#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_সাত
খামের ভিতর কয়েকটা ফটো। প্রথম ফটোতে তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তের সঙ্গে বসে আছে সৃজিতা। তার পাশে নির্ঝর। খিলখিলিয়ে হাসছে সৃজিতা। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে টকটকে লাল সিঁদুর। ওর ঘায়ে নুন ছিটানোর জন্য একটা ফটো যথেষ্ট। চার টুকরো করে ফটোটা ছিড়ে ফেলল। রাগে থরথর করে কাঁপছে। ঠিক তখুনি দেওয়ালে স্বামীর মালা ঝোলানো ফটোটার দিকে নজর পড়ল।
পায়ে পায়ে অগ্রসর হল সেই দিকে।
-কেন তুমি অকালে চলে গেলে বলোতো!? এত ঝামেলা কি আমি সামলাতে পারি? তোমার মৃত্যুর পর থেকে ঐ বুড়ো আরো শত্রুতা শুরু করেছে। কে বলবে তোমরা এককালের বন্ধু ছিলে। জানো এখন আমার মনে হচ্ছে সুজি যেই ছেলেটাকে বিয়ে করেছে সেই ছেলেটা ঐ বুড়োর দলে। ফাঁদে পড়ে গেছে আমার মেয়েটা। আমি যে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
স্বর্গীয় স্বামীর কাছে যখন অনুযোগ, অভিযোগ করছিলেন ঠিক তখুনি বেজে উঠল হৈমপ্রভা সান্যালের ফোন।
বিরক্ত হল হেভপ্রভা। বেজে বেজে ফোনটা কেটে গেল, আবার বেজে উঠল।
স্ক্রিনে ফুটে উঠছে ব্লসমের ম্যানেজারের নম্বর।
হ্যলো বলতেই অপর প্রান্ত বলে উঠল, “ম্যাডাম আজ সন্ধ্যা ছয়টায় রমেশ আগরওয়ালের ফ্যামিলির আসার কথা। আগে আরেকদিন এসেছিল। মোটামুটি চয়েস করে গেছে। দশ-বারোটা শাড়ি নেবে বলেছে। আপনি থাকলে ভালো হয়। আপনি কি একবার শোরুম ভিজিট করতে পারবেন?”
ইতস্তত করে বলল মেয়েটি।
মনে মনে হিসাব করল হৈমপ্রভা। দশ-বারোটা শাড়ি মানে দেড়-দু লাখ টাকা। ত্রেতা লক্ষ্মী। স্বশরীরে তার উপস্থিতিটা আজ আবশ্যক।
-হ্যাঁ আমি সাড়ে পাঁচটার মধ্যে যাচ্ছি।
শান্ত স্বরে বলল হৈমপ্রভা সান্যাল।
**
-তোমাকে বিয়ে করে লটারি পেয়ে গেছি আমি।
-জ্যাকপট!?
-হ্যাঁ তাই..
স্মিত হাসল নির্ঝর। রাত বাতির আলোতে তা দেখতে পেল না সৃজিতা।
-তাহলে যে আমাকে বিয়ে করতে চাইছিলে না?
-তুমি বিয়ে করে ভালো আছো তো?
-খারাপ থাকার সুযোগ কোথায় দিলে, এই যে আমাকে এত্ত ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছো, এর মধ্যে কি খারাপ থাকতে পারি? না খারাপ থাকার অবসর পেয়েছি?
সৃজিতার দিকে ঘুরে গালে গভীর চুম্বন করল নির্ঝর।
-এই সৃজি, তোমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বলো?
নির্ঝরের এই প্রশ্নের আগে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সৃজিতা। এবার স্তব্দ হল ও।
-আমি এই ক’দিন কিন্তু এই প্রশ্ন তোমায় করিনি, আজ মনে হল করা খুব দরকার।
“মা তুমি আমার পৃথিবী, আমার পথিকৃৎ। আমার ভালোবাসার আশ্রয়স্থল। তোমার ব্যক্তিত্বে এমন কিছু আছে যাতে সহজেই বশীকরণ হতাম। তুমি না বললে সেটাকে হ্যাঁ বলার ক্ষমতা আমাদের দুই বোনের ছিল না। আমাদের পড়াশোনা শুধু তোমার জন্য, পরীক্ষার সময় তুমিও তো আমাদের সঙ্গে রাত জাগতে মা। বাবাকে কত কী ভাবে তুমি ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিতে, তার সাক্ষী আমরা মা। তারপর বাবার মৃত্যুর পর তুমিই তো ব্যবসা সামলালে। “ব্লসম” শোরুম খুললে। সব দিক থেকে তুমি পারদর্শী। আমার চোখে শ্রেষ্ঠ নারী। তুমি আমায় এই পৃৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ করেছো। তোমাকে কী আলাদা ভাবে মনে করার প্রয়োজন আছে মা?”
বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রান্তের পর সৃজিতাকে মৌন দেখে নির্ঝর আবার বলে,
-জানি মনে পড়বেই। আমার জন্য নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ করলে। সৃজি তোমার মায়ের সত্যিই কোনো দোষ নেই, সত্যিই কোনো দিক থেকেই আমি তোমার সমকক্ষ নই।
নির্ঝরের বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকল সৃজিতার। আবার জন্মদাত্রীর উপর রাগের উদ্রেক হল।
“বরাবর আমি তোমার অপদার্থ মেয়ে মা। কোনোদিনও তোমাকে সাহায্য করতে পারিনি। তবে তুমি সবসময় বলতে যা মন চায় তাই করা উচিত। আমি মনে করি নির্ঝরকে ভালোবেসে বিয়ে করে আমি ভুল কিছু করিনি।”
কঠিন স্বরে বলল সৃজিতা। নির্ঝরের কাছেও নিজের উপলব্ধি গোপন রাখল। মায়ের জন্য কষ্টের অনুভূতির কথা বললে নির্ঝর নিজেকে দোষী মনে করবে। বারংবার স্বামীকে কষ্ট দিতে চান না সৃজিতা।
-না মনে পড়েনি। কেন মনে পড়বে বলতে পারো? তোমার ভালোবাসা, আর তোমার মায়ের স্নেহ আমাকে কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে মনে করতে দেয়নি।
পরিবেশ উতপ্ত উপলব্ধি করতেই প্রসঙ্গ পাল্টালো নির্ঝর।
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_আট
ছয় মাস পর:
ঘরের শো পিস গুলো মোছামুছি করছিল সৃজিতা। নতুন চাকরি পেয়ে ঘর মেরামত করেছে নির্ঝর। আরো টাকা জমাচ্ছে যাতে একবছর পর দোতলা নির্মাণ করা যায়।
ওদের জীবনে একটা বিরাট অঘটন ঘটে গেছে।
দুই কামরার ঘরে এখন দুটো প্রাণী। দুই মাস হয়েছে, নির্ঝরের মা হার্ট ফেল হয়ে মারা গেছে। সেই থেকে বড্ড একা হয়ে পড়েছে সৃজিতা। বিশেষ করে নির্ঝরের অনুপস্থিতির সময় গুলোতে। সেই বৃদ্ধা মাতৃ স্নেহে সৃজিতাকে আগলে রেখেছিল। তাঁর চলে যাওয়া অনেকটা অভাব সৃষ্টি করে।
মায়ের কথা মনে করে কষ্ট পায় সৃজিতা। প্রথম প্রথম দিদিকে ফোন করত। লুকিয়ে মায়ের খবর নিত। ইদানিং সুংযুক্তা আর ফোন তোলে না। একদিন ফোন তুলে বলল, মা যখন চায় না, তুইও আর ফোন করিস না।
জামাইবাবুকে ফোন করেছিল, তোলেনি সে।ব্যপারটা অপমানে লেগেছিল সৃজিতার। ও জানে দিদিকে জামাইবাবু বারণ করেছে তাই হয়ত ওর দিদি এড়িয়ে চলছে। নিন্ম মধ্যবিত্ত শালীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে রুচিতে বাধছে।
ঐ সব ভাবতে ভাবতে বাইরের বাগানে গেল সৃজিতা। সুন্দরী পাতা বাহারের পাতায় স্পর্শ করল। মোমের মতন মসৃণ পাতাগুলো। একটা কারণে চঞ্চল হয়ে আছে সৃজিতা। মনের ভিতরটা উথালপাতাল করছে। দুপুরে ভাত ভালো ভাবে খেতে পারেনি। বিছানায় শুয়েও উশখুশ করেছে। চাপা উত্তেজনায় শান্তি পাচ্ছে। সময় যেন বয়ছে না। ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
সেই সময় অতি পরিচিত রিংটোনে ফোন বেজে উঠল।
দ্রততার সাথে ফোন হাতে নিল সৃজিতা।
-বলো।
-ফোন করোনি যে?
-না এমনি..
-আমি এখুনি বাড়ি ফিরছি।
-রিপোর্টটা ডাক্তারকে দেখালে?
শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করল সৃজিতা।
-হু..
-ও..
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল সৃজিতা। বুকের ভিতরটা ফাঁকা অনুভব করল।
-এখন ফোন রাখছি।
সৃজিতার কন্ঠে ক্লান্তি।
-এই সৃজি..
-বলো..
সৃজিতার মনের তল পেল নির্ঝর। আর চাপে না রেখে বলল,
-আমাদের অনুমান সঠিক, আমি বাবা হতে চলেছি।
-সত্যি বলছো?
মুহুর্তে সৃজিতার মনের অবস্থা পরিবর্তিত হল। উচ্ছসিত কন্ঠে একবার লাফিয়ে নিল।
-এই একদম ছটপটানি চলবে না। খুব সাবধানে থাকতে হবে। যা যা সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার আমাদের করতে হবে। আমাদের তো কেউ নেই। মাও এই খুশির খবরটা শুনে যেতে পারল না।
শেষ বাক্য উচ্চারণের সময় কষ্ট প্রকাশ পেল নির্ঝরের গলায়।
-সত্যিই খুব খারাপ লাগছে।
-আমার মেয়ে চাই কিন্তু। মেয়ে হলে জানবো মা ফিরে এসেছে।
-আচ্ছা ঘরে এসো তারপর কথা হবে।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে নির্ঝর বলে ওঠে,
-সৃজি তোমার মাকে এই খবরটা দেবে না?
-না কোনো প্রয়োজন নেই।
একটু থেমে বলল সৃজিতা।
-এই খবর শুনলে উনিও খুশি হবেন। তখন আর তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারবেন না।
-না থাক নির্ঝর। আমার আগত সন্তানকে অপমানিত হতে হলে আমার ভালো লাগবে না।
-এই খবরে ওঁর খুশি হওয়ার কথা। আচ্ছা তুমি যখন চাইছো না তাই হবে।
-তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো..
-খুব বেশি হলে আধঘন্টা ডালিং। আমি আসছি।
ফোনের লাইন সংযোগ চ্যুত করল নির্ঝর।
কিছুক্ষণ স্থানুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সৃজিতা। হৃদয়ে মন খারাপের সুর। এত ভালো খবরেও কানায় কানায় পূর্ণ হতে পারছে না। ছুট্টে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। ওর শরীরে যে আরেকটা প্রাণের সূচনা হয়েছে, সেই খবরটা সবার প্রথম মাকে বলতে ইচ্ছে করেছিল। খুশিটা মায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে ইচ্ছে করছিল, ইচ্ছে করছিল মায়ের স্নেহাদর খেতে..কিন্তু কোথায় কি, সান্যাল ম্যানসনের দরজা যে ওর জন্য চিরকালের জন্য বন্ধ হয়েছে। গেলেও হয়তো অপমানিত হয়ে ফিরে আসবে। তার থেকে এই দুই কামরার ঘরেই শান্তি..
-মা আমি যদি তোমার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতাম। তুমি সোনায় মুড়ে দিতে আমাকে। দামি
আসবারে ঘর ভরে থাকত। আমার সুবিধার জন্য দুইজন কাজের লোক থাকত। আমার স্বামী হয়তো রাতে ঘরে ফিরত না। ফিরলেও মদ্যপ অবস্থায় আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ত। মারধোর করত। তাহলে তুমি খুশি হতে তো? তখনো সে তোমার কাছে আমার সমকক্ষ থাকত?? তোমার কাছে টাকাই সব তাই না? কিন্তু সেই অর্থে টাকা না থাকলেও আমি খুশিতে আছি, শান্তিতে আছি। নির্ঝর আমাকে খুব ভালোবাসে মা। জীবন দিয়ে ভালোবাসে। টাকা দিয়ে এমন ছেলে তুমি কিনতে পারতে না…
একা ঘরে এই বুলি আউড়াতে আউড়াতে অশ্রুবন্যায় ভাসছিল সান্যাল ম্যানসনের ছোট রাজকুমারী সৃজিতা সান্যাল।
চলবে: