অসময় পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
18

#অসময় (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

পলাশ রাতে জানায় সে বন্ধুদের সঙ্গে চারদিন ঘুরতে যাবে। আমি বাসায় একা থাকতে না পারলে যাতে বাবার বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসি। এই কথা শুনে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিছুটা কষ্ট পেয়েই উত্তেজিত হয়ে বললাম,“বিয়ের চার মাস হতে চললো, আমাকে নিয়ে পাশের মাঠেও একবার ঘুরে আসতে পারলে না। আর বন্ধুদের সঙ্গে চারদিনের জন্য চলে যাচ্ছো?”

“তোমার সমস্যা কী বলো তো?
আমার সঙ্গে সবসময় খিটখিট হয়ে কথা বলো কেন?”

“তোমার সমস্যা কি? তোমার নিজের নতুন বউকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে মন চায় না? কোন শখ আহ্লাদ নাই? শুধু বিছানা অব্দিই সব তোমার? তোমার মনে হয় না এখন বন্ধুদের নয় বরং তোমার বউকে সময় দেওয়া উচিত।”

“শুধু সময়, সময় আর সময়।
তোমাকে আমি সময় দেই না। যেটা দেই সেটা নিয়েই সুখে থাকো। তুমি কে যে তোমাকে নিয়ে আমার ঘুরতে যেতে হবে?”
এভাবেই এক কথায় দুই কথায় প্রচুর ঝগড়া হয়। আমি রাগ করে বাবার বাড়ি চলে আসি। পলাশের আচরণে এখন আমার তার বন্ধুদের নিজের সতীন মনে হয়। পলাশের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার নেশা। আমার ব্যাপারে উদাসীন থাকা সবকিছু আমাকে ভেতর থেকে কষ্ট দেয়। সে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে, এটায় আমার সমস্যা হতো না যদি সে আমাকে একটু সময় দিতো। কিন্তু সে সেটা করছে না। এসব নিয়েই রাগে অভিমানে তার সঙ্গে ঝগড়া করে ফেলি। এবার বাবার বাড়ি এসে ভাবলাম, আমার এই রাগকে গুরুত্ব দিয়ে পলাশ ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল করে আমাকে নিতে আসবে। কিন্তু না।

পলাশ আসলো না। বরং সে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে চলে গেছে। আমি তার ফেসবুক আইডি স্ক্রল করে সেই ঘুরতে যাওয়ার ছবি দেখে আরও বেশি কষ্ট পেলাম। একদম ভেঙে গেলাম। সে চারদিনের জায়গায় পাঁচদিন থেকেছে সেখানে। এই পাঁচদিনে সে একবার আমাকে ফোন অব্দি দিলো না। আমার তো মনে হয়, আমি রাগ করে বাবার বাড়ি আসায় তার ভালো হলো। এই সুযোগে সে ভালোভাবে ঘুরতে পেরেছে। নয়তো আমি ফোন দিয়ে বিরক্ত করতাম। এসব ভেবে হাউমাউ করে কান্না করে দেই। মায়ের সঙ্গে সবটা শেয়ার করলে সে বলে,“সবকিছু তো ঠিকই আছে। এই সামান্য কারণে এত ঝগড়া করলে চলে? পুরুষ মানুষ একটু বউয়ের প্রতি উদাসীন হয়। তাকে নিজের মতো গড়ে নিতে হয়।”

“সে আমার সঙ্গে মন খুলে দুই মিনিট কথা বলে না। সবসময় হয় বন্ধু নয় ফোন সেসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাকে নিজের মতো কিভাবে গড়বো?”
আমার কথা শুনে মা আমাকে সাহস দিয়ে বলে,“শোন মা। মেয়ে মানুষের এত সহজে ভেঙে পড়লে চলে না। ধৈর্য ধরতে হয়। মেয়েরা অসীম ধৈর্য ধরতে পারে বলেই একটা সংসার পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে।”

এটা বলে মা আমাকে আরও কিছু কথা বললো। আমি তার সব কথা মন দিয়ে শুনলাম। অতঃপর পলাশকে ফোন দিলাম। পলাশ ফোনটা ধরতে আমি নরম গলায় বললাম,“আমাকে নিতে আসবে না?”

“তুমি না রাগ করে চলে গেলা।
আর কখনো আসবে না বললে। তাহলে এখন এই কথা।”
পলাশের কথায় আমি রাগ করলাম না। কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলাম। পলাশ বললো,“আসছি।”

অতঃপর পলাশ বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে সরাসরি আমাদের বাসায় আসে। আমাকে নিতে আসে। তার এই আশায় আমার খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হতে পারলাম না। আমার মনে হলো তার এখন আমাকে প্রয়োজন সেজন্যই সে এক কথায় এসেছে৷ নয়তো আসতো না। আমি পলাশের সঙ্গে তেমন কথা বললাম না। পলাশও কথা বাড়ালো না।

বাড়ি ফিরে মায়ের দিয়ে দেওয়া খাবার গরম করতে চলে গেলাম। পলাশও একটা কাজে রান্নাঘরে আসতে আমি নরম গলায় বললাম,“ঘোরাঘুরি খুব ভালো হলো, তাই না?”

“হ্যাঁ। অনেক মজা করছি।”
এটা বলে পলাশ হাসি মুখে তার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর গল্প করে। আমি অজান্তে কেঁদে দেই। পলাশ এটা দেখেও দেখলো না।

___
এভাবেই সংসার জীবন এগিয়ে যায়। আমি ধৈর্য ধরে পলাশের সঙ্গে নিজেই খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করি। কিন্তু হয় না। পলাশ বরাবরের মতো আমার সব কথায় হুম হুম করে যায়। আমাদের মাঝে আবার ঝগড়া হয়। একটা সময় ঝগড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। এসব কথা মা, শাশুড়ীকে জানাই। শাশুড়ীর এক কথা,“আমার ছেলে তোমাকে ভালো না বাসলে বুঝি একসাথে ওখানে থাকতো। তুমি একটু বেশিই বোঝো। আসলে অনেকটা সময় একা থাকতে হয় বলে তুমি এমন ভাবছো। এক কাজ করো, একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। বাচ্চাকে সময় দিলে আর একা মনে হবে না। পলাশও ঠিক হয়ে যাবে।”

“বাচ্চা নিয়ে এসে কী করবো?
আমার মতো বাচ্চাটাও তার বাবার অবহেলায় বড় হবে?”
আমার এই কথার জবাবে শাশুড়ী মা আমাকেই দোষ দিলেন। তার কথা তার ছেলে ঠিকই আছে। এই বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডা দিবে এটাই স্বাভাবিক। আমি একটু বেশি ভাবছি। তার কথা, তারা সংসার করেনি। দু’দিনের মেয়ে আমিই সংসার করছি। এই ক’দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছি। আজকালকার মেয়েদের এজন্যই সংসার টিকে না। বেশি বুঝে। আমি তার সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দেই।

মায়ের সঙ্গে সবটা শেয়ার করলে তারও কিছুটা একই কথা। মা বলে,“একটা বাচ্চা নিয়ে নে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“মা এসব ভালো লাগছে না।
ভালো পরামর্শ দাও। পলাশ আমাকে সময় দেয় না, আমার স্পেশাল দিনে আমি তার থেকে সামান্য উইশ অব্দি পাই না। এভাবে সংসার হয়?”

“কেন হয় না?
আমাদের সময় তো উইশ টুইশ ছিলো না। আমরা ছিলাম না। তাছাড়া তোকে তো পলাশ খারাপ রাখছে না। তোর সব দায়িত্ব পালণ করছে। হ্যাঁ শুধু সময়টা কম দেয়। তাই বলে যে সংসার করা যায় না এমন নয়। এভাবেও মানিয়ে নেওয়া যায়। আমি বলছি শোন, তুই একটা বাচ্চা নিয়ে নে। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মায়ের কথা শুনে আমি আরও হতাশ হয়ে পড়লাম। পরক্ষণে নিজেকে সামলে মনেমনে বললাম,“হয়তো সন্তান হলে সত্যি সব ঠিক হয়ে যাবে। পলাশের কাছে আমি যেটা আশা করি সেটা আমি পাবো। সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় অন্তত সে ঘরে থাকবে। তার ছুঁতোয় আমাকে সময় দিলো।”

এটা ভেবে এবার সন্তানের জন্মের কথা ভাবলাম। হ্যাঁ এভাবেই মা হয়ে গেলাম। আমি সন্তানের মা হচ্ছি শুনে পলাশ খুব খুশি হলো। তবে গর্ভাবস্থায় যে যত্নটা তার থেকে প্রয়োজন ছিলো সেটা সে দেয়নি। সন্তানের কথা ভেবেও সে বন্ধুদের ছেড়ে কিছুটা সময় আমাকে দিতে পারলো না। এসব নিয়ে ঝগড়া হলে পলাশের এক কথা,“তুমি এত বেশিও অসুস্থ নও যে তোমাকে এখন বেড রেস্টে রাখা লাগবে। আর সেটা যখন লাগবে তখন করা হবে। সারাক্ষণ যখন তোমার পাশে কাউকে প্রয়োজন পড়বে তখন আমার মাকে আমি ডেকে পাঠাবো। তুমি চিন্তা করো না।”

এভাবেই পলাশ দ্বায় সাড়লো। তাও নিজে পরিবর্তন হলো না। এই ধরনের মানুষ সময়ে পরিবর্তন হয় না। আমিও বুঝে গেলাম। এসবই মেনে নিলাম। এভাবেই সংসার করে গেলাম। বছরের পর বছর এভাবেই কেটে যায়। আজ আমি দুই সন্তানের মা। একজনের বয়স সাত বছর, অন্যজনের ছয় মাস। সন্তান জন্মানোর পরও যখন পলাশের স্বভাব বদলালো না। ঘরে মন টিকলো না। উল্টো বাচ্চা রাতে কান্না করে বলে মন মতো ফোন চালাতে না পেরে পাশের ঘরে চলে যেতো তখনই বুঝেছি এই মানুষটি পরিবর্তন হওয়ার নয়। এর থেকে আমার কিছু আশা করা উচিত নয়। নিজেকে এবার নিজের মতো সময় দেওয়া উচিত। তাই বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এখন বাচ্চাদের নিয়েই সময় কাটে। পলাশের সঙ্গে কথা হয় না খুব একটা।

তবে এখন সময় বদলে গেছে। পলাশও বদলে গেছে। কোন কোন বন্ধু চাকরিসূত্রে দূরে চলে যাওয়া, কেউ বা ঠকিয়ে দিয়েছে সেই জন্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কমে গিয়েছে। এখন রাত করে বাড়ি ফেরে না। তবে হ্যাঁ ফোন চালায়। এখন ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া ছাড়া যে উপায় নাই। কারণ সে যখন এখন আমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাচ্ছে, সে নিজের ভুল বুঝে আমার সঙ্গ চাচ্ছে সেই সময়ে আমি আমার বাচ্চাদের সময় দিচ্ছি। তাকে দেবার মতো এখন আর সময় নেই। একদিন আমি কথা বলতাম সে হুম হুম করতো আজ আমি সেটা করছি। না এসব তার উপর প্রতিশোধ নিতে করছি না। এমনটা হয়ে গেছে। আসলে আমার এই মনটা গত কয়েক বছরে এতবার ভেঙেছে যে এখন মনের কোন ইচ্ছা পলাশকে ঘিরে নেই। পলাশও সেটা বুঝতে পারে। তবে যেদিন প্রথম আমি চুপ হয়ে গিয়েছিলাম, তার সঙ্গে কোন বিষয়ে আর ঝগড়া করছিলাম না সেদিন কিন্তু সে এটা বুঝেনি। যদি বুঝতো তাহলে আমাদের জীবনটা অনেক সুন্দর হতো। বরং সেদিন আমার চুপ করে থাকায় সে শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো। তবে আজ আমার নিরবতায় সে কষ্ট পাচ্ছে। যেই কষ্টটা তার সময়ে পাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সেটা অসময়ে সে পাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে এখন ফোনের সঙ্গে সময় কাটায়। সেই সঙ্গে বাচ্চাদেরও সময় দেয়। বাচ্চারাও বাবার সঙ্গ পেয়ে খুশি হয়। অবুঝ যে। তাদের তো মন ভাঙেনি। তাই খুব সহজে তাদের আপন করে নিতে পেরেছে পলাশ। কিন্তু আমাকে পারেনি। হয়তো পারবেও না। কারণ সে বড্ড অসময়ে আমার কাছে এসেছে। যেই সময়ে আমি আবেগের দোলনায় তার সঙ্গে দুলতে চেয়েছিলাম সেই সময়ে সে আমার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিলো। দুইটি মনের মাঝে বড় দেওয়াল বানিয়ে ফেলেছিলো। আজ এই অসময়ে সেই দেওয়াল যে ভাঙা সম্ভব নয়। হয়তো পলাশ চেষ্টা করলে একটা সময় এই দেওয়াল ভাঙা সম্ভব হতে পারে৷ তবে মনে হয় হবে। সেও হয়তো চেষ্টা করতে করতে আমার মতো হাঁপিয়ে গিয়ে থেমে যাবে। অবশেষে আমাদের দূরত্বময় এই সংসার বহুযুগ ধরে বয়ে চলবে। এমনই হয় প্রায় জায়গায়। আমাদের সঙ্গেও হয়তো এমনটাই হবে।

(সমাপ্ত)