অসময়ের শুকতারা পর্ব-১৪

0
45

#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:১৪

এক অস্ফুট আর্ত*নাদের শব্দ হিমের কনে এলে সে পিছন ফিরে তাকায়। একজোড়া অশ্রুসিক্ত ভী*ত সন্ত্র*স্ত চোখ তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,মনে মনে হয়তো হিম কে ভর্ৎ*সনা দিচ্ছে, কিন্তু কোনো আওয়াজ তার গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। শীতলের এমন করুন চাহনি দেখে হিমের মনে পড়ে যায় যে শীতলের সামনেই তার সর্বোচ্চ নৃশংস*তা প্রকাশ করেছে। কিন্তু এখন ভুলের জন্য আফ*সোস করার মত সময় নেই।

হিম দ্রুত শীতলের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে শীতল তার থেকে কয়েক কদম দূরে চলে যায়। এই ঘটনায় শীতল এতটাই আশ্চার্জিত হয়ে পড়েছিল যে কয়েক মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরও তার হাত পা কাপছে। সেই নি*ষ্ঠুরতা, যা সে এতদিন সাদাতের চোখে দেখেছিল। আজ সেটা সে হিমের চোখেও দেখেছে। পার্থক্য শুধু সাদাতের চোখে নিষ্ঠু*রতা বরাদ্দ ছিল কেবল শীতলের জন্য আর হিমের নিষ্ঠুর*তা কেবল শীতল ব্যতীত অন্য সকলের জন্য। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই নিষ্ঠু*রতার শিকার যে শীতল নিজে হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মানুষের মন আকাশের রঙের চেয়েও বেশি পরিবর্তিত হয়।

হিম কন্ঠ নরম করে বলে,

– শীতল, ভ*য় পেয় না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। ওরা এই শা*স্তির যোগ্য ছিল তাই আমি ওদের নিজ হাতে শা*স্তি দিয়েছি। কিন্তু তুমি ওদের তুলনায় হাজার গুণে নিষ্পাপ। তোমাকে ক*ষ্ট দেওয়া তো দুরের কথা তোমার গায়ে কেও আঁচ*ড় দিলে আমি তার কলিজা ছিঁ*ড়ে ফেলব।

হিম যতই তার কোমল কন্ঠে শীতল কে বিমোহিত করবার চেষ্টা করুক, তার ক*র্কশ ভাষা শীতল কে আরো ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। শীতল পিছাতে পিছাতে এক সময় তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। শীতল পাশে সরে যেতে চাইলে এবার হিম তার পথ আটকে দাঁড়ায়। হিম সযত্নে শীতলের একটা হাত স্পর্শ করলে শীতল সাথে সাথেই হিমের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

শীতল পালাতে চায় কিন্তু পারে না। তার আগেই হিম তাকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে ফেলে। শীতল অবিরাম হাত পা ছুড়তে থাকে, যার দরুন হিম বেশিক্ষণ তাকে আটকে রাখতে পারে না। হিমের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে শীতল এক দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়।

__________________________________________

সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে, নীল আকাশ ধীরে ধীরে লাল বর্ণ ধারণ করছে। সূর্যের অবস্থান দেখে সময় টা আন্দাজ করতে পারলেও শীতল জায়গাটা আন্দাজ করতে পারে না। প্রায় এক ঘন্টা ধরে প্রাণ পনে দৌড়িয়ে এখানে এসেছে সে। জায়গাটায় হালকা গ্রামের ছোঁয়া আছে, কিন্তু অচেনা। নীরব পথের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভীষণ কান্না পায় তার। এতগুলো দিন ধরে সে নিজের মনে হিম সম্পর্কে যে চরিত্রটি কে সাজিয়েছিল আজকে এক মুহূর্তে সেটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। সে কখনও ভাবতে পারে নি যে হিম এতটা নির্ম*ম হৃদয়ের মানুষ। তার মানে সে এতদিন শীতলের সামনে ভালো মানুষের মুখোশ পরিধান করে ছিল? বারবার প্রশ্নটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মনের অজান্তে যে পুরুষের নিকট সে তার নিষ্পাপ হৃদয়টা কে গচ্ছিত রেখেছিল সেই প্রাণ পুরুষের এ কি পরিচয় পেলো সে?

শীতল কিছুতেই মানতে পারছে না তার চোখের সামনে ঘটে জাউয়া বাস্তবতা। ঘোলা চোখে আশপাশে তাকিয়ে সে ধূ ধূ চাষের জমি ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। রাস্তার অন্য পাশে ঘন বনজঙ্গল। শীতল রাস্তার পাড়ের এক গাছের গোঁড়ায় বসে পড়ে। সেই সাথে অপ্রত্যাশিত দৃশ্য গুলো যেনো তাকে আরো বেশি করে জেঁকে ধরে।

– না, এটা সত্যি নয়। আমি জানি এটা সত্যি নয়। এসবই আমার মনের ভুল, আমি স্বপ্ন দেখছি। হিম এমন কাজ করতে পারে না। উনি এতটা নি*ষ্ঠুর নন।

মনের মাঝে কথা গুলো জপতে জপতে আবারও কান্নায় ভেংগে পরে শীতল। একসময় কাদতেঁ কাদতেঁ সেখানেই জ্ঞান হারায় শীতল।

__________________________________________

– এই মেয়ে ঠিক আছে তুমি?

ভারী হয়ে আসা দুটো চোখের পাতা হালকা খুলতেই এক বৃদ্ধার কন্ঠ কানে আসে শীতলের। এবার সে ভালো করে চোখ খুলে আশেপাশে তাকায় ভালো করে। অচেনা এক টিনের চালওয়ালা ঘরে বিছানায় তাকে শায়িত করা হয়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ লোক, বয়স প্রায় সত্তর হবে, মুখের চামড়া ঝুলে গেছে তার। আর শীতলের মাথার কাছে বসে আছেন এক বৃদ্ধা, তারও অনেক বয়স হয়েছে। নীল পারের সাদা শরীর লম্বা আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনে বসে আছেন তিনি।

শীতল উঠে বসে চেষ্টা করলে বৃদ্ধা তাকে বাধা দেয়।

– উঠো না মেয়ে, চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি গরম দুধ নিয়ে আসছি।

শীতল বলতে চায় ” তার কোনো দরকার নেই। আপনারা শুধু আমাকে আজকের রাতটা আপনাদের বাড়িতে থাকতে দিন”। কিন্তু সেটা শীতলের বলার দরকার হয়না। নিঃসন্তান বৃদ্ধ দম্পতি শীতলের ভীষণই যত্ন নেয়।

চাষবাস সেরে বৃদ্ধ লোকটা বাড়ি ফেরার পথে শীতল কে সে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। পাশেই তার বাড়ি ছিল তাই সে দ্রুত তার স্ত্রী কে ডেকে আনে সেখানে। তারপর দুজনে মিলে তাকে ঘরে এনে তোলে।

গরম দুধের গ্লাস টা শীতলের হাতে ধরিয়ে বৃদ্ধা তারও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

– কি মিষ্টি মেয়েটা, কি নাম তোমার মা?

শীতল কেবল শক্ত করে গ্লাসটা ধরে রাখে, মুখে কিছুই বলে না।

– কি হলো কথা বলবে না আমার সাথে?

এবার শীতল ইশারায় তাকে বলে, যে সে কথা বলতে পারে না। শীতলের মলিন মুখটা দেখে বৃদ্ধার ভীষণ মায়া হয়।

– তুমি যতদিন চাও এখানে থাকতে পারো। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন চটপট দুধটুকু খাও দেখি মা। তারপর বিশ্রাম করো কেমন?

_______________________________________

ল্যাপটপের স্ক্রিনে এক মনে চেয়ে আছে হিম। স্ক্রিনে শীতলের প্রতিটা গতিবিধি দেখা যাচ্ছে। মূলত এক বৃদ্ধ দম্পতির দ্বারা শীতল কে উদ্ধার করা, তাদের বাড়িতে শীতল কে আশ্রয় দেওয়া সবই ছিল হিমের কাজ।

– স্যার একটা কথা বলব?

– তুমি আবার কবে থেকে আমার পারমিশন নিয়ে কথা বলা শুরু করেছো ফয়সাল?

– না মানে জানতে ভীষণ মন চাইছে?

– কি জানতে চাও যে আমি ঘুমানোর সময় কোন ব্র্যান্ডের লুঙ্গি পরে ঘুমাই সেটা?

– স্যার, আপনি মেম কে যেতে দিলেন কেনো?

ফয়সালের প্রশ্ন শুনে হিম ভীষণ হাসি।

– তোমার মেমের মনে কিছু অভিমান জমেছে আমাকে নিয়ে। তাই একটু দুরে দুরে রেখেছি, কিন্তু চোখের আড়াল হতে দিইনি। কিছুটা সময় একলা কাটালে মনের দুঃ*খ গুলো হালকা হয়ে আসে।

– কিন্তু স্যার মেমের –

– ফয়সাল যাও এখন, আমি ঘুমাবো।

ফয়সাল আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ হিমের কথা মত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। হিম লেপটপ বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুঁজে শীতলের কথা মনে করতেই একটা সুর ভেসে আসে তার মনে।

– ও ছে*মরি ও ছেম*রি
আমি তোর দিওয়ানা।
ও ছেম*রি ও ছে*মরি
একটু কাছে আয় না।

চলবে………………….