#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ১১
#লেখিকা_দিশা_মনি
মিজানুর রহমান বেডে শুয়ে থাকা মালতী খাতুনকে দেখে আরো অবাক হয়ে বললেন,
“খুকি!”
মালতী খাতুন এত গুলো দিন পর তার মেজ ভাইকে চরম অবাক। মিজানুর রহমান এর অবস্থাও কিছুটা একই। আজ এতগুলো দিন পর তিনি তার হারানো বোনকে দেখলেন। আবেগঘন হয়ে এগিয়ে এসে বললেন,
“এতদিন কোথায় ছিলিস তুই খুকি? জানিস, আমি, বড় ভাইজান তোকে কত খুঁজেছি। আর আজ এতগুলো দিন পর তোকে দেখলাম।”
মালতী খাতুন অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন,
“আব্বা আমায় আলাদা করে দেয়ার পর তো তোরা কেউই আমার খোঁজ নিলি না ভাইয়া। মানছি আমি অনেক বড় অপরাধ করেছিলাম তোদের অবাধ্য হয়ে কিন্তু তার এজন্য এত গুলো বছর এভাবে আমায় শাস্তি দিলি?”
মিজানুর রহমান কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“কি করবো বল, আব্বু বলে দিয়েছিলেন যদি আমরা তোকে খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে উনি নিজেকে শেষ করে দেবেন। তারপর ১৫ বছর আগে যখন আব্বু মারা যায় তারপর আমি আর বড় ভাইজান তোকে খুঁজতে যাই কিন্তু সিরাজুলের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি ও নাকি এখন সিঙ্গাপুরে আছে। আমরা ভেবেছিলাম তুইও চলে গেছিস আমাদের সবাইকে ছেড়ে ওর সাথে। তাই আর খুঁজিনি। কিন্তু আজ এভাবে তোকে দেখব আমি ভাবতেও পারিনি। আম্মু, বড় ভাইজান থাকলে আজ কত খুশি হতেন!”
মালতী খাতুন হতবাক স্বরে বলেন,
“থাকলে মানে? আম্মু আর বড় ভাইজান কোথায় এখন? ”
“আম্মু ১০ বছর আগে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আর বড় ভাইজান আর বড় ভাবি ৫ বছর আগে একটা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। আর এই যে দেখতে পাচ্ছিস এই ডাক্তারকে, এ হলো সৌরভ,বড় ভাইজানের ছেলে। আর সৌরভ এই হলো তোর একমাত্র ফুফু, তোর আব্বুর নয়নের মণি যাকে জীবনের শেষ দিন অব্দি তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন।”
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায় এসব কথা শুনে। বৃষ্টি ও সৌরভ অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। সৌরভ এগিয়ে এসে বলে,
“কি বলছ কি তুমি মেজ চাচা? ইনি আমার সেই ফুফু…”
“হ্যাঁ, রে। আর মালতী এই হলো আমার ছেলে স্মরণ চৌধুরী।”
আলো এবার বিড়বিড় করে বলে,
“তার মানে ঐ লোকটা আমার ফুফাত ভাই?”
স্মরণ তো এসবের মধ্যে একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। একেই তাকে তার বাবা এখানে নিয়ে এসেছিল আলোর খোঁজ নিতে এখন আবার আলোর খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের হারানো ফুফুকে ফিরে পেয়ে গেল সে! স্মরণ আলোর দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়। মালতী খাতুন স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“তোর ছেলেকে আমার কেন জানি খুব চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ রে শেফালি এটা সেই ছেলেটা না যার সাথে আমার আলোর..?
আলো এবং স্মরণ দুজনেই এবার অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মিজানুর রহমান বলেন,
“কি বললি তুই? আলো তোর মেয়ে?”
মালতী খাতুন সামান্য হেসে বলেন,
“হ্যাঁ, এ হলো আলো আমার ছোট মেয়ে আর ঐ যে বৃষ্টি ও আমার বড় মেয়ে৷ জানিস মেজ ভাইজান, আজ অনেকদিন পর আমি আমার বড় মেয়েকে ফিরে পেলাম।”
“মানে?”
শেফালি বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“সেসব অনেক কথা। আমি পরে এখন বলব। আসলে মালতীর সবে একটা মেজর অপারেশন হয়েছে তো তাই ওর রেস্টের প্রয়োজন।”
“আচ্ছা, কি হয়েছিল ওর?”
“সবটা এখন আমি বলব ভাইজান। আপনি ধৈর্য ধরুন।”
মিজানুর রহমান শান্ত হন কিছু টা হলেও।
★★★
মালতী খাতুন এর কেবিনের বাইরে বসে আছেন মিজানুর রহমান। একটু আগেই শেফালি বেগম তাকে সব ঘটনা খুলে বলেছেন। সব শুনে তিনি তো সিরাজুল মজুমদার এর উপর ভীষণ রেগে গেছেন সাথে তার নিজেরও ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে এত গুলো বছর নিজের বোনের কোন খোঁজ না নেওয়ার জন্য। তিনি স্বগোতক্তি করে বলেন,
“আমার বোন এত গুলো দিন ধরে এত কষ্টে জীবন কাটিয়েছে অথচ আমি জানতেই পারিনি। হায় আল্লাহ! এ তোমার কি বিচার। আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। যদি সেই সময় গুলো আমি নিজের বোনের পাশে থাকতে পারতাম তাহলে ওকে আজ এই দিন দেখতে হতো না।”
“কি আর করবেন বলুন ভাইয়া। যা হবার হয়ে গেছে। এখন তো আর এসব বলে কিছু ঠিক হবে না।”
“তাও ঠিক। যাইহোক, তোমার উপর আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তুমি এত গুলো বছর যেভাবে আমার বোনকে সামনে রেখেছিলে তা অতুলনীয়।”
“কি যে বলেন না! মালতী আর আমি তো সব সময় একে অপরকে বোনের চোখেই দেখেছি। ওর বিপদে আমি পাশে থাকব না তো কে থাকবে?”
“তাও ঠিক।”
“আচ্ছা৷ একটা প্রশ্ন করব?”
“হুম, করো।”
“আপনাদের ছোট ভাই এখন কোথায় আছে?”
‘ছোটকুর কথা বলছ? ওর কথা আর কি বলব। আমি, আব্বা আর ভাইজান ওকে কত বুঝিয়েছি। আব্বা আর ভাইজান তো জীবনের শেষদিন অব্দি চেষ্টা করে গেছেন ওকে বিয়ে দেয়ার কিন্তু ওর একটাই কথা বিয়ে করবে না। আজ অব্দি আমার ভাইটা চিরকুমার রয়ে গেছে। এখন আপাতত ও কানাডায় আছে ওখানেই চাকরি করছে।’
“ও।”
একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে শেফালি বেগমের মুখ থেকে। তিনি মনে করেন অতীতের কিছু ঘটনা। মালতীর সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে প্রায়শই তাদের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল আর এভাবেই মালতীর ছোট ভাইয়ের নজর পড়ে তার দিকে। যে শেফালির থেকেও ২ বছরের ছোট ছিল৷ কিন্তু সেই শেফালিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল এমনকি কতই না পাগলামী করেছিল। কিন্তু শেফালী বেগম যেহেতু অন্য কারো প্রেমে ছিল তার উপর বয়সের ব্যবধান এসবের জন্যই এটাকে গুরুত্ব দেয় নি। তবে তার আজো মনে পড়ে শেফালির বিয়ের কথা জানতে পেরে ছেলেটা কতই না পাগলামী করেছিল। শেফালীর পায়ে পর্যন্ত পড়েছিল বিয়েটা আটকানোর জন্য। কিন্তু শেফালী তাকে ফিরিয়ে দেয়। সেই সময়েই সে বলেছিল, “প্রয়োজনে আজীবন কুমার থেকে হলেও আমার ভালোবাসার পবিত্রতা তোমায় বুঝিয়ে দেব।”
সে সময় শেফালী এই কথাকে গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের ভালোবাসার মানুষ তথা স্বামীকে হারানোর পর বুঝেছিল, মাঝে মাঝে অন্যের দীর্ঘ শ্বাসও জীবনে অশান্তি ডেকে আনতে পারে। আর আজ যখন জানতে পারল তাদের ছোট ভাই এখন অবিবাহিত তখন কেন জানি নিজের অজান্তেই অন্যরকম অনুভূতি হতে লাগল।
এরইমধ্যে মিজানুর রহমান বলে ওঠেন,
“তবে আমি একটা কথা ভেবেছি। ভাবছি মালতী সুস্থ হলেই ওর কানে এই কথা টা তুলব।”
‘কি কথা?’
‘যেহেতু স্মরণ আর আলোকে নিয়ে এমন একটা স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে গেছে তাই ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে চাই। এমনিতেও আমার নিজের বোনের উপর ভরসা আছে। ও নিশ্চয়ই নিজের মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে।’
শেফালি বলে
‘সেটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
এমন সময় বৃষ্টি এসে বলে,
“মামা, আমার আপনার সাথে কথা আছে।”
“হ্যাঁ, বলো।”
” আপনি আমায় একটা হেল্প করতে পারবেন?”
“কি হেল্প?”
“ড্যাডকে আমি বোঝাতে চাই সে জীবনে কত বড় ভুল করেছিল আমার মাকে ভুল বুঝে। আমি চাই, আমার বাবা সারাটা জীবন যে মিথ্যাকে বিশ্বাস করেছে তার সত্যতা জানতে পারুক। জানুক যে, আমার মম চরিত্রহীন নয়।”
‘আমি এই বিষয়ে তোমার পাশে আছি।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨