#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ৯
#লেখিকা_দিশা_মনি
ডাক্তার সৌরভ ছুটে আসে মালতী খাতুনকে চেক করার জন্য। কেবিনের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শেফালী বেগম। ডাক্তার সৌরভকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন,
“আপনি এসেছেন ডাক্তার সাহেব? দেখেন না, আমার বান্ধবী কেমন জানি করছে।”
“আচ্ছা, শান্ত হোন। আমাকে দেখতে দিন বিষয়টা।”
বলেই ডাক্তার সৌরভ কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করেন। এদিকে বৃষ্টি তখন ডাক্তার সৌরভের পেছন পেছন এদিকেই ছুটে আসছিল। কেবিনের একদম সামনাসামনি এসে শেফালী বেগমকে দেখেই হতবাক হয়ে যায় বৃষ্টি। তার পা দুটো আপনাআপনি থেমে যায়। শেফালি বেগম বৃষ্টিকে চিনতে পারে না, চিনতে পারার কথাও না। কারণ অনেক আগে দেখেছিলেন তাকে। কিন্তু বৃষ্টি শেফালি বেগমকে দেখামাত্রই চিনে ফেলে৷ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,
“শেফালি আন্টি, তুমি কেমন আছ?”
শেফালি বেগম অবাক হয়ে বলে,
“তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না? কে তুমি?”
বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি সুরাইয়া বৃষ্টি। আমাকে চিনতে পারছ না? তোমার বান্ধবী মালতী খাতুনের মেয়ে। মনে নেই, ছোটবেলায় আমি কত তোমাদের বাসায় যেতাম, তুমিও তো আসতে আমাদের বাসায়।”
শেফালি বেগম ভীষণ অবাক হয়ে যান। বৃষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠেন,
“তুই বৃষ্টি? কত বড় হয়ে গেছিস তুই! এতদিন কোথায় ছিলিস তুই?”
“ড্যাড আমায় অনেক ছোট থাকতেই সিঙ্গাপুর নিয়ে গেছিল৷ আমি এতদিন সেখানেই ছিলাম। জানো, আমি কিছু দিন আগেই দেশে ফিরেছি। দেশে এসেই আমি মাকে অনেক খুঁজেছি। তোমার বাসাতেও গেছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, তোমার স্বামীর মৃত্যুর পর তুমি আর তোমার শ্বশুর বাড়িতে থাকো না৷ তোমার বর্তমান ঠিকানাও কেউ দিতে পারে নি। তাই তোমার সাথে যোগাযোগও করতে পারিনি। এখন আমি এই মেডিকেল কলেজেই পড়াশোনা করছি। আচ্ছা, আন্টি, তুমি কি জানো আমার মম এখন কোথায় আছে?”
শেফালি বেগম নিজের চোখের জল মুছে বলেন,
“এটাই বুঝি অদৃষ্টের লিখন সুরাইয়া, আল্লাহ বুঝি চেয়েছেন এই অবস্থায় তোদের মা-মেয়ের দেখা হবেন৷ তুই তোর মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস আর তোর মা এই মেডিকেলেই চিকিৎসাধীন।”
বৃষ্টি অবাক হয়ে যায়। তার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। সে বলে ওঠে,
“মম এখানে আছে? কোথায় মম? আমার সাথে মমের দেখা করিয়ে দাও না। আমি মমকে দেখতে চাই। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে আমি মমকে দেখি না, মমের কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না। আমি যে আর পারছি না আন্টি। প্লিজ, তুমি বলো মম কোথায়।”
“তোর মম এই কেবিনেই চিকিৎসাধীন।”
বৃষ্টি যেন একের পর এক অবাক হচ্ছে। সে বলে,
“এই কেবিনে তো আলোর মা চিকিৎসাধীন!”
“তুই আলোকে চিনিস?”
“হুম, বাংলাদেশে আসার পর আমি তো বিলীন অভয়ারণ্যের ওদিকে গেছিলাম। সেখানেই আলোর সাথে দেখা হয়েছিল। এরপর এই হাসপাতালে আমার সাথে আলোর আবার দেখা হয়। আর ও তো বলেছিল ওর মা এখানে চিকিৎসাধীন। তাই তো নার্স যখন ডাক্তার সৌরভকে বলল যে এই কেবিনের রোগীর অবস্থা খারাপ তখন আমি ছুটে এলাম।”
“হায় আল্লাহ! এটা ভাগ্যের কিরকম খেলা? দুই বোনের আগেই দেখা হয়েছে অথচ তারা একে অপরকে চিনতে পারে নি!”
“কি বলছ তুমি আন্টি?”
“আলো তোর নিজের বোন রে, তোর ছোট বোন।”
বৃষ্টি বিস্ময়ের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়৷ এরইমধ্যে ডাক্তার সৌরভ মালতী খাতুনকে চেক করে বাইরে আসে। তাকে দেখামাত্রই বৃষ্টি বলে ওঠে,
“ডাক্তার সৌরভ, আমার মমের অবস্থা এখন কেমন?”
ডাক্তার সৌরভ অবাক স্বরে বলেন,
“উনি আপনার মা?”
“জ্বি..”
“ওনার অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল। এখনই জরুরি ভিত্তিতে ওনার অপারেশন করতে হবে। নাহলে ওনায় প্রাণে বাঁচানো যাবে না।”
শেফালি বেগম বলে ওঠেন,
“কিন্তু অপারেশন করতে তো অনেক টাকা লাগবে। এত টাকা তো এখন আমার হাতে নেই।”
বৃষ্টি তখনই বলে ওঠে,
“আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন ডাক্তার সৌরভ চৌধুরী। টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। দয়া করে আমার মমকে বাঁচান। অনেক দিন পর, আমি আমার মমের সন্ধান পেয়েছি৷ আর তাকে হারাতে চাই না।”
“আচ্ছা, আমি অপারেশনের ব্যবস্থা করছি।”
“আমি কি একবার আমার মমকে সাথে দেখা করতে পারি?”
“জ্বি, দূর থেকে দেখতে পারেন।”
বৃষ্টি দূর থেকেই তার মাকে দেখে। বৃষ্টির চোখভর্তি অশ্রু যেন তার অন্তরের দুঃখকেই প্রতিফলিত করছে। বৃষ্টি দূর থেকেই তার মাকে দেখে বলে,
“এত দিন পর তোমায় ফিরে পেয়ে আর আমি তোমাকে হারাতে দেব না, মম। তোমাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে।”
~~~~~~~~
বৃষ্টি তার বাবা সিরাজুল মজুমদারদেরকে ফোন করে। কয়েকবার রিং হবার পর সিরাজুল মজুমদার ফোন রিসিভ করে। বৃষ্টি তার বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“ড্যাড, আমার তোমার একটা হেল্পের প্রয়োজন।”
“ওহ আমার কথা অমান্য করে বাংলাদেশে ফেরার পর এখন আবার তোমার আমার সাহায্যেরও প্রয়োজন!”
“ড্যাড, প্লিজ। ইটস ইমার্জেন্সি। আমার জরুরি ভিত্তিতে ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন।”
“১ টা টাকাও পাবে না, তুমি। আমার অমান্য যখন হয়েছ তখন আমিও তোমার কোন হেল্প করব না।”
“ড্যাড প্লিজ..একজনের জীবন-মরণের প্রশ্ন।”
বিপরীত দিক থেকে ফোনের লাইন কেটে দেয়। বৃষ্টি এরপর আরো অনেকবার ফোন করে কিন্তু সিরাজুল মজুমদার ফোন রিসিভ করে না। বৃষ্টির চোখে জল চলে আসে। সে স্বগতোক্তি করে বলে,
“এবার আমি কি করব? এতগুলো টাকা কিভাবে জোগাড় করব আমি?”
এমন সময় ডাক্তার সৌরভকে নিজের চোখের সামনে দিয়ে যেতে দেখে বৃষ্টি। তাকে দেখেই বৃষ্টি তার সামনে গিয়ে বলে,
“আপনার সাথে জরুরি কথা ছিল।”
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আমাকে ইমিডিয়েটলি অপারেশন থিয়েটারে যেতে হবে আপনার মায়ের হার্ট সার্জারির জন্য।”
“আসলে…অপারেশনের টাকাটা জোগাড় করতে আমার একটু টাইম লাগবে..যদি একটু সময় দিতেন..”
“এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমিও একজন মানুষ তাই আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আমি ব্যাপারটা ম্যানেজ করছি।”
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তার সৌরভ চৌধুরী। আপনি আজ আমার যা উপকার করলেন আমি তা কখনো ভুলব না।”
ডাক্তার সৌরভ চৌধুরী স্মিত হেসে অপারেশন থিয়েটারের দিকে যান। বৃষ্টি আল্লাহর কাছে নিজের মায়ের জন্য দোয়া করতে থাকে। শেফালি বেগম এসে বৃষ্টির কাধে হাত রেখে বলে,
“সব ঠিক হয়ে তাই না? মালতী আবার সেড়ে উঠবে বল?”
“ইনশাআল্লাহ।”
এমন সময় আলো ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে আসে। একটু আগেই স্মরণ চৌধুরী তাকে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। তাকে আসতে দেখেই শেফালি বেগম বলে ওঠেন,
“ওখানেই দাঁড়িয়ে যা? কেন এসেছিস এখানে?”
আলো দাঁড়িয়ে যায়। তার চোখভর্তি অশ্রু। সে বলে ওঠে,
“শেফালি আন্টি!”
“তোর জন্য আজ তোর মায়ের এই অবস্থা। আমি তো তোকে ভরসা করেছিলাম আলো। সেই ভরসার এই প্রতিদান দিলি তুই? তুই তো বলেছিলি সৎপথেই নাকি তোর মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করবি। এটাই তোর সেই সৎ পথ? প্রতারণা করে, একটা ছেলের সাথে…”
“আন্টি, তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে। এসব কিছুই বিকৃত অপপ্রচার। এটা ঠিক যে আমি ছেলে সেজে ক্রিকেট খেলতে গেছিলাম কিন্তু ঐ লোকের সাথে আমাকে নিয়ে যা কথা ছড়ানো হয়েছে সবটাই ভুল।”
“এখন এসব ভুল ঠিক দেখে কি হবে? এসব নিউজ দেখে তোর মা এখন আরো অসুস্থ হয়ে গেছে। এখন যদি তোর মায়ের কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি তোকে কখনো ক্ষমা করব না।”
“আম্মুর কিছু হবে না।”
এরইমধ্যে বৃষ্টি শেফালি বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে আন্টি? তুমি আলোকে এভাবে কেন বলছ?”
শেফালি বেগম বলেন,
“তোকে পরে সবটা বলছি, আগে তোদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দেই, আলো এই হলো সুরাইয়া বৃষ্টি, তোর বড় বোন।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨