অসময়ের শুকতারা পর্ব-১৫

0
30

#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:১৫

– চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে
কদম তলায় কে?
ইকবাল নাচছে, ফয়সাল নাচছে
আজ হিম সাগরের বে।

বিয়ের সেরবানিতে নিজেকে ঠিক কেমন লাগছে সেটা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করছে হিম। সেই সাথে তার অশান্ত ঠোঁট যুগল তুলেছে নতুন সুর। সবশেষে চুল গুলোকে জেল দিয়ে স্পাইক করে তাকায় নিজের দিকে।

– নাহ ফাটাফাটি লাগছে। আজ ছে*মরি আমাকে এই লুকে দেখলে নির্ঘাত হার্ট এটাক করবে। করার কথাই তো, এত্ত হ্যান্ডসাম ছেলে কি আর রাস্তায় হাট বাজারে দেখা যায়। আর তাও যদি বজ্জা*তটা না হার্ট এটাক করে, তারমানে ছেম*রিটার নির্ঘাত যৌবনে সমস্যা রয়েছে।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে সানগ্লাস পরিধান করে হিম তার রুমের বাইরে চলে আসে। কালো চশমার আড়ালে তার ধূসর নীল রঙ্গা মনি দুটি ঢাকা পড়ে গেলেও, মুখের উপচে পড়া উল্লাস যেনো ক্ষণে ক্ষণে ইকবালের বুকে জা*লার সৃষ্টি করছে। সে একবার আড়চোখে একবার হিম কে দেখে দৃষ্টি মাটিতে নামিয়ে ফেলে। তারপর নিজ মনে আওড়ায়,

– বিয়ে করতে যাচ্ছেন ভালো কথা, কিন্তু আজ রাতে আপনি বাসর কি করে করেন, সেটা আমিও দেখব। আজ যদি আপনার বাসর করার সাধ না ঘুচাতে পারি তাহলে আমার নাম ও বা*ল I mean ইকবাল না।

__________________________________________

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে চলল তবুও বুড়ো দাদি দাদার আসার সময় নেই। আজ সকালে শীতলের ঘুমের ভাঙ্গার অনেক আগেই তারা তাদের আবাদ জমিতে চলে যায়। গ্রামে গ্রামে ফসল কাটার ধুম পড়েছে। আজ কালের মধ্যে ফসল না কাটলে বিক্রি করে কৃষক কোনো দাম পাবে না।

বৃদ্ধ দম্পতি নিজেদের কাজে বেস্ত থাকলেও শীতলের যত্ন করতে ভুলে নি। শীতলের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করেই তবে বৃদ্ধা মাঠে গেছেন। আর দুপুরে দুজনে ফিরেছিলেন একটু বিশ্রামের জন্য । তবুও সেই সময়টা তারা মিলিয়ে দেন শীতলের খেয়াল রাখার কাজে। অন্যের আমানত, একটু খেয়াল না রাখলে হয়। চব্বিশ ঘণ্টা ও কাটে নি কিন্তু এরই মধ্যে শীতলের প্রতি তাদের সুপ্ত বাৎসল্য প্রেম জেগেছিল। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বৈবাহিক জীবনে কখনও মা বাবার হতে না পারার ক*ষ্টটা যেনো শীতল কে পেয়ে লাঘব হয়েছে তাদের।

শীতলের সময় যেনো কাটতেই চাচ্ছে না। মুখ ভার করে বিছুক্ষণ বিছানায় মূর্তির মত বসে থেকে শীতল এবার উঠে দাঁড়ায়। ছোট ছোট কদম ফেলে সে চলে যায় বাড়ির পিছনে। সেখান থেকে সামনে তাকালে কেবল ফসলি জমি। সোনালী হলুদ ফসলে চেয়ে গেছে নামহীন অজানা গ্রামটা। সেই সাথে হালকা মৃদু ম*ন্দ বাতাস। শীতল প্রাণ ভরে শুষে নেই সেই ঠান্ডা বাতাসখানা, বাতাসে পাকা ধানের মিষ্টি গন্ধ। মুগ্ধ দুটি চোখে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করার সময় শীতলের চোখে পড়ে মাটির রাস্তার ওপর দিয়ে একটা প্রাইভেট কার তাদের বাড়ির দিকেই আসছে। মাটির রাস্তা হলেও বেশ চওড়া রাস্তা। তাই অনায়াসেই গাড়ি এগিয়ে চলছে আপন গতিতে।

শীতল কিছুটা ঘাবড়ে যায়, এটা হিমের গাড়ি নয়তো। হিমের নামটা সে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেছিল, সেই সাথে ভুলে ছিল হিমের নৃশংস*তার দৃশ্য। কিন্তু হিমের কথা মনে পড়ায় সেই দৃশ্য গুলো আবারও শীতলের চোখের সামনে ভাসতে শুরু করে।

শীতল শুকনো গলায় এক ঢুক গিলে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। সজোরে দরজা আটকে দরজার পাশেই বসে পড়ে সে। শ্বাস আটকে আসছে তার। হিমের মুখোমুখি সে কিছুতেই হতে চায় না।

কিছুক্ষণ পর বোঝা যায় আসলে শীতলের ধারণাই ঠিক। হিম এসেছে তাকে নিতে, সেই সাথে বৃদ্ধ বৃদ্ধা কেও সে নিয়ে এসেছে। সারাবাড়িতে শীতল কে না দেখতে পেয়ে হিম সোজা শীতলের রুমের সামনে চলে যায়। চওড়া গলায় তাকে ডাকতে থাকে,

– শীতল দরজা খোলো, আমাকে রাগিও না বলছি। আমি জানি তুমি এখানেই আছো।

হিমের কন্ঠ শীতলের কানে যেতেই তার শরীর জমে যায়। তাকে চোখে দেখেনি চব্বিশ ঘণ্টা ও হয়নি, কিন্তু কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে যেন কত বছর পর তার প্রিয়তমের কথা শুনছে সে।

– এই ছেম*রি কি ভেবেছিস, তুই দরজা না খুললে আমি ভিতরে ঢুকতে পারব না? ভালই ভালই বলছি দরজা খোল না হলে কিন্তু –

শীতল নিজে থেকেই দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসে। হিম শীতল কে নিজের চোখের সামনে দেখে তার বিক্ষিপ্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শেষমেষ জড়িয়ে ধরে শীতল কে। শীতল তো লজ্জা*য় মা*রা যাচ্ছে, তাদের সামনেই বর্শীয়সি দুজন দাঁড়িয়ে আছেন, তবুও এই ছেলে কিভাবে নির্লজ্জে*র মত শীতল কে জড়িয়ে ধরে আছে।

শীতল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে হিম তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রাগী কন্ঠে শীতলের কানের কাছে গিয়ে বলে,

– আর একবার নড়েছিস তো তোকে ফ্যানের সাথে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখবো। নিজের কুমারত্ব উপভোগ করতে দে, কারণ একটু পড়েই টা আর অবশিষ্ট থাকবে না।

শীতল হিমের কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝল না। তবে সে দ্বিতীয়বারের মতো নড়ার সাহস ও করলো না। একটু পর হিম তাকে নিজে থেকে ছেড়ে দিয়ে ফয়সাল কে বলে,

– কাজি সাহেব কে ধরে বেঁধে যেভাবে হক নিয়ে এসো। আজই চিরকুমারের ইতি টেনে বিয়ে করব এই ছে*মরিকে।

ফয়সাল মাথাটা স্মিত নাড়িয়ে চলে যায় কাজি কে আনতে। এদিকে শীতলের চোখ তো চড়কগাছ। হিমের মাথার কয়টা স্ক্রু একসাথে লুজ হয়েছে করে জানে। আশ্চর্জিত চোখ যুগল হিমের চোখের সাথে দেখা হতেই হিম একটা দু*ষ্টু হাসি হাসে।

– Be ready to handle me and my naughty desire baby. Cause tonight I won’t let you to sleep.

_________________________________________

প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে শীতল এর সম্মতি চাওয়া হচ্ছে কিন্তু শীতলের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মাটির দিকে চেয়ে বসে আছে পাথরের মতো। কাজী সাহেব ” বলো মা কবুল” কথাটা মিনিমাম ৫০০ বার বলেছেন। এতে আর যাই হোক তার গলাটা শুকিয়ে গেছে।

শীতলের এই অনড় অবস্থা দেখে হিমের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার অবস্থা। মেয়েটাকে চোখ রাঙিয়েও লাভ নেই।একসময় সে উঠে গিয়ে কাজি সাহেব কে বলে,

– কাজি আমি ওর পক্ষ থেকে বলছি, কবুল কবুল কবুল। আলহামদুলিল্লাহ আজ আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।

এরপর তড়িঘড়ি করে শীতলের এক হাত টেনে হিম বলে,

– চলো বেগম সোহাগ রাত টা মানিয়ে ফেলি।

– আরে দাঁড়াও বাবা, শুধু তুমি বললেই তো আর বিয়ে হবে না। কনে কেও সম্মতি দিতে হবে বিয়ের জন্য।

– আরে বোঝেন না, মেয়েদের একটু ন্যাকা*মি না করলে পেটের ভাত হজম হয়না। এই তো আপনি আসার আগে দাদি ওকে খাইয়েছে, এখন ঘাড় ত্যাড়ামি করে সেই খাবার গুলো হজম করছে, বদহজমের ভয়ে।

– অতশত আমি বুঝি না। কনে সম্মতি জানায় নায় তাই বিয়েও এখনও হয়নি।

হিমের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে। যত সে তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছে এই শীতল যেনো জেনেশুনে তত দেরি করাচ্ছে। হিম শীতলের হাত ধরে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।

– তুই কি চাস এখানেই সবার সামনে তোকে আমি চুমু খাই?

শীতল বড় বড় চোখে তাকায় হিমের দিকে।

– তাহলে এক্ষুনি সম্মতি জানা।

শীতল কে আবারও কাজি জিজ্ঞাসা করে,

– মা, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি।

এবার শীতল মাথা নাড়ায় অর্থাৎ সে রাজি।

– আলহামদুলিল্লাহ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।

– দাঁড়ান কাজি সাহেব, শুনলাম এখানে নাকি এই বো*বা মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটার নাকি এখনও ১৮ বছর হয়নি।

সকলে পিছন ফিরে তাকালে গ্রামের প্রধান কে দেখতে পায়। কিন্তু শুধু তিনি আসেন নি, সাথে করে গ্রামের আরো গণ্যমান্য ব্যক্তি আর তার লাঠিয়াল বাহিনী কে নিয়ে এসেছে সে।

– আমাকে তো বলা হয়েছে মেয়ে বিয়ের যোগ্য।

– তার মানে সব কার*সাজি এই ছেলেটার। ধর সবাই এই ছেলেকে, আজ বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে এর ছাল তুলবো। বিয়ের সাধ ঘুচে যাবে একদম।

হিম রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। সে দ্রুত শীতলের হাত ধরে তাকে নিয়ে এক দৌড় লাগায়। হিমের পিছনে গ্রাম প্রধান আর তার লাঠিয়াল বাহিনী ও ছুটতে থাকে। গ্রাম প্রধান তার গলা উঁচিয়ে বলে,

– ছুটে পালাচ্ছিস ভালো কথা, মেয়েটাকে নিয়ে পালাচ্ছিস কেনো? ওকে ছেড়ে দে।

– গ্রাম প্রধান সাহেব, বিয়ে করেছি কি বউকে ছাড়ার জন্য নাকি? তার ওপর এখনো বাসর করিনি। বাসর করার আগে বউকে ছাড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। বাসর তো আমি করেই ছাড়বো, কেও আটকাতে পারবে না আমায়।

কথা গুলো যেনো গ্রাম প্রধান আর গায়ে কাটার মতো লাগে। তিনি দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেন। কিন্তু হিমের সাথে পেরে উঠে না। দেখতে দেখতে হিম তার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

_________________________________________

রাত তখন ৯ টা। হিম আর শীতল দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ভীষণ ক্লান্ত। শীতল এবার হিমের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ে। সে আর দৌঁড়াতে পারছে না, পায়ের শক্তি ফুরিয়ে এসেছে তার। হিম ও শীতলের পাশে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পর শ্বাস প্রশ্বাস সাভাবিক হয়ে আসলে হিম আবারো চিন্তায় ডুব দেয়। এত রাতে বিয়ের পরবর্তী কাজ সম্পাদন করার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু আজকের রাতটা নষ্ট করতে চায় না হিম। বেশ খানিকক্ষণ চিন্তার পর হিমের নজর যায় ক্ষেতের দিকে। তারা বর্তমানে পাট ক্ষেতের ভিতর আছে। সাথে সাথেই একটা বুদ্ধি খেলে যায় হিমের মাথায়।

– বেগম?

শীতল হিমের দিকে তাকায়।

– চলো পাট খেতে বাসর সেরে ফেলি। এত রাতে কেও আসবে না আমাদের মাঝে। আজ বাসর না করতে পারলে নির্ঘাত আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলব। তুমি কি চাও সারাজীবন পাগ*লের সাথে সংসার করতে? তাই বলছি, গাছের আড়ালে গিয়ে দুষ্টু*মিষ্টি খেলায় মাতি চলো। 🫣🫣

চলবে…………………