আঁধার শেষে আলো পর্ব-০৭

0
36
আঁধার শেষে আলো
আঁধার শেষে আলো

#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ৭
#লেখিকা_দিশা_মনি

আলো আজ আবারো আলো সর্দারের ছদ্মবেশে মাঠে নেমেছে ক্রিকেট খেলার জন্য। আজ তার সংকল্প একটাই যে, তাকে যে কোন ভাবেই হোক এই ম্যাচটা জিততেই হবে। যাতে করে তার মায়ের অপারেশন করার জন্য প্রাথমিক ভাবে টাকাটা জোগাড় করতে পারে।

আলো আজ সবার শেষে মাঠে নেমেছে। তার হাতে টার্গেট ছিল দুই ওভারে ২৬ রান করা। আলোর উপর অনেক চাপ ছিল কিন্তু মাঠে ব্যাট করতে নেমেই সে প্রথমেই একটা ছক্কা মারে। এরপর পুরো ওভার জুড়ে ১৪ রান করে তফাত টা ১২ তে এনে ঠেকায়। এবার দরকার ছিল বাকি এক ওভারে ১২ রান করা। আলো অনেকটা আত্মবিশ্বাসী ছিল এবার। তবে এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় ওভারে প্রথম দুই বলে সে এক রানও করতে পারে না। চিন্তা বাড়ে। আলো মনে মনে বলে,
“এভাবে চলতে থাকলে তো হবে না। আমায় আরো ভালো পারফরম্যান্স করতে হবে।”

এরপর তীব্র সংকোচ নিয়ে তৃতীয় বলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে আলো৷ তৃতীয় বল আসতেই একটা চার মে*রে সে নিজের উপর চাপ কমায়। এখন তার টার্গেট ৩ বলে ৮ রান করা। তবে আলোর উপর চাপ বাড়ে যখন পরপর দুই বলে সে মাত্র ২ রান করতে পারে। আলোর দীর্ঘ শ্বাস বাড়ছিল। এবার তাকে মাত্র ১ বলে ছক্কা মারতেই হবে। তাহলেই ম্যাচ জিততে পারবে। চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থকদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। বিপরীত টিম “বসুন্ধরা ক্লাব” এর সদস্যরা ততক্ষণে উল্লাসও করতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ ১ বলে ৬ রান করা অসম্ভব না হলেও এর সম্ভাবনা ভীষণই কম। এত কিছুর মধ্যেই চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে স্মরণ চৌধুরী ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত হয়ে গেছে। সে দূর থেকেই আলু সর্দার নামক প্লেয়ারটিকে পরখ করে নিচ্ছে। সে যতদূর শুনেছে ক্লাবের সদস্যদের মুখে এই ছেলেটা বেশ গুণবান। এবার সেটাই দেখার পালা যে সে কেমন পারফরম্যান্স করে। সবাই যখন আশা ছেড়ে দিচ্ছিল তখন স্মরণ চৌধুরী আলু সর্দারের চোখে এক অসম্ভব আত্মবিশ্বাস দেখতে পায়। এরইমধ্যে বিপরীত টিমের সদস্যের করা একটি বল ধেয়ে দেয় তার দিকে। আলু সর্দার তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলটিকে আঘাত করার জন্য ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বলটি কাছে আসতেই জোরে একটা আঘাত আনে এবং কাকতালীয় ভাবে ৬ রান করে গেমটি জিতে নেয়।

একটু আগে স্তিমিত হওয়া চৌধুরী স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থকরা একদম উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সবাই মিলে চিৎকার করতে থাকে। টিমের অন্য প্লেয়াররা আলু সর্দার তথা আলোকে অভিনন্দন জানাতে থাকে। আলু ভীষণ খুশি হয়। এবার সে ২ লাখ টাকা পেয়ে সহজেই নিজের মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবে। এদিকে স্মরণ চৌধুরীও এগিয়ে আসে। আলু সর্দারের ভীষণ কাছাকাছি আসতেই তার কাছে মনে হয়, ভীষণ চেনা চেনা লাগছে এই যুবককে। যেন আগে কোথাও দেখেছে।

★★
খেলা শেষে প্লেয়ারদের জন্য বরাদ্দ নিজস্ব রুমে অবস্থান করে আলো। সেখানে সে একাই ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে পরচুলা আর নকল দাঁড়ি-গোঁফের কারণে বিরক্ত থাকা আলো কেউ নেই দেখে এগুলো খুলে রাখে। আর এটাই ছিল তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। কারণ ভুল বশত সে আগে থেকেই দরজা খোলা রেখেছিল। স্মরণ চৌধুরী আলু সর্দারের খেলায় মুগ্ধ হয়ে তার সাথে কথা বলার জন্য রুমে চলে আসে। এমন সময় আলোকে দেখে সে চিৎকার করে ওঠে। আলো হতবাক হয়ে তাকায় স্মরণ চৌধুরীর দিকে। স্মরণ চৌধুরী আলোকে দেখে বলে,
“তুমি সেই মেয়েটা না যে সেদিন ঐ ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশে আমার গাড়ির কাঁচ ভেঙে ছিলে? তুমি এখানে কি করছ?”

আলোও হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্মরণ চৌধুরীর দিকে। তার চোখে জল টইটুম্বর করছিল। তাহলে কি এখানেই তার সব আশা শেষ হয়ে যাবে?

স্মরণ চৌধুরী এগিয়ে এসে বলে,
“তার মানে তুমি ছেলের ছদ্মবেশে গেইম খেলতে আসছ? এটা তো একটা প্রতারণা।”

আলো বলে,
“শুনুন..আপনি ভুল বুঝছেন।”

“আমি এত বড় অন্যায় মেনে নেবো না। এখনই সত্যটা সবাইকে বলব।”

বলেই সে ডাকাডাকি করতে থাকে।

আলো স্মরণ চৌধুরীকে আটকানোর জন্য তার হাত ধরে টান দেয়। কিন্তু এর ফলে স্মরণ চৌধুরী আলোর উপর পড়ে যায়। আলোর সাথে ভীষণ আপত্তিকর অবস্থায় ছিল সে। কারণ আলোর পরণের জার্সির অনেকটাই উঠে গেছিল এবং স্মরণের মুখ পড়ছিল আলোর স্পর্শকাতর স্থানে। এমন সময় স্মরণের ডাকাডাকির আওয়াজ শুনে সেখানে ছুটে আসে ক্লাব কমিটির কিছু সদস্য। তারা ছুটে এসেই এহেন একটা দৃশ্য দেখে খারাপ কিছু ভেবে নেয়। এমনকি খেলা দেখতে আসা অনেক মিডিয়ার টিমও সেখানে চলে আসে। তারা সবাই মিলে এই দৃশ্য দেখে। একজন সাংবাদিক বলে ওঠে,
“আরে এই আলু সর্দার তো আসলে একটা মেয়ে..আর ইনি বিশিষ্ট শিল্পপতি স্মরণ চৌধুরীর সাথে এত আপত্তিকর অবস্থায় কি করছে?”

আলো ভীষণ বিপদে পড়ে যায়। স্মরণ আলোর ওপর থেকে উঠে দাঁড়ায়। আলোও হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মিডিয়া, ক্লাব কমিটি এবং খেলোয়াড়দের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি যেন আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন একের পর এক সাংবাদিক আলোর দিকে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে,
“আপনি একজন মেয়ে হয়ে ছেলের ছদ্মবেশে কেন খেলতে এলেন? আপনার এই প্রতারণার পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল?”

আলো অসহায়ের মতো চারপাশে তাকায়। তার চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক, কিন্তু তার ভিতরের সাহস যেন হারিয়ে যায়নি। সে একটু শান্ত হয়ে মুখ খোলে,
“আমি কোনো প্রতারণা করিনি। আমার মা হাসপাতালে, তার অপারেশনের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এই টুর্নামেন্ট জিতলেই টাকা পাওয়া যেত, তাই খেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি শুধু আমার মায়ের জীবন বাঁচাতে চাই।”

আলোর কণ্ঠের গভীরতা আর সত্যতা উপস্থিত সবার হৃদয়কে স্পর্শ করে। কিন্তু ততক্ষণে মিডিয়ার অনেকেই তার এই গল্প নিয়ে বিতর্ক শুরু করে দেয়। ক্লাব কমিটির প্রধান বলেন,
“আপনার সমস্যা আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু এইভাবে প্রতিযোগিতার নিয়ম ভাঙা মোটেও ঠিক হয়নি। আমরা এ বিষয়ে একটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”

স্মরণ চৌধুরী পুরো বিষয়টি নীরবে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার মধ্যে অপরাধবোধ জন্ম নিতে শুরু করে। আলোর এই গল্প তাকে কিছুটা নাড়া দেয়। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“সবাই একটু শান্ত হোন। হ্যাঁ, নিয়ম ভাঙা হয়েছে, কিন্তু আমি নিজে এই মেয়েটির খেলা দেখেছি। এটার মধ্যে প্রতারণার কিছুই নেই। ওর প্রতিভা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ও আমাদের দলের জন্যই খেলছিল, এবং ওর কারণেই আমরা জিতেছি। এখন শুধু নিয়মের দোহাই দিয়ে ওর প্রতি কঠোর হওয়া কি ঠিক হবে?”

স্মরণের এই কথা উপস্থিত সবার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা নরম করে। তবে মিডিয়ার লোকজন এত সহজে বিষয়টি ছাড়তে রাজি নয়। এক সাংবাদিক প্রশ্ন তোলে,
“আপনি কি ওর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, নাকি অন্য কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য আছে? একটু আগেই তো আপনাদের ভীষণ আপত্তিকর অবস্থায় দেখা গেছে।”

এই প্রশ্নে স্মরণ চৌধুরীর মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে উত্তর দেয়,
“আপনারা ব্যাপারটাকে অতিরঞ্জিত করবেন না। এটা শুধুই একটা দূর্ঘটনা ছিল।”

একজন সাংবাদিক বলে ওঠে,
“দূর্ঘটনা নাকি নষ্টামো?”

স্মরণ চৌধুরী রেগে সেই সাংবাদিকের কলার চেপে ধরে কিন্তু ইতিমধ্যেই তার আর আলোর আপত্তিকর ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। চারিদিকে ছি ছি রব ওঠে। সাংবাদিকরা তাদের আরো অনেক জঘন্য প্রশ্ন করতে থাকে। আলো এসব নিতে পারে না। তার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨