#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_একত্রিশ
স্মৃতির পালতোলা নৌকায় ভাসতে ভাসতে এক সময় ঘুমে ডুবে গিয়েছিল হৈমপ্রভা। ছোট্ট হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলল হৈমপ্রভা। বুবলাই হাসিমুখে ওর অভিমুখে তাকিয়ে আছে।
-ইটো ইটো..
-হ্যাঁ উঠছি..
-মিটু যাব।
বাইরে থেকে মিষ্টুর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে হৈমপ্রভার অনুপস্থিতি দেখে এই চিৎকার।
ঘড়ির অভিমুখে তাকাল হৈমপ্রভা। সময়টা যেন মুখ টিপে হাসছে। সান্যাল ম্যানসনে প্রথম এত দেরিতে ঘুম ভাঙল।
-তাড়াতাড়ি চল। মিষ্টুর ঘুম ভেঙে গেছে আমাদের ঘুম ভাঙেনি।
নাতির হাত ঘরে বাইরে এল হৈমপ্রভা।
-আপনার দেরি দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। দরজা ফাঁক করে দেখি নাতি-দিদা ঘুমাচ্ছে। তাই আর ডাকিনি..
-ডাকতে হত..কত দেরি হল বল তো..
-কতদিন পর একটু শুলেন বলুন তো..
-সারারাত ঘুম হয়নি, ভোরের দিকে চোখ লেগেছে। যা তুই বুবলাইয়ের মুখ ধুয়ে দে। আজ দশটায় চারজন আসবে। ওদের ইন্টারভিউ নেব। তারপর তো তুই আছিস..
-কেন বৌদিমনি?
-বুবলাইকে দেখাশোনার জন্য..আমাকে তো কাজে ফিরতে হবে।
-তুমি ফেরেস হও। আমি গ্রিন টি দিচ্ছি। আজ শোরুমে যাবেন?
-না আজ আর যাব না..
***
মধ্য রাতে একটা অদ্ভুত শব্দে ঘুম ভেঙে গেল হৈমপ্রভার। লাইট বন্ধের মতন ভুল আজ আর করেনি হৈমপ্রভা। কুঁকড়ে আছে বুবলাই। মুখ থেকে অদ্ভুত গোঁ গোঁ শব্দ করছে। ভয় পেল হৈমপ্রভা। বুবলাইকে স্পর্শ করতেই দেখল গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ঘুমন্ত ছেলেকে ওষুধ খাওয়ানো দুষ্কর ভেবে জ্বর নামাতে জল পট্টি দিল হৈমপ্রভা।
ঘুমের ঘোরে বাবা বাবা করতে থাকল বুবলাই। সকাল দিকে অনেকটা ভুলে থাকলেও মনের অগোচরে বাবা-মাকে এখনো একই ভাবে স্মরণে রেখেছে ছোট্ট শিশু। অসহায় মনে হল হৈমপ্রভার। এত বড় বাড়িতে নিজের বলতে শুধু বুবলাই। একরত্তিটাকে ঢাকা দিয়ে কোলে শোয়ালো।
-তোর যেমন কেউ নেই..আমারো কেউ নেই।
বড় মেয়ের প্রতি অভিমান থেকে বলল হৈমপ্রভা।
মা মা বলে কেঁদে উঠল বুবালাই। বুকের কাছে আগলে রাখল হৈমপ্রভা। এই তো মা এখানে..
দশদিন পর:
সর্বক্ষণ দেখাশোনার লোক রেখেও বুবলাইকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হৈমপ্রভা। ও ছেলে কারুর কাছে থাকে না। চোখের আড়াল হলেই মা মা করে। এখন বুবলাই দিদাকে মা বলেই ডাকে। সুংযুক্তা শুনে টুকতে ছাড়েনি। মাকে বলে বিশেষ লাভ হবেনা বুঝে বলা ছেড়ে দিয়েছে। বুবাই এলে বুবলাই খুব খুশি হয়। ডাডা ডাডা বলে সর্বক্ষণ ওর সাথেই ঘোরে। খুশিতেই আছে বুবলাই। তবে জেদ উঠলেই চিৎকার করে কাঁদে। বাবা দাবো বলে..হৈমপ্রভা ছাড়া কেউ আর সামলাতে পারে না। বুবলাইয়ের জীবনে বাবার অভাব অনুভব করে হৈমপ্রভা। আর তখুনি তার চেহারা স্মরণে আসে। সেদিন খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল এই মানুষটাকে..
কৌতূহল বশত খবর নিয়েছিল হৈমপ্রভা। সত্যিই গ্রামে ফিরে গেছে তীর্থঙ্কর।
-কাপুরুষ একটা..সেদিন একবারো সম্পর্কের কথাটা জানাতে পারল না..
সৃজিতার মৃত্যুর পর বাস্তবটাকে দেখতে পাচ্ছে হৈমপ্রভা। সবকিছুর ঊর্ধ্বে সে একটা মানুষ। এত মানুষের ভালোবাসা, এত লোকবলের মাঝে সে খুব একা। পাশে কেউ নেই..স্বামীর মৃত্যুর পর একা হয়েছিল হৈমপ্রভা। একাকিত্ব অনুভব করার সময় পায়নি। কাজ ওর সেই অভাবের ঘাটতি মিটিয়েছিল। এখন বয়স বেড়েছে..আত্মজার মৃত্যু মনকে তছনছ করে দিয়েছে। দায়িত্ব ছেড়ে ঈশ্বরের পায়ে সব কিছু সমর্পণ করে শান্তির সন্ধানে অন্যত্র যেতে ইচ্ছে করলেও যেতে পারেনা। নাতির বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। নিস্পাপ মুখের অভিমুখে তাকালে কষ্ট কিছুটা লাঘব হয় হৈমপ্রভার।
বুবলাইকে গল্প বলে স্যুপ খাওয়াচ্ছিল দিপালী। ন্যানি সন্ধ্যায় ছয়টায় ডিউটি শেষ করে চলে গেছে। সন্ধ্যায় দিপালীর কাছেই খায় বুবলাই। খেতে খেতে ড্রয়িং রুমময় ছোটাছুটি করছে। গাড়ি নিয়ে মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করছে।
-মা টুকি..
চেয়ারের আড়ালে বসে হৈমপ্রভার সাথে লুকোচুরি খেলতে চাইছে বুবলাই। এই কদিনেই হৈমপ্রভাকে মায়ের স্থান দিয়েছে।
-বুবলাই টুকি..
হৈমপ্রভার গলা শুনে ছুটে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গালে চুম্বন করল হৈমপ্রভা। আবার নেমে পড়ে ছোটাছুটি করতে থাকল।
-বুঝলি দিপালী মা তো হয়েই গেলাম। তবে ওর জীবনে বাবার অভাব থেকেই গেল।
-কী করবে বৌদিমণি সব কপাল..
এই বড় বাড়িতে দিপালীর সাথেই একটু মন খুলে কথা বলতে পারে হৈমপ্রভা। রান্নার আরো একজন লোক আছে। দিপালী সর্বক্ষণের জন্য..দিপালী ওর গ্রামের মানুষ। স্বামীর মারা যাওয়ার পর যখন একজন সর্বক্ষণের বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন পড়েছিল দিপালী তখন দেবদূতের মতন এসে হাজির হয়েছিল। সেই থেকে রয়ে গেছে। পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে নির্ঝঞ্ঝাট বিধবা মহিলা। শুধুমাত্র পুজোতে একবার চারদিনের জন্য বাড়ি যায়।
-সেই..সবই ভাগ্য..দে স্যুপটা আমাকে দে। তুই আমার ছানার বাটিটা আন।
-আনছি..
স্যুপটা হৈমপ্রভার হাতে ধরিয়ে রান্নাঘরে গেল দিপালী।
-দেখি তো কে খায় কে খায়..ম্যাও খায় না আমার বুবলাই খায়।
চোখ বন্ধ করে চামচটা সামনে ধরল হৈমপ্রভা। তাড়াতাড়ি এসে চামচটা মুখে নিল বুবলাই।
***
পনেরো দিন পর:
ফ্যাক্টরীতে অনেকটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে হৈমপ্রভা। ব্লসমে ভিজিট দেওয়া হয়নি। খাওয়ার পর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে যাবে। এখনো বাইরে বেরনো সমস্যা। বুবলাই সর্বক্ষণ গায়ের সাথে লেপ্টে থাকে। ওর চোখ এড়িয়ে যেতে হয়। আবার নিয়মিত আসছে সংযুক্তা। তবে বুবলাইয়ের প্রতি কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব..আর কিছু মন্তব্য করেনা হৈমপ্রভা। ভাত খেয়ে হাত ধুচ্ছিল হৈমপ্রভা। হন্তদন্ত হয়ে এল দিপালী।
-বৌদিমণি আমার ছুটি লাগবে..
চোখ কপালে উঠল হৈমপ্রভার।
-কেন রে?
-গেরামে বিয়া লেগেছে। আমাকে যেতে হবে।
-কার বিয়ে লাগল? তোর ভাইপোর?
-না না আছে একজনের..
-এইভাবে হঠাৎ করে বললে হবে?ঘরে এখন বাচ্চা আছে। কার ভরসায় ছাড়বো বল তো?
-তোমাকে এবার লোকের ভরসায় ছাড়তে হবে।
কেন রে?
অবাক হওয়ার পর্ব যেন শেষ হচ্ছে না হৈমপ্রভার।
-আমি আর ফিরব না। এবার থেকে গেরামেই থাকব। আমার দিদির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আমি ওখানেই থাকব..
-কী সব কথা বলছিল? তা বললে হয় নাকি..
-বলছি..
এদিক ওদিক তাকালো দিপালী। তারপর বলল,
-দিদির মেয়ের পেরায় চল্লিশ বছর বয়স। সামনের দাঁত উঁচু বলে বিয়া হয়নি। তিনুদা মানে যে কিছুদিন আগে এসেছিল সে তো আমাদের গেরামের। লোকটা এখন গেরামে থাকছে। একা মানুষ, বাড়ির লোক জোর করেছে বলে বিয়া করছে। ভালোই হল বলো দুজন একা মানুষ সঙ্গী পেল।
স্তব্দ হল হৈমপ্রভা। বিয়ের করবে তীর্থঙ্কর? তাও আবার এ বয়েসে এসে!
চলবে