আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-২৮+২৯

0
676

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৮

রঙিন কৃত্রিম আলোয় জ্বলজ্বল করছে আদ্র দের বাড়ির চারপাশ। কালো লেহেঙ্গা টা পড়ে তুলি বের হয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। বেশ ভারী লেহেঙ্গা টা। তুলির মনে হচ্ছে তার ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ ওজন এই অত্যাধিক সুন্দর লেহেঙ্গার।পায়েল,রিমি,আমরিন,ঝুমু সকলেই বসে বসে তুলির অপেক্ষা করছিল। তুলি বেরোতেই সবার নজর গিয়ে পড়ল তার উপর। পায়েল এগিয়ে গিয়ে হাত টেনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিল তাকে। গায়ের গহনা গুলো পড়িয়ে দিল এক এক করে। খুব হালকা মেকআপে ফুটিয়ে তুলল তুলির অন্যরকম এক সৌন্দর্য। রিমি অনেক শুনেছে শ্যামলা বর্ণের মেয়েদের সাজলে অদ্ভুত মুগ্ধতা ফুটে উঠে চেহারায়। তুলি কে না দেখলে কথাটা শুনাই থেকে যেত তার। সবাই একগাল হেসে বলে উঠল- “মাশাল্লাহ।”

তুলি লজ্জা পেল না বরং সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব অবলোকন করল এক পলক। আচ্ছা আদ্রর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তুলি কে এই রূপে দেখে?তুলির বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আজ চিরকালের জন্য আদ্রর হয়ে যাবে। সব সুখ এতো দ্রুত কেন ধরা দিচ্ছে তুলির আঁচলে?তার তো এতো সুখের লোভ নেই। শুধু একটা সুখেই আবদ্ধ থাকতে চায় তুলি, তা হলো আদ্র নামক সুখ। সকালে একবার আদ্র কে দেখেছিল। তারপর আর দেখা হয় নি। তুলির মন টা ভীষণ ছটপট করছে আদ্র কে এক পলক দেখার আকুলতায়। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে গিয়ে দেখে আসুক বর বেশে থাকা আদ্র কে। এই অপেক্ষার প্রহর সইছে না তুলির। সময় টা বেশ দীর্ঘ মনে হচ্ছে তার নিকট। সত্যিই কি সময়টা দীর্ঘ নাকি তুলির অন্তস্থলে প্রিয় মানুষের জন্য উৎপত্তি হওয়া তোলপাড়! অবশেষে অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি টানল ইনশিতা। দরজা ঠেলে বলে উঠল,

” তুলি কে নিয়ে নিচে আসো সবাই। রেজিস্ট্রির জন্য ডাকছে।”

এতো সময় অব্দি তুলির অপেক্ষা করতে কষ্ট হলেও,এই মুহুর্তে বুক টা ভীষণ ধুকপুক করছে। যেন অশনিপাত হচ্ছে বুকের মাঝে। আমরিন এগিয়ে এসে তুলি কে টেনে দাঁড় করিয়ে হাঁটা ধরল। একেকটা কদম তুলি কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চিরতরে আদ্রর কাছে।

তুলি কে বসানো হলো সাদা পর্দার একপাশে। আদ্র কে দেখার তেষ্টা ঘিরে ধরলেও মাথা তুলে তাকানোর সাহস হলো না তুলির। উপলব্ধি করতে পারছে সামনে বসা সুদর্শন যুবকের দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। শত চেষ্টা করেও মন কে আটকাতে পারল না তুলি। মাথা তুলতেই শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে গেল শীতল এক স্রোত। এ কেমন মোহনীয় দৃষ্টি!সাদা পর্দা ভেদ করে আদ্রর মাদকতাময় দৃষ্টি তুলির সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছে অদৃশ্যভাবে। দু’টো হৃদয়ে একসাথেই বয়ে যাচ্ছে ঝড়। রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দিতেই বাবা,মা,আহানের দিকে একবার তাকালো তুলি। সবার মুখে হাসির ঝলক। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলি কলম তুলে সাইন করে দিল। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। তুলির কাঁদতে ইচ্ছে করছে। স্বপ্ন লাগছে সবকিছু। মাথার উপর হাজারো তারা রা ঝলমল করছে আজ। বাগানের এক পাশ হতে এক স্নিগ্ধ হাওয়া ছুঁয়ে গেল দেহে। গুরুজনেরা চলে গেলেন বাড়ির ভিতরে। বাগানে উপস্থিত রয়ে গেল বন্ধুমহল ও আদ্রর কাজিনরা। সেই সাথে এখনও সাদা পাতলা পর্দার দু’পাশে রয়ে গেল দু’টো মানুষ।

সাদা পর্দা সরিয়ে দিল আদ্র। নত মস্তকে থাকা তুলির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। নিজের পায়ের কাছে আদ্র কে দেখে তুলি স্তম্ভিত,অতিশয় বিস্মিত। পা নাড়তে গিয়েও নাড়ল না,যদি বেসামাল আদ্রর গায়ে লেগে যায়। উপস্থিত সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দু’জনের দিকে। তুলির চিবুকে হাত রেখে মুখ টা নিজের সামনে ধরল আদ্র। নিমিষেই নীল বর্ণের চোখে ধরা দিল এক লজ্জায় রাঙা মুখ। তৃপ্তিতে চোখ বুঁজে আসল আদ্রের। ভ্রুঁ নাচিয়ে প্রশ্ন করল,

” নাম?”

হকচকিয়ে গেল তুলি। এ কেমন অদ্ভুত প্রশ্ন! তার নাম কি আদ্র জানে না?প্রগাঢ়ভাবে আদ্রর দিকে চাইতেই অদ্ভুত মুগ্ধতা খেলে গেল মনের আনাচে-কানাচে। কি সুন্দর হাসি আদ্রর ঠোঁটে!তুলি আলতো স্বরে জবাব দিল,

” ইশতাক তুলি।”

আদ্রর ঠোঁটের হাসি টা বিস্তর হলো। ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলে উঠল,

” কুমিল্লার তুলা?”

মৃদু কেঁপে উঠল তুলি। অবাক চোখে তাকালো আদ্রর মুখের দিকে। দু’ ঠোঁট প্রসারিত করে নিচু স্বরে বললো,

” আদ্রের তুলা।”

সবাই হৈচৈ করে উঠল তুলির কথায়। অন্তু তো রীতিমতো শিষ বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। তুলির পায়ে একজোড়া পায়েল পড়াতে পড়াতে আদ্র প্রশ্ন করে,

” আপনি আমার প্রাণনাশিনী হয়ে উঠেছেন তা কি আপনি জানেন কুমিল্লার তুলা?”

তুলি থমকালো কয়েক সেকেন্ড। প্রাণনাশিনী? তুলি সমীকরণ মিলাতে চাইল ঠিক কতটা ভালোবাসলে কারো প্রাণনাশিনী হওয়া যায়!
___________

বাগানের এক পাশে খাবার আয়োজন করা হয়েছে। তুলি বসেছে আহানের পাশের চেয়ারে। আজ ভাইয়ের হাতে খাবে বলে পণ করেছে মনে মনে। আহান সম্পর্কে খালাতো ভাই হলেও তুলি কে সর্বদা আপন ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে। বড় টেবিলটায় এক এক করে বসে পড়ল পায়েল,রিমি,অন্তু,নিবিড় সকলে। আদ্র কালো শেরওয়ানির হাতা গুটিয়ে বসল তুলির মুখোমুখি। আহানের হাতে তৃপ্তির সহিত খাবার খেয়ে যাচ্ছে সে। তা দেখে স্মিত হাসল আদ্র। তুলির গলায় ঘামের বিন্দু চোখে পড়তেই বড় টেবিল ফ্যান টা কে ঘুরিয়ে দিল তুলির দিকে। তুলি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চাইল। অতঃপর দেখতে পেল পায়েল,রিমি,অন্তু,নিবিড়, সাগর সবাই প্লেটে খাবার নিয়ে আদ্রর চেয়ারের পাশে গোল হয়ে বসেছে। প্রচন্ড অবাক হলো তুলি। অন্তু, পায়েল,রিমি সবাই একে একে এক লোকমা ভাত আদ্রর দিকে এগিয়ে দিল। স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে নিল আদ্র। তুলির চোখ জুড়িয়ে গেল এমন দৃশ্য দেখে। আমরিন ক্যামেরা বন্দি করে নিল মুহুর্ত টা।
তুলির কানে কানে বললো,

” জানিস ভাইয়ার বন্ধুগুলো ভাইয়াকে ভীষণ ভালোবাসে। এই মুহুর্ত টার জন্য কতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করছিল ওরা। মেডিক্যালে থাকতে ডিসাইড করেছিল যার বিয়ে হবে তার বিয়েতে পুরো বন্ধুমহল তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে। তুই তো শুধু এই দৃশ্য টা দেখছিস। একবার রিমি আপুর জ্বর হয়েছিল। সামান্য জ্বরে কি কান্না টা-ই না করেছিল সাগর ভাইয়া,পায়েল আপু,অন্তু ভাইয়া। ভাইয়া আর নিবিড় তো এক পা-ও নাড়ায় নি রিমি আপুর বাড়ি থেকে। যতদিন না রিমি আপু সুস্থ হয়েছে সবাই রিমি আপুর বাড়িতেই ছিল।”

তুলির ডাগরডাগর আখিঁদ্বয়ে খুশির অশ্রু দেখা দিল। মন থেকে দোয়া বেরিয়ে এল –” অটুট থাকুক বন্ধুত্ব।”
__________

রাত বারোটা বাজে। তুলি কে অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না ভেবে ছাদ থেকে নেমে এলো আদ্র। দরজার সামনে নিজের দূরন্ত বাজ বন্ধু বান্ধবদের দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। তৎক্ষনাৎ মৃদু হেসে বললো,

“লাভ নাই। দরজা ছেড়ে দাড়া সবগুলো।তোদের কে টাকা দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবো নাকি?ভবিষ্যতের জন্য পই পই করে টাকা জমাতে হবে। ”

নিবিড় আদ্র কে জড়িয়ে ধরে পকেটে কিছু একটা দিয়ে বাঁকা হেসে বললো,

” আমাদের তরফ থেকে মূল্যবান উপহার। ”

সন্দিহান চোখে চকিতে চাইল আদ্র। সবগুলোর মুখে মিটমিট হাসি। অন্তু দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,

” শুন আদ্র এই উপহারে আমি এক পয়সাও দেই নি। আমি এতোটাও খারাপ না। আমি তো উপহার হিসেবে উপদেশ রেখেছি তোর জন্য। ”

চোখ ছোট ছোট করে তাকাল আদ্র। অন্তু শুকনো একটা ঢোক গিলে কিছুটা পালানোর প্রস্তুতি নিয়ে বলে উঠল,

” বউ কিন্তু পিচ্চি। ডাক্তার হয়ে অবিচার করিস না। সামলে,,”

ব্যাস এতটুকুতেই থেমে গেল অন্তু। আদ্র অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পায়ের জুতা খুলে হাতে তুলে ছুঁড়ে মারল অন্তুর দিকে। তার আগেই অন্তু সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এক দৌড়ে বাহিরে। পায়েল,রিমি হাসতে হাসতে ধপ করে বসে পড়ল ফ্লোরে। নিবিড়, সাগর অল দ্যা বেস্ট জানিয়ে কেটে পড়ল পায়েল, রিমি কে নিয়ে।

বাহিরের হাসির শব্দে তুলি কান খাড়া করে রেখেছিল। দরজা খোলার শব্দে নিজেকে গুটিয়ে নিল। হুট করেই হৃদস্পন্দন কেমন দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করল। শ্বাস প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসতে লাগল ক্রমাগত। আদ্র তুলির দিকে এক নজর তাকালো। কাবার্ড থেকে একটা কালো রঙের জামদানি শাড়ি বের করে কোমল স্বরে বললো,

” লেহেঙ্গা টা তোমাকে অস্বস্তি দিচ্ছে। খুলে শাড়ি টা পড়ে আসো।”

তুলি দৃঢ় পায়ে হেঁটে এসে বিনা বাক্যে আদ্রর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল৷ দরজায় হেলান দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কয়েক সেকেন্ড। শাড়ি টা নিতেই তীব্রভাবে হাত টা কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি ছুঁয়ে দিব আদ্র। আর লজ্জায় নেতিয়ে পড়বে তুলি আদ্রর বক্ষে। কিছুক্ষণ বাদে শাড়ি পড়ে বেরোতেই সামনে একটা হাত বাড়িয়ে দিল কেউ। কর্ণকুহরে এলো,

” হাত টা আঁকড়ে ধরে তোমাকে কয়েক কদম আমার সাথে চলতে হবে বউ।”

তুলি থমকালো না। আজ বহু কষ্টে নিজেকে কিছুটা শক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে। লজ্জায় প্রতিবার দমে যায়। আজ একটুও দমতে ইচ্ছে করছে না তার। আদ্রর বুকে নিবিড়ভাবে লেপ্টে থাকার প্রবল ইচ্ছে জেগেছে মনে। নিঃসংকোচে আদ্রর হাতে হাত রাখল। মুঠোয় পুরে নিল আদ্র হাত টা শক্ত করে। সিঁড়ি বেয়ে দু’জন ছাদের দরজায় উপস্থিত হলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ল তুলি। পুরো ছাঁদে জোস্নার আলো ছড়িয়ে আছে। আকাশ জুড়ে হাজারো তারার বিচরণ। তুলির মনে পড়ে গেল আদ্র কোনো এক গভীর রাতে তাকে আকাশে তারার মেলার সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিল। ছাদের দরজা লাগিয়ে দিল আদ্র। তুলি অপলক তাকিয়ে রইল বিস্তর আকাশে। শাড়ি ভেদ করে উম্মুক্ত পেটে আকস্মিক হাতের স্পর্শ পেয়ে তুলির ভিতরে উতালপাতাল ঢেউ গর্জে উঠলো। প্রথম বার আদ্রর এতো গভীর স্পর্শে তুলির মন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। আদ্র সূক্ষ্ণ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তুলির পেটে হাতের বিচরণ গভীর করলো। ভিতর টা অস্থির হয়ে উঠছে তার। কানের পিঠে চুমু খেয়ে ফিচেল স্বরে প্রশ্ন করলো,

“ভয় পাচ্ছো?”

তুলির মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল,

” হু।”

মুহুর্তেই তুলির পেটে বিচরণ করা হাত থেমে গেল। বুক টা ধুক করে উঠল তুলির। আদ্রর আকস্মিক দূরে সরে যাওয়া মেনে নিতে পারল না। তড়িঘড়ি করে পিছু ফিরে আদ্রর বুকে মাথা রাখল। মনে সঞ্চারিত সব লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল আদ্রর বুকে। অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করল আদ্র। হৃদয়ে শীতল স্রোত অনুভব করল। বেসামাল হয়ে পড়ল মন,অনুভূতি। তুলির খালি কোমরে হাত রেখে উঁচিয়ে তুলল তুলি কে নিজের সম্মুখে। তড়িৎ বেগে কেঁপে উঠল তুলি। চক্ষুদ্বয় আদ্রর নেশাক্ত আঁখিযুগলে রাখতেই ভিতর টা এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। আদ্র গাঢ় স্বরে বলে উঠল,

” এটা কি করলে তুলা?আমার এতো বছরের অপেক্ষার ইতি টেনে দিলে। লাগামহীন করে দিলে নিয়ন্ত্রিত আমি টাকে।”

কিছু কিছু প্রহর এমন হয় নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে পার করতে হয়। তুলির মনে হাজারো কথা জমলেও গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো না। লজ্জায় আঁটকে থাকলো হৃদয় গহ্বরে। আদ্রর কপালে মুখ এগিয়ে নরম ওষ্ঠ চেপে ধরল। কোমরের বাঁধন গভীর হলো তুলির। বেসামাল স্পর্শে শিউরে উঠল দেহের সর্বাঙ্গ। আদ্রর চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে জল স্পর্শ করলো তুলির ঘাড়। তুলি চমকালো। কিছু বলার আগেই ঠোঁটে স্পর্শ পেল আদ্রর রুক্ষ অধর যুগলের। স্পর্শ গভীর হলো সময় সাপেক্ষে। তীব্র ভয়ংকর রূপ ধারণ করল অনুভূতিরা। নতুন সূচনার স্বাক্ষী হলো আকাশে তারার মেলা।

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৯

প্রভাতী কিরণের উষ্ণ আলিঙ্গনে তন্দ্রা কেটে গেল তুলির। সম্পূর্ণ রূপে উবে গেল ঘুম। কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো রুমের ডান দিকের বারান্দায়। বুঝতে পারলো রুম টা আদ্রর। হাজারো গোলাপ,জারবেরার ঘ্রাণে উৎফুল্ল হয়ে উঠল মন। কিন্তু তুলির যতটুকু মনে আছে রাতের নিকষ আঁধার কেটেছে তাদের ছাদের এক পাশে অবস্থিত ছোট্ট চিলেকোঠায়। তাহলে এখানে আসল কিভাবে?তুলি নিজের অবস্থার খেয়াল হতেই শিউরে উঠল। এই অবস্থা তেই বুঝি নিয়ে আসল আদ্র!ইশ!বড়ই বিভ্রান্ত, লজ্জাজনক বিষয়। বেশ ভালোই হয়েছে ঘুমের অতলে ডুবে গিয়েছিল সে,নয়তো সজ্ঞানে থাকলে জ্ঞান হারিয়ে বসতো। ঘাড় কাত করে পাশ ফিরে তাকাল তুলি। খালি গায়ে উপুড় হয়ে আরামে,নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আদ্র। যেনো কতকাল ধরে শান্তির ঘুম হয় না তার। আদ্রর ফর্সা পিঠের দিকে তাকিয়ে তুলির বুকটা ধুক করে উঠল। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেয়েও ছুঁয়ে দেখল না। গুটিয়ে নিল হাত। গাল দুটো লাল আভায় ছেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রাতের আঁধার যেমন তেমন,কিন্তু এই মুহুর্তে আদ্রর সামনে এমতাবস্থায় থাকা তুলির জন্য কষ্টসাধ্য। উঠতে গিয়ে অনুভব করল সারা শরীর ব্যাথায় ম্যাজম্যাজ করছে। টুকটুকে লাল রঙের একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল দ্রুত। প্রায় আধাঘন্টা সময় ব্যয় করে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো। তখনও ঘুমোচ্ছে আদ্র। তুলি চুল মুছে চুপটি করে এসে বসে পড়ল বিছানার এক কোণায়। বাহিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে মন কিন্তু লজ্জায় -সংকোচে তুলি ঘাপটি মেরে বসে রইল।

আদ্র একটু নড়েচড়ে উঠল। ঘুম হালকা হয়ে এলো তার। তুলি কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকালো। পরক্ষণেই গভীর অনুভূতিতে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল লাল টুকটুকে বেশে থাকা তুলির স্নিগ্ধ চেহারা দেখে। পাশে কিছু নড়বার আওয়াজে তুলির ধ্যান ভঙ্গ হলো। দৃষ্টি তাক করল আদ্রর দিকে। আধশোয়া অবস্থায় আদ্র পলকহীন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি কেমন নেশাগ্রস্ত। তুলি শুকনো ঢোক গিলল। রাতের কথা মনে পড়তেই বক্ষস্থলে সমুদ্রের ঢেউ ন্যায় উতালপাতাল শুরু হলো। পড়নের শাড়িটা দু’হাতে খামচে ধরল। চোখে চোখ রাখা যে দায় হয়ে পড়েছে। তুলির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসল আদ্র। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যেতে নিয়েও কদম পিছিয়ে আনল। আদ্র আয়নার দিকে নজর নিবদ্ধ করতেই তুলির অন্তরআত্মা কেঁপে উঠল। গাল দুটো গরম হয়ে এলো নিমিষেই। ধরা পড়ার ভয়ে ঝটপট দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরে নিক্ষেপ করল। আঁড়চোখে সবটাই পর্যবেক্ষণ করলো আদ্র। দুষ্টমির স্বরে তুলি কে শুনিয়ে বলে উঠল,

” নখ গুলো কেটে দিয়েও বিশেষ লাভ হয় নি।”

কথাটা হুর হুর করে তুলির কর্ণকুহরে প্রবেশ করে হৃদয়ে গিয়ে কম্পন সৃষ্ট করল। তুলির মনে হলো কেউ তার কানে জ্বলন্ত কয়লা ঢেলে দিয়েছে। এতো অসভ্য কেউ হয়?কি করে এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে একটা মানুষ? তুলি শুনেছিল পুরুষ মানুষের নাকি লজ্জা নেই। তা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে আদ্র কে দিয়ে। প্রথম দেখার গম্ভীর আদ্রর সাথে এই আদ্রর কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না তুলি। এই আদ্র চরম অসভ্য। তুলির কলিজা টা এখন থেকেই মোচড় দিয়ে উঠছে না জানি কখন আবার কেমন অসভ্য কথা বলে বসে আদ্র!

ফ্রেশ হয়ে এসে তুলির দিকে না তাকিয়েই রুম থেকে বের হয়ে এলো আদ্র। ড্রইং রুমের ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখল সাতটা বাজে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ,নিরব। বিয়ের আয়োজনে ক্লান্ত সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রান্নাঘর থেকে হালকা আওয়াজ আসছে। সেদিকেই পা বাড়াল আদ্র। সায়েরা বেগম কাজের মেয়ে টা কে সাথে নিয়ে সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছেন। দরজার কাছ থেকেই আদ্র বলে উঠল,

” এক কাপ কফি,এক কাপ চা হবে মা?”

” শত কাপ হবে আমার ছেলে ও ছেলের বউয়ের জন্য। ”

হাসিমুখে জবাব দিলেন সায়েরা বেগম। আদ্র দরজা ছেড়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। হেসে বললো,

” তাহলে শত কাপ-ই দাও।”

এতগুলো বছর ছেলেকে নিজের সাথে এতো ফুরফুরে মনে কথা বলতে দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। তিনি কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলেন,

” তুলি উঠেছে আদ্র?”

” হ্যাঁ। ”

প্লেট এনে নাস্তাও সাজিয়ে দিলেন তিনি। ট্রে তে সব তুলে দিয়ে আদ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আদ্র তুলির জন্য নাস্তা নিতেই এসেছিল। তুলির যা লাজুক স্বভাব আজকে নাস্তার জন্য নিচে আনলে লজ্জায় চুপসে যেত মেয়েটা। তাছাড়া রাতেও ঠিকঠাক খায় নি। মা মনের কথা বুঝে যাবে কল্পনাও করে নি আদ্র। ট্রে টা হাতে নিয়ে বললো,

” থ্যাংকস মা।”

” ইতি ভালো মেয়ে ছিল না আদ্র। আমি জাস্ট ওকে,,”

আদ্রর পা থেমে গেল। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

” আমি জানি মা। ও আমাদের সবার মনে আঘাত করেছে। ওর আসল রূপটা দেখিয়ে তুমি আমাদের জন্য ভালোই করেছো।”

সায়েরা বেগম আমতাআমতা করে বললেন,

” তুই কি এখনও অভিমান করে আছিস আমার সাথে?”

” ছিল এখন নেই। অভিমান করাটা কি সঠিক ছিল না মা?ছোট থেকেই আমি তোমার বাধ্য ছিলাম। জীবনের ছোট থেকে ছোট কথাটাও তোমার সাথে শেয়ার করেছি। তাহলে ইতির ক্ষেত্রে কেন তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারলে না?তুলি কে তোমার পছন্দ ছিল আমার জন্য সেটা আমাকে আগে বললেই পারতে, আমার উপর বিশ্বাস রাখলেই পারতে। তোমার ছেলে এতোটাও দুর্বল প্রকৃতির ছিল না যে কেউ ভালোবাসি বললো আর তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। আমার অভিমান ছিল একটা কারণেই, আমার মা আমার প্রতি, আমার মনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারে নি। ”

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো আদ্রর। মা কে ভীষণ ভালোবাসে সে। সায়েরা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের জল মুছতে লাগলেন। মায়ের চোখের পানি দেখে বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো। হাতের ট্রে টা রেখে মা’কে জড়িয়ে ধরল আলতো করে। ছেলের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন সায়েরা বেগম। আদ্র স্মিত হেসে বললো,

” বুঝলে মা,তোমরা নারী জাতি খুবই দুর্বল প্রকৃতির। কারণে অকারণে সমুদ্র বানিয়ে ফেলো চোখ দুটো কে। তোমার ছেলের বউ টাও ঠিক তোমার মতো হয়েছে, অল্পতেই কান্নাকাটি। মা!তুমি ইচ্ছে করে তোমার মতো ছিচকাদুনে তুলি কে আমার জন্য মিলিয়ে আনো নি তো?আমি কিভাবে সামলাবো এতো ছিচকাদুনে!”

আদ্রর কথা শুনে সায়েরা বেগম হেসে উঠলেন। একটু উঁচু হয়ে গাট্টা মারলেন আদ্রর মাথায়। আদ্র যেতে যেতে বলে উঠল,

” কাঁদবেন না মিসেস সায়েরা বেগম, আপনার অশ্রু যুগল আঁখির জল মুছে দেওয়ার জন্য আপনার সাহেব কে পাঠিয়ে দিব। ”

হু হু করে হেঁসে উঠলো কাজের মেয়েটা। সায়েরা বেগমও মুখ লুকিয়ে হাসলেন ছেলের কান্ডে।
_______

আদ্রের মোবাইলটা হাতে নিয়ে লক খোলার চেষ্টা করছে তুলি। বোরিং লাগছে একা একা। পাসওয়ার্ড কি হতে পারে ভাবতে লাগল। দরজা খোলার শব্দ পাওয়া মাত্র ধরাস করে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। চোখ বড় বড় করে হাতে থাকা মোবাইল টা পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। যদি আদ্র বিনা অনুমতিতে মোবাইল ধরার জন্য রেগে যায়!ভয়ে ধুক ধুক করতে লাগল অন্তর টা। আদ্রর কোনো প্রকার রিয়েক্ট না দেখে নিজেকে বুঝ দিল আদ্র দেখে নি। টি টেবিল টা টেনে তুলির পাশে রাখল আদ্র। খাবারের প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,

” খারাপ লাগছে?”

থতমত খেয়ে গেল তুলি। খারাপ বলতে কেমন খারাপ বুঝালো আদ্র?কি উত্তর দিবে প্রশ্নই তো বুঝলো না। আদ্রর চুলে ছোট ছোট পানি বিন্দু। ফর্সা মুখ টা আজ আরও ফর্সা লাগছে। কিছু টা চুপি চুপি কৌশলে নিজের হাত টা আদ্রর হাতের কাছে নিল। মনোক্ষুণ্ণ হলো তার। কেন আদ্রর মতো ফর্সা হতে পারলো না?তার থেকেও তিন শেড ফর্সা আদ্র।

” সৌন্দর্যের মাপামাপি শেষ হলে বলো তোমার শরীর কেমন লাগছে?”

বিস্ফোরিত নয়নে আদ্রর দিকে তাকালো। আদ্র তো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল,কিভাবে বুঝল সৌন্দর্য পরখ করছিল তুলি!আর শরীরের অবস্থা মানে!তুলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রতুত্তরে বললো,

” ভা,,ভালো।”

“মন ভালো আছে?”

” হুম।”

” রুমটা ভালো লাগছে?”

“হুম। ”

” আমাকে ভালো লাগছে? ”

” হুম।”

” শরীরে ব্যাথা করছে? ”

“হু,,।”

বলতে গিয়েও দু’হাতে মুখ চেপে ধরল তুলি। বুঝতে পারল আদ্র কৌশলে কথা বাহির করার জন্য এমনটা করেছে। ছি!তুলি নিজেকে বোকা বলে হাজারো গালাগাল দিতে লাগলো। মুচকি হাসল আদ্র। খাবার খাইয়ে দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধ বের করে তুলির হাতে ধরিয়ে দিল। প্রশ্ন সূচক ভঙ্গিতে চাইতেই বললো,

” পেইন কিলার।”

তুলির এই মুহুর্তে কোথাও মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে। কেন বিয়ে বসল সে!কষ্ট হচ্ছে,কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।বিয়ে না বসলে তো এতো লজ্জা পেতে হতো না। কে জানতে বিয়ের পর আদ্র এতো বেহায়া হবে!কেমন করে লজ্জা দিয়েই চলেছে। খেয়ে এক পলকও তাকালো না আদ্রর দিকে। উঠে বেলকনিতে চলে এলো। বিড়বিড় করে বলে উঠল,

” সাংঘাতিক লোক। ”

পেছন থেকে ঝাপটে ধরল আদ্র। শাড়ির নিচ দিয়ে পেটে হাত রেখে ঘাড়ে উষ্ম ছোঁয়া একে দিতে লাগলো। চোখ বুঁজে নিল তুলি। হুট করেই নিঃশ্বাস ফেলা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কর্ণে ভেসে এলো আদ্রর ফিচেল স্বর।

” তুমি লজ্জাবতী,সর্বনাশীনি,
তুমি হাজারো তারার ঝলমলে রূপ,
তুমি আমার এমনই অসুখ,
যা আমার হৃদয়ে চিরকাল বাসা বাঁধুক। ”

তুলির চোখের কার্ণিশে জল জমে গেল। আদ্রর মুখের বাক্য গুলো হৃদয়পটে গেঁথে বসলো। পকেট থেকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল আদ্র তুলির সামনে। পেটে এক হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে উঠল,

” টাইপ তুলা।”

অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করল তুলি ঘাড় ঘুরিয়ে। হাতে নিয়ে টাইপ করতেই সত্যিই লক খুলে গেল। হোম স্ক্রিণে ভাসছে এক শুভ্রতায় মোড়ানো মেয়ের ছবি,যে বসে বসে শিউলি কুড়চ্ছে। ইশ!আদ্র তখন মোবাইল হাতে দেখে ফেলেছিল। একটু লজ্জা অনুভূত হলো তুলির। মোবাইলটা বাড়িয়ে দিতেই কল এলো। সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করে তুলি কে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেই রিসিভ করলো আদ্র। ওপাশ থেকে কি বললো কিছুই শুনতে পেল না তুলি। তবে আদ্রর বলা কথাটা স্পষ্ট কানে এলো।

” এখনই আসছি আমি।”

দূরত্ব অনুভব করতেই তুলির মন টা হাহাকার করে উঠল। সামান্য দূরত্ব টুকুও তুলির মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দেয়। ইচ্ছে হয় সারাজীবন আদ্রর ভালোবাসায় ডুবে থাকুক। রুমে এসে দেখল আদ্র রেডি হচ্ছে। তুলি তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,

” কোথাও যাচ্ছেন?”

” হ্যাঁ। একটা জরুরি ওটি আছে। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় ছুটি নেওয়া হয় নি। ছুটির জন্য এপ্লিকেশন দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আজ হয়ে যাবে।”

তুলির কপালে গভীর একটা চুমু খেল আদ্র। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তুলি কে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। এক সেকেন্ডও নষ্ট করে নি তুলি। দৌড়ে গিয়ে আদ্র কে ঝাপটে ধরে বললো,

” তাড়াতাড়ি আসবেন ডাক্তার সাহেব। ”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)