#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ৬
#লেখিকা_দিশা_মনি
আলো পুরুষের ছদ্মবেশে ক্রিকেট খেলতে চলে এসেছে চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষ থেকে। নিজের এই ছদ্মবেশের সাথে বেশ সুন্দর একটি নামও নিয়েছে, “আলু সর্দার” এহেন মিথ্যা অভিনয় করার জন্য যদিও সে অনেক অনুতপ্ত কিনে নিজের মাকে বাঁচানোর জন্য এছাড়া যে তার হাতে আর কোন উপায় ছিল না। তাই আলো এই ছদ্মবেশেই ফরম পূরণ করে। মনে মনে বলে,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও মা, তুমি সব সময় বলতে সৎ পথে থাকতে। কাউকে না ঠকাতে কিন্তু আজ যে তোমার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য আমার আর কোন উপায় নেই।”
এরপর সে ফরমটা জমা দেয়। ফরম জমা দেবার পরই তাদের সবার প্রশিক্ষণের জন্য মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। যারা যারা ফরম তুলেছিল সবারই ব্যাটিং যোগ্যতা যাচাই করে দেখা হয়। এরমধ্যে অনেকে ভালো পারফর্ম করছিল তো অনেকের পারফরম্যান্স ছিল যথেষ্ট বাজে। এসব দেখে আলো অনেকটাই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। সে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বলে,
‘আমি কি পারবো নিজের সেরা পারফরম্যান্স টা দিয়ে টপ ১১ এ চান্স পেতে?’
এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য অবশ্য আলোকে খুব একটা অপেক্ষা করতে হয় না৷ একটু পরই আলু সর্দারের নাম ধরে ডাকা হয়। আলো ধুপধাপনি নিয়েই সামনে এগিয়ে যায়। তার মধ্যে এখন অনেক ভয় কাজ করছিল। নকল পরচুলা ও গোঁফটা সে আরো একবার হাত বুলিয়ে নেয়। মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে যেন এই ছদ্মবেশ কোন ভাবেই ধরা না পড়ে।
প্রথমে ভয় পেলেও মাঠে নেমেই নিজের সেরা পারফরম্যান্সটা দিতে থাকে আলু সর্দার মানে আমাদের আলো। একের পর এক ছক্কা হাতিয়ে নেয়। তার খেলার এই প্রতিভা দেখে তো সবাই হতবাক। কেউ কেউ তো বলাবলি করছিল,
“এই ছেলেকেই তো টিমের ক্যাপ্টেন করা উচিৎ।”
আলো মাঠ থেকে দারুণ পারফরম্যান্স করে আসতেই সবাই তার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে। কিছুজনের কাছে নামটা হাস্যকর লাগলেও এই নামের কারিশ্মাও সবাই বুঝতে পারে। খেলা শেষ হতেই আলো একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল যে সে টপ ১১ এ চান্স পাবে এবং হলোও তাই। আলোকে টপ ১১ খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন হিসেবে বাছাই করা হলো। আলো তো ভীষণ খুশি! নিজের এই খুশি সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিল না। ক্লাব কমিটির প্রধান আলোকে আলাদা করে ডেকে পাঠান। আলো যেতেই তিনি বলেন,
“ব্রাভো, তুমি যা পারফরম্যান্স দিয়েছ তা নিঃসন্দেহে আউটস্ট্যান্ডিং। আমি তো তোমার পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ। তোমার মতো হিডেন জেমসের খোঁজেই তো আছে বাংলাদেশ। তোমার খেলার যা সামর্থ্য দেখলাম তুমি তো চাইলে জাতীয় দলেও খেলতে পারো। তুমি কি আগে কখনো প্রফেশনালি খেলেছ?”
আলো পুরুষের গলা নকল করে বলে,
“কি যে বলেন না স্যার! আমি কিভাবে খেলবো। এটাই আমার প্রথম প্রফেশনাল ম্যাচ ছিল।”
“তোমার স্বরটা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
“এমন বলতে?”
“কেমন মেয়েদের মতো।”
আলো ভয় পেয়ে বলে,
“আসলে..গলাটা একটু খারাপ..”
“ও বুঝেছি। চিন্তা করতে হবে না। তবে তোমার নামটা কিন্তু ভীষণ ফানি আলু সর্দার। আর হ্যাঁ শোনো, তোমাকে কিন্তু চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন করা হলো। আশা করি কালকের আন্তঃক্লাব ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তুমি ফাটিয়ে খেলবে।”
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
“আর হ্যাঁ, এই নাও টিমের সদস্য হিসেবে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া ক্যাপ্টেন হবার জন্য ১০ হাজার টাকা বোনাসও দিয়েছি। কাল যদি ম্যাচটা জেতাতে পারো তাহলে আরো ২ লাখ টাকা পাবে।”
আলোর চোখ চকচক করে ওঠে। সে টাকাটা নেয়। সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায় কারণ সে এবার তার মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবে।
★★★
টাকাটা হাতে পাবার পরই দ্রুত মালতী খাতুনকে সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে শিফট করানোর ব্যবস্থা করে আলো। ডাক্তারের পরামর্শে সে মালতী খাতুনকে শহরের অন্যতম হাসপাতাল এভারগ্রীন হসপিটালে শিফট করিয়েছে। আপাতত ভর্তি বাবদ ৩০ হাজারের মতো টাকা লেগেছে। বাকি টাকাটা লাগবে অপারেশনের পর। আলো একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ কালকের ম্যাচটা তাকে জিততেই হবে যেকরেই হোক। তার মায়ের জন্য। এদিকে শেফালি বেগম আলোকে রাতারাতি এত টাকা জোগাড় করতে দেখে কিছুটা ভড়কে যান। তিনি আলোকে জিজ্ঞেস করেন,
“তুই এত টাকা কোথায় পেলি আলো? সত্যি করে বল তো তুই কি কোন খারাপ কাজ..”
আলো বলে ওঠে,
“না আন্টি। তুমি যেমন ভাবছ তেমন কিছু নয়। আমি পরে তোমাকে সব বুঝিয়ে বলব। তবে এখন এটুকু জেনে রেখো আমি কোন অনৈতিক কাজ করিনি। যদিওবা খুব একটা সৎ কাজও করিনি!”
শেষের কথাটা ভীষণ ধীর স্বরে বলে আলো।
এরইমধ্যে শেফালি বেগম বলেন,
“আচ্ছা, তোর উপর ভরসা রাখলাম। এখন যা বাড়িতে গিয়ে একটু রেস্ট নে। সারাদিন তো কম ধকল গেল না তোর উপর দিয়ে।”
“মায়ের এই অবস্থায় আমি বিশ্রাম নিতে পারব না।”
“আচ্ছা, তাহলে একটা কাজ কর, সারাদিন তো বোধহয় কিছু খাস নি৷ মুখটা শুকিয়ে আছে। এই নে এখানে ২০০ টাকা আছে, হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে গিয়ে কিছু খেয়ে আয়।”
“আন্টি..”
“না, আর কোন কথা শুনব না। যা গিয়ে খেয়ে আয়।”
আলো আর অমত করে না। সে হাসপাতালের ক্যান্টিনে দিকে অগ্রসর হয়। ক্যান্টিনে গিয়ে সে খাবার অর্ডার দেয়। তার কিছু সময় পরই এক পরিচিত মুখ তার ঠিক সামনাসামনি এসে বসে। সে আর কেউ নয় বৃষ্টি। দুজনেই দুজনকে দেখে অবাক হয়,
“আপনি!”
“তুমি!”
আলো মলিন হেসে বলে,
“আমার মা ভীষণ অসুস্থ আপু। এই হাসপাতালেই ওনাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছি।”
বৃষ্টি বলে,
“আমি তো এই মেডিকেলেই পড়ছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
“শোন, কোন প্রয়োজন হলে আমায় বলবে। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করবো।”
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।”
” শুনেছিলাম পৃথিবীটা গোল। আজ তার প্রমাণও পেলাম।”
এরপর কিছু টুকটাক কথা বলে বৃষ্টি আলোকে নিজের নাম্বার দিয়ে বলে,
“কোন প্রয়োজন হলে এই নাম্বারে কল দিও। আমার একটা জরুরি ক্লাস আছে। আমায় এখন যেতে হবে।”
“আচ্ছা।”
এরপরই বৃষ্টি নিজের ক্লাসের দিকে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
“ইশ, কত দেরি হয়ে গেল।”
এভাবে একটু পর সে ক্লাসে পৌঁছে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
“মে আই কাম ইন স্যার?”
এমন সময় তার একটি পরিচিত কন্ঠস্বর বলে ওঠে,
“নো, আগে পাংচুয়ালিটি শিখে আসুন। তারপর আমার ক্লাসে আসবেন।”
কঠোর স্বরে বলা কথাটি আর কারো নয় বরং ডাক্তার সৌরভ চৌধুরীর। বৃষ্টি আঁটোসাটো হয়ে বলে,
“স্যার আসলে..”
“নো এক্সকিউজ। স্টেই হিয়ার কোয়াইটলি।”
বৃষ্টি আর কিছু বলতে পারে না। একটু পরই সৌরভ চৌধুরী নিজের ক্লাসের শেষ করে ক্লাস থেকে বের হতে হতে বৃষ্টিকে বলে,
“এরপর থেকে যেন আপনাকে সঠিক সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হতে দেখি৷ আমার নজর আপনার উপরেই থাকবে। ”
বলেই সে চলে যায়। বৃষ্টি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ক্লাসে প্রবেশ করে।
এদিকে সৌরভ চৌধুরী বাইরে আসতেই তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা “মাই ডিয়ার ইওঙ্গার ব্রাদার” নামটা দেখেই সে হেসে ফোন রিসিভ করে বলে,
“হ্যাঁ, ভাই বল।”
বিপরীত দিক থেকে ডাক্তার সৌরভের ভাই স্মরণ চৌধুরী বলে ওঠে,
“ব্রো, তুমি তো নিজের মতো প্রফেশন বেছে নিলে আর আমায় ফেললে দুনিয়ার বিপদে।”
“মানে?”
“কাল আমায় আবার চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের ক্রিকেট ম্যাচের পুরোটা সময় ক্রিকেট গ্রাউন্ডে উপস্থিত থাকতে হবে। উফ! এমনিই বিজনেসের কাজে বাঁচি না তার উপর..”
“এটাও তো একটা বিজনেস ছোট ভাই। চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের ওনার তো আমরাই।”
“তা ঠিক৷ কিন্তু তুমি তো জানো আমার এসব খেলাধুলায় আগ্রহ নেই। তুমি একটু বাবাকে বোঝাও না যাতে কাল আমায় জোর না করে।”
“আমি মেজ চাচুকে কিছু বোঝাতে পারব না। তাই আমায় বলে লাভ নেই। ”
স্মরণ একটা হতাশার শ্বাস ফেলে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨