#অস্তরাগের_কলি
#পর্ব_দুই
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
বেলা তিনটা:
সবে মাত্র পেপারটা খুলে বসেছে হৈমপ্রভা সান্যাল। অফিস থেকে ফিরে স্নান সেরে, দুপুরের খাবার খেয়ে সোফায় গা এলিয়েছে। এই সময়টা ওর একান্ত অবসর। পেপারের হেড লাইনে চোখ বুলিয়ে সাড়ে তিনটার সময় বিছানা নেবে, একঘন্টা পরেই উঠে পড়বে। তারপর চলবে বাগানের পরিচর্চা। ওর কাছে বাগানের এক একটা গাছ সন্তান স্নেহে লালিত পালিত হয়। ছাদ বাগানের টবে তাই আমগাছ, সজনে গাছ শোভা পায়। বিদেশি হরেকরকম ফুল তো আছেই। তবে নিচের বাগানে দেখাশোনার জন্য দু জন মালি আছে। সেখানেও বাহারি ফুল ও ফলের গাছের সমাহার। তবে নিজের হাতে লালন-পালন করে বলেই বোধহয় ছাদ বাগানে একটা আত্মিক টান অনুভব করে।
পেপারে একটা হেডিংয়ে চোখ আটকে যায় ওর। “ফুসলিয়ে শিল্পপতির মেয়েকে বিয়ে। তারপর সোনা-গহনা হাতিয়ে স্ত্রীকে খুন করে ফেরার যুবক”
হাতটা কেঁপে উঠল হৈমপ্রভার। দু’ দুবার হেডিংটা পড়লেন উনি। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনটা বেজে দশ মিনিট।
” সুজি এখনো আসছে না কেন, আজ তো টিউশন ছিল। এতক্ষণে তো পড়া শেষ হয়ে ফিরে আসার কথা”
মনে মনে আউড়ালো। মেয়ের দেরি দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল হৈমপভা।
কলিং বেলটা বিশ্রী ভাবে কেউ তিন বার বেজে উঠল। দরজার ওপারের থাকা আগুন্তকের ব্যবহারে অধৈর্য্য প্রকাশ পাচ্ছে।
“এই সময় আবার কে এল, সুজি!”
-আরে বাবা যাচ্ছি। দুপুর বেলা একটু শুতেও পারব না।
চব্বিশ ঘন্টার কাজের ঝি দিপালি দরজা খুলে দিল।
তারপরেই দরজার ওপারের মানুষদের দেখে আঁতকে উঠল ও।
-বৌদিমনি শিগগিরি আসুন..
কান সচেতন ছিল হৈমপ্রভার।
দিপালির চিৎকার, বলা ভালো আর্তনাদে চমকে উঠল।
-একি বুনু তুই কি করলি!?
নিচে বড়মেয়ে সঞ্জুর আর্তনাদ পেল হৈমপ্রভা।
সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে ভেবে ছুটল। বয়েস হচ্ছে চাইলেও দ্রুত চলতে পারে না।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে থমকে গেল।
ভেবেছিল কোনো দূর্ঘটনায় হয়তো মেয়ে রক্তাক্ত হয়ে বাড়ি এসেছে। এই ভাবে কপাল ফাটিয়ে আসবে তা কে জানত!
আর নামতে পারছে না হৈমপ্রভা।
মেয়ের স্পর্ধা দেখে জ্বলে উঠল। শেষমেশ ছেলেটাকে বিয়েই করে ফেলল। সান্যাল বাড়ির মেয়ে হয়ে, ওর মেয়ে হয়ে এইভাবে সিঁথিতে সিঁদুর রাঙালো। ছি!
নাহ, এই পরিস্থিতিতে কোনভাবেই মাথা উতপ্ত করবে না। ঠান্ডা মাথায় একটা সিদ্ধান্তে আসবে। মনোস্থির করল।
-দাঁড়াও..আর ঘরে ঢোকো না।
হৈমপ্রভার গম্ভীর স্বরে পদ যুগল থেমে যায় নবদম্পতির।
নিচে নেমে এসে ওদের সোজাসুজি দাঁড়াল ও। যদিও দুই পক্ষের দূরত্ব কয়েক ফুটের।
-মা এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। তুমি কোনোভাবেই আমাদের সম্পর্ক মানতে না। তাই বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতেই হল।
-তোমার কি মনে হয়, তুমি সঠিক কাজ করেছো?
-একজনকে ভালোবেসে, তাকেই বিয়ে করেছি। এতে কোথাও অন্যায় দেখছি না।
চোখ বন্ধ করে দ্বিতীয় রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করল হৈমপ্রভা।
দেড় বছরের ছেলে ঘুম থেকে উঠে কাঁদছিল বলে ঘরে গিয়েছিল সংযুক্তা। ছেলেকে নিয়ে আবার ফিরে এল।
-ডিডা..
বলে হৈমপ্রভার দিকে হাত বাড়ালো শিশুটা। একবার কোলে নিয়ে, নাতির গালে চুম্বন করে বড় মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-বুবুনকে নিয়ে ঘরে যাও।
ইচ্ছা থাকতেও মায়ের আদেশ পালন করতে উদ্যোগি হল। একবার বোনের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে অভিমুখে গেল সংযুক্তা।
-একজন মায়ের মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে, অনেক আশা থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তোমাকে নিয়েও আমার অনেক আশা ছিল। প্রথম থেকে আমার ইচ্ছে ছিল B.B.A করে তুমি M.B.A করো। তারপর ব্যবসার হাল ধরো। অফিস সামলাও। তুমি ইকোনমিস্ট নিয়ে কলেজে ভর্তি হলে। M.A করলে। তারপরে এখন সরকারি চাকরি পরীক্ষার জন্য টিউশন নিলে। ইচ্ছা না থাকলেও আমি কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত তোমার উপর চাপিয়ে দিই নি। বরঞ্চ সবসময় তোমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছি। মা-বাবারা সর্বদা চায় তার সন্তানের বিবাহ যেন উচ্চ বংশে হয়। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান যেন আমাদের থেকে বিশাল হয় বা সম কক্ষ হয়। আসলে মেয়েকে সুখী দেখতে চায় সব বাবা-মা। আর এটাই এতদিন হয়ে আসছে, এতে দোষের কিছু নেই।
-সুখ-শান্তি কি টাকা দিয়ে মাপা যায় মা? সংসারে কম অর্থ থাকলেও মানুষ সুখে থাকে। যাকে ভালোবেসেছি, তাকেই বিয়ে করেছি। এতেও কোনো দোষের নেই।
বিস্ফোরিতে নয়নে মেয়ের দিকে তাকালো বছর সাতান্নের হৈমপ্রভা সান্যাল।
-মুখে যা চুনকালি মাখানোর ইতিমধ্যেই তা মাখিয়েছো। ক্ষমতার জোরে আমি তোমাদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারি। কিন্তু সেটা করছি না। শুধুমাত্র শেষ সুযোগ দিচ্ছি। তুমি এই ছেলেটার হাত ছেড়ে, পুতুল পতুল বিয়ে ভেঙে আবার সান্যাল ম্যানসনের রাজকুমারী হয়ে যাও। এই ছেলে তোমার উপযুক্ত নয়।
-তোমার কাছে যেটা মিথ্যা বিয়ে, সেটাই আমার কাছে ধ্রুব সত্যি। সেই রকম হলে আমি এই বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবো, তবুও আমি নির্ঝরের হাত ছাড়বো না।
-সৃজি কি বলছো এই সব!
নিন্ম স্বরে বলল নির্ঝর। এই প্রথম একটা বাক্য উচ্চারিত হল ওর মুখ গহ্বর থেকে..
-যেটা সত্যি সেটাই সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। এটাই শিখিয়েছে আমার মা। তাই না মা?
-এই মুখে আর “মা” উচ্চারণ করোনা। চোখের সামনে চলে যাও। কক্ষনো আর এই মুখো হও না। তোমাকে আমি ত্যাগ করলাম। কোনো অবস্থাতে তোমাকে ফিরিয়ে নেব না। দেখবো কতদিন অভাবে তোমার মন টেকে।
-আমিও তোমার শিক্ষায় শিক্ষিত মা। তাই বলছি, জীবনে এই বাড়িতে ফিরবো না। তোমাকেই আমাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ফিরলে আমি জোড়ে ফিরব।
নির্ঝরের হাত ধরে পিছন ফিরল সৃজিতা।
-সৃজি এটা ঠিক হচ্ছে না। ফিরে যাও তুমি।
নির্ঝরের কোনো কথা কর্ণগোচর হচ্ছে না সৃজিতার। ও অগ্রসর হচ্ছে সিংহদুয়ারের অভিমুখে..
-দিপালি দরজা বন্ধ করে দাও।
হুংকার ছাড়লো হৈমপ্রভা সান্যাল।
চলবে:
কেমন লাগলো দ্বিতীয় পর্ব?
কে সঠিক হৈমপ্রভা দেবী না সৃজিতা?
চলবে।