আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-৩২+৩৩

0
1289

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৩২।
দিন গড়াতে লাগলো। ইজহানের ভেঙে পড়েছে, গুটিয়ে নিয়েছে একদম নিজেকে। শ্যামা কাঁদে, তবু-ও নিজেকে সামলে ইজহানকে সময় দেয়। ইজহান এখন হুইল চেয়ার ছাড়া কোথা-ও যেতে পারে না। তেমনি একটা দিন আজ। ইজহানদের বাসার ছোট একটা শিশু পার্ক আছে। বাচ্চারা রোজ রোজ খেলতে আসে সেখানে ইজহান তার রুমের জানালা দিয়ে দেখে সামনে সেই বাচ্চাদের ছুটোছুটি গুলো। ইজহান মুগ্ধ নয়নে দেখে। মনে মনে আফসোস করে,

” ইশ.. তার যদি একটি ফুটফুটে বাচ্চা থাকতো?”

কিন্তু তা পূরণ হবার নয়! তাই ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে ইজহান। তখনি শ্যামা এসে দাঁড়ায় ইজহানের কাছে। ইজহানের কাধে হাত রেখে চোখের ইশরা দিয়ে বলে,

” ওখানে যাবে?”

ইজহান পার্কের বাচ্চাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাড়ী নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

” নাহ্!”

” কেন না? চলো তো ভালো লাগবে!”

” ইচ্ছে করছে না!”

” আরে চলো-ই না মজা হবে!”

বলতে বলতে হুইল চেয়ার ঠেলে বেড়িয়ে গেলো তারা। পার্কের সামনে এসে বাচ্চাদের দেখতে লাগলো। সবাই মিলে খেলছে। শ্যামা কিছু ভাবলো। বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলল,

” বাচ্চারা? আমাদের সাথে খেলবে?”

বাচ্চা হৈ হৈ আরো বেঁড়ে গেলো।

” হে খেলবো! কিন্তু কি খলবে?”

” কানামাছি খেলবো! চলবে?”

সকলেই এক্সাইটমেন্ট নিয়ে হাতে তালি দিলো। তারপর শুরু হলো বাটা বাটি। তখন ইজহান বললো,

” তোমরা খেলো? আমি দেখি!”

শ্যামা আর জোর করলো না। এইটুকুন এসেছে ইজহান এটাই ঢেড়। শ্যামা মাথা নেড়ে বাচ্চাদের দলে মিশে গেলো, যেন ছোট বাচ্চাদের সাথে এই মেয়েটি-ও বাচ্চা হয়ে গেছে। শ্যামা এবার বাটতে শুরু করলো,

” ওবু… দশ, কুঁড়ি, নাড়িভুড়ি, টেংরা মাছের চর্চরী, কে নিবে কত আনা বলে দাও না ভাই শুনি?”

শ্যামার বাটাবাটির কথিক শুনে বাচ্চারা হো হো করে হেসে দিলো। হাসলো ইজহান-ও। শ্যামার তা দেখে অনেক ভালো লাগলো। কিন্তু সে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে মুখ গম্ভীর করে বলল,

” এই এই তোমরা এভাবে হাসছো কেন? আমি কিন্তু খেলবো পরে!”

বাচ্চারা মুখ টিপে হেসে বলল,

” তোমার কবিতাটা জোস!”

শ্যামা একটু ঝুঁকে সেই বাচ্চার নাক টিপে বলল,

“তোমাকে শিখিয়ে দিবো এই জোস কবিতা কেমন? ”

বাচ্চাটি হেসে মাথা নাড়লো। তারপর আবার শুরো হলো বাটাবাটি। একেঁ এঁকে সব বাচ্চারা উঠে গেলো, চোর হলো শ্যামা। বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে চোখ বাঁধলো সে। শুরু হলো আবার ছুটাছুটি, হৈ-হুল্লোড়ের। সব বাচ্চার ইজহানের পিছনে লুকিয়ে গেলো। পুরো মাঠের বাচ্চারা চুপ। শ্যামা দু হাত অন্ধের মতো এদিকে অধিকে বার বার ছড়িয়ে যাচ্ছে, কাউকেই ধরতে পারছে না সে। শ্যামা কাউকে ধরতে না পেরে সোজা হেঁটে যেতে লাগলো। ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেয়ে হুমরি খেয়ে পড়ে গেলো ইজহানের উপর আর তার নরম তুলতুলে ঠোঁট স্পর্শ করে গেলো ইজহানের গ্রীবাদেশে। সাথে সাথে শক্ত করে ধরে ফেললো ইজহান শ্যামা। ইজহানের গরম ভাড়ী নিশ্বাস টের পেয়ে শ্যামা অবাক হয়ে গেলো। ইজহানের শারীরিক ত্রুটি কি আসলেই আছে? এটি নিয়ে এবার দ্বিধায় পড়ে গেলো। শ্যামার শরীরে স্পর্শে ইজহানের উত্তেজনা যেগে উঠতে দেখে দুজনেই হা হয়ে গেলো। একে অপরের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপরেই দুজনের মুখ থেকে মেদুর ছায়া দূর হয়ে গেলো। ইজহান খানিকটা লজ্জা পেয়ে লাল টুকটুকে হয়ে গেলো। তা দেখে শ্যামা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো,

” তুমি… তুমি… ঠিক হয়ে গেছো!”

ইজহান লাজুক মুখ লুকাতে ব্যস্ত। সেদিন শ্যামা খুশিতে ইজহানের রিপোর্ট নিয়ে ছুটলো হসপিটাল। মনের মাঝে তার আজ আতসবাজি ফোটানোর মতো শব্দ হচ্ছে। ইজহানের ফিকে মুখটি দেখতে এত কষ্ট লাগতো শ্যামা! আফসোস হতো খুব বার বার মনে পড়ে যেতে তার বাচ্চাটির কথা। এসব ভাবতে ভাবতে ডাক্তারের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো সে।দরজার হাতোলে চাপ দিতেই ভিতর থেকে ভেসে এলো এক পরিচিত কন্ঠ,

” আশা করছি ইজহানের শরীর মেডিসিন বেশিদিন কার্যকর হবে? নয়তো বুঝতেই পারছেন? আমার বাবা আপনার লাইসেন্স ক্যানসেল করবে তো করবেই তার উপর! আপনি বউ বাচ্চা হারা হবেন!”

ডাক্তার বলল,

” আপনি আমাকে দিয়ে এসব করিয়ে পার পেয়ে যাবেন? ভাবছেন? ভুলে যাবেন না, এই শহরের হবু এম পি সে!”

” আপনাকে অতশত বুঝতে হবে না। যা বলেছি, তাই করুন!”

ডাক্তার হতাশার শ্বাস শুনতে পেলো শ্যামা। ভিতরে এবার আরো কিছু কথা শোনা গেলো। শ্যামা প্রতিটি কথা রেকড করে নিলো আগে। তারপর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে চমকে গেলো সে,

” মেহরিন? তুমি?????”

চলবে,্

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৩৩।

” মেহরিন? তুমি?????”

মেহরিন ডাক্তারের দিকে ঘুরে বসেছিলো। শ্যামার কৌতূহল কন্ঠ শোনে ঘাবড়ে পিছনে তাকালো। চাপা হেসে বলল,

” আরে… শ্যামা… আমি? আমি ওই আর কি ডাক্তার দেখাতে!”

শ্যামা ভ্রু কুচকে বলল,

” কিন্তু আমি-তো অন্য কিছু শুনলাম!”

মেহরিনের সুন্দর মুখে যেন ঘন কালো মেঘ নেমে এলো। খানিক চুপ থেকে বলল,

” তো.. তুমি সব জেনেই গেছো?”

শ্যামা ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো। দু’হাত বেঁধে। মেহরিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ালো শ্যামার মুখোমুখি। তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়ে হাসলো সে,

” যেনেই যখন গেছো? তাহলে আর লুকিয়ে কি লাভ?”

শ্যামা সোজাসোজি পয়েন্টে এলো,

” তুমি না ইজহানকে ভালোবাসো? তাহলে? এসব কেন করলে? শুধু তাই না… তুমি.. তুমি আমার বাচ্চাটাকে-ও মেরে দিলে? কি দোষ ছিলো বাচ্চাটার? পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তুমি ওকে মেরে ফেললো!”

এ পর্যায় ধরে এলো গলা। মেহরিনের হাসি মিলিয়ে গেলো, বিড়বিড় করে বলল,

” ভালো-তো আমার মা-ও বাসতো মেহতাব আঙ্কেলকে, খুব ভালো.. অথচ কি পেলো! সারা জীবন অবহেলা। ”

শ্যামা অবাকথায় ডুবে গেলো,

” কি বলছো এসব?”

“সত্যি বলছি, আমার মা এশা, মেহতাব আঙ্কেল আর তোমার মার ভালো বন্ধ ছিলো। এতটাই যে এক প্লেটে খাবার খেতো। কিন্তু তোমার মা? ফাঁসিয়ে ফেললো মেহতাব আঙ্কেলকে, আমার মা অনেক কষ্ট পেয়েছিল। অথচ আমার মা… আমার মার পেটে আমি ছিলাম, মেহতাব আঙ্কেলের অবৈধ সন্তান। অথচ দেখো ভাগ্যের কি পরম ইতিহাস তোমার মমা আঙ্কেলকে ঠকালেন। মা ভেবেছিলো, এবার হয়তো মেনে নিবেন মেহতাব আঙ্কেল আমাদের, কিন্তু.. কিন্তু উনি নিজেই আমাকে নাজায়েজ বলে দিলেন। আমার মা এসব সইতে পারেনি। সে দেশ ছেড়ে চলে যান। আমার জম্মের পর মা আমাকে সব বলেন। আর মায়ের প্রতিশোধ নিতেই এত কিছু করা!”

শ্যামা বিস্ময় নিয়ে বলল,

” তাহলে তুমি ইজহানের বোন?”

“আমি কি এতখন উগান্ডার ভাষায় কথা বলেছি নাকি?”

শ্যামা শুকনো ঢুক গিললো,

” এমন-তো নয়? ইজহানের মা মারা যাওয়ার পিছনে তোমার হাত?”

মেহরিন বাঁকা হাসলো,

” আমার মা আমাকে সামলে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই আমার ছোট মামা আমাকে তাদের সাথে নিয়ে আসে, তাদের বাবা-মা বলেই ডাকি। আর একদিন জানতে পারি, ইজহানদের সাথে বাবা অনেক ভালো সম্পর্ক বাবার। নিজ বাবাকে দেখবো সেই লোভ৷ সামলাতে পারিনি আমি তাই ছুটে গেছিলাম সেদিন তাদের বাসায়। কিন্তু বাগির থেকে দুজন মানুষের ঝগড়ার আওয়াজে সেখানে থেমে যাই। মেহতাব আর তার স্ত্রী সানিয়া ঝগড়া করছে। তখনি জানতে পারি তোমার মা আবারো আমার সো কোল্ড পিতার সংসারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ইনফেক্ট এতো রাগ হয়েছিলো না। তাই তো? তাইতো আগুন টা সেদিন আমি ধরিয়ে ছিলাম। বয়সে ছোট হলেও ক্রাইম করার বুদ্ধি ছিলো আমার। সে জন্য-ই তো আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারে নি সেদিন ইজহানের মা আত্মহত্যা নয় খুন হয়ে ছিলেন।”

শ্যামার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো,

“সানিয়া আন্টি কি দোস করেছিলো?”

“কিছুই না.. উনি আমার সো কোল্ড পিতার সহধর্মিণী ছিলেন, আর আমার মা সারা জীবন সমাজের কাছে কলঙ্ক। তাই রাগে দুঃখে মেরে দিয়েছি ব্যস!”

যেন সামান্য কোনো ব্যপার মেহরিনের কাছে। শ্যামা চোখ-মুখে অবিশ্বাস্য ফুঁটে উঠেছে। সে বলল,

” আর ইউ মেড?”

মেহরিন হেসে ফেললো। রোলিংর চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল,

“মারতে তো তোমার মাকেও গেছিলাম, কিন্তু বেচারি তোমার বাবার কাছে এত অত্যচার সহ্য করতে না পেরে ভেগেছে, এই জন্য মায়া হলো জানোতো! তাই ছেঁড়ে দিলাম!”

শ্যামা এবার ভাষা হারিয়ে ফেললো। মেহরিন তখনি হিংস্র চাহনি নিয়ে তাকালো শ্যামার দিক। টেবিলের উপর রাখা ছুঁরিটা নিয়ে গেঁধে দিলো শ্যামার গলার উপর। আচমকা এমন এট্যাকে সামলাতে পাড়লো না শ্যামা। চোট খেয়ে আহ্ করে উঠলো। ক্ষত থেকে গল গল করে বেড়িয়ে আসতে লাগলো রক্ত।

” এই কি করছো তুমি?”

চিৎকার করলো শ্যামা। মেহরিন বলল,

” তুমি আমার সব সত্য যেন গেছো। যদিও তোমাকে-ও মারতাম। আমার সো কোল্ড বাবার পরিবার ধংস করে দিতাম। তা না হয় তোমার থেকেই শুরু হোক? মেরে তোমার প্রতিটি পার্টস বিলিন করে দিবো আমি!”

শ্যামা মেহরিনকে ধাক্কা মেরে দূরে সরাতে চাইলো,

“পাগল হয়ে গেছো, তোমার চিকিৎসা দরকার, ছাড়ো আমায়!”

মেহরিন ছাড়লো না গলার উপর আরো দাবিয়ে দিয়ে চিল্লিয়ে বলল,

” হ্যাঁ হয়েছি পাগল। তুমি কি জানবে? যে মেয়ে অবৈধ হয় তাকে কত কিছু সহ্য করতে হয়? জানবে না… কারণ তুমি তেমন সিচুয়েশনে ছিলেনা। ”

শ্যামা এবার সইতে না পেরে নিজের নখ দিয়ে মেহরিনের মুখে খামচি মারলো। সাথে সাথে ছিটকে গেলো মেহরিন। সেই সুযোগে শ্যামা পালাতে যাবে তখনি পিছন থেকে মেহরিন আবারো শ্যামাকে ধরে তার হাতে ছুঁড়ি ঢুকিয়ে দিলো। শ্যামা গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। ডাক্তার পাশেই বসে ভয় আধমরা। মেহরিন থেমে নেই যেন। ছুরি দিয়ে আবার আঘাত করতে যাচ্ছিলো তখনি একটি বলিষ্ঠ হাত মেহরিনের হাত ধরে নিয়ে ঠাটিয়ে এক চর বসালো। মেহরিন পিছনে তাকি চোখ বড় বড় করে ফেললো। ভয়ে ভয়ে বলল,

” ইজহান তুমি?” তুমি দাঁড়াতে পারো?”

তখনি পিছন থেকে হেসে উঠে অধিরাজ…,

“শুধু দাঁড়াতে নয়… দৌঁড়াতে-,ও পারে!”

মেহরিন তোতলাতে তোতলাতে বলল,

” কিন্তু তুমি তো?”

তখনি পিছন থেকে এক বয়স্ক কন্ঠ ভেসে এলো,

” তুমি চলো,ডালে, ডালে, আর আমরা চলি পাতায় পাতায়!”

চলবে,