#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_পঁচিশ
মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল বুবলাই। সৃজিতার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলে বলল,
-তি হয়েছে?
অন্যসময় হলে ছেলেকে আদরে ভরিয়ে দিত সৃজিতা। আজ ছেলের দিকে তাকানোর সময় নেই। কোল থেকে ছেলের মাথা নামিয়ে সিটে রেখে দিল। সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারের পাশে মুখ নিয়ে তাগাদা দিল,
-রুকিয়ে রুকিয়ে..
সৃজিতার পাগলামি দেখে বিরক্ত হল নির্ঝর।
-সৃজি কী হচ্ছে? দাঁড়াও সঠিক জায়গা দেখে থামবে।
সৃজিতার অস্থিরতায় ঘাবড়ে গেল ড্রাইভার। সৃজিতার দিকে তাকিয়ে বাঁক ঘোরানোর সময় একেবারে রাস্তার কিনারায় গাড়ির চাকা অবস্থান করল।তারপরেই গভীর খাদ। সমূহ বিপদ অনুমান করে গাড়ি ঘোরাল ড্রাইভার। টাল সামলাতে না পেরে সাইডে থাকা বড় পাথরে ধাক্কা মারল। মূহুর্তের মধ্যে ঘটে গেল এই বিশাল দুর্ঘটনা।
ধাক্কার ফলে সামনের কাঁচ ভেঙে টুকরো গুলো ভিতরে প্রবেশ করলো। মাথায় সজোরে আঘাত পেল ড্রাইভার ছেলেটা। সাথে সাথেই জ্ঞান হারাল। অর্ধেক দন্ডায়মান অবস্থায় ছিল সৃজিতা। ও ছিটকে গাড়ির সামনে পড়ল। ভঙ্গুর কাঁচে মুখাবয়ব আঘাতপ্রাপ্ত হল। সিটে শুয়েছিল বুবলাই। প্রবল আঘাতে সিট থেকে নিচে পড়ল সেই অবোধ শিশু। ড্রাইভারের সিটে সজোরে ধাক্কায় কপাল -মাথা ফেটে গেল নির্ঝরের। ঝরঝর করে বইছে রক্তের ধারা।
বুবলাইয়ের কান্না তখন আর্তনাদে দাঁড়িয়েছে।
সৃজিতার দিক থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিল না নির্ঝর। সাহায্যের জন্য দরজা খুলে বেরনোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। কষ্ট করে ছেলেকে তুলতেই ওর রক্তাক্ত মুখ দেখে শিউরে উঠল। সামনের দুই খানি দাঁত ভেঙে গেছে। কেঁদেই চলেছে বুবলাই। কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছে। চাইলেও ছেলেকে আগলে রাখতে পারছে না। অস্ফুট স্বরে কি যেন বলছে সৃজিতা।
“আমরা বোধহয় মরেই যাব”
বলেই চোখ বন্ধ করল।
দুইচোখ থেকে জলের ধারা পড়ছে নির্ঝরের।দাঁতে দাঁত চেপে কষ্টটা সহ্য করতে থাকল। অত্যাধিক ব্যথার প্রভাবে শরীর ঝিমঝিম করছে। চোখের সামনে নেমে এল নিকষ অন্ধকার।
। ততক্ষণে আকাশে পুনরায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির তীব্রতায় উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি ওদের অবস্থা বুঝতেও পারল না। এইভাবে আরো পাঁচ মিনিট কাটল।
উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির সজাগ ড্রাইভার ওদের দুর্ঘটনাগ্রস্থ গাড়িটা দেখে থামল। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার ও ট্যুরিস্টরা ছুটে এল। ওদের পিছনে আসা গাড়িটাও থামলো।
বাইরের হাওয়াতে দাঁড়িয়ে ছিল হৈমপ্রভা। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই উঠে বসল গাড়িতে। গাড়ি আবার আগের মতন চলতে শুরু করল। কিছুদূর এগোতেই পাহাড়ি বাঁকে জটলা দেখে ওদের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নামল। কৌতূহল বশত এগিয়ে গেল। তারপরেই নজরে এল দূর্ঘটনাগ্রস্থ গাড়িটা।
-বাপরে এক্সিডেন্ট!
গাড়ি থেকে নামল হৈমপ্রভার বড় জামাই। ড্রাইভারের পিছন পিছন ঘটনাস্থলে এগিয়ে গেল শিবম।
-ছেলেটার এখনো জ্ঞান আছে।
-ড্রাইভারটাকে দেখ।
-আহা বাচ্চাটা…
-মেয়েটা বোধহয় শেষ!
সমবেত স্বরে সবাই কথা বলছে।
-কী হয়েছে রে?
পিছনের সিটে গায়ে এলিয়ে বসেছিল হৈমপ্রভা। গাড়ির থামানোতে প্রথম অবাক হলেও পরে বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে।ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞাসা করল হৈমপ্রভা সান্যাল। শরীরটা ঠিক সঙ্গ দিচ্ছে না। হোটেলে গিয়ে শুতে পারলে যেন বেঁচে যায়। তারপর রাস্তায় বাধা..
-এক্সিডেন্ট মনে হয়।
-হ্যাঁ রে খুব বেশি লাগেনি তো?
এক্সিডেন্টের খবরে উতলা হয়ে উঠল হৈমপ্রভা। কপালে দুই হাত ঠেকিয়ে মা দুর্গাকে স্মরণ করল। মা সকলকে রক্ষা করো।
-বুঝতে পারছি না। দাঁড়াও নেমে দেখি।
-বৃষ্টি পড়ছে তো..
-একবার দেখে আসি।
গাড়ি থেকে নামতেই সংযুক্তা শিবমকে থমথমে মুখে ছুটে আসতে দেখল।
-কী হয়েছে? কী হয়েছে?
মুখে কিছু না বলে শিবম গাড়ির কাছে টেনে নিয়ে গেল।
গাড়ির কাঁচ ভেঙে খুব সাবধানে বের করা হচ্ছে ওদের চারজনকে..
কাঁচের টুকরোর কারণে ক্ষতবিক্ষত সৃজিতার মুখাবয়ব। তবুও আপন সহোদরা ঠিক চিনে নিল।
-এটা তো বোন!!
-আপ ইসে পেহেচ্যানতে হো..
-আপনার বোন? আপনারা কী একসঙ্গে এসেছেন?
ট্যুরিস্ট ও ড্রাইভার সমবেত প্রশ্ন করল। কাউকে উত্তর দেওয়ার মতন অবস্থায় নেই। ধপ করে বসে পড়ল সংযুক্তা। নির্ঝরের সামান্য আঙুল নড়লেও স্থির হয়ে আছে সৃজিতা। ড্রাইভার ছেলেটিকে মৃত বলেই মনে হচ্ছে। বুবলাইকে একজন কোলে নিয়েছে। বৃষ্টির ফোঁটায় তিরতির করে কাঁপছে একরত্তি। কাঁদার বা কথা বলার সব শক্তি হারিয়েছে।
-হসপিটাল লে জানা হোগা..
-মিলিটারি ক্যাম্প আছে একটু দূরেও..ওখানে কেউ খবর দাও। ওদের হসপিটালে নিয়ে যাক।
দুই দিক আসা প্রায় দশ বারোটা গাড়ি তখন লাইন দিয়ে থেমেছে। কৌতুহল হচ্ছে হৈমপ্রভার।
-ও দিনদিন দেখো মনে হচ্ছে মা কাঁদছে..
গাড়ির ভিতর ছটফট করছিল বুবাই।
দরজা থেকে উঁকি মেরে অদূরের দৃশ্য দেখে দিদাকে খবর দিল।
বুকটা ঝড়াস করে উঠল হৈমপ্রভার।
-তাহলে কি কোনো চেনা মানুষ!
আর গাড়িতে বসে থাকতে পারল না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সামনে এগতে থাকল..
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_ছাব্বিশ
মনে অদম্য জোর রেখে পায়ে পায়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেল হৈমপ্রভা। মৃতপ্রায় দেহ গুলো থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটায় চারিদিকে লাল তরল গড়িয়ে পড়ছে।
-এখানে কী হয়েছে?
মাকে দেখে শব্দ করে কেঁদে উঠল সংযুক্তা।
-এই সমু কাঁদছিস কেন? ওগুলো কে?
মৃতপ্রায় দেহ গুলোর অভিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল হৈমপ্রভা। কত বড় নিষ্ঠুর সত্য অপেক্ষা করেছে তা তখনো কল্পনা করতে পরেনি হৈমপ্রভা।
-মা ওটা বোন গো..
-সুজি..
-মা গো সব শেষ।
-কী বলছিস সব শেষ কেন হবে??
সৃজিতার দিকে এগিয়ে গেল হৈমপ্রভা। যেতে আর পারল কই! তার আগেই পদযুগল স্থির হল। ক্ষত বিক্ষত মুখাবয়ব দেখে নিজের আত্মজা বলে মনে হলেও মস্তিষ্ক সায় দিল না।
-না না এটা সুজি নয়..অন্য কেউ হবে তুই ভুল করছিস।
হৈমপ্রভাকে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল সংযুক্তা।
-তাকাও ভালো করে। ওটা বোন।
হৈমপ্রভার মন মানছে না। বিদেশ বিভূঁইয়ের ছোট মেয়ের সাথে এইভাবে সাক্ষাৎ হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। চিৎকার করে কাঁদতে পারে না হৈমপ্রভা। ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ও। মাথা ঘুরছে, শরীর টলমল করছে। তবুও আশা রাখছে হৈমপ্রভা। মেয়ে সুস্থ হবে। শুধু মেয়ে নয়। বাকি তিনজনের মঙ্গল কামনা করছে হৈমপ্রভা। বড় মেয়েকে সামলাতে নিজেও বলল,
-ওরা ঠিক হয়ে যাবে। দেখিস ওরা ঠিক হয়ে যাবে।
মায়ের আশ্বাস শুনে সামান্য শান্ত হল সংযুক্তা। ছুটে গিয়ে বুবলাইকে কোলে নিল। ভয়ে কেঁদে উঠল বুবলাই। ওর মুখাবয়বের রক্ত তখন বন্ধ হয়েছে। বোতলের জল হাতে নিয়ে বুবলাইয়ের মুখ ধুয়ে দিল সংযুক্তা।
ততক্ষণে মিলিটারি ট্রাক চলে এল। বিভৎস দৃশ্য দেখে সেনাদের চোখ কপালে উঠল। দ্রুততার সাথে সবাইকে তুলে নিল ট্রাকে। শিবম সাথে গেল। চিকিৎসার যেন ত্রুটি না থাকে, প্রয়োজনে আজকেই কোলকাতা ফিরে যাব ওদের নিয়ে..জামাইকে নির্দেশ দিল হৈমপ্রভা। চিকিৎসার জন্য বুবলাইকেও পাঠানো হল। হৈমপ্রভা সংযুক্তাকে ট্রাকে যেতে বলছিল। মা-ছেলেকে ছেড়ে যেতে রাজি হল না ও। ওদের গাড়ির ড্রাইভার আবার হোটেলের উদ্দেশ্য গাড়ি চালাতে শুরু করল।
সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে হৈমপ্রভা। অন্তরে তোলপাড় চলছে। সব দেবতার কাছে মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা করছে। মানত করছে। মাঝেমাঝেই ফোপাচ্ছে সংযুক্তা। চোখের সামনে ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ঘাবড়ে গেছে বুবাই।
-মা ছোট বাচ্চাটা কি আমার ভাই?
সাহস করে প্রশ্ন করল বুবাই। ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল সংযুক্তা।
হোটেলে পৌঁছাল হৈমপ্রভারা। রাস্তার ধারের বেলকনিতে শ্যোন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসেছিল তীর্থঙ্কর। হৈমপ্রভাকে দেখে নিশ্চিত হল। ওদিকে সৃজিতারা তখনো হোটেলে ঢোকেনি শুনল। তাহলে নিশ্চয় দেখা হয়নি! তবুও ধন্দ্বে থাকল তীর্থঙ্কর।
মিলিটারি হসপিটালে ড্রাইভার ছেলেটিকে মৃত ঘোষণা করল। সৃজিতার অবস্থা অতি আশঙ্কাজনক। নির্ঝরের শরীর থেকে অনেক রক্ত নির্গত হয়েছে। ডাক্তার জবাব দিয়েছে। হৈমপ্রভা সিদ্ধান্ত নিল এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে ওদের কোলকাতায় নিয়ে যাবে।
হোটেলে চেক আউট করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরল ওরা। পাশের হোটেলে থেকেও কিছুই জানতে পারল না তীর্থঙ্কর। আবারো তিন ঘন্টা পথ অতিক্রম করে সৃজিতা ও নির্ঝরের মৃতপ্রায় দেহ এয়ারপোর্টে এল। ডাক্তার নার্স ছাড়াও হৈমপ্রভা সেই এ্যাম্বুলেন্সে থাকল। মেয়েকে এক মুহুর্তের জন্য কাছছাড়া করতে চাইছে না হৈমপ্রভা। পায়ের কাছে বসে নিশব্দে চোখের জল ফেলছে। ভিতর ভিতর ভেঙে পড়ছে হৈমপ্রভা। মন কু ডেকেই চলেছে..
-মা রে একবার চোখ তুলে তাকা। তোর মা তোর কাছে এসেছে রে..এইভাবে কেউ অভিমান করে থাকে? তুই ঠিক হয়ে যা..জামাই সুস্থ হলেই বরণ করে ঘরে তুলব। সেই সুযোগটা আমাকে দে মা। এসে বল না তোর নিজের নির্বাচন করা ছেলে কতটা খাঁটি..আমাকে ভুল প্রমাণ করতে একবার তাকা..সত্যি বলছি মনে কোনো ক্ষেদ রাখব না। স্ট্যাটাস নিয়ে কখনো খোটা দেব না। শুধু ফিরে আয় তুই..
নিশব্দে রোদন করছে হৈমপ্রভা।
সন্ধ্যা অব্দি কারুর ঠিকঠাক খবর না পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল তীর্থঙ্কর। তারপরেই পেল এই ভয়ংকর খবর। সারারাত দুশ্চিন্তায় থেকে ভোর রাতেই হোটেল থেকে বেরল তীর্থঙ্কর। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। হৃদয় ব্যাঙ্গ করে বলছে, মা-মেয়ে চির বিচ্ছেদ হতে চলেছে। এবার শান্তি পেলি তো?
দুই ঠোঁট চেপে রাখল তীর্থঙ্কর। মনে মনে উচ্চারণ করল,
-হে ঈশ্বর ওদের সুস্থ করে দাও। আমি নিজে মধ্যস্থতা হয়ে সান্যাল ম্যানসনে নিয়ে যাব। মা মেয়ের মিলন করাব।
নাহ, সেই সুযোগ আর কেউ পেল না। না হৈমপ্রভা না তীর্থঙ্কর। যত সময় পেরচ্ছিল তত সৃজিতার অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। হসপিটালে ঢোকানোর আগেই শরীর ঠান্ডা হল। ডাক্তার-নার্স ব্যস্ত হয়ে উঠল। পায়ের তলা ঘষতে থাকল হৈমপ্রভা। একবার চোখ খুলে মায়ের অভিমুখে তাকিয়ে প্রাণ বায়ু স্তব্দ হল সৃজিতার।
চলবে: