আঁধার শেষে আলো পর্ব-১০

0
39
আঁধার শেষে আলো
আঁধার শেষে আলো

#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ১০
#লেখিকা_দিশা_মনি

শেফালি বেগমের কথা শুনে আলো চরম পর্যায়ের অবাক হয়। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“বোন? আমার বোন কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? আমার বড় বোন কোথা থেকে এলো?”

শেফালি বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“তোরা অনেক কিছুই জানিস না। অনেক কিছু তোদের থেকে লুকানো হয়েছে। আজ তোরা সব জানবি।”

এই বলেই তিনি সিরাজুল মজুমদার ও মালতী খাতুন এর জীবনের সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। কিভাবে মালতী খাতুন প্রেগন্যান্ট হবার পর তাকে সিরাজুল মজুমদার ভুল বুঝে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাড়ায় সেই সব কথা খুলে বলেন তিনি। সব শুনে দুই বোন স্তব্ধ হয়ে যায়। আলো অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
“এত কিছু ঘটে গেছিল কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না৷ আমি তো সব সময় জানতাম আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়েছিল কিন্তু আমার বড় বোনও আছে..”

বৃষ্টি আলোর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমিও তো জানতাম না, আমার একটা ছোট বোন আছে। সবই ভাগ্যের খেলা। আমাদের দু-দুবার দেখা হলো৷ অথচ আমরা একে অপরকে চিনতে পারলাম না। তবে, তোমাকে প্রথম দেখেই আমার কেমন জানি আপন আপন লাগছিল।”

“আপু..”

“হ্যাঁ, আলো। তবে এবার আর আমরা আলাদা থাকব না। যখন এত বছর পর আমরা এক হবার সুযোগ পেয়েছি তখন আমাদের পুরো পরিবারকেই আমি এক করবো। মমকে সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে। মম সুস্থ হবার পর আমি ড্যাডের সামনে প্রমাণ করে দেবো যে তুমি আমারই বোন।”

শেফালি বেগম বলেন,
“এটা কিভাবে সম্ভব?”

“সম্ভব, আন্টি। আগে প্রযুক্তি সেরকম উন্নত ছিল না। তাই তখন সন্তানের পিতৃপরিচয় জানার জন্য কোন রকমের কোন উপায় ছিল না। কিন্তু এখন DNA টেস্ট এর মাধ্যমে সব সত্য জানা যায়। আলোর সাথে ড্যাডের ডিএনএ টেস্ট করাতে পারলেই সব সত্য সামনে আসবে।”

আলো বলে,
“কিন্তু আম্মু..আম্মু এখন কেমন আছে?”

“চিন্তা করো না,মম ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন আমাকে বলো তো, আসল ঘটনা কি ঘটেছিল। আন্টি যা বলল, তার মানে কি?”

আলো এবার সমস্ত কিছু বৃষ্টিকে বলে। সব শুনে বৃষ্টি বলে,
“যাই হোক না কেন, তোমার এভাবে মিথ্যা অভিনয় করা ঠিক হয়নি। এটা একধরনের প্রতারণা। তবে এটাও সত্যি যে, তুমি যা করেছ মমের ভালোর জন্য করেছ। আমার বোনের উপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি জানি, মমের শিক্ষায় বড় হবার পর তুমি খারাপ হতে পারো না।”

“ধন্যবাদ আপু। আমার উপর ভরসা রাখার জন্য। ”

কিছু সময় পেরিয়ে যায়৷ ততক্ষণে ডাক্তার সৌরভ চৌধুরী অপারেশন থিয়েটার থেকে বাইরে বের হয়। তিনি বের হতেই বৃষ্টি ছুটে আসে। যার ফলে বৃষ্টি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয়। সেই সময় সৌরভ বৃষ্টিকে সামলে নেয়। দুজনের চোখাচোখি হয় এমতাবস্থায় এবং দুজনেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যখন আলো ও শেফালি বেগম চলে আসে। বৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর ডাক্তার সৌরভকে জিজ্ঞেস করে,
“মম কেমন আছেন?”

” টেনশনের কোন ব্যাপার নেই। অপারেশন সাকসেসফুল। আশা করি, উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

এই কথা শুনে বৃষ্টি ও আলোর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। শেফালি বেগম আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলেন,
“যাক, আল্লাহর দোয়ায় সব ঠিক হয়ে গেল।”

বৃষ্টি আবেগের বসে ডাক্তার সৌরভ চৌধুরীর হাত ধরে বলে,
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তার চৌধুরী। আপনার জন্য আমি আমার মমকে আবার ফিরে পেলাম!”

সৌরভ মুচকি হাসে। বৃষ্টির এই খুশি যেন তাকেও খুশি দিচ্ছে। কিন্তু কেন? কিছু দিন আগেই পরিচিত হওয়া একটা মেয়ে যাকে প্রায়ই সে ঝামেলা হিসেবেই দেখেছে তার সাথেই কেন এমন অনুভুতি উপলব্ধি হচ্ছে। সৌরভ মনে করে, অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে মেয়েটা যখন কান্নাকাটি করে তার কাছে অনুনয় করছিল তার মাকে বাঁচানোর জন্য সে সময় তার বুকের বা পাশে অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছিল। এখন মেয়েটার মুখে হাসি দেখে যেন নিজেকে সবথেকে সুখী মনে হচ্ছে। কি কারণ এই অদ্ভুত অনুভূতির? জানে না, সৌরভ। তবে তার এখন ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। তাই তো একটা হাসি উপহার দিয়ে বলে,
“একজন ডাক্তার যখন একজন রোগীর প্রাণ বাঁচাতে পারে তখন তার নিজের থেকে সুখী বোধহয় আর কেউ হয় না। আপনার মাকে সুস্থ করতে পেরে আমি নিজেও অনেক খুশি।”

বলেই সে সামনের দিকে পা বাড়ায়। বৃষ্টি পেছন থেকে বলে ওঠে,
“এখন মমের সাথে দেখা করতে পারব?”

সৌরভ ঘুরে বলে,
“নাহ, আপাতত ওনাকে কেবিনে শিফট করা হবে। অতঃপর জ্ঞান ফিরলে আপনারা ওনার সাথে দেখা করতে পারেন।”

★★
স্মরণ চৌধুরী এখন তার বাবা মিজানুর চৌধুরীর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। স্মরণের মা সোহেলা নিজের ছেলের হয়ে বলেন,
“স্মরণ হয়তো ঠিকই বলছে। তুমি ওর কথা টা বিশ্বাস করো। হয়তো সত্যিই ঐ মেয়েটার সাথে ওর…”

“তুমি চুপ থাকো। যেটা জানো না, সেটা নিয়ে কথা বলে কি হবে? এসব বলে কোন লাভ নেই। এই স্মরণ, আমি নাহয় তোর কথা বিশ্বাস করলাম কিন্তু এই সমাজ কি করবে? আর যেই মেয়েটার সাথে তোর স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়েছে তার কি হবে? এই সমাজে তো একজন ছেলের থেকে একজন মেয়েকে বেশি কথা শুনতে হয়। একবারো মেয়েটার কথা ভেবেছিস?”

সোহেলা বলেন,
“যা হয়েছে তাতে আমার ছেলেটার কি দোষ? ঐ মেয়েরই তো দোষ বেশি।”

“তুমি কথার মাঝে কথা বলো না তো। আর স্মরণ যা বলছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে তো মেয়েটা সত্যি বেশ অসহায়। নিজের মাকে বাচাতে ছেলে সাজে ক্রিকেট খেলতে এসেছিল। কিন্তু ওর খেলার স্কিল তো আমি দেখেছি। এত ভালো খেলে, ছেলেদেরকেও হারিয়ে দিচ্ছে। এই মেয়ের প্রতিভা কে তো অস্বীকার করা যায় না। আমি ভাবছি মেয়েটার সাথে কথা বলব। এই স্মরণ তুই মেয়েটাকে কোথায় নামিয়ে দিয়ে এসেছিস রে?”

“এভারগ্রীন হাসপাতালের সামনে।”

“কি? আমাদের স্মরণের হাসপাতাল। বাহ, তাহলে তো ভালোই। চল গিয়ে মেয়েটার সাথে দেখা করে আসি। তোর তো কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। মেয়েটার এত বিপদের কথা জেনেও ওকে একা নামিয়ে দিয়ে চলে এলি। এবার আমি গিয়ে ওর সাথে কথা বলব। চল।”

★★
মালতী খাতুনের জ্ঞান ফিরেছে৷ জ্ঞান ফেরার পরই শেফালি বেগম বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে তার সামনে এসে বলে,
“দেখ তো চিনতে পারিস কি না।”

মালতী খাতুন বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“কে এই মেয়েটা?”

বৃষ্টি কান্না করতে করতে বলে,
“আমি তোমার সুরাইয়া মম।”

“সুরাইয়া!”

মালতী খাতুনের চোখে জল। তিনি বলেন,
“আমার বড় মেয়ে! হায় আল্লাহ! আমি কি সত্যি দেখছি। আমার মেয়ে যাকে আমার স্বামী ১৮ বছর আগে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিল আজ সে আমার চোখের সামনে! আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

বৃষ্টি মালতী খাতুনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“হ্যা, মম। আমি এসেছি তোমার কাছে। এখন থেকে আমি তোমার কাছেই থাকব।”

মালতী খাতুন এত বেশি খুশি যে বলার মতোই কিছু খুঁজে পান না। এমন সময় আলো বলে ওঠে,
“আম্মু..”

মালতী খাতুন রেগে বলেন,
“তুই কি করছিস এখানে। তোর সাথে আমার কোন কথা নেই। তুই আমার মান-সম্মান ডুবিয়েছিস।”

“আম্মু আমার কথা..”

“তোর কোন কথা শুনব না। দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।”

আলোর চোখে জল। এমন সময় স্মরণ তার বাবাকে নিয়ে সেখানে চলে আসে। স্মরণের বাবা মিজানুর রহমান এসেই বলে,
“আলো কি এখানে?”

মিজানুর রহমান এর কন্ঠস্বর শুনে মালতী খাতুন অবাক হয়ে যায়। এতদিন পর যেন আপন কারো কন্ঠ শুনলেন। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,
“ভাইজান!”

মিজানুর রহমান বেডে শুয়ে থাকা মালতী খাতুনকে দেখে আরো অবাক হয়ে বললেন,
“খুকি!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨