#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ১২
#লেখিকা_দিশা_মনি
বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে তার মা মালতী খাতুন এর সামনে। মালতীর অপারেশন এর পর প্রায় ১ সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। এই এক সপ্তাহে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে গেছে৷ মালতী খাতুন এখন আলোকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। মিজানুর চৌধুরী আলো ও স্মরণের বিয়া কথা তুললে অবশ্য তিনি সরাসরি কিছু না বলে একটু ঘুরিয়ে বলেছেন,
“এত তাড়াহুড়ো না করে ওদের সিদ্ধান্ত মতোই আগানো হোক।”
মিজানুর চৌধুরী সেটা মেনেও নিয়েছেন। তখন থেকে আপাতত স্থবিরতাই চলছে। তবে আজ বৃষ্টি এসে মালতী খাতুন এর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“মম, আজ তোমাকে আবার তোমাকে তোমার অতীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সামনে দাঁড়াতে হবে। তুমি কি সেটার জন্য প্রস্তুত?”
মালতী খাতুন বুঝতে পারেন না তার মেয়ে কি নিয়ে কথা বলছে। তাই তিনি বলেন,
“কিসের কথা বলছিস তুই সুরাইয়া?”
বৃষ্টি একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,
“সারাটা জীবন তোমায় অনেক খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যেই মানুষটাকে ভালোবেসে তুমি নিজের পরিবার, সংসার সব ত্যাগ করেছ সেই মানুষটাই তোমায় সবথেকে বড় ক্ষতটা দিয়েছে। আমরা দুই মা-মেয়ে আলাদা হয়ে ছিলাম এত গুলো বছর। আমার ছোট বোনটাও পরিবারের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এসব কিছুর সূত্রপাত হয়েছিল যে ঘটনা থেকে সেই ঘটনার এবার সমাধান হবে।”
মালতী খাতুন অবাক চোখেই তাকিয়ে ছিলেন। এমন সময় আলো তার মায়ের কেবিনে প্রবেশ করে। তার চোখেও অসংখ্য প্রশ্ন যেন লুকিয়ে। শেফালি বেগমও তার পেছন পেছন কেবিনে প্রবেশ করল। কেবিনে এসেই আলতো হেসে বলল,
“জানি, তোদের সবার মনে অনেক প্রশ্ন। তবে খুলে শীঘ্রই সেই সব প্রশ্নের উত্তর পাবি তোরা।”
একটু পরেই মিজানুর চৌধুরীও কেবিনে প্রবেশ করেন। তবে তিনি একা আসেন নি। তার সাথে ছিল আরো একজন। যাকে দেখেই মালতী খাতুন অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলেন। বিগত কিছুদিনে তার জীবনে অনেক চমক ঘটে গেছে। নিজের জীবনে অনেক হারানো ব্যক্তিদের সে ফিরে পেয়েছে। তবে সবকিছুকেই যেন ছাড়িয়ে গেল আজকের ঘটনা। কারণ আজ স্বয়ং সিরাজুল মজুমদার তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে। সিরাজুল মজুমদার কে দেখামাত্রই মালতী খাতুন নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বললেন,
“তুমি!”
সিরাজুল মজুমদার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
“তুই না আমাকে বলেছিলি আমার সাথে ফিরে যাবি আজ। সেজন্যই তো আমি সিঙ্গাপুরে নিজের এত জরুরি কাজ ফেলে এখানে এলাম। আর তুই এটা কি করলি? আবারো আমাকে এই দুশ্চরিত্র মহিলার সামনে এনে দাঁড় করালে?”
আলো প্রতিবাদ করে বলল,
“মুখ সামলে কথা বলুন। আমার মার নামে আর একটা খারাপ কথাও বললে আমি বরদাস্ত করব না।”
সিরাজুল মজুমদার বললেন,
“ও, এই তাহলে তোমার সেই অবৈধ সন্তান। ব্যবহার দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ কেমন শিক্ষা পেয়েছে।”
বৃষ্টি রেগে বলল,
“ড্যাড,অনেক হয়েছে। তুমি কিন্তু এবার সীমা অতিক্রম করছ৷ এটা ঠিক না। আর তোমাকে আজ আমি এখানে ডেকেছি বড় একটা উদ্দ্যেশ্যে। তুমি যে এত গুলো দিন বোকার স্বর্গে বাস করছিলে এবার সেটাই আমি প্রমাণ করে দেব।”
“মানে?”
বৃষ্টি ডাক্তার সৌরভ চৌধুরীর নাম ধরে ডাকলেই সে কিছু রিপোর্ট নিয়ে আসে। বৃষ্টি সেই রিপোর্ট দেখে বলে,
“গতকাল তোমার মেডিক্যাল চেকআপের নাম করে আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। তবে আমার মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল অন্য কিছু। আমার মম যে দুশ্চরিত্র নয় সেটাই আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। আর সেটা প্রমাণও হয়ে গেল।”
“যা বলার পরিস্কার করে বলো।”
“এই নাও ড্যাড এটা হলো তোমার আর আলোর ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। আশা করি, এটা দেখার পর তোমার আর আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকবে না।”
বৃষ্টির কথা মতো সিরাজুল মজুমদার এই ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট টা দেখল। আর এটা দেখা মাত্রই তার চোখ একদম কপালে উঠে গেল। কারণ এই ডিএনএ রিপোর্ট এ স্পষ্ট লেখা তার সাথে আলোর ডিএনএ পুরোপুরি মিলে গেছে। এর মানে, আলো তার নিজের মেয়ে! সিরাজুল মজুমদারের চোখে জল চলে আসে এই রিপোর্ট দেখে। নিজের এতদিনের ভুল তার এক নিমেষেই ভেঙে যায়। মালতী খাতুনেরও চোখে জল।
সিরাজুল মজুমদার বলেন,
“তার মানে আলো আমার সন্তান..ঐ সুমন পাটোয়ারীর নয়। তাহলে এত গুলো বছর ধরে আমি ভুল জেনে গেলাম। আর আমার এই ভুল ধারণা আমার পুরো পরিবারকে খণ্ড বিখণ্ড করে দিল!”
মিজানুর চৌধুরী তাচ্ছিল্য হেসে বলেন,
“আব্বাজান বলত, আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও মানুষের জাত যায়না। তোমাকে দেখে আমি সেটারই প্রমাণ পেলাম। আমার বোন নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে, সবাইকে ত্যাগ করে তোমায় বিয়ে করল। আর তুমি…তুমি আমার বোনকে তার জীবনের সবথেকে বড় কষ্টটা দিলে। ওর সারাটা জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে দিলে।”
সিরাজুল মজুমদার মাথা নিচু করে নেন। তার নিজের সারা জীবনের ভুল আজ এক লহমায় ভেঙে গেল। এখন যে তিনি নিজের এই মুখ আর কাউকেই দেখাতে পারছেন না। বৃষ্টি সিরাজুল মজুমদারকে বলেন,
“তোমার এই ভুল ধারণা আমার মম, আমার বোনের থেকে আমায় আলাদা করেছে। এর জন্য আমি কখনো তোমায় ক্ষমা করব না ড্যাড।”
সিরাজুল মজুমদার মালতীর দিকে এগিয়ে যান। তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে বলে,
“সারাটা জীবন আমি তোমার সাথে যা অন্যায় করেছি, ভুল বুঝে বিনা অপরাধে তোমায় যা শাস্তি দিয়েছি তার কোন ক্ষমা হয়না, আমি জানি। তবুও আমি তোমার কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”
এমন সময় আলো বলে উঠল,
“আমার আম্মু আপনাকে ক্ষমা করবে কিনা জানিনা কিন্তু আপনি একটা কথা জেনে রাখুন, আমি কখনোই আপনাকে নিজের বাবা বলে মেনে নেব না। আমি এত দিন ধরে যেমন জেনে এসেছিলাম আমার বাবা নেই, বাকিটা জীবনও ঠিক এভাবেই কাটিয়ে দেব।”
“আলো!”
করুণ কণ্ঠে বলেন সিরাজুল মজুমদার। মালতী খাতুন বলেন,
“তোমাকে আমি বলেছিলাম না, একদিন তুমি নিজের কাজের জন্য আফসোস করবে কিন্তু সেদিন তোমার কিছু করার থাকবে না। আজ বোধহয় সেই দিন এসে গেল। আমার মেয়েরা কি করবে জানি না, ওদের কোন বিষয়ে আমি কিছু বোঝাতেও যাব না। ওরা তোমার সাথে কিভাবে ব্যবহার করবে, তোমায় মেনে নেবে কি না, ক্ষমা করবে কিনা সেটা ওদের সিদ্ধান্ত। তবে আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমায় জানিয়ে দেই, আমি তোমায় কেয়ামতের আগ পর্যন্ত ক্ষমা করবো না৷ তোমার জন্য আমি আমার বড় মেয়ের থেকে আলাদা ছিলাম এতগুলো বছর, আমার ছোট মেয়েটা একটা পুরো পরিবার থাকা সত্বেও এত গুলো দিন অনাথের মতো কাটিয়েছে। এসব আমি ভুলব না।”
সিরাজুল মজুমদার বলেন,
“এসবই বোধহয় আমার প্রাপ্য ছিল। আসলেই সব অপরাধের ক্ষমা হয়না। আমার অপরাধও যে ক্ষমার অযোগ্য। তবে আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে, তোমায় একটা কথা দিচ্ছি মালতী। তুমি আমায় ক্ষমা করো বা না করো যার কারণে আমাদের এতগুলো বছর নষ্ট হয়েছে তাকে আমিও ক্ষমা করবো না। ঐ সুমন পাটোয়ারীকে আমি ওর কৃতকর্মের শাস্তি দেবই আর সাথে নিজেকেও।”
বলেই তিনি চোখের জল মুছে কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। তিনি বেরিয়ে যেতেই শেফালি এসে মালতীর কাধে হাত রাখেন। এদিকে ক্রন্দনরত আলোকে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টি। জড়িয়ে ধরে বলে,
“কাঁদিস না বোন আমার। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঐ লোকটাকে আমি বাবা বলে মানি না। তুমি আমার বড় বোন, আমার মা এই দুইজনকে নিয়েই আমার পরিবার। আর কাউকে আমার লাগবে না।”
বৃষ্টি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। তবুও সে কিছু বলে না
এদিকে মিজানুর চৌধুরী বলেন,
“তুই একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস মালতী। তোর এই সিদ্ধান্তে আমি তোর পাশে আছি। যার কারণে তোর পুরো জীবন নষ্ট হয়েছে তাকে ক্ষমা করার কোন মানে হয়না। কাল অথবা পরশু বোধহয় তোকে রিলিজ দেবে, তারপর আমি তোকে আর তোর দুই বোনকে নিয়ে আবার বাসায় ফিরব। আম্মাজান মৃত্যুর আগে তোর জন্য যা যা রেখে গেছিল সব তোক বুঝিয়ে দেব। তারপর তুই তোর মেয়েদের নিয়ে সুখে থাকতে পারবি।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨