#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ৪
#লেখিকা_দিশা_মনি
আলো বর্তমানে অবস্থায় করছে বিলীন অভয়ারণ্যের সামনে অবস্থিত একটি বিশাল বিলের সামনে। এই স্থানটায় এসে সে যেন অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পাচ্ছে। বিলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় আলো। চোখ বন্ধ করে ধীরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,
“আমার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন কি কখনোই পূরণ হবে না? মায়ের আবদারের কাছে কি হেরে যেতে হবে আমার স্বপ্নকে?”
আলো যখন চোখ বন্ধ করে এসবই ভাবছিল তখনই ধীর পায়ে হেটে ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়ায় অন্য একটি মেয়ে। সে আর কেউ নয় বৃষ্টি। বৃষ্টিও বিলের সামনে এসে চোখ বন্ধ করে বলে,
“আমি কি আর কখনো নিজের মম খুঁজে পাবো না? ছোটবেলার মতো আর মায়ের কোলে মাথা রাখতে পারব না? ভাগ্য কি এতটাই নিষ্ঠুরতা দেখাবে আমায়?”
দুই বোন,যাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক বিদ্যমান। আজ একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে। অথচ তারা একে অপরের সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল নয়। দুজনেই আজ ভিন্ন ভিন্ন উদ্দ্যেশ্যে আজ এখানে এসেছে। দুজনের প্রত্যাশাও ভিন্ন। তবে কি তাদের জীবন কেটে যাবে ভিন্ন পথ এর যাত্রী হিসেবে? নাকি কোথাও গিয়ে মিলবে তাদের দুজনের এই পথ?
আলো হঠাৎ করে চোখ খুলে নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে খানিক ভয় পায়। ডান পাশে ফিরে তাকাতেই বৃষ্টিকে দেখে চমকে ওঠে এবং সামান্য চিৎকার করে পিছিয়ে যায়। বৃষ্টিও চোখ খুলে আলোকে দেখে বলে,
“এনি প্রব্লেম?”
আলো এবার ভালো করে বৃষ্টিকে পরখ করে। লং জিন্সের সাথে টপস পরিহিত একটি মেয়ে। চুলগুলোও ছোট করে ছাটা। সাজপোশাক দেখে বেশ ধনী এবং আধুনিক পরিবারের মেয়েই মনে হচ্ছে। আলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলে,
“আসলে এই স্থানটা বেশ নির্জন তো…সচরাচর এদিকে কেউ আসে না। তাই হঠাৎ নিজের পাশে অন্য কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
বৃষ্টিও এবার চকিতে তাকায় আলোর দিকে। লাল সালোয়ার-কামিজ পরিহিত এই মেয়েটির এমন সহল সরল স্বীকারোক্তি তাকে মুগ্ধ করে। বৃষ্টিও স্মিত হেসে বলে,
“ওহ, বুঝলাম। তুমিও তাহলে এখানে একান্তে নিজের বিষন্নতা কমাতে এসেছ। কিছু মনে করো না, তুমি বলে ফেললাম। আসলে তোমাকে আমার থেকে বেশ ছোটই লাগছে আর..”
বলেই থেমে যায় বৃষ্টি। এই মেয়েটিকে একটু আগেই দেখল সে। তবে প্রথম দেখাতেই কেন জানি তার কেমন আপন আপন অনুভূতি আসছে। যেন মেয়েটি তার অনেক দিনের চেনা। আলো লাজুক হেসে বলে,
“না, কোন ব্যাপার না। আপনি আমায় তুমি করেই বলতে পারেন৷ কি বলুন তো,এই স্থানটা না আমার অনেক প্রিয়। আমার মন যখনই খারাপ হয় আমি এখানে চলে আসি নিজের মন ভালো করার জন্য। আর অদ্ভুত ভাবে আমার মন ভালো হয়েও যায়।”
“ওহ, আচ্ছা।”
বলেই বৃষ্টি নিজের ফোন বের করে। বারবার সিঙ্গাপুর থেকে তার বাবা সিরাজুল মজুমদার তাকে ফোন করছে। বৃষ্টি বরাবরের মতো এবারও ফোনটা রেখে দিল। অতঃপর মনে মনে বলল,
“বিগত ১৮ টা বছর ধরে তুমি আমাকে মমের কাছ থেকে দূরে রেখেছিলে ড্যাড। তবে এবার আর আমি তোমাকে সেই সুযোগ দেব না। একবার যখন আমি বাংলাদেশে আসতে পেরেছি তখন আমি মমকে খুঁজে বের করবোই।”
আলো হঠাৎ করে বৃষ্টির চেহারার দিকে খেয়াল করে তার উদাসীনতা টের পেয়ে বলে,
“আচ্ছা,আপনিও কি আমার মতোই কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”
বৃষ্টি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“হুম, জানো আমি অনেক দিন থেকে আমার খুব কাছের এক জন মানুষের থেকে দূরে রয়েছি। এত গুলো বছর তার থেকে দূরে থেকে আমি কে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছি তা বলে বোঝাতে পারব না কাউকে। আমার সেই আপনজনকে খোঁজার জন্যই তো ভীনদেশ থেকে পাড়ি জমালাম নিজের মাতৃভূমিতে। কিন্তু…”
আলো বুঝতে পারে তার সামনে দাঁড়ানো অতীব সুন্দরী এই রমনীর জীবনের কষ্টটা হয়তো তার থেকেও বেশি৷ সে তো নিজের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছে অথচ এই মেয়েটা কত দিন ধরে নিজের আপনজনকে খুঁজে চলেছে। নিশ্চয়ই এতগুলো বছর ধরে মেয়েটা মনে এক গভীর ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে৷ এসব কথা চিন্তা করেই আলো বৃষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আশা করি আপনি আপনার সেই কাছের মানুষ টাকে খুব শীঘ্রই খুঁজে পাবেন।”
আলোর কথায় বৃষ্টি কিছুটা ভালো অনুভব করে। অতঃপর আলোকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার নামটা কি?”
আলো স্মিত হেসে বলে,
“আমার নাম সুমাইয়া আলো। আর আপনার?”
“আমার নাম সুরাইয়া বৃষ্টি।”
আলো আবারো হেসে বলে,
“বাহ,আমার আর আপনার নামের মধ্যে কতই না মিল!”
বৃষ্টি বলে,
“তাই তো দেখছি।”
আসলে আলোকে মালতী খাতুন তার বাবা এবং বোনের ব্যাপারে কিছুই বলে নি। ছোট থেকে আলো জেনে এসেছে তার মা একজন সিঙ্গেল মাদার এবং তার একমাত্র সন্তান সে। বাবা সম্পর্কে যতটা জেনেছে যে তার জন্মের আগেই তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে, বৃষ্টিও জানে না তার মা প্রেগন্যান্ট ছিল এবং তার একটি বোন আছে। সে শুধু জানে তার বাবা আর মায়ের বিচ্ছেদের কথা। এজন্য দুই বোনই একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
এদিকে বৃষ্টি হঠাৎ করে বলে ওঠে,
“তোমার বাসা কি এখান থেকে কাছেই?”
“হ্যাঁ, এই তো। এখান থেকে সামান্য দূরেই।”
“ওহ।”
বৃষ্টি আর আলোর সীমিত আলাপ এখানেই শেষ হয়। এরইমধ্যে বৃষ্টির ফোন আবারও বেজে ওঠে। সে ভাবে হয়তো তার বাবা আবার তাকে ফোন করেছে কিন্তু ফোনটা হাতে নিতেই সে দেখে তার বাবা না অন্য কেউ ফোন করেছে। বৃষ্টি ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে বলে ওঠে,
“মিস সুরাইয়া বৃষ্টি বলছেন?”
“জ্বি,আপনি কে?”
“আমি এভারগ্রীন হসপিটাল থেকে বলছি। আজ তো আপনার এখানে ইন্টার্নশিপ কোর্সে জয়েন করার কথা ছিল। আজ তো ওরিয়েন্টেশন ক্লাস ছিল কিন্তু আপনি এলেন না। কোন সমস্যা হয়েছে কি?”
বৃষ্টি বলে,
‘আসলে কিছু সমস্যায় ফেঁসে গেছিলাম আর সেকারণেই…’
“ওহ৷ বুঝতে পেরেছি। যাইহোক, এরপরের ক্লাসগুলোয় আপনার উপস্থিতি কাম্য করছি।”
“জ্বি,আমি চেষ্টা করবো উপস্থিত থাকার।”
ফোনটা রেখে দেয় বৃষ্টি। অতঃপর সে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালো থেকো, আলো। আমায় এখন যেতে হবে।”
“আপনিও ভালো থাকবেন।”
একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা হাসি বিনিময় করে। অতঃপর বৃষ্টি আলোকে বলে,
“আর তুমিও এখান থেকে নিজের বাসায় যাও এখন। যায়গাটা বেশ নির্জন। এভাবে একা থাকা সেইফ নয়।”
“জ্বি,আমি এখনই ফিরব।”
বৃষ্টি ফেরার জন্য পা বাড়ায়। তবে চলে আসার সময় কেন জানি বারবার তার মনে হচ্ছিল আপন কারো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আলোরও কেন জানি বৃষ্টিকে ভীষণ আপন লাগে। তবে তাদের প্রথম দেখার সমাপ্তি ঘটে এখানেই।
★★
আলো বাড়িতে ফিরেই দেখতে পায় শেফালি বেগম অস্থির চিত্তে ছুটে বাইরে আসছেন। আলোকে দেখেই তিনি ক্রোধের সাথে ছুটে এসে বলেন,
“কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
“একটু বিলীন অভয়ারণ্যের দিকে গিয়েছিলাম৷ কেন?”
“তোর চিন্তায় চিন্তায় তোর মা অস্থির হয়ে গেছে। এখন তুই গিয়ে তোর মাকে শামলা।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨