#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৩৪।
মেহরিন এবার ভয়ে চুপসে গেলো। এক দলা কালো কুলেপ যেন মুখের মাঝে লাগিয়ে দিলো কেউ৷
” এসব কি বলছেন দাদিজান?”
শ্যামা এবার হেসে ফেললো,
“, বিষয়টা সিনেমেটিক্স হলেও সত্যি, মেহরিন। আমরা সব জেনে গেছি। ”
মেহরিনের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।
” আপনারা কি বলতে চাইছেন?”
শ্যামা শুরু থেকে বলল,
” ইজহানের এক্সিডেন্ট তুমি করিয়েছো। শুধু তাই নয়.. ডাক্তারকে দিয়ে কিসব ভুল ভাল বকিয়ে ছিলে সেদিন? মনে আছে তোমার?”
মেহরিন চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো। শ্যামা বলতে থাকলো,
” আমি কিন্তু সব রিপোর্ট পরের দিন-ই অন্য ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। তখনি সব সত্যি ক্লিয়ার হয়।”
মেহরিন এবার মুখ কঠিন করে ফেললো,
” হ্যাঁ করেছি..! সব আমি করেছি… বুঝলে? দাদিজানকে ধাক্কা দিয়ে আমি ফেলেছি, তোমার বাচ্চাকে আমি মেরেছি, ইজহানকে মারা চেষ্টা আমি করেছি। ইজহানের মাকে আমি খুন করেছি। হ্যাঁ সব আমি করেছি…!”
বলতে বলতে ফুপিয়ে উঠলো মেহরিন। আলিয়া অবিশ্বাস্য চোখে-মুখে বলল,
” সেদিন তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ছিলে?”
মেহরিন কিছু বলল না শুধু ফুপিয়ে গেলো। শ্যামা হতাশ শ্বাস ছাড়লো,
” অফিসার?”
বলতেই পুলিশ ঢুকলেন। থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। শ্যামা বলে,
” মেহরিন? তুমি যা করেছো তার জন্য তোমার শাস্তি পেতেই হবে!”
মেহরিন তখনো চুপ। পুলিশ যখন তাকে হাত কড়া পড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো, মেহরিন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
কিছু ঘন্টা পর….
শহরের আনাচে-কানাচেতে আজ কেমন যেন নিরবতা চলছে। গুমোটে ভাব। যেন সবাই অবরোধ করেছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে শুধু। ইজহানদের বাড়ির বাগানের পাশটায় বসে ছিলেন মেহতাব। চারপাশটা একবার নজর বুলিয়ে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি বড্ড শক্ত পোক্ত আর সমৃদ্ধ শালী মানুষ। বয়স প্রায় ৫০ এর উপর। তবু-ও স্ট্রং। মুখের গঠনটা-ও ইজহানের মতোই। জীবনে অনেক ভুল তিনি করেছেন। তার মাঝে একটি হচ্ছে সেদিন রাতের করা ভুল। আজিজুল, আফিয়া, এশা, আর মেহতাব। চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আফিয়াকে মেহতাব পাগলেররমতো ভালোবাসতেন। এতটাই… যে হাতের মাঝে সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে নাম লিখে ছিলেন। মেহতাব হাতের স্লীভ ভাজ করে দেখলেন আফিয়ার নামটি জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু? কিন্তু সেদিন… আফিয়া তাকে ছেঁড়ে যাওয়ার বছর দুয়েক চলছিলো। ইজহান তখন সবে গর্ভে এসেছিলো সানিয়ার। ডাক্তারের কাছ থেকে চেকাপ করিয়ে আসার সময় আজিজুল আর আফিয়াকে দেখেছিলো রাস্তার ধারে। পুরোনো প্রেম আবারো জেগে উঠে সেদিন রাতেই সে মাতাল হয়ে গেছিলো। উন্মাদ হয়ে গেছিলো। এশা-ই সেদিন তাকে সামলায়.. আর সেদিন মস্ত বড়ো ভুলটা করে বসে মেহতাব। বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। এত এত ঝামেলার কারণ যে, তার সেই করা ভুলটি আজ এত বড় কাল হয়ে দাঁড়ালো। সানিয়া-ও চলে গেলো, আফিয়া-ও এ জীবনে তার ভালোবাসা পাওয়া হলো না…! এসব ভেবেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুঠোফোনটি হাতে তুলে একটা নাম্বারে ডায়ল করলো সে…!
” এশা কোথায় আছে? খবর নাও আধ ঘন্টার মাঝে ওকে আমি চাই!”
ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল,
“ওকে!”
ফোন রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। যে ময়লা সে ফেলেছে? আজ তা পরিস্কার করতেই হবে! হাত বাঁধা অবস্থায় এক মাঝ বয়সি নারী বসে আছে ভাঙ্গা একটি রুমের মাঝে। সে আর কেউ নয়, এশা।
” আমাকে কেনো আনা হয়েছে এখানে?”
চিৎকার করলো সে। মেহতাব থমথমে গম্ভীর মুখে বলল,
” মেহরিন কি আমার সন্তান? ”
এশা ঘাবড়ে গেলো,
” কককি বলছো?”
” যা জিগ্যেস করছি? তার উত্তর দেও!”
এশা মাথার উপর বন্দুক রেখে জিজ্ঞেস করলো এদিক সেদিক মাথা নাড়িয়ে না করলো এশা। মেহতাব বলল,
” তাহলে… তাহলে এসব মিথ্যা কথা কেন বললে মেহরিনকে তুমি?”
এশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আই লাভ ইউ মেহতাব। ”
“ছিঃ! ”
নাক ছিকটালো মেহতাব!
” লজ্জা করে না? এসব বলতে? একটু-ও বিবেকে বাজে নাকি? মেহরিনকে তুমি… এক মাত্র তুমি আজ মানসিক রোগী বানিয়ে ছেঁড়েছো তা কি জানো?”
এশা অবাক হয়ে বলল,
” মেহরিনের কি হয়েছে?”
মেহতাব চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” তোমার করা পাপ গুলো প্রায়শ্চিত্ত করছে। তুমি… তুমি ওকে খুনি বানিয়ে দিয়েছো!”
এশার দুনিয়া সম্পূর্ণ উল্টে গেলো। মেহরিন আর খুনি? এশা চকিতে বলল,
” ও কাউকে খুন করতে পারে না!”
” করছে ডেমেড করেছে, আমার আমার সানিয়াকে মেরেছে, যাকে দ্বিতীয় বার ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আমি।”
এশার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। নেতিয়ে পড়লো যেন। বিড়বিড় করে বলল,
” আমার মেয়ে। আমার মেয়ে এত বড় আহুতি দিলো!”
মেহতাব ভ্রু কুচকে ফেললো,
” মানে?”
এশা ভাঙা কন্ঠে বলল,
” আফিয়ার সাথে তোমার সব ভিডিও গুলো আমি আর আজিজুল করেছিলাম। এবং কি আমিই সানিয়াকে দেখিয়ে ছিলাম সব। আর সানিয়া যখন সইতে না পেরে দরজা আটকে দেয়? তখনি আমি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম তার ঘরে। সানিয়া যেন বের হতে না পারে তার জন্য আমিই দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলাম বাহির থেকে। ইনফেক্ট, আফিয়ার মনে তোমায় নিয়ে বিষ আমি-ই ঢেলেছিলাম। সে তোমার ব্যবসার অবনতির জন্য নয়.. বরং আমার জন্য ছেড়ে গেছিলো। সেটাই তোমার অফিসে বলতে এসেছিলো সে দিন। কিন্তু তুমি তাকে বের করে দিচ্ছিলে? আর সে তোমাকে বোঝাবার জন্য চেষ্টা করছিলো। এক পর্যায় সে তোমার খুব কাছে আসে তাই কেপচার করে পাঠিয়েছিলাম সানিয়ার কাছে। আর এদিকে আজিজুল হক নিজেও আফিয়াকে ছাড়তে চাইছিলো। তাই দিজনে হাত মিলিয়ে এসব খেলা খেলে ছিলাম। কিন্তু কে জানতো? আমার মেয়ে এসবে ফেসে যাবে।”
মেহতাব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এই এক জীবনে ভালোবাসার মানুষ গুলোকে সে এভাবে হারালো। না আফিয়াকে পেলো না সানিয়াকে? মেহতাবের ভয়ংকর রাগ উঠে গেলো। পর পর ঠাটিয়ে কয়েকটা চর বসিয়ে দিলো। তাতেও রাগ কমলো না৷ মেহতাবের বন্দুকের সব কটা গুলি ঠুকে দিলো এশার মাথায়। রক্তাক্ত এশার সেখানেই মৃত্যু হলো। মেহতাব চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
এদিকে রিহাভসেন্টারের তিন তলার একটি রুমে মেহরিন শুয়ে ছিলো। তখনি তার কাছে একজন নার্স এসে ফোনটা এগিয়ে দিলো। যেটাতে একটা ভিডিও চলছিলো। মেহতাব আর এশার কথোপকথন। তা সব টুকু দেখে ভায়োলেন্ট হয়ে যায় মেহরিন। তার মা তাকে এত এত মিথ্যা কথা বলেছে? এসব দেখে আর সহ্য করতে পারলো না। তার রুম থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লো সে…
চলবে,