#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ২
#লেখিকা_দিশা_মনি
মালতী খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন জানালার রেলিঙ ধরে। সময়ের পরিক্রমায় তার জীবনের অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। একসময়ের যুবতী নারী আজ মধ্যবয়সী নারীতে পরিণত হয়েছেন। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা, কিছু চুলেও ধরেছে পাক। মালতী খাতুন একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। হঠাৎ করেই নিজের প্রাণপ্রিয় বান্ধবী শেফালীর ডাকে পিছন ফিরে তাকালেন। শেফালী মালতীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“আয় খেতে আয়। কতক্ষণ আর এভাবে না খেয়ে থাকবি?”
“আমার এখন একদম খেতে ইচ্ছা করছে না রে।”
শেফালী উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন,
“এভাবে না খেয়ে থাকলে তো তোর শরীর খারাপ করবে। একটু কিছু খেয়ে নে। প্রতি বছরই তো এই দিনটা তুই এমন উদাসীন থাকিস।”
মালতী খাতুন অতীতের কিছু হৃদয়বিদারক স্মৃতি মনে করেন। তার দুচোখ অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে ওঠে। তিনি সেই চোখের জলটা মুছে নিয়ে বলেন,
“কি করব বল? হাজার চাইলেও যে ১৮ বছর আগের সেই দূর্বিষহ স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে যায় ভালোবাসার মানুষটার অবিশ্বাসের কথা। উনি কি আমার উপর একটু ভরসা রাখতে পারতেন না? আজ ১৮ বছর হলো ওনার থেকে আমি দূরে রয়েছি..আমার সুরাইয়া..আমার মেয়েটাকেও তো কতদিন থেকে দেখি না। আমার বুক জুড়ে কি হাহাকার সেটা আমি কিভাবে বোঝাবো বল?”
শেফালী সান্ত্বনা দিতে বলেন,
‘একদম চিন্তা করিস না। আল্লাহ যদি চায় তাহলে একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তুই আবারো তোর মেয়েকে ফিরে পাবি।’
“সেই আশাতেই তো বেঁচে আছি। আমার জীবনে এখন শেষ ইচ্ছা এটাই..শেষবারের মতো আমার বড় মেয়ে সুরাইয়াকে দেখা। তার কাছে নিজের সত্যটা প্রকাশ করা। ও যেন ওর বাবার মতো আমায় ঘৃণা না করে নাহলে যে আমি একেবারে শেষ হয়ে যাব রে।”
“তুই এত চিন্তা করিস না। আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি। তুই খেয়ে নে।”
“আচ্ছা, ও কোথায় রে?”
“আলোর কথা বলছিস?”
“হুম৷ কোথায় ও?”
“তোর আলো কি আর শান্ত হয়ে থাকার মেয়ে? ১৮ বছর হয়ে গেল তাও মেয়ের দস্যিপনা গেল না। দেখ কোন মাঠে হয়তো আবারো ক্রিকেট খেলতে চলে গেছে।”
মালতী খাতুন রাগান্বিত স্বরে বলেন,
“এই মেয়েকে আমি কতবার মানা করেছি তবুও যদি ও আমার কথা শোনে। এত বড় মেয়ে কিনা ছেলেদের সাথে মিলে ক্রিকেট খেলছে! লোকে কি বলবে?”
“ওকে এসব বলে কি কোন লাভ আছে? তুই তো জানিস ও কেমন।”
“না, এবার আমাকে ওকে আরো শক্ত হাতে মানুষ করতে হবে। এতদিন ওকে বেশি আদর, ভালোবাসা দিয়ে একদম মাথায় তুলে ফেলেছি। এবার ওকে মাথা থেকে নামাতে হবে।”
“তাহলে তুই কি করতে চাইছিস?”
“সামনেই তো ওর এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। আমি ভাবছি এরপরই ওকে কোন ভালো মেডিকেল বা ভার্সিটিতে এডমিশনের প্রেসার দিতে হবে। এমনিতে তো ছাত্রী হিসেবে ও খারাপ না। আশা করি ওর এইচএসসি রেজাল্টও ভালো হবে৷”
“কিন্তু ও যে ক্রিকেটার হতে চায়..”
“ও চাইলেই তো আর হবে না। আমি চাই ও জীবনে ভালো কিছুতে প্রতিষ্ঠিত হোক। ও আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছিল। তাই আমিও চাই ওর জীবন আলোকিত হোক।”
“স্বপ্নের বিরুদ্ধে গিয়ে কি আলোকিত জীবন পাওয়া যায়?”
“ও যেই স্বপ্ন বেছে নিয়েছে সেটা যে ওর জীবনে খুব একটা আলো ছড়াবে না সেটাও তো তুই জানিস।”
শেফালি দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন।
★★
“এই ৬..ইয়ে আমরা জিতে গেছি..”
বলেই আনন্দে মেতে ওঠে আলো। পরণে তার একটা গাঢ় লাল সালোয়ার কামিজ। এই সালোয়ার কামিজ পড়ে ক্রিকেট খেলেই সে একদম খেলা মাতিয়ে দিয়েছে৷ পাড়ার তাবড় তাবড় ছেলে প্লেয়ারদের হারিয়ে জিত হাসিল করে নিয়েছে। পাড়ার বাঘা প্লেয়ার আকাশের মুখে আঁধার নেমে এসেছে। আলো আকাশের সামনে গিয়ে ভাব দেখিয়ে বলে,
‘কি রে? কে যেন বলেছিল সে এই এলাকার বেস্ট প্লেয়ার..একটা সামান্য মেয়ে নাকি তাকে হারাতে পারবে না। তো তার ফটর ফটর হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল যে?’
এই অপমান হজম করতে পারল না আকাশ৷ রেগে কিছু বলতেই যাবে তার আগেই পেছন থেকে কেউ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“এই বলটা কে ছুঁড়েছে?”
আলো পিছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় স্যুট-কোট পরিহিত একজন সুদর্শন যুবককে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন বড় বিজনেসম্যান হবে। আলো তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্তির স্বরে বলে,
“আমি ছুঁড়েছি, কেন?”
এবার সেই যুবক ভীষণ রাগী স্বরে বলে,
“ইউ ইডিয়েট….তুমি জানো না, আমার কত বড় ক্ষতি করেছ।”
‘আপনার সাহস কি করে হলো আমায় ইডিয়েট বলার?’
“ইউ..তুমি জানো তোমার জন্য আমার গাড়ির দামি কাঁচ ভেঙে গেছ। এটার দাম কত জানো?”
“এসেছে টাকার গরম দেখাতে..তা বলুন কত টাকা আমি ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব..”
“বেশি না, মাত্র ২ লাখ টাকা।”
“ওহ দুই লাখ..অ্যাঁ!”
আলোর দুচোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এবার যুবকটি নিজের আইডি কার্ড আলোর হাতে দিয়ে বলে,
“এই যে আমার ঠিকানা। ২ লাখ টাকা জোগাড় হলে এখানে দেখা করে টাকাটা ফেরত দিয়ে এসো। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকলাম।”
বলেই সে অনেকটা ভাব দেখিয়ে চলে গেল। আলো যুবকটির যাওয়ার পানেই তাকিয়ে রইল। আকাশ যেন এই ঘটনায় সুযোগ পেয়ে গেল৷ সে বলল,
“মেয়েরা খেলতে এলে এমনই হয়! কোন না কোন দূর্ঘটনা ঘটাবেই। এজন্যই এদের খেলতে নিতে চাই না। মেয়েদের কাজ হলো ঘরদোর সামলানো৷ তা না করে চলে এসেছে ক্রিকেট খেলতে। আরে গাধাকে দিয়ে কি আর হালচাষ হয়।”
আকাশের কথা শুনে তার দিকে রক্তিম চোখে তাকায় আলো। চ্যালেঞ্জের সুরে বলে ওঠে,
“একদিন এই সামান্য মেয়েই বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের প্লেয়ার হবে৷ মিলিয়ে নিস।”
বলেই সে কিছুক্ষণ আগে দেওয়া যুবকটির আইডি কার্ডের দিকে তাকায়। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “স্মরণ চৌধুরী”
আলো তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
“একদিন এই টাকাটাও আমি সম্পূর্ণ ফেরত দেব। এটা আমার প্রতিজ্ঞা।”
★★★
সিঙ্গাপুরের এক বিশাল আকাশচুম্বী এপার্টমেন্টের একটি বিলাসবহুল রুমে দাঁড়িয়ে নিজের ডায়রিতে সযত্নে লুকিয়ে রাখা কিছু ছবি দেখছে একটি মেয়ে। বছর তার ২৩ এর কোঠায়। একটা ছবির উপর হাত বুলিয়ে তার চোখে জল চলে আসে। হাতের উল্টোপিঠে সেই জল মুছে নিয়ে মেয়েটি বলে,
“১৮ বছর..দীর্ঘ ১৮ বছর তোমায় আমি দেখি না মম। ড্যাড যাই বলুক না কেন, আমি বিশ্বাস করি আমার মম কখনো খারাপ হতে পারে না। এতগুলো বছর বাবার জেদের জন্য আমি তোমার থেকে দূরে ছিলাম৷ তবে এবার আর না। আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসছি মম।”
এরইমধ্যে হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে কেউ বলে ওঠে,
“এটা আমি কি শুনলাম বৃষ্টি? আপনি নাকি আমাদের মেডিকেলে জবটা ছেড়ে দিচ্ছেন। যা করছেন ভেবে করছেন তো? আমাদের মেডিকেল হলো এশিয়ার অন্যতম সেরা মেডিকেল। দেশ বিদেশের কতজন এখানে ইন্টার্নশিপ করার জন্য হাপিত্যেশ করে মরে আর সেখানে কিনা আপনি এখানে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছেন? তো এরপর কোথায় যাবেন?”
“বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট মেডিকেলে কথা হয়েছে। আমি সেখান থেকেই ইন্টার্নশিপ করব।”
“কি বাংলাদেশ? আর ইউ ম্যাড? এখানে এত ভালো সুযোগ ছেড়ে দিয়ে আপনি বাংলাদেশে যাবেন?”
“হুম। কারণ সেখানে আমার এখানকার থেকেও অনেক বেশি কিছু করার আছে।”
বলেই সে ফোনটা রেখে দেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨