#আঁধার_শেষে_আলো
#পর্বঃ১৪(শেষ)
#লেখিকা_দিশা_মনি
গোটা চৌধুরী বাড়ি সেজে উঠেছে বিয়ের সাজে। আজ একই সাথে চৌধুরী বাড়ির দুই ছেলের বিয়ে। পুরো বাড়ি আত্মীয়-স্বজনে ম-ম করছে। বিশেষ করে সবাই যখন জেনেছে পাত্রীদ্বয় আর কেউ না, চৌধুরী বাড়ির হারিয়ে যাওয়া মেয়ের সন্তান তখন তো সবার উৎসাহ অনেকটাই বেড়ে গেছে।
স্মরণ ও সৌরভ দুই ভাই বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে একে অপরের মুখোমুখি হলো। স্মরণের পরণে একটা সাদা, শুভ্র পাঞ্জাবি এবং সৌরভের পরনে একটা গোলাপী কালারের পাঞ্জাবি। স্মরণ সৌরভকে দেখে বলে,
“কি ব্যাপার ভাইয়া? হঠাৎ করে গোলাপী পাঞ্জাবি যে? ভাবির প্রিয় রং কি গোলাপী নাকি?”
সৌরভ বেশ লজ্জা পেল৷ তবে আসলেই বৃষ্টির প্রিয় রং গোলাপী আর সেটা বৃষ্টিই সৌরভকে বলেছিল। সেজন্যই তার এই রংয়ের পাঞ্জাবি পড়া। পাঞ্জাবিটা নিয়ে বেশ ভাব নিয়ে সে বলে,
“মোটেই না। আমার পছন্দ হয়েছে তাই পড়েছি।”
“থাক, থাক। বুঝেছি।”
“আচ্ছা৷ আচ্ছা, দেখবো এখন। তোরও তো আজ বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের পর তুই কিভাবে বউয়ের ভালোবাসায় অন্ধ হস তা দেখব।”
“আমি কারো ভালোবাসায় অন্ধ হবো না। ওই আমাকে ভালোবেসে অন্ধ হবে।”
“হয়েছে আর ভাষণ দিতে হবে না।”
এদিকে নিজের দুই ভাতিজার বিয়ে উপলক্ষ্যে আজ প্রায় দীর্ঘ কয়েক বছর বিদেশে থাকার পর দেশের মাটিতে পা রাখলেন চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলে মোর্শেদ চৌধুরী। এসে নিজের দুই ভাতিজাকে এভাবে ঝগড়া করতে দেখে বললেন,
“তোরা আজো আগের মতোই রয়ে গেলি!”
স্মরণ আর সৌরভ তাদের প্রিয় ছোট চাচ্চুকে দেখে খুশি হলো ভীষণ। দুজনেই দৌড়ে এসে নিজেদের ছোট চাচ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি এসে গেছ চাচ্চু।”
“হ্যাঁ, রে। আমার ভাতিজাদের জীবনে এত সুখের দিন আর আমি আসব না? মালতী আপাও নাকি ফিরে এসেছে। আমার তো আপার সাথে দেখা করার প্রাণ ফেটে যাচ্ছে।”
এমন সময় মালতী খাতুন সেখানে এলেন। মোর্শেদ নিজের বড় বোনকে দেখামাত্রই অশ্রুসিক্ত চোখে এগিয়ে এসে বলল,
“কেমন আছ আপা? আমায় চিনতে পারছ?”
মালতী খাতুন নিজের চোখের জল মুছে নিজের ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তোকে ভুলে যাই কি করে? নিজে কোলেপিঠে করে তোক বড় করেছি আমি। চাইলেও যে তোকে ভুলতে পারব না।”
‘তোমাকে অনেক মিস করেছি আপা।’
“আমিও রে।”
মিজানুর চৌধুরী সেখানে এসে বললেন,
“অনেক ফ্যামিলি ড্রামা হয়েছে এখন বিয়ের আসরে চল। মেয়ে দুটো আর কতক্ষণ এভাবে সেজে বসে থাকবে? কাজি সাহেবও তো তাড়া দিচ্ছেন।”
“হুম যাচ্ছি।”
★★
“কবুল” নামক সুন্দর শব্দটির মাধ্যমে পবিত্রতম এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল দুই জোড়া প্রাণ। সৌরভ-বৃষ্টি ও স্মরণ-আলো হয়ে গেল স্বামী-স্ত্রী। বিয়ে সম্পন্ন হতেই মালতী খাতুন এগিয়ে এসে নিজের দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তোরা সুখী হ। আমি নিজের জীবনে সুখী হতে পারিনি। আল্লাহর কাছে শুধু এটুকুই চাইব, তোদের জীবন যেন অন্তত আমার মতো না হয়। তোদের জীবন সুখ, সমৃদ্ধি ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হোক।”
সিরাজুল মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন এই বিয়ের আসরে। সবার অগোচর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,
“বৃষ্টি!”
“ড্যাড!”
“আয় মা,আমার বুকে আয়।”
বৃষ্টি ছুটে এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। হাজার হোক, এই মানুষটাই তো তাকে ছোটবেলা থেকে একা আগলে রেখে বড় করেছে। তাই চাইলেও এই লোকটাকে সে ভুল বুঝে থাকতে পারবে না। সিরাজুল মজুমদার বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুমি অনেক সুখী হও। এই দোয়া করি।”
অতঃপর তিনি আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
“জানি, তুমি কখনোই আমাকে ক্ষমা করবে না, বাবা হিসেবে আমাকে প্রাপ্য সম্মানও দেবে না। যদিও সেটার যোগ্যও আমি নই। তবে বৃষ্টির মতো তুমিও তো আমার মেয়ে, তোমার শরীরেও আমার রক্ত বইছে। তাই আমি তোমার জন্যেও অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দোয়া করি। তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।”
আলো সামান্য হাসে। এতটুকু বিনয় না দেখালেই নয়। সবশেষে সিরাজুল মজুমদার নিজের স্ত্রী মালতী খাতুন এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
“ঐ সুমন পাটোয়ারীকে আমি তার কাজের উচিৎ শিক্ষা দিয়েছি। ও একটা ড্রাগ স্মাগলার ছিল, অনেক অনৈতিক ব্যবসা করত। সেসব প্রমাণিত হওয়ার পর ও এখন জেলে। আর সারাটা জীবন হয়তো ঐ জেলের মধ্যেই কাটিয়ে দেবে। ঐ জেলের চৌহদ্দির বাইরে আসতে পারবে না।”
মালতী খাতুন বলেন,
“ভালো। অপরাধ করলে তার শাস্তি তো পেতেই হবে।”
“হুম। যেমন আমি যেই অপরাধ করেছি তার শাস্তিও বয়ে নিয়ে বেড়াবো বাকিটা জীবন।”
বলেই মালতী খাতুন এর দিকে এক নজর তাকিয়ে তিনি সরে আসেন।
এদিকে, মোর্শেদ চৌধুরী আজ এত গুলো বছর পর শেফালী বেগম কে দেখে থমকে যান। দীর্ঘ ২০ বছর পর এই মুখশ্রী দর্শন করলেন তিনি৷ শেফালী বেগমও একই রমক ভাবে চমকে যায়। মোর্শেদ চৌধুরী সকল সংশয় ভুলে এগিয়ে এসে বলে,
“কেমন আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“শেষবার যেমনটা দেখে ছিলেন ঠিক তেমনি। এক বিধ্বস্ত হৃদয় নিয়ে বেঁচে গেছি।”
মোর্শেদ চৌধুরীর এই কথায় শেফালি বেগম হতবাক হয়ে তার চোখের দিকে তাকায়। এই চোখ জোড়ায় আজো সেই একই দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যার বহিঃপ্রকাশ তিনি দেখে ছিলেন ২০ বছর আগে, নিজের বিয়ের দিন।
★★
২ বছর পর,
সময়ের ব্যবধানে জীবন অনেকটা এগিয়ে গেছে। রাতের পর যেমন দিন আসে, দুঃখের পর যেমন সুখ আসে তেমনি আঁধার শেষে আজ সকলের জীবনে এসেছে আলো।
সৌরভ এখন ডাক্তার হিসেবে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। বৃষ্টিও নিজের ইন্টার্নশিপ শেষ করে এখন একজন নিউরোলজিস্ট ডাক্তার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের দুজনের জীবন কেটেছে অনেক সুখে। তাদের জীবনে নতুন অতিথিও আসতে চলেছে খুব শীঘ্রই। যা তাদের সুখ আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।
স্মরণ আলোর জীবনও এখন গুছিয়ে গেছে অনেকটা। স্মরণ তার বাবার বিজনেসকে আরো বড় করছে আর আলোও একজন মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে বেশ ভালো অর্জন করেছে। যদিও এখন সে ক্রিকেট থেকে কিছুটা সরে এসে সংসারে মনযোগ দিচ্ছে।
নিজের দুই মেয়েকে সুখী দেখে মালতী খাতুনও সুখী৷ এখন তার বেশিরভাগ সময় ভাই-ভাবির সাথে গল্প করেই যায়।
এদিকে এই দুটি বছরে মোর্শেদ চৌধুরী ও শেফালি বেগমের সম্পর্কও অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। মোর্শেদ চৌধুরী আর কানাডায় ফিরে যান নি। এই দেশেই অবস্থান করে নিজের প্রিয় মানুষটার মন জয়ের চেষ্টা করছেন। আজ তো সাহস করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েই ফেললেন। এর পেছনে তার ভাতিজাদেরও অবদান অনেক। তারাই তাকে উতসাহ দিয়েছে। শেফালি বেগম প্রথমে বয়সের কথা, সমাজ এসব ভেবে না না করলেও আলো, বৃষ্টি, মালতী খাতুন সবাই মিলে যখন তাকে বোঝায় তখন আর তিনিও অমত করতে পারেন না।যার ফলে মোর্শেদ চৌধুরীর এত দিনের ভালো বাসাও আজ পূর্ণতা পেতে চলেছে।
সব মিলিয়ে সবাই আঁধার শেষে আলোর দেখা পেয়েছে। তবে একজন এখনো জীবনে পরিপূর্ণ সুখ পান নি। আসলে কিছু কিছু ভুলের ফল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তেমনি হয়েছে সিরাজুল মজুমদার এর সাথে। বৃষ্টির সাথে তার মাঝে মাঝে কথা হয়, আলোও এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে, তার খোঁজ-খবর নেয়। কিন্তু মালতী খাতুন আজ অব্দি তাকে ক্ষমা করেন নি। যার ফলে তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচে নি। এজন্যই বুঝি বলে, সময় গেলে সাধন হয় না! মাঝে মাঝে কিছু কিছু আঘাত মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে৷ যার আঁধার শেষে আলো হয়তো আসে না।
তবে এই গল্পে যারা ডিজার্ভ করত তাদের সবার জীবনেই কিন্তু এসেছে আঁধার শেষে আলো।
সমাপ্ত ✨