আকাশেও অল্প নীল পর্ব-৩৪+৩৫

0
240

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ৩৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_নীল

১০৯
লাগেজ থেকে রাইমার জন্য যা কিছু আনা হয়েছে সবই রাইমার পাশে বোসে একটা একটা করে দেখিয়ে দিচ্ছে স্নেহা। গ্রামের দাদী সম্পর্কীয়, ভাবী সম্পর্কীয় মহিলা-রা ভীড় জমিয়েছে দেখবে বলে। সব দেখানো শেষে স্নেহা শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলে,

“নাও শুরু করো তোমার বান্ধবীকে সাজানো। সময় কম, ঝটপট যেমন সাজানো যায়, সাজিয়ে ফেলো।”

স্নেহার কথা শুনে রেখা খাটের উপর বসা ছিলো, সে বলে উঠে,

“আপনাদের বাড়ির বউ, আপনারা কি সাজে সাজিয়ে নিয়ে যাবেন। এটা আপনাদের বিষয় বেয়ান সাহেবা। সাজানো শুরু করুন।”

স্নেহা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আসার পর থেকে এই পিচ্চি মেয়েগুলোর কলকাকলীতে চারপাশ মাতোয়ারা। বিয়ে বাড়ির আমেজটা যেনো ধরে রাখার দায়িত্ব তাদেরই। স্নেহাকে কিছু বলতে না দেখে ইশা পাশ থেকে বললো,

“আমাদের বাড়ির বউকে তো আমরা আছিই সারাজীবন সাজানোর জন্য। আপনাদের তো এটাই শেষ সুযোগ বলা চলে! এরপর কবে সুযোগ হবে ঠিক নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে সাজিয়ে ফেলুন।”

স্নেহা বললো,

“ওসব কথা বাদ, রাই তুমি নিজেই বলো কার হাতে সাজবে?”

রাইমা শাড়ির আঁচলে ঘোমটার নিচে সলজ্জ ভাবে বসেছিলো। রাইমা স্নেহার কথা শুনে ঘোমটা-টা একটু উচিয়ে চারপাশে তাকালো। তার নজর মাহিশাকে খুজে চলেছে। মাহিশার সাথে বন্ধুত্বের শুরু থেকেই মজার ছলে হলেও তাকে বিয়ের দিন সাজাবে বলে মাহিশা নিজের স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলেছিলো। নজর ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেয়েও গেলো রাইমা। দরজার একপাশে দাড়িয়ে একহাতের কনুইয়ে অন্য হাতে চাপিয়ে অশ্রুসজল চাহনীতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাইমা তাকাতেই মাহিশা চট করে চোখ সরিয়ে উল্টোদিকে হয়ে চোখ মুছে নিলো। হাসিমুখে ফের আবার রাইমার দিকে তাকালো। ঘরের মধ্যে এতো সরগম, তবুও যেনো এক শুনশান নিরবতা বিরাজ করে চলেছে রাইমা আর মাহিশার মাঝে। রাইমা মাহিশাকে হাতের ইশারায় তার কাছে এসে বসতে বললো। শার্লিন একবার রাইমা আর একবার মাহিশাকে দেখে আলতো হাসলো। সব আগের মতো ঠিক না হোক, কিন্তু মাঝের দূরত্ব টা ঘুচে যাক। এজন্য শার্লিন নিজের জায়গা টা ছেড়ে মাহিশাকে ইশারা করে এসে বসতে বললো। স্নেহা একবার রাইমা তো একবার মাহিশার দিকে তাকায়। শার্লিন রাইমার পিছনে দাড়িয়ে বললো,

“মাহিশা আপু, আমার ননদও হবে, আবার রাইয়ের একসময়ের আমার মতোই ফ্রেন্ড ছিলো। এখনও ফ্রেন্ড তবে সে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আপনাদের সাথে আলাপ করানোর মতো সিচুয়েশন ছিলো না।”

স্নেহা জবাবে আলতো হেসে মাহিশাকে লক্ষ্য করে বললো,

“শুরু করো ছোটো আপু। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে আবারও সূদুর জেলায় পারি দিতে হবে আমাদের।”

১১০
মাহিশার খুশিতে চোখে জলই এসে গেছে। রাইমার বিয়ে ঘিরে কতো আশা, কতো ইচ্ছে ছিলো তার। নিজের দোষেই অনেককিছুই করতে পারেনি। রাইমা যে তার ইচ্ছে মনে রেখে সাজানোর জন্য কাছে ডাকলো! এটাই তার জন্য অনেক। সে আনন্দে কেঁদে ফেলেছে। রাইমার পাশে বসে টুকটুক করে সাজানো শুরু করলো। এরমাঝেই ইফরাদ এসেছে সব মেয়েদের খাওয়ার জন্য ডাকতে। এসে দরজায় দাড়িয়ে মাহিশার হাতে রাইমাকে সাজাতে দেখে থমকে দাড়ায়। বোনের জন্য রাইমাকে কম তো অপমান করেনি! সব ভুলে যখন সবকিছু একটু একটু করে ঠিক হয়ে যাচ্ছে! তারও কি উচিত বোনকে একটু একটু করেই আগের মতো ভালোবাসা! শত হোক সে তো বড়ো ভাই। বোনের জন্য ভালোবাসাগুলো বুকের মাঝে কব”র দেওয়ার মতোই আগলে রেখেছে। একবার যদি সবটুকু বিষয় বুঝিয়ে তাকে বলতো! তাহলে আজ এতো দূরত্ব আসতোই না। বিয়ের কথা তুলেছে মানেই যে বিয়ে দিয়ে দিতো, বিষয়টা তো এমন ছিলো না। থাক সেসব অতীতের চিন্তাভাবনা, হয়তো তারই খামতি ছিলো। ভাইয়ের মতো ভাই হতে পারেনি, যেমন ভাই হলে বোন এসে নির্দ্বিধায় সব বলে দেবে। ইফরাদ বোনের জন্য চোখের কোণে জমা জলটুকু বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে ছিটকে ফেলে নিজের ধাতস্থ করার চেষ্টায় মত্ত হয়ে বললো,

“এই যে ব্যান্ডপার্টি! সারাক্ষণ বাজতে থাকলেই হবে? চলো, চলো খাবে চলো!”

ইফরাদের কথা কানে যেতেই তিশা চট করে বলে উঠলো,

“আরে ছোটো দুলাভাই! এতো তাড়া কিসের? খেতে তো বসবো বড়ো দুলাভাইয়ের সাথে। নয়তো আদর যত্নটা করবো কিভাবে?”

সারাঘরে হাসির রোল পরলো। ইফরাদ কপাল চাপড়ে বললো,

“দিগন্ত ভাইয়ের অবস্থা দেখে আমার যা শিক্ষা হবার হয়ে গেলো। আমি আর এতো ধুমধাম করে বিয়ে করছিনা। শার্লিনকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে দৌড় মারবো। বাপরে বিয়ের এতো প্যারা জানলে আমি নিশ্চিত দিগন্ত ভাইও তাই করতেন।”

শার্লিন কোমড়ে হাত দিয়ে ইফরাদের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,

“সবাইকে নিজের মতো ভাবেন কেন? এমন করে বিয়ের ইচ্ছে থাকলে আপনার সাথে এই মুহুর্তে ব্রেকআপ। অনেক সুন্দরী মেয়েরা এসেছে, একটা খুজে নেন নিজের জন্য। নয়তো বউ জুটবেনা কপালে।”

“তাতে আমার আপত্তি নেই তোমার অনুমতি থাকলে। তুমি সহো তোমার কথামতো আরও একটা বিয়ে করাই যায়। তুমি মা”রলে অন্তত সে বাঁচাবে। এমনিতেও বিয়ে বাড়িতে বিয়ে হয় তো দুজনের, আর বিয়ে ঠিক হয় ১৪জনের৷”

ইফরাদের উত্তরে হাসির দমক বাড়লো পুরো ঘরজুড়ে। মাহিশা সাজানোয় ব্যস্ত থাকায় রাইমাকে হাসতে হাসতে নড়াচড়া করতে দেখে তার হাতের পিঠে থাবা দিয়ে বলে,

“আরে চুপ করে বোস না। এতো নড়িস কেন? বিয়ের দিন পেত্নী সাজাই এমন কিছু চাইছিস!”

রাইমা স্টেচু হয়ে বসে যায় মাহিশার মৃদু ধমকে৷ এদিকে ইফরাদের কথায় তো শার্লিন চোখ পাকানো দৃঢ় করে যাচ্ছে। যার অর্থ এটাই বোঝায়, একবার একা পাই! দেখাবো মজা। তার দিকে তাকিয়ে ইফরাদ ফাঁকা ঢোক গিললো। ইফরাদের কথার প্রেক্ষিতে সাইরা বলে উঠে,

“ইফরাদ ভাই এই বিষয় খেয়াল করেননি! ফেসবুকে অনেক পোস্ট হয়, মানুষ স্বপ্নে দেখে দুটো বিয়ে করে। ভাবে এক বউ অত্যা”চার করলে অন্য জন বাঁচায় । কিন্তু সত্যি হয় কি! একজন বাঁধে, আরেকজন পি”টায়। শেষে না এমন হয়ে যায় আপনার কপালটা।”

“এই তো বোনের মতো কথা। লাবিউ বইনা।”

শার্লিন সাইরার উদ্দেশ্যে ফ্লাইং কিস ছুড়ে কথাটা বললো। ইফরাদ কপাল চুলকে বিরবির করে,

“যেমন বউ, তেমন জুটবে শালীগুলো। একেকটা একেকজনের এক কাঠি উপরে। সন্ন্যাস জীবন কেমন হবে! এদের ভয়ে বিয়েই করা যাবেনা মনে হয়।”

এরপর নিজেই আর কথা না বাড়িয়ে প্রস্থান করলো। মানুষ বেশি হওয়ায় ঘরের মাঝে সিলিং ফ্যান, টেবিল ফ্যান ছাড়া থাকলেও গরম যেনো কমছেনা। এজন্য শার্লিন প্রতিবেশী সব মানুষকে নিয়ে তাড়া দেখিয়ে বললো,

“আপনারা তো খাওয়া দাওয়াই করেননি মনে হয়। চলেন চলেন, খাওয়া দাওয়া করা যাক। সাথে দুলাভাইয়ের একটু দর্শন করে আসি। বেচারা একা হয়তো বসে বসে বোর হচ্ছে। চলেন তো ভাবী-রা।”

শার্লিন সবাইকে নিয়ে বাইরে গিয়ে ঘর একদম ফাঁকাই করে দেয় প্রায়। শুধু ইশা, ঐশী, স্নেহা আর সাজাঁনোর জন্য মাহিশা থেকে যায়। সব বেরুতে মাহিশা হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে-ও সেই রাইমা আর শার্লিনের মতোই। বেশি মানুষজন সহ্য করতে পারেনা৷ ঘর ফাঁকা হতেই সে সাজানোয় আরও গভীর মনোযোগ দেয়।

১১১,
শার্লিন সহো বাকি মেয়েরা এসে দেখে আরফান দিগন্তের কোলে বসে স্টেজে বসে আছে। একপাশে মাহাদ অন্য পাশে রাইমার দাদা বসে আছেন। জুতা টা পায়েই পরা। হয়ে গেলো, তাদের সাধের জুতা চুরির প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেলো। যাকগে সেসব না পারলো একটু বিরক্ত তো করা যায়! সে সব মেয়েদের নিয়ে দিগন্তের সামনে গিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু করে দেয়। দিগন্তও বিষয়গুলো ইনজয় করছে। বিয়ে বলে কথা! এতো তো বিরক্ত হলে চলে না। এভাবে একঘন্টার মতো সময় চলে গেলে আজাদ সাহেব তাড়া দেন, এবার রেজিস্ট্রি, কবুল বলা হবে। কাজী সাহেব এসে পরেছেন। শার্লিন সব শুনে ছুটে রাইমার কাছে আসে সাজানোর কতোদূর এটা দেখতে। এসে দেখে সব শেষ। শুধু মাথায় দোপাট্টা-টা সেট করে বাকি। মাহিশা শার্লিনকে দেখেই বলে,

“তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। এসো, তুমি এই কাজটুকু করো।”

“তুমিই তো সব করে ফেলেছো আপু। আমি আর কি করবো! তুমিই করে ফেলো।”

“এই আমি তোমার এতোটাও বড়ো নই, আপু আপু শুরু করেছো। সেম এজই তো আমরা।”

মাহিশা শার্লিনের কথার জবাব দেয়। শার্লিন মুচকি হাসে। কথা না বাড়িয়ে রাইমার পিছনে দাড়িয়ে দোপাট্টা সেট করে দেয়। এরপর সামনে দাড়িয়ে চোখ থেকে কাজল নিয়ে কানের পিছনে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,

“মাশা আল্লাহ, আমার আত্মার মানুষ টার উপর, তার সুখের উপর কারোর বদ নজর না পরুক। আপনি সবটা সময় ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুখে থাকুন। প্রতিটা মোনাজাতে এটাই চাইবো। সংসার জীবনে পা দিচ্ছেন, এতোটা বুঝ আমার নেই। কিন্তু কিছু কথা বলি, আপনি ভীষণ নরম মনের মানুষ আমার আত্মার সাথী। হয়তো নিজেকে অনেকটা স্ট্রং হিসেবে সবার মাঝে প্রেজেন্ট করেন, আদৌও আপনি ততোটা স্ট্রং নন আমি জানি। নিজের বাবা-মাকে যেভাবে সংসার করতে দেখে বড়ো হয়েছেন। সেভাবে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন। ছোট্টখাট্টো ঝামেলায় কষ্ট পাবেন না। মায়ের কথা মনে করবেন, লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে মিটানোর চেষ্টা করবেন। আমি জানি আপনি শান্ত মানুষ। সব শান্ত ভাবেই সামলে নিবেন। আপনার জীবনে ঝামেলাও কমই আসবে। আসবেনা, এই ভরসা তো দেওয়া যায় না। কারণ সংসার জীবন, ঠুকঠাক ঝামেলা সবারই হয়। ঘাবড়াবেন না। শান্ত ভাবে সামলে নিবেন। আপনার উপর আমার ভরসা আছে। দিগন্ত ভাই বাইরে থেকে রুক্ষ মেজাজের হলেও ভেতরটা বাচ্চাদের মতোই নরম। তাকে সামলে রাখবেন। মনে রাখবেন, আপনি একমাত্র বর্তমানে উনার জীবনে একটাই আপন মানুষ। স্নেহা ভাবী তো আপনার ভাইকেই সামলাচ্ছে। আপনিও তাকে সামলে সুস্থ, সুন্দর একটা সংসার গড়ে তুলবেন। আপনার কাছে আমার এটুকুই আর্জি কষ্ট পেলে সেটা চেপে রেখে অভিমান না বাড়িয়ে মিটিয়ে নিবেন। জানেনই তো ভালোবাসার থেকে ভয়ংকর কিছু হতে পারেনা। ভালোবাসা সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর। এটা একমাত্র আমার মতো ভালোবাসার কাঙাল-রাই বুঝতে পারি। হাতের জিনিস কখনও পায়ে ঠেলে দিয়ে সরে আসবেন না। আকড়ে ধরে সুন্দর একটা জীবন কাটিয়ে দিন। আপনি পারবেন আমি আশা রাখি। চলে তো চাইলেই যাওয়া যায়! আকড়ে ধরে বাঁচে ক’জন বলুন! দিগন্ত ভাই নিজের বাবা মায়ের যে তিক্ততা দেখে বড়ো হয়েছেন! সেই তিক্ততার ছাপ উনার উপর আবারও পরতে দিবেন না কখনও। তখন যে চাইলেই মানুষ টাকে সামলানো যাবেনা। স্নেহা ভাবী পারবেন না তো সামলাতে। আপনার জীবন, সংসার জীবন আল্লাহ রহমত ময় করে দিন, সেটাই চাইবো সবটা সময়। ভালো থাকবেন আমার সাথী, আপনি ভালো থাকবেন। আজ হতে আমরা কাছের মানুষ-রা আপনার দূরের মানুষ। আর দূরের মানুষগুলোই আপনার কাছের। এটা মনে রাখবেন।”

১১২,
শার্লিন একদমে কথাগুলো বলে নিজের কান্না লুকাতে চলে গেলো ঘর থেকে। উপস্থিত সকলে নির্বাক, শান্ত চাহনীতে শার্লিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। রাইমা হতবিহ্বল হয়ে পরেছে শার্লিনের কথাগুলো শুনে। একটা চঞ্চল, দুষ্টু মেয়ে, যার কাজই সবটা সময় সবাইকে হাসিয়ে চলা! সে এতো ভারী কথাও বলতে জানে। রাইমার ভেতরে ভেতরে কান্নারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। উফ কি দারুণ য”ন্ত্রণা। কাছের মানুষগুলো দূরের, দূরের মানুষগুলো কাছে। ইশশশ! এমনটাও মেনে নিতে হয় জীবনে! হয়তো, হয় বলেই এর নাম সংসার জীবন। কাজী দরজায় এসে উপস্থিত হওয়ায় রাইমা নিজেকে সামলে নেয়। আজাদ সাহেব সহো বাকি মুরব্বিরা উপস্থিত হয়েছেন। স্নেহা সবাইকে নিয়ে সরে দাড়িয়ে উনাদের ভেতরে আসার জায়গা করে দেয়। হামিদা বেগম এসে নাতনীর পাশে বসেন। অন্যপাশে আজাদ সাহেব আরফানকে এনে বসিয়ে দেয়। রাইমা অনেকক্ষণ পর ভাইকে কাছে পেয়ে তার ছোট্ট হাত আকড়ে বসে। কাজী সাহেব তার কাজ সম্পূর্ণ করে রেজিস্ট্রি পেপার রাইমার দিকে এগিয়ে দিলে রাইমা বাবার মুখের দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রয়। আজাদ সাহেব মেয়েকে চোখের ইশারায় সাইন করতে বলেন। এই একটা তিন অক্ষরের সাইন অন্য একটা মানুষকে তার উপর অধিকার ফলানোর জন্য অধিকার দিয়ে বসবে! বাবার জোড় টা আগের মতো আদৌও রইবে! আজগুবি চিন্তা করতে করতে সাইন টা করেই দেয় রাইমা। এরপর আসে কবুল বলার পালা। কাজী সাহেব সব কথা বলে রাইমাকে কবুল বলতে বলায় আজাদ সাহেবের বুকের মাঝে হু হু করে উঠে। অবশেষে বাবার রাজকন্যা অন্য কারোর ঘরের ঘরণী হয়েই যাচ্ছে। রাইমা চারদিকে নজর বুলিয়ে মা-কে খুজে বেড়ায়। পেয়েও যায়৷ দরজার কাছে শাহনাজ বেগম সহো তার চাচী, ফুফু, খালা, মামীরা দাড়িয়ে আছে। মামাদের চাকরি থেকে ছুটি মিলছিলো না, এজন্য বিয়েতে আসতে পারতো কিনা ঠিকই ছিলো না। তবুও বিয়ের দিন বরপক্ষ আসার পরপরই উনারা আসতে পেরেছেন এটাই আনন্দের বিষয় রাইমার কাছে। উনারা তাদের আদরের মেয়েকে অন্য মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার কার্যক্রম উনারাও দেখছেন। চোখে জল, ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে কবুল বলতে ইশারা করছেন। রাইমাও কেঁদে ফেলেছে। তবুও হাসি হাসি মুখ করে বলেই দেয়,

“কবুল।”

শাহনাজ বেগমদের পেছনেই দাড়িয়ে ছিলো শার্লিন। রাইমা কবুল বলতেই চোখের সামনে সাড়ে ৪টা বছরের বন্ধুত্বের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। চাইলেও আর আগের মতো সে রাইমাকে তার পাশে পাবেনা। শার্লিন নিজেকে সামলাতে পারলো না। বারান্দাতেই হাটু মুড়ে বসে চিৎকার করেই কান্না করে উঠলো। সবাই এদিকে শোকর আদায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলো। তার মাঝেই শার্লিনের চিৎকার শুনে শাহনাজ বেগম চট করে পিছন ফিরে তাকান। সবার দৃষ্টি চলে যায় শার্লিনের দিকে। রাইমা সবাইকে পাশ কাটিয়ে ছুটে এসে বান্ধবীকে আকড়ে ধরে। রাইমাদের বাড়িটা টিনশেড হওয়ায় মেঝে পাকা ছিলো বিধায় কাপড়চোপড় মাখার কথা নয়। কিন্তু সবাই জুতা পায়ে হাটছে। সেই ধুলোর মাঝে এমন করে বসে পরায় শাহনাজ বেগম আর সাহিরা বেগম দুই মেয়েকে টেনে তুললেন। তাদের কান্নায় যেনো আকাশ বাতাসও আজ গম্ভীর হয়ে গেছে। সবার চোখের কোণে জল জমে গেছে। বিদায়ের সময় না আসতেই দুজনের কান্না সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। শার্লিন কান্নার চোটে প্রলাপ বকছে। একনাগারে বলে যাচ্ছে,

১১৩,
“আপনাকে আর চাইলেই পাশে পাবো না প্রাণ, আপনি আমার সাড়ে চার বছরের অভ্যাস। আপনাকে সকাল হলেই আমি কারণে অকারণে দেখতাম, জ্বা’লাতাম। আজ থেকে আগামীকাল হতে কাকে জ্বা”লাবো! বলে দেন! আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে আত্মার সাথী। আপনি কাগজ-কলমে আজ একজনের হলেন। আপনাকে আটকে রাখার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু আপনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অভ্যাস আমি বদলাবো কি করে! জানেন তো আপনি আমার শান্তির জায়গা। আপনি ছাড়া এই মেয়েটা এককদম চলতেও হোচট খায় এখন। আমায় যে আপনার মতো শাসন করে কেউ আগলাতে পারবেনা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে প্রাণ।”

দিগন্ত স্টেজে বসেই সবার অবস্থা দেখে নিজেও ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। সে ঠিক করেই নেয়, এদের বন্ধুত্বে দেওয়াল হবেনা। ওদের ইচ্ছেমতোই ওরা আড্ডা, ঘোরাঘুরি বিয়ের আগে যেমন করতো, তেমনই থাকবে সব। ইফরাদ, মিহাল, নিহাল, মেসবাহ, মাহাদ দিগন্তকে ছেড়ে এসে বারান্দার কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে ওদের কান্না দেখে নিজেরাও ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। রাইমা শার্লিনের কথাগুলো শুনে থামানোর চেষ্টা করবে কি! নিজেই কান্না জুড়ে দিয়েছে। মাহিশা ঘরের দরজার কোণে দাড়িয়ে ছিলো। দুজনকে কাঁদতে দেখে সে পারেনি নিজেকে সামলাতে। রাইমার সাথে ছোটো থেকে বড়ো হওয়া! এতোদিনের দূরত্ব সব মিলিয়ে তার বুকের মাঝেও যন্ত্রণার ঝড়। সেও ছুটে এসে দুজনকে জড়িয়ে কান্না করে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টায় নামলো। বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ এদের বন্ধুত্বের বন্ধন দেখে কান্না করে দিয়েছে। এই স্বার্থ দেখার সময়ে এসেও এতো পাগলামি করার মতো বন্ধুত্বও হয়! শাহনাজ বেগম নিজেও যেনো পাগলের মতো হয়ে গেলেন। শার্লিন, মাহিশা এবং মেয়েকে জড়িয়ে তিনজনকেই শান্ত করার জন্য বললেন,

“মাহিশা আর শার্লিনকে পাওয়ার পর কখনও ভাবিনি আমার এক মেয়ে। আমার তিনটা মেয়ে। বড়ো মেয়ে তো সংসার সাজিয়ে নিয়েছে, মেঝো জনকেও দিয়ে দিলাম অন্যের হাতে। ছোটো জনকেও দিয়ে দিতে হবে। তিনটা মেয়েকে হারিয়ে আমি এক মা পথের কাঙাল হবো। আমার ঘরের জান্নাতদের অন্যের ঘরে দিয়ে আমার ঘরে যে হাহাকার জমবে! সেগুলো কে দেখবে মায়েরা আমার! তোমরা নিজেরা এভাবে ভেঙে পরলে আমরা বাঁচবো কি করে? শান্ত হও, মায়ের কথা ভেবে হলেও শান্ত হও।”

শাহনাজ বেগমের কথা তাদের কর্ণ কুহরে আদৌও যাচ্ছে কিনা! কেউ বুঝতে পারলোনা। আজাদ সাহেব তো বাবা, চাইলেও সবার মতো কাঁদতে পারলেন না। মেয়েদের সামলাতে ইফরাদ আর সামিদকে ইশারায় তাদের প্রিয়তমাদের সামলে নিতে বললেন। ইফরাদ এসে শার্লিনে হাত ধরে সরিয়ে নেয়, সামিদ মাহিশাকে। তাদের মেয়ের কাছে নিয়ে যায়। আদ্রিশা তার নানীর কোলে ছিলো। সামিদ সেখানেই নিয়ে যায় মাহিশাকে। এদিকে বিয়ের বাকি কার্যক্রমও সম্পন্ন করতে লেগে পরে সবাই। দিগন্তকে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করিয়ে কবুল বলতে বলা হয়। দিগন্ত একবার অদূরে দাড়ানো বোন, দুলাভাই, চাচা, ফুফার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়,

“কবুল।”

সবাই একত্রে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। এরপর মিষ্টি দেওয়া হয় সবার মাঝে। এরপর মিহাল-নিহাল মিলে রাইমা-দিগন্তকে পাশাপাশি চেয়ারে বসিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলে। আজাদ সাহেব হতে শুরু করে প্রতিটা মুরব্বি সহো পুরো পরিবার একসাথেই খেতে বসিয়ে দেয় তারা। ইফরাদ, মিহাল, নিহাল, মেসবাহ, রাহান সার্ভ করে দেয় নিজ হাতে। রাইমার কান্না থামছে না। তবুও সবার মুখ পানে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে খেতে বসে। আবার কবে, চাচা-চাচী, ফুফু-ফুফা, খালা-খালু,, মামা-মামী-রা, দাদা-দাদী, সকল ভাইবোন সবার সাথে বসে একসাথে খাবে! তার তো ঠিক নেই। সবার জীবনে যে ব্যস্ততা। রাইমা নজর ঘুরিয়ে শার্লিনকে খুজছে। পেলো না, সে ইফরাদের দিকে তাকালো। ইফরাদ তখন সবার পাতে মুরগীর রোস্ট সার্ভ করছিলো। রাইমার পাতে দিতে আসতেই রাইমা ধীর স্বরে বলে,

“ইফরাদ ভাই! শালুকে দেখছিনা যে!”

“পাগলি টার কথা ছাড়ো। তোমাকে দেখেই কান্না আটকাতে পারছেনা। বড়ই গাছের সাথে হেলান দিয়ে কাঁদছে। খাওয়া শুরু করো। আমি আনছি ওকে।”

রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই পাগলিটা যে কি! বুঝতে পারেনা সে। মাত্র কিছু বছরের পরিচয়ে এতো আপন কেউ হয়! এই মেয়েকে না দেখলে জানতেই পারতোনা। ইফরাদ নিজের হাতের কাজ শেষ করে জোড় করে শার্লিনের হাত ধরে টেনে এনে রাইমার পাশে চেয়ার এনে বসিয়ে দেয়। শার্লিন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাইমা খাওয়ার মাঝেই বা হাতে শার্লিনের হাত ধরে ওর মুখের দিকে তাকায়। শার্লিন তাকাতেই রাইমা স্মাইলি ফেইস করতেই শার্লিন হাসার চেষ্টা করে। এরপর রাইমা ইশারা করে খাওয়ার জন্য। ইফরাদ খাবার এনে দিতেই সবাই খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার মাঝেই দিগন্ত বলে উঠে,

“তোমার বান্ধবীকে বিয়ে করলাম শালু, নিয়ে জেলাখানায় আটকে রাখবো না তো। এতো কাঁদছো মনে হচ্ছে অন্যদেশে নিয়ে দৌড় দিবো। তোমরা একসাথে আছো, থাকবে। ইচ্ছে হলেই ছুটে যাবে। কোনো বাঁধা নেই।”

শার্লিন নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করলো। এরপর মনোনিবেশ করে খাওয়ার দিকে। আজাদ সাহেব শার্লিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“পাগোল মেয়ে আমার। কোথায় বোনের বিয়ে, কবজি ডুবিয়ে খাবে, আনন্দ করবে! তা নয় চোখের জল নাকের জল এক করে সাজগোজ নষ্ট করে একেবারে ভুতনী হয়ে বসে আছে।”

আজাদ সাহেব হাসানোর জন্য যে কথা-টা বললেন, এটা সবাই বুঝলো। এজন্য আনন্দের মাঝেই খাওয়া শেষ করতে চাইলো সবাই।

১১৪,
খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে আসলো। এরপর রাইমা দিগন্তকে পাশাপাশি বসিয়ে আয়নায় মুখ দেখা, মায়ের হাতে দুধভাত খাওয়ানোর পর্ব চুকিয়ে সময় আসলো জামাইয়ের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়ার নিয়ম। আজাদ সাহেব স্টেজে উঠে রাইমার হাত টা দিগন্তের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

“আমার আদরের রাজকন্যা, বাবা-রা হয়তো রাজা হইনা আমরা। কিন্তু আমাদের কন্যাকে রাজকন্যার রুপেই মানুষ করি। আগলে রেখো বাবা। কষ্ট দিয়ো না। আমার মেয়ে মোমের মতো, ও গলে যায় অল্পতেই। তুমি শক্ত হাতে সামলে রেখো।”

আজাদ সাহেব কেদেই দিবেন এমন অবস্থা। দিগন্ত কিছু উত্তর দিতে পারলোনা শ্বশুর মশাইয়ের অবস্থা দেখে। শুধু উনার হাতের উপর অপর হাত দিয়ে চোখের ইশারায় আশস্ত করলেন। এরপর আসলো বিদায়ের পালা। এই সময়টা যে কি ভয়ানক! বর্ণনাতীত। স্নেহা একহাতে আকড়ে রাইমাকে গাড়ির কাছে আনলো। শাহনাজ বেগম সহ রাইমার খালা, ফুফু, চাচী, মামীরা নিজেদের হাতে আগলে বড়ো করা আদরের মেয়েটার বিদায় বেলায় আর সামলাতে পারলেন না। সাইরা, সাইফা, তিশা, রাহান, মিহাল, নিহাল, শিখা, রেখা নিজেদের আদরের বোনের থেকে দূরেই থেকেছে সবসময়। তবুও যেটুকু সময়ের জন্য কাছে পেয়েছে, আবার চাইলেই নিজেদের চাওয়া মতোই কাছে পাবেনা। দিগন্তের ব্যস্ততা থাকবে, রাইমার সংসার হবে। তাদের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠছে। বাবা-রা তো চাইলেই কাঁদতে পারেন না। উনারা সবাই দূরেই দাড়িয়ে মেয়ের বিদায় দেখছেন। হামিদা বেগম ও আরফানকে রাইমার সাথে দেওয়া হলো। শার্লিনকে আশে পাশে পাওয়া গেলো না। এখানে থাকলেই আবার তার পাগলামি শুরু করে। ইফরাদ তাকে নিয়ে সরে গিয়েছিলো। তবুও শেষ মুহুর্তে এসে সে রাইমাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এরপর বুকের মাঝে কষ্ট চেপেই রাইমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। সবাইকে বিদায় জানানো হয়ে গেলে গাড়ির দরজা আটকে দেয় দিগন্ত। রাইমা গাড়ির কাচ নামিয়ে এক পলক সবাইকে আবার দেখে নেয়। সবাই একসারি হয়ে দাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে তাকে বিদায় জানায় হাসিমুখে৷ রাইমা লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে সীটে গা এলিয়ে দেয়। নিজের মনকে শক্ত করে, মেয়েদের জীবন এটাই। দিগন্ত রাইমার একহাত নিজের হাতে আঁকড়ে ধরে বলে,

“ধরলাম হাত,, ইনশা আল্লাহ কখনও ছাড়বোনা পুষ্পবতী। আপনি আমার মানসিক শান্তি হয়ে রয়ে যান, আমি আপনাকে আমার কাছে যত্ন করে রেখে দিবো। ঝড়ঝাপটা আসবে, কখনও হাত টা ছাড়িয়েন না। আপনি ছাড়া আমার অস্তিত্ব এখন হতে কিছু টা ঠুনকোই। দিগন্ত আহসান যে ধীরে ধীরে রাইমা খন্দকারের মায়ায় ডুবছে। কি করে যে ঝগড়া করতে করতে আপনাকে বিয়েই করে নিলাম, বুঝে উঠতে পারলাম না৷ কিন্তু আপনার মায়ায় ডুবে যাচ্ছি। অদ্ভুত না?”

“আপনি পুরো মানুষ টাই অদ্ভুত মি: দিগন্ত আহসান।”

রাইমা আলতো হেসে উত্তর দেয়। তখনই স্নেহা আর মাহাদ গলা খাকাড়ি দেয়। মাহাদ বলে,

“বড়ো ভাই আমি, গাড়িতেও আছি। একটু লজ্জা রেখে বাসর ঘরে তোমরা নিজের মায়ায় ডুবিয়ো আমার শালাবাবু, আদরের বোন।”

দিগন্ত হাসলো মাহাদের কথায়। সে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে। স্নেহা দিগন্তের অন্য পাশে বসা। পরিচিত মানুষদের সাথে থাকলে হয়তো রাইমার খারাপ কম লাগবে। এজন্য একসাথেই বসেছে তারা। মাহাদ দিগন্তের দিকে ফিরে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বললো,

“আরে শালাবাবু আপনারা যে আমি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেও পরিচিত ছিলেন, এটা তো বুঝতেই পেরেছি। এবার বলেন তো এই যে ঝগড়ার কথা বললেন! এতো ঝগড়া করলেন কবে!”

“এই এটা আমারও জানার আগ্রহ আছে।”

স্নেহা মাহাদের কথায় তাল মেলালো। দিগন্ত একবার রাইমার দিকে তাকিয়ে মাহাদ আর স্নেহার দিকে তাকালো। রাইমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। তাদের মাঝে পরিচয় হওয়া, ঝগড়া হওয়া সব চোখের পাতায় ভাসছে তাদের। দিগন্ত সীটে গা এলিয়ে রাইমার মাথাটা নিজের কাধে নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের দেখা হওয়া থেকে শুরু করে সব খুলে বলে। সব শুনে স্নেহা আর মাহাদ হতবাক। স্নেহা ভাইয়ের বাহুতে কি”ল মে”রে বললো,

“যাকে ঝগড়ার সাথী বানিয়েছিলিস, তাকেই জীবন সাথী হিসেবে পেলি। দারুণ তো ভাই।”

দিগন্ত মুচকি হেসে বললো,

“সে আমার আকাশে অল্প নীল আপু। নীল মেঘের মতো জমে এসে বৃষ্টি ঝড়িয়ে ঝকঝকে আকাশের মতো সুন্দর করে দিতেই তার আগমন আমার জীবনে।”

“আগলে রেখো তোমার #আকাশেও_অল্প_নীল আনা এই মেয়েটিকে।”

মাহাদ মৃদু হেসে কথাটা বললো। দিগন্তও হেসে মাহাদকে ভরসা দিলো।

চলবে?

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ৩৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১১৫,
রাইমার বিদায়ের পর নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছে শার্লিন। রাইমা চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়ি তার অভাবে খা খা করছে। শার্লিন নিরবে পুকুরপাড়ের শান বাধানো ঘাটে বোসে আছে ইফরাদের কাঁধে মাথা এলিয়ে। শিখা, রেখা, সাইরা, সাইফা, তিশা, রাহান, মিহাল-নিহাল, মেসবাহ সবাই মিলে উঠোনে চেয়ার পেতে গোল হয়ে মনমরা হয়ে বোসে আছে। মাহিশা বারান্দা থেকে নামার জন্য তিনটে সিড়ি বানানো।,সেই সিড়ির উপর সামিদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে শার্লিনের মতোই নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত। এটা যে আসলে বিয়ে বাড়ি তার চিত্র পাল্টে একট মানুষের অভাবে শোক বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে এতো এতো মানুষ। অথচ সবথেকেও যেনো নেই। এতো শূ্ণ্যতা মানা যায়! শাহনাজ বেগম সবার দিকে নজর বুলিয়ে হতাশ হলেন। বাচ্চাদের এতো মনমরা অবস্থায় মানা তো যায়না। মেয়েকে বিদায় দিয়ে যে উনি সস্তি পাচ্ছেন বিষয় টা এমন নয়। কিন্তু নারীদের জীবনই তো এমন। বাবার ঘর আলো করে এসে নির্দিষ্ট একটা সময়ে গিয়ে পরের ঘর আলো করতে হয়। এই তিক্ত সত্য যতো তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যাবে। ততো তাড়াতাড়িই বিষয়টা সুন্দর মনে হবে। এতো ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সবার মাঝে এতো নিস্তেজ অবস্থা মানা যাচ্ছে না। শাহনাজ বেগম মেসবাহকে ডাকলেন। ধীরস্থির ভাবে কিছু একটা বললেন। মেসবাহ উনার কথামতো মিহাল এবং নিহালকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লো। উদ্দেশ্য শাহনাজ বেগমের কথামতো একটা কাজ সম্পূর্ণ করা। শাহনাজ বেগম বোনকে ডেকে সাথে নিয়ে ঢুকলেন বাড়ির ভিতর। এরপর গামলা ভর্তি চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে, পেয়ারা স্লাইস করে কে”টে পেয়ারা দিয়ে খাওয়ার জন্য মশলা বানালেন। ছোটো জা-কে ডেকে তার সাহায্যে বিশাল কয়েকটি মাদুর নিয়ে বাহির উঠোনে আরও বেশ কয়েকটা লাইট জ্বা”লিয়ে দিলেন। মাদুর পেতে গামলা ভর্তি মুড়ি মাখা, কা”টা পেয়ারা আনলেন। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে শাহনাজ বেগমের কাণ্ড দেখছে। কি হচ্ছে তাদের মাথায় ঢুকছেনা। তিশা তো প্রশ্ন করেই বোসে,

“ফুফু এসব কি হচ্ছে!”

“অনেক শোক তাপালে সবাই। আসো সবাই গোল হয়ে বোসে পরো। মুড়ি মাখা খাও, পেয়ারা খাও। সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে দাও। আড্ডা দাও, মজা করো। এই বয়সে মজা করবেনা তো কি আমাদের মতো বুড়ো হলে মজা করবে?”

উনার কথা শুনে সব ছেলেমেয়েরা হতবাক। শাহনাজ বেগমের কথা যেনো মাথায় ঢুকছেনা। শাহনাজ বেগম নিজেই আগ বাড়িয়ে অল্প সাউন্ডে সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে দিলেন। এরপর সব ক’টার হাত ধরে এনে বসিয়ে দিলেন মাদুরে। শার্লিনের কাছে গিয়ে গলা খাকাড়ি দিতেই ইফরাদ সরে যায় চট করে। এরপর শার্লিন আর ইফরাদ দুজনেরই হাত ধরে এনে মাদুরে বসিয়ে দেন। মাহিশা আর সামিদকেও টেনে এনে বসিয়ে দিয়ে সব বড়োদেরও ডাকলেন। মুহুর্তে মন খারাবি গায়েব হয়ে যেনো উৎসবের আমেজ লেগে গেলো। এরমাঝেই মেসবাহ, মিহাল, নিহাল এসে উপস্থিত হয়। হাতে কোঁকাকোলা, আইসক্রিম তো তেমন ভালো মানের পাওয়া যায়না গ্রামের দোকানে। তবুও সবার জন্য চকবার আইসক্রিম, চকলেট একগাদা নিয়ে হাজির তারা। এসব আনতেই শাহনজা বেগম তাদের পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো এনে মাদুরের উপর ছড়িয়ে দিতেই সবাই আড্ডায় মেতে উঠে। সবার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে শাহনাজ বেগম শান্তি পেলেন। এক মেয়ে চলে যাওয়ার বদলে এতোগুলো ছেলেমেয়ের মাঝে শোকের আবহ উনার মনে মানছিলো না। এজন্য বাড়ির সবাইকে একটু হাসানোর চেষ্টা করতে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আড্ডা দিতে ব্যস্তরত সবার উদ্দেশ্যে আজাদ সাহেব এসে বললেন,

“আগামীকাল তো ছেলের বাড়িতে যেতে হবে, বউভাত। সকাল ১১টার মাঝে সবাই রেডি থাকবে বুঝলে? সকাল সকাল গিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। এরপর সব নিয়ম শেষ করে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। রমজান আসছে দুদিন পর, প্রস্তুতি তো শেষ করতে হবে। সবারই জীবনের ব্যস্ততা আছে।”

সবাই উনার কথার জবাবে একসাথে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো তারা রেডি থাকবে।

১১৬,
সব নিয়মের পার্ট শেষ করে সবে বাসর ঘরের দরজায় এসে দাড়ালো দিগন্ত। রাইমাকে আগেই বাসরঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাসরঘর দরজার সামনে আসতেই তার ভীমড়ি খাবার যোগার। স্নেহা, মাহাদ থেকে শুরু করে ইশা, ঐশী, আয়মান, ইশফাক সবাই দরজা আঁটকে দাড়িয়ে আছে। দিগন্তের সবাইকে দেখে হেঁচকি উঠে গেছে প্রায়। সে নিজের নার্ভাসনেস সবার সামনে প্রকাশ করলো না। বোকার মতো হেসে হাত নাড়িয়ে বললো,

“হাই এভরিওয়ান!”

“হাই-টাই পরে হবে ভাই। আগে টাকা দাও। এরপর আমরা দরজা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নিজের শালা-শালীকে অনেক টাকা দিয়ে আসছো। আমাদের জন্য এবার মনখুলে টাকা ছাড়ো, আমরাও মন খুলে তোমার বাসর যেনো সুন্দর হয় দোয়া করবো।”

আয়মান কথাটা বললো। ওর কথায় সবাই তাল মিলিয়ে বললো,

“ঠিক ঠিক। দিয়ে দাও এখন টাকা। আমরা গেইট ছাড়ি।”

মাহাদ বললো,

“এমনি অনেক ক্লান্ত লাগছে। মাঝরাত তো হয়েই গেছে শালাবাবু। আমাদের সাথে তর্ক করলে উল্টে বাকি বাসর করার সময় টাও মাটি হবে ভাই।”

দিগন্ত আর কি করবে, বেচারা একা হয়ে তো এতো মানুষের সাথে তর্ক করা চলে না। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা টাকা ছিলো বের করে দিলো। এমনিতেও বেশি বড়ো এমাউন্টও ছিলো না। যা ছিলো তাতেই সবাই খুশিমনে দরজা ছেড়ে চলে গেলো। দিগন্ত হাফ ছেড়ে বুকের মাঝে ধুকপুকে অনুভূতি নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতর থেকে দরজা আঁটকিয়ে রাইমার দিকে দৃষ্টি ফেলে। মেয়েটা ক্লান্ত তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিছানার বোর্ডের সাথে অর্ধ ভাবে হেলান দিয়ে শুয়ে পরেছে ইতিমধ্যে। দিগন্ত প্রবেশ করার শব্দ পেতেই রাইমা চট করে চোখ মেলে। বিছানা থেকে নেমে দাড়ায়। দিগন্ত ধীর কদমে হেঁটে রাইমার সামনে দাড়াতেই রাইমা সালাম করতে উদ্দ্যত হয়। দিগন্ত হাত দিয়ে রাইমাকে আঁটকে দেয়। রাইমাকে দাড় করিয়ে দিয়ে দুগালে হাত ছোঁয়ায়। পূর্ণদৃষ্টি মেলে রাইমার চোখে চোখ মেলায়। দুজন দুজনকে এতোটা কাছ থেকে প্রথম দেখছে তো। সময়টা যেনো তাদের জন্য থমকে গেছে। দিগন্তের চোখে রাইমা নিজের জন্য অনুভূতি হাতরে বেড়ায়। চোখ দুটোয় কি যে মায়া! এই মায়ায় ডুবলে রাইমা কূল পাবে তো! ইশশ কি সুন্দর অনুভূতি। নিজের করে পাওয়া এই লোকটির প্রতি আচমকা কেমন একটা প্রেম প্রেম অনুভূতি হচ্ছে রাইমার। সে লাজলজ্জার মাখা খেয়ে দিগন্তকে বলেই বসে,

“আপনাকে দেখে আমার কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে দিগন্ত সাহেব। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।” (কোথাও একটা পড়েছিলাম বোধহয়। সেই উক্তি লেখার দরুণ আবার কপি বলে চালিয়ে দিয়েন না)

রাইমার কথা শুনে দিগন্ত নিজের হেঁচকি আর থামাতে পারলো না। সে রাইমাকে ছেড়ে দূরে দাড়িয়ে পরলো। রাইমা বেড সাইড টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে দিগন্তের দিকপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

“কি হলো? ঠিক আছেন আপনি?”

১১৭,
দিগন্ত রাইমার হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে পানি ঢকঢক করে খেয়ে বললো,

“আপনি নির্লজ্জ এটা জানি আমার অ”সভ্য বউ। কিন্তু সোজা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! এটা কেমন কথা!”

রাইমা দিগন্তের সামনে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বললো,

“আপনাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করলে আমার কি দোষ! আপনি এতো কিউট কেনো হতে গেছেন?”

দিগন্ত হাতের গ্লাস টা রেখে রাইমার দুবাহু নিজ হাত দ্বয়ে আঁটকে বললো,

“পুষ্পবতী, অনেক মজা করলেন। এবার চলুন, ফ্রেশ হোন। নামাজটা আদায় করা যাক?”

রাইমা মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। প্রথমে রাইমা এরপর দিগন্ত বিয়ের ভারী সাজ ছেড়ে নরমাল।সুতির শাড়ি আর দিগন্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরে নিলো। দুজনে একত্রে নামাজ পরে উঠলো। নামাজ শেষে রাইমা বিছানায় বসে নখ খুঁটতে শুরু করে দেয়। দিগন্তর সাথে একা এক রুমে ভাবতেই তো তার ঘুম উড়ে যাচ্ছে। দিগন্তও নার্ভাস হয়ে পরেছে। যতোই সে শক্ত মনের পুরুষ হোক! স্ত্রীর সামনে এসে তার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। রজনীগন্ধা, তাজা গোলাপে সাজানোর ঘরটায় রজনীগন্ধার সুবাস মো মো করছে পুরো রুম জুড়ে। রাইমার প্রিয় ফুল সূর্যমুখীরও দেখা মিলছে কিছু কিছু জায়গায়। দিগন্তও রাইমার পাশে বসে রাইমার দেখাদেখি নখ খুঁটতে শুরু করে। রাইমা তা দেখে মুখ থেকে নখ সরিয়ে বলে,

“আমার মতো আপনারও নখ খুঁটার বদ অভ্যাস আছে?”

“ছিলো না, আপনাকে দেখে বোধ হয় হয়েই যাবে এই অভ্যাস।”

দিগন্তের উত্তরে দিগন্তের বাহুতে কি”ল মে”রে বসে রাইমা। কিল মে”রে বলে,

“ধুর কি বলেন এসব!”

দিগন্ত রাইমার কি”ল খেয়ে বিরবির করে বলে,

“আদরের বদলে মা”ইর দিয়ে বউয়ের সাথে আলাপ শুরু। বোঝা গেলো, ইনশা আল্লাহ কি”ল খেয়েই আমার জীবন পার হয়ে যাবে।”

রাইমা দিগন্তকে বিরবির করতে দেখে বললো,

“কিছু বললেন?”

“না, কিছু বলিনি। আপনার খিদে পেয়েছে? খাবারের ব্যবস্থা করবো? সারাদিন অনেক ধকল গেছে। কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পরি চলুন!”

“আপনি কি কা”না?”

আচমকা রাইমার এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেলো দিগন্ত। থতমত খেয়ে বললো,

“কানা হবো কেন?”

“আপনার চাচী, ফুফ যে আসার পরপরই ঘরে তুলে আমায় খাইয়ে দিয়েছে! চোখে দেখেননি?”

“দেখবো কি করে? আরফান ঘুমিয়ে কাঁদা হয়েছিলো। দাদী সহো তার শোয়ার ব্যবস্থা করতে গেছিলাম তো।”

“আচ্ছা বাদ দিন, আজ তো বাসর রাত। এই রাতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যা সম্পর্ক হয়, আপনি চাইলে জড়াতে পারেন। আমার দিক থেকে সমস্যা নেই। জীবনের আঠাশ বছর সিঙ্গেল থেকে বউ পেয়ে তো আর তাকে না আদর করে থাকা যায় না বলেন!”

রাইমার এরকম সরাসরি কথাবার্তা বলার ধরণ দেখে দিগন্ত রিতীমতো ঘামতে শুরু করেছে। এই মেয়ে এতো নির্লজ্জ কেন বাপু! দিগন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে থমথমে গলায় রাইমার বাহু ধরে নিজের কাঁধের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

“আঠাশ বছর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলে আরও আঠাশ মাসও আমি ধৈর্য ধরে থাকতে পারবো আমার অস”ভ্য বউ। কিন্তু তার আগে আমাদের মাঝে নিজেদের বোঝাপরার বিষয়টা শুরু হোক! নারীর শরীর ছুইলেই যে তাকে পাওয়া হয়ে যায় এমনটা নয়! যদি আপনার মনেই আমার স্থান দৃঢ় না হয়, শরীর ছুয়ে আমি কি করবো? শরীর তো সব পুরুষই ছোয়! মন ছুতে পারে ক’জন পুরুষ! আপনি আমায় ভালোবাসতে শেখালে, অনুভূতি গুলো যত্ন সহকারে কুড়িয়ে মনের মনি কুঠোয় তুলে রাখতে সাহায্য করলে আমি আগে আপনার মন টাই পেতে ইচ্ছুক অস”ভ্য বউ।”

দিগন্তের কথাগুলো মন ছুয়ে গেলো রাইমার। শ্রদ্ধার সহিত দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। দিগন্ত পলক ফেলে রাইমাকে দেখে শুধালো,

“কি সাহায্য করবেন?”

রাইমা মাথা হেলিয়ে বুঝালো, করবে সাহায্য। দিগন্ত মুচকি এসে আলতো ছোয়ায় রাইমাকে বুকে জড়িয়ে পরম তৃপ্তিতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। দিগন্তের বুকে মাথা রেখে রাইমা-ও ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত হলো। জার্নি করে দুজনেই ভীষণ টায়ার্ড।

১১৮,
পরদিন সকালবেলায়, সকালের খাবার দাবার সেড়ে বউভাতের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সবাই। রাইমাকেও তার রুমপ সাজানোর পর্ব চলছে। আরফান রাইমার বিছানায় বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে চকলেট খাচ্ছে আর বোনকে দেখছে। রাইমা সাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাইয়ের দিকেও তাকাচ্ছে। পার্লার থেকে মানুষ আনা হয়েছে, তারাই আপাতত সাজাচ্ছে রাইমাকে। আরফানকে এতোটা গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে রাইমা ভাইকে জিগাসা করে,

“মায়ের জন্য মন খারাপ? ”

“না আমি কয়েকদিন হলো তোর সাথে মন খুলে ঝগড়া করতে পারছিনা আপা। আমার সেজন্য মন খারাপ।”

রাইমা হেসে ফেললো ভাইয়ের উত্তরে। দুটো দিন পর থেকে যে ঝগড়া তো দূর তাক, বোনকেই কাছে পাবে না! তখন কি করবে তার ভাইটা? এটা ভেবেই রাইমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইশা ঐশী রুমেই বসা ছিলো। তারা দুজনে সোফা ছেড়ে আরফানের দুপাশে বসে আরফানের গাল টেনে বললো,

“ওরে কি কিউট রে আমাদের বেয়াই মশাই।”

আরফান বিরক্ত হলো, বললো,

“আমার গাল টানবেনা তোমরা। আমার পছন্দ নয়।”

ইশা বললো,

“দুলাভাইয়ের পারফেক্ট শালাবাবু। সবকিছুতেই দেখছি গম্ভীর।”

রাইমা ওদের খুনশুটি দেখে মৃদু হাসলো। পার্লারের মেয়ে দুটোর সাজানোয় সমস্যা হবে বুঝে চুপটি করে বসলো। তার দাদী যে কোথায় কি করছে! তার ঠিক নেই। খোজই পাওয়া যাচ্ছে না উনার। এরমাঝেই দিগন্তের বেশ কয়েকবার কাজের উছিলায় চক্কর দিয়ে রাইমাকে দেখে যাওয়া শেষ। আবার যখন দেখতে আসলে, ঐশীর চোখে তা পরতেই দৌড় দিয়ে দিগন্তের হাত ধরে রুমে আনে। হাসির ছলে বলে,

“বউকে চোখে হারাচ্ছো ভাইয়া! এই নিয়ে ৭বার আসলে দেখতে। ব্যাপার কি হুম?”

চুরি করার পর চোর ধরা পরলে চোরের যে অবস্থা হয়! দিগন্তের অবস্থাও ঠিক সেরকম। স্নেহা এসেছিলো রাইমার জন্য গহনা দিতে। সে আসতেই ঐশীর কথা তার কানে যেতেই বললো,

“কি আর করবে! ভাইটা এতোদিন পর বউ পেলো! বউকেই তো দেখছে, পরনারীকে তো নয়। থাক আর লজ্জা দিস না।”

দিগন্তের অবস্থা এখন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে সে। সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে দিগন্তের অবস্থা দেখে। দিগন্ত কথা কা”টাতে পকেট থেকে কয়েকটা চকলেট বের করে আরফানের হাতে দিতে দিতে বললো,

“আরে আমি তো আরফানকে চকলেট দিতে আসছিলাম। আম্মাকে ছেড়ে আসছে! বাচ্চাটা কাদবে হয়তো। এজন্য খেয়াল রাখছিলাম। পকেটে চকলেটও রেখেছিলাম যেনো কাঁদলেই দিতে পারি। তোমরা এমনি এমনি আমায় লজ্জা দিচ্ছো। ”

দিগন্তের উত্তর যে পুরোটাই বানোয়াট বুঝতে পারলো সকলেই। রাইমা পারছেনা সবার মাঝে হেসে দিতে। তার যে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আরফান তো হেল গরম কিছু বুঝেনা। আরও চকলেট পেয়ে খুশিমনে সে খেতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। দিগন্ত লজ্জা কমাতে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো। সে চলে যেতেই সবাই হাসিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।

চলবে?