আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-১০+১১

0
750

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১০

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। অন্তু,নিবিড়, সাগর সাদা পাঞ্জাবি পড়ে পিক তুলতে ব্যস্ত। পায়েল,রিমি দু’জনে হলুদ ও নীল রঙের জামদানি শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে, চুলের খোপায় লাল গোলাপ গেঁথেছে। বর ও কন্যা পক্ষের হলুদ অনুষ্ঠান একই সাথে হচ্ছে। কেননা রনকদের বাড়ি অর্থাৎ ইনশিতার হবু শশুর বাড়ি ঢাকাতে। তাই বান্দরবানে বিয়ের আয়োজন একসাথেই করা হয়েছে। রনক ও ইনশিতা স্টেজে বসে কথা বলতে মগ্ন। তৃপ্ততার আনন্দ দু’জনের চোখে মুখে উপচে পড়ছে। পড়বেই না কেন?দীর্ঘ তিন বছরের প্রণয়ে আবদ্ধ থাকা দু’জন যুগলের ভালোবাসা সার্থক হতে যাচ্ছে অতি শীগ্রই। চারদিকে হৈ হুল্লোড়। এতোদিন গুমোট পরিস্থিতিতে থাকা বাড়িটার কানায় কানায় আজ কোলাহলে পরিপূর্ণ। ঝুমু ও আমরিন একসাথে হলুদের ঢালা নিয়ে এসে স্টেজে রাখল। নিবিড় এক পলক চাইল আমরিনের মুখের দিকে। আমরিন নিবিড়ের দৃষ্টি বুঝলেও তোয়াক্কা করল না। কারণ সেদিন নিবিড়ও তার কোনো তোয়াক্কা করে নি। নিবিড় কে এক প্রকার অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভিতরে যেতে লাগল। মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল নিবিড়ের। দাঁতে দাঁত খিঁচে ডেকে উঠল,

‘ দাঁড়া আমরিন।’

কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই পা দু’টো আপনাআপনি থমকে গেল আমরিনের। জমে গেল সে। নিবিড় খুব বেশি নিকটে এসে দাঁড়াল। রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা চোখে ভাসতেই সূক্ষ্ম একটা ঢুক গিলল আমরিন। দৃঢ়,ভয়ার্ত স্বরে বলল,

‘ কিছু বলবেন ভাইয়া?’

‘ অনেক কিছু বলব।’- কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল নিবিড়।

নিবিড়ের রাগান্বিত কথা শুনে আমরিনের সঞ্চিত সব সাহস ফুঁশ করে উড়ে গেল। তবুও সে দমতে রাজি নয় এই ছেলের কাছে। এতো বছর একটা হুমকির ভিত্তিতে তার মনে ভালোবাসা জাগিয়ে আবার তাকে ইগনোর করবে,কষ্ট দিবে। তাহলে কেন সাড়া দিবে সে এই ছেলের ডাকে!দিবে না। একদমই দিবে না। মনে সাহস জুগিয়ে আমরিন কঠোর কন্ঠে বলল,

‘ জ্বি বলুন ভাইয়া।’

আমরিনের কঠোর কন্ঠে ধপ করে জ্বলে উঠল নিবিড়ের দু চোখ। এমনিতেই আমরিনের উপর তীব্র মেজাজ গরম ছিল তার কারণ মেয়েটা তাকে এখানে আসার পর থেকেই ইগনোর করে যাচ্ছে। এখন তো আগুনে ঘি ঢেলেই দিল। চারদিকে তাকিয়ে একটুখানি সময়ও বিলম্ব না করে আমরিনের হাত টেনে বাড়ির পিছন দিকে নিয়ে এল নিবিড়। আমরিন বিচলিত কন্ঠে মৃদু স্বরে চেঁচালো,

‘ কি করছেন?ছাড়ুন আমাকে।’

নিবিড়ের তাতে কোনো হেলদোল নেই। আমরিন কে নিজের সাথে চেপে ধরল শক্ত করে। অবাক দৃষ্টিতে নিবিড়ের মুখের দিকে তাকাল আমরিন। কোমরে জ্বলন অনুভব করতেই নিবিড় থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফটাতে লাগল । চোখ দুটোতে নেমে এল অসহায়ত্ব। নিবিড় কোমর থেকে হাত সরিয়ে হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ল আমরিনের সম্মুখে। কোমরের খালি অংশটুকু শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিল অতি যত্নসহকারে। চোখের পলক ফেলতে ভুলতে গেল আমরিন। হতভম্ব হয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল নিবিড়ের কর্মকান্ড। শাড়িটা ঠিক করে উঠে দাঁড়াল নিবিড়। আমরিন কে কাছে টেনে নিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘ এভাবে শাড়ি পড়লে কেন?’

‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই!’–থমথমে গলায় বলল আমরিন।

আমরিন বলতে দেরি করলেও তার ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠ দ্বারা আঁকড়ে ধরতে একটুও বিলম্ব করল না নিবিড়। কোমরে চাপ দিয়ে নিজের আরো কাছে টেনে আনল আমরিন কে। নিমিষেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আমরিনের দেহের সর্বাঙ্গে। মৃদু নড়ে উঠল সে। নিবিড়ের বুকে হাত দিয়ে ঠেলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে লজ্জায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। চোখ বড় বড় করে লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল নিবিড়ের দিকে।

‘ কেন করলেন এমনটা?’

নিজের ওষ্ঠযুগল হাত দিয়ে মুছে নিবিড় বাঁকা হেসে চোখ টিপে প্রতুত্তর করল,

‘ আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই! ‘

অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল আমরিন। আমরিনের কাছে এই মুহুর্তে নিবিড় কে শয়তান মনে হচ্ছে। এতো বছর ভুল মানুষ কে চিনেছিল সে। সবার চোখে ভদ্র, গম্ভীর, ইননোসেন্ট ছেলের আসল রুপ তো এতোদিন লুকায়িত ছিল। কি অসভ্য ভাবা যায়!ইচ্ছে হলেই কি কিস করা যায়! হাঁটতে থাকা নিবিড়ের পথ অবরোধ করে দাঁড়াল আমরিন। নিবিড় প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে তাকাতেই আমরিন গলার জোর বাড়িয়ে বলে উঠল,

‘ ইচ্ছে হলেই কিস করবেন?কেন করবেন?আমার ঠোঁট কি আপনার কেনা সম্পত্তি?’

মুচকি হাসল নিবিড়, যা দেখে আমরিনের হৃদয় মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। অবুঝ মনে বছর খানেক আগে উদয় হওয়া ভালোবাসা নিমিষেই অনেকখানি বেড়ে গেল সামনে স্থির ছেলেটার জন্য। নিবিড় নির্বিঘ্নে মুখের হাসি বজায় রেখে বলল,

‘ তুমি আমার কেনা সম্পত্তি নও, তবে আমার ভবিতব্য। এবং আশা করি বলতে হবে না ভালোবাসি।’

সাথে সাথেই শিষ বাজানোর আওয়াজ কানে এসে প্রতিধ্বনিত হলো দু’জনের। আওয়াজ অনুসরণ করে তাকাতেই চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে জাগল আমরিনের। পায়েল,অন্তু, সাগর,ঝুমু,আহান,রিমি একসাথে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। অন্তু শিষ বাজাতে বাজাতে তিরস্কার সুরে বলে উঠল,

‘ কিছু দেখি নি ভাই, শুধু শুনেছি ভালোবাসি। ‘

অন্তুর তিরস্কার সুর শুনে এক মুহুর্তও স্থির থাকতে পারল না আমরিন। লজ্জায়, অভিশঙ্কায় এক প্রকার ছুটে পালিয়ে গেল। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। অন্তু দাঁত কেলিয়ে নিবিড় কে প্রশ্ন করল,

‘ আদ্র জানে তো ভাই?নইলে কিন্তু বন্ধুর হাতে মারা পড়বি। বোনদের ব্যাপারে কিন্তু ভীষণ পজেসিভ।’

‘ ভালোবেসেছি বলেই অনুমতি পেয়েছি।’

নিবিড়ের কথায় উঁহু উঁহু করে উঠল সবাই। পায়েল, রিমি,সাগর, অন্তু ঝেঁকে ধরল নিবিড় কে ট্রিট দেওয়ার জন্য। নিবিড় হেয়ালি স্বরে বলে উঠল,

‘ বিয়েতে তো কব্জি ডুবিয়ে খাবি। তোদের মতো রাক্ষসদের বার বার খাওয়ানোর টাকা নাই আমার। তবে ভিক্ষা দিতে আমি মোটেও কৃপণতা করি না।’

নিবিড়ের কথা শুনে সবগুলো মিলে কিল ঘুষি দিতে লাগল পিঠে। বেচারা নিবিড় সবসময় বেঁচে বেঁচে থাকত কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এখন অন্তুর মতো কেলানি খাচ্ছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। পায়েলের ফোন বেজে উঠল শব্দ করে। স্ক্রিণে ভেসে উঠল ‘ অভিক।’ সবাই ভ্রুঁ নাচাতেই পায়েল জড়তা নিয়ে এক গাল হাসল। অন্তু সবার অলক্ষ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শব্দ করে হেসে উঠল। পায়েল কে রাগানোর মোক্ষম সুযোগ সে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। লজ্জা লজ্জা ভাব এনে বলল,

‘ উফ!তোরা এমনভাবে তাকাবি না তো। আমার খুব লজ্জা পাচ্ছে।’

হাসির রোলে মুখরিত হয়ে গেল নিস্তব্ধ জায়গাটা। পায়ে রাগে তেড়ে এল অন্তুর দিকে দ্রুত গতিতে। অন্তু কে আর পায় কে!পায়েল কাছে আসার আগেই অন্তু প্রগাঢ়পাড়। পায়েল থেমে গিয়ে হালকা হেসে অভিকের কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল। বাকি সবাই স্টেজের দিকে চলে আসল।
___________

কালো পাঞ্জাবির হাতা ফ্লোড করতে করতে আদ্র স্টেজের দিকে আসছে। সারাটাদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। আদরের বোনের বিয়েতে কোনো প্রকার ত্রুটি রাখতে চায় নি সে। তাই নিজ হাতে সবটুকু করেছে। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে,ক্লান্তি দেহে ভর করেছে প্রখরভাবে। কিন্তু শ্যামাঙ্গিনী কে চোখে চোখে রাখার জন্য সকল ক্লান্তি কাটিয়ে রেডি হয়ে এল। মেয়েটার সারাদিনের পায়চারী আজ তার চোখে পড়েছে। তাকে দেখার তৃষ্ণায় ছটফট করতে দেখে মেয়েটা কে নিজের বুকে মিশিয়ে নিতে প্রবল ইচ্ছে জেগেছিল। শত ব্যস্ততা থাকলেও ইচ্ছে করেই আজ দেখা দেয় নি আদ্র। আড়ালে দেখে গেছে মেয়েটার অস্থিরতা। অসম্ভব শান্তি অনুভব করছে আজ। চার বছরে তাকে কাছে না পাওয়ার বিষাক্ততার বিষ শ্যামাঙ্গিনী নিজেই কাটিয়ে দিয়েছে। বাগানের কাছে আসতেই পা দু’টো থমকে গেল আদ্রর। নীল বর্ণের দু’চোখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল। রক্তজবার ন্যায় টকটকে লাল চোখ দুটো একদৃষ্টিতে বাগানের এক কোণায় দুটো মানুষের উপর নিবদ্ধ।


পূর্ব নিষ্পলক চেয়ে আছে তুলির দিকে। তুলির খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও সামলে নিল । কোনো ক্রমেই আর আদ্র নামক মানুষটার কথা ভাববে না ও। আদ্র কে এড়িয়ে যাওয়া নিজের জন্য শ্রেয় মনে করল। কারণ সে তো আদ্রর যোগ্য নয় তা আদ্র নিজ মুখেই স্বীকার করেছে। এমন এক বাক্য শুনার পর তুলির প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তবুও ইনশিতার জন্য নিচে এল। কোনোভাবেই কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না সে আদ্রর জন্য দুর্বল তবে দেখা যাবে অযোগ্য বলে সরাসরি অপমান করা হবে তাঁকে। সেই ভয়ে তুলি পিছিয়ে গেল,আদ্রর মুখোমুখি না হওয়ার দৃঢ় পণ করল। মনে প্রাণে দোয়া করল আদ্রর জীবনে যোগ্য কারো আগমন হোক। কিন্তু মন!তুলির মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আদ্র কে দেখাতে ইচ্ছে করছে কষ্টগুলো। চিল্লিয়ে বলতে চাইছে মন,’দেখুন না ডাক্তার সাহেব আমি ভিতরে ভিতর মৃত্যুবরণ করছি,নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছি। দয়া করে রক্ষা করুন আমায়। ভিক্ষা দিন আপনাকে।’ পূর্বের ডাকে ভাবনার জগত হতে বেরিয়ে এল তুলি। অগোচরে কৌশলে মুছে নিল কার্ণিশে লেগে থাকা জল টুকু। গলাটা বার বার ধরে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজকাল চিৎকার করে কাঁদার সুযোগ টুকুও নেই। পূর্বের দিকে তাকিয়ে কান্নামিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,

‘ গতকাল আসেন নি যে?ভাইয়ের বিয়ে অথচ আপনি লেট।’

আলতো হাসল পূর্ব। এক হাত পিছনে নিয়ে নম্র স্বরে জবাব দিল,

‘ আসলে একটা ফ্রেন্ডের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছিলাম তাই গতকাল আসতে পারি নি। কিন্তু মনে হচ্ছে আজ এসেই ভালো করেছি। নইলে তো এক শ্যামবর্ণার ফোলা ফোলা কান্নামিশ্রিত ডাগরডাগর আখিঁদ্বয় সর্বপ্রথম দেখার চান্স টুকু আমি মিস করে যেতাম।’

তুলি বুঝতে পারে পূর্ব তার চোখের পানি দেখে ফেলেছে। তাই ঠোটের কোণে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,

‘ কাজল দিলে আমার চোখের এমন দশা হয়। আপনি,,,’

তুলি কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই একটা শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাত তার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। ভয়ার্ত চোখে পাশ ফিরতেই চোখে পড়ল আদ্র কে। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তুলির আদ্রর রক্তিম দৃষ্টি দেখে। পূর্ব আদ্রর তুলির হাতে ধরে রাখতে দেখে রাগে হাত মুঠো করে নিল। তুলি কে নিজের দিকে টেনে নিল আদ্র। পূর্বের দিকে তীক্ষ্ন নজর নিক্ষেপ করল তীর্যক কন্ঠে বলে উঠল,

‘ রিলেক্স পূর্ব। সুস্থ আছো এইটা কি বেশি নই?যে তোমার নয় তার জন্য রেগে যাওয়া নিছক। তাঁকে নিজের জন্য কল্পনা করার পূর্বে নিজের জীবন নিয়ে আগে একবার চিন্তা করে নিও, কারণ আদ্র নিজের অস্তিত্বে অন্যের উপস্থিতি অনুভব করার আগেই সমাপ্তির পাতা টেনে দিবে।’

পূর্বের চোখে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল। যা বুঝার বুঝে গেল সে। কিন্তু সে পিছাবে না। কারণ তার মন তুলি কে ভালোবেসে ফেলেছে। তুলি কে না পাওয়ার কষ্টে জর্জরিত হতে চাই না সে। আপাতত চলে যাওয়ায় সঠিক মনে হলো তার। তুলি আদ্রর কথা না বুঝলেও তার শক্তির কাছে পেরে উঠতে পারছে না। মনে পড়ে গেল আদ্রর বলা বাক্যটা। কষ্ট হলেও আদ্র তার হাত ধরে টান দিতেই চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ হাত ছাড়ুন আদ্র ভাইয়া।’

ভ্রুক্ষেপ করল না আদ্র। রাগে ক্ষোভে কষিয়ে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে তুলি কে। খুন করলেও তার এই রাগ কমবে না। কিন্তু নিজেকে কিভাবে খুন করবে সে?একটু থেমে তুলির শাড়ি ভেদ করে হাত দু’টো কোমরে চেপে ধরল। কাছে টেনে নিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,

‘ ছাড়ব না।’

তুলি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

‘ কেন ছাড়বেন না?কোন অধিকারে স্পর্শ করেছেন আমায়?আপনি আমার খালাতো ভাই। খালাতো ভাই কে এভাবে অধিকার খাটানোর অনুমতি তো আমি দেই নি।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে অসহনীয় পীড়ন হচ্ছিল তুলির। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে গেল। বহু কষ্টে চেপে রাখল ঠোঁট কামড়ে। আদ্রকে দেখাতে চায় না নিজের ভেঙেচুরে যাওয়া অনুভূতিগুলো, যারা কান্না রূপে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার ডাক্তার সাহেব কে অপমান করার অপরাধে। আদ্র ফিচেল স্বরে বলল,

‘অধিকার চাই তোমার?’

তুলি খানিকক্ষণ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে প্রশ্নটা বুঝার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখে পড়ল আদ্রর চোখের কোণে চিকচিক করা জল। পলক ঝাপটাল তুলি। সে কি ভুল দেখছে?আরেকবার দেখার আগেই আদ্র তার হাত ধরে টানতে টানতে রাদিফ সাহেবের রুমের সামনে উপস্থিত হল। বাড়ির সকল মেহমান বাহিরে স্টেজের কাছে। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম তৈরি হয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখনই ছেলেকে দেখে দাড়িয়ে পড়লেন দু’জন। বিস্মিত চোখে তাকালেন আদ্রর পিছনে থাকা তুলির দিকে। রাদিফ সাহেব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। সায়েরা বেগম এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে যাবেন, পূর্ব মুহুর্তে রাদিফ সাহেব হাত দেখিয়ে বাঁধা দিলেন। ছেলের দিকে চেয়ে আদুরে কন্ঠে বললেন,

‘ ভিতরে এসো আদ্র। কি হয়েছে?তুলির হাত কেন ধরে রেখেছো?তুলি তুই কি কিছু করেছিস প্রিন্সেস? আমার ছেলে রেগে আছে কেন?’

তুলি জড়তা-সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। জবাব দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে খালা-খালুর সামনে কল্পনা করে নি কখনো। আদ্র রাদিফ সাহেবের দিকে দৃষ্টি রেখে বিনীত স্বরে বলল,

‘ আমি তুলি কে বিয়ে করতে চাই বাবা। আশা করি জীবনে প্রথম বার আপনার নিকট কিছু চাওয়ার বিনিময়ে আপনি আমায় ফিরিয়ে দিবেন না। ‘

বাক্যগুলো ঝংকার তুলে তুলির শ্রবণগ্রন্থিতে পৌঁছাল। মুহুর্তেই থমকে গেল তুলির পৃথিবী টা। রাদিফ সাহেবের হাসিমাখা মুখটা চোখে পড়ল তার। সেই হাসি মুখ খানা উপেক্ষা করে সায়েরা বেগমের দিকে তাকিয়ে শান্ত ও স্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,

‘ কিন্তু আমি পূর্ব ভাইয়া কে বিয়ে করতে চাই খালা মণি। ‘

#চলবে,,,?

(ভুল -ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ গল্প খুবই তাড়াহুড়ায় লিখেছি। রি-চেইক করার সুযোগ হয় নি।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১১

কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে তুলির। আদ্রর হাত থেকে টুপ টুপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝড়ছে ফ্লোরে। সাদা ফ্লোরে লাল বর্ণের তরল দেখে তুলির কান্নার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। তার মনে হচ্ছে এই রক্তক্ষরণ তার হৃদয় থেকে হচ্ছে। সেদিকে অপলক চেয়ে থেকে চোখ বুঁজে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠল,

‘ কবুল।’

পরপর আরো দু’বার বলে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল তুলি। আদ্রর রক্তিম চেহারার দিকে তাকানোর সাহস আর তার নেই। অন্যায় করেছে সে। বিরাট অন্যায়। আজ তুলি উপলব্ধি করতে পারছে শুধু ভালোবাসলেই হয় না,ভালোবাসার মানুষটার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়,বুঝে নিতে হয় মানুষটার অপ্রকাশিত অনুভূতি। আফসানা বেগম মেয়ে কে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

‘ কাঁদছিস কেন আম্মু?বিয়েতে কি তোর অমত ছিল?’

তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

‘ না আম্মু। আমি নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করেছি। কিন্তু আদ্র ভাইয়া আর খালামণি তো আমাকে কখনও ক্ষমা করবে না। আমি কীভাবে ওনাদের মুখ দেখাবো?আমায় নিয়ে চলো প্লিজ। নিয়ে চলো এখান থেকে। ‘

তুলির কান্নামিশ্রিত স্বরের কথাগুলো রুমে উপস্থিত সবারই কর্ণগোচর হল। সায়েরা বেগম ধীর পায়ে হেঁটে এসে তুলির পাশে বসলেন। আফসানা বেগমের কাছ থেকে টেনে নিজের কাছে আনলেন তিনি। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। তার থেকে বেশি সারা চেহারা জুড়ে ভয় ও অনুশোচনার ছাপ। সায়েরা বেগমের বুঝতে অসুবিধা হল না অনুশোচনায়, কষ্টে ভিতর থেকে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। তিনি তুলির চোখের পানি মুছে দিলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে ঝাপটে ধরলেন নিজের সাথে। মমতার ছোঁয়া পেয়ে তুলি অশ্রু ভরা কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি খালা মণি। আমি ক্ষমার যোগ্য না। কেন তোমার বুকে জায়গা দিলে আমাকে?তবুও বলব আমায় ক্ষমা করে দাও।’

‘ তুই যা দেখেছিস,শুনেছিস তা-ই বিশ্বাস করেছিস। তোর কোনো দোষ নেই তুলি। তুই ছোট কিন্তু এটা থেকে শিক্ষা নিবি,মনে রাখবি আমরা তোকে খুব ভালোবাসি।’

সায়েরা বেগমের বুকে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল তুলি। আজ থেকে সে কারো অর্ধাঙ্গিনী। কেউ তাকে বউ বলে সম্বোধন করবে সবার কাছে। এভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটা কে নিজের করে পাবে কখনও ভাবে নি তুলি। মনের সুপ্ত কোণে সঞ্চারিত প্রণয় আজ সার্থক। কিন্তু তুলির ভয় হচ্ছে। তীব্র ভয় হচ্ছে আদ্র ক্ষমা করবে তো?

কিছুক্ষণ আগে~~

পূর্ব কে বিয়ে করার কথা বলতেই আদ্র দ্রুত গতিতে তুলির হাত টা ছেড়ে দিল। প্রচন্ড অবাক হল তুলি আচমকা আদ্র হাত ছেড়ে দেওয়াতে। আনত মস্তক তুলতেই চোখে পড়ল আদ্রর করুন চাহনি, যা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে আদ্রর হৃদয়ে সৃষ্ট হওয়া ঝড়ের বেগ। সায়েরা বেগম ছেলের চাহনি দেখে আঁতকে উঠলেন। এগিয়ে এসে তুলির দু হাত আঁকড়ে ধরে ভয়ার্ত স্বরে বললেন,

‘ কি বলছিস মা?পূর্ব কে কেন বিয়ে করবি?’

‘ কারণ আমি আদ্র ভাইয়ার অযোগ্য খালা মণি। ‘

নিচু স্বরে বলল তুলি। সায়েরা বেগমের চোখ বড় বড় হয়ে এল। তিনি অনাসয়ে বুঝতে পারলেন তুলি আদ্রর রুমে বলা কথাগুলো শুনে ফেলেছে। কিন্তু তুলি বোধহয় পুরো কথা শুনে নি। তুলি যদি পূর্ব কে বিয়ে করে তাহলে ওনার ছেলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বহু কষ্টে চার বছর আগে ছেলের মুখে এক চিলতে হাসি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ওনার। ছেলেটা ছোট থেকেই একাকীত্ব নিয়েই কাটিয়েছে। নিজেকে গম্ভীর প্রকৃতির হিসেবে প্রকাশ করেছে সর্বদা। কলেজ জীবনে একটু-আধটু সুখী হলেও তা স্থায়িত্ব হয় নি বেশিদিন। বরং নিজেকে আরো শক্ত করে গুটিয়ে নিয়েছিল আদ্র। রাগ হয়ে উঠেছিল তার চিরসঙ্গী। তার হৃদয়ে জমায়িত কষ্টের কাছে রাগের মাত্রা কম হলেও রাগ কেই প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। ভাঙতে চায় নি সে তাই তো নিজেকে গড়েছে কঠোরভাবে। পরিবার থেকে দূরে থেকেছে বছরের পর বছর। সায়েরা বেগমের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার জন্যই আদ্র পাঁচ বছর পর ফিরে এসেছে বাড়িতে একেবারের জন্য। নয়তো মাঝে মাঝে এলেও চলে যেতো। নিজের ফ্ল্যাটে আলাদাভাবে থাকত। ফ্ল্যাট টা আদ্রর দাদা আদ্রর জন্য কিনে রেখেছিলেন। তিনি আদ্র কে চোখে হারাতেন। সায়েরা বেগম তুলির দু’হাত টেনে এনে বসালেন সোফায়। পাশে বসে কোমল স্বরে বলে উঠলেন,

‘ আমার ছেলের সাথেই তোর বিয়ে হবে মা। রনকের ফ্যামিলি কে আমরা না করে দিয়েছি।’

‘ কিন্তু আমি তো গ্রাম্য মেয়ে, আদ্র ভাইয়ার অযোগ্য খালা মণি। তোমরা আদ্র ভাইয়ার জন্য যোগ্য কাউকে খুঁজে নিও।’

তুলির ছলছল নয়ন দেখে এবার সবটাই পরিষ্কার হয়ে গেল সায়েরা বেগমের। রাতে সবাই তৈরি হওয়ার সময় সায়েরা বেগম আদ্রের রুমে গিয়েছিলেন। সকাল বেলা রাদিফ সাহেবের বড় বোন মুমতাহিনা খানম বিশাল ঝামেলা করেছেন আদ্রের বিয়ে নিয়ে। উনি চাইছেন আদ্র ওনার ছোট মেয়ে রূপসা কে বিয়ে করুক। রাদিফ সাহেব রূপসা কে ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন বলে বড় বোন কে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে বেঁকে যাবে তা তিনি ভাবেন নি। তাছাড়া ছেলেকে তিনি খুব ভালোবাসেন তাই ছেলের খুশি ওনার কাছে মুখ্য। আদ্র অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় সেটা জানতে পেরেই মুৃমতাহিনা খানম ইচ্ছে মতো গালাগাল করেছে সেই মেয়েকে। বাড়ির সবাই সেই খবর না জানলেও ড্রইং রুমে যারা উপস্থিত ছিল তারা সবাই জেনেছে। আদ্র সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরেই কাজের মেয়ে রিমার কাছ থেকে সব শুনেছে। রিমা আবার আদ্র ভক্ত। বিয়ে উপলক্ষে আদ্রদের সাথে এসেছে এখানে। সব শুনে আদ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। সায়েরা বেগম ছেলের অবস্থা দেখে রিমা কে দমকে আদ্রর পিছু পিছু রুমে এলেন। রুমে এসেই হন্তদন্ত হয়ে বলতে শুরু করলেন,

‘ তুলি অযোগ্য, গ্রাম্য মেয়ে এসব আমাদের দৃষ্টিতে নয় আদ্র। তোর ফুপু আম্মা রাগের মাথায় বলে ফেলেছে। প্লিজ কোনো সিনক্রিয়েট করিস না। ইনশিতার বিয়েটা মিটে যাক। ‘

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল আদ্র। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

‘ তুলি অযোগ্য, গ্রাম্য মেয়ে। আমার জন্য পারফেক্ট নয়। কথাগুলো ফুপু আম্মার কাছে শ্রেয় মনে হলেও মেয়েটা আমার চোখে আমার নিঃশ্বাসের কারণ। কাউকে আমি আমার নিঃশ্বাস কেড়ে নেওয়ার অনুমতি দেই নি। তাকে অপমান করারও না।’

কথাগুলো বলেই আদ্র ওয়াশরুমে চলে গেল। উত্তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন সায়েরা বেগম। অর্ধেক শোনা কথা আঁকড়ে ধরে পুরোটা বিবেচনা করা একদম উচিত নয়। সায়েরা বেগম তুলি কে সবটা খুলে বললেন। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে পড়ল তুলি। পরক্ষণেই প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠল তার হৃদয়। আদ্রর রক্তাক্ত হাত দেখে চোখে টলমল করা জল গড়িয়ে পড়তে লাগল অনবরত। সায়েরা বেগমের সাথে ছুটে আসতে নিলে হাত দিয়ে থামিয়ে দিল আদ্র। মাথা নিচু রেখেই ধরা গলায় বলল,

‘ তুলির মাথার ঘোমটা টা টেনে দাও মা। বাবা কাজী সাহেব কে নিয়ে আসছেন হয়তো। ওকে একবার জিজ্ঞেস করো তো পূর্ব কে বিয়ে করতে চাই নাকি আমাকে?’

আদ্রর এমন ব্যবহার তুলি ঠিক মানতে পারছে না । আদ্র তার সাথে রাগ দেখাচ্ছে না,কিছুই বলছে না। কিন্তু আদ্রর না বলা আর্তনাদ তুলি শুনতে পাচ্ছে। নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সায়েরা বেগম কিছু বলার আগেই তুলি দ্রুত গতিতে উত্তর দিল আদ্র কে,

‘ আমি আপনাকেই বিয়ে করব।’

তখনও আদ্র মাথা তুলল না। সায়েরা বেগম ছেলের হাতের মুঠোয় থাকা ছুরি টার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছেন। নিজের রাগ দমনের জন্যই আদ্র রাগ টা নিজের উপর ঝাড়ছে। কখন যে আদ্র পাশের ঝুড়ি থেকে ছোট্ট ছুরি টা হাতে চেপে ধরেছে কেউই খেয়াল করে নি। আর করলেই কি! এতে আদ্রর রাগ তুলির উপর দিয়ে যেতো, যা আদ্র নিজেই চায় না। রাদিফ সাহেব বাহির টা সামলিয়ে তুলির বাবা-মা এবং কাজী সাহেব কে সাথে নিয়ে রুমে ঢুকল। আদ্রর হাতের দিকে চাইতেই ওনার বুক টা হাহাকার করে উঠল নিমিষেই। ছেলের বিন্দুমাত্র কষ্ট ওনার সহ্য হয় না। তাই তো আদ্রর জন্য তুলির বাবা -মার কাছে দু বছর আগেই তুলির হাত চেয়েছেন। তুলির বাবা-মা প্রথমে ভীষণ ইতস্তত করছিলেন। কেননা আদ্র তুলির থেকে বয়সে দশ-এগারো বছরের বড়। কিন্তু রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগমের অনুরোধ ফেলে দিতে ব্যর্থ হল। শেষমেশ তুলির ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে হবে বলে ঠিক করা হয়। অথচ এখন আদ্রর জেদ ও তুলির কান্নার কাছে হার মানতে বাধ্য হল সবাই। বিয়েটা হয়ে গেল একদম গোপনে। ইনশিতার বিয়ের পর অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিলেন দুই পরিবার মিলে।
_____

রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম কাজী সাহেব কে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। সাথে তৌফিক সাহেব ও বেরিয়ে গেলেন। আফসানা তুলির শাড়ি টা ঠিকঠাক করে দিয়ে মুখ মুছে তুলি কে নিয়ে বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তুলি তার মা’র হাত টা ধরে বলল,

‘তুমি যাও আম্মু। আমি একটু পর আসছি। ওনার হাত টা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে চলে আসব।’

মেয়ের কথায় মৃদু হাসলেন আফসানা। মাথায় হাত বুলিয়ে সায় জানিয়ে চলে গেল। আদ্র তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে এখনও। তুলির ভয় হচ্ছে এখন। বেশি রক্ত ঝরলে তো ক্ষতি হবে এই লোকটা কি ডাক্তার হয়ে বুঝতে পারছে না?সায়েরা বেগম ব্যান্ডেজ করতে গেলে আদ্র সাফ জানিয়েছে,

‘ আমি করে নিব মা। ইনশিতার কাছে যাও। আমি চাই না আমার বোন শূন্যতা অনুভব করুক। একটু পর আমিও চলে আসব। আর হে, বাহিরে যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ বিয়ের কথা টের না পায়।’

আদ্রর শেষ কথাটা শুনে সবাই প্রচন্ড চমকাল। হয়তো আদ্র ভালো কিছু ভেবেই এমনটা বলেছে সবাই এটাই ধরে নিল। একে একে সবাই চলে গেলে তুলি ভীত-সন্ত্রস্ত পায়ে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আদ্রর সামনে এসে বসল। কাঁপা কাঁপা হাতে আদ্রর কাটা হাত টা আলতো করে স্পর্শ করতেই মাথা তুলে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র তুলির দিকে। প্রগাঢ় সেই দৃষ্টিতে বক্ষস্থলে তীব্রভাবে কম্পন অনুভত হল তুলির। কেঁদে দিল শব্দ করে। কাঁদতে কাঁদতে আদ্রর হাতে ব্যান্ডেজ করতে লাগল। কোনো প্রকার বাঁধা দিল না আদ্র। তুলির হাত টা ধরে নিচ থেকে টেনে তুলে সোফায় বসাল। পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ থেকে ঝরে পড়া অবাধ্য জল গুলো মুছে দিতে লাগল। তুলি ভেবেই কুল পাচ্ছে না একটা মানুষ এমন কি করে হয়?তুলি মানুষ টা কে আঘাত করেছে। মানুষটার অনুভূতি গুলো উপেক্ষা করেছে,অস্বীকার করেছে,অবিশ্বাস করেছে তবুও তার
এতো যত্ন!তুলির দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আদ্র। আদ্রর রক্তিম বর্ণের চোখে তাকিয়ে তুলি অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আমায় ক্ষমা করে দিন আদ্র।’

‘ তুমি আমায় ভেঙে দিয়েছ তুলা। হাতের রক্তক্ষরণ দেখতে পেলেও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখার সক্ষমতা তুমি অর্জন করো নি। তোমার প্রতি আমার অভিযোগ নেই তাই ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। তবে আমি তোমায় স্ত্রীর অধিকার দিতে পারব না। ‘

আদ্রর গম্ভীর স্বরের কথাগুলো বিষাক্ত তীরের ন্যায় তুলির বুকের ঠিক বা পাশে গিয়ে বিঁধল। সদ্য বিবাহিতা তুলির দুনিয়া থমকে গেল আদ্রর মুখের শেষ বাক্যে। শূণ্যতায় খা খা করে উঠল হৃদপিণ্ড। কম্পিত গলায় প্রশ্ন করল,

‘ মানে?’

তুলির গালে এক হাত রাখল আদ্র। চোখে রাগের আভাস থাকলেও গলার স্বর শান্ত।

‘ এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছে তোমায় গলা টিপে মেরে ফেলি পূর্ব কে বিয়ে করতে চাওয়ার অপরাধে। পরমুহূর্তে মনে হলো আমি বাঁচতে চাই, আর বাঁচার জন্য তোমার প্রয়োজন। তাহলে তোমায় কিভাবে নিঃশেষ করি বলো?আমি তোমাকে ভালোবাসি তুলা। আমি তোমার যোগ্যতা দেখি নি বরং বহু বছর আগে তোমার মধ্যে নিজের বেঁচে থাকার কারণ দেখেছি। তুমি ভালোবাসা অনুভব করলেও বিশ্বাস করার যোগ্যতা অর্জন করো নি। যেদিন আমার ভালোবাসায় বিশ্বাসের যোগ্যতা অর্জন করবে সেদিনই স্ত্রীর মর্যাদা পাবে তুমি।এতোকাল অপেক্ষা করেছি, আরেকটু নাহয় করব।’

তুলি বুঝতে পারল আদ্রর কথাগুলোর মর্মার্থ। আজ আদ্র সঠিক। ভুল তো সে ছিল। আদ্র চলে যেতে নিলে হাত ধরে আঁটকে দিল। অস্ফুটস্বরে ডাকল,

‘ আদ্র!”

স্মিত হাসল আদ্র। তুলির হাত ছাড়িয়ে কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের মুখ বরাবর তুলে ধরল তুলির দেহ টা। উত্তাল ঢেউ গর্জে উঠলো তুলির বুকে। আলতো হেসে বলে উঠল,

‘ বাহ্!বেশ ভালো করেছেন আদ্র। আমি তো আরো ভাবছিলাম কীভাবে আপনার বরাবর হবো। একটুখানি মেয়ে আমি। যাক সুবিধা করে দিলেন ডাক্তার সাহেব। ‘

আদ্র তুলিকে আরেকটু কাছে টেনে নিল। মাদকতায় ভরপুর নীলাভ চোখ দুটো তুলির সারা মুখে বুলালো। সারা মুখ জুড়ে কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই লজ্জার ছাপ ফুটে উঠেছে। লজ্জামিশ্রিত মুখখানা আদ্রর সবটুকু রাগ নিঃশেষ করে দিল। তুলির কপালে কপাল ঠেকিয়ে দুষ্টমির স্বরে বলল,

‘ যদি ফেলে দেই?’

‘ জানি ফেলবেন না। তবে সুযোগ যখন পেয়েছি একটা কথা বলে দেই?যদি কখনও আর সুযোগ নাহয়!’

তুলির কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল আদ্র। নড়ে উঠল তুলি ভালোবাসার উষ্ম ছোঁয়ায়। পড়ে যেতে নিলে আদ্রর গলা আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। আদ্রর সম্মতি পেয়ে বুকে মুখ গুঁজে লজ্জামিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,

‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি আদ্র । ‘

#চলবে,,,!

( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)