অস্তরাগের কলি পর্ব-২৭+২৮

0
386

#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_সাতাশ

রইলো পড়ে সাজানো সংসার। রইলো পড়ে সাধের গোপাল, চোখের দেখা হাজারো স্বপ্ন। সব ছেড়ে পরলোকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সৃজিতা। মায়ের হাহাকার দেখে মুচকি হাসছে..যেন ব‍্যাঙ্গ করে বলছে, পারলে না তো আমাকে ধরে রাখতে।
সেদিন আমাকে বাড়ি যেতে বললে না, দেখো আমি আর বাড়িই গেলাম না। পারলে না..তুমি পারলে না। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে না। চোখের সামনে মেয়ের মৃত‍্যু দেখে জ্ঞান হারালো হৈমপ্রভা। নার্সিংহোমে পৌঁছে নির্ঝরের চিকিৎসা শুরু হল। সেখানে আগে থেকে পৌঁছে গেছে তীর্থঙ্কর। ততক্ষণে সৃজিতার মৃত‍্যুর কথা চাওর হয়েছে। চেতনাহীন অসুস্থ হৈমপ্রভাকে প্রাথমিক চিকিৎসা জন‍‍্য একজন ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল।
তীর্থঙ্করের মুখাবয়ব সাদা কাগজের মতন ফ‍্যাকাশে। ডাক্তারকে বারবার অনুনয় বিনিনয় করছে, ওর একটা বাচ্চা আছে। ওর জন‍্য ওকে বাঁচিয়ে দিন।
যাকে চিরদিন অবজ্ঞা করেছে, যার মুখ দেখতে চাই নি। যাকে চেনেই না..
হৈমপ্রভা সেই নির্ঝরের জন‍্য প্রার্থনা করছে। প্রার্থনার পাল্লা হেরে গেল ভালোবাসার পাল্লার কাছে…নির্ঝর সারাজীবন সৃজিতাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। সেই ভালোবাসার কোনো ছলনা, শঠতা ছিলনা..হয়ত সৃজিতার
ক্ষতবিক্ষত পরিস্থিতি দেখে বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে গিয়েছিল। নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতেই মৃত‍্যু বরণ করল নির্ঝর। সৃজিতার সাথে মৃত‍্যুর পার্থক্য মাত্র ছয় ঘন্টার। এই ছয়ঘন্টার মধ‍্যেই অনাথ তকমা পেল বছর দুইয়ের শিশু। পরিচিত মুখ বলতে আর কেউ থাকল না। একনাগাড়ে কেঁদেই চলছে বুবলাই..
উচ্চতার শিখর থেকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে হৈমপ্রভাকে নিচে ফেলেছে। নাহ সে মানুষ নয়, সে বিবেক। ব্লসম ও সোনা ফ‍্যাক্টারীর প্রধান, সান‍্যাল ম‍্যানসনের কর্ত্রী দ‍্যা গ্রেট হৈমপ্রভা সান‍্যাল আজ জনাসমাগমে চোখের জল ফেলছে। কোটি কোটি টাকাতেও আপন আত্মজা হারানোর যন্ত্রণা লাঘব হয়না। আজ সৃজিতার মৃত‍্যু চোখে আঙুল দিয়ে এই সত‍্য দর্শন করালো। প্রতিপত্তি, দম্ভ, অহংকার..এগুলো এক একটি শব্দ মাত্র। ঈশ্বরের শাস্তির কাছে এগুলো নস‍্যি।
তীর্থঙ্করও অসুস্থ বোধ করছে। এক ধাক্কায় বয়স অনেকটা বেড়ে গেছে। একটা চেয়ারে বসে আছে তীর্থঙ্কর। চলার শক্তি যেন হারিয়েছে। নিজের স্বার্থে নির্ঝর-সৃজিতাকে ব‍্যবহার করেছিল ঠিকই পরে পরে আপনজনের মতন ভালোবেসেছিল। হৈমপ্রভাকে জব্দ করতে সৃজিতাই ছিল তুরুপের তাস। আজীবন বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় দগ্ধ করতে চেয়েছিল হৈমপ্রভাকে..কিন্তু এই রকম বিচ্ছেদ চাই নি।

তবে কথা রেখেছে সৃজিতা। জোর গলায় বলেছিল আমি আবার এই বাড়িতে ফিরলে জোড়েই ফিরব নাহলে ফিরব না। একসঙ্গেই দুজনের শবদেহ ঢুকল সান‍্যাল ম‍্যানসনে। মৃত‍্যু নামক অস্ত্র প্রয়োগ করে মাকে হারিয়ে দিল মেয়ে..
সাদা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল দুজনের শরীর। তীর্থঙ্করও পৌঁছাল সেখানে.. লোকে লোকে লোকারণ‍্য..দুই প্রতিপক্ষের চোখাচোখি হল। দুজনের চোখে কষ্ট। ক্ষতবিক্ষত মা-বাবাকে চিনতেই পারলনা বুবলাই। চিৎকার করে কাঁদতে থাকল। দিপালী কোলে করে অন‍্যত্র নিয়ে গেল। একমাত্র সন্তানকে পৃথিবীতে রেখে পঞ্চভূতে বিলীন হল নির্ঝর-সৃজিতার শরীর।
***
সাতদিন পর:

-মা তুমি কী ভাবছ?
-কী ব‍্যপারে?
প্রায় বারোদিন পর হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছে হৈমপ্রভা। এখন আর লাভ-ক্ষতির হিসেব করতে ওর মন চাই না।মাথা নিচু করে বলল মেয়েকে প্রশ্ন করল।
-বুবলাইকে কী করবে?
-কী করব মানে..
-মানে কোন বোডিংয়ে রাখবে ওকে। দেখো আমি এখন আছি। সর্বক্ষণ তো এখানে থাকব না। আমার শ্বশুরবাড়ি আছে, সংসার আছে। বুবাইয়ের স্কুল আছে। তুমি সর্বক্ষণ ঘরে থাকো না। কী ভাবে মানুষ হবে ও?

-সমু ও সবে দুই বছর দু মাস। ওকে কোথায় রাখব?
-তোমার বয়েস হচ্ছে। তুমি ওর ঝুক্কি সামলাতে পারবে? বাপরে! কী ডানপিটে..আগে ভাবতাম বুবাই চঞ্চল। এখন দেখছি এ ছেলে আরো দু কাঠি উপরে..
-তুমি অত ভেবো না। শ্বশুরবাড়ির জন‍্য মন আনচান করলে চলে যেতে পারো। বুবলাইয়ের জন‍্য আমি তো আছি। তোমাদের যেমন মানুষ করেছে ওকেও করব।

মায়ের কথায় জ্বলে উঠল সংযুক্তা। আজ আর ভয় পেল না। বলেই দিল..
-মা আমি তোমার ভালোর জন‍্যই বলছিলাম। আমি চাইলে আরো আগেই চলে যেতে পারতাম। তোমাকে একা করে যাব না বলেই আছি। বয়েস হচ্ছে কথার ধার এবার কমাও। নাহলে প্রিয়জনরা একে একে সরে যাবে। একজন তো প‍ৃথিবী ছেড়েই চলে গেল।

চোখ ফেটে জল এল হৈমপ্রভার। সৃজিতার মৃত‍্যুর জন‍্য আবার নিজেকে দায়ী মনে হল। নিজের কষ্ট প্রকাশ করল না মেয়ের কাছে..এক রাশ ডলা পাকানো কষ্ট গিলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
-বুবলাই কে নিয়ে তুই কী ভাবছিস?
উৎসাহ পেল সংযুক্তা।
-বুবলাইকে কাউকে দিয়ে দাও। ওর উপুযুক্ত ভরণপোষণেরর জন‍্য টাকাও দাও। দেখবে ভালো হবে। বাচ্চার ঝামেলা কে নেবে বল?
মাআআ দাবো..বাবাআ..
পাশের ঘরে বুবলাইয়ের কান্নার রোল উঠল।
চলবে:

#অস্তরাগের_কলি
#পর্ব_আটাশ

-ঐ দেখো আবার কাঁদছে..মা-বাবার জন‍্য কতদিন কাঁদবে কি জানি? কোলেও আসতে চায় না। নিতে গেলেও কামড়াতে যায়। এমন দস‍্যি..
-দিপালী ওকে মিষ্টুর কাছে নিয়ে যাও। মিষ্টুকে ছোলা দাও।
গলা চড়াল হৈমপ্রভা।
-ছোলা দেওয়া হয়ে গেছে।
-আবার দাও..ওকে ভোলাও। তারপর আমি যাচ্ছি।
অনেক দিন পর কাজ নিয়ে বসেছিল হৈমপ্রভা। বড়মেয়ে, তারপর পাশের ঘরের চিৎকারে কাজে বিঘ্ন ঘটল। একটু বিরক্তই হল..তবে অধিক বিরক্ত এল বড় মেয়ের কথায়।
-দিপালী মাসি রান্নার লোক থেকে ছেলে ধরার লোক হয়ে গেছে।
শব্দ করে হাসল সংযুক্তা। বর্তমান মানসিক অবস্থায় এই হাসি দগ্ধের ক্ষতের বাড়িয়ে দিল। হতাশ হল হৈমপ্রভা।
-বল না কী বলতে এসেছিলিস?
-বল্লাম তো..তুমি কী ভাবছো বল? তেমন একজনকে বা একটা পরিবারকে খুঁজতে হবে।এখানে কে বুবলাইয়ের দায়িত্ব নেবে? শ্বশুর কুলে বোনের কেউ তো নেই। থাকলে এই অসহায় বাচ্চাটা আশ্রয় পেত।
কঠিন মুখে আপন আত্মজার অভিমুখে তাকাল হৈমপ্রভা। সাতদিন আগে যার বোন মারা গেছে, যাকে ঘিরে এত প্রস্তাব সেও সংযুক্তার আপন বোনপো। কী ভাবে এমন কথা মুখে আনতে পারে? মুখ ঝামটার ভয়ে মুখে কিছু বলল না। তবে ভিতরে ভেঙে পড়ছে হৈমপ্রভা।
-তোর প্রস্তাব আমি ভেবে দেখব। এখন তুই যা..আমি কাজ করি।
প্রস্তাবে মায়ের সামান‍্যতম হলেও সমর্থন আছে ভেবে খুশি হল সংযুক্তা। বাইরে যেতে যেতে বলল,
-কই দিপালী দি..বুবলাইকে আমার কাছে দাও।

আবার খাতাতে মুখ গুঁজলো হৈমপ্রভা। অস্থির মন সহজেই মস্তিষ্ককে কাবু করে ফেলছে। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে। খাতা বন্ধ করল হৈমপ্রভা। দেওয়ালের দিকে দৃষ্টি যেতেই স্তব্দ হল। এখন স্বামী না, স্বামীর পাশের প্রতিবিম্ব বেশি কষ্ট দেয়। কাঁদায়..
**
-কঠিন ছেলে তো! এতটা লেগেছে। রক্ত পড়ছে বলবে না?
রুকুর কথায় চুপ করে থাকল তিনু।
-চলো তোমাকে রাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
-আমাকে নিয়ে মাতামাতি করতে হবে না। তোকে আগে ঘরে দে আসি। চাপ..
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল তিনু। অবাক হল চতুর্দশীর কিশোরী। এতটা ব‍্যথাতেও কী ভাবে সেই কিশোর নিশ্চুপ আছে।
কিছুক্ষণের মধ‍্যে ঘরে পৌঁছাল রুকু। অধিকাংশ মানুষ যাত্রা দেখছে গেছে, কেউ কেউ আছে ঘরে। ওদেরকে কেউ দেখেনি। ঘরেও তিনুর নাম উল্লেখ করল না রুকু। সেই সাথে গোপন রাখল ক্ষত।
একটা কৃতজ্ঞতা জমা থাকল সেই কিশোরের জন‍্য..
যতই হোক বিপদের সময় ত্রাণ কর্তা হয়ে সেই ছেলেই ছিল। তারপরে প্রায় দেখা হতে থাকল সেই কিশোরের সাথে..ছল করে যেনতেন প্রকারেন রুকুও তার সাথে সাক্ষাৎ করত। তিনুও রুকুর উপলব্ধি না বুঝে মনের কথা অব‍্যক্তই রেখেছিল। এইভাবে আরো দু বছর কাটল। রুকু তখন ষোড়শী। তিনুর কলেজে পড়া প্রায় শেষ। চাকরির জন‍্য নানান জায়গায় আবেদন করছে। সাদামাটা রেজাল্টের জন‍্য সিঁকে ছিড়ছে না। ম‍্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ঘরে ফিরছিল রুকু। হঠাৎ বৃষ্টিতে সঙ্গছাড়া হয়ে পড়ল। একটা বন্ধ দোকানের চাতালে আশ্রয় নিয়েছিল রুকু। প্রায় ভিজে গেছে ও। বাইরে তাকিয়ে যখন বৃষ্টির তীব্রতা দেখছিল তখন সেখানে ভেজা কাক হয়ে প্রবেশ করল তিনু। দুজন দুজনকে দেখে চমকে উঠল। এইভাবে পছন্দের মানুষের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ হবে ভাবেনি উভয়ই।
ওখানে উপস্থিতির কারণ উভয়ে একে অন‍্যের থেকে জানল। তারপরে একরাশ নীরবতা। একদৃষ্টিতে বৃষ্টির অভিমুখে তাকিয়ে থাকলেও, রুকু মন থেকে চাইছে তিনু ওকে পর্যবেক্ষণ করুক। আড়চোখে সেটাই করছে তিনু। হঠাৎ থেমে গেল বৃষ্টি। আকাশের একপাশে কালো মেঘ থাকতেও পশ্চিম আকাশ দেখা গেল লালচে আভা।
-চা খাবি রুকু?
গোল্লা পাকিয়ে তাকাল রুকু।
-বাড়ির এত কাছে..কেউ যদি দেখে?
-কেউ ভ‍্যালবে না। তুই আয়।
জড়তা নিয়ে চায়ের দোকানে গেল রুকু। দুই ভাড় চা এনে এক ভাড় রুকুর হাতে দিল। স্মিত হেসে গরম চায়ে চুমুক দিল রুকু। মুগ্ধ হয়ে দেখল তিনু। পশ্চিম আকাশ তখন রক্তাভ।
-কী সুন্দর আকাশটা..
-আমারো গেদে ভালো লাগে..
এক মুহূর্ত দেরি করল না। মনের কথা মুখে আনল তিনু..
-জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার সাথে এমন আস্তরাগ দেখবি??
***
তিন দিন পর:
সন্ধ‍্যা সাতটা:
নিচের ড্রয়িং রুমে গাড়ি চালাচ্ছে বুবলাই। মুখ থেকে থুথু বের করে অদ্ভুত আওয়াজ করছে।
-দিমা দেখো..আমি গাড়ি..
চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল হৈমপ্রভা।
-খুব সুন্দর খুব সুন্দর..
হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিল হৈমপ্রভা। সেই সময় মোবাইল ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। ফোন কানে নিল হৈমপ্রভা। সিকিউরিটির কথা শুনে মুখটা গম্ভীর হল। মুখে বলল,
-ঠিক আছে ছেড়ে দাও.. দিপালী কোথায় গেলে..
তারপর দিপালীর উদ্দেশ্য ডাক ছাড়ল হৈমপ্রভা।
-বলুন..
-বুবলাইকে অন‍্য ঘরে নিয়ে যাও।
আদেশ মেনে বুবলাইকে কোলে তুলতেই চিৎকার করে উঠল বুবলাই..
-ওর গাড়ি সমেত নিয়ে যাও..তাড়াতাড়ি যাও..
-বুবলাইকে কোথায় পাঠাচ্ছো হৈমপ্রভা?
হৈমপ্রভার সম্মুখে উপস্থিত হল তীর্থঙ্কর।
চলবে: