অস্তরাগের কলি পর্ব-১৫+১৬

0
368

#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_পনেরো

-হ‍্যাঁ আমি।
উঠে বসতে উদ‍্যত হল হৈমপ্রভা।
-আরে অস্থির হচ্ছো কেন? বিপি বেড়ে যাবে। তখন তোমার নার্স আমাকে বকাবকি করবে।
তীর্থঙ্করের কথায় মুচকি হাসল নার্স।
ভিতর ভিতর ফুঁসছে হৈমপ্রভা।
-সিস্টার..এটা একটু রেখে দেবেন প্লিজ।
ফুলের তোড়াটা কমবয়েসি নার্সের দিকে এগিয়ে দিল। তারপর বসার অনুমতি চাইল..
আমি কি এখানে বসতে পারি?
-অবশ‍্যই..
টুলটা সঠিক জায়গায় এনে দিল নার্স। ষাট বছরের যুবকের আচরণে মজা পেল সে।
-আপনারা গল্প করুন, আমি একটু আসছি..
-এই তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-যাক না আমি তো আছি…
তীর্থঙ্করের আশ্বাসে হেসে বাইরে গেল নার্স।
নার্স চলে যাওয়াতে অস্বস্তিতে পড়ল হৈমপ্রভা।
-আপনি এসেছেন কেন?
-তোমাকে দেখতে..
-এখন ভিজিটিং আওয়ার্স নয়। কী করে এলেন?
-ক্ষমতা থাকলে সব হয়।
তীর্থঙ্করের মুখ দেখবেনা বলে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিল হৈমপ্রভা।
-তুমি বুড়ি হয়ে গেলে। আমাকে দেখেছ? ত্রিশ বছরের ছেলে আমাকে হিংসা করে। এখনো আমার লেটার বক্সে পাত্রীর বাবা ছবি সমেত বায়োডাটা রেখে যায়। এখনো আমার বিয়ে হবে..
-করতেই পারেন। যাক গে..আমাকে দেখা হয়ে গেছে। আমার অবস্থা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন এবার যান..
-আমি এখানে তোমার প্রতিপক্ষ হয়ে আসিনি। তোমাকে দেখতেই এসেছি।
-কেন এসেছেন? সেটাই জানতে চাইছি..
-জোর গলায় প্রশ্ন করলেই সত‍্যিটাকে ঢাকা দেওয়া যায় না হেম। এবার আমি উঠলাম..
হেঁয়ালি ছেড়ে গম্ভীর গলায় বলল তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত।
-বাঁচলাম..
-ও আর একটা কথা। সৃজিতা সত‍্যিই তোমার নিজের মেয়ে তো? না..মানে ওর সাহস আর ভালোবাসা দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেছি।
-তুমি আমার মেয়েটাকে বিগড়ে দিয়েছ।
হিসহিসিয়ে বলল হৈমপ্রভা।
-ভুল। আমি শুধুমাত্র সুযোগ দিয়েছি। আমি নির্ঝরকে আর একটা তীর্থঙ্কর তৈরি করব। সৃজিতা ছায়ার মতন স্বামীকে আগলে রাখে। ওর ভালোবাসা, স্বার্থত‍্যাগে আরো বড় হবে নির্ঝর।
-আপনি আমার ক্ষতি করার জন‍্য আমার মেয়েকে ব‍্যবহার করছেন। তাই তো শাড়ির আউটলেট খুলেছেন।
-ক্ষতি না.. সান‍্যালদের টপকে যাওয়ার জন‍্য..সম্পত্তি বাড়ানোর জন‍্য..
-ঠিক আছে চলি। সুস্থ থেকো হৈমপ্রভা। সুস্থ না থাকলে আমার সঙ্গে লড়বে কী করে? তুমি চাইবে জীবনে যাতে আমার সাথে দেখা না হয়। আমি চাইব তাড়াতাড়ি আবার যেন আমাদের সাক্ষাৎ হয়। দেখি কার কথা উপরওয়ালা শোনে।
চলে গেল তীর্থঙ্কর। স্থির হয়ে বসে রইল হৈমপ্রভা। এই লোকটা কী এখনো পিছনে লাগা ছাড়বে না?
মনে মনেই উচ্চারণ করল।

***
দুই দিন হল বাড়ি ফিরেছে হৈমপ্রভা। এখনো মাস দুই হাতে বেল্ট পরে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ফিজিওথেরাপি হবে। তারপরে ডাক্তার ফিট বললে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। এখন সব ব‍্যপারে পরের উপর নির্ভরশীল।
এই দুই দিনে পরাধীন পরাধীন অনুভব হচ্ছে। শুয়ে বসে আর কীভাবে দিন কাটাবে? সকলের কাজ আছে, এমনি কি নাতি বুবাইয়েরও টিউশন আছে, স্কুল আছে। শুধু ওর কাজ নেই।
আটান্ন দিন কী ভাবে কাটাবে ভেবেই চলেছে হৈমপ্রভা।

হাত ভাঙার সাথে শোরুমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, অসুবিধাও নেই। কদিন রেস্ট নিয়ে স্টোরে যাবে। অল্প সময় থাকবে তাও যাবে বলে মনোস্থির করল হৈমপ্রভা।
-যতদিন ঘরে আছি বিজনেসটা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা ভাবতে হবে। ঐ লোকটার কাছে হার স্বীকার করতে পারি না। তেমন হলে অন‍্য শহরে ব্লসমের এক ব্রাঞ্চ খুলব।

জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল হৈমপ্রভা। চোখ দুটো গোলাপি দেওয়ালে ধাক্কা খেল। তেরছা চাহুনিতে একটা নীল অপরাজিতাতে চোখের শান্তি হল। আগে এই জানলা দিয়ে একটা বড় পুকুর দেখা যেত। পুকুরের পাড়ে একটা বিশালাকার বট গাছ। কত হাঁস পুকুরে ঘুরে বেড়াত। কত পাখির আশ্রয় স্থল ছিল ঐ গাছ। এখন কোনো কিছুর আর অস্তিত্ব নেই। চারিদিকে শুধু বড় বড় বাড়ি..
পুকুরের হাঁসদের দেখিয়ে দুই মেয়েকে ভাত খাওয়াতো। অতীতের স্মৃতিতে ডুব দিল হৈমপ্রভা।

-মা..
সংযুক্তার ডাকে সম্বিত ফিরল হৈমপ্রভার।
-ও তুই। বুবাই কই?
-এখানে এসে দাপাদাপি করবে তাই আনছি না। ফোন করেছিলাম, ফিজিওথেরাপির লোকটা এক ঘন্টার মধ‍্যে আসবে।

-সমু এখানে বস না কথা আছে..বস বস..
মায়ের ব‍্যস্ততা দেখে মায়ের পাশে এসে বসল সংযুক্তা।
-কী বলবে বলো?
-বলছি সুজিকে একটা ফোন করলে হয় না? ফোন করে একবার আসতে বলতাম। আমি ফোন করলেই ও আসবে। আমাকে দেখতে এসে খুব কাঁদছিল। কতদিন পর দেখলাম। চেহারাটা একটু ফিরেছে। ইস! আমি আবার কেমন মা হয়ে মেয়েকে নজর দিচ্ছি। থু থু নজর যেন না লাগে..
শেষের কথাটা নিন্মস্বরে বলল হৈমপ্রভা।
মায়ের কথায় হতবাক হল সংযুক্তা।
যেই মেয়ে পরিবারে সম্মানের কথা চিন্তা না করে মায়ের মুখ পুড়িয়ে ঘর ছেড়েছিল। তাকে মা মেনে নেবে?
-মা কী বলছ তুমি? বোনকে আসতে বলবে?

চলবে:

#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_ষোলো
-হ‍্যাঁ। অনেক দিন তো হল। এবার ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরুক।
-মা তুমি একজন শোরুমের কর্মচারীকে জামাই হিসাবে মানতে পারবে? আমি ভাবতে পারছি না কী করে তোমার মাথায় এই ভাবনাটা এল। একটা পাতি কর্মচারী সান‍্যালদের জামাই??
-কিন্তু সুজি আমাকে ছেড়ে কষ্টে আছে। আর কতদিন মেয়েটাকে কষ্ট দেব?
-মা তোমার কী স্মৃতি লোপ পেয়েছে? তুমি জানো না বোন কার সাথে ওঠা বসা করে। ওদের অন্নদাতা কে..তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত আমাদের শত্রু। কী ভাবে ভরসা করবে?
সংযুক্তার কথায় প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখাবয়ব চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল। দুই চোখ জ্বলে উঠল হৈমপ্রভার।
-ঠিক বলেছিস, আর কদিন যাক। তারপর ভেবে দেখব।
-হু..
আর কোনো কথা না বলে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুংযুক্তা। দপ দপ পা ফেলে নিজের ঘরে ঢুকল। আজ সান‍্যাল ম‍্যানসনেই আছে বড় জামাই শিবম। স্ত্রীর থমথম মুখাবয়ব ওর কৌতূহল বাড়াল।
-কী হয়েছে?
-মা বোনকে এবার ঘরে ঢোকাবে।
রাগে ফুঁসছে সুংযুক্তা।
-তোমার মায়ের সব তেজ ফুস হয়ে গেল?
অতিরিক্ত ক্রোধে অন্ধ সুংযুক্তা শিবমের খোঁচাটা বুঝতে পারল না।
-হসপিটালে দেখতে গিয়েছিল তাতেই গলে গিয়েছে।
-সংযুক্তা তোমার মায়ের ইচ্ছাটাকে দমন কর। সান‍্যাল বংশের একমাত্র উত্তরসূরী আমার ছেলেই হবে।
এই আমরা তাহলে বুবলাইকে প্লে স্কুলে দিয়ে দিই?
-পাগল নাকি, ছেলের সবে দুই বছর দুই মাস। এখন থেকে স্কুলে দেবে? বিদ‍্যাসাগরের প্রপৌত্র বানানোর কোনো ইচ্ছে নেই। আমার ছেলে হবে দ‍্যা গ্রেট সৃজন দত্ত।
-হাতি হবে। তোমার সবসময় ফাজলামি করা স্বভাব। তুমি অফিসে চলে যাও। এই ছেলেকে নিয়ে আমার সারাদিন যে কিভাবে কাটে তা যদি বুঝতে..
-ছেলেরা একটু চঞ্চল হবে। এই সত‍্যি বলো যখন বুবলাই ঘুমায় তখন ফাঁকা ফাঁকা লাগে না?
রুটি চিবাতে চিবাতে বলল নির্ঝর। ঠিক তখুনি বুবলাই নির্ঝরের পিঠে ঝাপিয়ে পড়ল। ওর পুরো মুখ লাল রঙের প্রলেপ।
-এই তুই কি মেখেছিস? আমার লিপস্টিক?
ছুটে পাশের ঘরে গেল সৃজিতা।
-তুই আমার দামী লিপস্টিকটা নষ্ট করেছিস? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
ভয়ংকর কিছু দোষ করছে বুঝছে পেরে ছোট্ট বুবলাই তখন ওর বাবার কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
-ঠিক আছে ও আর এমনি করবে না। এই বুবলাই তুমি আর মায়ের সাজগোজের জিনিস ছোবে না। কেমন!তুমিও বা ওর হাতের নাগালে রাখো কেন? সব দোষ তোমার..
-তুমি তো এখন বলবেই। ছেলের দোষ তো তুমি দেখতে পাও না। দেখেছো ঐ কারণে আমি ওকে স্কুলে দিতে চাই। অবশ্য স্কুলে গিয়েও যে বাচ্চাদের মারবে না, সেই গ‍্যারিন্টিও নেই।
-নিজেই প্রশ্ন করছে, নিজেই উত্তর দিচ্ছে।
-এই ছেলে আমাকে একটুও শান্তি দেয় না।
-তখন তো আয়া রাখতে বলেছিলাম। সেই সময় আয়া রাখলে ছেলে ও তোমার দুজনের দুজনকে ছেড়ে থাকার অভ‍্যাস হয়ে যেত। আর তুমিও স‍্যারের বিজনেসে জয়েন করতে পারতে।
-বাপরে ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো? তাছাড়া বিজনেস আমার জন‍্য নয়। এই নিয়ে আমাকে জোর কোরো না।
ঐ নিয়ে কথা বাড়ালো না নির্ঝর।
-বেটা যাও মায়ের কাছে যাও। এবার আমার দেরী হয়ে যাবে।
ছেলের দিকে হাত বাড়ালো সৃজিতা।
মায়ের কোলে না এসে বাবার শরীরে লেপ্টে থাকল বুবলাই।
-এসো আমার কাছে এসো। আমি বকবো না।
-আমি ওপিট যাব। তোমাল সাতে যাব।
গোমড়া মুখে বলল বুবলাই।
-হ‍্যাঁ যাবে তো। আমি গাড়িটাকে ঠিক করিয়ে আনি তারপর যাব।
ছেলেকে সৃজিতার কোলে দিল নির্ঝর।
কাঁদতে শুরু করল বুবলাই।
-সোনা, বাবা এখুনি চলে আসবে। তারপর আমরা ঘুরতে যাবো।
-নাআ আ..
চিৎকার করে কাঁদছে বুবলাই।
-এই সাতদিন ছুটি নিয়ে চলো না কোথাও ঘুরে আসি। এই একঘেঁয়ে জীবন আর ভালো লাগছে না। বুবলাইও একটু বড় হয়েছে। আমরা তো কখনো কোথাও ঘুরতে যাই নি। এই যাবে গো?
নির্ঝর স্ত্রীর অভিমুখে তাকালো। অনেক আশা নিয়ে কথা গুলো বলেছে সৃজিতা। সাড়ে তিনবছরের বিবাহিত জীবনে পরিবারে সঙ্গে টানা ছুটি কখনো কাটায়নি ও। ঘুরতে যাওয়া বলতে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, সিনেমা দেখা। ছেলের দৌরাত্ম্যে এখন সেই সবে দাঁড়ি পড়েছে। ওর কাছে এখন টাকা আছে, নেই শুধু সময়। প্রথম থেকে সৃজিতা সবটাই মেনে নিয়েছে। আজ কেবল মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
-হাঁ করে কি দেখছো। বলো না যাবে?
-দেখছি..
-আবার দেখছি বলে..
-এখুনি কথা দিতে পারছি না সুজি।
মুখ ভার হল সৃজিতার। প্রথমবার নির্ঝরের কাছে কিছু চেয়ে নিরাশ হল।
চলবে: