#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২১।
আর তখনি দেখতে পেলো হল ঘরেই বসে আছে প ইজহানের দাদি আলিয়া। আর তাদের কেয়ার টেকার নিপা। আলিয়ার মুখ গম্ভীর। শান্ত তার অভিব্যক্তি। শ্যামার খানিকটা ভয়ই করলো তাকে দেখে। এই মহিলার উপরেই হয়তো ইজহান গিয়েছে। শ্যামার ভাবনার মাঝে ফোরান কেঁটে ইজহান বলল,
“নিপা… ওদের উপরে নিয়ে যাও, আর জান্নাতকে তার রুম দেখিয়ে দিও। শ্যামা উপরে যাও, আমি আসচ্ছি। ”
শ্যামা মাথা নাড়লো। জান্নাতের হাত শক্ত করে ধরে হাটা ধরলো উপরের দিকে। পিছে পিছে গেলো নিপা। ওর সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই ইজহানের দাদিজান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
” এখন তাহলে দিন রাতে বেহায়া মেয়ে ছেলের সন্তানদের মুখ দেখতে হবে! ”
ইজহান ঠান্ডা ভাবে জবাব দিলো,
“দাদিজান, সে আমার স্ত্রী! আর আমি যেখানে থাকবো? সেখানে সে-ও থাকবে। আর আপনার খুব বেশি সমস্যা হলে? আমি চলে যেতে পারি!”
ইজহানের ভাবলেশহীন কথা শুনে আলিয়া কিড়মিড় করে উঠলো,
“তুমি কি ভুলে গেছো সব? ভুলে গেছে এই মেয়ের মা তোমার মার সাজানো সংসার ভেঙেছে, তোমার মাকে কেড়ে নিয়েছো?”
ইজহান চুপ মেরে গেলো। তার উদাসীন দৃষ্টিতে চেযে রইলো একুরিয়ামের ছোট ছোট মাছের দিকে।আলিয়া ভ্রু কুটি কুচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে বলল,
” ইজহান, এমন তো নয়? তুমি ওই মেয়েকে ভালোবাসতে শুরু করেছো? হ্যা.. হ্যা.. তাই হবে, পুরোনো প্রেম বলে কথা, ভালোবাসা আবার উতলে পড়ছে তাই না…! এতটাই? এতটাই যে মৃত্যু মায়ের কষ্ট, দুঃখ সব ভুলে গেছো? ছিঃ ইজহান ছিঃ। তোমার থেকে এসব আশা আমি করিনি।”
ইজহানের চোখ মুহূর্তেই লাল হয়ে গেলো। মনের মাঝে দর-কষাকষি করতে লাগলো সে। কাকে কতটুকু ভাগ দিবে ইজহান? নিজের মার প্রতিশোধ? নাকি ভালোবাসা। ইজহান হতাশার শ্বাস ছাড়লো। দাদিজানের দিক তাকিয়ে বলল,
” আমি ক্লান্ত দাদিজান। আমি ক্লান্ত। আমি ওকে আর কষ্ট দিতে চাই না!”
আলিয়া বিদ্রুপ হাসলো,
” ভালোবাসা? এই সেই মেয়ে না? যে তোমার প্রেম নিবেদন পুরো স্কুলের সামনে তাচ্ছিল্য করেছিলো?”
ইজহান আবারো হারিয়ে গেলো পুরোনো স্মৃতিতে। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাসের কনকনে এক শীতের দিন। শ্যামা প্রতিদিনের মতো স্কুলে এসে মাঠ পেরিয়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। চারিদিকে ঘন কালো কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ঠিক তখনি একটি ছোট ছেলে হাতে একটি চিঠি আর একটি বক্স এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছিলো শ্যামার। ছেলেটির হঠাৎ আগমনে শ্যামা ভয় পেয়ে গেছিলো। বাচ্চা ছেলেটি যখন বলল,
“আপু.. একটা ভাইয়া তোমাকে দিয়েছে!”
বলেই ছেলেটি ছুটে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে গেলো। শ্যামা হতভম্ব হয়ে গেছিলো। এবং যখন চিঠিটি খুলেছিলো, সাথে সাথে চিঠি টি নিয়ে হাজির হয়েছিলো তাদের পিটি স্যারের কাছে। এবং পিটির সময় স্যার চিঠিটি জোরে জোরে পরে মজা করে বলেছিলো,
“কোন গাধারে তুই? পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব ছ্যাছরামো? সামনে আয়? নয়তো আমি খুঁজে পেলে বেতিয়ে লাল করে দিবো।”
সেদিন ইজহানের চিঠি পড়ে সকলেই হো হো করে হেসেছিলো। দূর থেকে ইজহানের মনের হাজার টুকরো হতে সেদিন প্রথম বার উপলব্ধি করতে পেরেছিলো। সেদিন অবশ্য বেচে গেছিলো কারণ চিঠিতে নাম ছিলো না বলে। ইজহান পুরনো কথা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো! শ্যামার কাছে ইজহানের ফিলিং বরাবরই শূন্য ছিলো। হয়তো এখনো তাই হবে! তাইতো… তাইতো ডিভোর্সের কথা বলতে বুক কাঁপেনি শ্যামার। এসব ভেবেই চরচর করে রাগ মাথায় উঠে গেলো ইজহানের। সামনের দামি ইমপোর্টেড টেবিলের উপর এক লাথি বসিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আর এদিকে আলিয়া মনে মনে খুশি হলো খুব। কিছুটা হলেও রাগিয়ে দিতে পেরেছে নিজের নাতিকে ওই মেয়ের প্রতি। ইজহানকে সে হাত রাখে বরাবর। এক মাত্র সেই হবে তাদের মেহরাব ইন্ডাস্ট্রিয়ালের যোগ্য ছেলে। কারণ আরমান এসবে কখনো মাথা ঘামাবে না। সে আছে তার সিংগিং প্রপোসনে মৎ। আর তার ছেলে? তার ছেলেকে তো আগেই বিতারিত করেছে সব কিছু থেকে। আলিয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। আর যাই হোক, তার নাতি ওই মহিলার মেয়ের সাথে সারাজীবন থাকতে সে দিবে না। তার মেয়ে সমতুল্য সানিয়ার সুখের সংসারটা ভেঙে গেছে। লাস্ট পর্যন্ত কিনা গায়ে আগুন ধরাতে হলো! এসব ভেবেই চোখের কোনে জল গড়িয়ে পড়লো আলিয়ার। চোখের জল মুছে হাটা দিলো নিজের ঘরে। দরজা লাগাবে সেই মুহূর্তেই দরজায় এসে দাঁড়ালো শ্যামা। কাঁদো কাঁদো মুখ। কোনো সময় ব্যয় না করে সোজাসাপটা বলল,
” আমার… আমার মা কি করেছিলো মেডাম? কেন বার বার বলেন আমার মার জন্য আপনার পরিবার ধংস হয়েছে? কি করেছেন উনি?”
কাঁপছিলো যেন শ্যামা কথাটুকু বলতে বলতে। আলিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঠ কাঠ গলায় বলল,
” আমি এখন কোনো কথা বলতে চাইনা!”
শ্যামা এবার অসহায় ভাবে বলল,
“প্লিজ দাদিজান। আমি জানতে চাই, কেন এত ঘৃণা আমার মায়ের উপর আপনাদের?”
আলিয়া এবার দরজা ছেড়ে জানালার পাশের আর্ম চেয়ারে বসে পড়লো,
“তোমার মা আমার সব থেকে বড় সর্বনাস করেছে। আমার ছেলের হাসি খুশি সংসারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কত সুখি পরিবার ছিলো ১২ বছর আগে। যেদিন তোমার বাবা-মার আবির্ভাব হলো? তচনচ করে দিলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ”
আলিয়া বলতে লাগলেন,
” তোমার মার সাথে আমার ছেলের বিয়ের আগে সম্পর্ক ছিলো। ”
শ্যামা চমকে গেলো। আলিয়া আবার বলল,
” হ্যাঁ আফিয়া, আজিজুল আর মেহতাব তিনজন একই ভার্সিটিতে এক সাথে ছিলো। মেহতাবের সাথে তোমার মার বিয়েও প্রায় ঠিক হয়ে গেছিলো। কিন্তু হুট করেই ইজহানের দাদা কোম্পানিতে লশ করতে শুরু করে। ঠিক তখনি তোমার মা বোল পাল্টে ফেললো। বিয়ে করে নিলো আজিজুলকে। তখন তোমার বাবার কোম্পানি রেঙ্ক ছিলো ১০ নম্বরে। আর ছেড়ে দিলো মেহতাবকে। মেহতাব তখন অনেক ভেঙে পরে। আর তাই না পেরে মেহতাবের জন্য সানিয়াকে বিয়ে করিয়ে আনি আমরা। মেয়েটি আমার ভাইয়ের মেয়ে ছিলো। খুব আদরের ছিলো সবার। মেহতাবকে খুব ভালোও বাসতো। এতটা! যে মেহতাব নিজেই ওর উপর নরম হয়ে গেছিলো। ভালোই চলছিলো সংসার। তারপরেই আবার তোমার মা, ওই নোংরা মহিলা যখন আমাদের শহরে ফিরে আসে? তখন তোমার বাবার বিজনেস ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছিলো। ”
এই পর্যায় হাসলেন আলিয়া। আবার বললেন,
“বলে না কর্মের ফল দুনিয়াতেই আল্লাহ দিয়েন। তাই হয়েছে। একে একে তোমার বাবার সব সহায়সম্পদ শেস হতে লাগলো। আর তখন আমাদের কোম্পানি হায়েস্ট রেঙ্কে। তাই তোমার বাবা মাফ চেয়ে মেহতাবের সাথে মিলে তার কোম্পানি আগের লেবেলে আনার জন্য। কিন্তু হায়। তোমার মা? তোমার বাবাকে ঠকিয়ে আবারো আমার ছেলের উপর নজর দিলো, কতটা লোভী মেয়ে ছেলে। এমন কি তাদের আপত্তিকর কিছু ফেইক, ভিডিও সানিয়াকে সেন্ড করেছিলো তোমার মা। যার কিছু সত্যি হলেও, বাকিটা ছিলো মিথ্যা। আর সানিয়া! ও খুব দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলো। সে এতটাই ভালোবাসতো যে মেহতাবের দেয়া ধোকা সইতে না পেরে, গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। তখন আমার ছোট আয়ানা মাত্র পাঁচ বছরের। মাকে এমন ভাবে মরতে চোখের সামনে দেখে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তিন দিন.. টানা তিন দিন জ্ঞান ছিলো না তার।”
ফুপিয়ে উঠলো আলিয়া। কাঁদছে শ্যামা-ও। ধর ধর করে কাঁপছে শরীর। শ্যামা আলিয়ার দিক তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল,,
” এইটা সত্য না! আমি.. আমি বিশ্বাস করি না!”
আলিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” তোমার বিশ্বাসে সত্যি কখনো চেঞ্জ হবে না মেয়ে! এবার বের হও আমার ঘর থেকে!”
শ্যামা দৌঁড়ে চলে গেলো তার ঘরে। হাটু গেরে মাটিতে বসে পড়লো। চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
“না.. না.. এমন হতে পারেনা। আমার.. আমার মা.. এমন না!”
পৃথিবীর সব থেকে আপন থাকে নিজের মা। যদিও শ্যামার বোঝ হওয়ার পরে মাকে সে কম পাশে পেয়েছে। বাবা-মা দুজনই তো নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকতো। মেয়েদের পিছনে সময় ব্যয় করার সময়টুকু তাদের থাকতো না। কিন্তু সপ্তাহিক ছুটিতে বাবা মা নিজেই ঘুরতে নিয়ে যেতেন, রান্না করে মুখে তুলে খাওয়াতো। তাহলে? তাহলে কিভাবে বিশ্বাস করবে সে? সব থেকে বড় কথা। কোনো সন্তান তার বাবা-মার সম্পর্কে এসব শুনতে পারে কি?? কেউ বিশ্বাস করবে? তার মা অন্যের সংসার ভেঙেছে? এত.. এত টা নিচ?
শ্যামার কান্না শুনে জান্নাত দৌঁড়ে আসে। বোনটি তার মাথা চুল টেনে ধরে আছে। সারা শরীরে খামচে দাগ করে ফেলেছে৷ জান্নাতের মনে এক অজানা ভয় ঝেকে ধরলো। চুটে গিয়ে জান্নাত বোনের মুখটি দু হাতে ধরে ভয়ে ভয়ে বলল,
“এই এই আপু কি হয়েছে কাঁদছিস কেনো? কি হয়েছে বলো? ”
শ্যামা জান্নাতকে দেখে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“জান.. আমাদের মা.. আমাদের মা কারো সংসার ভাঙ্গতে পারে?”
এমন প্রশ্নে জান্নাতের কোনো ভাবান্তর হলো না। উল্টো বোনকে ছেড়ে দিলো সে, যেন এসব সে অনেক আগে থেকেই জানে। শ্যামা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো জান্নাতের মুখের দিকে। জান্না ঠোঁট নেড়ে শুধু বলল,
” আমি পানি আনছি তোমার জন্য আপু!”
এইটুকু বলেই বেড়িয়ে গেলো জান্নাত। অপলক চেয়ে রইলো শ্যামা। মনের কোনে বার বার কেউ বলছে, কিছু তো এমন আছে, যা জান্নাত জানে, শ্যামা জানেনা। কি সেটা?
শ্যামা একেবারে চুপ মেরে গেলো যেন। জান্নাতের স্বাভাবিক আচরণ হজম হচ্ছে না কিছুতেই। মাথার মাঝে কাঠপোকার মতো খুট খুট করছে এত এত প্রশ্ন। সেই মুহূর্তে একটি ঠান্ডা গলা ভেসে এলো শ্যামার কানে। শ্যামা ছল ছল চোখে গম্ভীর, দাম্ভিকপূর্ণ মুখখানায় চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“ইজহান? তুমি-ও কি তাই ভাবো? তোমার মায়ের মৃত্যুর পিছনে আমার মা দায়ি?”
ইজহান হঠাৎ এমন প্রশ্ন চুপ করে গেলো। নিস্প্রভ চাহনিতে চেয়ে রইলো শ্যামার কান্না করা মুখটির দিকে।
চলবে,