#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_তিন
বিশালাকার গেট পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছালো সৃজিতা-নির্ঝর।
-সৃজিতা অশান্তি বাড়িও না ঘরে ফিরে যাও। তুমিও কষ্ট পাচ্ছো উনিও কষ্ট পাচ্ছেন। আমি আগেই বলেছিলাম এই বিয়েতে আমরা সুখী হব না। তুমি ফিরে যাও..
-এখন আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ বদলেছে নির্ঝর। প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে আমরা দম্পতি হয়েছি। সদ্য বিয়ে হয়েছে আমাদের, এর মধ্যে তুমি আমাকে ফিরে যেতে বলছো। ফিরে যাওয়ার হলে, আমি তোমাকে বিয়ে কেন করলাম?
সৃজিতার ঝাঁঝে কেমন মিইয়ে গেল নির্ঝর। আমতা আমতা করে বলল, এর পর আমরা কোথায় যাবো?
-কেন তোমার ঘর নেই?
-আচ্ছা আমি গাড়ি দেখছি।
শুধুমাত্র বাঙালি শাড়ি পরিপাটি করে পরে আছে সৃজিতা। হাতে শাঁখা-পলা। দৈনন্দি
ন পরিহিত গলায় চেনটা ছাড়া গায়ে কোনো সোনার গহনা নেই। কপাল ও সিঁথি জুড়ে সিঁদুর যেন গহনার অভাব পূরণ করছে। একটা লালিত্য ছড়িয়ে পড়েছে ওর মুখাবয়বে।
অভিজাত পাড়ায় সান্যাল ম্যানসন অবস্থিত। সেখানে কেউ কারুর ব্যপারে নাক গলায় না, তবুও আশেপাশের লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে দেখছে। রাস্তায় একটা ট্যাক্সি দেখতে পেল নির্ঝর। ওতেই ওঠে বসল ওরা। পিছনের সিটে ঘাড় এলিয়ে দিল সৃজিতা।
বড্ড বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে।
-যদি মা ইন্দ্রনীলকে আমার বিয়ের পাত্র হিসাবে নির্ধারণ না করত তাহলে কি আমি এখন এই ডিসিশন নিতাম!? মা তো আমাকে বাধ্য করল।
বিড়বিড় করে বলল সৃজিতা।
অসহায় দৃষ্টিতে সৃজিতার দিকে তাকালো নির্ঝর। নিজেকে দোষী মনে হল। রাজকুমারীর যথাযথ মর্যাদা দিতে পারবে কিনা..সেই বিষয়ে যথেষ্ট ভীত ও।
সবে প্রাইভেট কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরিতে জয়েন করেছে নির্ঝর। ঐ তিন-সাড়ে তিন মাস হবে। ঘরে অবশ্য বিধবা রুগ্ন মা ছাড়া আর কেউ নেই। আকস্মিক বিয়েতেও সেই মায়ের পূর্ণ সমর্থন ছিল । তাই হয়তো একটু মনোবল পেয়েছিল নির্ঝর। সৃজিতার মা সম্পর্কটা মানবে না জানত, এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে সেই বিষয়ে ও নিশ্চিত ছিল। তবে এখন সৃজিতার কষ্টটা দেখে বেশি পীড়িত হচ্ছে। তাও বারবার বলল, মায়ের কাছে ফিরে যেতে। তবুও সৃজিতা শুনল না। অবশ্য সৃজিতা যে ওকথা শুনবে না সেই ব্যপারে দুশো শতাংশ নিশ্চিত ছিল ও। গুরুজনের অমতে বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করলে প্রথম প্রথম এই সমস্যা হয়। তারপর পরে ঠিক মেনে নেয়। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না। কিছু দিন, কিংবা কিছু মাস গেলেই হয়তো মা-মেয়ের মিলন হবে।
মনে মনে এই ভাবনা গুলো চলছিল নির্ঝরের। ফোপানোর শব্দ কানে যেতেই পাশে তাকালো ও। স্থান ,কাল ভুলে সৃজিতা কাঁদছে।
-এই সৃজি, এইভাবে কাঁদছো কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন পরে দেখবে তোমার মা তোমাকে কাছে টেনে নেবে। মায়ের সঙ্গে এই বিচ্ছেদ ক্ষণস্থায়ী।
স্ত্রীর হাত চেপে ধরল নির্ঝর। সেই স্পর্শের মধ্যে ছিল সমবেদনার প্রকাশ, ছিল পাশে থাকার অঙ্গীকার।
-কিচ্ছু ঠিক হবে না নির্ঝর। আমি আমার মাকে চিনি। সে এককথার মানুষ। যখন আমাকে অপশন দিল তখুনি বুঝে গেছি হৈমপ্রভা সান্যাল তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ওঁকে তুমি চেনো না নির্ঝর। ভীষণ এক জেদি মানুষ। আমাকে এই অবস্থায় দেখে কেমন শান্ত ছিল দেখেছিলে। আসলে নিজের মনে রাগকে চেপে রেখেছিল। খুব রেগে গেলে মা ওমনি শান্ত থাকে।
-আচ্ছা, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আর ঐ সব নিয়ে ভেবো না। এই দেখেছো আমি কেমন মাকে আমাদের ফেরার খবর জানাতে ভুলে গেছি। দাঁড়াও একটা ফোন করে দিই..
-নির্ঝর উনি যদি হৈমপ্রভা সান্যাল হয়, তাহলে আমিও সৃজিতা সান্যাল। যেদিন উনি আমাকে ডেকে নিয়ে যাবেন, সেদিন আমি যাব। তার আগে নয়। আমিও আর ঐ বাড়ি ফিরবো না।
গালে উপচানো চোখের জল দুহাতে মুছে বলল সৃজিতা।
এই বিচ্ছেদ যে সহজে মিটবে না উপলব্ধি করল নির্ঝর। স্ত্রীর মাথাটা আবার নিজের কাঁধে রাখল। আবার অশ্রুবন্যার দমক বাড়ল। সৃজিতাকে কাঁদতে দিল নির্ঝর।
ধীর পায়ে পায়ে আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকল হৈমপ্রভা। এই ভাবে মেয়েটা মুখ পোড়াবে কে জানত!
-সুজি শেষ অব্দি তুই বিয়ে করে ফেললি? ঐ ছেলেটা কোনো দিক থেকে কী তোর যোগ্য? না খেতে পেয়ে মরে যাবি যে..
বিড় বিড় করছিল হৈমপ্রভা।
-ছোট দিদি এটা করল বলো তো? মা তুমি কি সত্যিই ছোট দিদিকে তাড়িয়ে দিলে?
দিপালীর কথায় উত্তর দিল না হৈমপ্রভা।
-ছেলেটা কিন্তু দেখতে সুন্দর..
দিপালীর এই কথায় জ্বলে উঠল হৈমপ্রভা।
-যা নিজের কাজে যা..
বুলি বন্ধ হল দিপালীর।
-আমার ঘরে এক কাপ কফি দিয়ে যা..
রান্নাঘরে যাচ্ছিল দিপালী। হৈমপ্রভার আদেশে থেমে গেল।
-তোমার যে কফি খাওয়া বারণ..
-সেই নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। যেটা বললাম কর..
আর সেখানে দাঁড়ালনা দিপালী। দ্রুততার সাথে রান্নাঘরে ঢুকল।
সেদিনের সব কার্যে ছেদ পড়লো, দৈনন্দিন রুটিন ব্যহত হল হৈমপ্রভা সান্যালের। নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করল।
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব চার
-কী বলছ! এই খবরটা সত্যি?
-একদম পাকা খবর আছে, কালকেই বিয়ে করেছে ছোটো মেয়েটা। ছেলেটা বোধহয় বেকার। মেয়েটা ঐ মহিলার মুখে চুন কালি মাখিয়ে দিল।
-না সজল, চুন কালি নয়। চুন কালি নয়। ও তো ধুলে উঠে যাবে। মেয়েটা হৈমপ্রভা সান্যালের গালে আলকাতরা মাখিয়ে দিল। শুধু গাল বলি কেন, হৈমপ্রভার ব্যক্তিত্বেও এই দাগ লেগে গেল। যার দাগ শত চেষ্টা করলেও উঠবে না..
হা হা করে হেসে উঠল বছর ষাটের তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত।
-চলো চলো এখুনি কারখানায় যাওয়া যাক। কর্মীদের সঙ্গে কিছু কথা আছে। ওদের আজ হাফ বেলা ছুটি দিতে চাই।
-স্যার আপনি ফ্যাক্টারীতে যাবেন?
একটু অবাক হল সজল।
-কেন আমি যেতে পারি না?
-না এই তো আপনি বাড়ি থেকে এলেন, এর মধ্যে আবার যাবেন? মানে অনেকটা রাস্তা..
-আমাকে কি বুড়ো মনে করো সজল?
“না আপনি কেন বুড়ো হবেন। আপনার চেহারার কাছে আমাকে বুড়ো মনে হয়। বাব্বা! আপনার যেমন কাজ, তেমন রাগ! সব দিক থেকেই আপনাকে যুবক মনে হয়”
-না স্যার। চলুন এখন যাওয়া যাক…কিন্তু কোন ফ্যাক্টারিতে যাবেন?
-কেন সজল “সোনা” ছাড়া এখন আর অন্য কোথাও যাওয়া কি সম্ভব?
-হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন..
আরামদায়ক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বছর ষাটের ছয় ফুট উচ্চতার যুবক। পেটানো চেহারা, গৌর বর্ণের সেই পুরুষ এখনো মহিলাদের হৃদয়ে ঝড় তুলতে সক্ষম। নিয়ম করে তার ধূসর কেশ গুলোতে সযত্নে কালো প্রলেপ দেয়। এক মাথা কালো চুল ওঁর কাছে খুব গর্বের। একমাথা ঘন চুলে হাত বুলিয়ে কেবিন ছাড়লেন উনি। রাস্তায় নেমে গাড়ির কাছে যেতেই ড্রাইভার গেট খুলে দিল।
-মোহন রোফি সাহেবের গান চালাও তো?
ড্রাইভারকে হুকুম দিল তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত।
সামনের সিটে বসল সজল। তারপরেই হাস্যরত স্যারের অভিমুখে তাকালো। স্যারের খোশমেজাজের কারণটা জানে ও। তবে কি কারণে হৈমপ্রভা দেবীর সঙ্গে এতটা শত্রুতা তা জানে না। শুধুই কি ব্যাবসায়িক দিক থেকে, না সেই শত্রুতা ব্যক্তিগত ভাবেও আছে তা সঠিক সজলের জানা নেই।
তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তের গাড়ি গিয়ে থামল “সোনা” লেখা প্রকান্ড দুই পাল্লা লোহার গেটের সামনে।
গেটে সিকিউরিটি ঝিমাচ্ছিল। মোহন ড্রাইভারের হর্ন শুনে জিভ কেটে উঠে দাঁড়ালো। তারপরেই খুলে দিল দরজা।
এই কারখানায় শুধুমাত্র বাচ্চাদের পোশাক তৈরি হয়। এই তাছাড়াও একটা নিজস্ব ঠান্ডা পানীয়ের ও একটা ন্যাপথলিনের কারখানা আছে। সপ্তাহে রুটিন করে তিনটা কারখানায় ভিজিট করেন তীর্থঙ্কর সেন।
কখনো বা অতর্কিত ভাবে ঢুঁ মারেন। কর্মীরা অল্পবিস্তর ফাঁকি মারে ঠিকই, তবে মালিক সদয় থাকার দরুন তেমন কোনো ঝুটঝামেলা হয়না। ফলস্বরূপ সর্বদা লক্ষ্মী উথলে পড়ে।
এই যেমন আজ তিনি এতটাই খুশি কর্মীদের হাফবেলা ছুটি দিয়ে, তারপরের দিনে দুপুরের খাওয়ানোর আয়োজন করলেন। কর্মীরা ওঁর নামের জয়ধ্বনি দিল।
বাকী দুই কারখানাতেও কর্মীদের একটা করে মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার আদেশ দিলেন। তুলনামূলক ছোট “সোনা” কারখানার প্রতি বিশেষ মায়া জড়িয়ে আছে তীর্থঙ্করের। অনেক কষ্ট করে এই কারখানা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন অল্প জমি, কয়েকজন কর্মী নিয়ে সূচনা হয়েছিল। পরে পরে কারখানার আয়তন ও কর্মী দুই বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জায়গাটাতে। প্রথম প্রথম মেশিনে নিজে সেলাই করে বাচ্চাদের পোশাক বানাতনম। আজও যেন পুরনো কথা ভেবে স্মৃতিবেদনাতুর হচ্ছে তীর্থঙ্কর।
সজলের মনে হচ্ছিল ওর স্যার আগে কখনো এতটা খুশি হয়নি। কানাঘুষোয় শুনেছিল হৈমপ্রভা দেবীর স্বামীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। কোনো কারণে সেই সম্পর্কে চিড় ধরে। তারপর চির শত্রুতে পরিণত হয়।
-সজল..
সম্বিত ফেরে সজলের।
-বলুন স্যার।
-ঐ মহিলার মেয়ে যেই ছেলেটাকে বিয়ে করেছে তার সম্পূর্ণ বায়োডাটা চাই। এক সপ্তাহের মধ্যে ছেলেটাকে আমার সামনে দাঁড় করাতে হবে।
নিশব্দে ঢোক গিলল সজল। দেওয়ালে মাথা ঠুকছে ইচ্ছা করছে ওর। কি কুক্ষণে যে পাজি বুড়োটাকে খবরটা দিল কি জানি!
-আমি চেষ্টা করছি।
-চেষ্টা না। আনতেই হবে..খোঁজ নাও।
***
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না সৃজি। ওঁর মতন ব্যবসায়ী আমাকে কেন ডেকে পাঠালো?
-সামনের দিকের জামাটা ভালো করে গোঁজা হয়নি। ঠিক করে আর একবার গুঁজে নাও তো।
বলে নির্ঝরের চুলে চিরুনি চালালো সৃজিতা।
-ওহ বলেছিনা শার্টের বোতামটা বন্ধ রাখবে। বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে ড্রেসআপটা মেইন।
-ধুর ভালো লাগে না।
ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো নির্ঝর।
-কি হল কী?
-আমার টেনশন হচ্ছে, আর তুমি ড্রেসআপ নিয়ে পড়ে আছো।
-টেনশনের কি আছে, ডেকেছে যখন কাজের কথা বলতেই ডেকেছে। হয়তো তোমাকে কোনো কাজ দেবে।
-সেটাই আমার প্রশ্ন, এত বড় শিল্পপতি আমার মতন চুনোপুঁটিকে কেন ডাকলেন।
-কারণ হৈমপ্রভা সান্যাল আমাদের সম্পর্কটাকে মানে নি। তাই..
-কি বলছো তুমি?
-তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত আমাদের কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি শিউর ওঁর কাছে খবর আছে যে মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেয় নি। তাই শত্রুর শত্রুকে বন্ধু করতে চাইছেন।
-এ তো অন্যায়! না আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবো না।
-তুমি যাও, ভালো খবর নিয়ে ফিরে এসো।
ফ্যালফ্যালিয়ে সৃজিতার দিকে তাকালো নির্ঝর।
মুচকি হেসে নির্ঝরের ঠোঁটে ঠোঁট ডোবালো সৃজিতা।
-তুমি কী চাও বলো তো?
-এই ভাবে হৈমপ্রভা দেবীকে জবাব দিতে হবে নির্ঝর, সেই সঙ্গে আমাদেরও ভালো থাকতে হবে। তুমি যাও নির্ঝর, যাও..
-হ্যাঁ যাই..
-চিন্তা কোরো না, সব কিছু ভালোই হবে..
বাড়ি থেকে বেরল নির্ঝর। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল সৃজিতা।
চলবে: