায়।

– দিলে তো আমার মন্টু ঝন্টুর ঘুমটা ভাংগিয়ে।

চলবে……………….