আঁধার শেষে আলো পর্ব-০১

0
38
আঁধার শেষে আলো
আঁধার শেষে আলো

#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ১
#লেখিকা_দিশা_মনি

১.
“তোমার পেটে আমার নয়, অন্য কারো বাচ্চা। এই বাচ্চাকে আমি কিছুতেই নিজের বলে মানবো না।”

নিজের স্বামীর থেকে এহেন কথা শুনে চমকে উঠলেন মালতী খাতুন। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে বয়ে চললো নোনাজল। দীর্ঘ ৮ বছরের সংসার জীবনে এত আত্মত্যাগের পরও কিনা তার স্বামী তাকে বিশ্বাস করতে পারল না। মালতী খাতুন আজ চাইলেই নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে পারতেন কিন্তু তিনি বললেন না। শুধু নিজের স্বামীর উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“আমার উপর কি একটুও ভরসা করা যায় না? আমাদের এতগুলো বছরের সংসারের থেকেও কি তোমার কাছে ঐ মিথ্যা প্রমাণগুলো বেশি দামি?”

সিরাজুল মজুমদার পাষাণ স্বরে বললেন,
“নিজের চোখে দেখা সত্যকে আমি অস্বীকার করতে পারবো না৷ তুমি একজন ব্যভিচারী। আমার দেশের বাইরে অবস্থান করার সুযোগ নিয়ে তুমি অন্য একটা পুরুষের সাথে..ছি! আমার বলতেও লজ্জা করছে,তোমার সৌভাগ্য এটাই যে তুমি আমার ৫ বছর বয়সী মেয়ের মা, এজন্যই তোমার উপর দয়া করে তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি। নাহলে তো এই ব্যাভিচারের দায়ে আমার তোমায় মে**রে মাটিতে পুঁতে দেয়া উচিৎ ছিল।”

মালতী খাতুন আর কিছু বললেন না। শুধু নির্বিকার চেয়ে রইলেন। সিরাজুল মজুমদার তা দেখে রাগী কন্ঠে বললেন,
“এখনো দাঁড়িয়ে আছ কোন মুখে? বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”

মালতী খাতুন ধরে আসা গলায় বলেন,
“যাওয়ার আগে কি শেষবারের মতো একবার আমাকে সুরাইয়ার সাথে দেখা করতে দেবে?”

“খবরদার তোমার ঐ পাপী মুখে আমার মেয়ের নাম নেবে না। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।”

মালতী খাতুন বুঝলেন আজ আর তার কোন অনুরোধেই সিরাজুল মজুমদারের মন গলবে না। তাই তো তিনি আর কোন দাবি-দাওয়া না করে এককাপড়ে বেড়িয়ে এলেন নিজের স্বামীর ভিটে ছেড়ে। বের হওয়ার সময় তার বুক কেপে উঠল। কিন্তু পা থামল না এক মুহুর্ত। নিজের স্বামীর করা জঘন্য অপমানগুলো বহন করে তিনি বেরিয়ে এলেন মজুমদার বাড়ির বাইরে। বাইরে এসে চোখের জল মুছে বললেন,
“তুমি একদিন এসব কিছুর জন্য আফসোস করবে। মিলিয়ে নিও আমার কথা।”

মালতী খাতুন এগিয়ে চললেন এক অজানা গন্তব্যের উদ্দ্যেশ্যে। মনে করতে লাগলেন তার জীবনের একের পর ঘটনাগুলো। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে মালতী খাতুন। বাবা আর তিন ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন ছিলেন তিনি৷ এককথায় সবার চোখের মনি। বাবা-ভাইয়েরা চাইত মালতী খাতুন জীবনে অনেক সুখী হোক। তার সুখের কথা ভেবেই ধনাঢ্য এক বনেদী পরিবারে মালতীর বিয়ে ঠিক করেছিলেন তারা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মালতী যে মন দিয়ে বসেছিল তারই এক সহপাঠী সিরাজুল মজুমদারকে। আর তাই নিজের পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তার ভালোবাসার মর্মটা। কিন্তু মালতীর বাবা-ভাই কেউই তাদের এই সম্পর্কটা মেয়ে নেয় না। কারণ একে তো সিরাজুলের সাথে তাদের স্টেটাস মেলে না তার উপর সিরাজুলের বাবা এককালে মালতীর বাবার অফিসের কর্মচারী ছিল৷ এই বিষয়টাই তাদের ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মালতী এসব বাধা মানতে নারাজ ছিল৷ আর তাই তো পরিবারের অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে সিরাজুল মজুমদারকে। নিজের আদরের মেয়ের থেকে এহেন অবাধ্যতা সহ্য করতে পারেন মালতীর বাবা৷ আর তাই তো এই ঘটনার পরই তিনি স্ট্রোক করে সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। মালতী এসব জেনে তার বাবার সাথে দেখা করতে গেলে তার তিন ভাই এবং মা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মালতীর মা তো অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন যে জীবনে এক না এক দিন এর যথাযথ শাস্তি তিনি পাবেনই। আজ হয়তো তাঁর মায়ের সেই অভিশাপই ফলল।

ভাবতে ভাবতেই মালতী খাতুনের কান্নার গতি বাড়ল৷ মনে পড়ে গেল বিয়ের পরবর্তী জীবনের গল্প। মালতীর সাথে বিয়ের পরই যেন সিরাজুল মজুমদারের ভাগ্য খুলে গেল৷ হঠাৎ করে তিনি একটা ব্যবসা শুরু করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার ব্যবসা ফুলে ফেপে উঠল। শহরের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে উঠলেন তিনি৷ এরপর তাদের জীবনে এলো তাদের প্রথম সন্তান, সুরাইয়া বৃষ্টি। যে তাদের জীবনে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল যেন। সেই সুরাইয়াকে নিয়েই তাদের দীর্ঘ সুখের সংসার ভালোই কাটে। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎ তাদের জীবনে ঘনিয়ে আসে এক আঁধার। সিরাজুল মজুমদার এই ব্যবসার জগতে এসে অনেক শত্রু বানিয়ে ফেলেন। তাদেরই একজন সুমন পাটোয়ারী। এই সুমন পাটোয়ারীর শুরু থেকেই মালতীর দিকে কুনজর পড়েছিল যখন এক বিজনেস মিটিং এ তিনি মালতীকে দেখেছিলেন। তার এই খারাপ উদ্দ্যেশ্য বুঝতে সিরাজুল মজুমদারেরও বেশি বেগ পেতে হয় না। তাই তিনি মালতী খাতুনকে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই একদম বন্ধ করে ফেলেন তার নিরাপত্তার কথা ভেবে। কিন্তু শিক্ষিত মালতীর এই বন্দিদশা ভালো লাগত না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন আর তার ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেয়া। সেজন্যই তিনি লড়াই করে যান নিজের স্বামীর সাথে। এই থেকে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। মালতী খাতুন একপ্রকার সিরাজুল মজুমদারকে উপেক্ষা করেই একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যা সিরাজুল মজুমদারকে মনোক্ষুণ্ণ করে। এরপর একদিন সিরাজুল মজুমদারকে তার কোম্পানির কিছু জরুরি কাজে সিঙ্গাপুরে যেতে হয়। আর সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেই তিনি জানতে পারেন মালতী খাতুন মা হতে চলেছেন। এই বিষয়টাতে তিনি প্রথমে ভীষণই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন যখন তার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী সেই সুমন পাটোয়ারী তাকে কিছু ছবি পাঠায়। যেখানে মালতী খাতুন ও তার ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট ছিল। এসব দেখেই সিরাজুল মজুমদার মালতীকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেন। তিনি ভাবতে থাকেন এসব কারণেই মালতী তার অবাধ্যতা করেছে৷ আর এখান থেকেই তাদের সুন্দর সম্পর্কের চিড় ধরে। মালতী সিরাজুল মজুমদারকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এসব ছবি মিথ্যা কিন্তু তিনি কোন কথাতেই কান দেন না। অবশেষে আজ পরিস্থিতি সবথেকে তিক্ত হয়ে ওঠে যখন সিরাজুল মজুমদার তার সন্তানকে অস্বীকার করে তাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেয়!

মালতীর এখন একমাত্র ভরসা তার বান্ধবী শেফালী। কারণ সেই তার বিপদের একমাত্র সঙ্গী। মালতী শেফালীর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। শেফালী একজন বিধবা নারী যিনি একা এই শহরে বাস করছেন। ভালোবেসে বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় সড়ক দূর্ঘটনায় নিজের স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। তারপর থেকে একাই থাকেন। শেফালি একজন বিসিএস ক্যাডার এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ে চাকরি করছেন। মালতীর থেকে সব শুনে তিনি হতবাক হয়ে বলেন,
“তোর স্বামী তোকে বিশ্বাস করল না? এটা কেমন কথা?”

“আমি বুঝতে পারছি না শেফালি। যাকে ভালোবেসে একসময় আমি নিজের পরিবারকে ত্যাগ করেছিলাম আজ সে আমাকেই ত্যাগ করল।”

“দুঃখ পাস না মালতী। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আসলেই কি সব ঠিক হবে? এই প্রশ্নই আনাগোনা করতে থাকে মালতী খাতুনের মনে।

অন্যদিকে,
পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট সুরাইয়া মলিন চোখে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। সিরাজুল মজুমদার ক্ষিপ্ত হয়ে সবকিছু গোছগাছ করছেন। ছোট্ট সুরাইয়া কাদো কাদো স্বরে বলে,
“মম কোথায় ড্যাড? মমকে আমার কাছে এনে দাও না।”

সিরাজুল মজুমদার রেগে বলেন,
“মরে গেছে তোমার মম। আর একবারও ঐ মহিলার নাম আমার সামনে নেবে না।”

নিজের বাবার থেকে এমন ধমক খেয়ে ছোট্ট সুরাইয়া কাঁদতে থাকে। সিরাজুল মজুমদার আবারো ধমকে বলেন,
“এসব কান্না বন্ধ করো। তোমার সব জিনিস আমি গুছিয়ে নিয়েছি। আমরা এখনই এই বাড়ি, এই শহর এমনকি এই দেশও ত্যাগ করব।”

“কোতায় যাব আমরা ড্যাড?”

“সিঙ্গাপুরে। আমি চাই না ঐ ব্যাভিচারী মহিলার ছায়াও আর তোমার উপর পড়ুক। তাই আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব যেখানে ঐ মহিলা কখনোই তোমার নাগাল পাবে না।”

“আমি যাবো না।”

“চুপ, যেতে তোমাকে হবেই।”

এভাবেই জোরপূর্বক নিজের মেয়ে সুরাইয়াকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান সিরাজুল মজুমদার।

৯ মাস পর,
পৃথিবীতে এলো এক নতুন প্রাণ। মালতী খাতুন কোল আলো করে আজ জন্ম নিলো আরো একটি কন্যা সন্তান। শেফালি নিজ হাতে তাকে মালতীর কোলে তুলে দিয়ে বলল,
“তোর আবারো মেয়ে হয়েছে রে! কি নাম রাখবি ওর?”

মালতী খাতুন অনেক কষ্টে হেসে বলেন,
“ও শুধু আমার মেয়ে হয়ে আসে নি ও আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছে। আমি জানি একদিন এই মেয়েই আমার জীবনের সব আঁধার দূর করে আলো নিয়ে আসবে। তাই আমি ওর নাম রাখব “সুমাইয়া আলো” ”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨