আঁধার শেষে আলো পর্ব-০৫

0
34
আঁধার শেষে আলো
আঁধার শেষে আলো

#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ৫
#লেখিকা_দিশা_মনি

আলো রুমে এসেই দেখতে পায় তার মা বিছানায় শুয়ে আছে। আলো ভয়ে ভয়ে রুমে প্রবেশ করে। অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আম্মু, কিছু বলবে?”

কিন্তু বিপরীত দিক থেকে কোন উত্তর আসে না। আলো বলে,
“আসলে আমি একটু বিলীন অভয়ারণ্যের দিকে গেছিলাম। আমার রেজাল্টের ব্যাপারে জানো আম্মু? আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। তুমি খুশি হও নি?”

কিন্তু তবুও কোন প্রতিত্তোর আসে না। আলো এবার তার মায়ের হাত ধরে বলে,
“আম্মু, কিছু বলছ না কেন..”

এমন সময় সে উপলব্ধি করতে পারে মালতী খাতুন এর জ্ঞান নেই। আলো চিন্তিত হয়ে পড়ে। বলে ওঠে,
“কি হয়েছে তোমার আম্মু? তুমি কথা বলছ না কেন? শেফালি আন্টি..তুমি দেখো না আম্মু কেন জানি কোন রেসপন্স করছে না।”

শেফালি বেগম ছুটে আসেন। এসেই তিনি দেখতে পান মালতী খাতুন জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছেন। তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ মালতী খাতুনকে ডাকাডাকি করে বুঝতে পারেন এসব করে কোন লাভ হবে না। এজন্য তিনি বলেন,
“আলো, তুই তোর মায়ের পাশেই থাক। আমি দেখছি, কি করা যায়। মনে হয় তোর মাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিছুদিন ধরেই ও বলছিল ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না৷ আল্লাহই ভালো জানেন, কি হয়েছে।”

আলো কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ও আম্মু, তুমি চোখ খোলো না। আমি তোমার সব কথা মেনে চলব আম্মু। তুমি যা বলবে তাই করবো। দয়া করে চোখ খোলো আম্মু।”

এভাবেই এক তুমুল অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।

খুব শীঘ্রই এম্বুলেন্সে করে মালতী খাতুনকে একটি স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তার চিকিৎসা শুরু হয়।

★★
নতুন দিনের আগমন ঘটল পৃথিবীতে। কিন্তু আলোর জীবনে যেন এই ভোরের আলো এক উপহাস নিয়ে এলো। তার জীবনের একমাত্র আশার প্রদীপ, তার মার অবস্থা এখনো ঠিক হয়নি৷ ডাক্তার জানিয়েছেন, মালতী খাতুনের হার্টে অনেক বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন, যা এই সরকারি হাসপাতালে হবে না। এর জন্য তাদের কোন ভালো হাসপাতালে যেতে হবে। এসব শুনে যেন আলোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। শেফালি বেগম আলোর কাধে হাত দিয়ে বলেন,
“তুই এত চিন্তা করিস না, আলো। আমি দেখছি কি করা যায়।”

আলো বলে,
“তুমি তো আমাদের জন্য অনেক করেছ শেফালি আন্টি। আর কত কি করবে আমাদের জন্য?”

“এটা তুই কেমন কথা বলছি আলো? আমি কি তোদের পর? তোদের আপন ভাবি জন্যই তো সবসময় তোদের পাশে থাকার চেষ্টা করি।”

“সেটা আমি জানি, আন্টি। তবে এবার আমি আমার মায়ের পাশে থাকতে চাই। তার মেয়ে হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে চাই।”

“তুই এতটুকু একটা মেয়ে কি করবি?”

আলো চোখের জল মুছে বলে,
“জানি না। কিন্তু কিছু না কিছু তো করবোই। আম্মুকে সুস্থ করার দায়িত্ব এখন আমারই।”

অন্যদিকে,
এভারগ্রীন হসপিটালে নিজের প্রথম দিনের ক্লাস করতে এসেছে বৃষ্টি। তার চোখজুড়ে হতাশা। যেই উদ্দ্যেশ্য নিয়ে সে বাংলাদেশে পা রেখেছিল তার সেই আশা অপূর্ণই থেকে গেল! তবে বৃষ্টি এখনো আশা ছেড়ে দেয়নি৷ তার তীব্র বিশ্বাস সে তার মাকে আবারো খুঁজে পাবে।

এসব ভেবে আনমনে হাসপাতালের করিডর দিয়ে হেটে যাবার সময় হঠাৎ কারো একটা সাথে ধাক্কা খায় বৃষ্টি। তাল সামলাতে না পেরে সে যেই পড়ে যেতে নেবে এমন সময় কেউ হঠাৎ তাকে ধরে ফেলে। বৃষ্টি ভয়ে দুই চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। পড়ে যায়নি এটা নিশ্চিত হয়েই দুই চোখ মেলে তাকায় বৃষ্টি। আর তাতেই নিজের চোখের সামনে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা এক পুরুষ অববয়ের সাক্ষী হয় সে।

বৃষ্টি বলে,
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ..”

নিজের কথা শেষ করার পূর্বেই বিপরীত দিকে থাকা পুরুষটি তাকে বলে ওঠে,
“দেখে চলতে পারেন না? চোখ কি কপালে নাকি?”

বৃষ্টি কিছুটা অপমানিত বোধ করে তাই আর কিছু বলে না। এমন সময় একজন নার্স এসে বলে ওঠে,
“ডক্টর সৌরভ চৌধুরী, আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের দিকে চলুন৷ একজন নতুন পেশেন্ট এসেছেন ওনার অবস্থা বেশ খারাপ। আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন।”

কথাটা শোনা মাত্রই লোকটি দ্রুত কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়ালো। বৃষ্টি জানতে পারল বদরাগী ডাক্তার লোকটার নাম সৌরভ চৌধুরী এবং তিনি একজন কার্ডিওলজিস্ট। বৃষ্টি আর ব্যাপারটাকে বেশি পাত্তা দিল না৷ সে নিজের মতো নিজের ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল।

★★★
আলো উদাসীন মন নিয়ে মেইন রোড দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। একটু আগেই সে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে। দেশের সরকারি হাসপাতাল গুলোর বেহাল দশা সম্পর্কে সকলেই জানে। তেমনি আলোকেও ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে তার মাকে দ্রুতই কোন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আলো তখন জানতে চেয়েছিল বেসরকারি হাসপাতালে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য কিরকম খরচ লাগতে পারে। সেই সময় ঐ ডাক্তার স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে না পারলেও জানিয়েছেন কম করে হলেও ৫ লাখ টাকা তো লাগবেই।

এই কথা শুনে আলোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে৷ এত গুলো টাকা সে কিভাবে যোগাড় করবে? এটাই তার মূল চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

এদিকে যেতে যেতেই হঠাৎ আলোর নজরে আসে একটি বিলবোর্ড। যেই বিলবোর্ডে লেখা ছিল, “খুব শীঘ্রই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তঃক্লাবের Under-19 ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এজন্য চৌধুরী ক্লাবের পক্ষ থেকে তরুণ কিছু ক্রিকেটার খোঁজা হচ্ছে। অংশ নেওয়া প্রত্যেক ক্রিকেটারকে সম্মানী বাবদ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে এবং যদি তারা ম্যাচ জিততে পারে তাহলে দেয়া হবে ২ লাখ টাকার চেক।”

আলো অবাক চোখে বিলবোর্ডটা দেখে। তার কাছে যেন মনে হয় এটা তার জীবনে একটা নতুন আশার দ্বার খুলে দিয়েছে। আলো বলে ওঠে,
“এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে তো আমি খুব সহজেই অনেক টাকা রোজকার করতে পারি। সেটা দিয়ে মায়ের চিকিৎসার প্রায় অনেক অংশই বহন করতে পারব!”

কিন্তু আলোর চোখ আটকে যায় যখন সে দেখে এটা পুরুষদের টুর্নামেন্ট।

আলোর মনের মাঝে যে সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল তা যেন নিভে যায়! আলো একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বলে,
“তাহলে কি আমার আর কোন আশা নেই? মায়ের চিকিৎসার টাকা কি তাহলে আমি জোগাড় করতে পারব না?”

এমন সময় আলোর নজর যায় রাস্তার একপাশে দাঁড়ানো নাট্যদলের কিছু সদস্যর দিকে। তারা বিভিন্ন সাজসজ্জায় সজ্জিত ছিল। তাদের মধ্যে একজন পুরুষকে দেখে তার চোখ আটকে যায়। তাকে কেমন জানি সন্দেহভাজন লাগছিল। একটু পরেই সে নিজের মুখে লাগানো নকল দাঁড়ি-গোফ সরিয়ে নেয়। আর প্রকাশিত হয় এটা কোন পুরুষ নয় এক নারী যে ছেলে সেজেছিল। এটা দেখে আলোর মাথায় এক নতুন বুদ্ধি আসে। সে বলে ওঠে,
“মায়ের জন্য এটা আমায় করতেই হবে!”

*★★
চৌধুরী ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট লীগে অংশ নেয়ার জন্য যুবকদের বড় একটা লাইন লেগে আছে৷ সেখানে তারা সবাই একটা করে ফর্ম তুলছে। এরকমই সেই লাইনের মধ্যে থেকে এক তরুণ এগিয়ে আসে৷ ফর্ম বিতরণ করা পুরুষ জানতে চায়,
‘তোমার নাম কি?’

সে আলতো হেসে বলে,
‘আমার নাম আলু সর্দার।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨