আঁধার শেষে আলো পর্ব-০৩

0
41
আঁধার শেষে আলো
আঁধার শেষে আলো

#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ৩
#লেখিকা_দিশা_মনি

আলো বাসায় ফিরতেই আজ এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো। মালতী খাতুন, তার মায়ের যে নরম রূপ সে এত দিন ধরে দেখতে অভ্যস্ত আজ তার রাগী রূপও দেখে নিলো আলো। আলো বাসায় ঢুকতেই মালতী
খাতুন ক্রোধের সুরে বলে,
“আবারো ক্রিকেট খেলতে গেছিলি তুই?”

আলো ঢোক গিলে বলে,
“আসলে আম্মু..তুমি তো জানোই যে..”

মালতী খাতুন ইশারা করে আলোকে থামিয়ে দেন। অতঃপর চূড়ান্ত রেগে বলেন,
‘পাশের বাসার রাহেলা ভাবি আমায় কি বলছিল জানিস, আমার মেয়েকে নাকি আমি বেলাজ বানিয়েছি। এত বড় হয়েও সে নাকি পাড়ার ছেলেদের সাথে মিলে বেয়াল্লাপনা করে বেড়াচ্ছে। তাদের নাকি গতর দেখিয়ে বেড়াচ্ছে!’

আলো এই কথার তীব্র বিরোধিতা করে বলে,
“এসব কথা ঠিক নয়, আম্মু। আমি মোটেই এমন কিছু করিনি৷ আমি তো শুধু ওদের সাথে মিলে ক্রিকেট খেলেছি।”

“তোর কি বিবেক বলে কিছু নেই? এখনো কি তুই ছোট আছিস? ছোটবেলায় নাহয় তোকে কিছু বলতাম না ক্রিকেট খেলা নিয়ে কিন্তু তাই বলে এত বড় মেয়ে হয়ে তুই ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলবি? সমাজের লোক কি এটাকে ভালো চোখে দেখবে?”

আলো দুঃখ ভরা স্বরে বলে,
“আমি কি করব আম্মু? কোন মেয়েই তো ক্রিকেট খেলে না এই পাড়ায় আর তাই..”

“আর সেজন্য তুই ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলবি? এত বড় হয়েছিস তুই মাথায় কি বোধবুদ্ধি কিছু হয়নি? মেয়েদের কি এভাবে ছেলেদের সাথে মিলে ক্রিকেট খেলা শোভা পায়? দেখ আমি নারী অধিকারের বিপক্ষে নই কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি এধরণের কাজকে সমর্থন করব। তুই এখন একজন পরিপূর্ণ নারী হয়েছিস। তাই সমাজ তোকে সেভাবেই জাজ করবে। আর তুই যে এভাবে ছেলেদের সাথে খেলছিস ঐসব ছেলেদের মনে কি আছে তুই জানিস?”

আলো কিছুই বলতে পারে না। মালতী খাতুন একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“তুই এসব ক্রিকেট খেলা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দে। আগামী সপ্তাহেই তোর এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। আমার অনেক আগেই তোকে এসব বলা দরকার ছিল কিন্তু আমার মধ্যেও কিছু উদাসীনতা ছিল। যাইহোক আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোকে মেডিকেল ভর্তি কোচিং এ ভর্তি করাবো। তোকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই আমি৷ আমার এই কথাটা রাখ প্লিজ।”

আলো বলে ওঠে,
“কিন্তু আম্মু, আমি তো ডাক্তার হতে চাই না। আমি ক্রিকেটার হতে চাই।”

মালতী খাতুন আবারো রাগী সুরে বলেন,
“আমি এই বিষয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না। এই জীবনে আমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। আমি চাই তুই অন্তত জীবনে একটু সুখী হ। তাই তোর সুখের কথা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোকে ডাক্তার বানাবো। ”

“নিজের স্বপ্নের বিরুদ্ধে গিয়ে কি আমি সুখী হতে পারব আম্মু?”

“কিন্তু তুই যেই পথে সফলতার আশা দেখছিস সেখানে সফলতা পাবি তা কি তুই নিশ্চিত? আর যদিওবা সফলতা পেয়েও যাস তবুও সমাজের লোক তোকে বাকা চোখেই দেখবে। আমি তোকে এমন কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াতে দিতে পারব না। তাই আমি যা বলছি তাই শোন। কালকে আমি তোকে গিয়ে একটা মেডিকেল কোচিং এ ভর্তি করিয়ে আসব। তুই এবার পড়াশোনায় মন দে। এটাই তোর কাছে আমার শেষ ইচ্ছা।”

“আম্মু!”

“এবার ভেবে দেখ, তুই আমার এই কথা রাখবি কিনা।”

আলো এক অদ্ভুত দোটানার মধ্যে পড়ে। সে বুঝতে পারে না এই পরিস্থিতিতে সে কি বেছে নেবে? নিজের স্বপ্ন নাকি নিজের মায়ের ইচ্ছাকে? যেই মা তার জন্য জীবনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে!

★★
কয়েক দিন পর,
বৃষ্টি অবশেষে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছে আজকেই৷ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় ফিরেই সে এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করে নি। নিজেদের পুরাতন বাড়ি থেকে শুরু করে যতজন আত্মীয়ের কথা তার মনে ছিল তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করেছে শুধুমাত্র নিজের মায়ের খোঁজ করার জন্য। কিন্তু কেউই তাকে মালতী খাতুনের খোঁজ দিতে পারেনি৷ বৃষ্টি অনিশ্চিত ভাবে একটি ক্যাবে করে যাচ্ছিল রাস্তার মধ্য দিয়ে। তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল নানা চিন্তা। এত দূর থেকে বাংলাদেশে সে যেই উদ্দ্যেশ্যে এসেছিল সেটা কি তাহলে ব্যর্থ হবে? হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে বৃষ্টি বলে ওঠে,
“আমি কি তাহলে এত দূরে এসেও তোমার দেখা পাবো না মম? আমাদের কি তাহলে আর কখনো এক হওয়া হবে না? আর কখনো কি আমি আগের মতো তোমার ভালোবাসা পাবো না?”

বলেই সে চোখ বন্ধ করে ছোটবেলায় তার এবং তার মায়ের কাটানো কিছু সুন্দর মুহুর্ত মনে করে। হঠাৎ করেই তার কিছু একটা মনে হয়। তাই সে ক্যাব চালককে উদ্দ্যেশ্য করে বলে ওঠে,
“আমাকে একটু বিলীন অভয়ারণ্যের দিকে নিয়ে যাবেন?”

ক্যাব চালক বলে ওঠেন,
“কিন্তু ম্যাম, এটা তো ঢাকা থেকে অনেকটা দূরে। জায়গাটা বেশ নির্জন। যেতে অনেক সময় লাগবে।”

“কোন ব্যাপার না। ওখানে নিয়ে চলুন আমায় প্লিজ। প্রয়োজনে আমি আপনাকে প্রয়োজনের থেকেও বেশি ভাড়া দেব।”

“আচ্ছা, বেশ। যাচ্ছি।”

★★
মুখ কালো করে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আলো। বুক চিরে তার বেরিয়ে আসছে দীর্ঘ শ্বাস। নিজের করা কাজের জন্য নিজেরই আফসোস হচ্ছে। আলো নিজেই নিজের প্রতি অভিযোগ জানিয়ে বলল,
“কেন যে এত ভালো করে পরীক্ষাগুলো দিলাম! যদি আজ একটু খারাপ পরীক্ষা দিতাম তাহলে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না।”

এমন সময় আলোর কলেজের এক বান্ধবী তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল৷ সে আলোকে দেখেই বলে ওঠে,
“কি রে আলো! তোর মুখে এমন অন্ধকার কেন? ফেইল করেছিস নাকি? কোন ব্যাপার না, পরের বার পাস করবি। এই নে, মিষ্টি খা। আমি ৪.৫০ পেয়েছি, হি হি।”

বলেই সে আলোকে মিষ্টি খাইয়ে দেয়। আলো বিষন্ন স্বরে বলে,
“ফেইল করলে তো হয়েই যেত। আমি ফেইল করিনি।”

“তাহলে মুখটা এমন গোমড়া করে রেখেছিস কেন? জিপিএ পয়েন্ট কম এসেছে? কই দেখি তো রেজাল্ট।”

বলেই সে আলোর হাত থেকে তার ফোনটা নিয়ে নিলো৷ আর তারপর বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এ কি! তুই তো সব বিষয়েই A+ পেয়েছিস! এত ভালো রেজাল্ট করেও মুখটা গোমড়া করে রেখেছিস! পাগল নাকি তুই?”

আলো ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
“আমার অবস্থাটা তুই বুঝবি না! আজ যদি ফেইল করতাম কতই না ভালো হতো। এখন আমায় না চাইতেও মেডিকেলের জন্য পড়তে হবে আবার এখন চাইলেও মেডিকেল এক্সাম খারাপ দিতে পারব না কারণ আম্মুকে কথা দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এইচএসসি দেয়ার সময় তো কথা দেইনি, তাই রেজাল্ট খারাপ আসলে যদি কোনভাবে আমাকে এই ডাক্তারি পরা থেকে রেহাই পাওয়া যেত ভালোই হতো। এখন আমাকে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ডাক্তারি পড়তে হবে। ধুর। ভাল্লাগেনা।

বলেই সে সামনের দিকে চলতে থাকে। তার বান্ধবী পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে, ” কিরে এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?””

আলো পিছন ফিরে না তাকিয়েই বলে,”যাচ্ছি একটু শান্তির খোঁজে বিলীন অভয়ারণ্যের দিকে।”

“ও..একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আছিস। জায়াগাটা তো আবার বেশি ভালো না।”

“চাপ নেই, এখান থেকে তো কাছেই আছে।”

বলেই আলো যাওয়া শুরু করে। ছোটবেলায় তার যখনই মন খারাপ হতো তখন তার মা তাকে এই বিলীন অভয়ারণ্যে নিয়ে আসত। আজ বড় হয়েও আলোর মধ্যে এই স্বভাব থেকে গেছে। তাই তো সে বিষন্নতা কমাতে সেখানে যাচ্ছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨