#আঁধারে_প্রণয়কাব্য
#পর্ব____১৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
“কাল রাত থেকেই সানাম দরজা বন্ধ করে বসে আছে বাবা। কিছুতেই দরজাটা খুলছেনা!”
সময় ব্যায় করলনা ফায়েয। ছুটে গেল সানামের শোবার ঘরের দিকে। ছটফট করতে লাগল সে। উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হয়ে ফায়েয দরজায় কয়েকবার টোকা মেরে বলল,
“সানাম শুনছেন? দরজাটা খুলুন।”
পাশ থেকে আফিয়া শিকদার চিন্তিত ও কান্না ভারী গলায় বললেন,
“এভাবে তাকে ডেকে লাভ নেই বাবা। তুমি বরং দরজা ভাঙার ব্যাবস্থা করো। সাইফা ও তার বাবাও তো বাড়িতে নেই, যে কারো সাহায্য নিব।”
ফায়েয এবার ব্যাপারটিকে গুরুতর ভাবে নিলো। কোনো অঘটন না ঘটলে নিশ্চয়ই সানাম এত ডাকাডাকির পরেও দরজা বন্ধ করে বসে থাকতনা। মাজরা কি জানতে হবে তার। বাইরে থেকে কয়েকজন লোক এনে ফায়েয দরজা ভাঙার ব্যাবস্থা করল। অনেক খাটাখাটুনির পর অবশেষে দরজা ভেঙে তারা রুমে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো। মুহূর্তেই দুজন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে গেল! বিছানায় উল্টে পড়ে আছে সানাম। পাশেই স্লিপিং পিলের পাতা। সেখান থেকে কয়েকটি স্লিপিং পিল নেই। আফিয়া শিকদার চিৎকার করে ওঠে সানামের পাশে বসলেন। সানামকে সোজা করে তিনি জ্ঞানহীন সানামের গালে চাপড় মেরে বলল,
“এটা কি করলি তুই মা? ঘুমের ঔষধ কেন খেলি?”
ফায়েয বিপর্যস্ত, বিমর্ষ। কপাল ঘঁষে সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“আন্টি এখন এসব বলে টাইম ওয়েস্ট করার সময় নেই। তাকে ইমেডিয়েটলি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।”
সানামকে ধরাধরি করে ফায়েয গাড়িতে ওঠিয়ে নিলো। আফিয়া শিকদার সানামের মাথার ঠিক পাশেই বসলেন। কান্নারত অবস্থায় তিনি অবিরত সানামের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। মনের দুঃখ থেকে তিনি আওড়াতে লাগলেন,
“এতো বছর পর মেয়েটাকে কাছে পেয়েও আমি তাকে দেখেশুনে রাখতে পারলাম না। ঘাঁ এখনও শুকালো না মেয়েটার। সেই তো আকাম ঘটিয়ে বসল। মায়ের মনে আর কত আঘাত দিবি তুই?”
ফায়েয ড্রাইভিং সিটে বসল। ঘর্মাক্ত, চিন্তিত ও ভীত মুখশ্রী নিয়ে সে পিছু ফিরে একবার জ্ঞানশূণ্য সানামের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,
“আমি কল তুলিনি বলেই কি আপনি এটা কাজটা করলেন সানাম? নাকি এর পেছনেও অন্য কোনো কারণ আছে? তবে যে কারণই থাকুক না কেন কাজটা আপনি মোটেও ঠিক করেননি।”
ফায়েয উর্ধ্বগতিতে গাড়ি ছেড়ে দিলো। মিনিট পনেরোর মধ্যে তারা আশেপাশের একটি প্রাইভেট হসপিটালে পৌঁছে গেল। সানামকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করানো হলো। অতিরিক্ত স্লিপিং পিল সেবনের দরুন তার ভেতরে ইনফেকশন হয়ে হাল করুন হয়ে গেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তাকে ওয়াশ করে কেবিনে দেয়া হলো। আপাতত স্যালাইন লাগানো তার হাতে। জ্ঞান এখনও ফিরেনি তার। সানামের অবস্থার উন্নতি দেখে আফিয়া শিকদার কিছুটা স্বস্তি পেলেন।
খবরটি শুনে সিফরা ও তার বাবাও হসপিটালে ছুটে এলো। মাস্টার্সের ভর্তি পরীক্ষার জন্য সিফরা তার বাবাকে নিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম গিয়েছিল। আজ সকালেই তাদের ফেরার কথা ছিল। এরমধ্যেই এতকিছু ঘটে গেল।
সানামের এই জীবননাশী পদক্ষেপ নেয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছিলনা কেউ। কারণ, সে গতকাল খুশি খুশিই বাড়ি ফিরেছিল। তবে এরমধ্যে সিফরাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল। গুমোট বেঁধে সে সবার থেকে দূরে দূরে থাকছিল! অপরাধ করার পর অপরাধীদের মধ্যে যেমন ধরা পড়ার ভয় কাজ করে তেমনি সিফরার মধ্যেও ঠিক সেই ভয়টাই কাজ করছিল! ফায়েয সেটা বেশ অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করে সিফরার মুখোমুখি দাড়ালো। সিফরার দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভড়কে ওঠল সিফরা। শুকনো গলায় শুধাল,
“কিছু বলবেন ভাইয়া?”
“এক্সাম কেমন হলো?”
“এইতো মোটামুটি।”
“তোমার আপু তো এখন মোটামুটি সুস্থ। তবুও তোমার চোখে-মুখে এত ভয় কেন?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফায়েযের। থতমত খেয়ে সিফরা বলল,
“আপু পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি তো ভয় থাকবেই ভাইয়া। ইট’স নরমাল।”
“বাট তোমার চোখ অন্য কথা বলছে! বাই দ্য ওয়ে, ভয় পেওনা। তোমার আপু আজই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। প্রে ফর হিম।”
সিফরার সামনে থেকে ফায়েয সরে দাড়ালো। সিফরা রুদ্ধশ্বাস ফেলল। চোখের কার্ণিশে জল ছুঁইছুঁই তার! বিরাট অনুশোচনা বোধ গ্রাস করতে লাগল তাকে। কি করে সে সানামের কাছে মুখ দেখাবে? সত্য যে আর চাপা নেই! কেউ না জানলেও অন্তত সিফরা তো জানে সানাম কেন হঠাৎয়ের মধ্যেই এই মরণনাশক সিদ্ধান্ত নিলো!
বিকেল অবধি সবাই অপেক্ষা করল। ফায়েযও সবার সাথে হসপিটালে রইল। অফিসের সমস্ত কাজ ফেলে রেখে সে সানামের পেছনে চুম্বকের ন্যায় চিপকে রইল। যেন দিন দুনিয়ার সবচেয়ে অবসর মানুষ সে। সানাম তাকে বেশ বড়ো সড়ো শোকই দিলো। ধাক্কা যেন সামলাতে পারছিলনা সে। ভীষণ ভাঙাচোরা অবস্থা তার।
প্রায় সন্ধ্যার দিকে সানামের জ্ঞান ফিরল। তার রিলিজ সম্পর্কিত কথাবার্তা বলার জন্য তার মা এবং বাবা রিসিপশনে গেল। সিফরা বাইরে দাড়িয়ে ঠায়। সানামের মুখোমুখি হতে বিরাট সংকোচবোধ কাজ করছে তার! ফায়েয কেবিনে প্রবেশ করল। দু-চোখের কোণ বেয়ে সানামের জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। কেমন বিষন্ন, নির্জীব, নিষ্প্রাণ অবস্থা তার। ফায়েয বিমূঢ় ও অপলক দৃষ্টিতে সানামের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশ্ন ছুড়ল,
“খুব শান্তি পাচ্ছেন, না? চোখের কোণে এসব আনন্দ অশ্রু?”
সানাম চোখমুখ খিঁচে নিলো। পূর্বের তুলনায় জলের ধারা দ্বিগুন গড়াতে লাগল। ফায়েয উদ্বিগ্ন হলো। প্রশ্ন ছুড়ল,
“কি সমস্যা আপনার?”
“আমি বাঁচতে চাইনা!”
“কারণ?”
“কোনো কারণ নেই। আমি জাস্ট বাঁচতে চাইনা।”
“কারণ ছাড়া কেউ নিজের মৃত্যু কামনা করেনা। বলে ফেলুন কি কারণ?”
“আমি এতো বোকা কেন? কেন বার বার মানুষ চিনতে ভুল করি?”
“আমি আবার কি করলাম?”
“আপনি নন।”
“তবে কে?”
“আছে কেউ একজন! আমি সত্যিই বাঁচতে চাইনা।”
“এই সামান্য কারণে আপনি নিজের মৃত্যু কামনা করছেন? আমি আপনাকে খুবই সাহসী, বুদ্ধিমতী ও ধৈর্যশীল মেয়ে ভাবতাম। এখন দেখি আপনি তার উল্টোটা।”
চোখ খুলল সানাম। নিশ্চল দৃষ্টি তার। বলল,
“আমার জায়গায় আপনি থাকলেও এটাই করতেন। সহ্য করতে পারতেন না।”
“বলেই দেখুন না। সহ্য করতে পারি কিনা তা পরে দেখা যাবে।”
“আপন পর সবাই আমাকে ঠকালো!”
ফায়েযের দৃষ্টি তৎপর হলো। তড়িৎ বেগে বলল,
“কি হয়েছে খুলে বলুন?”
সানাম অঝরে কেঁদে দিলো। অভিমানী গলায় বলল,
“কাল রাতে যদি আপনি আমার কলটা তুলতেন তবে আমার একা লাগতনা। দুঃখটা আপনার কাছে শেয়ার করে হালকা হতাম। মরণের পথ বেছে নিতে হতোনা!”
অপরাধবোধ হলো ফায়েযের। বুকে ভারী পাথর পড়ল এমন মনে হলো। ফায়েযের অহেতুক রাগের কারণে সানাম তার বিরুদ্ধে অভিমান, অভিযোগ করার সুযোগ পেল। সানামকে এই মুহূর্তে শান্তনা দেয়ার জন্য ফায়েয মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বলল,
“কাল অনেক ক্লান্ত ছিলাম। তাই কলটা তুলতে পারিনি। এখন বলুন না হয়েছেটা কি?”
সানাম এদিক ওদিক তাকিয়ে শুধাল,
“সিফরা কোথায়?”
“বাইরেই দাড়িয়ে।”
“তাহলে পরে বলব!”
ফায়েযের সন্দেহই ঠিক হলো। সিফরার সাথেই সানামের কিছু একটা হয়েছে। বিষয়টিকে বাড়ালোনা ফায়েয। রয়ে সয়ে শুনতে চাইল। হসপিটালে অন্তত কোনো বাড়াবাড়ি না হোক।
সানামকে রিলিজ দেয়া হলো। রাতের দিকে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল সবাই। সিফরা তখনও দূরে দূরে রইল। ভেতরে ভেতরে পাহাড় চিবাতে লাগল! কেউ এখনও জানতে পারলনা সানাম কেন আত্নহননের পথ বেছে নিতে চেয়েছিল। আফিয়া শিকদার রান্না বান্নায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা, ফায়েয এখানে আছে। খালি রুম পেয়ে ফায়েয সানামের রুমে প্রবেশ করল। সানাম বিছানায় শুয়ে। ফায়েয গলা ঝাকালো। সানাম চোখ খুলল। চেয়ার টেনে ফায়েয সানামের পাশে বসল। ধীর কণ্ঠে শুধাল,
“এবার বলুন ঘটনা কি?”
লাগামহীন গলায় দ্বিধা সংকোচ ভুলে সানাম বলল,
“স্পর্শ সিফরাকে ভালোবাসত এমনকি সিফরাও!”
ফায়েয হয়রান হয়ে গেল। উত্তেজিত গলায় শুধাল,
“সিরিয়াসলি?”
ক্ষত গাঢ় হতে লাগল সানামের। অকাতরে চোখের জল ফেলে বলল,
“হ্যাঁ। আমার সাথে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় স্পর্শ সিফরার সাথেও সম্পর্কে জড়িয়েছিল! যদিও সিফরাই স্পর্শকে তার প্রতি আকর্ষিত করেছিল!”
“ওয়েট ওয়েট। স্পর্শ যদি সিফরাকে ভালোই বাসত তাহলে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল কেন?”
ইতোমধ্যেই সিফরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে সে ছুটে এসে সানামের পায়ে ধরে বসল! অপরাধী ও অসহায় গলায় বলল,
“এখানে স্পর্শ ভাইয়ার কোনো ভুল ছিলনা আপু! তুমি মরা মানুষটাকে নিয়ে ভুল ধারণা মনে পুষে রেখোনা।”
ফায়েয শক্ত গলায় সিফরাকে বলল,
“তাহলে সত্যিটা কি তুমিই বলো?”
সিফরা ডুকরে কাঁদল। আশঙ্কিত গলায় বলল,
“আপুর সাথে স্পর্শ ভাইয়াকে আমার এক পলক দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল। তখন আপুর সাথে স্পর্শ ভাইয়ার মাখামাখো সম্পর্ক ছিল। তবুও আমি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছিলাম ভাইয়াকে নিজের করতে। ভাইয়া প্রথম প্রথম আমাকে পাত্তা না দিলেও পরে আমার প্রতি সিরিয়াস হয়ে যায়! এভাবে কয়েকমাস চলতে থাকে। এর মাঝখানে আপু ও ভাইয়ার বিয়েও ঠিক হয়ে যায়। তখন থেকেই স্পর্শ ভাইয়া আমাকে অস্বীকার করতে শুরু করে। পরে ভাইয়া আমাকে বুঝায়, আমরা যা করছি ভুল করছি। এই সম্পর্ক থেকে আমাদের সরে যাওয়া উচিত!”
সানাম হেয়ো হাসল। বাকরুদ্ধকর গলায় বলল,
“এরপর তোরা দুজন আলাদা হয়ে যাস। কিন্তু স্পর্শের মনে তুই সবসময় ছিলিস!”
“হয়ত বা! কিন্তু আমাদের ভালোবাসায় পাপ ছিল বলেই হয়ত স্পর্শ ভাইয়াকে জীবন দিতে হয়েছিল! আমার পাপে স্পর্শ ভাইয়া ধ্বংস হয়েছে। তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আপু। তবুও ক্ষমা চাইছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও!”
সিফরা কাঁদতে কাঁদতে রুমে থেকে বের হয়ে গেল। সানাম নির্বিকার। মানবমূর্তিতে পরিণত হলো। একটা দু’নম্বর ছেলের জন্য সে কিনা তার জীবনের পাঁচ পাঁচটা বছর নষ্ট করল? কত কষ্ট পেল, লাঞ্চনা ভোগ করল, কত ত্যাগ স্বীকার, কত লড়াই না করল। স্পর্শ না হয় বাইরের কেউ কিন্তু সিফরা তো তার আপন মায়ের পেটের বোন। সিফরা কিভাবে তার সাথে বেইমানি করতে পারল?
ফায়েযও নিশ্চুপ। সানামের দুঃখ সে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে উপলব্ধি করতে পারছিল। মৌনতা ভেঙে ফায়েয বলল,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
“বিন্দাস আছি। একদম ঠিকঠাক।”
“বাহ্ খুব শক্ত কথা বলতে শিখে গেছেন তো।”
“আরও শক্ত হতে হবে আমাকে।”
“কতটা শক্ত? আমার মন ভেঙেচূড়ে চুরমার করে দেয়ার মত শক্ত?”
“উঁহু। নিজেকে গড়ে তোলার মত শক্ত! আপনি তো আগেরই ভাঙাচোরা! আপনাকে আর কি ভাঙব?”
ফায়েয আলতো হাসল! মনের অজান্তেই সানামের নাক টেনে দিলো! বলল,
“বুদ্ধি খুলেছে তবে। আহাম্মক থেকে ইনটেলিজেন্ট!”
সানাম নাক ফুলালো। অভিমান ঝরা গলায় বলল,
“আমার নাক টানার শাস্তি কিন্তু ভয়ঙ্কর হবে!”
ফায়েয অধর বাঁকিয়ে হাসল। রসিয়ে বলল,
“শাস্তি কোনো ব্যাপার নয়। আমি আপনার ভয়ঙ্কর ভালোবাসা হতে চাই! এরজন্য আমাকে যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হলেও আমি করব। এই জাহানে আমার চেয়ে ভালো আপনাকে কেউ বাসতে পারবেনা।”
_________________________
“তোর কাছে ভালো কোনো ছেলে টেলে হবে?”
মনের আয়েশে সিগারেটে টান দিয়ে ফায়েয প্রত্যয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল। প্রত্যয় কপাল কুঁচকালো। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বেশ অস্বাভাবিক গলায় শুধাল,
“কেন? মেয়ের কি অভাব পড়েছে দেশে? গে দের মতো কথা বলিসনা!”
প্রত্যয়ের পাছায় লাথি মেরে ফায়েয বলল,
“শ্লা। বিয়ে করার জন্য নয়। বিয়ে করানোর জন্য।”
লাথি খেয়ে প্রত্যয়ের হুশ এলো। মুহূর্তেই ভাবভঙ্গি পাল্টে সে ঠোঁটের আলিজে মিচকে হাসি ফুটিয়ে তুলল। শার্টের কলার টেনে চুলটুল ঠিক করে বেশ পরিপাটি হলো। মেয়েদের মতো ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
“চোখের মাথা খেয়েছিস? আমাকে চোখে লাগেনা?”
#চলবে____?
#আঁধারে_প্রণয়কাব্য
#পর্ব____১৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“চোখের মাথা খেয়েছিস? আমাকে চোখে লাগেনা?”
অধর কোণে ক্রুর হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল ফায়েয। একটু মজা নেয়া যাক তবে। পাত্রীটা আসলে কে চট করে বলে দিলে প্রত্যয়ের সাথে মজা লুটা যাবেনা। অনেকদিন হলো প্রত্যয়ের পেছনে বাঁ হাত দেয়া হয়না! প্রত্যয়কে ঝাঁকিয়ে ফায়েয বাজিয়ে বলল,
“তুই প্রস্তুত?”
“একদম। শুধু ক্লিন শেভ করা বাকি!”
“কোনো তাড়াহুড়ো নেই। নিচের দিকেও একটু নজর দিস!”
ফায়েযের কু-ইঙ্গিত বুঝতে পারল প্রত্যয়। দাঁত কপাটি বের করে রসিয়ে বলল,
“অশ্লীল না?”
“ঐটাই তো মেইন!”
“যত্নেই রেখেছি।”
“কই দেখি!”
“শ্লা তোকে কেন দেখাব?”
দুজনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল! ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ফায়েযকে থামিয়ে প্রত্যয় হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,
“শ্লা থাম। আগে বল মেয়েটা কে?”
“মেয়ে যে-ই হোক, যেমন-ই হোক। মেয়ে পেলেই তো হলো তোর!”
“তা অবশ্য ঠিক। হাজার বছর পর তুই একটা কাজের কাজ করলি। তোর এই অসহায়, কাঙাল, দুস্থ বন্ধুটার দিকে মুখ তুলে তাকালি। আল্লাহ্ তোর ভালো করবে নে।”
প্রত্যয় পুরো সিরিয়াস। ফায়েযকে মন থেকে হাজার রকম দোয়া করতে ব্যাস্ত তখন। প্রত্যয়ের সাথে মজা নিতে ফায়েযের বরং ভালোই লাগছিল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলল দুজন। রাস্তার পাশে থাকা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো। আচমকা কপালে ভাঁজ পড়ল ফায়েযের। প্রয়োজনীয় কিছু একটা মনে পড়ল তার। বেগ পোহালোনা সে। বেশ তৎপর গলায় প্রত্যয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আচ্ছা নাবিল ভাইয়ার কি খবর?”
“আছে ভালোই। কেন?”
“ভাইয়ার সাথে কবে দেখা করাবি বল?”
“তুই কবে দেখা করতে চাস বল?”
“কাল বা পরশু?”
“ডান। কিন্তু কেন?”
“তোর বিয়ে। তোর ভাই তোর জন্য ঠিক করা পাত্রী দেখব না?”
“ওহ্ হ্যা। তা তো অবশ্যই!”
____________________
“আমি কেসটা তুলে ফেলতে চাই মিস্টার ফায়েয!”
শক্ত কণ্ঠ সানামের। কথায় কোনো রসকষ নেই। মুখে চরম লেভেলের কাঠিন্য ভাব। ফায়েয ভড়কালো। ঘুম থেকে ওঠেই তাকে কিসব হ য ব র ল কথা শুনতে হলো। তাও আবার উদোম শরীরে! চোখ থেকে ঘুম উবে গেল ফায়েযের। তড়িঘড়ি করে সে শোয়া থেকে ওঠে বসল৷ তার দৃষ্টির সম্মুখেই বুকে হাত গুজে দাম্ভিক ভঙিতে দাড়িয়ে সানাম। দৃষ্টি তার অন্যদিকে। ফায়েয হটকারি গলায় শুধাল,
“রাতে কি খেয়েছেন?”
“আপনাকে খেয়েছি!”
“কিহ্!”
“যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর!”
সানামের এই রূপের সাথে ফায়েয নতুনভাবে পরিচিত হলো। বিছানায় হাতে ভর দিয়ে বসল ফায়েয। বেশ আরাম করেই বসল। চোয়াল উঁচালো। কদাকার হেসে লাগামহীন গলায় বলল,
“ওহ হো চোখের সামনে ভার্জিন ছেলে দেখে মাথা একদম ঠিক নেই তাইনা? তাও আবার বিবস্ত্র শরীর! ফুটফুটে ফর্সা দেহ। বলিষ্ঠ শরীর। বাই দ্য ওয়ে আমি কিছু মনে করিনি। শুনতে ভালোই লাগছে। আরও কিছু অশ্লীল কথা বলুন, শুনি! সকাল টাইমে মুড এমনিতেও অন থাকে।”
ফায়েযের ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা। দৃষ্টি তার বেসামাল। সানামকে ঠিকঠাকভাবে তাতিয়ে দেয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায়। সানাম একটু আগেও ভাবেনি তার একটা কুচুটে কথার পরিবর্তে এতগুলো নির্লজ্জ কথা অনায়াসে শুনে যেতে হবে! সানামের দৃষ্টি খরতর। নাকের ডগা লাল হয়ে এলো। তবুও সে ফায়েযের দিকে ফিরে তাকালোনা। বরং ভ্রুদ্বয় কুঁচকে রুক্ষ গলায় বলল,
“একটু খেয়াল করলে হয়ত দেখবেন আমি আপনার দিকে এখনও ফিরেও তাকাইনি! বয়ে গেছে আপনার দিকে ফিরে তাকাতে।”
“বয়ে যায়নি। তবে যাবে! দেখবেন আমি ওয়ান টু কাউন্ট করতে করতেই আপনি আমার দিকে ফিরে তাকাবেন!”
সানাম হেয়ো হেসে বলল,
“হাহ্, শেগুড়ে বালি!”
“এই ফ্লোরে সা*প। রাসেলস ভাইপার!”
“কোথায় রাসেলস ভাইপার?”
সানাম চট করে ফায়েযের দিকে ফিরে তাকালো। শঙ্কিত গলায় বলল,
“ফাইজলামি পাইছেন?”
“ইশশ! ফিরে তাকালো ময়নাটা!”
সানাম রুখে এলো ফায়েযের দিকে। বিছানায় হাঁটু গেড়ে বসে ফায়েযের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
“আমি এখানে আপনার সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা বলতে এসেছি। ইয়ার্কি ফাজলামি করতে নয়।”
ফায়েয নিমগ্ন। সূক্ষ্ম ও নিঁখুত দৃষ্টি ক্ষিপ্ত সানামের দিকে নিবদ্ধ। রয়ে সয়ে ফায়েয বলল,
“কাছ থেকে দেখতে আপনি আরও সুন্দর। ইতিমধ্যে যদিও পৃথিবীর সব সুন্দর সুন্দর সৃষ্টিগুলো আমার দেখা হয়ে গেছে। তবে আপনাকেই ভালোবাসার চোখে এতটা কাছ থেকে দেখা বাকি ছিল! জন্ম আমার ধন্য করে দিলেন আপনি।”
“ধ্যাত আমি চলেই যাচ্ছি।”
বিরক্ত হলো সানাম। মুখের ভাব পাল্টালো। নিমিষেই ফায়েযের সম্মুখ থেকে প্রস্থান নেয়ার জন্য পেছন ঘুরল। ফায়েয তার সীমা বুঝতে পারল। যা একটু আগেই লঙ্ঘন করে ফেলেছে সে! শঙ্কিত হলো ফায়েয। তড়িৎ বেগে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাড়ালো। সটান হয়ে সানামের সামনে দাড়ালো। দুষ্টুমির ভাবভঙি পাল্টে সে বেশ তৎপর গলায় শুধাল,
“ওকে বলুন কি ইম্পর্ট্যান্ট কথা?”
“আমি কেসটা তুলতে চাই।”
“কারণ?”
“কার জন্য লড়ব আমি?”
“কেন? আপনার এক্সের জন্য।”
“এক্স মরে ভূত হয়ে গেছে। এমন দু-নম্বর লোকের জন্য আমি কোর্ট কাচারিতে দৌড়োদৌড়ি করতে পারবনা।”
“সিরিয়াসলি?”
“অমন অবাক হওয়ার কি আছে? স্বার্থপর মানুষের কথা আমি দু-বার ভাবিনা। আমি অতোটাও ভালো মানুষ নই।”
ফায়েয হয়রান হয়ে গেল। সানামের রূপ এবার খুলছে বলে! তবে ফায়েয এই বিষয়ে সানামকে প্রশ্রয় দিতে চাইলনা। বেশ ভেবেচিন্তে বলল,
“কেস তোলার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“কেন? জাস্টিস দেখাতে এসেছেন?”
“উঁহু। এখানে আমার স্বার্থ রয়েছে।”
“যেমন?”
“এখন আপনি কেসটা তুলতে গেলে আমার করা কেসগুলোও পুরোপুরি হালকা হয়ে যাবে।”
সানাম ভাবল। ফায়েযের এটুকু উপকার সে অনায়াসে করতেই পারে। সানাম সম্মতি প্রকাশ করল। বলল,
“ওকে। এজন্যই আপনার কাছে আসা।”
“এটা ফোনেও বলা যেতো!”
“কিছু বিষয় সামনাসামনি কথা বলে মিটমাট করা ভালো।”
“এতে মানুষটাকেও দেখা হয়ে গেল!”
“আবার শুরু করেছেন আপনি?”
“কি করব? আপনি করছেনই এমন কাজ। ঘুম থেকে ওঠেই আপনার মুখ দেখতে হচ্ছে। চলেন একসাথে ঘুমাই!”
সানাম কথা বাড়ালোনা। ফায়েযকে ধাক্কা মেরে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফায়েয হাসতে হাসতে সানামের পিছু নিয়ে বলল,
“আরে দাড়ান। কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাড়ি যাচ্ছি। আপনার মতো ঠোঁটকাটা লোক আমি বাপের জন্মে দেখিনি।”
ইতোমধ্যেই একটি ফর্সা, লম্বা দেখতে মেয়ে পাশের রুম থেকে বের হয়ে এলো। সানাম ও ফায়েযের মুখোমুখি হয়ে গেল। মেয়েটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সানামের আগা গোঁড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। অতঃপর ফায়েযের দিকে দৃষ্টি ফেলল। ফায়েয মেয়েটিকে দেখে চমকালো। বলল,
“তৃধা তুই?”
“মেয়েটা কে?”
“কখন এলি তুই?”
“আগে বলো মেয়েটা কে?”
“বেস্টফ্রেন্ড!”
ফায়েযের প্রত্যত্তুরে সানাম কেমন যেন আঘাত পেল! তৃধাকে ডিঙিয়ে সে ফায়েযের বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলো। শ্রেতাদের বাড়ি একবার যেতে হবে তাকে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।
তৃধা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। উতলা ফায়েযের দিকে দৃষ্টি ফেলল। প্রশ্ন ছুড়ল,
“খালি গাঁয়ে কেন তুমি? সিক্স প্যাকওয়ালা বডিটা সবাইকে দেখাচ্ছ?”
“এত ক্ষেপছিস কেন স্টু’পিট!”
ফায়েয রুমে ঢুকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। তৃধা অজানা কারণেই ফুলে ফেঁপে ওঠছিল। মুখশ্রী কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,
“এট অ্যানি কস্ট ঐ মেয়েটি সম্পর্কে আমার খোঁজ নিতে হবে!”
________________________
“ধ্যাত বেটা।। মেয়ে দেখাইতে আনছিস মেয়ে কই?”
প্রত্যয় আগাগোড়া ফিটফাট হয়ে রেস্টুরেন্টে ফায়েযের পাশে বসে ছটফট করছিল। ফায়েয ফোন চাপতে ব্যাস্ত। অমনোযোগী কণ্ঠে বলল,
“এত উতলা হচ্ছিস কেন?”
“তর সইছেনা। ব্রেকাপের পর নিজেকে কত সামলে রেখেছি জানিস?”
“আমার চেয়েও বেশি?”
ইতোমধ্যেই শার্টের হাতে গুটাতে গুটাতে নাবিল বেশ ব্যাস্ত ভঙিতে ফায়েযদের বুক করা টেবিলটির দিকে এগিয়ে এলো। ফায়েযদের সামনেই থাকা চেয়ারটি টেনে বসে সে অনর্গল বলতে শুরু করল,
“সরি সরি। তোদের অনেকক্ষণ অপেক্ষায় রেখেছি।”
নাবিলকে দেখে প্রত্যয় চমকালেও ফায়েয বেশ প্রস্তুতভাবে আলতো হেসে বলল,
“ইট’স ওকে ভাইয়া। আপনি আমার ডাক শুনে এসেছেন এইতো অনেক।”
“আরে কি বলো? এতো ফর্মালিটিস দেখাচ্ছ কেন?”
#চলবে_____?